তাহলে তো আজ জোর আড্ডা হবে।
না, না, তুমি এত ঘোরাঘুরি করে এসেছ, তুমি নিশ্চয়ই ঘুমোবে।
গল্প করলে আমার ঘুম আসে না।
তুমি শোও। আমি তোমাকে ঘুম পাড়িয়ে দিচ্ছি। সোনালী একটু থেমে, একটু হেসে বলল, কাল রাত্রে তুমি আমাকে যা দিয়েছ, তার কিছু প্রতিদান আজ দিই।
সে রাত্রে খোকন সত্যি ঘুমিয়ে পড়ে।
এরপর যখন খোকন ছুটিতে এসেছে তখনই কথায় কথায় বলেছে মা, সোনালী যদি পাঁচ মিনিটের মধ্যে আমাকে চা না দেয় তাহলে পুরীর ওই ভদ্রলোকের ছেলে ক্যাবলার সঙ্গেই আমি…
সোনালী দুম দুম করে খোকনের পিঠে দুটো-তিনটে ঘুষি মেরে বলে, ক্যাবলার বোনের সঙ্গে তোমার বিয়ে দেবো।
বিহাইকাকা বলেছিল ক্যাবলা ছেলেটি বেশ ভালো। মল্লিক বাজারে মোটরের চোরাই পার্টস বিক্রি করে বেশ টু পাইস…
আর কেবলি বুঝি তোমার সঙ্গে আই-আই টিতে পড়ে?
তবে ক্যাবলা জামাই হলে বাবা নিশ্চয়ই ওকে অফিসের জমাদার করে নেবে।
সোনালী বাচ্চাদের মতন চিৎকার করে, খোকনদা!
শিবানী আর শুয়ে থাকতে পারে না। উঠে এসে বললেন, তোদের জ্বালায় কোনোদিন দুপুরে আমার বিশ্রাম করার উপায় নেই।
দ্যাখো না বড়মা…
ওকে এক কাপ চা করে দিলেই তো…
কিন্তু আমাকে যা তা বলছে কেন?
খোকন…তুই বড্ড ওর পিছনে লাগিস।
খোকন ফিরে যাবার দু-এক দিন আগে সব ঝগড়া হঠাৎ থেমে যায়।
জানিস সোনালী, হোস্টেলে এমনি বেশ ভালোই থাকি কিন্তু ছুটির পর ফিরে গিয়ে কিছুদিন বড্ড খারাপ লাগে।
সত্যি বলছ, নাকি আমাকে খুশি করার জন্য বলছ?
সত্যি বলছি। হোস্টেলে পড়াশুনা ইয়ার্কি-বাঁদরামি করে দিনগুলো ভালোই কাটে, তবে এখন ফিরে গিয়ে মাসখানেক শুধু এখানকার কথা মনে পড়বে।
আমার কথা মনে পড়ে?
খোকন সিগারেট টানতে টানতে শুধু মাথা নাড়ে।
কি মনে হয়?
খোকন দু-এক মিনিট কি যেন ভাবে। তারপর আস্তে আস্তে দৃষ্টিটা বাইরের দিকে ঘুরিয়ে যেন আপন মনেই বলে, তোর কথা খুব বেশি মনে হয়।
কেন?
খোকন যেন ওর কথা শুনতে পায় না। বলে, তোকে নিয়ে অনেক কথা ভাবি।
আমাকে নিয়ে এত কী ভাবে খোকনদা?
ও একটা দীর্ঘনিশ্বাস ফেলে বলে, সে এখন বলতে পারব না।
কেন?
খোকন ওর দিকে তাকিয়ে একটু হেসে বলে, মানুষ মনে যা কিছু ভাবে তা কি সব সময় বলতে পারে?
আমার কথা আমাকেও বলা যায় না?
খোকন আবার মাথা নাড়ল। বলল, না।
বেশ কিছুক্ষণ পরে সোনালী বলল, তুমি চলে গেলে আমারও খুব খারাপ লাগে। মনে হয় কেন তোমার সঙ্গে ঝগড়া করতাম, কেন তোমার গা টিপে দিইনি…
আর কি মনে হয়?
বাড়িটা ভীষণ ফাঁকা লাগে!
তাই নাকি?
হ্যাঁ খোকনদা। লেখাপড়া, কাজকর্ম কিছুতেই মন বসাতে পারি না।
কেন?
কেন আবার? শুধু তোমার কথা মনে হয়।
কিছুক্ষণ চুপ করে থাকার পর হঠাৎ খোকন তাকে জিজ্ঞাসা করল, তুই সত্যিই আমাদের ছেড়ে চলে যাবি?
কোথায় চলে যাব?
কোথায় আবার? বিয়ে করে চলে যাবি?
ওসব কথা আমি ভাবি না।
একেবারেই ভাবিস না?
না।
কিন্তু একদিন তো তোকে চলে যেতে হবে, তা তো জানিস?
সোনালী কোন জবাব দেয় না।
আচ্ছা সোনালী আমি যদি তোকে যেতে না দিই?
সোনালী হেসে বলে, এখানে থাকতে পারলে তো আমারই মজা।
সত্যি বল তুই থাকবি?
থাকব না কেন?
তোর আপত্তি নেই?
এখানে থাকতে আমার আবার কি আপত্তি?
মিস্টার সরকার অফিস থেকে এসে বাড়িতে ঢুকতে ঢুকতেই বললেন, শিবানী আমি একদম ভুলে গিয়েছিলাম আজই মিস্টার ব্যানার্জির মেয়ের বিয়ে।
আজই? শিবানী অবাক হয়ে জিজ্ঞাসা করলেন।
আমার একদম মনে ছিল না। তারপর ঘোষের কাছে শুনেই…
আজ তো আঠারোই। আমারও একদম খেয়াল ছিল না।
চটপট তৈরি হয়ে নাও। একটা শাড়ি কিনতে হবে তারপর মিত্তিরকে তুলে নিয়ে হাওড়া হয়ে কোন্নগর যাওয়া।
মিত্তিরের গাড়ি কি হলো?
ওর গাড়ি টিউনিং করতে গ্যারেজে দিয়েছে।
তার মানে পার্ক সার্কাস ঘুরে হাওড়া হয়ে কোন্নগর?
কি আর করা যাবে? তুমি তাড়াতাড়ি তৈরি হয়ে নাও।
কাল খোকন যাবে, আর আজ… কিন্তু ব্যানার্জির মেয়ের বিয়েতে না গিয়ে তো উপায় নেই।
তা ঠিক। শিবানী একটু ভেবে বললেন, ফিরতে ফিরতে নিশ্চয় বারোটা একটা হয়ে যাবে?
মিস্টার সরকার একটু হেসে বললেন, এখন ছটা বাজে। সাতটায় বেরিয়ে শাড়ি কিনে মিত্তিরের বাড়ি পৌঁছতেই আটটা। সোনালীর হাত থেকে চায়ের কাপ নিতে নিতে বললেন, বিয়ে বাড়ি পৌঁছতেই দশটা বেজে যাবে।
তার মানে ফিরতে ফিরতে দুটো আড়াইটে!
তবে কাল রবিবার। এই যা ভরসা।
তৈরি হয়ে সোনালীকে সব বুঝিয়ে ওদের বেরুতে বেরুতে সোয়া সাতটা হয়ে গেল।
ওরা বেরিয়ে যাবার সঙ্গে সঙ্গেই খোকন সিগারেট ধরিয়ে একটা লম্বা টান দিয়ে বলল, সোনালী, চা কর।
ও হাসতে হাসতে বলল, জ্যাঠামণি, বড়মা বেরুবার সঙ্গে সঙ্গেই বুঝি তোমার বাঁদরামি শুরু হলো?
ভালো করে সেবা-যত্ন কর; তা নইলে আমি চলে যাবার পর মনে মনে আরও কষ্ট পাবি।
অযথা এসব কথা বলে আমার মন খারাপ করে দিও না।
খোকন হঠাৎ দু হাত দিয়ে ওর গলা জড়িয়ে ধরে কপালের সঙ্গে কপাল ঠেকিয়ে বলল, আমি চলে গেলে সত্যি তোর মন খারাপ হয়?
না হবার কি আছে?
তুই আমাকে ভালোবাসিস?
তুমি জানো না?
না।
বুঝতে পারো না?
খোকন অদ্ভুতভাবে ওর দিকে তাকিয়ে শুধু মাথা নাড়ল।
তাহলে তোমার জেনে কাজ নেই।
তুই বল না আমাকে ভালোবাসিস কিনা।
ভালোবাসব না কেন?
কি রকম ভালোবাসিস?