আজকাল আর খোকনের সঙ্গে ঝগড়া করে না?
না, আজকাল আর ঝগড়া হয় না। একটু বেশি তর্ক হলেই আমার কাছে ছুটে আসে।
বাড়িতে একমাত্র ছেলে বা মেয়ে সব সময় একটু বেশি আদুরে, একটু খামখেয়ালী হয়। সোনালী এসে সেদিক থেকে খোকনের উপকারই হয়েছে।
প্রথম প্রথম খোকনের মধ্যে একটু দ্বিধা ছিল।
দ্বিধা মানে?
মানে, ও ভারত ড্রাইভার বিহারীর মেয়ে, কিন্তু সে-ভাবটা আস্তে আস্তে চলে গেছে। এখন ওকে ঠিক নিজের বোনের মতনই ভালোবাসে।
দরজার ওপাশ থেকে সোনালী বলল, জ্যাঠামণি অফিসের জামা-কাপড় ছাড়বে না?
ওর কথায় ওরা দুজনেই হাসেন।
মিস্টার সরকার ওকে ডাকেন, সোনালী শুনে যা।
সোনালী ঘরে ঢুকে বলে, কী বলছ জ্যাঠামণি?
সোনালীকে কোলে বসিয়ে মিস্টার সরকার বললেন, এত খিদে লেগেছে যে উঠতে পারছি না।
আজ লাঞ্চের সময় কিছু খাওনি?
নারে।
কেন?
এত কাজে ব্যস্ত ছিলাম যে কিছুতেই উঠতে পারলাম না।
তার পরেও কিছু খেতে পারলে না?
মিস্টার সরকার ঠোঁট উল্টে বললেন, লাঞ্চের পর কি আর সময় হয়?
তাই বলে কি না খেয়ে কেউ কাজ করে নাকি? সোনালী উঠে দাঁড়িয়ে ওর হাত ধরে টানতে টানতে বলে, আর বকবক না করে এবার উঠে পড়ো।
মিস্টার সরকার সোনালীকে কোলে-তুলে নিয়ে বলেন,
আমাদের সোনালী
বেড়াতে যাবে মানালী
করে না হেঁয়ালি
আছে একটু খামখেয়ালি।
এক গাল হাসি হেসে সোনালী বলল, দেখলে বড়মা, জ্যাঠামণি কি সুন্দর কবিতা বানালো।
শিবানী হেসে বলল, তোর জ্যাঠামণি রবিঠাকুর হয়ে গেছে।
না বড়মা, ঠাট্টার কথা নয়। সত্যি কবিতাটি খুব সুন্দর হয়েছে।
মিস্টার সরকার হাসতে হাসতে বললেন, তোকে একটুও ভালোবাসি না বলেই তো কবিতাটা ভালো হল।
তুমি আমাকে ভালোবাস না? সোনালী মিট মিট করে হাসতে হাসতে জিজ্ঞাসা করল।
মিস্টার সরকার মাথা নেড়ে বললেন, না।
সোনালী হাসতে হাসতে বলল, তাই বুঝি রোজ রোজ লুকিয়ে লুকিয়ে আমার জন্য…
মিস্টার সরকার হঠাৎ খুব জোরে চিৎকার করে বললেন, বাজে কথা বলবি না। আমি কোনোদিন কাউকে লুকিয়ে লুকিয়ে কিছু দিই না।
সোনালী হাসি চাপতে পারে না। বলে, তুমি লুকিয়ে দিলেও আমি সবাইকে বলে দিই।
আজেবাজে কথা বললে একটা থাপ্পড় খাবি।
সোনালী আর শিবানী হাসতে হাসতে ঘর থেকে বেরিয়ে গেলেন।
৪. মিস্টার সরকার বাড়ি ফিরতেই
মিস্টার সরকার বাড়ি ফিরতেই খোকন প্রণাম করল। ছেলেকে একবার ভালো করে দেখে নিয়ে বললেন, এই মাসে তুই বেশ লম্বা হয়েছিস তো।
শিবানী বললেন, ছেলের পায়ের দিকে তাকালেই বুঝবে কেন এত লম্বা হয়েছে।
মিস্টার সরকার ছেলের পায়ের দিকে তাকাতেই সোনালী বলল, হোস্টেলে গিয়ে খোকনদার অনেক কায়দা বেড়েছে।
খোকন সঙ্গে সঙ্গে ওর মাথায় একটা চাটি মেরে বলল, আবার ফড় ফড় করছিস?
তোমার কায়দা বেড়েছে, বলব না?
কিছু কায়দা বাড়েনি।
তোমার মাথার চুল আর পায়ের জুতো দেখে তো আমি প্রথমে…
আবার?
ড্রইংরুমে চা খেতে খেতে গল্প গুজব হয়। হঠাৎ মিস্টার সরকার বললেন, শিবানী চলল আমরা সবাই মিলে সপ্তাহ খানেকের জন্য পুরী ঘুরে আসি।
তুমি ছুটি পাবে?
তা পেয়ে যাব।
খোকন বলল, আগে জানলে আমি পুরী পর্যন্ত কনসেশন নিতে পারতাম।
মিস্টার সরকার বললেন, সে আর কি হবে।
শিবানী বললেন, রেল কোম্পানিকে অযথা কতকগুলো টাকা দিতে হতো না।
সোনালী বলল, পুরী তো এক রাত্তিরের জার্নি। আমি আর খোকনদা থ্রী টায়ারে চলে যাব। তোমরা?
খোকন সঙ্গে সঙ্গে সোনালীকে বলল, আবার খোকনদাকে টানছিস কেন? কেন? তোমার থ্রী টায়ারে যেতে লজ্জা করবে? ছাত্রজীবনে বেশি বাবুগিরি করা ভালো।
দ্যাখ সোনালী বুড়ীদের মতো ফালতু উপদেশ দিবি না।
মিস্টার সরকার বললেন, খোকন, সোনালী কিছু অন্যায় বলেনি। আমি তোমাদের ফার্স্ট ক্লাসে নিয়ে যেতে পারি ঠিকই কিন্তু দশ-বারো ঘন্টার জার্নির জন্য অযথা এক গাদা টাকা ব্যয় করার কোনো দরকার আছে কি?
খোকন হেসে বলে, আমি একবারও বলিনি থ্রী টায়ারে যাব না। তবে এবার এসে দেখছি সোনালী বড্ড পাকা পাকা কথা বলছে।
এতক্ষণ পরে শিবানী বললেন, তুই ভুলে যাস না খোকন, সোনালী ক্রমশ বড় হচ্ছে।
খোকন সোনালীর দিকে তাকিয়ে বলল, শাড়ি পরেই তোর মাথাটা গেছে।
পরের দিন দুপুরে মিস্টার সরকার টেলিফোনে টিকিট হয়ে যাবার খবর দিতেই বাড়িতে উত্তেজনার ঢেউ বয়ে গেল।
শিবানী বললেন, সোনালী কাল সুটকেশ-টুটকেশ গুছিয়ে ফেলতে হবে।
আচ্ছা।
দুপুরে খাওয়া-দাওয়ার পর, শিবানী একটু বিশ্রাম নিতে-গেলেন।
খোকন নিজের ঘরে যেতেই সোনালী এসে জিজ্ঞাসা করল, দেশলাই আনতে হবে?
দেশলাই আছে। অ্যাসট্রেটা নিয়ে আয়।
সোনালী ড্রইংরুম থেকে অ্যাসট্রে আনতেই খোকন সিগারেট ধরাল। সিগারেটে একটা টান দিয়েই জিজ্ঞাসা করল, সোনালী, পুরী তোর কেমন লাগে রে?
সমুদ্র বা পাহাড়ে কারুর খারাপ লাগে নাকি?
পুরী আমার তত ভালো লাগে না।
কেন?
ওখানে ভোরবেলায় আর সন্ধ্যেবেলায় ছাড়া তো বেড়াবার উপায় নেই।
তা ঠিক। রোদ্দুর উঠলে আর সমুদ্রের ধারে যাওয়া যায় না।
তাছাড়া পুরীতে তো আর কোথাও বেড়াবার জায়গা নেই।
জগন্নাথের মন্দির?
মন্দিরে কি লোকে সারাদিন পড়ে থাকবে?
তাহলে অন্য কোথাও যাবার কথা তুমি জ্যাঠামণিকে বললে না কেন?
ধারে কাছে আর যাবার জায়গা কোথায়? তাছাড়া বাবা-মার পুরী খুব ভালো লাগে।