একটা স্বামীকে তাল দিতেই স্বপনচারিণীর প্রাণান্তকর অবস্থা হয়। আর-এ-ডি-সি-কে? নিত্য নতুন স্বামীর মনোরঞ্জন করতে হয় তাকে। রাজভবনে নিত্য অতিথিদের আগমন। অতিথি সকারের দায়িত্ব গভর্নরের ডেপুটি সেক্রেটারির কিন্তু তাদের অভ্যর্থনার দায়িত্ব এ-ডি-সি-র নয়। কলকাতার বাইরে লাটসাহেবের ট্যুর ডিউটিতে থাকলে তো কথাই নেই। বেয়ারা, চাপরাশি, অর্ডালী থাকলেও সব দায়িত্বই এ-ডি-সি-র। লাটসাহেবের পোশাক-আশাক খাওয়া-দাওয়া ওষুধ-পত্র ইত্যাদি ইত্যাদি সব কিছুই এ-ডি-সি-কে দেখতে হয়। এইখানেই শেষ নয়।
এক একজন লাটসাহেবের এক একরকম বাতিক থাকে। যে লাটসাহেব নরম বালিশে শুতে পারেন না, তার ট্যুর প্রোগ্রাম ঠিক হবার পরই ডিস্ট্রিক্ট ম্যাজিস্ট্রেটকে এ-ডি-সি-র টেলিগ্রাম পাঠাতে হয়, অ্যারেঞ্জ শক্ত বালিশ ফর গভর্নর অ্যাট সার্কিট হাউস স্টপ কনফার্ম স্টপ এ-ডি-সি গভর্নর। লাটসাহেব কি খাবেন, কি ভাবে তা রান্না হবে এবং সে খাবার অল্প না বেশি গরম খেতে উনি পছন্দ করেন, তার ছাপান সার্কুলার আছে। সুতরাং এ-ডি-সি-কে তা নিয়ে বেশি মাথা ঘামাতে না হলেও লাটসাহেবের খাবার আগে চেক-আপ করে দেখতে হয় সার্কুলারের ইজ্জত রক্ষা করা হয়েছে কিনা।
এইখানেই শেষ নয়। রাজ্যপাল ভাব ভোলা বলে তার পোশাক-আসাকের দিকেও তীক্ষ্ণ নজর দিতে হয়।
আরো কিছু?
আরো কিছু আছে তবে হয়তো প্রকাশ্যে নয়। রাজাগোপালাচারী বা কৈলাশনাথ কাটজু বা হরেন মুখুজ্জের মতো গভর্নর আজ খুঁজে পাওয়া যাবে না। আজকাল অনেক রাজ্যপাল দিনে প্রহিবিশন কাউন্সিলের সভাপতিত্ব করলেও সন্ধ্যার পর স্কচ মার্কা দাওয়াই না খেলে পারেন না। সমস্ত লোকচক্ষুর আড়ালে এ-ডি-সি-কেই গেলাস বোতল সোডার ব্যবস্থা করতে হয়। একজন অতি বিশ্বস্ত বেয়ারা সাহায্য করে মাত্র। অনেক রাজ্যপাল তো পুরনো দিনের বান্ধবী দেখলে বর্তমান ভুলে যান। কোনো কোননা ক্ষেত্রে সদ্য পরিচিতাকে পুরনো দিনের বান্ধবী বলে। চালাতে স্যুট-টাই পরা রাজ্যপালরা দ্বিধা করেন না।
ক্যাপ্টেন রায় অবশ্য ভাগ্যবান। ওর গভর্নরের বোতল বা বান্ধবীর রোগ নেই কিন্তু চাকরি করতে গিয়ে অন্য রাজ্যপালদের এসব রোগের কথা জানতে বাকি নেই। রাজভবনের বা সরকারি গাড়িতে নয়, সন্ধ্যার পর প্রাইভেট গাড়িতে লাটসাহেব যান বান্ধবী সন্দর্শনে। ব্যবস্থা করতে হয় এ-ডি-সি-কেই। সবাইকে বলতে হয়, আই অ্যাম সরি স্যার, হিজ একসেলেন্সি ইজ নট ওয়েল।
রমজানের কাছে ডায়না-ডরোথির কাহিনি শুনতে ভালো লাগে কিন্তু চমক লাগে না ক্যাপ্টেন কমল রায়ের। তখনকার মতো এখনও সন্ধ্যার পর চোখের দৃষ্টিটা রঙিন হয়, রক্ত একটু বেশি দ্রুত চলাচল করে, নিশ্বাসে আগুনের হলকা ভেসে আসে।
মারাঠা রেজিমেন্টের ক্যাপ্টেন মিশ্র যখন আসাম গভর্নরের এ-ডি-সি ছিলেন, তখন তার কাছে কত কি শুনত! ঘন ঘন কলকাতা থাকতেন লাটসাহেব আর ক্যাপ্টেন রায়কেই তো খবর দিতে হতো মিসেস সরকারকে।
.
বত্রিশ বছর দেশ সেবার পর ট্যান্ডন সাহেব যেদিন রিটায়ার করলেন, সেইদিন সন্ধ্যাবেলাতেই রাষ্ট্রপতি ভবনের ইস্তাহারে তার পুরস্কার ঘোষণা করা হল।…দি প্রেসিডেন্ট ইজ প্লিজড টু অ্যাপয়েন্ট…। ট্যান্ডন সাহেব আসামের গভর্নর হলেন। প্রেসিডেন্ট একটুও খুশি হননি তার। অ্যাপয়েন্টমেন্টে। সরকারি অফিসে বড় বড় অফিসারদের পৌষ মাস খুব বেশি দীর্ঘস্থায়ী হয় না। ট্যান্ডন সাহেবের এমন দুর্দিনে তাকে রাষ্ট্রপতির সেক্রেটারি করার প্রস্তাব করা হয়। প্রেসিডেন্ট নিজে ফাইলের উপর মন্তব্য লিখেছেন, এনি ওয়ান বার্ট মিঃ ট্যান্ডন! সেই ট্যান্ডনকে প্রেসিডেন্ট ইজ প্লিজড় টু অ্যাপয়েন্ট…।
দশ চক্রে ভগবান ভূত! ক্ষেত্র বিশেষে ও প্রয়োজন মতো অপ্রিয় অফিসারদের প্রমোশন দিয়ে দিল্লী থেকে বিতাড়ন করা হয়। ট্যান্ডন এমনি একজন অপ্রিয়-ভাগ্যবান। বত্রিশ বছর সরকারি চাকরি করতে গিয়ে কি না করেছেন?
আমাদের দেশে বিদ্যাসাগর-বিবেকানন্দের জীবনী ছাপা হয়। কিন্তু যদি এইসব দেশপ্রেমিক একসেলেন্সিদের জীবনী ছাপা হতো, তাহলে উপন্যাস লেখার প্রয়োজন হতো না। লিখলেও বিক্রি হতো না। মোগল সম্রাট ঔরঙ্গজেব এক হাতে পবিত্র কোরাণ অন্য হাতে ধারালো ছোরা নিয়ে রাজ্য পরিচালনা করেছিলেন বলে আজও তার নিন্দা ছাপা হচ্ছে ইতিহাসের পাতায় পাতায়। কিন্তু যেসব বেইমান মীরজাফরের দল এন্ডারসন বা ডায়ারে কৃপালাভ করার জন্য নিরস্ত্র মানুষের উপর গুলি চালিয়েছে, কিশোর-কিশোরীদের ফাঁসির দড়িতে ঝুলিয়েছে, তাদের নিন্দা কোনো ইতিহাসের পাতায় লেখা হল না। লেখা হল না আরো কিছু…।
পুরোদমে তখন দ্বিতীয় মহাযুদ্ধ চলছে। গ্রামের চাষীদের সর্বস্ব কেড়ে নিয়ে সৈন্যদের খাওয়াবার ব্যবস্থা হল। দেশের লোকদের মুষ্টিভিক্ষা দেবার জন্য চালু হল রেশনিং। পেটের ক্ষুধা, দেহে লজ্জা নিবারণের জন্য যা যা প্রয়োজন, তার সব কিছুই রেশনিং-এর আওতায় এল। এক মুষ্টি অন্নের জন্য, এক টুকরো কাপড়ের জন্য দেশের কোটি কোটি মানুষ হাহাকার করে উঠল।
দেশের মানুষের এই সর্বনাশের দিনেই ট্যান্ডন সাহেবের পৌষ মাস ছিল। ট্যান্ডন হলে ডেপুটি কন্ট্রোলার জেনারেল অফ রেশনিং। গাল ভরা নাম হলেও আন্ডার সেক্রেটারির চাকরি আর কি! ইংরেজ কোনো গোলমালকেই বিশ্বাস করত না। ডিফেন্স বা হোম ডিপার্টমেন্টে যে দুচারজন ইন্ডিয়ান অফিসার ছিলেন, তাদের কাউকেই কোনো গুরুত্বপূর্ণ বা গোপনীয় কাজের ভার দেওয়া। হতো না। আর যাদের দায়-দায়িত্ব দেওয়া হতো না, তারা পেতেন গাল ভরা নামে পোস্ট! ডেপুটি কন্ট্রোলার জেনারেল অফ রেশনিং ছিল এমনি এক পদ! দায়-দায়িত্ব বিশেষ না থাকলেও কয়েক হাজার লোকের অস্থায়ী চাকরি নেবার মালিক ছিলেন ট্যান্ডন সাহেব এবং সে সুযোগের সদ্ব্যবহার করতে কার্পণ্য করেননি তিনি।