- বইয়ের নামঃ কথা অমৃতসমান
- লেখকের নামঃ নৃসিংহপ্রসাদ ভাদুড়ী
- প্রকাশনাঃ দে’জ পাবলিশিং (ভারত)
- বিভাগসমূহঃ উপন্যাস
০০১. নৈমিষারণ্য
কথা অমৃতসমান – নৃসিংহপ্রসাদ ভাদুড়ী (১ম খণ্ড)
প্রথম প্রকাশ : নভেম্বর ২০১৩, অগ্রহায়ণ ১৪২০
ধর্মে চার্থে চ কামে চ মোক্ষে চ ভরতষভ।
যদিহাস্তি তদন্যত্র যন্নেহাস্তি ন কুচিৎ।
—ধর্মশাস্ত্র বলুন কিংবা অর্থশাস্ত্রই বলুন, কামশাস্ত্রই বলুন অথবা মুক্তির শাস্ত্রই বলুন–যা এই মহাভারতে আছে, তা অন্যত্রও আছে; আর যা এখানে নেই, তা অন্য কোথাও নেই।
মহাভারত মানে মহা-ভারত। যা এখানে নেই, তা অন্য কোথাও নেই। আর আর এখানে যা আছে, তা অন্য কোথাও নিশ্চয়ই আছে। আমরা এই নিরিখেই গ্রন্থটাকে দেখতে চেয়েছি–তারা সবাই অন্য নামে আছেন মর্ত্যলোকে। আজকের এই সর্ব-সমালোচনামুখর, ঈর্ষাসূয়ায় হন্যমান শতাব্দীর মধ্যে দাঁড়িয়ে শত শত শতাব্দী-প্রাচীন আরো এক সাসূয় সমাজের কথা বলতে লেগেছি, যদিও সেখানে প্রাতিপদিক বিচলনের সঙ্গে সঙ্গে একটা শব্দ বার বার নিনাদিত হয় এবং সেটা ধর্ম–সে ধর্ম একদিকে নীতি এবং নৈতিকতা, অন্যদিকে সেটা ‘জাস্টিস’, শৃঙ্খলা, ‘অরডিন্যান্স’ এমন কী আইনও। মহাভারত অন্যায় এবং অধর্মকে সামাজিক সত্যের মতো ধ্রুব বলে মনে করে, কিন্তু সেটা যাতে না ঘটে তার জন্য অহরহ সচেতন করতে থাকে প্রিয়া রমণীর মতো। আমরা সেই মহা-ভারতকথা বলেছি এখানে, যা শতাব্দীর প্রাচীনতম আধুনিক উপন্যাস।
.
লেখক পরিচিতি
এখনকার বাংলাদেশের পূর্ব-প্রারন্ধের মতো পাক-চক্র ছিল এক। লেখকের জন্ম সেখানে পাবনা জেলার গোপালপুর গ্রামে, ১৯৫০ সালে। কলকাতায় প্রবেশ ৫৭ সালে। শিক্ষাগত উপাধিগুলি ব্যাধির মতো সামনে-পিছনে আসতে চাইলেও বর্তমান লেখক সেগুলিকে মহাভারত-পাঠের সোপান হিসেবে গ্রহণ করেছেন। যে আস্বাদন মহাভারতের স্বাধ্যায়-অধ্যয়নের মধ্যে আছে, তার প্রতিপদ-পাঠ বুঝতে গেলে অন্যান্য জাগতিক বিদ্যার প্রয়োজন হয়। লেখকের জীবন চলে শুধু মাধুকরী বিদ্যায়, সাংগ্ৰাহিক আস্বাদনে। লেখালেখির জীবনে এসে পড়াটা একেবারেই আকস্মিক ছিল। প্রবীণ সাহিত্যিক রমাপদ চৌধুরী তার লেখক জীবনের পরিণতি ঘটিয়েছেন বাঁচিক তিরস্কারে এবং বাঁচিক পুরস্কারে। আনন্দবাজার পত্রিকায় প্রথম লেখা এবং আনন্দ থেকে তাঁর প্রথম বই এককালে শিহরণ জাগাত লেখকের মনে। এখন। শিহরণের বিষয়–মহাভারত-পুরাণের অজ্ঞান তমোভেদী এক-একটি বিচিত্র শব্দ। গুরুদাস কলেজে অধ্যাপনা-কাল শেষ করে এখন। মহাভারত-পুরাণের বিশাল বিশ্বকোষ রচনায় ব্যস্ত আছেন লেখক।
.
সিন্ধু-বিন্দু
২০১০ সালে পুজোর পর প্রখ্যাত পরিচালক ঋতুপর্ণ ঘোষের সঙ্গে আড্ডা দিতে বসেছি। সে আড্ডায় অবধারিতভাবে মহাভারতের প্রসঙ্গ চলে আসে। নানা কথার মধ্যে হঠাৎই ঋতু বলে –তুমি আমাদের জন্য লিখতে আরম্ভ করো ‘রোববার’-এ। আমি এই কাগজের সম্পাদনার দায়িত্বে আছি। তুমি নিশ্চিন্তে লেখো। মহাভারত বুঝিয়ে দাও আমাদের। আমি বলেছিলাম, মহাভারত কখনো নিশ্চিন্তে লেখা যায় না। এই মহাকাব্যের বিশালতা এবং গভীরতা দুটোই এত বেশী যে, আমি যেভাবে মহাভারত বোঝাতে চাই, সেটা বোঝাতে গেলে জীবন কেটে যাবে। ঋতু বলল– লেখার মতো করে লেখো, ভেবে নাও তোমার চোখের বাইরে বসে-থাকা শত শত পাঠকের আকুল জিজ্ঞাসা। তাদের ছোট করে দেখো না। তাদের প্রশ্ন তুমি তৈরী করবে, তুমিই উত্তর দেবে।
ঋতুর কথা আমি মেনেছি। রোববারে আমার ‘কথা অমৃতসমান’ চলছে, কিন্তু এরই মধ্যে আমার সবচেয়ে প্রিয় পাঠক আমাদের ছেড়ে চলে গেছে বিশ্বময় নিজেকে ছাড়িয়ে দিয়ে। ঋতুকে বলেছিলাম আমি আগেও মহাভারত-কথা লিখতে আরম্ভ করেছিলাম তৎকালীন বর্তমান পত্রিকার সম্পাদক বরুশ সেনগুপ্ত-মশায়ের অনুরোধে। সাড়ে তিন বছর ফি-হপ্তায় লিখে আমি পাণ্ডবদের জতুগৃহ-দাহ পর্যন্ত এগোতে পেরেছিলাম। তদবধি ভেবেছি–আমাকে তিনি অশেষ করেননি, এমন লীলা আমার ক্ষেত্রে হবেও না। কাজেই আবার নতুন করে মহাভারতকে পাকড়ে ধরা কী ঠিক হবে? ঋতু বলেছিল-তোমরাই কীসব বলল না–যারা বিদ্যে লাভ কস্তুতে চায়, যারা খুব টাকা-পয়সা পেতে চায়, তারা নিজেদের অজর, অমর মনে করে। তুমি তাই ভেবে লেখা আরম্ভ করো।
ঋতুকে আমি ফেলতে পারিনি। ‘কথা অমৃতসমান’ আরম্ভ করেছিলাম ‘রোববার’-এ। এখনও চলছে, আমিও চলেছি। এরই মধ্যে একটা নতুন প্রয়োজন দেখা দিল। একদিন ‘দেজ পাবলিশিং’-এর নব্যযুবক অপু সুধাংশুদের যোগ্য উত্তরাধিকারী, আমার কাছে এসে কথা অমৃতসমান’ছাপতে চাইল বই আকারে। আমি বললাম–শর্ত আছে। এখন ‘রোববারে’ যে লেখা চলছে, সেটা আমার আগের লেখার ‘কনটিনিউয়েশন’। কাজেই মহাভারত নিয়ে যদি এই বই ছাপতে চাও, তবে আগে বরুণদার দপ্তরী লেখাটা ছাপতে হবে। অপু বলল–তাই দিন-আমরা তিন-চার খণ্ডে ‘কথা অমৃতসমান’ বার করবো। ওর এই সাহসটা আমার ভাল লেগেছিল। এখন লেখকদের ওপর হুলিয়া আছে–লেখা পুরো শেষ করুন, তবে ছাপাবো। এটা কী সমরেশদার ‘দেখি নাই ফিরে’-র ফলশ্রুতি কীনা কে জানে! লেখকের বুঝি মরেও শান্তি নেই। তবে কিনা মহাভারত তো সত্যিই আয়ু-শেষ-করা মহাকাব্য। ধন-জন, মান-যশ, আশা-আকাঙ্ক্ষার আকস্মিক ছেদে যে শান্তরসের বৈরাগ্য তৈরী হয়, সেই তো মহাভারতের চরম প্রতিপাদ্য তত্ত্ব। কাজেই মহাভারতের কথা শেষ না হতেই আমিও যে ঋতুর মতো কোথাও চলে যাবো না, এ-কথা জোর দিয়ে কে বলতে পারে? এখানে অপু সাহস দেখিয়েছে প্রকাশক হিসেবে।