পুরী তোমার একেবারেই ভালো লাগে না?
পুরীর সমুদ্রে চান করতে খুব ভালো লাগে।
দু-এক মিনিট পরে খোকন জিজ্ঞাসা করল, সমুদ্রে চান করতে তোর কেমন লাগে?
ভালো, তবে এবার আর করব না।
কেন?
এখন ওই অত লোকের সামনে চান করা যায়? লজ্জা করবে না?
খোকন সিগারেট টানতে গিয়েও পারে না। হাসে।
হাসছ কেন?
তোর কথা শুনে।
এমন কি হাসির কথা বললাম?
তুই এমনই বড় হয়ে গেছিস যে পুরীর সমুদ্রে আর চান করতেই পারবি না?
গায়ে অত কাপড়-গামছা জড়িয়ে চান করতে বিরক্ত লাগে।
তুই তাহলে সত্যি বড় হয়েছিস?
ভুলে যেও না আমি সামনের বার হায়ার সেকেন্ডারি দেবো।
খোকন সিগারেট টানতে গিয়েও মাথা নেড়ে জানায়, সে ভুলে যায়নি।
তাছাড়া জানো, আমাদের ক্লাসের দুটো মেয়ের বিয়ে হয়ে গেছে।
চোখ দুটো বড় বড় করে খোকন বলে, সত্যি?
বড়মাকে জিজ্ঞাসা করো।
তোদের ক্লাসের মেয়েরা বিয়ের কি বোঝে?
আমাদের ক্লাসেও অনেক পাকা পাকা মেয়ে আছে। শিউলিটা তো ভীষণ বদ হয়ে গেছে।
বদ হয়েছে মানে?
সুকুমার বলে একটা লোফার ছেলের সঙ্গে ওর খুব ভাব। যেখানে-সেখানে ঘুরে বেড়ায়।
তুই কী করে জানলি?
অনেক বন্ধুরা দেখেছে। তাছাড়া দুজন দিদিমণি দেখে ওকে খুব বকাবকি করেছেন।
তাহলে তোর বন্ধুরাও ওস্তাদ হয়ে উঠেছে।
একটু চুপ করে থাকার পর সোনালী চাপা হাসি হাসতে হাসতে বলল, আমার এক বন্ধুর তোমাকে খুব ভালো লাগে।
সত্যি?
তুমি বড়মাকে বললো না।
বলব না, কিন্তু মেয়েটা কে?
মায়া।
সে আমাকে দেখল কোথায়?
ও তো দু-তিন দিন পর পরই আমার কাছে আসে। আজ সকালেও তো এসেছিল।
ওই মায়া?
হ্যাঁ।
বিয়ে করবে?
জানি না।
তবে আর কী ভালো লাগল?
সোনালী আবার হেসে বলে, শুধু তোমাকে দেখার জন্যই ও আজ সকালে এসেছিল।
তাই নাকি?
সত্যি বলছি।
আবার কবে আসবে?
তা কি আমাকে বলে গেছে?
.
দুদিন পর পুরী এক্সপ্রেস হাওড়া স্টেশন ছাড়ার পরই খোন একটা সিগারেট ধরিয়ে সোনালীকে বলল, বাবা-মার সঙ্গে ফার্স্ট ক্লাসে না গিয়ে ভালোই হয়েছে।
কেন, সিগারেট খেতে পারতে না বলে?
হ্যাঁ। খোকন সিগারেটে টান দিয়ে বলল, ট্রেনে উঠেই সিগারেট ধরাতে না পারলে আজকাল একদম ভালো লাগে না।
তবে তখন যে খুব রেগে গিয়েছিলে?
মোটেও রাগিনি।
মিথ্যে কথা বোলো না খোকনদা। নিতান্ত জ্যাঠামণি আর বড়মা আমাকে সাপোর্ট করলেন, নয়ত…
দ্যাখ সোনালী বাবা-মার চাইতে আমি তোকে কম ভালোবাসি না…
তা জানি।
তোর উপর ঠিক রাগ করতে পারি না।
তবে যখন-তখন আমাকে যা তা বলো কেন?
সিগারেটে খুব জোরে একটা টান মেরে খোকন বলল, ও তোকে একটু রাগাবার জন্য।
তুমি বড্ড আমার পিছনে লাগো।
তবে কি বাবা-মার পিছনে লাগব?
সোনালী হাসে।
.
ট্রেন ছুটে চলেছে। অনেক প্যাসেঞ্জার এর মধ্যেই শোবার ব্যবস্থা করে নিয়েছেন। অনন্যরা কেউ বা খাওয়া-দাওয়া করছেন অথবা গল্প-গুজব করছেন।
খোকন আবার সিগারেট ধরায়। বলে, দ্যাখ সোনালী, আজকাল বাবা-মা আমার চাইতে তোকে বেশি ভালোবাসেন।
আমি অত বেশি-কম বুঝি না।
তুই কাছে না থাকলে তো বাবার মুখের চেহারাই বদলে যায়।
কি জানি? আমি দেখিনি।
মা একটু চাপা। ঠিক প্রকাশ করতে চান না কিন্তু প্রতি মুহূর্তেই ধরা পড়ে যান।
তুমি জ্যাঠামণি-বড়মার একমাত্র ছেলে। তোমাকে কি ওঁরা কম ভালোবাসতে পারেন?
কিছুক্ষণ পরে খঙ্গপুর আসে। খোকন দুটো কফি কিনে একটা সোনালীকে এগিয়ে দিতেই ও বলল, এখন কফি খেলে রাত্তিরে ঘুমোব কখন?
একটু অনিয়ম, একটু অত্যাচার না করলে বাইরে বেড়াবার আনন্দ কি?
তুমি এই দু বছর হোস্টেলে থেকে বেশ বদলে গেছ।
হোস্টেলে না গেলেও এই পরিবর্তন হতো।
পরিবর্তন হলেও এতটা হতো না।
এই বয়সটাই পরিবর্তনের বয়স।
তা ঠিক।
এই বয়সে সব ছেলেমেয়েরাই হঠাৎ অদ্ভুতভাবে সব ব্যাপারেই সচেতন হয়ে ওঠে। সবকিছু জানতে চায়, বুঝতে চায়, এক্সপেরিমেন্ট করে দেখতে চায়।
সোনালী মুগ্ধ হয়ে খোকনের কথা শোনার পর বলে, তুমি আজকাল কত সুন্দর করে কথা বলো।
খোকন হেসে বলল, তাই নাকি?
সত্যি খোকনদা তোমার কথাবার্তার ধরনটা একেবারে বদলে গেছে।
খোকন একটু হাসে। কিছু বলে না।
সোনালী বলল, খোকনদা, পুরীতে গিয়ে আমরা সারা রাত গল্প করব।
আমার সারা রাত আড্ডা দেওয়া অভ্যাস আছে কিন্তু তুই পারবি না।
খুব পারব।
বারোটা-একটার পর তুই ঠিক ঘুমিয়ে পড়বি।
তুমি গল্প করলে আমি কিছুতেই ঘুমোব না।
আর যদিও বা একটা রাত কোনোমতে জেগে থাকিস তাহলে আর তার পরের দিন সকালে তো…
কিচ্ছু হবে না।
আচ্ছা দেখা যাবে।
একটু চুপ করে থাকার পর সোনালী জিজ্ঞাসা করল, কি খোকনদা, তোমার ঘুম পাচ্ছে নাকি?
খোকন হেসে বলল, এখুনি?
এখন কটা বাজে?
মোটে এগারোটা কুড়ি।
এখনও সাড়ে এগারোটাও বাজেনি?
না।
সোনালী একবার চারপাশে দৃষ্টি ঘুরিয়ে নিয়ে বলল, সবাই কী ঘুম ঘুমোচ্ছ!
আমাদের দেশের কটা মানুষ জীবন উপভোগ করতে জানে? কোনমতে খেয়েদেয়ে বউকে জড়িয়ে শুতে পারলেই…
শুনতেও সোনালী লজ্জা পায়। খোকনের মুখের উপর হাত দিয়ে বলল, চুপ করো!
চুপ করবো?
হ্যাঁ।
কেন? আমি কি মিথ্যে কথা বলছি?
তা বলছি না তবে…
সোনালী কথাটা শেষ না করে খোকনের দিকে তাকায়।
কথাটা শেষ না করে আমার দিকে তাকিয়ে কি দেখছিস?
দেখছি আর ভাবছি। একটু থেমে সোনালী আবার বলল, দেখছি তোমাকে আর ভাবছি তোমার কথা।