সরষের তেল কি হবে?
খোকনদা আমার কাধ-পিঠ মালিশ করবে।
শিবানী হাসতে হাসতে জিজ্ঞাসা করেন, কেন? কি হয়েছে?
বিহারী একবার খোকনের দিকে তাকিয়ে বলে, এত বড় বুড়োধাড়ী ছেলেকে কাঁধে করে খেলা দেখাতে হলে…
খোকন আর চুপ করে থাকে না। বলে, বিহাইকাকা, অযথা আমাকে দোষ দেবে না।
তবে কাকে দোষ দেবো খোকনদা?
খোকন এবার মাকে বলে, জানো মা, বিহাইকাকাই আমাকে বলল, খোকনদা, আমার কাঁধে চড়। তা নয়ত কিছু দেখতে পাবি না।
.
বিহারী হাসতে হাসতে বলে, হারে খোকনদা, তুই কি চিরকালই আমাকে বিহাইকাকা বলবি?
ওর প্রশ্ন শুনে খোকনও হাসে। জিজ্ঞাসা করে, কেন, আমার বিহাইকাকা ডাক তোমার ভালো লাগে না?
তুই যা বলে ডাকবি তাই আমার ভালো লাগবে।
তাহলে তুমি ওকথা বলছ কেন?
এমনি জিজ্ঞাসা করছিলাম। বিহারী কিছুক্ষণ চুপ করে থাকার পর জিজ্ঞাসা করে, আচ্ছা খোকন, এখন তো তুই একটু বড় হয়েছিস, তবে কেন তুই এখনও দাদা বউদিকে সব কথা বলতে পারিস না?
খোকন দুহাত দিয়ে বিহারীর গলা জড়িয়ে ধরে বলে, আমি তোমাকে বিরক্ত করি বলে তুমি রাগ করো?
দূর পাগল! তোর উপর আমি কখনও রাগ করতে পারি?
কিন্তু আমি তো তোমাকে খুবই বিরক্ত করি।
তুই বিরক্ত না করলে আমার পেটের ভাত হজমই হবে না।
দুজনে এক সঙ্গে হেসে ওঠে।
দুজনে আরো কত কথা হয়।
বিহারী বলে, আচ্ছা খোকন, আমি যদি কোনো কারণে তোদের বাড়িতে কাজ না করি…
খোকন একটু বিরক্ত হয়েই প্রশ্ন করে, তার মানে? তোমাকে কি মা বা বাবা কিছু বলেছেন?
না, না, কেউ কিছু বলেননি।
তাহলে তুমি হঠাৎ একথা বললে কেন?
কোনো কারণ নেই রে খোকনদা! এমনি বললাম। হাজার হোক মানুষের কথা কেউ কি কিছু বলতে পারে?
খোকন কিছুতেই বিশ্বাস করে না। বলে, না না বিহাইকাকা, তুমি চেপে যাচ্ছ।
বিহারী খোকনকে বুকের মধ্যে জড়িয়ে ধরে বলে, সত্যি বলছি কিছু হয়নি। তবে মনে মনে নানা কথা ভাবতে ভাবতে এসব কথা প্রায়ই মনে হয়।
না না বিহাইকাকা তুমি আর এসব ভাববে না। ঠিক তো?
বিহারী হাসে। বলে, ঠিক আছে খোকনদা, আমি আর এসব কথা ভাবব না।
.
বেশ চলছিল কিন্তু হঠাৎ একদিন সবকিছু ওলট-পালট হয়ে গেল।
অ্যাকসিডেন্ট।
মিস্টার সরকারের টেলিফোন পেয়েই শিবানী প্রায় পাগলের মতন চিৎকার করে উঠলেন, অ্যাকসিডেন্ট! তোমার?
না, না, আমি গাড়িতে ছিলাম না। বিহারী…
বিহারী নেই?
আছে আছে। হাসপাতালে…
কোথায় অ্যাকসিডেন্ট হলো?
আমার এক কলিগকে নিয়ে টিটাগড়ের কারখানায় যাবার পথে…
তোমার কোন কলিগ?
মিত্তির। তার কিছু হয়নি।
কিভাবে অ্যাকসিডেন্ট হলো?
একটা লরি অ্যাকসিডেন্ট করে পালাবার সময় আমার গাড়িতে এমন ধাক্কা লাগিয়েছে যে…
বিহারীর কোথায় লেগেছে?
বোধহয় বুকের দু-তিনটে হাড় ভেঙেছে আর ডান হাতটা…
ডান হাত নেই?
আছে, তবে বোধহয় কিছু কাটাকাটি করতে হবে।
কি সর্বনাশ!
যাই হোক আমি আবার এক্ষুনি হাসপাতালে যাচ্ছি…
তুমি একলা?
না, না, অফিসের অনেকেই হাসপাতালে আছে।…
কোন্ হাসপাতালে?
আর. জি. কর-এ। যাই হোক খোকনকে কিছু বোলো না। ও শুনলে…
আমি হাসপাতালে আসব?
এখন গিয়ে কোনো লাভ নেই। বিহারীকে অপারেশন থিয়েটারে নিয়ে গেছে।
দিন পনেরো পরে খোনকে দেখেই বিহারী কাঁদতে কাঁদতে বলল, খোকনদা ছুটির ঘণ্টা পড়লেও যেতে পারলাম না। তোর জন্য থেকে যেতে হল।
খোকন কাঁদতে কাঁদতে বলল, বিহাইকাকা, আমার আর গাড়ি চালানো শেখা হল না।
দাদা তোমাকে শেখাবেন।
না বিহাইকাকা, আমি অন্য কারুর কাছে শিখতে পারব না।
নারে খোকনদা, ওই অস্টিনে চড়িয়ে তোকে আমি নার্সিং হোম থেকে এনেছিলাম। তোকে ওই গাড়ি চালাতেই হবে।
না বিহাইকাকা, আমি ও গাড়ির স্টিয়ারিং টাচ করব না, কোনদিনও না। তুমি দেখে নিও। তিনমাস কেটে গেল।
হাসপাতাল থেকে ছুটি পাবার আগের দিন বিহারী মিস্টার সরকার আর শিবানীর দিকে তাকিয়ে কাঁদতে কাঁদতে বলল, আমি বাড়ি গিয়ে কি করব দাদা? বউদি, কিভাবে আমার সংসার চলবে?
মিস্টার সরকার বললেন, অত চিন্তা কোরো না সব ঠিক হয়ে যাবে।
কিন্তু যার ডান হাতের চারটে আঙুল নেই, সে কি কাজ করবে?
শিবানী বললেন, তোমার দাদা আর চৌধুরিদা যখন আছেন তখন তুমি অত ভাবছ কেন?
এই তিনমাস হাসপাতালে আসা যাওয়া করার জন্য বিহারীর স্ত্রী মিস্টার সরকারের সামনে একটু আধটু কথাবার্তা বলেন। বলতেই হয়। না বললে চলে না। উনি বিহারীকে বললেন, চৌধুরি সাহেব আর দাদা-বউদি যখন আছেন তখন আমিই সংসার চালিয়ে নেব তোমাকে কিছু করতে হবে না।
আমাকে যমের দুয়ার থেকে ফিরিয়ে আনতে ওঁরা যা করলেন, তার কোনোই তুলনা হয় না। ওঁরা আর কত করবেন?
.
চৌধুরিদের পুরনো গ্যারেজ আর ড্রাইভারের থাকার ঘর মেরামত হল। সামনের দিকে ছোট মুদিখানা দোকান বিহারীলাল স্টোর্স তার পিছনেই ওদের থাকার ব্যবস্থা। বিহারীর ছেলে সন্তোষ ক্লাস টেন-এ উঠেছে। ও আগের মতনই পড়তে লাগল। বিহারী দোকান চালায়। ওর স্ত্রী সংসার চালায় আর স্বামীকে দেখে। বিহারীর মেয়ে কালীকে শিবানী নিজের কাছে নিয়ে এলেন।
মিস্টার সরকার বললেন, যাই বলো বিহারী, তোমার মেয়ে এমন কিছু কালো নয় যে ওকে কালী বলে ডাকতে হবে।
দাদা, ও কালো না?
না, ও শ্যামবর্ণ।
বিহারী হেসে বলে, কালী যদি শ্যামবর্ণ হয়, তাহলে আমি ফরসা।
কালী একটা সোনার টুকরো মেয়ে। তাই আমি ওর নাম দিয়েছি সোনালী।