সোনালী আর পারে না। এক মুহূর্তে কান্না থেমে যায়, অভিমান চলে যায়। হঠাৎ দু-হাত দিয়ে খোকনের কোমর জড়িয়ে ধরে ওর পায়ের উপর মাথা রেখে বলে, যেমন তুমি আমাকে দুঃখ দিয়েছ, তেমন তুমি সারা রাত এইভাবে বসে থাকবে। আমি তোমার কোলে মাথা রেখে ঘুমোব।
খোকন একটু অস্বস্তি বোধ করে কিন্তু কিছু বলতে পারে না। ওর মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে দিতে বলে, এই ভাবে সারারাত বসে থাকা যায় পাগলী?
আমি কিছু জানি না।
তুই ঠিক হয়ে বালিশে মাথা রেখে শুয়ে পড়। আমি তোকে ঘুম পাড়িয়ে দিচ্ছি।
সোনালী আরো জোরে ওকে আঁকড়ে ধরে বলে, তোমাকে আমি ছাড়ছি না। ঠিক এইভাবে বসে থাকতে হবে।
এইভাবে কি বেশিক্ষণ বসে থাকা যায়?
আমি জানি না।
তুই জানিস না?
না।
খোকন কিছু বলে না। চুপ করে বসে বসে ওর মাথায় হাত বুলিয়ে দেয়। বেশ কিছুক্ষণ কেটে গেল। বোধহয় আধঘণ্টা-পঁয়তাল্লিশ মিনিট।
সোনালী মুখ তুলে খোকনের মুখের দিকে তাকিয়ে, একটু হেসে বলল, কেমন জব্দ!
সোনালী পা-টা ব্যথা হয়ে গেছে।
হোক।
ওর কথায় খোকন না হেসে পারে না। বলে, সত্যিরে বড় ব্যথা করছে।
তোমার কথায় আমার আরো অনেক বেশি ব্যথা লেগেছিল।
সোনালী, তুই বালিশে মাথা রাখ। আমি একটু হেলান দিয়ে বসি।
তারপর তুমি পালিয়ে যাবে?
সত্যি পালাব না।
ঠিক?
আমি বলছি তো পালাব না।
কিছুক্ষণ চুপ করে থাকার পর সোনালী বলল, অনেক দিন পর তোমার কোলে মাথা রেখে শুয়েছি, তাই না খোকনদা?
হ্যাঁ, অনেক দিন পর।
আগে আমরা একসঙ্গে শুয়ে কত রাত পর্যন্ত গল্প করতাম। আর বড়মা ঘরে ঢুকলে আমরা ঘুমের ভান করতাম, তাই না?
সত্যি সেসব দিনগুলোর কথা ভাবলে ভারি মজা লাগে।
আচ্ছা খোকনদা, হোস্টেলে থাকার সময় আমার কথা তোমার মনে পড়ে?
কেন মনে পড়বে না?
কি মনে পড়ে?
অনেক কিছু।
অনেক কিছু মানে?
অনেক কিছু মানে সবকিছু। আমাদের হাসি-ঠাট্টা ঝগড়া-মারামারি…
আমি তো মাঝে মাঝে লুকিয়ে লুকিয়ে তোমার জন্য কাঁদি।
কেন?
কেন আবার? একলা একলা ভালো লাগে না বলে।
তাহলে আমি এলে ঝগড়া করিস কেন?
আমি মোটেও ঝগড়া করি না।
আবার একটু চুপচাপ।
আচ্ছা খোকনদা, আমি তোমার কোলে মাথা রেখে শুয়ে আছি বলে তোমার ভালো লাগছে না?
তোকে সব সময়ই আমার ভালো লাগে। বিশেষ করে হোস্টেলে চলে যাবার পর তোকে বোধহয় বেশি ভালোবাসতে শুরু করেছি।
সত্যি?
এখন বাবা-মার চাইতে তোর জন্য বেশি মন খারাপ লাগে।
পুরী এসে ভালোই হয়েছে, তাই না?
হ্যাঁ।
তুমি সমুদ্রে চান করবে?
করতেও পারি, ঠিক নেই। তুই তো সমুদ্রে চান করবি না বলেছিস।
না আমি সমুদ্রে চান করব না।
সত্যি সোনালী, তুই যেন হঠাৎ বড় হয়ে গেছিস।
এখন আমাকে দেখলে বেশ বড় মনে হয়, তাই না?
তা একটু হয় বৈকি।
তোমাকেও আজকাল বেশ বড় দেখায়। সোনালী একবার ওর দিকে তাকিয়ে বলল, আজকাল তোমাকে যে দেখে সেই ভালো বলে।
তুই ঠিক উল্টো কথা বললি। মেয়েরা বড় হলে ভালো দেখায়। ছেলেরা না।
আমি ঠিকই বলেছি। আমি বড় হয়েছি কিন্তু আমি যেরকম ছিলাম, সেই রকমই আছি। একটুও বদলাইনি।
অনেক বদলে গেছিস।
কি বদলেছি?
খোকন হেসে বলল, সে কথা আমি বলতে পারব না।
কেন?
কেন আবার? বলতে নেই।
সোনালী আর প্রশ্ন করে না। চুপ করে থাকে। ভাবে।
খোকনদা, আমার ভীষণ ঘুম পাচ্ছে।
ঘুমো।
সনালী খোকনের হাত দুটো চেপে ধরেছিল। আস্তে আস্তে ওর হাত দুটো আলগা হয়ে গেল। সোনালী ঘুমিয়ে পড়ল।
হঠাৎ সোনালীর ঘুম ভেঙে গেল। খোকন তখনও ওইভাবে পাশে বসে আছে!
কটা বাজে খোকনদা?
আবছা আলোয় খোকন হাতের ঘড়িটা ভালো করে দেখে বলল, সোয়া চারটে।
এ রাম! তোমাকে সারারাত জাগিয়ে রাখলাম। তুমি এখানেই শুয়ে পড়ো। আমি তোমাকে ঘুম পাড়িয়ে দিচ্ছি।
আমি আমার বিছানায় যাই।
এখানেও শোও। চিরকাল তো এক বিছানায় শুয়ে মারামারি করেছি। এখন এত লজ্জা কেন?
খোকন শুয়ে পড়ল কিন্তু এতকাল পরে সোনালীর পাশে শুয়েই ওর সারা শরীরের মধ্যে দিয়ে একটা বিদ্যুৎ তরঙ্গ বয়ে গেল।
৫. পরের দিন দুপুরে খোকন
পরের দিন দুপুরে খোকন সোফায় বসে সিগারেট টানছিল। সোনালী বিছানার উপর বসে ভাজা মশলা চিবুতে চিবুতে বলল, কাল রাত্রে তোমাকে খুব কষ্ট দিয়েছি, তাই না খোকনদা?
কষ্ট দিয়েছিস নাকি?
এক সেকেন্ডের মধ্যে তুমি ঘুমিয়ে পড়লে দেখে আমার এত কষ্ট লাগছিল যে কী বলব।
তুইও তো সঙ্গে সঙ্গে ঘুমিয়ে পড়লি।
মোটেও না। আমি আর ঘুমোইনি।
বাজে বকিস না।
সত্যি বলছি আর ঘুম এলো না।
কেন?
সোনালী একটু হেসে বলল, তুমি এমন ক্লান্ত, অসহায় হয়ে আমাকে জড়িয়ে শুয়েছিলে যে আমি তোমাকে ছেড়ে উঠতেও পারলাম না ঘুমোতেও পারলাম না।
বানিয়ে বানিয়ে আজেবাজে কথা বলবি না।
সত্যি খোকনদা, তুমি ঠিক ছোটবেলার মতন…
এই বুড়ো বয়সে ছেলেবেলার মতন…
আজ্ঞে হ্যাঁ।
খোকন মনে মনে একটু লজ্জা পায়। একটু পরে খোকন জিজ্ঞাসা করল, আমি ওইভাবে শুয়েছিলাম বলে তোর রাগ হয়নি?
রাগ হবে কেন? তবে অনেক কাল পরে তুমি আমার পাশে শুয়েছিলে বলে একটু অস্বস্তি লাগছিল।
অস্বস্তি মানে?
তোমার হাত-টাত কত ভারী, কত মোটা হয়ে গেছে।…
খোকন হাসে।
তবে তোমার গায়ে একটা ভারি সুন্দর গন্ধ আছে।
খোকন হেসে জিজ্ঞাসা করে, তাই নাকি?
সত্যি। তোমার গায়ের গন্ধ আমার খুব ভালো লাগে।
সবার গায়েই একটা গন্ধ থাকে। তোরও আছে।