মিসেস ডেভিডসন! আমার স্ত্রী! আপনার সঙ্গে আলাপ হয়নি। ইনি মিস্টার ভিন্সেন্ট ভান গর্গ!
মিসেস ডেভিডসন গাড়ি থেকে নেমে এসে ডান হাতখানা বাড়িয়ে দিয়ে বলেন, ডিলাইটেড টু মিট য়ু মিস্টার গর্গ। কিন্তু আপনাকে কোথায় দেখেছি বলুন তো?
ভিন্সেন্ট তখনও স্বাভাবিক হতে পারেনি। ঊর্মিলা কি সত্যিই ওকে চিনতে পারছে না, কি এও ওর একটা চাল? কিন্তু কী সুন্দর দেখতে হয়েছে ঊর্মিলাকে! কোথায় সেই কিশোরী ঊর্মিলা, আর কোথায় এই পূর্ণযৌবনা মিসেস ডেভিডসন!
আপনি কি বাওয়ালী গ্রামে ফাদার শারদাঁর কাছে কখনও এসেছিলেন? ঠিক ঐ । রকম বড় বড় খরগোশের মত কান
ডক্টর ডেভিডসন একটু অপ্রস্তুত। সদ্য-পরিচিত কোন ভদ্রলোকের দৈহিক বিকৃতি নিয়ে তাঁর স্ত্রী যে এমন অশালীন উক্তি করে বসতে পারেন, এটা যেন ধারণা ছিল না তাঁর।
ভিন্সেন্ট মুহূর্তে মনস্থির করে। প্রগম্ভ ঊর্মিলা ওকে নিয়ে রসিকতা করছে! ভুল করেছিল ভিন্সেন্ট, এটা সে স্বীকার করছে। ঐ মেয়েটিকে প্রেম নিবেদন করে সে ভুল করেছিল। কিন্তু তার ভালবাসায় তো কোন খাদ ছিল না। উপেক্ষ্য সহ্য হয়, কিন্তু তার, সঙ্গে অপমানের কৌতুক যোগ করার কি প্রয়োজন? গম্ভীর হয়ে বলে, আপনি বোধহয় অন্য কারও সঙ্গে আমায় ভুল করেছেন। বাওয়ালী গ্রামের ফাদার শারদাঁকে আমি চিনি না।
ফাদার শারদাঁ না হলেও অন্তত রেভ. হেনরি চার্ডিনকে নিশ্চয় চেনেন?
ভিন্সেন্ট এবার ঊর্মিলাকে সম্পূর্ণ উপেক্ষা করে ডক্টর ডেভিডসনকে বলে, –এদিকে কোথায় যাচ্ছিলেন?
ছুটির দিনে পিকনিক করতে বেরিয়েছি। কোন নির্জন জায়গায় বসে দুপুরটা কাটাব। সঙ্গে গ্রামাফোন আছে, খাবার আছে।
মিসেস ডেভিডসন বলেন, –আপনিও আসুন না মিস্টার গর্গ! ছবি আঁকা তো রোজই আছে। আজ পিকনিক করে যান বরং। আপনাকে দেখে আমার পুরনো দিনের কথা মনে পড়ে যাচ্ছে।
ডক্টর বলেন, আসবেন? মন্দ মজা হয় না তাহলে—
ভিন্সেন্ট দোটানার মধ্যে পড়ে যায়। বুঝতে অসুবিধা হয় না ঊর্মিলা ওকে নিয়ে মজা করতেই এ প্রস্তাবটা করছে। সে শুধু ভিন্সেন্টকে নিয়ে কৌতুক করতে চায়, খেলা করতে চায়। কিন্তু ভিন্সেন্ট? দীর্ঘদিন পরে ঊর্মিলাকে দেখে ওর কী ভাল যে লাগছে! ওকে এখনই দৃষ্টির আড়ালে সরে যেতে দিতে মন সরে না। বলে, -পুরানো কথা মানে?
মিসেস ডেভিডসন তার স্বামীর দিকে ফিরে বলেন, তোমাকে বলেছি কিনা ঠিক মনে নেই। বাওয়ালীতে আমি একবার কালল্যাভে পড়েছিলাম। ছেলেটিকে দেখতে অনেকটা আপনার মত মিস্টার গর্গ। অন্তত তার কান দুটো!
ডক্টর ডেভিডসন হো-হো করে হেসে ওঠেন। বলেন, তুমি এসব কথা আমাকে কোনও দিনই বলনি! কিন্তু এভাবে মিস্টার গর্গকে বিব্রত করা কি তোমার ঠিক হচ্ছে?
–আপনি কি বিব্রত বোধ করেছেন মিস্টার গর্গ?
ভিন্সেন্ট মাথা নেড়ে বলে, –মোটেই না! আমার বরং হিংসে হচ্ছে। আমি নিজেই কেন সেই ছেলেটি হলাম না!
ডক্টর আবার দিলখোলা হাসি হাসেন। বলেন, ঠিক মুখের মত জবাব হয়েছে।
ঊর্মিলাও হাসতে হাসতে বলে, –তা হলেই বা কী লাভ হত? আপনিও নিশ্চয় তার মত পালিয়ে যেতেন!
-তোমার বুল কাফ কি তোমার গুঁতো খেয়ে পালিয়ে গিয়েছিলেন নাকি?–প্রশ্ন করেন ডক্টর।
-হ্যাঁ! প্রণয় উপহার দেবার ভয়ে!
ভিন্সেন্ট গম্ভীর হয়ে বলে, কী উপহার চেয়েছিলেন আপনি?
–বিশেষ কিছু নয়! তার খরগোশের মত কান দুটো!
অট্টহাস্যে ফেটে পড়েন ডেভিডসন, –ও য়ু নটি গার্ল!
ভিন্সেন্টের কর্ণমূল লাল হয়ে ওঠে। সে জবাব দিতে পারে না!
ডক্টর ডেভিডসনের সনির্বন্ধ অনুরোধ উপেক্ষা করল শেষ পর্যন্ত। সে পিকনিক যেতে রাজী হল না। ছবিটা আজই শেষ করতে হবে তাকে। মিসেস ডেভিডসন ওকে বারে বারে নিমন্ত্রণ করে গেলেন। বললেন, আপনাকে কষ্ট দিচ্ছি, মিস্টার গর্গ! কিন্তু আপনাকে দেখলে আমার সেই হারানো-প্রেমের আনন্দ ফিরে পাব। আসবেন কিন্তু!
ভিন্সেন্ট বললে, -নেহাৎ যদি না যেতে পারি আমার প্রেসেন্ট আপনাকে পাঠিয়ে দেব!
–প্রেসেন্ট? ছবি?
না! আমার কান দুটো! সে দুটোর উপরেই তো আপনার লোভ!
হো-হো করে হেসে উঠেছিলেন সস্ত্রীক ডক্টর ডেভিডসন।
ভিন্সেন্ট ওঁদের সঙ্গে বনভোজনের আনন্দ ভাগ করে নিতে পারেনি। নিরলস নিষ্ঠায় সে সারাদিন ধরে ল্যাণ্ডস্পেকখানা শেষ করল। তারপর সন্ধ্যাবেলা সম্বিৎ ফিরে পেয়ে দেখে সারা দিনমান সে পণ্ডশ্রম করেছে। রাঁচির নিসর্গ চিত্র মোটেই আঁকেনি। নিজের অজান্তে সে এঁকে গেছে কী, তা সে নিজেই জানে না। কিছুটা লাল, কিছুটা সবুজ, কিছুটা কালোর প্রলেপ। সম্পূর্ণ বিমূর্ত চিত্র! তার অর্থ বোধকরি স্বয়ং শিল্পীরও বোধের অতীত। যেন শিল্পীর অবদমিত অবচেতন মনের কতকগুলো রক্তের মত জমাট উলঙ্গ বাসনা কামনা তুলির মুখে বেরিয়ে এসে ক্যানভাসটাকে কলঙ্কিত করেছে। হালকা তুলির স্পর্শ নয়, সে যেন স্যাব-হেয়ার ব্রাশটাকে শংকর মাছের চাবুকের মত ব্যবহার করেছে। সারাদিন। ক্যানভাসের পিঠ সেই চাবুকের আনিতেই চিত্রের উপর ফুটে উঠেছে রক্তের মত রাঙা রেখা! যা বলতে চেয়েছে, যা আঁকতে চেয়েছে তা বলা হয়নি, আঁকা হয়নি। বরং যা বলতে চায় না, লুকাতে চায় তাই বলে বসে আছে!
ক্যানভাসটাকে ছুঁড়ে ফেলে দিয়ে রিক্তহাতে ফিরে এসেছিল ভিন্সেন্ট।
সমস্ত রাত ওর ঘুম হল না। যন্ত্রণায় বিছানায় সে শুধু এপাশ-ওপাশ করল।