লজ্জায় সোনালী প্রায় দৌড়ে ঘর থেকে বেরিয়ে গেল।
.
পরীক্ষা দিয়ে ফিরতেই হাওড়া স্টেশনে সোনালীকে একলা দেখে খোকন অবাক। জিজ্ঞাসা করল, কিরে মা আসেনি?
না।
তুই একলা এসেছিস?
হ্যাঁ।
মা এলেন না কেন?
আমি বারণ করলাম।
কেন?
তোমার সঙ্গে ঝগড়া করব বলে।
ঝগড়া!
তুমি যেন গাছ থেকে পড়লে মনে হচ্ছে।
কিন্তু…
এই দুমাসের মধ্যে আমাকে একটা চিঠি দাওনি কেন?
খোকন সোনালীর কানের কাছে মুখ নিয়ে ফিস ফিস করে বলল, তোকে আজ দারুণ দেখাচ্ছে!
আঃ! কি বাজে বকছ!
স্টেশন থেকে বাইরে বেরিয়ে এসেই খোকন বলল, চল সোনালী রিকশা করে বাড়ি যাই।
তোমার কি মাথা খারাপ হয়েছে?
রিকশায় গেলে বেশ প্রাণভরে আড্ডা দেওয়া যাবে।
তুমি রিকশায় এসো। আমি ট্রামে-বাসে ফিরে গিয়ে বড়মাকে খবরটা দিই।
ট্যাক্সিতে উঠেই সোনালী বলল, তোমার চেহারাটা দারুণ খারাপ হয়ে গেছে।
হবে না? একে পড়াশুনোর চাপ, তার উপর তোর চিন্তা।
বড়মা জিজ্ঞাসা করলেও এই জবাব দেবে তো?
খোকন হাসে।
ছুটির দিনগুলো আনন্দে, হৈ-হুঁল্লোড় করে প্রায় ঝড়ের বেগে ফুরিয়ে গেল।
রেজাল্ট বেরুবার দিন বাড়িতে আনন্দের বন্যা বয়ে গেল।
বিহারী ছুটতে ছুটতে এসে খোনকে জড়িয়ে ধরে বলল, খোকনদা এখন আমি মরলেও আমার কোনো দুঃখ থাকবে না।
কে তোমাকে মরতে দিচ্ছে?
তোর অনুমতি নিয়ে আমাকে মরতে হবে?
একশো বার!
.
রেজাল্ট বেরুবার এক মাসের মধ্যেই খোকন বাঙ্গালোরে বারোশো টাকা মাইনের চাকরি পেয়ে গেল। সবাই খুশি, সবাই আনন্দিত কিন্তু খোনকে দেখে খুশি হওয়া তো দূরের কথা, বেশ চিন্তিত মনে হয়!
শিবানী খোকনের মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে দিতে জিজ্ঞাসা করলেন, কিরে, তুই এত কি ভাবছিস?
কিছু না।
কিছু না বললেই আমি শুনব! আজ কদিন ধরে সব সময় চুপচাপ বসে আছিস। কি হয়েছে তোর?
সত্যি বলছি কিছু হয়নি।
রাত্রে সবাই শুয়ে পড়ার পর সোনালী আস্তে আস্তে খোকনের ঘরে এসে ওর পাশে বসল। একটু চুপ করে থাকার পর বলল, তোমাকে এমন চিন্তিত থাকতে দেখে জ্যাঠামণি ভীষণ চিন্তিত।
খোকন কোন কথা বলে না।
তুমি আমাকেও কিছু বলবে না?
কি বলব বল।
তুমি এত কি ভাবছ?
কি আর ভাবব? ভাবছি তোর কথা।
সোনালী আর কোনো প্রশ্ন করতে পারল না।
.
খোকনের বাঙ্গালোর রওনা হবার আগের রবিবারের কথা। সোনালী বন্ধুদের সঙ্গে সিনেমায় গেছে। খোকন ওর বাবা মার ঘরে ঢুকেই মুখ নীচু করে বলল, একটা কথা বলতাম।
ওর মা একটু হাসতে হাসতে বললেন, তা এমন করে বলছিস কেন?
খোকন মুখ নীচু করেই বলল, আমি সোনালীকে বিয়ে করব।
মিস্টার সরকার পাগলের মতন চিৎকার করে উঠলেন, ননসেন্স! ভাই-বোনে কখনো বিয়ে হয়?
শিবানী তাড়াতাড়ি খোকনের হাত দুটো জড়িয়ে ধরে বললেন, তোর কি মাথা খারাপ হয়েছে?
খোকন জিজ্ঞাসা করল, তোমাদের মতামত বলবে না?
মিস্টার সরকার আবার গর্জে উঠলেন, রাসকেল, গেট আউট। এক্ষুনি বেরিয়ে যা হতভাগা!
শিবানী দুহাত দিয়ে ছেলেকে বুকের মধ্যে জড়িয়ে ধরে উত্তেজনায় কাঁপতে কাঁপতে বললেন, হাজার হোক সোনালী একটা ড্রাইভারের মেয়ে…
খোকন পাগলের মতো হো হো করে হাসতে হাসতে বলল, মা! ওয়ান্ডারফুল! ওয়ান্ডারফুল! আমি ভুলে গিয়েছিলাম, সোনালী বিহারী ড্রাইভারের মেয়ে!
.
খোকনের পৌঁছনোর সংবাদ আসার পর কলকাতা থেকে ওরা তিনজনেই চিঠি দিলেন কিন্তু তার কোনো উত্তর এল না। মিস্টার সরকার টেলিগ্রাম করে ওর খবর জানতে চাইলেন।
ঠিক দুদিন পরের কথা।
এগারোটা বাজতে না বাজতেই মিস্টার সরকার অফিস থেকে ফিরে এসেই বাচ্চা ছেলের মতন কাঁদতে কাঁদতে বললেন, শিবানী, খোকন পাগল হয়ে গেছে!
পাগল!
হ্যাঁ।
ছোট্ট শিশুর মতন হাউ হাউ করে কাঁদতে কাঁদতে মিস্টার সরকার টেলিগ্রামটা শিবানীর দিকে ছুঁড়ে দিলেন।
পাশের ঘর থেকে সোনালী উন্মাদিনীর মতন চিৎকার করে উঠল, খোকনদা!