শ্রীধরবাবু সব পুত্রদেরই কিঞ্চিৎ ইংরেজি শিখিয়েছিলেন এবং সেই সামান্য ইংরেজি জ্ঞানের দৌলতে অন্য একটি পুত্রও অশ্ব ও গোডাক বিভাগে কাজ পান। এর নাম কামিনীরঞ্জন।
কামিনীরঞ্জন সত্যি একটি রত্ন ছিলেন। নিজের কর্ম দক্ষতায় উনি যে শুধু মাত্র ডেপুটি পোস্ট মাস্টার হন তাই নয়, সিপাহী বিদ্রোহের সময় উনি যেভাবে ইংরেজ সেনাপতি ও অফিসারদের সেবা করেন, তার তুলনা বিরল। বিদ্রোহী সিপাহী ও মুসলমানরা ইংরেজসেবক বাঙালীদের শত্রু মনে করতেন বলে তাদের অনেকের উপরই অকথ্য অত্যাচার হয়। ধন-সম্পত্তি ছাড়াও বহু বাঙালীকে প্রাণ হারাতে হয়। বিদ্রোহীরা কামিনীরঞ্জনকেও খুন করার পরিকল্পনা করেছিল কিন্তু উনি সে খবর আগেই জানতে পেরে পোস্ট অফিসের দামী ও দরকারী জিনিসপত্র ছাড়াও কিছু বিশ্বস্ত কর্মীকে নিয়ে পালিয়ে যান।
কামিনীরঞ্জন আত্মগোপন করে থাকার সময় বিশ্বস্ত কর্মী ও ইংরেজ সমর্থক কিছু সুচতুর গ্রামবাসীদের সাহায্যে বিদ্রোহী দলের গোপন খবর সংগ্রহ করে অত্যন্ত গোপনে ওয়াটসন সাহেবের এক ঘনিষ্ঠ অফিসারের কাছে পাঠাতেন অনেক সময় কামিনীরঞ্জন নিজেও জীবন বিপন্ন করে সাধুসন্ন্যাসী-ফকিরের বেশে শত্রু শিবিরে প্রবেশ করে সংবাদ সংগ্রহ করতেন। যাদের সক্রিয় ও ঐকান্তিক সাহায্যে মহামান্য ইংরেজ সরকার বিদ্রোহ দমনে সমর্থ হয়, তাদের অন্যতম এই বাবু কামিনীরঞ্জন বন্দ্যোপাধ্যায় মহোদয়।
দেশে শান্তি স্থাপনের পর ইংরেজ সরকার প্রকাশ্যে ওকে ধন্যবাদ জানিয়ে প্রচুর অর্থ ও ডেপুটি কালেক্টরের পদ দিয়ে পুরস্কৃত করেন। সে সময় উত্তরপ্রদেশের বেশ কিছু বাঙালী চরম রাজভক্তি দেখাবার জন্য এই দুর্লভ সম্মান লাভ করেন।
কামিনীরঞ্জনের কাহিনী, সৌভাগ্যের ইতিহাস এখানে শেষ নয়। কোম্পানির জমানা শেষ হবার পর স্বয়ং মহারানী ভিক্টোরিয়ার শাসন ব্যবস্থা চালু হবার কিছুকালের মধ্যেই ছোটলাটের ব্যক্তিগত সুপারিশে ও আগ্রহে কামিনীরঞ্জন বিহার ও উত্তরপ্রদেশে বিশাল জমিদারীও লাভ করেন। একদা অশ্ব ও গো-ডাক বিভাগের নগণ্য কর্মচারীর সৌভাগ্যের ইতিহাস এখানেও শেষ হল না।
মহারানী ভিক্টোরিয়ার শাসনব্যবস্থা চালু হলে কিছু ইংরেজ অফিসারকে দেশে পাঠান হল, নতুন কিছু অফিসার দেশ থেকে এখানে এলেন। আবার বেশ কিছু উচ্চপদস্থ অফিসারকে কম গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব দিয়ে বদলী করা হল। এই রদবদলের বাজারে ল্যাঙ্কাশায়ার ফিফথ ইনফ্যান্ট্রি রেজিমেন্টের ক্যাপ্টেন বার্জম্যানকে এলাহাবাদে কমিশনার নিয়োগ করা হল। কোন অজ্ঞাত কারণে বহু ইংরেজ অফিসারই এই নিয়োগের খবর জেনে অত্যন্ত অসন্তুষ্ট হলেন এবং তারা অনেকেই ওঁর সঙ্গে দেখা-সাক্ষাৎও করতেন না। এই সব ইংরেজদের দ্বারা প্রভাবিত হয়ে বহু গণ্যমান্য ভারতীয়রাও বার্জম্যানকে এড়িয়ে চলতেন কিন্তু ব্যতিক্রম ছিলেন শুধু কামিনীরঞ্জন।
কামিনীরঞ্জন নতুন কমিশনার সাহেব ও মেমসাহেবের সুখ-স্বাচ্ছন্দ্য ও আনন্দের জন্য প্রাণ ঢেলে দিলেন ও দু-হাতে জলের মত অর্থ ব্যয় করতেন। ক্যাপ্টেন বার্জম্যান সর্বশক্তিমান কমিশনার হলেও লাটসাহেব ছিলেন না, কিন্তু প্রভুভক্ত কামিনীরঞ্জন ওঁকে খুশি করার জন্য সব সময় হিজ একসেলেনসী বলে সম্বোধন করতেন।
বন্ধু কুমুদবিহারী একদিন বললেন, কামিনীরঞ্জন, এতগুলো ইংরেজ অফিসারকে চটিয়ে নতুন কমিশনার সাহেবকে খুশি করা কী বুদ্ধিমানের কাজ হচ্ছে?
কামিনীরঞ্জন সঙ্গে সঙ্গে জবাব দিলেন, দেখ কুমুদবিহারী, আমি কমিশনার সাহেবকে নিয়োগ করিনি। স্বয়ং মহারানী ভিক্টোরিয়া ওঁকে এখানে পাঠিয়েছেন। যিনি পৃথিবীব্যাপী এতবড় সাম্রাজ্য চালাচ্ছেন, আমি কি করে তার মনোনীত নতুন কমিশনার বাহাদুরকে সম্মান ও মর্যাদা না দিয়ে পারি।
তা ঠিক কিন্তু…
ওঁকে বাধা দিয়ে কামিনীরঞ্জন বললেন, তাছাড়া কে বলতে পারে, কমিশনার সাহেব স্বয়ং মহারানীর প্রিয়পাত্র বা আত্মীয় না।
কুমুদবিহারীও রাজভক্ত এবং রাজ অনুগ্রহেই জীবনে বহু উন্নতি করেছেন কিন্তু ওঁর মাথায়ও এত কিছু চিন্তাভাবনা আসেনি। উনি গম্ভীর হয়ে মাথা নেড়ে বললেন, তা তো বটেই।
এবার কামিনীরঞ্জন একটু হেসেই বলেন, দেখ কুমুদবিহারী, হু এভার ম্যারেজ মাই মাদার, ইজ মাই ফাদার! যিনিই মাকে বিয়ে করবেন, তিনিই আমার বাবা।
ওঁর কথায় কুমুদবিহারী হোহো করে হেসে ওঠেন। বলেন, ইউ আর রাইট, মাই ডিয়ার ফ্রেণ্ড! ইউ আর রাইট, মাই ডিয়ার ফ্রেণ্ড! ত্রিবেণী সঙ্গম দিয়ে গঙ্গা-যমুনার জল আরো গড়িয়ে যায়। কমিশনার সাহেব ও তার মেমসাহেবের সঙ্গে কামিনীরঞ্জনের ঘনিষ্ঠ পরিচয় ধীরে ধীরে গভীর হৃদ্যতা ও বন্ধুত্বে পরিণত হয়। কামিনীরঞ্জন বুঝতে পারেন, কমিশনার সাহেব শুধু ক্ষমতা পেয়ে খুশি না। উনি আরও অনেক কিছু আশা করেন। প্রভুভক্ত জমিদারও তার সে সুপ্ত আশা আকাঙ্ক্ষা পূর্ণ করতে কোন ক্রটি করেন না। যখন তখন সাহেব-মেম সাহেবকে দামী দামী জিনিসপত্র উপহার দেন। তারপর সাহেবের জন্মদিনে উনি ওঁকে একটা অত্যন্ত দামী হীরার আংটি দিতেই মেম সাহেব হাসতে হাসতে বললেন, খামিনী, আমি কী অপরাধ করলাম যে তুমি বার্জ-কেই শুধু উপহার দিলে?
কামিনীরঞ্জন গদগদ হয়ে হাসি মুখে বললেন, হিজ একসেলেনসী দয়া করে অনুমতি দিলে আমি আপনাকে হীরের নেকলেস উপহার দেব।