…তুমি ভাবতে পারবে না জার্নালিস্ট, মানুষ অর্থের জন্য, নারীর জন্য কত নীচ, কত জঘন্য, কত অশ্লীল হতে পারে। ইন্সপেকশনের জন্য বেরিয়ে ডাকবাংলোয় আশ্রয় নিয়েছি, বিশ্রাম নেবার জন্য ফরেস্টে গিয়েছি, নিমন্ত্রণ রক্ষা করতে বন্ধুর বাড়ী গিয়েছি, সব জায়গায় ব্যবসা দারের দল আমার জন্য একটি নৈবেদ্য প্রস্তুত রেখেছে। মন বিদ্রোহ করেছে, কিন্তু দেহকে সংযত করতে পারিনি। রাগে-আক্রোশে ইচ্ছায় অনিচ্ছায় এইরকম আগুন নিয়ে খেলা খেলতে খেলতে আমি নিজেকে হারিয়ে ফেললাম। আর হারালাম নিজের সংসার। আমার স্ত্রী পুত্রকে নিয়ে বিদায় নিলেন আমার সংসার থেকে। সে আজ বিশ বছরের কথা। এই বিশ বছরে আমি যতটা তলিয়ে গেছি, যতটা নীচে নেমেছি, আমার পুত্র ঠিক ততটাই উঁচুতে উঠেছে। ক্যালিফোর্নিয়া ইউনিভার্সিটিতে সে আজ নিউক্লিয়ার ফিজিক্সে সিনিয়র লেকচারার, কিন্তু তাকে নিয়ে আমার গর্ব করার কোন অধিকার নেই।
কাপুর সাহেব গড় গড় করে আরো অনেক কথা বলেছিলেন। আমি থামাতে চেষ্টা করেছিলাম, কিন্তু পারিনি।
…অনেক জায়গা ঘুরে শেষে দিল্লীতে এসে ভেবেছিলাম একটু স্বস্তি পাব, নিজেকে রক্ষা করতে পারব। কিন্তু অদৃষ্ট বিরূপ; ভারত বর্ষের সর্বত্র রাত্রের অন্ধকারের সুড়ঙ্গপথে সবার অলক্ষ্যে লুকিয়ে-চুরিয়ে যে কারবার, যে লেন-দেন হয়, রাজধানী দিল্লীতেই সেই লেন-দেন প্রায় প্রকাশ্যে হবার অফুরন্ত সুযোগ।
লিয়াজো অফিসার আর থার্ডপার্টিদের কৃপায় লাঞ্চ-ডিনার ককটেল রিসেপশনের অভাব নেই। এদের অনেকের কৃপায় সন্ধ্যার স্তিমিত আলোকে জোড়বাগ-গলফ লিঙ্ক–ডিফেন্স কলোনী–সুন্দর নগরের অনেক ফ্ল্যাটে, বিংশ শতাব্দীর অপ্সরীদের আবির্ভাব হয়।
কাপুর সাহেব বলতেন, পারভারশনের মধ্যে একটা আকর্ষণ আছে, পৈশাচিক আনন্দের মধ্যে একটা নেশার আমেজ পাওয়া যায়। তার সঙ্গে আছে অর্থ। এই ত্র্যহস্পর্শের টানে নেমে এসেছে সর্বস্তরের নারী।
রাজধানী দিল্লীর নৈশ অভিযানের অন্যতম নায়ক ছিলেন আমাদের কাপুর সাহেব। কিন্তু হঠাৎ একদিন দীর্ঘদিনের ইতিহাসের মোড় ঘুরল, কাপুর সাহেবের কাহিনীর ওপর যবনিকা নেমে এলো।
পর পর তিন দিন ছুটি ছিল। ডেরাডুনে চাওলাদের অতিথিশালায় তিনটি দিন উপভোগ করার জন্য মিঃ চাওলার সঙ্গে কাপুর সাহেব ভোরবেলায় চলে গেলেন ডেরাডুন। লাঞ্চের পর বিশ্রাম করে সন্ধ্যার মুখোমুখি ফিয়েটে করে দুজনে চলে গেলেন মুসৌরী। ডিনার খেয়ে ফিরতে ফিরতে রাত প্রায় দশটা বেজে গেল। চাওলা সাহেবের গাড়ী গেট দিয়ে ঢুকতে না ঢুকতেই হঠাৎ লাইট ফিউজ হয়ে গেল।
কাপুর সাহেবের সন্তোষ বিনোদনের জন্য একটি নৈবেদ্যের আয়োজন করেছিলেন বুদ্ধিমান চাওলাসাহেব। গাড়ী থেকে নেমে বারান্দায় উঠতেই তিনি মিহি সুরে দুজনকে অভ্যর্থনা করলেন। চাঁদের আবছা আলোয় চাওলাসাহেব পরিচয় করিয়ে দিলেন, কমলা, মীট মাই গুড এ্যাণ্ড রোমান্টিক ফ্রেণ্ড ববি কাপুর! ঐ আবছা আলোতেই তিনজনেই দু-এক পেগ হুইস্কী খেয়ে একটু গল্পগুজব করলেন।
ইতিমধ্যে চাকর-বাকরের দল ছুটাছুটি করেও, একটা ইলেকট্রিক মিস্ত্রী জোগাড় করতে পারল না। কাপুর সাহেব টিপ্পনী কেটে বললেন, দি ইলেকট্রিসিয়ান উইল নট টার্ন আপ বিফোর টু-মরো মর্নিং।
কয়েক মিনিট বাদেই টেলিফোন বেজে উঠল। এক বন্ধু সন্দর্শনের জন্য চাওলাসাহেব বিদায় নিলেন। প্রতিশ্রুতি দিলেন আধ ঘণ্টার মধ্যে ফিরে আসার। বিশ বছর আগে হলে কাপুর সাহেব বিশ্বাস করতেন, ইলেকট্রিসিয়ান এসে আলো জ্বালাবে আর চাওলাসাহেব আধ ঘণ্টার মধ্যে ফিরবেন। আজ জানেন, এ-সবই মিথ্যে, সবই উপলক্ষ্য মাত্র।
লনে বসে আরো পেগ দুই হুইস্কী খেয়ে নিলেন দুজনে। তার পরের কাহিনী নতুন কিছু নয়। বাকী রাতটুকুর জন্য কমলার বুকে আশ্রয় নিলেন কাপুর সাহেব।
ভোরবেলার দিকে ঠাণ্ডার আমেজ লাগায় ঘুম ভেঙ্গে গেল। ঘুমে অচৈতন্য প্রায় বিবস্ত্র কমলাকে পাশে দেখে চমকে উঠলেন কাপুর সাহেব। খুব ভাল করে দেখে নিলেন। হ্যাঁ, কপালের কাটা দাগটা ঠিকই আছে, বাঁ দিকের গালের তিলটাও। কাপুর সাহেবের সারা শরীরটা কেঁপে উঠল। বিন্দু বিন্দু ঘামে সারা শরীরটা ভিজে উঠল। কমলার গলা পর্যন্ত একটা চাদর টেনে দিয়ে খুব ভাল করে সারা মুখটা দেখে নিলেন। প্রায় বছর দশেক আগে দেখেছিলেন এই মুখ, বড় পছন্দ হয়েছিল। আদর করে ঘরে তুলে এনেছিলেন এক অনুজ প্ৰতিমের বধুরূপে।…ভাইয়ের থেকেও বেশি, দু যুগের ওপর তাঁরই কাছে থেকে জীবনে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল সেই ছেলে। সংসারের বিচিত্র গতিতে আর দেখা হয়নি। কোন সন্দেহের কারণ ছিল না, তবুও আলতো করে হাতের আংটিটা দেখলেন, ভ্যানিটি ব্যাগটা দেখে নিলেন। সব সংশয়ের অবসান।
হাতের কাছে রিভলবার থাকলে নিশ্চয়ই গর্জে উঠত। হয়তো দুটি প্রাণই দেহছাড়া হতো। কিন্তু তা হয়নি। কাপুর সাহেব চোরের মতো লুকিয়ে পালিয়ে এসেছেন দিল্লী। চাকুরীতে ইস্তফা দিয়ে ফ্রেণ্ডস কলোনীর বাড়ীতে বন্দী করেছেন নিজেকে।
মাঝে মাঝে আমি গিয়েছি। টুকটাক কথাবার্তা। কিন্তু তার সংযত আচরণের মধ্যেই কেমন যেন একটা চঞ্চলতা লক্ষ্য করেছি। বড় অসহায় মনে হয়েছে কাপুর সাহেবকে। তারপর আর কদিন যেতে পারিনি। কাজের চাপে টেলিফোন করাও হয়নি।