তবে একটা কথা আপনাকে আগেই বলে রাখা উচিত। আমি আপনাকে ঠকিয়ে নিয়ে গেছি একথা যেন আমাকে শুনতে না হয়। তাই প্রথমেই বলে রাখছি—ছবিটি মূল্যবান। আপনি বুঝেসুঝে দর দিন ডক্টর লাহিড়ী।
আমি ফস্ করে বলে বসি, –পাঁচশ টাকা দামটা কি খুব বেশি হবে?
প্রফেসর আমার কথার জবাব দিলেন না। তিনি তৈরী হয়েই এসেছিলেন। হাতব্যাগ খুলে পঞ্চাশখানি একশো টাকার নোট টেবিলের উপর রেখে বলেন, এক হাজার ডলার এর মিনিমাম্ প্রাইস্!
আমি স্তম্ভিত।
একটি পোর্টেবল টেপ-রেকর্ডার আমার টেবিলের উপর রাখেন। মাউথ-পীসটা আমার মুখের সামনে বাড়িয়ে ধরে বলেন, –আর্টিস্ট গগন পাল সম্বন্ধে আপনি যা জানেন এবার বলে যান।
আমি বলি, আগে আপনি বলুন গগন পালকে কেমন করে চিনলেন আপনি! কেনই বা ওর বিষয়ে এত উৎসাহ আপনার!
প্রফেসর ম্যাকগ্রেগরী বলেন, ডক্টর লাহিড়ী, আমিও আপনাকে একটি চমকপ্রদ কাহিনী শোনাব; কিন্তু সেটা পরে। আমি চাই সেকথা না জেনে খোলা মনে আপনি আপনার বন্ধুর সম্বন্ধে যা জানেন তা বলে যান। তার শেষ জীবনের কথা জানা হয়ে গেলে তার জীবনের প্রথম অধ্যায়টা ঠিকমত বলতে পারবেন না আপনি।
অগত্যা গগন পাল সম্বন্ধে আমার স্মৃতির ঝাপি খুলে ধরলাম। স্কুলজীবনের নানান। খুঁটিনাটি। পড়াশুনায় সে ভাল ছেলে ছিল না। ক্লাসে সেই ছিল বয়ঃজ্যেষ্ঠ। তারপর আমরা একসঙ্গে এনট্রান্স পরীক্ষা দিলাম। গগন এর আগেও দুবার ঐ পরীক্ষা দিয়েছিল, পাস করতে পারেনি। এবার পরীক্ষার পর আমরা ক বন্ধু কোম্পানির বাগানে কেমন করে সেই সন্ন্যাসী দর্শন করতে গিয়েছিলাম তাও বললাম। সন্ন্যাসী তুলসীদাসজীর একটি দোঁহা শুনিয়েছিলেন–তেরা বনৎ বনৎ বনি যাই; তেরা বিগড়ি বনৎ বনি যাই। চন্দ্রভানকে বলেছিলেন, -যবন কাহাকা!
বাধা দিয়ে ম্যাকগ্রেগরী বলেন, দাঁড়ান, দাঁড়ান। আপনার এই বন্ধু চন্দ্রভান গর্গ কি পরে খ্রীষ্টান হয়ে যান!
-হ্যাঁ। সেও পরবর্তী জীবনে চিত্রকর হতে চেয়েছিল। তার নাম হয়েছিল ভিন্সেন্ট ভান গর্গ। বেচারীর ছবি কোন সমাদর পায়নি।
প্রফেসর বললেন, আপনি খবর রাখেন না ডক্টর লাহিড়ী। আপনার বন্ধু ভিন্সেন্ট ভান গর্গ অতি সম্প্রতি পশ্চিম-জগতে একজন স্বীকৃত মহাশিল্পী। আমার কাছে তার এ পর্যন্ত উদ্ধার-পাওয়া আটচল্লিশখানি ছবির হিসাব আছে। সাতটি অরিজিনাল এ পর্যন্ত আমি নিজে দেখেছি। বাকিগুলি য়ুরোপে ও আমেরিকায় আছে।
আমি অবাক হয়ে বলি, কী বলছেন আপনি! চন্দ্রভানের কোন্ ছবি আপনি দেখেছেন? তার ছবি য়ুরোপে আছে মানে? কেমন করে গেল সেখানে? নিশ্চয় আপনার ভুল হচ্ছে। সে আমার বন্ধু চন্দ্রভান নয়।
-আমি দেখেছি-আলুর ভোজ, সিঙারণের সেতু, সূরযমুখী, ইলিশমাছের ঝুড়ি, একটি গীর্জা, খান দুই সেলফ-পোর্ট্রেট।
কী আশ্চর্য! ওর এসব ছবি কোথায় আছে?
–পৃথিবীর বিভিন্ন বিখ্যাত সংগ্রহশালায়। আমস্টার্ডাম, জুরিখ, ওটেলো, মস্কো, লণ্ডনের ন্যাশনাল গ্যালারী, প্যারীর লুভার সংলগ্ন ইম্প্রেশনিস্ট মিউজিয়ামে।
আমি স্তব্ধ বিস্ময়ে প্রশ্ন করতেও ভুলে যাই। অধ্যাপক বলেন, আর্টিস্ট ভান গর্গের একটি সংক্ষিপ্ত জীবনী আমি পড়েছি। লিখেছেন মিসেস ডেভিডসন; তিনি ছিলেন ওঁর চিকিৎসকের স্ত্রী। লেখাটা আমেরিকান আর্ট-জার্নালে ছাপা হয়েছিল। অদ্ভুত জীবনী! ভদ্রলোক সমস্ত জীবন অর্থকষ্টে কাটিয়েছেন; অথচ তার যে-কোন একখানি ছবির আজ যা বাজার-দর তাতে সারাজীবন তিনি পায়ের উপর পা দিয়ে কাটাতে পারতেন।
আমি তখনও কথা বলতে পারছি না। মনে পড়ে যাচ্ছে কত কথা! বিশেষ করে ভিন্সেন্টের সেই উক্তিটি, –তুমি কি আমাকে করুণা করতে এসেছ ঊর্মি? সহানুভূতি জানাতে এসেছ?
শুধু ধ্রুবানন্দ অগ্নিহোত্রী একাই নন, ভিন্সেন্টও ছিল ভবিষ্যৎদ্রষ্টা। সে বলে গিয়েছিল –একদিন পৃথিবী নতমস্তকে স্বীকার করবে তার সৃষ্টিকে।
তারপর বলুন?
আবার শুরু করি আমার কাহিনী। বঙ্গভঙ্গ আন্দোলনে গগনের সেই উদাত্ত কণ্ঠের গান, বাঙলার মাটি বাঙলার জল। তারপর সে ফেল করল। গগ্যা মুছে গেল আমার জানা দুনিয়া থেকে। এরপর কী ভাবে ঢাকার পল্টনবাজারে তার সন্ধান পাই, কী ভাবে সে স্ত্রী-পুত্র কন্যাকে ত্যাগ করে চলে আসে বরানগরের বস্তীতে, রঙলালের স্ত্রীর স্কেচ করার অপরাধে তার মাথা ফেটে যাওয়া
তারপর আমি সঙ্কোচে থেমে যাই। বলি, -প্রফেসর, এরপর গগন পালের জীবনে এমন একটি অধ্যায়ের কথা আমি জানি যার সঙ্গে অন্যের জীবন যুক্ত। সেটা প্রকাশ করা বোধ হয় সঙ্গত হবে না!
যন্ত্রটা বন্ধ করে দিয়ে অধ্যাপক জানতে চান ব্যাপারটা কি। গগন তার বন্ধুর স্ত্রীকে ইলোপ করেছিল শুনে উনি জানতে চান সেই মেয়েটি, তার স্বামী অথবা সন্তান কে কে বেঁচে আছে। কেউ নেই শুনে বললেন, তাহলে আর সঙ্কোচ করবেন না। ইতিহাসকে অস্বীকার করবেন না।
যা জানি অকপটে সব বলে গেলাম।
অধ্যাপক বলেন, এবার আমি কেমন করে ওর সন্ধান পেলাম শুনুন।
বাধা দিয়ে বলি, না, এবার ইন্টারমিশন। একটু জলযোগ করে নিতে হবে।
প্রফেসর বলেন, –সে কি! আমি ব্রেকফাস্ট সেরে বেরিয়েছি!
–তা হোক। এই হচ্ছে ভারতীয় শিষ্টাচার। আপনি কিছু না খেয়ে গেলে আমার স্ত্রী অত্যন্ত মর্মাহত হবেন।
প্রফেসর শ্রাগ করেন। হেসে বলেন, -ওরিয়েন্টাল কালচার সম্বন্ধে এখনও অনেক কিছু শিখতে বাকি আছে দেখছি!