এই নিমসর, নিমখারবন বা নৈমিষারণ্যেই কুলপতি শৌনকের বারো বচ্ছরের যজ্ঞ-প্রক্রিয়া আরম্ভ হয়েছে। কম কথা তো নয়। এক একটি বিশেষ বৈদিক ক্রিয়াকলাপের জন্য একাধিক মুনি-ঋষি-ব্রাহ্মণ নিযুক্ত হয়েছেন। দিনভর ঋক-মন্ত্রের উচ্চারণ, সামগান, যজ্ঞ-হোম, অগ্নি-সমিন্ধন, সোম-রস-নিষ্কাসন, আহুতি– এত সব চলছে। প্রতিদিনের অভ্যস্ত প্রক্রিয়ায় শান্ত-সমাহিত ঋষিরাও হাঁপিয়ে ওঠেন। তার ওপরে নিজেদের বিশেষ বৈদিক কর্মটি সাঙ্গ হওয়ার পর তাঁদের অবসরও জুটে যায় অনেক। তবু তো তখন অন্য মুনি-ঋষিদের সঙ্গে গল্প জোড়া চলে না। কেন না, একজনের কাজ শেষ হলে অন্যজনের বৈদিক ক্রিয়া-কলাপ আরম্ভ হয়।
তবে হ্যাঁ, দৈনন্দিন যজ্ঞক্রিয়ার পৌনঃপুনিকতা, ঋষিদের একঘেয়েমি অথবা তাঁদের অবসরের কথাগুলি মহাভারতে লেখা নেই। মহাভারতের কবির এসব কথা লেখা চলে না। মহাকাব্যের আরম্ভে তিনি শুধু জয়-শ্লোকটি উচ্চারণ করেই লিখে ফেলেছেন–বারো বচ্ছরের চলমান যজ্ঞ-ক্রিয়ার মধ্যেই এক পৌরাণিক এসে উপস্থিত হয়েছেন নৈমিষারণ্যে, শৌনকের তপোবনে। যে সে পৌরাণিক নন, একেবারে পৌরাণিকোত্তম লোমহর্ষণের পুত্ৰ উগ্রশ্রবা।
সেকালে লোমহর্ষণের মতো কথক ঠাকুর দ্বিতীয় ছিলেন না। জাতের বিচারে তিনি বামুনদের থেকে সামান্য খাটো, কেন না তাঁর জন্ম হয়েছিল বামুন-মায়ের গর্ভে কিন্তু তাঁর বাবা ক্ষত্রিয়। ক্ষত্রিয় কুলের যুদ্ধ-গৌরব আর বামুন-মায়ের শুদ্ধশীল বৈদিক ব্রাহ্মণ্য-ভাবনা এই সংকর-জন্মা ছেলেটির মনে এমন এক মিশ্ৰক্ৰিয়া তৈরি করেছিল যে, সে শুধু গল্প বলাই শিখেছে, গল্প বলাই তার প্রথম প্রেম। ক্ষত্রিয় হয়েও যার বাবা বামুনের ঘরের মেয়েকে ভালবেসে ফেলেছিল, সেই ভালবাসার মধ্যেও গল্প ছিল, স্বপ্ন ছিল। গল্প আর স্বপ্নের মিলনেই সূত-জাতির জন্ম। লোমহর্ষণ সেই সূত-জাতির লোক।
সূতজাতি নাকি ভারতের প্রথম বর্ণসংকর। শোনা যায় রাজা পৃথু, যাঁর নামে এই পৃথিবী শব্দটি, সেই পৃথুর যজ্ঞে দেবতাদের গুরু বৃহস্পতির জন্য যে ঘৃতাহুতি প্রস্তুত করা হয়েছিল, সেই ঘিয়ের সঙ্গে দেবরাজ ইন্দ্রের ঘৃতাহুতি মিশে যায়। এদিকে আহুতি দেওয়ার সময় বৃহস্পতির ঘৃতাহুতি হাতে নিয়ে ইন্দ্রের উদ্দেশে মন্ত্র উচ্চারিত হয়। ইন্দ্র হলেন দেবতাদের রাজা, ক্ষত্রিয়ত্বই রাজার সংজ্ঞা। ফল যা হওয়ার তাই হল, এই হবির্মিশ্রণের ঘটনা থেকেই সূত জাতির উৎপত্তি। পৃথিবীর প্রথম বর্ণসংকর–সূত্যায়ামভবৎ সূতঃ প্রথমং বর্ণবৈকৃতম্। ক্ষত্রিয় পিতার ঔরসে ব্রাহ্মণ-কন্যার গর্ভে তাঁর জন্ম। রাজাদের সারথিবৃত্তি অথবা তাঁদের মন্ত্রিসভায় একজন মাননীয় মন্ত্রী হওয়াটা তাঁর কাছে মুখ্য কোনও কাজ নয়। তার প্রধান কাজ- রাজা, মুনি-ঋষিদের বংশগৌরব কীর্তন করা, সৃষ্টি-প্রলয়-মন্বন্তরের বিচিত্র কথা শোনানো। আর ঠিক এই কাজেই সূত লোমহর্ষণের ভারত-জোড়া নাম।
লোমহর্ষণের আসল নাম কী ছিল, তাও বোধহয় সবাই ভুলে গেছে। তাঁর কথকতা, গল্প বলার ঢঙ ছিল এমনই উঁচু মানের যে তাঁর কথকতার আসরে শ্রোতাদের গায়ের লোম খুশিতে খাড়া হয়ে উঠত। তাই তাঁর নামই হয়ে গেল লোমহর্ষণ। লোমানি হর্ষয়াঞ্চক্রে শ্রোতৃণাং যঃ সুভাষিতৈঃ। স্বয়ং ব্যাসের তিনি প্রিয় শিষ্য। ব্যাস মহাকাব্য লিখেছেন, অষ্টাদশ পুরাণ লিখেছেন। তিনি লেখক–লেখার ‘অডিও-এফেক্ট’ তাঁর ভাল জানা নেই। যেদিন তিনি দেখলেন–তাঁরই লেখা জমিয়ে গল্প করে যে মানুষ শ্রোতাদের লোম খাড়া করে দিতে পারেন, সেদিনই বোধহয় তিনি এই সূতজাতীয় মেধাবী মানুষটির নাম দিয়েছিলেন লোমহর্ষণ এবং তাঁকে শিষ্যত্ব বরণ করে তাঁর মহাকাব্যের রসে দীক্ষা দিয়েছিলেন- শিষ্যো বভুব মেধাবী ত্রিষু লোকেষু বিশ্রুতঃ।
সেই লোমহর্ষণের ছেলে এসে উপস্থিত হয়েছেন শৌনকের আশ্রমে। উগ্রশ্রবা তাঁর নাম। কথকতায় লোম খাড়া করার ক্ষমতা তাঁরও আছে। লোকে তাঁকে যত না উগ্রশ্রবা নামে জানে, তার থেকে বেশি জানে–সে বাপকা বেটা– অর্থাৎ ভাবটা এই– আরে ও হচ্ছে লোমহর্ষণের ছেলে লৌমহর্ষণি, সূতের ছেলে সৌতি। আসলে লোমহর্ষণের কথকতা শুনলে যেমন শ্রোতার লোম খাড়া হয়ে ওঠে, তেমনই তাঁর ছেলেরও সেই ক্ষমতা আছে। এই জন্যই তাঁকে সবাই– লোমহর্ষণি বলেই বেশি ডাকে। মহাভারত তাই বলেছে– লোমহর্ষণপুত্রঃ উগ্রশ্রবাঃ সৌতিঃ। বাপের সুবাদে উগ্রশ্রবা সৌতিও ব্যাসের সঙ্গ পেয়েছেন। ব্যাসশিষ্য বৈশম্পায়নের তিনি বড় স্নেহভাজন।
লৌমহর্ষণ উগ্রশ্রবা যখন শৌনকের আশ্রমে এসে উপস্থিত হয়েছেন, তখন হয়তো সূর্য অস্ত গেছে। সারাদিন যজ্ঞক্রিয়ার পর তখন ঋষিদের অনন্ত অবসর। সবাই একসঙ্গে বসে আছেন, কথা দিয়ে কথা বাড়াচ্ছেন। ব্রহ্মচারী বালকেরা সমিৎ কুড়িয়ে বাড়ি ফিরে এসেছে। এই অবসর আর প্রশান্তির মধ্যেই লৌমহর্ষণি উগ্রশ্রবা তপোবনে প্রবেশ করেছেন।
লৌমহর্ষণিকে দেখে ঋষি-মুনিরা সব একেবারে হই-হই করে উঠলেন। সবাই মনে মনে একেবারে হাঁপ ছেড়ে বাঁচলেন। অনন্ত অবসর, অথচ বৃথা কাল না যায়– কেন হ্যবসরঃ কালো যাপনীয়ো বৃথা ন হি–কথক ঠাকুরের আগমন এই অবসর সফল করার একমাত্র উপায়। কথক ঠাকুর উগ্রশ্রবা সৎ-প্রসঙ্গ আর ধর্মকথা যতই বলুন, তার মধ্যে প্রধান আকর্ষণ হল গল্প। রাজা-রাজড়ার গল্প, ঋষি-মুনি অথবা ভগবানের বিচিত্র কাহিনী, লীলা প্রসঙ্গ। দিনভর বৈদিক ক্রিয়া-কলাপে ব্যস্ত ঋষিরা গল্প শোনার আনন্দে সবাই মিলে একেবারে ঘিরে ধরলেন সৌতি উগ্রশ্রবাকে–চিত্রা শ্রোতুং কথাত্ৰস্ত পরিবব্ৰুস্তপস্বিনঃ।