আজকের দিনে ফিল্মের ভাষায় আপনারা যাকে ফ্ল্যাশব্যাক বলেন, সেই ফ্ল্যাশব্যাকের কায়দাতেই মহাভারতের কাহিনীর আরম্ভ। কুরু-পাণ্ডবের বিরাট যুদ্ধ শেষ হয়ে গেলে মহারাজ যুধিষ্ঠির খুব বেশি দিন রাজত্ব করতে পারেননি। মৃত্যুর মুখে দাঁড়িয়ে মহারাজ দুর্যোধন যুধিষ্ঠিরকে বলেছিলেন–সারা জীবনে যা পাবার আমি পেয়েছি। ভোগ ও লাভ করেছি ইচ্ছামতো। কিন্তু সমস্ত জ্ঞাতি-বন্ধু, আত্মীয়-স্বজন হারিয়ে তুমি কোথায় রাজত্ব করবে, যুধিষ্ঠির? তোমার রাজ্যের বাসিন্দা হবেন কতগুলি বিধবা আর কতগুলি সন্তানহীন মাতা।
কথাটা একেবারে মিথ্যে বলেননি দুর্যোধন। রাজ-সিংহাসনে বসে যুধিষ্ঠির মোটেই সুখ পাননি। মাত্র ছত্রিশ বছর সে কালের দিনের আন্দাজে সময়টা কিছুই নয়; মাত্র ছত্রিশ বছর রাজত্ব করে, পাণ্ডব-কৌরবের একমাত্র সন্তান-বীজ পরীক্ষিতকে সিংহাসনে বসিয়ে যুধিষ্ঠির মহাপ্রস্থানের যাত্রা শুরু করেছেন। যখন সিংহাসনে বসেছেন পরীক্ষিতের বয়সও তখন ছত্রিশ। কারণ, পাণ্ডব-কৌরবের মহাযুদ্ধের শেষেই তার জন্ম। তারও রাজত্বকাল অতি অল্প। মাত্র চব্বিশ বছর। তিনি অকালে মারা গেলেন তক্ষক সাপের দংশনে। রাজা হয়ে বসলেন তার পুত্র জনমেজয়।
জনমেজয় পিতার মৃত্যুর প্রতিশোধ নিতে সর্প-যজ্ঞ আরম্ভ করলেন। সেই সর্প-যজ্ঞেই মহাভারত-কথার সূচনা। আস্তীক মুনি এসে জনমেজয়ের সর্প-যজ্ঞের ছেদ টানলেন। যজ্ঞ স্তব্ধ হল এবং মহাভারতের কথা আরম্ভ হল। সর্পযজ্ঞে যোগদান করেছিলেন যত রাজ্যের মুনি-ঋষিরা। আর উপস্থিত ছিলেন মহামুনি ব্যাস। কুরু-পাণ্ডবের বংশধারায় ব্যাসের নিজের রক্ত আছে, মমত্ব আছে। ফলে বাণপ্রস্থে ধৃতরাষ্টের মৃত্যু, যুধিষ্ঠিরের মহাপ্রস্থানের পরেই তিনি মহাভারত রচনা করেন। রচনা করেন কৌরব-পাণ্ডববংশের পূর্ব এবং উত্তর ইতিহাস। গোটা মহাভারতটা লিখতে তার তিন বচ্ছর সময় লেগেছিল। হয়তো হাতে-কলমে লেখা যাকে বলে সেভাবে তিনি মহাভারত লেখেননি কিন্তু মহাভারতের পুরো বয়ানটা মনে মনে পুরো ছকে নিতে তার সময় লেগেছিল তিন বচ্ছর ত্রিভিবর্ষে মহাভাগঃ কৃষ্ণদ্বৈপায়নো’ব্রবীৎ। মহাভারত কীভাবে শব্দ-ছন্দ-অলংকারের পরিসরে বাঁধা পড়ল–সে কথায় পরে আসছি। কিন্তু দুটি ভিন্নতর পরিস্থিতিতে মহাভারতের কথা কী ভাবে আরম্ভ হচ্ছে সেটা আগে বুঝে নিতে হবে।
মনে রাখা দরকার–উগ্রশ্রবা সৌতি মহাভারতের কথা বলছেন নৈমিষারণ্যে বসে। এখানে তিনি বক্তা। কিন্তু তিনিই আবার শ্রোতা হিসেবে ছিলেন মহারাজ জনমেজয়ের সভায়। সেখানে বক্তা ছিলেন ব্যাস-শিষ্য বৈশম্পায়ন। খেয়াল করে দেখবেন– মূল মহাভারত বলার আগে নৈমিষারণ্যে বসে উগ্রশ্রবা সৌতি মহাভারতের মূল ঘটনাগুলি সূত্রাকারে বলে গেছেন। এতে সমবেত ঋষিদের মনে বিস্তারিত কাহিনী শোনবার স্পৃহা জেগেছে। অন্যদিকে জনমেজয়ের সভায় বৈশম্পায়নও প্রথমে একই ভাবে সূত্রাকারেই মহাভারতের কথা বলেছেন এবং তাতে জনমেজয়ের বক্তব্য আপনি বিস্তারিতভাবে সব কাহিনী বলুন মহর্ষি! আমার পূর্বজ মহান পাণ্ডব-কৌরবদের কীর্তিকলাপ এত অল্প শুনে মোটেই তৃপ্তি হচ্ছে না আমার- ন হি তৃপ্যামি পূর্বেষাং শূনশ্চরিতং মহৎ। বৈশম্পায়ন বিস্তারিতভাবে কাহিনী আরম্ভ করলেন।
.
০৩.
জনমেজয়ের সর্প-যজ্ঞের সভা এবং নৈমিষারণ্য–এই দুয়ের মধ্যে যে ভৌগোলিক দূরত্ব আছে, তার সঙ্গে আছে সময়ের দূরত্ব। ব্যাস যে কাহিনী রচনা করেছিলেন, তার শেষে ছিল ধৃতরাষ্ট্র-বিদুরের জীবন-শেষের পর্ব আর ছিল যদুবংশের ধ্বংস এবং যুধিষ্ঠিরের মহাপ্রস্থান। বৈশম্পায়ন এই পর্যন্তই মহাভারত জানেন। কিন্তু উগ্রশ্রবা সৌতি যখন মহাভারত বলছেন, তখন ক্ষীয়মাণ পাণ্ডব-বংশের অঙ্কুর পরীক্ষিতের মৃত্যু হয়ে গেছে। আর সেই প্রতিশোধে যে সর্পষজ্ঞ হয়েছিল, সেই যজ্ঞসভায় সৌতি উপস্থিত ছিলেন। ফলত পরীক্ষিতের মৃত্যু এবং জনমেজয়ের সর্পযজ্ঞের বিবরণ আমাদের শুনতে হবে নতুন এই কবিওয়ালার কাছে। তিনি উগ্রশ্রবা সৌতি।
মুশকিল হল– উগ্রশ্রবা সৌতি নতুন কবিওয়ালা। তিনি কেমন বলেন, কেমন তার কথকতা, সে সম্বন্ধে সমবেত ঋষিদের ধারণা নেই। সৌতি অবশ্য এসে ইস্তক থেমে থাকেননি। তিনি ঋষিদের কাছে এ কাহিনী সে কাহিনী বলে যাচ্ছেন। নৈমিষারণ্যের কুলপতি শৌনক অভিজ্ঞ লোক। তিনি নতুন কবিওয়ালাকে স্বাগত জানিয়েছেন বটে, বসতে দিয়েছেন, ফল-মূল সেবা করতে দিয়েছেন বটে, কিন্তু মূল মহাভারতের কথকতার ব্যাপারে শৌনক এই নতুন কবিওয়ালাকে আগেই তত পাত্তা দেননি। তিনি সৌতিকে বসিয়ে রেখেই চলে গেছেন অগ্নিশরণ গৃহে- যেখানে তার বারো বছরের যজ্ঞের ক্রিয়াকলাপ চলছে।
সৌতি উগ্রশ্রবা অবশ্য থেমে থাকেননি। তিনি তার কথকতার ক্ষমতা দেখিয়ে যাচ্ছেন। দু-চারটে উটকো কাহিনী তিনি বলে যাচ্ছেন নিতান্ত খাপছাড়া ভাবে। যদিও খাপছাড়া হলেও এগুলি অর্থহীন নয়। তিনি একবার মহাভারতের সংক্ষেপ-সূত্রগুলি বলে যাচ্ছেন, একবার জনমেজয়ের সপত্রের কথা বলছেন, একবার পরীক্ষিতের মৃত্যুর কথাও বলছেন। আবার কখনও বা সাপের কথায়, জনমেজয়ের কথার সূত্র ধরে উপমন্যর কাহিনী, উতঙ্কের কাহিনী, রুরু-প্রমদ্বরার কাহিনীও বলে যাচ্ছেন। পণ্ডিতেরা মহাভারতের মূল কাহিনীর সঙ্গে বেমিল দেখে এই সব কাহিনীর মধ্যে প্রক্ষেপের গন্ধ পেয়েছেন। কিন্তু আমি ব্যক্তিগতভাবে এই কাহিনীগুলির মধ্যে নতুন কথক-ঠাকুরের আত্মঘোষণা দেখতে পাই। সে-কালের কবিওয়ালাকে ইতিহাস-পুরাণের তত্ত্ব-কাহিনী, লোক-কথা ভাল করে জানতে হত। একইভাবে সেকালের কথক-ঠাকুরদেরও বেদ-উপনিষদের মর্মকথাও জানতে হত। তাদের সময়েই যেহেতু ইতিহাস-পুরাণের কথকতা আরম্ভ হয়েছে, অতএব পূর্ববর্তী বেদ-উপনিষদের কল্প-কাহিনীগুলি বলে তারা কথকতার নমুনা দেখাতেন।