ক্যাপ্টেন রায়ের এসব জানার নয়। তবে খটকা লেগেছিল রাজভবনের ক্লার্কদের কথাবার্তা শুনে। মিঃ সরকারকে ওরা সবাই সরকার মশাই বলতেন। এবার গভর্নরের সঙ্গে জলপাইগুড়ি ট্যুরে গিয়ে ডেপুটি কমিশনারের কাছে সরকারের ইতিহাস জানতে পারেন। .ইউ নো ক্যাপ্টেন রয়, দিস ফেলো ওয়াজ এ ক্লার্ক আন্ডার মি।
সেই সরকার আজ শেরওয়ানি-চুড়িদার পরে, গভর্নরের বি টিম। মালেশিয়া পার্লামেন্টারি ডেলিগেশনের সদস্যরা তো সরকারকেই ইওর একসেলেন্সি বলে শ্রদ্ধা জানিয়েছিলেন।
এক্সকিউজ মি স্যার! আই অ্যাম স্পেশাল সেক্রেটারি টু হিজ একসেলেন্সি…
ডেলিগেশনের নেতা হাসতে হাসতে মন্তব্য করেছিলেন, বাট ইউ লুক লাইক এ গভর্নর।
সেই সরকার সাহেবের মেয়ের জন্মদিন উপলক্ষে গত রাত্রে ডিনার খেয়েছেন ক্যাপ্টেন রায়। লক্ষ লক্ষ সরকারি কর্মচারী জীবন ভোর রোজা পালন করা যেমন সত্য, স্পেশাল অফিসার-স্পেশাল সেক্রেটারিদের ঈদটাও তেমনি সত্য।
রাজভবনের হেড কুক পেরেরা সাহেবের খানা এ-ডি-সি-দের অপরিচিত নয় কিন্তু তবুও সরকার সাহেব বার বার বললেন, সুড আই গিভ ইউ অ্যানাদার কোলেটা পোজারস্কি? রাশিয়ান অন্যান্য খাবারের চাইতে এই চিকেন কাটলেটটা আমার সব চাইতে ভালো লাগে।
না, না, থ্যাঙ্ক ইউ! অলরেডি অনেক খেয়েছি…
ইউ মাস্ট হ্যাঁভ এনাদার! এসব কোনো হোটেল রেস্তোরাঁয় পাবেন না। আমার স্ত্রী নিজে হাতে…
কোথায় শিখলেন?
সী লানটি ইট ফ্রম রাশিয়ানস হু কেম উইথ ক্রুশ্চেভ অ্যান্ড বুলগানিন।
আই সী! একটা দিন!
ক্যাপ্টেন মনে মনে পেরেরাকে ধন্যবাদ জানায়।
.
প্রাইম মিনিস্টার, হোম মিনিস্টার বা অন্যান্য রাজ্যের গভর্নর ছাড়াও বহু অতিথির আগমন হয় রাজভবনে। প্রেসিডেন্ট বা প্রাইম মিনিস্টারের মতো ভি-আই-পি-দের সিকিউরিটির জন্য, নিরাপত্তার জন্য রাজভবনের থাকতেই হয়? এদের পক্ষে অন্যত্র থাকা নাকি নিরাপদ নয়।
ভারতবর্ষের মতো সিকিউরিটির কদর্যতা আর কোথাও দেখা যাবে না। নিজের দেশের মানুষকে এমন ভাবে দূরে বহুদূরে রাখার নজির আর কোনো দেশে নেই। লর্ড ওয়েলেসলি, স্যার জন অ্যান্ডারসনই আমাদের পূর্বসুরী থেকে গেলেন। স্যার জন অ্যান্ডারসন প্রতিটি ভারতবাসীকে সন্দেহের চোখে দেখতেন; মনে করতেন প্রতি ভারতবাসীর পকেটেই টাইম বোমা থাকে। সরকারি গোলামের দল কনস্টেবল সাবইনসপেক্টরদের বিশ্বাস করবেন কিন্তু হেডমাস্টার-প্রফেসর ভাইস চ্যান্সেলারকেও ঠিক সন্দেহের ঊর্ধ্বে মনে করতে পারেন না।
আর্মিতে সিকিউরিটি হচ্ছে মূলমন্ত্র। দেশরক্ষার জন্য গোপনে কত কি করতে হয়। একজন সুবেদার বিশ্বাসঘাতকতা করলে দেশের কি ভীষণ সর্বনাশ হতে পারে কিন্তু সেখানেও মানুষকে এমনভাবে ঘৃণা অবিশ্বাস করা হয় না।
রাজভবনের ভি-আই-পি সিকিউরিটির ব্যবস্থা দেখে ক্যাপ্টেন রায় স্তম্ভিত হন। অজ্ঞাত জুজুর ভয়ে এদের কাণ্ডকারখানা দেখে হাসিও পায়।
পাবে না?
ওই বিরাট লোহার ফটকের ওপাশ থেকে যারা রাজভবনকে দেখে, বর্শা হাতে নিয়ে ঘোড়-সওয়ার পুলিশ দেখে যারা শুধু মজা পায়, তারা না হয় সব কিছু জানে না, জানতে পারে না। যারা কালে কস্মিনে রাজভবনে আসেন বা মার্বেল হলে কাউন্সিল চেম্বারে ভি-ভি-আই-পি দর্শনের পরম সৌভাগ্যলাভ করেন, তারাও হয়তো সবাইকে চিনতে পারেন না। কিন্তু এ-ডি-সি তো সবাইকে চেনেন, জানেন। সবকিছুই দেখেন।
গেটের বাইরে দুচারটে বেতার গাড়ি, দুচার লরি বোঝাই সশস্ত্র পুলিশ বাহিনী। ভিতরে? ভিতরে প্রতি পদক্ষেপে ভি-ভি-আই-পি-দের অভিভাবকের দল। বাছাই করা অভিভাবকের দল। রাজভবনের বারান্দায় লিফট-এর পাশে, প্রিন্স অফ ওয়েলস স্যুইটের মুখে অ্যাসিস্ট্যান্ট কমিশনারদের অমন করে চৌকিদার দারোয়ানী করতে দেখে ক্যাপ্টেন রায় না হেসে পারেন না। রাজভবনের বাইরে থেকে কামানের গোলা ছুঁড়লেও যেখানে পৌঁছাবে না, সেখানেও এই সতর্কতা? নাকি মেন গেটের সশস্ত্র বাহিনীকে পরাস্ত করে যদি কোনো অবিমৃষ্যকারী ঢুকে পড়ে ভিতরে?
এসব ভি-ভি-আই-পি এলে রাজভবনের সমস্ত কর্মচারীদের প্রাণান্তকর অবস্থা হয়। সমস্ত কাজকর্ম জীবনযাত্রা লণ্ডভণ্ড হয়ে যায়। ঠিক কাজের চাপ, দায়িত্বের বোঝ যে খুব বেশি থাকে তা নয়। অধিকাংশ সময়েই অ্যাটেনশন হয়ে দাঁড়িয়ে থাকতে হয় অথবা খিদমদগার হয়ে। দৌড়াদৌড়ি করতে হয়। গভর্নরের সেক্রেটারি, স্পেশাল সেক্রেটারি, ডেপুটি সেক্রেটারি, এ-ডি-সি থেকে বেয়ারা-চাপরাশিদের ওই একই অবস্থা। মনে মনে বিরক্তবোধ করে সবাই, মুখে প্রকাশ করে না কেউই। বিদেশি ভি-আই-পি এলে বেয়ারা-চাপরাশিদের অদৃষ্টে কিছু প্রাপ্তিযোগ ঘটে। আর ইন্ডিয়ান ভি-আই-পি এলে প্রাইভেট সেক্রেটারির বাথ টাওয়েলের হিসাব মেলার জন্য মাইনে থেকে খেসারত দিতে হয়।
সহিদাদুল্লা তো স্পষ্টই বলে, আরে ছোড়িয়ে সাব-। বড়া মিনিস্টার বা লাটসাব হলেই দিল বড় হয় না। আমরা গরিব হতে পারি কিন্তু বাথরুম থেকে তোয়ালে বা ড্রইংরুম থেকে বই নিয়ে চলে যাব না।
গঙ্গা সিং বলেছিল, কি আর বলব সাহেব? কিছু কিছু সাহেব আছেন যারা ডিনারের ফলমূল পর্যন্ত নিয়ে যেতে দ্বিধা করেন না।
অবাক হয়ে ক্যাপ্টেন রায় বলেছিলেন, কি বলছ?
বিশ্বাস না হয় হেড ক্লার্কবাবুকে জিজ্ঞাসা করবেন। ওর কাছে আরো অনেক কিছু জানতে পারবেন।