খোকন কিছু বলল না, শুধু একটু হাসল।
সোনালী ওর সিগারেটের প্যাকেটটা নাড়াচাড়া করতে করতে বলল, সত্যি খোকন, তুমি কত বড় হয়ে গেছ। মনে হয় এইতো সেদিনও তুমি বাবার কাঁধে চড়ে…
তুই যে দিদিমা-ঠাকুমার মতন কথা বলছিস!
সোনালী একটু হেসে বলে, তুমি যখন এখানে থাকে না তখন সময় পেলেই আমি পুরনো অ্যালবামগুলো দেখি।…
কেন?
তোমার-আমার ছোটবেলার ছবিগুলো দেখতে মজা লাগে।
ছেলেবেলার ছবি দেখতে সবারই মজা লাগে।
আমি কি শুধু ছবি দেখি?
তবে?
যখন একলা একলা ভালো লাগে না, তখন তোমার ছবিগুলো দেখতে দেখতে তোমার সঙ্গে কত কথা বলি।
খোকন হাসতে হাসতে বলে, তুই কি পাগল নাকি?
এতে পাগলের কি আছে?
ছবির সঙ্গে কি কেউ কথা বলে?
একলা একলা ভালো না লাগলে কি করব?
তাই বলে অ্যালবামের ছবিগুলোর সঙ্গে কথা বলবি?
বলব না কেন? কিছুক্ষণ অ্যালবামের ছবিগুলো দেখার পর মনটা বেশ ভালো হয়ে যায়।
অতি উত্তম কথা।
সোনালী খোকনের একটা হাত ধরে একটু টান দিয়ে জিজ্ঞাসা করল, তারপর কি করি জানো?
কি?
তোমাকে চিঠি লিখতে বসি।
হা ভগবান!
সোনালী একটু রাগ করেই বলে, তুমি এ রকম হা ভগবীন, হা ভগবান করবে না।
করব না?
না।
তুই এত সেন্টিমেন্টাল হলে বিয়ের পর স্বামীর ঘর করবি কি করে?
তোমার মতন আমি চট করে বিয়ে করব না।
আমি বুঝি চট করে বিয়ে করতে চাই?
তোমার কথাবার্তা শুনে তাইতো মনে হয়।
খুব ভালো কথা। কিন্তু তুই বিয়ে করবি না কেন?
বিয়ে করব না, তা তো বলিনি। তাই বলে তোমার মতন আমি চটপট বিয়ে করে পালাতে চাই না।
কেন?
কেন আবার? তোমাদের ছেড়ে চলে যাবার কথা আমি ভাবতেও পারি না।
আচ্ছা সোনালী, একটা কথা বলবি?
বলব না কেন?
বাবা-মা আর আমার মধ্যে সব চাইতে কাকে বেশি ভালোবাসিস?
ওঁদের দুজনের সঙ্গে কি তোমার তুলনা হয়?
কেন হয় না?
ওঁদের একরকম ভালোবাসি, শ্রদ্ধা করি আর তোমাকে অন্য রকম ভালোবাসি, শ্রদ্ধা করি।
অন্যরকম মানে?
আমি অতশত বোঝাতে পারব না।
হঠাৎ গাড়ির গতি কমে আসতেই খোকন হাতের ঘড়ি দেখে বলল, পৌনে একটা বাজে। তোর ঘুম পাচ্ছে না?
না।
আস্তে আস্তে চলতে চলতে গাড়ি থামল।
সোনালী জিজ্ঞাসা করল, এটা কোন্ স্টেশন?
বালাশোর।
তার মানে বাংলাদেশ ছাড়িয়ে এসেছি?
হ্যাঁ।
জানলার পাশ দিয়ে চাওয়ালা যেতেই খোকন ওকে জিজ্ঞাসা করল, চা খাবি?
এত রাত্তিরে চা খাব?
চা না খেলে রাত জাগবি কিভাবে?
চায়ে চুমুক দিতেই সোনালী বলল, আমি বোধহয় জীবনে এত রাত্রে আর চা খাইনি।
জীবনে এতকাল যা করিসনি, এখন তো তাই করার বয়স আসছে।
তুমি হোস্টেলে থেকে বড় ওস্তাদ হয়েছ।
এখনও ওস্তাদ হবে না?
চা খাওয়া শেষ। গাড়িও ছেড়ে দিয়েছে।
খোকন জিজ্ঞাসা করল, হারে তুই কি সত্যিই ঘুমুবি না?
চা খাবার পরই কারুর ঘুম পায়?
শুয়ে পড়। আস্তে আস্তে ঘুম এসে যাবে।
না, আমি শোব না।
কেন রে?
এমন করে সারারাত তো কোনোদিন জাগিনি, তাই বেশ লাগছে।
সত্যি বলছিস?
সত্যি বলছি। সোনালী একটু থেমে বলল, তাছাড়া তোমাকেও তো অনেক কাল এভাবে পাই না।
তাহলে আমার সঙ্গে ঝগড়া করিস কেন?
ভালো লাগে।
কিছুক্ষণ চুপচাপ। সামনের বার্থের এক ভদ্রমহিলা ঘুম থেকে উঠে বাথরুম গেলেন।
খোকন বলল, দেখলি, উনি কিভাবে আমাদের দেখলেন?
ওসব তুমি দ্যাখো।
কি অদ্ভুত সন্দেহের দৃষ্টিতে উনি আমাদের দেখলেন, তা তুই ভাবতে পারবি না।
অদ্ভুত দৃষ্টিতে দেখার কি আছে?
এ দেশে ছেলেমেয়েদের গল্প করতে দেখলেই তো বুড়োদের দুশ্চিন্তার শেষ নেই।
সোনালী হেসে বলল, তা ঠিক।
.
গাড়ি এগিয়ে চলে। রাত আরো গম্ভীর হয়। খোকন ঘন ঘন সিগারেট ধরায়।
আর কত সিগারেট খাবে?
খোকন সিগারেটে টান দিয়ে হেসে জিজ্ঞাসা করল, খুব বেশি সিগারেট খাচ্ছি নাকি?
এইতো পাঁচ মিনিট আগেই…
মাত্র তিন প্যাকেট সিগারেট নিয়ে তো গাড়িতে উঠেছি।
ছি, ছি, এত কম সিগারেট কেউ খায়?
খোকন কিছু না বলে সিগারেটে আবার একটা টান দিল।
সোনালী জিজ্ঞাসা করল, ফেরার সময় জ্যাঠামণি যদি তোমাকে আলাদা আসতে না দেন? যদি ওঁদের সঙ্গেই ফার্স্ট ক্লাশে আসতে হয়?
ছাত্র জীবনে বিলাসিতা করা আমি একটুও পছন্দ করি না।
সোনালী হাসতে হাসতে খোকনের গায়ের ওপর লুটিয়ে পড়ল।
ভদ্ৰক পার হতেই ওরা শুয়ে পড়ল।
.
রাত্রে খাওয়া-দাওয়ার পর বারান্দায় বসে কিছুক্ষণ গল্পগুজব করার পর মিস্টার সরকার পরপর দুবার হাই তুলতেই শিবানী বললেন, চলো শুতে যাই। খোকন আর সোনালীর দিকে তাকিয়ে বললেন, যা তোরাও শুতে যা।
খোকন বলল, এখুনি?
এগারোটা বেজে গেছে। আর রাত করিস না।
কিরে সোনালী, তোর ঘুম পেয়েছে নাকি?
সোনালী জবাব দেবার আগেই ওর মা বললেন, ঘুম না পাবার কি হয়েছে? সারাদিন ধরে এত ঘোরাঘুরির পর ঘুম পাবে না?
সবাই উঠে দাঁড়াতেই শিবানী সোনালীকে বললেন, হয়, টেবিল লাইট না হয় বাথরুমের আলোটা জ্বালিয়ে রাখিস।
আচ্ছা।
ঘরে ঢুকেই খোকন জিজ্ঞাসা করল, কিরে সোনালী, ঘুমোবি নাকি?
ঘুমোব না তবে শুয়ে শুয়ে গল্প করব।
কেন?
সারাদিন ঘোরাঘুরি করে পা-দুটো বড় ব্যথা করছে।
তার মানে তোর ঘুমোনোর মতলব।
মোটেও না।
আমি সারারাত জাগব বলে দশ প্যাকেট সিগারেট কিনে এনেছি।
দশ প্যাকেট!
এক রাত্রেই দশ প্যাকেট লাগবে না তবে চার-পাঁচ প্যাকেট লাগবে।
খোকনদা, তুমি এত সিগারেট খেও না।
আবার বুড়ীদের মতন হিতোপদেশ দিচ্ছিস? হোস্টেলে কত ছেলে মদ খায় জানিস?