মদ!
হ্যাঁ মদ। হুইস্কী, রাম।
মদের নাম রাম? সোনালী হাসতে হাসতে প্রশ্ন করে।
হাসছিস কিরে!
মদের নাম রাম শুনেও হাসব না?
সোনালীর বিছানায় পাশাপাশি বসেই ওরা চাপা গলায় কথা বলে। খোকন বলল, আমাদের হোস্টেলে মদ খাবার কথা কিভাবে বলা হয় জানিস?
কিভাবে?
বলা হয়, আজ অত নম্বর ঘরে রাম নাম।
সোনালী শুনে হাসে। তারপর জিজ্ঞাসা করে, তুমি কোনোদিন খেয়েছ নাকি?
খাইনি তবে অনেকেই জোর-জুলুম করে।
না না, তুমি কক্ষনো খাবে না। জ্যাঠামণি-বড়মা জানতে পারলে ভীষণ কেলেঙ্কারি হয়ে যাবে।
খাব না ঠিকই কিন্তু খেলেও কি ওরা জানতে পারবে?
একদিন না একদিন ঠিক জানতে পারবে।
খোকন আর একটা সিগারেট ধরিয়ে একটা টান দিয়ে বলল, দ্যাখ সোনালী, ছেলেমেয়েরা বড় হবার পর কত যে ফাজিল, কত বদ হয় তা বাবা-মারা ঠিক আন্দাজ করতে পারে না।
না, পারে আবার না?
সত্যিই পারে না। ছেলেমেয়ে সম্পর্কে বাপ-মার এমনই অন্ধ স্নেহ থাকে যে তাদের বেশি খারাপ ভাবতে পারে না।
সোনালী ভাবে।
খোকন সিগারেটে টান দিয়ে জিজ্ঞাসা করে, কি ভাবছিস?
তোমার কথা।
বেশি দূর যাবার কি দরকার? এই যে আমি আর তুই এখনও গল্প করছি বা আমি একটার পর একটা সিগারেট খাচ্ছি তা কি বাবা-মা পাশের ঘরে থেকেও জানতে পারছেন?
তা ঠিক।
তাহলে ভেবে দ্যাখ, বাড়ির বাইরে বা হোস্টেলে থেকে ছেলে-মেয়েরা কি করে তা বাবা-মা জানবে কি করে?
ঠিক বলেছ। সোনালী আবার কি যেন ভাবে। তারপর খোকনের একটা হাত ধরে বলে, তুমি আমার একটা কথা রাখবে খোকনদা?
কী কথা?
আগে বলো রাখবে কিনা।
জেনে কী করে বলব?
অসম্ভব কিছু বলব না।
তাহলে নিশ্চয়ই রাখব।
ঠিক?
আগে থেকে প্রতিজ্ঞা না করিয়ে কী কথা রাখতে হবে, সেটা তো বল।
তুমি অন্য ছেলেদের মতন খারাপ হবে না।
খোকন হেসে বলে, খারাপ হবে না মানে?
মানে এমন কিছু করবে না যাতে তোমাকে কেউ খারাপ বলে।
এ কথার কোনো মানেই হল না।
কেন?
সব কাজই একজনের কাছে ভালো, অন্যের কাছে খারাপ।
তবুও মাঝামাঝি একটা কিছু তো আছে।
সেটাও এক-এক জনের কাছে এক-এক রকম।
সোনালী খোকনকে একটা ধাক্কা দিয়ে বলে, তুমি বড় তর্ক করো।
খোকন হেসে বলে, আচ্ছা তর্ক করব না কিন্তু তুই কী করতে বারণ করেছিস, তা তো বলবি।
বলছি যে তুমি বন্ধুদের পাল্লায় পড়ে কোনোদিন মদ-টদ খাবে না।
হুজুগে পড়ে যদি কোনোদিন খাই?
হুজুগে পড়েও খাবে না।
কেন খেলে কি হয়েছে? একদিন মদ খেলেই কি আমি খারাপ হয়ে যাব?
আমি বলছি তুমি খাবে না।
তুই আমার কে যে তোর কথা আমাকে শুনতে হবে?
সোনালী চমকে উঠল, কী বললে? আমি তোমার কে?
তোর কথা শুনতেই হবে?
না। তুমি শুতে যাও, আমি এবার ঘুমোব।
সারারাত গল্প করবি না?
না, তুমি শুতে যাও।
সোনালী রাগ করে মুখোনা ঘুরিয়ে রাখে। খোকনও একটু ঝুঁকে পড়ে ওর মুখের সামনে মুখ নিয়ে জিজ্ঞাসা করে, তুই সত্যি রাগ করেছিস?
সোনালী কোনো জবাব দেয় না।
খোকন আবার জিজ্ঞাসা করে, কিরে, কথা বলবি না?
তুমি শুতে যাও।
তুই জবাব না দিলে আমি শুতে যাব না।
না রাগ করিনি, খুশি হয়েছি।
খোকন হাসে।
সোনালী রেগে যায়। বলে, আর দাঁত বের করে হাসতে হবে না।
হাসব না?
নিজের বিছানায় গিয়ে যা ইচ্ছে কর। এবার আমি শোব।
সত্যি শুবি?
হ্যাঁ।
দু-এক মিনিট চুপ করে থাকার পর খোকন নিজের বিছানায় চলে গেল।
হঠাৎ খোকনের ঘুম ভেঙে গেল। প্রথমে ঠিক বুঝতে পারল না। বেশ কিছুক্ষণ পরে বুঝল, কেউ কাঁদছে। এত রাত্রে কোথায় কে কাঁদছে, তা ভেবে পেল না। আরো ভালো করে কান পেতে শুনল। খোকন চমকে উঠল, সোনালী কাঁদছে?
তাড়াতাড়ি উঠে ওর কাছে যেতেই কান্নার শব্দ আরও স্পষ্ট হল।
খোকন ডাকল, সোনালী!
কোনো জবাব নেই।
আবার ডাকল, সোনালী কাদছিস কেন, কী হয়েছে?
সোনালী কোনো জবাব দেয় না, দিতে পারে না। উপুড় হয়ে শুয়ে আগের মতনই কাঁদে।
সোনালী, তোর শরীর খারাপ লাগছে, মাকে ডাকব?
কাঁদতে কাঁদতেই ও জবাব দিল, না, তুমি শুতে যাও।
এবার খোকন ওর পাশে বসে মাথার উপর হাত রেখে বলল, তুই কাঁদছিস আর আমি শুয়ে থাকব?
আমি তোমার কে যে আমার কান্নার জন্য তোমাকে জেগে থাকতে হবে?
এতক্ষণে ওর কান্নার কারণ বুঝতে পেরে খোকন হাসতে হাসতে বলল, হা ভগবান! তুই আমার এই কথার জন্য কাঁদছিস?
ছি, ছি, খোকনদা, তুমি ও-কথা বললে কেমন করে? এতকাল পরে তুমি জানতে চাইলে আমি তোমার কে?
খোকন ওর মাথায় পিঠে হাত বুলিয়ে দিতে দিতে বলল, আমার ওই সামান্য একটা কথার জন্য…
ওটা তোমার সামান্য কথা হল?
আচ্ছা আর ও-কথা বলব না। তুই ঠিক হয়ে শো, আমি তোকে ঘুম পাড়িয়ে দিচ্ছি।
আমার জন্য তোমাকে কিছু করতে হবে না। তুমি শুতে যাও।
তুই না ঘুমুলে আমি এখান থেকে উঠছি না।
আমি তোমার কে?
খোকন ঝুঁকে পড়ে ওর মুখের ওপর মুখ রেখে কানে কানে বলল, তুই আমার সোনা, সোনালী!
সোনালী মুখ তুলেই বলল, এখন আর গরু মেরে জুতো দান করতে হবে না।
গরু মেরে জুতো দান করছি নাকি?
এর আগে যা তা বলে এখন আর আমাকে সোনা সোনালী বলে ভোলাতে হবে না।
সত্যি বলছি তোকে ভোলাবার জন্য বলিনি। তোকে আমি কত ভালোবাসি, তা জানিস না?
হাতের বুড়ো আঙুল দেখিয়ে বলল, ঘণ্টা ভালোবাসো।
নারে সোনালী, তোকে আমি সত্যি ভালোবাসি।
মা কালীর নামে দিব্যি করে বল।
আমি মা কালীর নাম করে বলছি তোকে আমি ভালোবাসি।