সোনালী বলল, তোমার কি এমন পাকা ধানে মই দিয়েছি যে তুমি আমাকে তাড়াতে চাও?
খোকনের মা সোনালীর দিকে তাকিয়ে বললেন, দু-এক বছর পরে সত্যি তোর বিয়ের কথা ভাবতে হবে।
খোকন মুহূর্তের জন্য সোনালীকে একবার ভালো করে দেখেই বলল, দু-এক বছর দেরি করারই বা দরকার কী?
সোনালী গম্ভীর হয়ে বলল, আমার ব্যাপারে তোমাকে মাথা ঘামাতে হবে না।
খোকনের মা বললেন, খোকন যাই বলুক না কেন, এবার সত্যিই তোর বিয়ের কথা ভাবতে হবে।
সোনালী কোনো কথা না বলে লজ্জায় ঘর থেকে বেরিয়ে গেল।
২. পঁচিশ বছর আগেকার কথা
পঁচিশ বছর আগেকার কথা।
মিস্টার সরকার অফিস থেকে বাড়িতে ফিরেই স্ত্রীকে বললেন, শিবানী একটা খবর আছে।
স্বামীর গলার টাই খুলে দিতে দিতে শিবানী জিজ্ঞাসা করলেন, আবার বদলী নাকি?
না।
তবে আবার কি খবর?
মিস্টার সরকার দুহাত দিয়ে স্ত্রীর কোমর জড়িয়ে ধরে হাসতে হাসতে বললেন, যদি বলতে পারো তাহলে তোমাকে এক সপ্তাহের জন্য দার্জিলিং ঘুরিয়ে আনব।
এই বর্ষায় আমি দার্জিলিং যাচ্ছি না।
কেন?
আমি কি পাগল যে এই বর্ষায় দার্জিলিং যাব?
বর্ষাতেই তো দার্জিলিং যেতে হয়। শহরে কোন জানাশুনা লোক দেখা যাবে না। সারাদিন বেশ ঘরের মধ্যে…
অসভ্যতা না করে খবরটা বলো।
অফিস থেকে গাড়ি কিনতে বলেছে।
গাড়ি কিনতে বলেছে মানে?
মানে গাড়ি কেনার টাকা দেবে, মাসে মাসে আড়াইশো টাকা কেটে নেবে।
আর অ্যালাউন্স তো দেবে?
তা তো দেবেই।
তবে তোমাকে আমি গাড়ি চালাতে দিচ্ছি না।
তোমাকে চালাতে পারছি আর গাড়ি চালাতে পারব না?
স্বামীর জামার বোতাম খুলতে খুলতে শিবানী জিজ্ঞাসা করলেন, কবে গাড়ি কিনতে হবে?
এই মাসের মধ্যেই কিনতে হবে!
কি গাড়ি কিনবে?
তুমি বলো।
অস্টিন। ঘোটর মধ্যে ভারি সুন্দর গাড়ি।
তোমার দাদার অস্টিন আছে বলে কি আমাকেও অস্টিনই কিনতে হবে?
এই পৃথিবীতে যেন আমার দাদাই একমাত্র অস্টিন চড়েন!
আমিও অস্টিন কিনব ভেবেছি!
আজে-বাজে রঙের গাড়ি নিও না।
তুমি কি রঙের চাও?
স্টিল গ্রে।
.
নমস্কার স্যার। আমাকে চৌধুরী সাহেব…
তোমার নামই কি বিহারীলাল দাস?
হ্যাঁ স্যার।
চৌধুরী তো তোমার প্রশংসায় পঞ্চমুখ।
কৃতার্থের হাসি হেসে বিহারী বলল, ওঁদের বাড়ির সবাই আমাকে খুব স্নেহ করেন।
তাই বলছিল বটে।
আমার বাবা চৌধুরী সাহেবের বাবার গাড়ি চালাতেন। আর চৌধুরী সাহেব তো আমার কাছেই গাড়ি চালানো শিখেছেন।
শিবানী বললেন, এই সাহেবকে স্টিয়ারিং ধরতে দেবে না।
বিহারী হাসে।
না না হাসির কথা নয়।
কিন্তু সাহেব যদি বলেন?
সাহেব কান্নাকাটি করলেও দেবে না।
শিবানীর কথায় শুধু বিহারী না মিস্টার সরকারও হাসেন।
হাসি থামলে মিস্টার সরকার বিহারীর দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞাসা করলেন, মাইনে-টাইনে কাজকর্মের ব্যাপারে চৌধুরী যা বলেছে তাতে আপত্তি নেই তো?
না স্যার।
সোমবার আমার গাড়ির ডেলিভারী পাব।
আমি কখন আসব স্যার?
সকাল নটা-সাড়ে নটার মধ্যে এসো।
বিহারী দুজনকে নমস্কার জানিয়ে চলে গেল।
সরকার দম্পতির জীবনে বিহারীলাল দাসের সেই প্রথম আবির্ভাব।
বছর ঘুরে পূজা এলো। শিবানী মিস্টার সরকারকে জিজ্ঞাসা করলেন, হ্যাঁগো বিহারীকে একটা ধুতি-পাঞ্জাবি দেবে না?
ও তো অফিস থেকে মাইনে পাবে।
তা পাক। হাজার হোক তোমাকে দাদা বলে ডাকে, আমাকে বউদি বলে। আমাদেরও তো একটা কর্তব্য আছে।
মিস্টার সরকার ও-কথার কোনো জবাব না দিয়ে জিজ্ঞাসা করলেন, পূজায় তুমি আমাকে কি দিচ্ছ?
শিবানী স্বামীর কানে কানে বলল, অনেক অনেক ভালোবাসা।
বিহারী সত্যিই বড় ভালো মানুষ। সব সময় মুখে হাসি লেগে আছে। কোন সময় কাজে বলে না। সর্বোপরি অত্যন্ত সৎ লোক।
বউদি!
কি বিহারী?
একটা ভীষণ অন্যায় হয়ে গেছে।
মিসেস সরকার হেসে জিজ্ঞাসা করেন, তোমার না আমার?
আপনি কেন অন্যায় করবেন? আমারই অন্যায় হয়েছে।
কি হয়েছে?
শনিবার আপনাদের সিনেমার টিকিট কেটে বাকি পয়সা ফেরৎ দিতে ভুলে গিয়েছিলাম।
বিহারী একটা টাকা আর কিছু খুচরো পয়সা এগিয়ে দিতে গেলেও মিসেস সরকার নিলেন না। বললেন, এত বড় অন্যায় যখন করেছ তখন তোমাকে কিছু খেসারত দিতে হবে।
বলুন বউদি।
আমাকে একটু ঢাকুরিয়া নিয়ে যেতে হবে।
বিহারী এক গাল হাসি হেসে বলল, এ খেসারত দিতে তো আমি সব সময় প্রস্তুত।
মিসেস সরকার ঘুরে দাঁড়াতেই বিহারী বলল, বউদি পয়সাটা নিলেন না?
না।
ঢাকুরিয়া যাবার পথে বিহারী গাড়ি চালাতে চালাতেই মিসেস সরকারকে বলে, বউদি প্রায় তিন বছর গাড়ি কেনা হয়েছে কিন্তু একবারও আপনারা গাড়ি নিয়ে বাইরে কোথাও গেলেন না।
তোমার দাদার বলে সময় হয় না।
সামনের সপ্তাহেই তো দাদার তিন দিন ছুটি।
কেন?
অ্যানুয়াল কনফারেন্সের জন্য বেশি খাটতে হয়েছে বলে সামনের সপ্তাহে দাদার ডিপার্টমেন্টের সব অফিসারদের তিন দিন ছুটি।
ছুটির কথা তোমাকে কে বলল?
অফিসেই শুনেছি।
আজ?
আজ না। কনফারেন্স শেষ হবার দিনই সব অফিসারদের বলে দেওয়া হয়েছে।
অথচ তোমার দাদা আমাকে কিছুই জানাননি।
হয়তো ভুলে গিয়েছেন।
তোমার দাদার সব কথা মনে থাকে। শুধু ছুটির কথা বলতেই ভুলে যান।
বিহারী হাসে।
একটু চুপ করে থাকার পর মিসেস সরকার জিজ্ঞাসা করেন, সামনের সপ্তাহে কোন তিন দিন ছুটি জানো?
বৃহস্পতি-শুক্র-শনি।
তার মানে তো চার দিন ছুটি!