–পদত্যাগ করছেন? আপনি। কেন?
–আমি চিরদিনের জন্য হারওয়েল ছেড়ে চলে যাচ্ছি, ক্লাউস।
–কেন স্যার?
–তোমাকে তো আগেই বলেছি জুলি–প্রত্যেক ক্রিশ্চিয়ানের জীবনে এমন একটা ‘ক্রস্’ থাকে যার ভার তাকে নিজেকেই বইতে হয়।
–আমাকে সব কথা খুলে বলবেন?
-বলতেই তো এসেছি। তবে সব কথা নয়। কারণ সবটা আমার নিজের কথা নয়–
-তবে কার? রোনাটার?
-না, আমার যমজ-ভাইয়ের। রোনাটার সব কথা তোমাকে খুলে বলতে আমার আপত্তি নেই। সে কথা শোনার অধিকার তোমার আছে। কী জানতে চাও বলো?
ফুকস্ কোন ইতস্তত করল না। সরাসরি চরম প্রশ্নটা একেবারে প্রথমেই পেশ করে বসে, রোনাটা আপনার সন্তানের জননী হয়নি কেন? অসুস্থ ছিল কে? আপনি না রোনাটা?
বৃদ্ধ তীক্ষ্ণদৃষ্টিতে বিদ্ধ করেন প্রশ্নকারীকে। প্রতিপ্রশ্ন করেন, রোনাটা বলেনি তোমাকে?
–না। সে শুধু বলেছিল–বিবাহের আগেই আপনি নাকি কথা দিয়েছিলেন, আপনার সন্তানের জননী হতে হবে না তাকে।
-হ্যাঁ, ঠিক কথা। ওইরকম একটা প্রতিশ্রুতি আমি দিয়েছিলাম।
–কিন্তু কেন? কেন?
-কারণ কোনো সন্তানের পিতা হবার মতো শারীরিক ক্ষমতা আমার নেই। অ্যালিসের মাকে বিবাহ করে সেটা বুঝতে পেরেছিলাম আমি।
ফুকস্ অসহিষ্ণুর মতো মাথা ঝাঁকিয়ে চাপা আর্তনাদ করে ওঠে, তবে সব জেনেশুনে কেন ওই বাইশ বছরের মেয়েটির এতবড় সর্বনাশ আপনি করলেন? এজন্য পরলোকে আপনাকে জবাবদিহি করতে হবে না?
ম্লান হাসলেন কার্ল। বললেন, পরলোক। তুমি মানো?
-না, মানি না, আমি মানি না, কিন্তু আপনি তো মানেন। এজন্য নিজেকে দায়ী। মনে করেন না?
শান্ত সমাহিত কণ্ঠে অধ্যাপক বললেন, না। এজন্য আমি দায়ী করি তোমাকে।
–আমাকে?
–হ্যাঁ, তোমাকে। এবার তুমি জবাবদিহি কর কেন ওই বাইশ বছরের মেয়েটার এতবড় সর্বনাশ করলে তুমি? কেন তাকে বিবাহ করনি? কেন তাকে বাধ্য করলে আমার সঙ্গে এমন অস্বাভাবিক জীবন যাপন করতে?
ক্লাউস দু-হাতে মুখ ঢেকে বসে রইল। জবাব জোগালো না তার মুখে।
বৃদ্ধ তখন একে একে বলতে থাকেন তার অভিজ্ঞতার কথা। অসঙ্কোচে। যেন চার্চে এসে ‘কনফেস্’ করছেন। যেন ক্লাউস ওখানে উপস্থিত নেই। তিনি তাঁর বিচারকের সামনে সব কিছু মনের ভার উজাড় করে দিচ্ছেন :
যৌবনের ঊষাযুগে একটি কলেজে-পড়া প্রাণচঞ্চল মেয়ে ভালোবেসেছিল একটি যুবককে। একই বাড়িতে থাকে ওরা, একই বয়সী প্রায়। ওদের মন জানাজানি হল। তারপর ছেলেটি হঠাৎ একদিন বাঁধন ছিঁড়ে সরে পড়তে চাইল। মেয়েটি প্রাণপণ বলে তাকে আঁকড়ে ধরতে চেয়েছিল–নির্লজ্জের মতো বলেছিল, আমায় বিবাহ করো। ছেলেটি শোনেনি। প্রত্যাখ্যান করার একটা মনগড়া কৈফিয়ও দেখায়নি। পাথরের দেয়ালে মাথা খুঁড়ে ফিরে এসেছিল মেয়েটি। তারপর অনেক। পুরুষ এসেছে তার জীবনে, কিন্তু সে তার প্রথম প্রেমকে ভুলতে পারেনি। বাবা মারা গেলেন–ভাইবোনেরা প্রতিষ্ঠিত হল জীবনে, বিয়ে করল। ও স্থির করল–আজীবন বিবাহ করবে না। সন্ন্যাসিনী হয়ে যাবে। নান’ হয়ে যাবে। কিন্তু সেই সংকল্পটাও তার হারিয়ে গেল, যখন অ্যালিসের মা ছয়মাসের শিশুকন্যাটিকে রেখে মারা গেলেন। পিতৃবন্ধু আত্মভোলা অধ্যাপক অটো কার্লকে দেখে মায়া হল মেয়েটির। মা-হারা মেয়েটিকে সে বুকে তুলে নিল। সে নিজেই হতে চাইল অ্যালিসের মা। প্রফেসর কালই বরং আপত্তি করেছিলেন। বয়সের পার্থক্যের জন্য নয়, যৌনজীবনে তিনি যে অশক্ত তা বুঝতে পেরেছিলেন অ্যালিসের মাকে বিবাহ করে। সত্যাশ্রয়ী প্রফেসর নির্দ্বিধায় সব কথা খুলে বলেছিলেন রোনাটাকে। পরিবর্তে রোনাটাও খুলে বলেছিল তার জীবনের গোপনতম লজ্জার কথাটা। সে প্রত্যাখ্যাতা। বলেছিল, প্রফেসর, সন্ন্যাসিনী হতে চেয়েছিলাম আমি, তা এও তো একরকম সন্ন্যাসিনীর জীবন। অন্তত–দুজনেই নিঃসঙ্গতার হাত থেকে তো মুক্তি পাব। আপনার বিধবা মেয়ে থাকলেও তো তাকে বাড়িতে থাকতে দিতেন।
বৃদ্ধ চুপ করলেন। ফুকস্ তখনও বসে আছে স্থাণুর মতো। কিন্তু রেহাই দিলেন না তাকে অধ্যাপক কার্ল। বললেন, সত্যি করে বল তো জুলি, কেন প্রত্যাখ্যান করেছিলে তাকে?
ফুকস উঠে দাঁড়ায়। নীরবে পায়চারি করে কয়েকবার। তারপর বলে, প্রফেসর। প্রত্যেকের জীবনেই এমন একটা ‘ক’ থাকে যার ভার তাকে একাই বইতে হয়–
চীৎকার করে ওঠেন বৃদ্ধ : না। ওকথা বলার অধিকার তোমার নেই। ওটা ক্রিশ্চিয়ানের কথা। তুমি খ্রিস্টান নও। তুমি নাস্তিক। ক্রস’ বইবার অধিকার তোমার নেই।
-আমি নাস্তিক। কে বলেছে আপনাকে?
প্রফেসর কার্ল নীরবে একটি ভোলা চিঠি বার করে ওর হাতে দিলেন। রোনাটার পত্র। শেষ পত্র। লিখে গেছে তার স্বামীকে। সম্বোধন করেছে, ‘মাই ডিয়ার ওল্ড ড্যাডি’ বলে। অকপটে সে স্বীকার করেছে তার পারির শেষ রজনীর অভিজ্ঞতা। সবিস্তারে। পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে। লিখেছে, আমার ইচ্ছার বিরুদ্ধে যদি এ দুর্ঘটনা ঘটত তাহলে নিজেকে ক্ষমা করতাম। তাহলে মিসেস অটো কার্লের পরিচয় বহন করেই জীবনের বাকি কটা দিন কাটিয়ে যেতে পারতাম। কিন্তু তা তো হয়নি। আই ওয়াজণ্ট রেপড। আই কোয়াপরেটেড। অ্যান্ড আই এঞ্জয়েড দ্য অর্গাজম। দ্যাটস্ হোয়াই আই হ্যাভ সিনড।
বুকের ভিতর মুচড়ে উঠল ফুকস-এর। রোনাটা আত্মহত্যা করেনি–ক্লাউস তাকে হত্যা করেছে! মাথাটা সে আর তুলতে পারে না।