—নৃসিংহপ্রসাদ ভাদুড়ী
.
.
০১.
নৈমিষারণ্য। ইতিহাস-পুরাণ খুললেই দেখবেন নৈমিষারণ্য। মহর্ষিদের তপোবন। সেখানে বারো বচ্ছর ধরে যজ্ঞ হবে এবং সেই যজ্ঞ চলছে। মহাভারত বলবে–এটি কুলপতি শৌনকের আশ্রম। শুধু মহাভারত কেন আঠারোটা মহাপুরাণের বেশির ভাগটার আরম্ভেই সেই একই কথা–নৈমিষারণ্যে কুলপতি শৌনকের তত্ত্বাবধানে বারো বচ্ছরের যাগ-যজ্ঞ আরম্ভ হয়েছে। নানা দেশ থেকে নানা মুনি-ঋষি এসেছেন এখানে। যজ্ঞ চলছে। ঋগবেদের ঋত্বিক ঋক-মন্ত্রে দেবতার আহ্বান করছেন। সামবেদীরা সাম-গান করছেন। যজুর্বেদের পুরোহিত অধ্বর্যু–ইন্দ্রায় বৌষট, অগ্নয়ে স্বাহা–করে আগুনে আহুতি দিচ্ছেন। আর অথর্ব-বেদের পুরোহিত ‘ব্রহ্মা’ এই বিশাল যজ্ঞের সমস্তটার ওপর দৃষ্টি রাখছেন। কিন্তু সবার ওপরে আছেন কুলপতি শৌনক। বারো বচ্ছরের যজ্ঞ। সোজা ব্যাপার তো নয়। সমস্ত দায়টাই তাঁর। তিনি কুলপতি। মহাভারতের ভাষায়–নৈমিষারণ্যে শৌনক্য কুলপতের্দ্বাদশবার্ষিকে সত্রে।
পিতৃকুল, মাতৃকুল, পক্ষিকুল, এমনকি কুলগুরু এরকম অনেক কুলের কথা শুনেছি, কিন্তু কুলপতি কথাটা তো শুনিনি। বাবা-টাবা গোছের কেউ হবে বুঝি। পণ্ডিতেরা বলবেন– শুনেছ, মনে নেই। এমনকি এই ঘোর কলিযুগে কুলপতি তুমি দেখেওছ। খেয়াল করে দেখো–কালিদাসের অভিজ্ঞান-শকুন্তলে, রাজার সঙ্গে শকুন্তলার তখনও দেখা হয়নি। ঋষি বালকেরা রাজাকে মহর্ষি কণ্বের খোঁজ দিয়ে বলল, এই তো মালিনী নদীর তীরে কুলপতি কণ্বের আশ্রম দেখা যাচ্ছে–এষ খলু কাশ্যপস্য কুলপতেরনুমালিনীতীরম আশ্রমো দৃশ্যতে।
যখন এসব পড়েছিলুম, তখন সিদ্ধবাবা, কাঠিয়াবাবা প্রমুখের সাম্যে কাশ্যপ-কণ্বকেও একজন মুনি-বাবাই ভেবেছিলুম। পরে সত্যিকারের পড়াশুনোর মধ্যে এসে দেখেছি–কুলপতি শব্দটার অর্থ নৈমিষারণ্যের মতোই বিশাল। এবং সত্যি কথা, কুলপতি গোছের মানুষ আমি দেখেওছি। কুলপতি হলেন এমনই একজন বিশাল-বুদ্ধি অধ্যাপক ঋষি, যিনি নিজের জীবনে অন্তত দশ হাজার সংযমী বৈদিককে খাইয়ে-পরিয়ে লেখা-পড়া শিখিয়েছেন–মুনীনাং দশ-সাহস্রম্ অন্নদানাদিপোষণাৎ। অধ্যাপয়তি বিপ্রর্ষিঃ– তা দশ হাজার না হলেও অনেক ছাত্রকে বাড়িতে রেখে, খাইয়ে দাইয়ে মানুষ করে পড়াশুনোর সুযোগ করে দিয়েছেন–এমন অনেক ব্রাহ্মণ-পণ্ডিতকে আমি দেখেছি এবং অনেক অব্রাহ্মণ বিশাল-বুদ্ধি মানুষও আমি দেখেছি, যাঁরা এই কুলপতির গোত্রে পড়তে পারেন।
শৌনক এই মাপেরই মানুষ। হয়তো আরও বড়। কারণ বৃহদ্দেবতার মতো বৈদিক গ্রন্থ তাঁরই রচনা। মহাভারত কিংবা অন্যান্য পুরাণের আরম্ভে কুলপতি শৌনককে আমরা দেখেছি, তিনি হয়তো বৃহদ্দেবতার লেখক নন, কিন্তু তিনি যে বিশাল এক মহর্ষি, তাতে কোনও সন্দেহ নেই, কারণ তা নইলে সমস্ত পুরাণকারই এই নৈমিষারণ্যের কুলপতি শৌনকের নাম ব্যবহার করতেন না।
কুলপতি কণ্বের আশ্রম যেমন মালিনীর তীরে, কুলপতি শৌনকের আশ্রমও তেমনই গোমতীর কোলঘেঁষা। গোটা ভারতে নৈমিষারণ্যের মতো এত বিশাল এবং এত সুন্দর তপোবন বোধহয় দ্বিতীয়টি ছিল না। এখনকার উত্তরপ্রদেশের লখনউ ছেড়ে মাইল পাঁচেক উত্তর-পশ্চিমে গেলেই দেখা যাবে তির-তির করে বয়ে যাচ্ছে গোমতী নদী। বর্ষাকালের জলোচ্ছ্বাস যাতে তপোবনের নিরুদ্বেগ শান্তি বিঘ্নিত না করে, তাই নৈমিষারণ্যের তপোবন গোমতী নদী থেকে একটু তফাতে, বাঁ-দিকে।
জায়গাটাও ভারি সুন্দর। ময়ূর কোকিল আর হাঁসের ছড়াছড়ি। গরু আর হরিণ একই সঙ্গে চরে বেড়াচ্ছে, অথচ বাঘ-সিংহের হিংসা নেই। শান্ত আশ্রম–শান্তস্বভাবৈর্ব্যাঘ্রাদ্যৈরাবৃতে নৈমিষে বনে। এই নৈমিষারণ্যে এলে কোটি-তীর্থ ভ্রমণের পুণ্য হয়। ‘নিমিষ’ মানে চোখের পলক। পুরাণ কাহিনীতে শোনা যায়, গৌরমুখ মুনি নাকি এখানে এক নিমেষে দুর্জয়-দানবের সৈন্য-সামন্ত পুড়িয়ে ছাই করে দিয়েছিলেন–যতম্ভ নিমিষেণেদং নিহতং দানবং বলম– সেই থেকেই এই জায়গার নাম নৈমিষারণ্য। সুপ্রতীকের ছেলে দুর্জয় রাজত্ব করতেন এই অঞ্চলে। অসামান্য তাঁর শক্তি। তিনি একদিন শুনলেন যে, তাঁরই রাজ্যের অধিবাসী গৌরমুখ মুনির কাছে নাকি চিন্তামণি আছে। সেই চিন্তামণির কাছে যা চাইবে তাই পাবে। দুর্জয় দানব মণিটি চেয়ে পাঠালেন। মুনি দেখলেন–ওই মণি অপাত্রে পড়লে পৃথিবী এবং মানুষের ক্ষতি হবে অনেক। তিনি মণি দিলেন না।
কিন্তু দানব দুর্জয় মুনির এই পরার্থচিন্তা মানবেন কেন? তিনি সসৈন্যে মুনির আশ্রমে রওনা দিলেন মণির দখল নিতে। দুর্জয়কে দেখতে পেয়েই বিরক্ত গৌরমুখ চোখের নিমেষে পুড়িয়ে দিলেন তাঁর সৈন্যবাহিনী এবং স্বয়ং দানবকেও। দুর্জয়ের সেই ভস্মপীঠের ওপরেই গজিয়ে উঠল ঘন বন, যার নাম নৈমিষারণ্য।
এখন ওঁরা বলেন, নিমখারবন বা নিমসর। নিমসর নামে একটা রেল-স্টেশনও আছে ওখানে। নৈমিষারণ্য থেকে নিমখারবন বা নিমসর কী করে হল, ভাষাতত্ত্বের নিরিখে তা বোঝানো মুশকিল। তবে গোমতী নদী, যেমন নব-নব জলোচ্ছ্বাসে প্রতিদিন কূল ভেঙে নতুন চর তৈরি করে, তেমনই সাধারণের ভাষাও বহতা নদীর মতো নৈমিষারণ্য নামটিও ভেঙে-চুরে নতুন নাম তৈরি করেছে। প্রথম কথা, সাধারণ মানুষ ‘অরণ্য’ বলে না, বলে ‘বন’। এমনকি সাধারণ জনে এটাও খেয়াল করেনি যে, নৈমিষারণ্য দুটো শব্দের সন্ধি–নৈমিষ+অরণ্য। তাঁরা শুধু শেষের ‘ণ্য’টাকে ছেঁটে দিয়ে প্রথমে বলতে আরম্ভ করেছিলেন নৈমিষার-বন, যেন নৈমিষার একটা কথা। আপনারা হয়তো জানেনই যে, ‘ষ’ বর্ণটাকে উত্তরভারতে অনেকই ‘খ’ উচ্চারণ করেন। ‘সহস্ৰশীর্ষা’ পুরুষঃ এই মন্ত্রটাকে বৈদিকরা অনেকেই ‘পুরুখঃ’ বলেন। কবিরা ‘অনিমিষে’ শব্দটাকে কাব্যি করে বলেছেন ‘রইব চেয়ে অনিমিখে’। ফলে নৈমিষার-বন থেকে প্রথমে নৈমিখার-বন, আর তার থেকে নিমখার-বন শব্দটা বলতে আর কত সময় লাগবে। ছোট শব্দটা অর্থাৎ ‘নিমসর’ আরও সোজা। অর্থাৎ বনটাকেও ছেঁটে দিন। থাকে নৈমিষার। তার থেকে সোজা করে নিমসর।