আমি পদার্থবিজ্ঞানী, কেমিস্ট নই। তাই কে. সি. এন.-এর চেয়ে কিলো ভোল্টকে আমি বেশি চিনি। ক্যাপসুলের চেয়ে ইলেকট্রিক চেয়ার। সেটাও আসল কথা নয়–আসল কথা এবার চুপি চুপি বলি : শুধু তোমাকেই বলছি!
ইতিমধ্যে আমার অদ্ভুত একটা পরিবর্তন হয়েছে, জানলে? ডায়ালেকটিকাল মেটেরিয়ালিজম-এ এর ব্যাখ্যা খুঁজে পাচ্ছি না। সেটা যে কী, তা এদের বলতে যাওয়া বৃথা। এরা বুঝবে না! তোমার কাছে তো যাচ্ছিই–তোমাকে বলব, বুঝবে তুমি। আর একজন বুঝবেন–তিনি আমার বাবা। সে জন্যই ক্যাপসুলটা আমি মুখে পুরতে পারছি না। আমি নিজের ক্ৰস্ নিজের কাঁধে বইতে চাই যে!
মৃত্যুদণ্ডাজ্ঞা পেয়ে আমি একটি অনুরোধ জানাব। আমার বাবাকে শুধু একবার দেখতে চাই : তাকে একটা অনুরোধ করে যাব : আমার সমাধির ওপর কবি উইলিয়াম টেস্-এর ওই চারটি লাইন কবিতা যেন তিনি উত্তীর্ণ করিয়ে দেন। হ্যাঁ, চারটি লাইনই। প্রথম দুটি সমেত :
চিরউন্নত বিদ্রোহী শির লোটাবে না কারও পায়ে
তোমারেই শুধু করিব প্রণাম, অন্তরতম প্রভু!
জীবনের শেষ শোণিতবিন্দু দিয়ে যাব দেশ-ভাইয়ে
রহিবে বিবেক! সে শুধু আমার! বিকাবো না তারে কভু!
তোমার কাছে যাওয়ার সময় হয়ে এল। লর্ড যিসাস্! এবার তুমি মেষশিশুর মতো আমাকে তোমার বুকে তুলে নাও।
আমেন!
সমাপ্ত
৮. পরিশিষ্ট
পরিশিষ্ট ক
শেষ কথা
কাহিনির সমাপ্তি আছে, ইতিহাস থামতে জানে না। আমি এ কাহিনির যবনিকা টেনেছি 1950-এর তিরিশে জানুয়ারি, যেদিন তথাকথিত “বিশ্বাসঘাতক” ডেক্সটার জবানবন্দি দেন। তারপর চব্বিশবার এই পৃথিবী সূর্যপ্রদক্ষিণ করছে। তাই কথাসাহিত্যের খাতিরে যেখানে থেমেছি তার পরের কথা এবার বলি। যা সেদিন ছিল একান্ত গোপন, তার তথ্য জেনে ফেলেছে অন্তত আধ ডজন দেশ। কে কবে পরমাণু বোমার বিস্ফোরণ ঘটিয়েছে সে তথ্যটা এই সঙ্গে লিখে রাখি :
আমেরিকা-16 জুলাই 1945
রাশিয়া–23 সেপ্টেম্বর 1949
ব্রিটেন-15 মার্চ 1957
ফ্রান্স–13 ফেব্রুয়ারি 1960
চিন–16 অক্টোবর 1964
ভারত–18 মে 1974
ডক্টর ফুকস-এর আশঙ্কা কতদূর বাস্তব তার ইতিহাস সকলেরই জানা।
ডক্টর জে. ওপেনহাইমারের বিচারের রায় প্রকাশিত হয়েছিল 1958 সালে। বিশ্বাসঘাতকতার অভিযোগ থেকে তাকে অব্যাহতি দেওয়া হয়; কিন্তু এ কথাও প্রমাণিত হয় যে তিনি পদমর্যাদা অনুযায়ী আচরণ করেননি। কর্তব্যচ্যুতি, মিথ্যাভাষণ ইত্যাদির অভিযোগ প্রতিষ্ঠিত হয়। ফলে সরকারি গোপন তথ্যে তার প্রবেশাধিকার প্রত্যাহৃত হয়। এর পর দীর্ঘ নয় বছর ডক্টর ওপেনহাইমার অন্তেবাসীর জীবন যাপন করেন। প্রমাণিত হয়েছিল, মিস ট্যাটুলক তার প্রাকবিবাহ জীবনে প্রণয়িনী মাত্র–ট্যাটুলকের আত্মহত্যার সঙ্গে গুপ্তচর বৃত্তির কোনো সম্পর্ক নেই। মৃত্যুর পূর্বে ওপেনহাইমারকে ‘এনরিকো ফের্মি অ্যাওয়ার্ড’ পুরস্কার দেওয়া হয়, যার আর্থিক মূল্য পঞ্চাশ হাজার ডলার। তার মৃত্যুর পর প্রফেসর হারকন শেভেলিয়ার একটি আত্মজীবনী লেখেন, যার উল্লেখ গ্রন্থপঞ্জীতে করা হয়েছে।
পারমাণবিক-বোমার অপেক্ষা শক্তিশালী মারণাস্ত্র আমেরিকা ও রাশিয়া পর পর আবিষ্কার করে-যার নাম হাইড্রোজেন বোমা অথবা থার্মোনিউক্লিয়ার বোমা। ডেক্সটারের বিশ্বাসঘাতকতার জন্য রাশিয়ার বৈজ্ঞানিকদের সাফল্য অন্তত দেড় থেকে দুবছর এগিয়ে আসে। এ-কথা অস্বীকার করার উপায় নেই, ওই তথাকথিত বিশ্বাসঘাতকের জন্য পৃথিবীর দুটি বৃহত্তম-শক্তির ক্ষমতার সমতা ত্বরান্বিত হয়েছিল।
***
বাস্তব তথ্য থেকে কোথায় কতদূর বিচ্যুত হয়েছি এবার তা স্বীকার করি :
ডক্টর ক্লাউস ফুকস্ ইংল্যান্ডে এসে যে পরিবারে আশ্রয় নিয়েছিলেন সেই পরিবারে যে মেয়েটি ছিল তার নাম ‘রোনাটা’ নয়। সৌজন্যের খাতিরে নামটা আমি পরিবর্তন করেছি। অনুরূপভাবে হারওয়েল তিননম্বর চেয়ারে অধিষ্ঠিত ডক্টর ফুকসের ওপরওয়ালার নাম প্রফেসর অটো কার্ল নয়। সেই ওপরওয়ালার নাম প্রফেসর রুডলফ পেল। তাঁর স্ত্রীর সঙ্গে ফুকসের কোনো সম্পর্ক গড়ে ওঠেনি। প্রফেসর অটো কার্ল-এর নামটি কল্পিত। ফুকস-এর ওপরওয়ালা একজন বৈজ্ঞানিক তার স্ত্রীকে সঙ্গে নিয়ে এবং ফুকে নিয়ে পারি ও সুইজারল্যান্ডে বেড়াতে এসেছিলেন এ কথা সত্য; কিন্তু পারি হোটেলের অভ্যন্তরে যে-সব ঘটনার কথা বলা হয়েছে তা কল্পনা। বলা বাহুল্য, ওই প্রফেসরের তরুণী ভার্যার নামও ‘রোনাটা’ ছিল না। এছাড়া মানসিক বিপর্যয়ে মূল অপরাধী একদিন হঠাৎ থানায় উপস্থিত হয়ে স্বতঃপ্রণোদিতভাবে-জবানবন্দি দিতে চান এ কথা সত্য; কিন্তু তিনি একটি টেপ রেকর্ডার যন্ত্রের সামনে বসে নির্জনে স্বর্গগতা বান্ধবীকে উদ্দেশ করে তাঁর বক্তব্য রাখেন–এমন কোনো নজির নেই।
অপরাধীর ধারণা ছিল তাঁর মৃত্যুদণ্ড অবধারিত! সে কথা জেনেই তিনি জবানবন্দি দিয়েছিলেন। কিন্তু বাস্তবে তার মৃত্যুদণ্ড হয়নি। বিচারকালে আদালত-কর্তৃক নিযুক্ত অভিযুক্তের কৌঁসুলী যুক্তি দেখান–বিশ্বাসঘাতকতার অপরাধে মৃত্যু সেখানেই প্রযোজ্য যেখানে শত্রুপক্ষকে গোপন সংবাদ সরবরাহ করা হয়। এক্ষেত্রে সোভিয়েত ইউনিয়ন ছিল ইঙ্গ-মার্কিন দলের মিত্রপক্ষ। এই আইনের ফাঁকে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া যায়নি। বিচারক আইনে-নির্দেশিত সর্বোচ্চ শাস্তি দিয়েছিলেন-চোদ্দো বছর সশ্রম কারাদণ্ড। বাস্তবে নয় বছর পরে (1959) তাকে মুক্তি দেওয়া হয়–বিজ্ঞানজগতে তার দানের কথা স্মরণ করে।