–লোকটাকে শেষ কবে দেখেছিলেন?
-ঐ যে বললাম, বছর সাত-আট আগে। সে যখন আটুয়ানা ছেড়ে চলে যায় লোকটা আমার দোকানে এসেছিল কিছু রঙ-তুলি কিনতে। আর কাগজ। ক্যানভাসও চেয়েছিল, তা আমার কাছে ছিল না। মনে আছে, লোকটা আমাকে বলেছিলাম নগদে দিতে পারছি না, খানকতক ছবি রেখে যাচ্ছি। তা আমি রাজী হয়ে যাই।
কই কই, দেখি সেই ছবি?
না, ছবিগুলি আমার কাছে নেই। লোকটা রঙের দাম যখন মিটিয়ে দিতে এল না তখন আমি সেগুলি বিক্রি করে দিয়েছিলাম–
কাকে?
কাকে তা কি আর মনে আছে?
প্রফেসর তার অ্যাটাচি-কেস খুলে একটি মার্কিন আর্ট-ম্যাগাজিন বার করে বলেন, — দেখুন তো, এই ছবিগুলি কি?
দোকানদার অবাক হয়ে যায়। বলে, কী আশ্চর্য! হ্যাঁ, এই ছবিগুলিই তো বটে!
ম্যাকগ্রেগরী বলেন, আমি ঐ লোকটার সন্ধানে আমেরিকা থেকে এসেছি। আপনি কি আর কিছুই মনে করতে পারেন না তার সম্বন্ধে? আর কোন ক্লর সন্ধান দিতে পারেন না?
দোকানদার ভদ্রলোক শিক্ষিত। দ্রুতগতিতে সে প্রবন্ধের পাতা উল্টে যায়। বলে, — আশ্চর্য! উনি যে এমন প্রতিভাধর শিল্পী তা আদৌ ভাবতে পারিনি আমি! আচ্ছা, দাঁড়ান।
অনেকক্ষণ চিন্তা করে বলেন, হ্যাঁ, তার সম্বন্ধে আর একটি কথা আমার মনে পড়ছে।
কী? ..
যাবার দিনে উনি বলেছিলেন, মাস কয়েক পরে এসে খবর নিয়ে যাব ছবিগুলো বিক্রি হল কিনা।
কিন্তু তা তিনি আসেননি?
না আসেননি; কিন্তু আমার মনে পড়ছে তাঁকে প্রশ্ন করেছিলাম–আপনি কি দূরে কোথাও চলে যাচ্ছেন। উনি জবাবে বলেন, হ্যাঁ, আরও গভীর অরণ্যে। আর কিছু মনে পড়ছে না।
দ্বিতীয়ত উনি খোঁজ করলেন স্থানীয় ডাকঘরে। পোস্টমাস্টার মশাই নামটা শুনে, বলেন, না, পল গগ্যা নামের কোন লোক এ দ্বীপের ত্রিসীমানায় বাস করে না। অন্তত ঐ নামে কোন চিঠি তাঁর ডাকঘরে পনের বিশ বছরের ভিতরে আসেনি। তারপর হঠাৎ কি খেয়াল হওয়াতে বলেন, দাঁড়ান প্রফেসার! কী নাম বললেন? পল গগ্যা? গগন পল নয় তো?
-কেন, গগন পল নামে কাউকে চেনেন?
পোস্টমাস্টার মশাই তার বাক্স থেকে একটি জীর্ণ পোস্টকার্ড বার করে বলেন, দেখুন তো এই লোক কিনা?
প্রফেসর গভীর মনোযোগ দিয়ে পোস্টকার্ডখানা লক্ষ্য করে দেখেন। পেনসিলে লেখা চিঠিকিছুই পড়া যায় না। অন্ততঃ ভাষাটা যে ইংরাজি নয় এটুকু বোঝা যায়। অধ্যাপক ম্যাকগ্রেগরী প্রাচ্যশিল্পী-বিশারদাঁ। সংস্কৃত ও পালি ভাষা জানেন, ব্রাহ্মী ও মাগধী হরফ চিনতে পারেন। তিনি এটুকু বুঝতে পারেন ভাষাটা ভারতীয়। সংস্কৃত অথবা পালির অপভ্রংশ–অর্থাৎ দাক্ষিণাত্যের নয়, আর্যাবর্তের ভাষা। ঠিকানাটা অবশ্য ইংরাজি ভাষায় লেখা। সেটা কালিতে লেখা এবং স্পষ্ট পড়া যাচ্ছে। পত্রলেখকের নাম গগন পাল, প্রাপকের নাম শান্তিরাণী পাল। ঠিকানা–পল্টন বাজার, ঢাকা, ভারতবর্ষ। ভারতবর্ষের অনেকগুলি ডাকঘরের ছাপের নামাবলী গায়ে জড়িয়ে পোস্টকার্ডখানি আবার প্রেরকের কাছে ফেরত এসেছিল। ঠিকানা ভুল, প্রাপককে খুঁজে পাওয়া যায়নি। তাহিতি ডাকঘরে পোস্টমাস্টার মশাই আবার এদিকে প্রেরককে খুঁজে পাননি। ফলে দীর্ঘদিন সেটি পড়ে আছে ঐ বাক্সে।
অধ্যাপক ম্যাকগ্রেগরী অনেকক্ষণ সেই পোস্টকার্ডখানি হাতে নিয়ে নির্বাক বসে থাকেন। কে এই পল গগ্যা অথবা গগন পাল? কোন্ দেশের লোক? ভারতীয়? কী সম্পর্ক ছিল ঐ লোকটার অজ্ঞাত শান্তি পালের সঙ্গে? দুজনেরই উপাধি পাল-ওরা। স্বামী-স্ত্রীও হতে পারে। প্রফেসর জানতেন ঢাকা একটি শহরের নাম। পূর্ব-পাকিস্তানের। রাজধানী। সেটা ভারতবর্ষে নয়। সে খবরটা জানে না এই গগন পাল। হয়তো ভারতবর্ষে অথবা পাকিস্তানে সে কখনও যায়নি। ঢাকা আগে ছিল ভারতবর্ষে, বর্তমানে পাকিস্তানে। এমনও হতে পারে ঐ লোকটা এই অরণ্যে বাস করতে করতে সংবাদই পায়নি যে, ভারতবর্ষ ইতিমধ্যে স্বাধীন হয়েছে। সে খবর রাখে না–ঢাকা বর্তমানে ভারতবর্ষে নয়। সে ক্ষেত্রে অবশ্য ধরে নিতে হবে গগন পাল আর শান্তি পাল স্বামী-স্ত্রী নয়। গগন পাল ভারতীয়ই নয়। কারণ লোকটা শিক্ষিত, সংবাদপত্রে ফরাসী ভাষায় প্রবন্ধ লিখবার মত ক্ষমতা তার আছে। এমন একজন শিক্ষিত মানুষ খবরই রাখবে না যে, তার মাতৃভূমি দুশো বছর পরাধীনতার পর স্বাধীন হয়ে গেছে? বিশেষ যদি তার স্ত্রী। সেখানেই থাকে? গোয়েন্দা কাহিনীর মত কোন সমাধানই মনঃপুত হচ্ছিল না। আর আশ্চর্য বুদ্ধি ভারতীয় ডাকঘরের কর্মকর্তাদের। তারা চিঠিখানি দূর তাহিতিতে প্রেরকের কাছে ফেরত না পাঠিয়ে পাশের বাড়ি ঢাকায় পাঠালে প্রাপক হয়তো সময়ে চিঠিখানি পেতেন। অন্ততঃ তখনও চিঠির পাঠোদ্ধার করা চলত।
মোট কথা লোকটা শিক্ষিত। ফ্রেঞ্চ জানত। Le Sourire পত্রিকার প্রবন্ধটাই তার প্রমাণ। ঔপনিবেশিকতার বিরুদ্ধে কলম ধরে জেল খেটেছিল শিল্পী মানুষটা। প্রবন্ধটা সংগ্রহ করে পড়লেন। বেশ জোরালো ভাষা। প্রবন্ধ লেখক ফ্রেঞ্চ ভাষাটা ভালই। জানেন। আদালতে খোঁজ নিতে গিয়ে আবার কতগুলো অদ্ভুত সংবাদ পাওয়া গেল। আদালতের নথী বলছে, লোকটা নিজেকে নির্দোষ বলেছিল, এবং বলেছিল সে ফরাসী ভাষা আদৌ জানে না! তার তরফে কোন উকিল ছিল না, সে নিজেই সওয়াল করে। স্থানীয় বার অ্যাসোসিয়েশনের একজন নবীন উকিল-কামিল দমিয়ে বিনা পারিশ্রমিকে আসামীর তরফে মামলা পরিচালনা করতে চেয়েছিলেন, কিন্তু আসামী তাঁকে। ওকালতনামা দিতে অস্বীকার করেন। বিচারে তিন মাস সশ্রম কারাদণ্ড হয়ে যায়।