সাত দিনের অতিবৃষ্টির পরেও কৃষ্ণ ব্রজবাসীদের সম্পূর্ণ সুরক্ষা দিতে সমর্থ হলেন, ইন্দ্র তখন হার মানলেন এবং আকাশ-বাতাস পুনরায় নির্মল হল। এইরকম পরিস্থিতিতে বৃন্দাবনের গোপবৃদ্ধরা সকলকে নিয়ে কৃষ্ণের কাছে উপস্থিত হলেন তাদের আন্তরিক কৃতজ্ঞতা জানাতে। তাদের কৃতজ্ঞতার ভাষাটা এইরকম তোমাকে আমাদের মাঝখানে পেয়ে আমরা ধন্য বোধ করছি, কৃষ্ণ! তুমি তোমার ব্যবহার এবং নীতিকুশলতায় আমাদের সবাইকে বড় বাঁচিয়েছ– ধন্যা স্নোনুগৃহীতা স্মঃ তৃবৃত্তেন নয়েন চ।
দেখুন, আমি আগে অনেকবার বলেছি যে, দু-একটা অসুর-বধ অথবা আক্ষরিক অর্থে গোবর্ধন পাহাড়কে আঙুলে ধারণ করার কথাটা কাহিনী হিসেবেই থাকুক, আসল কিন্তু কৃষ্ণের নীতি-কুশলতা। নীতি বা নয় শব্দটা রাজনৈতিক প্রজ্ঞার অর্থে প্রাচীনেরা ব্যবহার করেছেন। অত দুটি রাজনীতি-গ্রন্থ নীতি নামেই পরিচিত, যেমন কামন্দকীয় নীতি অথবা শুক্রনীতি। সে যাই হোক, ব্রজবাসীদের সুখ-দুঃখে কৃষ্ণের আন্তরিক ব্যবহার এবং তাঁর নীতিজ্ঞতা–যে দুটি তাকে ভবিষ্যতের শ্রেষ্ঠ রাজনীতিজ্ঞে পরিণত করবে–সেই ব্যবহার আর নীতিজ্ঞতাই বৃন্দাবনের সরল মাটিতে তাকে অনন্যসাধারণ ব্যক্তিত্বে পরিণত করেছে। আমরা আগেই বলেছি–কৃষ্ণ এখন সকলের ভরণ-পোষণ করেন এমন এক ভর্তা হিসেবে পরিচিত। মর্যাদা এবং প্রিয়ত্বের সম্বন্ধে এখন তিনি সকলের কাছে ভর্তা দামোদর নামে পরিচিত।
গয়লাদের মোড়ল গোপবৃদ্ধেরা কৃষ্ণকে সামনে রেখে বলল–আমাদের গোরুগুলো সব ভীষণ বর্ষার ভয় থেকে বেঁচে গেছে, বেঁচে গেছি আমরা সকলেই–গাবো বর্ষভয়াত্তীর্ণা বয়ং তীর্ণা মহাভয়াৎ। তোমার সমস্ত কাজই আমাদের কাছে অলৌকিক ঠেকছে। গোবর্ধন পর্বতকে ধারণ করে যেভাবে তুমি আমাদের সুরক্ষা দিয়েছ, তাতে বারবার এটা মনে হচ্ছে তুমি মানুষ নও দেবতা–বিদ্মঃ ত্বাং কৃষ্ণ দৈবত। তুমি সাক্ষাৎ রুদ্রও হতে পার, হতে পার দেবপ্রতিম অষ্ট বসুর মধ্যে একজন, কিন্তু মানুষ বসুদেব তোমার বাবা হলেন কী করে, সে কথা ভেবে আমরা অবাক হচ্ছি–কিমর্থঞ্চ বসুদেবঃ পিতা তব।
গোপবৃদ্ধদের শেষ মন্তব্যটি ভীষণভাবে প্রণিধানযোগ্য। পণ্ডিতজনে কেউ কেউ বলেছেন যে, এখানে বসুদেব মানে কৃষ্ণের পালক-পিতা নন্দকে বুঝতে হবে। কেননা ব্রজবাসীরা তখন পর্যন্ত বসুদেবকে কৃষ্ণের পিতা বলে জানতেনই না। আমাদের মনে হয়, কথাটা মেনে নেওয়াই ভাল, কারণ সহজভাবে দেখতে গেলে সত্যিই ব্রজবাসীরা কৃষ্ণকে তো বসুদেবের পুত্র বলে জানতেন না। তাও না হয় মানা গেল যে, বসুদেব বলতে এখানে নন্দকে বুঝতে হবে। কিন্তু ব্রজবাসীদের ভাষা থেকে বোঝা যাচ্ছে যে, কৃষ্ণকে তাঁরা নন্দের পুত্র বলতে এখন শঙ্কিত হচ্ছেন। সহজ সরল গোপরাজ নন্দের ঘরে এমন কালজ্ঞ, ব্যবহারজ্ঞ তথা নীতিনিপুণ ব্যক্তির জন্ম যে অস্বাভাবিক, এটা কিন্তু ব্রজ-বৃদ্ধরা বিশ্বাস করতে আরম্ভ করেছেন। তাঁরা বলেছেন–বাল্যকালেই তোমার এই অসম্ভব ক্রিয়া-কর্ম আমাদের স্তম্ভিত করে দিয়েছে। তোমার এই অলৌকিক, অতিমানুষিক শক্তি-নিপুণতা দেখে আমাদের মনে বড় শঙ্কা হচ্ছে–শঙ্কিতানি মনাংসি নঃ। বারবার কেবলই মনে হচ্ছে–এমন অসম্ভব ক্ষমতা থাকা সত্ত্বেও কেন তুমি আমাদের মধ্যে এমন গয়লার বেশে ঘুরে বেড়াচ্ছ–কিমর্থং গোপবেশেন রমসেম্মাসু গর্হিত? এক গয়লার বাড়িতে তুমি গাই দুইয়ে বেড়াচ্ছ, গোরু চরাচ্ছ, গো-রক্ষণ করছ–এসব যে নিতান্ত গর্হিত কাজ। তোমার মতো এমন বিরাট মানুষের পক্ষে আমাদের বাড়িতে জন্ম নেওয়াটাই নিতান্ত অন্যায়-জন্ম চাম্মাসু গহিত।
আসলে কৃষ্ণের মতো এক বিরাট-ব্যক্তিত্ব যে সাধারণ গয়লার ঘরে জন্মাতে পারেন না–এ বিষয়টা এখন ব্রজবাসীদের হৃদয় আন্দোলিত করছে। অন্যদিকে এতকাল একত্র সহবাসের ফলে কৃষ্ণের প্রতি প্রত্যেক ব্রজবাসীর যে সহজ সম্বন্ধ গড়ে উঠেছে সে সম্বন্ধও তারা ভাঙতে চায় না। তারা বলে–তুমি দেবতা-দানব, যক্ষ-গন্ধর্ব যাই হও না কেন, তুমি আমাদের আত্মীয়-বন্ধু হয়ে জন্মেছ। আমাদের উপকার সাধন করার জন্য তুমি আমাদের নমস্কার গ্রহণ করো, কিন্তু সবার ওপরে তুমি আমাদের আত্মীয়-বন্ধু বটে–অস্মাকং বান্ধবো জাতো যোসি সোসি নমোস্তু তে।
আমরা জানি, এইরকম একটা মন্তব্যের পরিসরে চৈতন্যপন্থী বৈষ্ণবেরা কী অপূর্ব সরসতা সৃষ্টি করতে পারতেন। ব্রজবাসীজনে কৃষ্ণের সহজ পীরিতী–এই সরসতা দিয়ে শুরু করে রূপ-গোস্বামী কথিত বাৎসল্য-সখ্য-মধুরের দার্শনিক রসবত্তা প্রতিষ্ঠিত হতে পারত শুধু এই কটি মন্তব্যকে উপজীব্য করেই। কিন্তু আমরা এখানে দার্শনিক তর্ক-যুক্তি নিয়ে মাথা ঘামাব না। আমরা মহাভারতের কৃষ্ণের সঙ্গে বৃন্দাবনের কৃষ্ণাকে মিলিয়ে দিতে চাই এবং তা করতে গেলে কৃষ্ণকে মথুরাবাসী কংসের সঙ্গে যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত করতে হবে আমাদের।
ঐতিহাসিক দৃষ্টিতে গোপবৃদ্ধদের মন্তব্যগুলি এইজন্য গুরুত্বপূর্ণ যে কৃষ্ণ তাঁর আইডেনটিটি আর লুকিয়ে রাখতে পারছেন না। গোপজনেরা আর তাকে নন্দরাজার পুত্র বলে মেনে নিতে পারছে না। এমনকি পূর্বোক্ত শ্লোকে বসুদেব অর্থেই ধরি, তাহলে ঐতিহাসিক দৃষ্টিতে আমাদের আরও বেশি সুবিধে হয়। মনে রাখা দরকার, একের পুত্র যদি জন্ম থেকেও অন্যে পালন করে, তবে স্বাভাবিকভাবেই সেই পুত্রের পরিচয় গোপন রাখা কঠিন। তার ওপরে বসুদেব মথুরা নগরে এক অতি গণ্যমান্য ব্যক্তি। কৃষ্ণ যে বসুদেবের পুত্র সে কথা মথুরার অত্যাচারী রাজা কংস ভালভাবেই জানেন এবং কৃষ্ণকে হত্যা করার জন্য তিনি নানা চক্রান্তও এর মধ্যে করেছেন। তার চক্রান্তগুলি ব্যর্থ হলেও মানতেই হবে যে, কৃষ্ণের পরিচয় আর এখন অজ্ঞাত নেই। কাজেই এমন হতেই পারে যে, ব্রজবাসীরা কৃষ্ণকে বসুদেবের পুত্র বলেই জেনে গেছে। কিন্তু কৃষ্ণের প্রভাব-প্রতিপত্তি এবং নীতিনিপুণতা এতটাই উচ্চস্তরের যে, কৃষ্ণকে এখন মানুষ-বসুদেবের পুত্র বলতেও ব্রজবাসীরা নারাজ। তারা এখন তাকে দেবতার মর্যাদায় দেখে–তবে প্রসাদাদ গোকিদ দেবতুল্যপরাক্রম।