ঠিক তক্ষুনি চেঁচিয়ে ওঠে মুরলী।
–হাঁ হাঁ–দেখো দেখো ভুট্টারাম! তোমার পায়ের কাছে একটা কাঁকড়া বিছে।
–আরে বাপ! বলে ভুট্টারাম তিড়িং করে লাফ মারে একটা, আর সঙ্গে সঙ্গে শুকনো ডাঙাতে পা পিছলে দড়াম করে রাম-আছাড়।
তখন রঘু আর মুরলীকে কে পায়? হাসতে হাসতে দুজনে টেনে দৌড়। আর ওদের ধরতে না পেরে পেছন থেকে চেঁচিয়ে গাল দিতে থাকে ভুট্টারাম : একদম মার দেগা–জান লে লেগা–টিকি উখার দেগা। ই বাত হম আভি কহ দেলা—হুঁ–হুঁ।
.
দুপুর বেলা কে যেন কোন দিকে চলে যায়, রঘু বুঝতে পারে না। এই পোড়ো বাড়িটা অন্তত ফাঁকা হয়ে যায় তখন। কিষণলাল কি ভুট্টারামের মতো দু-একজন হয়তো বা খাঁটিয়া পেতে ভোঁস ভোঁস করে ঘুমোয়। বাকি মানুষগুলোর কোনও পাত্তা পাওয়া যায় না। এমন কি মুরলী পর্যন্ত কোথায় যেন কোন দিকে চলে যায়। তখন রঘু আপন মনে বেড়াতে বেরোয়।
খুব ঘন বন যেদিকে–সেদিকে যায় না। সেই চিতাবাঘটার কথাটা এখনও মনে আছে তার–সে কি সহজে ভোলবার মতো? মানুষের পায়ে-চলা পথ লক্ষ করেই সে এগোয়। দেখে ফুল ফুটেছে, পাখি ডাকছে, খরগোশ ছুটে পালাচ্ছে। রঘুর মনে পড়ে স্কুলে যাওয়ার রাস্তাটাকে। গঙ্গার ধার দিয়ে লাল কাঁকরের পথ–তার দুধারে ঝাউয়ের শোঁ শোঁ আওয়াজ আর কৃষ্ণচূড়ার ফুলে একাকার।
সব এখন স্বপ্নের মতো লাগে।
আজও রঘু এমনি করে নিজের মনে চলেছিল। হঠাৎ থমকে দাঁড়িয়ে পড়ল।
এ কী! এ কোথায় এল সে।
একটা পুরনো মন্দির, তার গা বেয়ে বটগাছ উঠেছে। তবু মন্দিরটা বেশ পরিষ্কার মনে হয়, লোকের আসা-যাওয়া আছে এখানে। মন্দিরের সামনেই একটা দিঘি, পদ্মফুলে আর কলমি শাকে ছাওয়া। আট-দশটা ফাটল-ধরা সিঁড়ি নেমে গেছে সেই দিঘিতে।
বেশ জায়গাটা তো।
রঘু গুটিগুটি পায়ে মন্দিরের দিকে এগোল, ভেতরে আধো-অন্ধকার। তবু রঘু দেখতে পেল বেদীর ওপর কালো পাথরের কালীমূর্তি। লকলক করছে লাল টকটকে জিভ–চোখ দুটি কিসের তৈরি কে জানে–যেন ঝকঝক করে জ্বলছে। হাতে টিনের খঙ্গ নয়, আসল খাঁড়া একখানা–তার এক কোপে মানুষের গলা নামিয়ে দেওয়া যায়।
তা হলে এই সেই বৃন্দা সিংয়ের কালী মন্দির! দরকার হলে যেখানে সে নরবলি দিতে পারে।
কালীমূর্তিকে প্রণাম করবে কি–এখান থেকে এখন ছুটে পালাতে পারলে বেঁচে যায় রাঘবলাল। কিন্তু পালাতে পারল না। কে যেন দুটো গজাল ঠুকে তার পা দুটোকে সেইখানে আটকে দিলে।
রঘু দেখল, ঠিক যেন কালীমূর্তির পেছন থেকে বেরিয়ে এল স্বয়ং বৃন্দা সিং।
–রঘুয়া! বাজের মতো গলায় বৃন্দা সিং ডাকল। রঘু কাঠ। গলা দিয়ে তার স্বর ফুটল না।
–তু হিয়াঁ আয়া কেঁও?–বৃন্দা সিয়ের চোখ দুটো আগুনের ভাঁটার মতো ঘুরতে লাগল :
কাহে?
বৃন্দা সিং যেভাবে পা বাড়াল তাতে মনে হল, এখুনি সে দুটো সাঁড়াশির মতো হাত দিয়ে গলা টিপে ধরবে। রঘু একভাবে দাঁড়িয়ে রইল–যেন তার নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে গেছে। ঠিক তখুনি রঘু চেঁচিয়ে উঠল : সর্দার, সর্দার,–তোমার মাথার ওপর সাপ।
লাফিয়ে সরে গিয়ে বৃন্দা সিং দেখে, ফাটা দেওয়ালের ভেতর দিয়ে একটা গোখোর ফণা দুলছে। আর একটু দেরি হলেই তার কপালে ছোবল বসিয়ে দিত।
তীরবেগে কালীর হাতের খাঁড়াটা খুলে নিয়ে বৃন্দা সিং–এক কোপ। সাপের মাথাটা তিন হাত দূরে ছিটকে পড়ল। আর ঘন ঘন নিঃশ্বাস পড়তে লাগল বৃন্দা সিংয়ের।
–তোকে মাপ করলাম। আর তুই আমার জান বাঁচালি। এ-কথা কোনওদিন আমি ভুলব না।
.
নয়
রাঘবের ভয় তখনও কাটেনি। দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে সে দেখছিল, কুচকুচে কালো সেই সাপটার প্রকাণ্ড শরীরটা দেওয়ালের ফাটলের ভেতর থেকে বাইরে ঝুলে পড়ছে একটু-একটু করে–তখনও থর-থর করে কাঁপছে। তার কাটা গলা দিয়ে ফোঁটায় ফোঁটায় রক্ত ঝরছে। তারপর এক সময়ে ঝুপ করে এক বান্ডিল দড়ির মতো সাপটা মেঝের ওপর খসে পড়ল।
বৃন্দা সিং কয়েকটা শুকনো ফুলপাতা কুড়িয়ে খাঁড়াটা মুছে ফেলল। কালীমূর্তির হাতে সেটা আবার বসিয়ে দিয়ে এসে দাঁড়াল রাঘবের পাশে। কাঁধে হাত রেখে ডাকল : রঘুয়া!
রঘু চুপ করে রইল। সর্দার বললে, ঠিক আছে, কালী মাঈজীই আজ তোকে পাঠিয়েছিলেন এদিকে। নইলে ওই সাপটা আমার কপালেই ছোবল বসিয়ে দিত। দুনিয়ার কোনও রোজাই আমাকে বাঁচাতে পারত না।
রঘু হাসতে চেষ্টা করল, হাসতে পারল না। বুকটা তখনও সমানে ঢিপঢিপ করছে তার। সর্দার বললে, আয় আমার সঙ্গে। দুজনে বনের পথ ধরে আড্ডার দিয়ে এগিয়ে চলল।
বৃন্দা সিংয়ের কর্কশ গলাটা নরম হয়ে গিয়েছিল। জিজ্ঞেস করল : তোর মা-বাপের কাছে ফিরে যেতে ইচ্ছে হয়?
রঘুর চোখে জল এসে গেল। হাতের পিঠে চোখটা মুছে বললে, হুঁ।
–ফিরে গিয়ে কী করবি?
–ভালো করে লেখাপড়া শিখব। ইস্কুলে যাব।
–বাপের দোকানে মিঠাই চুরি করে খাবি না? রসগোল্লা, মোণ্ডা, দহি, ছানার জিলাপি। তা যদি না হত, তা হলে কি সে এই বলরামপুরের জঙ্গলে এমন ভাবে এসে পড়ত! পড়ত এই ডাকাতদলের পাল্লায়?
–না, আর ও-সব খাব না।
বৃন্দা সিং হেসে বললে, কেন, অরুচি ধরে গেল?
–তা নয়। ও-সব বেশি খেলে পেটে চর্বি হয়ে যায়, বুদ্ধি মোটা হয়।
–ঠিক বাত! সর্দার একটু হাসল, তারপর গম্ভীর ভাবে কি যেন ভাবতে লাগল।
রঘু কিছুক্ষণ সঙ্গে সঙ্গে চলল, শেষে আর থাকতে না পেরে ডাকল : সর্দার!