সোনালী মাথা দুলিয়ে বলল, আমি অত জানি না।
জানিস না?
না। সোনালী ওর হাত দুটো টেনে বলল, হাত খোলল। চা করব।
চা করতে হবে না।
এক মিনিট আগেই বললে চা কর। আবার…
আগে আমাকে একটু আদর কর।
অসভ্যতা কোরো না। তুমি হাত খোলো।
আগে আমাকে একটু আদর কর। তা না হলে আমি হাত খুলছি না।
অসভ্যতা কোরো না খোকনদা। তুমি আমাকে ছেড়ে দাও। আমার অনেক কাজ আছে।
একটু আদর না করলে আমি ছাড়ছি না।
আমি আদর করতে জানি না।
জানিস না?
না।
আমাকে আদর করতে ইচ্ছে করে না?
বাজে বকবে না। তুমি এই পাঁচ বছর হোস্টেলে থেকে অত্যন্ত অসভ্য হয়ে গেছ।
তাই নাকি?
আজ্ঞে হ্যাঁ। তুমি কি ভেবেছ আমি কিছুই বুঝি না? আমিও দুদিন পর বি-এ পরীক্ষা দেবো।
আমি কী অসভ্যতা করলাম?
সব বলা যায় না।
এমন অসভ্যতা করেছি যে বলাই যায় না?
তোমাদের মতন হোস্টেলের ছেলেদের কাছে এসব অসভ্যতা না হলেও…
কি সব অসভ্যতা?
বলেছি তো আমি সবকিছু খুলে বলতে পারব না। তুমি আমাকে ছেড়ে দাও।
খোকন একটু হেসে ওকে ছেড়ে দিল। বলল, তুই ঠাট্টা-ইয়ার্কি বুঝিস না সব ব্যাপারেই তুই বড্ড সিরিয়াস।
সোনালী ড্রইংরুম থেকে বেরুতে বেরুতে বলল, এ ধরনের ঠাট্টা-ইয়ার্কি তুমি আমার সঙ্গে করবে না।
আচ্ছা তুই চা কর।
পারব না।
চা খাওয়াবি না?
না।
কাল চলে যাবার পর যখন…
আমার কিছু মন খারাপ হবে না। তুমি আজই চলে যাও।
কিন্তু আমার যে ভীষণ চা খেতে ইচ্ছে করছে।
শুধু চা কেন, আরও অনেক কিছু খেতেই তোমার ইচ্ছে করছে কিন্তু আমার দ্বারা কিছু হবে না।
চা খাওয়াবি না?
তুমি আমার সঙ্গে বকবক কোরো না। সোনালী এবার আপন মনেই বলে, হাজার কাপ চা খাইয়েও তোমার মন ভরবে না। একটু আগেই তোমার যে মূর্তি দেখেছি তাতে আমার আর কিছু বুঝতে বাকি নেই।
খোকন ওর কথার কোনো জবাব না দিয়ে নিজের ঘরে গেল। প্যান্ট-বুশসার্ট পরে বেরুবার সময় বলল, আমার ফিরতে রাত হবে।
আমি একলা একলা থাকব?
খোকন চলে গেল।
সোনালী দরজা বন্ধ করে অনেকক্ষণ চুপ করে বসে রইল। ভাবছিল নানাকথা। খোকনদার কি মাথা খারাপ হয়েছে? ও কেন এমন পাগলামি করে? তাছাড়া আমার সঙ্গে কি ওর এই পাগলামি করার সম্পর্ক?
সোনালী খোকনের কথা ভাবতে ভাবতেই রান্নাঘরের কাজ শেষ করল। তারপর নিজের ঘরে এলো। বসল। সঙ্গে সঙ্গেই উঠে খোকনের সঙ্গে গার্ডেনে তোলা ওদের দুজনের ছবিটার দিকে মুগ্ধ হয়ে তাকিয়ে রইল। ঘড়িতে ঢং ঢং করে দশটা বাজতেই সোনালী চমকে উঠল। মনে মনে একটু ভয় পেল। তাছাড়া হঠাৎ খোকনের জন্য মনটা বড় চঞ্চল হয়ে উঠল। জানালা দিয়ে অনেকক্ষণ রাস্তার দিকে তাকিয়ে রইল। না খোকন আসছে না। এক এক মিনিট এক এক ঘণ্টা মনে হয়। সোনালী ছটফট করে। ঘড়িতে সাড়ে দশটার ঘণ্টা বাজতেই ওর কান্না পায়।
সোয়া এগারটার সময় খোকন আসতেই সোনালী আর কান্না চেপে রাখতে পারে না। অঝোরে কাঁদে। কাঁদতে কাঁদতেই বলে, এভাবে আমাকে একলা রেখে যাবার কোন মানে হয়? আমি ভয় ভাবনায় মরে যাচ্ছিলাম।
খোকন শুধু বলল, কাদিস না। আমার ঘরে আয়। কথা আছে।
আমাকে একলা রেখে তুমি এতরাত পর্যন্ত কেন বাইরে ছিলে, আগে সেকথা বলো।
সত্যি অন্যায় হয়েছে। তুমি আমাকে ক্ষমা কর।
খোকনের কথা শুনে সোনালী চমকে ওঠে। বলে, তুমি এভাবে কথা বলছ কেন খোকনদা?
খোকন নিজের ঘরে ঢুকতে ঢুকতে বলল, অন্যায় করেছি, ক্ষমা চাইব না?
সোনালী ওর পিছন পিছন ওর ঘরে ঢুকে জিজ্ঞাসা করল, তোমার কী হয়েছে বলো তো?
কি আবার হবে? কিচ্ছু হয়নি।
সোনালী খোকনের কপাল থেকে চুলগুলো সরিয়ে দিতে দিতে বলল, আমাকেও বলবে না? আমি না তোমার সোনা, সোনালী?
খোকন আর চুপ করে থাকতে পারে না। দুহাত দিয়ে ওর কোমর জড়িয়ে বুকের ওপর। মাথা রেখে কাঁদতে কাঁদতে বলল, সোনালী, তোকে ছাড়া আমি বাঁচব না।
আমি কি মরে যাচ্ছি যে তুমি একথা বলছ?
না, না সোনালী, তোকে আমি হারাতে পারব না। কোনোদিন না। সোনালী আঁচল দিয়ে ওর চোখের জল মুছিয়ে দিতে দিতে বলে, আমি কোথায় হারিয়ে যাচ্ছি যে তুমি এমন করে কাঁদছ?
খোকন মুখ তুলে ওর মুখের দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞাসা করল, তুই আমাকে ভালোবাসিস না?
নিশ্চয়ই ভালোবাসি।
খুব ভালোবাসিস?
মনে তো হয়।
তুই আমাকে বিয়ে করতে…
সোনালী সঙ্গে সঙ্গে একটা হাত দিয়ে ওর মুখ চেপে ধরে বলে, খোকনদা!
সোনালীর হাত সরিয়ে খোকন বলল, আমি কি খুব অন্যায় কথা বললাম?
সোনালী কাঁদতে কাঁদতে বলল, আমি জানি না খোকনদা। তুমি আমাকে এসব প্রশ্ন কোরো না।
খোকন নিজেকে একটু সামলে নিয়ে বলল, আমার পাশে একটু বসবি?
সোনালী কোন জবাব না দিয়ে পাশে বসল।
তুই আমার জন্য খুব ভাবছিলি?
ভাবব না?
কি ভাবছিলি?
অনেক রকম আজেবাজে চিন্তা হচ্ছিল।
আজেবাজে মানে?
ভাবছিলাম কোনো বিপদে পড়লে কিনা।
খোকন একটু থেমে জিজ্ঞাসা করল, আমি তো কাল চলে যাচ্ছি। চিঠি লিখবি তো?
তুমি চিঠি লিখলেই জবাব দেবে।
না, এবার তুই আগে লিখবি।
কেন?
আমি যে প্রশ্ন করলাম, তার জবাব দিবি।
না, না খোকনদা, ওসব কথা আমি লিখতে পারব না!
কিন্তু আমি যে তোর জবাব না পেলে শান্তিতে পরীক্ষা দিতে পারব না।
মনে রেখো এবার ফাইন্যাল পরীক্ষা।
তাই তো বলছিলাম…
ওসব পাগলামি ছাড়ো। পরীক্ষার রেজাল্ট খারাপ হলে আমি আর তোমাকে ভালোবাসব না।
খোকন সোনালীর মুখের সামনে মুখ নিয়ে হাসতে হাসতে প্রশ্ন করল, পরীক্ষার রেজাল্ট যদি ভালো হয়, তাহলে আপত্তি করবি না তো?