শিবানী ঘুরে দাঁড়িয়ে অজয়ের দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞাসা করলেন, তোমার এক লাখ টাকাই আনব?
না, না, হাজার খানেক।
শিবানী মীনার দিকে তাকিয়ে বললেন, জানো দিদি, তোমাদের এই জামাই গতবার কলকাতায় এসে কি রকম ফোর-টোয়েন্টি করে আমার…
ডার্লিং তুমি সে টাকা এখনও পাওনি? আমি তো ফিরে গিয়েই তোমাকে চেক পাঠিয়েছিলাম।
ব্যাঙ্ক অফ বে অফ বেঙ্গলের চেক আমার দরকার নেই।
শিবানীর কথায় সবাই হেসে উঠলেন।
.
আস্তে আস্তে সবাই চলে গেলেন। সবার পৌঁছনোর সংবাদও এলো। সবাই চিঠিতে বিহারীর কথা লিখেছেন।
কদিন পরে শিবানী ওকে বললেন, বিহারী, চিঠিতে সবাই তোমার কথা লিখেছেন। মীনাদি আর অজয় লিখেছে তোমাকে নিয়ে ওদের ওখানে ঘুরে আসতে।
সত্যি বউদি, একবার ঘুরে এলে হয়।
ওরা এত করে বলেছে যে না গেলে অত্যন্ত অন্যায় হবে।
যাইহোক, খোকনের অন্নপ্রাশনের জন্য আপনাদের সব আত্মীয়স্বজনের সঙ্গে বেশ আলাপ-পরিচয় হয়ে গেল।
তোমাকে তো সবারই খুব ভালো লেগেছে।
ভালো কথা বউদি, আপনাদের আত্মীয়স্বজনের কাছ থেকে আমার কত আয় হয়েছে জানেন?
আয় হয়েছে নাকি? কত?
তিনশো দশ টাকা পেয়েছি।
দেড়শো টাকা ব্যাঙ্কে জমা দিয়ে দিও।
না বউদি, এ টাকা থেকে কিছুই ব্যাঙ্কে রাখতে পারব না!
কেন?
সন্তোষের বইপত্তর কিনতে হবে, তাছাড়া এবার শীতে লেপতোষক না করালে…
পুরো টাকাই লাগবে?
হ্যাঁ বউদি।
ঠিক আছে, আমি তোমাকে একশো টাকা দেব। এই একশো টাকা ব্যাঙ্কে রেখে দেবে।
আপনাদের দয়ায় খেয়ে-পরে বেঁচে আছি। আপনি আবার টাকা দেবেন কেন?
খোকনের অন্নপ্রাশনে এত খাটা-খাটনি করলে…
দাদা তো আমাকে ধুতি-সার্ট কিনে দিয়েছেন। আবার…
এত বড় একটা কাজ তুমি উদ্ধার করে দিলে আর তোমাকে কিছুই দেবো না? তাই কী
দুদিন পরে বিহারী বলল, বউদি, ব্যাঙ্কে আমার কত জমেছে জানেন?
কত?
চোদ্দশো পঞ্চাশ।
এর একটি পয়সাতেও তুমি হাত দেবে না।
বিহারী হাসে।
সেদিন রাত্রে শুয়ে শুয়ে ওরা স্বামী-স্ত্রী খোকনের অন্নপ্রাশনের কথাই আলোচনা করছিলেন।
জানো শিবানী, আমি ভীষণ নার্ভাস ছিলাম।
কেন?
এত লোকজন নেমন্তন্ন করে যদি কোন কেলেঙ্কারি হয়, সেই ভেবেই আমি মনে মনে খুব নার্ভাস ছিলাম।
আর আমরা নেমন্তন্ন করতে তো কাউকে বাদ দিইনি।
বন্ধু-বান্ধব, আত্মীয়স্বজন, অফিসের লোকজন–এদের তো বাদ দেওয়া যায় না।
যাইহোক, বেশ ভালয় ভালয় সব হয়ে গেল।
তবে হ্যাটস অফ টু চৌধুরী আর বিহারী।
চৌধুরীদা বড় বাড়ির ছেলে। অনেক কাজকর্মের অভিজ্ঞতা থাকা স্বাভাবিক কিন্তু বিহারী যে এসব কাজেও এত এক্সপার্ট তা আমি ভাবতে পারিনি।
আমিও কল্পনা করতে পারিনি।
আমি ওকে একশো টাকা দিয়েছি।
খুব ভালো করেছ। ও ডেকরেটর আর মিষ্টির দোকানের বিল থেকে কত টাকা বাঁচিয়েছে জানো?
কত?
দুশো পঁচাত্তর টাকা।
তুমি হলে একটা পয়সাও বাঁচাতে পারতে না।
অসম্ভব।
তাছাড়া বিহারী খোকনকে কি দারুণ ভালোবাসে, তোমাকে কী বলব।
হ্যাঁ, খোকনও ওর খুব ভক্ত হয়ে উঠেছে। আই মাস্ট ডু সামথিং ফর বিহারী।
কি করবে?
আমাদের অফিসের সব ড্রাইভারের অ্যাকসিডেন্ট ইন্সিওরেন্স আছে। অফিসই প্রিমিয়াম দেয়। অফিসারদের ড্রাইভারদের অ্যাকসিডেন্ট ইন্সিওরেন্স করলে অফিস থেকে অর্ধেক প্রিমিয়াম দেবে।
তাই নাকি?
হ্যাঁ। ভাবছি, বাকি অর্ধেক প্রিমিয়াম আমি দিয়ে ওরও একটা…
খুব ভালো হবে। হাজার হোত কলকাতা শহরে ড্রাইভারী করা! কখন কি হয় কিছুই বলা যায় না।
তা তো বটেই।
.
দেখতে দেখতে খোকন তিন বছরের হল। বিহারী কদিন আসছে না। খোকনকে রোজ বিকেলে গাড়িতে বসাতেই হবে। ও স্টিয়ারিং নেড়ে-চেড়ে ঘণ্টা দুই কাটিয়ে দেয়।
সেদিন বিকেলে মিস্টার সরকার অফিস থেকে ফিরতেই শিবানী বললেন, জানো একটু আগে বিহারী এসে খবর দিয়ে গেল ওর একটা মেয়ে হয়েছে।
তাই নাকি?
হ্যাঁ। বিহারী খুব খুশি।
ছেলেটা এত বড় হবার পর মেয়ে হল, খুশি হবারই তো কথা। খোকন আরো একটু বড় হবার পর তোমার একটা মেয়ে হলে আমিও কি কম খুশি হবো?
এত সব খায় না।
খায় না মানে? আমাদের একটা মেয়ে হবে না?
একটা হবার ঠেলাতেই আমার জান বেরিয়ে গেছে। ন্যাড়া বেলতলায় বার বার যায় না।
তাই বলে…
ন্যাকামি কোরো না। ওই কষ্ট আমি আর সহ্য করতে পারব না।
খুব কষ্ট হয়? কষ্ট হবে কেন? এত আরাম লাগে যে…
শিবানী চলে গেলেন।
পরে চা খাবার সময় মিস্টার সরকার বললেন, শিবানী বিহারীর মেয়েকে একদিন দেখে এসো।
তুমি যাবে না?
না, না, আমি গেলে ওর স্ত্রী লজ্জা পাবে।
তা ঠিক।
দাদা কাল আপনি ট্যাক্সিতে অফিস যাবেন!
মিস্টার সরকার অবাক হয়ে জিজ্ঞাসা করলেন, কেন? গাড়ির ফুয়েল পাম্প কি আবার গণ্ডগোল করছে?
বিহারী নির্মম ঔদাসীন্যের সঙ্গে বলল, গাড়ি ঠিকই আছে।…
তবে?
কাল খোনকে পোলিও ভ্যাকসিন দেবার জন্য…
মিস্টার সরকার জানেন বিহারীর এসব সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করার কোন ফল নেই। তাই বললেন, ঠিক আছে।
খোকনের সঙ্গে বিহারীর খুব ভাব। মাত্র কমাসের শিশু হলেও বিহারীকে দেখলেই ও হাসবে, কোলে চড়ার জন্য হাত বাড়িয়ে দেবে।
খোকনকে কোলে নিয়ে ঘুরতে ঘুরতে বিহারী শিবানীকে বলে, জানেন বউদি, আমি গত জন্মে খোকনের কাছে গাড়ি চালানো শিখেছিলাম।
শিবানী হাসতে হাসতে বলেন, তাই নাকি?
তাইতো এবার আমি ওকে গাড়ি চালানো শেখাব।