কর্মব্যপদেশে চার চারটি মাস থেকে দেশ দেশান্তরে ঘুরে বেড়ালাম। সকাল, বিকেল, সন্ধ্যা বা মাঝরাতে টাইপরাইটারে প্রেস ম্যাসেজ টাইপ করে কেবল পাঠিয়েছি প্রায় প্রতিদিন। কাজকর্ম ও ককটেল ডিনারের অবসরে মস্কোয় রেড স্কোয়ারে ঘুরে বেড়িয়েছি, লেনিনের স্মৃতি সৌধে লেনিনের মৃতদেহ দেখেছি, জারদের স্মৃতি বিজড়িত পঞ্চদশ শতাব্দীর ক্রেমলিন প্রাসাদ দেখেছি, লেনিনগ্রাদে অক্টোবর বিপ্লবের স্মৃতি চিহ্ন দেখেছি, প্যারিসে ক্রেজী হর্স সেলুনে উন্মত্ত যৌবনের প্রদর্শনী দেখতে গিয়ে সারারাত স্যাম্পেন খেয়েছি, বার্লিনে দুটি বিবদমান মহাশক্তিকে মুখোমুখি দেখেছি, দেখেছি দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের ভয়াবহ ধ্বংসলীলার জীবন্ত ইঙ্গিত।
আরো অনেক কিছু দেখেছি ও করেছি। লণ্ডনে বণ্ড স্ট্রীট, অক্সফোর্ড স্ট্রীট, রিজেন্ট স্ট্রীটে ঘুরে বেড়িয়েছি। রাতের লণ্ডনে ইংরেজ যুবক যুবতীদের অসহ্য উচ্ছলতা দেখেছি, প্রত্যক্ষ করেছি কালা আদমীদের দুর্গতি। তারপর রোমে সুন্দরী ইতালিয়ান যুবতীর উষ্ণ সান্নিধ্য উপভোগ করেছি, সেন্ট পিটারের চারপাশে ঘুরে বেড়িয়েছি। আর একবার মহাকবি কীটস-এর সমাধির সামনে দাঁড়িয়েছিলাম কিছুক্ষণের জন্য। এরপর ক্রেডল অফ সিভিলাইজেশন আথেন্স দেখে এলাম বেইরুট। বাইবেলের ভাষায় লেবানন দুধ ও মধুর দেশ হলেও আজ কাল বোধহয় ওদেশের শিশুরাও হুইস্কী খেয়ে নাইট ক্লাবে মানুষ হয়।
এলাম কায়রো। সাতদিন থাকার প্রোগ্রাম ছিল, কিন্তু সাত হাজার বছরের ইতিহাসের ‘পর দিয়ে চোখ বুলিয়ে নিতে সাত দিনও সময় নিলাম না, পাঁচ দিনেই মোটামুটি সব কিছু দেখে নিলাম। স্যার যদুনাথ সরকার বা টয়েনবি হলে যে কাজ সত্তর বছরেও করতে পারতেন কিনা সন্দেহ, আজকের দিনে বুদ্ধিমান টুরিস্ট সে কাজ প্রয়োজনবোধে একদিনেও শেষ করতে পারেন। তাইতো পাঁচদিন ঘোরাঘুরির পর আমি আর প্রয়োজনবোধ করলাম না।
পরের দিন সকালে ঘুম ভাঙ্গার পরও অনেকক্ষণ বিছানায় এপাশ ওপাশ গড়াগড়ি করে কাটালাম। তবুও উঠলাম না, মাথার বালিশ দুটোকে বুকের তলায় চেপে ধরে বিছানার ’পর পড়ে রইলাম আরো কিছুক্ষণ। হঠাৎ মনটা উদাস হয়ে গেল, মনে পড়ে গেল দিল্লীর স্মৃতি। ঘরে ফেরার টান অনুভব করলাম অনেক দিন পর। আপন জনের বিরহ বেদনায় মনটা একটু নরম হয়ে গেল। মনে হলো ছুটে চলে যাই দিল্লী, কিন্তু মন তো অনেক কিছুই চায়!
অনিচ্ছা সত্ত্বেও উঠতেই হলো। হেলে দুলে বাথরুমে গেলাম। সেভ করে, স্নান সেরে বেরিয়ে এসে দেখি সাড়ে নটা বেজে গেছে। রুম সার্ভিসকে টেলিফোন করে ঘরে ব্রেকফার্স্ট দিতে বললাম। ব্রেকফার্স্ট সেরে ড্রেসিং টেবিলের সামনে দাঁড়িয়ে চুলের ওপর দিয়ে আরেকবার ব্রাশটা টেনে নিলাম, নাকের পাশ, চোখের কোণা থেকে ল্যাকটো ক্যালামাইনের গোলাপী দাগগুলো মুছে ফেললাম। তারপর টাই-নটটা একটু ঠিক করে নিয়ে কোটের পকেটে পাশপোর্ট আর ট্রাভেলার্স চেকগুলো পুরে নিলাম। নীচে ব্যাঙ্ক থেকে চেকগুলো ভাঙ্গিয়ে নিয়ে মাস্কি রোড বা খান খালিল বাজারে গিয়ে কিছু কেনা কাটার উদ্দেশ্যে গজেন্দ্র গমনে ঘর থেকে বেরিয়ে পড়লাম।
লিফট থেকে বেরিয়ে ডান দিকের কোণায় ব্যাঙ্কের কাউন্টারে গিয়ে বিশেষ ভীড় দেখলাম না। দুচারজন বিদেশী টুরিস্টদের পাশে একজন শাড়ি পরিহিতা যুবতীকে এক ঝলক দেখেছিলাম। মনে হয়েছিল দক্ষিণ ভারতীয়। যাই হোক সে ঐ ঝলকই, তার বেশী কিছু নয়। ব্যাঙ্কের কাউন্টারে পাশপোর্টের মধ্যে চেকগুলো গুঁজে এগিয়ে দিয়ে একটু পাশে সরে গিয়ে সিগারেট ধরালাম। সিগারেট টানতে টানতে হয়তো কোন আধেক-আবৃত কোন বিদেশিনীকে মুগ্ধ হয়ে দেখতে গিয়ে আনমনা হয়ে পড়েছিলাম, এমন সময় আমার নাম ধরে কে যেন ডাকতেই সম্বিত ফিরে এলো। বুঝলাম ব্যাঙ্ক কাউন্টার থেকে তলব এসেছে। চেকগুলোতে আর একবার সই করে ইজিপসিয়ান পাউণ্ডের নোটগুলো তুলে নিয়ে একটু এগুতেই হঠাৎ এক নারী কণ্ঠে কে যেন প্রশ্ন করলেন–আপনি বাঙালী?
সেদিন নাইল হিলটন হোটেলের লাউঞ্জে দিনে দুপুরে ভূত দেখলেও নিশ্চয়ই অতটা আশ্চর্য হতাম না, যা আশ্চর্য হয়েছিলাম অকস্মাৎ এক নারী কন্ঠে বাংলা কথা শুনে। নিজেকে একটু সামলে নিয়ে শুধু বললাম, হ্যাঁ।
একটু থেমে আবার প্রশ্ন করলাম, আপনিও বাঙ্গালী নাকি?
একটু হেসে তিনি বললেন, কেন? কথা শুনে কি মনে হচ্ছে জাপানী?
নিজের বোকামির জন্য নিজেই ভীষণ লজ্জিত বোধ করলাম! শুধু বললাম, অনেকদিন পর বাংলা কথা শুনে ব্রেনটা ঠিক রিএ্যাক্ট করতে পারেনি। তাছাড়া বাংলাদেশ থেকে হাজার হাজার মাইল দূরে কায়রোয় নাইল হিলটন হোটেলের লাউঞ্জে যে বাংলা কথা শুনব তা কল্পনাও করতে পারিনি…
এই ভাবেই ডাক্তারের সঙ্গে আমার প্রথম আলাপ। তারপর ঐ লাউঞ্জের একপাশে দাঁড়িয়েও ডাক্তারকে জানিয়েছিলাম, দুনিয়ার কোন চুলোয় ঠাঁই না হওয়ায় শেষ পর্যন্ত জার্নালিজম করছি এবং বাধ্য হয়ে বাংলাদেশের গুণী-জ্ঞানী শিক্ষিত লোকদের আমার লেখা পড়তে হচ্ছে।
কেন এ কথা বলছেন? জার্নালিজম তো চমৎকার প্রফেশন, আর নিশ্চয়ই ভাল লেখেন…
থাক, থাক, আর এগুবেন না।
ডাক্তারও তার নিজের কথা শুনিয়েছিল। শুনিয়েছিল, সে দেশ থেকে এম. বি. বি এস. পাস করে হাসপাতালে চাকরি করতে করতে বৃত্তি লাভ করে শিশু-যক্ষ্মারোগীদের বিষয়ে বিশেষজ্ঞ হবার জন্য পশ্চিম জার্মানীর স্টুটগার্টে ছিল দু বছর। এখন ডিপ্লোমা নিয়ে দেশে ফিরছে। জার্মানীতে থাকার সময় ছুটিতে কন্টিনেন্ট ঘুরেছে, কিন্তু মিডল ইস্ট দেখেনি। তাইতো এবার বেইরুট দেখে কায়রো এসেছে।