সোনালী!
হ্যাঁ সোনালী।
স্নেহ বড় বিচিত্র সম্পদ। স্নেহ দিয়ে বনের পশুকেও বশ করা যায়। সোনালীকে তো যাবেই।
সোনালী!
কি জ্যাঠামণি?
বড়মাকে বলে এসো আমি পরশুদিন চিড়িয়াখানা যাব। বাড়িতে ফিরতে দেরি হবে।
তুমি একলা যাবে জ্যাঠামণি?
আর কে যাবে?
আমি আর খোকনদা যাব না?
ওখানে বাঘ-সিংহ আছে। তোমাদের ভয় করবে।
তোমার ভয় করবে না?
করবে, তবে অল্প অল্প।
তোমার অল্প ভয় করবে কেন?
আমি যে বড় হয়েছি।
সোনালী একবার নিজেকে আপাদমস্তক দেখে বলল, আমিও বড় হয়ে গেছি।
তাই নাকি?
হ্যাঁ জ্যাঠামণি আমি বড় হয়ে গেছি।
কি করে বুঝলে?
আমাকে মা-বড়মা কেউ কোলে নিতে পারে না।
সোনালী মাথা নেড়ে ছোট্ট দুটো বিনুনি দুলিয়ে বলতে লাগল, না! পারে না।
তাহলে আমার সোনালী সত্যি বড় হয়েছে।
তাছাড়া আমি তো লুডো খেলাও শিখে গেছি।
সত্যি?
আমি মিথ্যে কথা বলি না। বড়মা বলেছে মিথ্যে কথা বললে জিভে ঘা হয়।
রবিবার সবাই মিলে চিড়িয়াখানা গেলেন। বাড়ি ফেরার পথে বিহারীর ওখানে।
গাড়ি থামতেই সোনালী চিৎকার করল, বাবা, আমি হাতির পিঠে চড়েছি।
তাই নাকি?
হ্যাঁ বাবা।
খোকনদা, তুই চড়েছিস?
তুমি এর মধ্যেই ভুলে গেলে বিহাইকাকা? তুমি আমাকে কতবার চড়িয়েছ মনে নেই?
আজ চড়েছিস? চড়েছি।
সোনালী দৌড়ে ভিতরে গিয়ে মাকে খবরটা দিয়েই আবার বাইরে বেরিয়ে আসে। পিছন পিছন ওর মা।
মিস্টার সরকার হেসে বললেন, সোনালী বড় হয়ে গেছে। আর আমাদের চিন্তা নেই। ও বাঘ-সিংহ দেখেও ভয় পায় না, তাছাড়া লুডো খেলাও শিখে গেছে।
চিড়িয়াখানার বাঘ-সিংহ দেখে কেউ আবার ভয় পায় নাকি?
শিবানী জিজ্ঞাসা করলেন, সন্তোষ কোথায়?
বউদি, ও আজকাল এই পাড়ারই একটা ছেলের কাছে পড়তে যায়। সেখানেই গেছে।
দোকান কেমন চলছে?
এক পয়সা ভাড়া তো দিতে হচ্ছে না, আর দাদা টাকা-পয়সার ব্যবস্থা যেভাবে করে দোকান সাজিয়ে দিয়েছেন তাতে তিনজনের মোটামুটি চলে যাচ্ছে।
বিহারীর স্ত্রী বললেন, আগের মতন এখন আর অত ঘাবড়ে যান না। দোকান তো উনি একলাই চালিয়ে নিচ্ছেন।
আরো কিছুক্ষণ কথাবার্তা বলার পর শিবানী বললেন, সোনালী, তুই আজ এখানে থাক। কাল বিকেলে তোর জ্যাঠামণি এসে তোকে নিয়ে যাবে।
ঠিক নিয়ে যাবে তো?
মিস্টার সরকার হাসতে হাসতে বললেন, তুই না থাকলে এই বুড়োকে কে দেখবে?
তুমি মোটেও বুড়ো হওনি।
রওনা হবার আগে বিহারী একবার গাড়িটা দেখে, স্টিয়ারিংটা নাড়াচাড়া করে। তারপর বলে, বউদি, দাদাকে যদি গাড়ি চালানো না শেখাতাম তাহলে আজ কত অসুবিধে হতে বলুন তো!
দিন আরো এগিয়ে চলে। সোনালী আরো কাছে আসে, আরো আপন হয়। তারপর একদিন স্কুলে ভর্তি হয়। ভোরবেলায় যায়। দশটায় ছুটি। দুপুরে বড়মার কাছে বসে পরের দিনের পড়াশুনা করে নেয়। কখনও খোকনের সঙ্গে গল্প করে, লুডো খেলে। নয়তো ক্যারাম। খেয়াল হলে ডাইনিং টেবিলে টেবিল টেনিস।
আজ সোনালীর জন্মদিন। আজ স্কুলে যায়নি। ভোরবেলায় উঠে স্নান করে নতুন জামা পরে জ্যাঠামণি, বড়মা, খোকনদাকে প্রণাম করে। আশীর্বাদ নেয়। তারপর অফিস যাবার সময় মিস্টার সরকার ওকে বাবা-মার কাছে পৌঁছে দেন। পরের দিন সকালে সন্তোষ পৌঁছে দিয়ে যায়।
দিনগুলো বেশ কেটে যায়। দেখতে দেখতে বছরের পর বছর পার হয়।
.
জানালায় দাঁড়িয়ে দূর থেকে মিস্টার সরকারের গাড়ি দেখেই সোনালী দৌড়ে রান্নাঘরে গিয়ে কেটলি গ্যাসে চড়িয়ে দেয়। তারপর উনি গলিটা পার হয়ে বাড়ির সামনে গাড়ি থামাতে-না-থামাতেই সোনালী গ্যাস বন্ধ করে কেটলির মধ্যে চা ফেলে দেয়! উনি ঘরে বসতে-না-বসতেই সোনালী ট্রেতে দু কাপ চা আর চারটে বিস্কুট নিয়ে ঢোকে। শিবানী চা-বিস্কুট নামিয়ে সেন্টার টেবিলে রাখতে রাখতে বলেন, আমার মেয়ে তোমাকে কি রকম ভালোবাসে?
মিস্টার সরকার সোনালীকে কাছে টেনে নিয়ে জিজ্ঞাসা করেন, তুই আমাকে সত্যি ভালোবাসিস?
সোনালী একটু হেসে মাথা নাড়ে।
আমি তোকে একটুও ভালোবাসি না।
সোনালী বেশ গম্ভীর হয়ে বলল, জ্যাঠামণি, তুমি মিথ্যে কথা বললে জিভে ঘা হবে আর বড়মা খুব রাগ করবে।
আমি মিথ্যে কথা বলছি না। আমি সত্যি তোকে একটুও ভালোবাসি না।
ভালো না বাসলে আমার ছবি অত বড়ো করে শোবার ঘরে ঝুলিয়ে রেখেছ কেন?
সোনালীর কথায় ওরা দুজনেই হাসেন।
সোনালী ভিতরে চলে যাবার পর শিবানী বললেন, সোনালী সত্যি তোমাকে খুব ভালোবাসে। তোমার আসার সময় হলে ও যেভাবে জানালায় দাঁড়িয়ে হাঁ করে রাস্তার দিকে তাকিয়ে থাকে, তা দেখে আমিই অবাক হয়ে যাই।
মিস্টার সরকার চায়ের কাপে চুমুক দিয়ে বললেন, তা ঠিক। আমার সবকিছু খুঁটিনাটি ব্যাপারেও ওর নজর আছে।
শিবানী হেসে বললেন, আজ স্কুল থেকে ফিরে আমাকে কি বলেছে জানো?
কি?
বলেছে, বড়মা, একটা লোকের পায়ে খুব সুন্দর একটা জুতো দেখলাম। জ্যাঠামণিকে ওই রকম জুতো কিনে দেবে? ওইরকম জুতো পরলে জ্যাঠামণিকে খুব সুন্দর দেখাবে।
মিস্টার সরকার হাসেন।
শিবানী চা খেতে খেতে বলেন, সেদিন ঢাকুরিয়ায় দাদাকে লখনৌ চিকনের পাঞ্জাবি পরতে দেখেই মেয়ে ধরল, বড়মা, জ্যাঠামণিকে ওই রকম পাঞ্জাবি তৈরি করে দাও।
তাই বুঝি তুমি লখনৌ চিকনের পাঞ্জাবি কিনে আনলে?
কি করব? সোনালী এমন করে ধরল যে পাঞ্জাবি না কিনে পারলাম না।