মহাভারতের মূল কাহিনী আরম্ভ করার আগে উগ্রশ্রবা সৌতি দেখাতে চাইছেন। তিনি পারবেন। বেদ-উপনিষদের নিগুঢ় তত্ত্ব তার জানা আছে। জানা আছে, পূর্ববর্তী কালের কাহিনীগুলিও। খেয়াল করে দেখবেন- মহাভারতের মূল কাহিনী সবিস্তারে বলার আগে তিনি যতগুলি গল্প বলেছেন তার মধ্যে উপমনু, আরুণি ইত্যাদি ঔপনিষদিক কাহিনী যেমন আছে, তেমনই আছে ইন্দ্ৰস্তুতি, অশ্বিনীকুমারের স্তুতি এবং সূর্য-বিষ্ণুর একাত্মতা। তার মানে মহাভারতের ঠিক আগের যুগের বৈদিক এবং উপনিষদীয় পরিমণ্ডলের সঙ্গে আমাদের কথক-ঠাকুর পরিচিত। কাহিনী বর্ণনার এই পরম্পরার মাধ্যমে উগ্রশ্রবা সৌতি বেদ উপনিষদের সঙ্গে মহাভারতের কাহিনীর পরম্পরা তৈরি করছেন। অন্যদিকে রাজনৈতিক পালাবদলের টাটকা খবরও তার কাছে পাওয়া যাচ্ছে।
মনে রাখতে হবে, এ সব কথা তিনি বলছেন যজ্ঞ থেকে অবসর লাভ-করা ঋষিদের কাছে। মহাভারতের মূল কাহিনী তিনি আরম্ভ করতে পারছেন না, কারণ কুলপতি শৌনক তখনও এসে পৌঁছোননি। তিনি সে সময় অগ্নিশরণ-গৃহে। অগত্যা তিনি শুধু জনমেজয়ের কাহিনী বলে যাচ্ছেন। জনমেজয়কে তিনি দেখেছেন। তিনি তার সর্পযজ্ঞে গেছেন এবং সবচেয়ে বড় কথা সেখানে তিনি মহাভারত শুনেছেন। পুরুবংশের শেষ পুরুষের সঙ্গে তার একটা পরিচয় আছে এই মর্যাদাতেই তিনি এখন শুধু জনমেজয়ের কথা বলছেন। বলতে পারেন, আমরা মহাভারত শুনতে বসেছি, ওসব জনমেজয়ের গল্প শুনব কেন? আমরা বলব, একটা বিয়ে করতে গেলে মশাই আপনার মাতুল অমুক চন্দ্র অমুকের মেয়ের সঙ্গে আমার শালার ভাইয়ের বিয়ে হয়েছে, আপনার বন্ধুর পিতৃদেব আমার পিসেমশাই হন ইত্যাদি সম্পর্ক খুঁজে কথা জমাবার চেষ্টা করেন। আর এখানে মহাভারতের মতো একটা মহাকাব্য শুনবেন, অথচ জনমেজয়ের কথা শুনবেন না, তার দুঃখ-সুখের কথা শুনবেন না, তা কি হয়? তাছাড়া ভারতে সমাজ-সম্বন্ধ অনেক। পাশ্চাত্যের ব্যক্তি-কেন্দ্রিক সমাজ আমাদের আদর্শ নয়। আমাদের আদর্শ গোষ্ঠীতন্ত্র, গুষ্টিসুখ। এখানে একজনের পরিচয় জানতে গেলে, তার বাবার। কথা শুনতে হয়, গুরুস্থানের কথা শুনতে হয়, এমনকি সেই গুরুর অন্য শিষ্যদের কথাও। শুনতে হয়। তবে বোঝা যায় যার কথা বলছি, তিনি লোকটা কী রকম? সৌতি উগ্রশ্রবাও তাই জনমেজয়ের পরিচয় দিয়ে যাচ্ছেন। যতক্ষণ কুলপতি শৌনক অগ্নিশরণ-গৃহ থেকে সন্ধ্যা-আহ্নিক সেরে ফিরে না আসেন, ততক্ষণ আমরাও একটু জনমেজয়কে বুঝে নিই।
সৌতি উগ্রশ্রবা সপর্যজ্ঞের কথা বলতে বলেছিলেন- এই আমি উতঙ্কের চরিত্র কীর্তন করলাম। জনমেজয়ের সর্প-যজ্ঞের অন্য কারণ এই উতঙ্ক –ময়া উতস্য চরিতমশেষমুক্তং, জনমেজয়স্য সপত্রে নিমিত্তান্তরমিদমপি। উতঙ্কের কথাটা আমরাও বলতে উদযুক্ত হয়েছি এই কারণে যে, মহারাজ জনমেজয়ের তিনি গুরুভাই। অবশ্য এখনকার দিনে শাক্ত বৈষ্ণব সমাজে যেমন গুরুভাই দেখি, তেমন গুরুভাই তিনি নন। ব্যাপারটা একটু অন্যরকম।
উতঙ্কের গুরুর নাম বেদ। গৃহস্থ, ব্রহ্মর্ষি, মহা পণ্ডিত। জনমেজয় এই বেদকে এক সময় নিজের উপাধ্যায় হিসেবে বরণ করেন। উপাধ্যায় হিসেবে বেদ ছিলেন ভারি ভাল মানুষ। সেকালের দিনে বিদ্যা লাভ করার জন্য শিষ্যদের অসম্ভব কষ্ট করতে হত। সংযমের শিক্ষা এবং নির্বিচারে গুরুবাক্য পালন করার মধ্যে এতটাই কাঠিন্য ছিল যে, তাদের গুরুগৃহ-বাসের সময়গুলি গল্পে পরিণত হয়েছে। মহর্ষি বেদের অন্য দুই গুরু-ভাই আরুণি এবং উপমন্যর গুরু-সেবার স্তরগুলি আমাদের কাছে কল্প-কাহিনীর মর্যাদা নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। বেদ যখন গুরুগৃহে ছিলেন তখন তাকেও ভার বইতে হত গোরুর মতো। শীত নেই গ্রীষ্ম নেই, ক্ষুধা-তৃষ্ণার বালাই নেই। সমস্ত সময়টা শুধু গুরুর আদেশ নির্বিচারে পালন করা। এমনিভাবে চলতে চলতে শুরু একদিন প্রসন্ন হলেন, বেদকে বিদ্যা দান করলেন। গুরুর কাছে বিদায় নিয়ে বাড়িতে এসে বেদ বিয়ে করে গৃহস্থ হলেন।
মানুষ যখন ছাত্র থাকে, তখন সে যে যে কষ্ট পায়, যেভাবে কষ্ট পায়–বড় হয়ে তা দূর করার চেষ্টা করে। মহর্ষি বেদ এখন গুরু আসনে বসেছেন। তবু ছাত্রাবস্থায় গুরুর আশ্রমের দিনগুলি তাঁর স্মরণে আসে। তিনি শিষ্যদের দিয়ে কোনও কষ্ট করাতে চান না, তাদের খাঁটিয়ে নিতে চান না, এমনকি গুরুষাও করতে বলেন না- স শিষ্যান্ন কিঞ্চিদুবাচ কৰ্ম বা ক্রিয়তাং গুরুশুশ্রূষা বেতি। গুরুগৃহবাসের দুঃখ তিনি জানেন, অতএব তিনি সেই কষ্ট শিষ্যদের দিতে চান না।
মহর্ষি বেদের তিন শিষ্যের মধ্যে প্রধান ছিলেন উতঙ্ক। উতঙ্ক ব্রহ্মচারী গুরুগৃহবাসী। বেদের অন্য দুই শিষ্য দুই ক্ষত্রিয় রাজা–একজন তো জনমেজয়, অন্যজন রাজা পৌষ্য।
উতঙ্ক যখন গুরুগৃহে বিদ্যাভ্যাস করছেন, তখন এক সময় মহর্ষি বেদের প্রয়োজন হল অন্য জায়গায় যাওয়ার। সেকালের দিনে বেদের মতো ব্রাহ্মণ-পণ্ডিতেরা নিজের পড়া এবং অন্যকে পড়ানো নিয়েই দিন কাটাতেন। এর মধ্যে তাদের কাছে মাঝে মাঝে অন্যের যজ্ঞ করার নিমন্ত্রণ আসত। তারা যেতেন, যজমান ধনী হলে দক্ষিণাও পেতেন ভাল। দুধেলা গোরুও মিলত। এই দক্ষিণার টাকা আর গোরুর দুধ খেয়ে অন্য সময় তাদের কষ্টে-সৃষ্টে চলে যেত। এর মধ্যে বাড়িতে যে দু-চারজন শিষ্য থাকতেন, তাদের ভরণ-পোষণও চলত।