.
এককড়ি সরখেল তার কথা রেখেছে। পরদিনই ওকে নিয়ে দেখিয়ে আনল পাতালরাজ্যটা।
অদ্ভুত অভিজ্ঞতা একটা। লোহার খাঁচায় আর দশজন মালকাটার সঙ্গে এককড়ি ওকে নিয়ে উঠল খাদ-ভসকার মাথায়। ঘন্টা বাজল, হঠাৎ দুলে উঠল খাঁচাটা। ঝাঁপ দিয়ে পড়ল পাতকুয়োর গর্তে। নাগরদোলায় নাতির মুখে হঠাৎ যেমন পেটের মধ্যে গুলিয়ে ওঠে সেই অনুভূতিটাই চতুর্গুণ হয়ে জেগেছিল প্রথমে। দু-পাশে খাড়া পাথরের দেওয়াল। তির তির করে জল ঝরে পড়ছে শ্যাওলাধরা দেওয়াল বেয়ে। কখনও অঝোর ধারে ঝরে পড়ছে খাঁচার উপরে। ঘনিয়ে আসে অন্ধকার। ঘোর অন্ধকার। কিছু ঠাওর হয় না। অবশেষে খাঁচাটা এসে থামল পাতালপুরীর একপ্রান্তে। সেটা আসলে শেষপ্রান্ত নয়, পাতালরাজ্যের সেটাই শুরু। সুরঙ্গ দিয়ে উপর পানে তাকিয়ে দেখলে এ পাতালরাজ্যের হিসাবে অতবড় আকাশটার দাম স্রেফ এক আধলা। অতি ক্ষুদ্র গোলাকৃতি একটা সাদা বিন্দু।
দুমুখো দুটো রাস্তা। গোলাকার টানেল, চলে গেছে সামনের দিকে। নিশ্চিদ্র অন্ধকারের বুক চিরে। জোনাকি পোকার মত নীলাভ আলোর খাঁচালণ্ঠন নিয়ে এককড়ি রওনা হল একদিকে, বলে, পিছন পিছন এস ফাদারদা।
রাস্তাটা প্রথমে বেশ চওড়া, খাড়াই অনেকটা। দু-জোড়া ছোট রেলের লাইন চলে গেছে সাপের মত এঁকেবেঁকে। একটু পরেই পথটা আরও সরু হয়ে গেল। দুটো মানুষ পাশাপাশি যেতে পারে না। মাথা নিচু না করলে ঠুকে যাবে পাথরের দেওয়ালে। চন্দ্রভান কিছুই দেখতে পায় না; এই আলো-আঁধারে দেখতে সে অভ্যস্ত নয়। বারে বারে ঠোক্কর খাচ্ছে ঢালু পথে। একটু পরেই একটা ফাঁকা মত জায়গা। দু-তিনটে সুরঙ্গ । পথ এসে মিশেছে এখানে। এককড়ি বলে, –দেওয়াল সিঁটে দাঁড়াও কেনে ফাদারদা। কয়লা বোঝাই টব যাবে কিন্তুক এই রেলের লাইন বরাবর।
অসহ্য গরম। দরদর করে ঘাম ঝরছে। পায়ের নিচে জল। এত জল কোথা থেকে আসছে এ পাতালপুরীতে? অন্ধকারে আবছা নজর হল সুরঙ্গপথে কজন মানুষ গাঁইতা চালাচ্ছে। মেয়েরাও কাটছে কয়লার চাই–বোঝাই দিচ্ছে লোহার টবগাড়িতে। ঠেলে নিয়ে যাচ্ছে। বাচ্চারাও আছে–আট-দশ বারো বছরের ছেলে ও মেয়ে। ওরা কয়লা বোঝাই দিচ্ছে টবে, ঠেলে নিয়ে যাচ্ছে হলারের দিকে।
দৈত্যটারে দেখতি আসছি ফাদারদা? তা দেখি লও কেনে! বড় জবর লড়াই করে শালা। তা করুক। মর্মও কম যায় না এ দৈত্যটারেও টুক্ দেখি লও। হঁ!
গাঁইতাটাকে কাঁধের উপর তুলে দৈত্যের মত দু-পা ফাঁক করে খাড়া হয়ে দাঁড়ায় যোসেফ মুর্ম–যেন ফটো তোলাচ্ছে। ভেডিস-ল্যাম্পের নীলাভ আলোয় জখম ঠ্যাঙাখানায় ভর দিয়ে ওর সোজা হয়ে দাঁড়াবার ভঙ্গিটা অদ্ভুত। সর্বাঙ্গ মিশ কালো, শুধু দু-চোখের সাদা অংশটুকু চকচক করছে।
ওভারম্যান এককড়ি হাতের লণ্ঠনটাকে পরীক্ষা করে দেখল। তারপর শিকারী কুকুরের মত নাক উঁচু করে কি যেন শুঁকে বলে, –গ্যাস যান বেশি মনে লাগে বড়ভাই! এ পিটে কাম বন্ধ করি দাও বরং। গাইতার মুখে ফুকি উঠলি বিতিকিচ্ছিরি কাণ্ড হই যাবে।
মুর্মু হেসে উড়িয়ে দেয়; বলে, –ওস্তাদ, খালিটব হলারে পাঠালি হাজরিটো লিখে লিবে তো তুমি?
এ কথার জবাব নেই।
এককড়ি অসহায়ের মত মাথা নাড়ে। অনুনয়ের সুরে বলে, একটো দিন বই তো লয়। আমি আজই বড় সাহেবরে বলি। এ পিটে পেরথমে হাওয়া পাম্প করতে হবেক।
আমিনবাবু ছিল পিছনে। বললে, ইটা তো যোসেফদার কথার জবাব লয় ওস্তাদ? খালিটব পাঠালি উয়াদের হাজরির কি হবে?
হঠাৎ ধমকে ওঠে এককড়ি, আর অগ্নিকাণ্ড হই গেলে হাজরিটো মিলবে? সওয়া শ মালকাটা এখন খাদের ভির রইছে। সিটো খেয়াল আছে?
মুর্মু একগাল হেসেছে। মিশ্বালো মুখে একঝাঁক সাদা দাঁত ভুট্টার দানার মত। বলে, –দেড়শ মালকাটার হিসাবটো তুমার, মোর লয় ওস্তাদ। মোর স্রেফ সাত পেটের হিসাব বটে! মাগভাতার আর পাঁচটো বাচ্ছা! ব্যস্! একদিনের খোরাকি দিবে তুমি?
এককড়ি জবাব দিতে পারে না। ওর অসহায় অবস্থাটা দেখে যোসেফ বোধহয় দুঃখিত হয়। এগিয়ে এসে কয়লামাখা হাতখানা রাখে এককড়ির কাঁধে। বলে, ডরাও কেনে গ ওস্তাদ? খাদের ভিৎরি জনম কাটল মোর। এ্যারে চিনি না? আগুনের ফুলকি ছুটতে দিব কেনে? গাঁইতা চালাইব যান মাগের মুখে চুমু খাইছি!
চুক করে অদ্ভুত একটা শব্দ করে ভেঙায়। ভিখু, বুধন আর আন্টুনি হাহা করে হেসে ওঠে। ওপাশ থেকে বাতাসী বলে ওঠে, -মরণ
এককড়িও রাগ করে বলে, –মর তা হলে।
অ্যাই খবদ্দার! গাঁইতা উঁচিয়ে রুখে দাঁড়ায় মুর্মু। দুতরফা মরণ-ডাক সে সইতে পারে না। এককড়িও ঘুরে দাঁড়ায়। এটা ইয়াকুবের ভাটিখানা নয়। এখানে সে ওভারম্যান। পাঁচটা মালকাটার সামনে সে আপন মর্যাদা ভুলে থাকতে পারে না। সুরঙ্গ থেকে লীলায়িত ছন্দে বেরিয়ে আসে বাতাসীদাঁড়ায় দুই প্রতিযোগীর মাঝখানে। যোসেফের দিকে ফিরে বলে, হাই বাবা! কারে কি বুলছিস্ বড়ভাই! উ হল গে ওস্তাদ!
যোসেফ এক হাতে তাকে সরিয়ে দেয়। ওভারম্যানের দিকে এগিয়ে এসে বলে, মরণ কেনে কড়ছিস ওস্তাদ? মরণ কাড়লি মোর সব ভুল হই যায়, তু তো জানিস। লে ভাই, খৈনি লে–
এ জতুগৃহে বিড়ি খাওয়া মানা। তামাকপাতা চিবায় ওরা সারা দিনমান।
এককড়ি হেসে ফেলে। হাত বাড়িয়ে তামাকপাতা নিয়ে ডলতে থাকে।
এককড়ি আর যোসেফ। প্রভু আর ভৃত্য। মৃত্যুরাজ্যে রোজগারের ধান্দায় ওরা। আজ স্বগোত্র, বন্ধু!