এই কথা শুনেই রাঘবলালের খারাপ লাগল। বৃন্দা সিংয়ের মতো ভয়ঙ্কর লোকও তাকে বাহবা দিচ্ছে–এতে মনটা খুশি হতেই পারে, কিন্তু বড় হলে সে নামজাদা ডাকাত হবে, এইতে রঘু ভারি দমে গেল। এই লোকগুলো সাংঘাতিক ডাকাত-পুলিশের ভয়ে এখানে লুকিয়ে আছে রঘু প্রাণপণে তা ভুলে থাকতে চেষ্টা করে। কিন্তু ইচ্ছে করলেই ভোলা যায় না। এক-একদিন রাত্রে বাইরে পাতার আওয়াজ কিংবা শেয়াল-কুকুরের চলার শব্দে তার মনে হয়, এই বুঝি পুলিশের দল বল আসছে, এদের সঙ্গে তাকেও ধরে নিয়ে গিয়ে ফাঁসিতে লটকে দেবে।
পালাতে পারলে সে বাঁচে এখান থেকে। কিন্তু মুরলী বলে দিয়েছে, বৃন্দা সিংয়ের দুটো চোখ এই বনের হাজার হাজার জোনাকির মতো চারদিকে জ্বলছে। পালাতে গেলেই ধরা পড়বে, আর তারপর
ওদিকে বৃন্দা সিংয়ের কথা শুনে কিষণলাল বললে, খালি রঘুয়ারই প্রশংসা করছ কেন সর্দার? ওকে লাঠি খেলা শিখিয়ে, কুস্তি লড়িয়ে মানুষ করেছে কে, সেটাও বলল।
বৃন্দা সিং বললে, আলবাত–আলবাত! কিষণলালেরও বাহাদুরি আছে বইকি!
কিন্তু রঘুর প্রশংসা শুনে একজনের গা জ্বালা করছিল, তার নাম ভুট্টারাম। বেঁটে চেহারার লোক ভূট্টারাম, মুখে বসন্তের দাগ, একটা চোখ আবার তার কানা। এই বলরামপুরের আচ্ছায় ভুট্টারামকেই রঘু একদম পছন্দ করে না। যখন-তখন মাথায় গাঁট্টা মারে, রঘুর টিকি ধরে টেনে দেয়। এক-একদিন রাত্রে শোয়ার সময় রঘুকে গা-হাত-পা টিপে দিতে বলে, পছন্দ না হলে ঠাঁই করে চড় বসায়। মুরলীও দুচক্ষে ভুট্টারামকে দেখতে পারে না, বলে, ও একনম্বরের বিচ্ছু।
সেই ভুট্টারাম মুখ বাঁকিয়ে একটা ছড়া কাটল :
তুফান সে কৌয়া গিরে
মৌলা বোলো দেখো খেল্।।
(অর্থাৎ ঝড়ে কাক মরে–আর মোল্লা বলছে, আমার ওস্তাদিটা দ্যাখো একবার!)
বৃন্দা সিং ধমক দিয়ে বললে, চোপরাও! তু তো একদম নিকম্মা; কারও ভাল দেখলে বুঝি সহ্য হয় না? ভাগ হিঁয়াসে!
সবাই হেসে উঠল, সব চাইতে বেশি করে হাসল রাঘবলাল। আর মুখটা গোঁজ করে সামনে থেকে সুড় সুড় করে চলে গেল ভুট্টারাম।
কিন্তু লোকটার পেটে পেটে কুবুদ্ধি। সেদিন রাতেই সেটা টের পাওয়া গেল।
সবাই তখন অঘোরে ঘুমুচ্ছে, হঠাৎ রাঘবলালের বাপ রে–মা রে চিৎকার।
মুরলী লাফিয়ে উঠল। বৃন্দা সিং, কিষণলাল, চামরি সিং, হনুমান প্রসাদ–যে যেখানে ছিল, টর্চ লাইট আর লাঠি-সোঁটা নিয়ে দৌড়ে এল। সেই বাঘটাই পিছে পিছে এসে চড়াও হল নাকি রঘুর ওপর।
–ক্যা হুয়া? ক্যা হুয়া?
–আমার গায়ের ওপর কী একটা জানোয়ার এসে লাফিয়ে পড়ল।
–জানবর? কাঁহা জানর!–বৃন্দা সিং খাঁটিয়ার তলায় টর্চ ফেলতেই দেখা গেল সেটাকে। প্রকাণ্ড একটা কোলা ব্যাঙ। রেগে বেগুন হয়ে বসে আছে আর ড্যাবড্যাব করে তাকাচ্ছে। তার কায়দাই আলাদা।
এই জানোয়ার! সবাই হেসে লুটোপুটি হল। আর এবারে সব চাইতে বেশি হাসল ভুট্টারাম।
–হো দেখা কেইসা পালোয়ান ব্যাঙের ভয়ে মুছা যায়! হাহা! ও আবার বাঘ মারবে। তুফানসে কৌয়া গিরে, মৌলা বোলে–
বৃন্দা সিং ব্যাঙটার ঠ্যাং ধরে বাইরে এনে ভেতর ছুঁড়ে ফেলে দিলে। তারপর ধমক দিয়ে বললে, এতনা রাতমে হল্লা মত করো, সব কোই আব শো যাও।
সবাই শুতে গেলে মুরলী এসে বসল রঘুয়ার খাঁটিয়ায়। চুপি চুপি জিজ্ঞেস করলে, ব্যাঙটা এই ঘরের মধ্যে কেমন করে এল রে রঘুয়া?
–সে আমি কী করে জানব ভাই?
–বুঝলি, এ হচ্ছে ও বিচ্ছটার কাজ। ওই ভুট্টারামই বাইরে থেকে ওটাকে ধরে এনে তোর গায়ের ওপর ছুঁড়ে দিয়েছে। তুই যে বাঘটাকে মেরে তাড়িয়ে দিয়েছিস আর সবাই তোকে ভালো বলছে, এ ওর প্রাণে একেবারেই সইছে না। তাই সর্দারের কাছে তোকে বুন্ধু। বানাবার জন্যে কাণ্ডটা করেছে।
–ভুট্টারাম আমাকে একেবারেই দেখতে পারে না ভাই।–রঘু কাঁদো কাঁদো হল।
–দাঁড়া, ওকে মজা দেখাচ্ছি। কাউকে কিছু এখন বলিসনি, কাল রাত্তিরে এর বদলা নেব।
পরদিন বিকেলে লাঠি খেলা হয়ে গেলে রাঘবলাল যখন কোদাল নিয়ে কুস্তির জায়গায় মাটি কোপাচ্ছে, তখন কাউকে কিছু না বলে চুপি-চুপি বনের একদিকে চলে গেল মুরলী। ঝোঁপের ভেতর এক জায়গায় তার দরকারি গর্ত দেখেছে একটা। ফিরল অন্ধকার হলে–সকলের চোখ এড়িয়ে। দুটি ছোট-ছোট ঝাঁপির মতো নিয়ে গিয়েছিল। তার মধ্যে যে কী লুকিয়ে নিয়ে এল রাঘবলালও তা জানতে পারলে না। কিন্তু জানল ভুট্টারাম। সেই মাঝরাত্তিরেই।
–জান গিয়া–জান গিয়া–মার দিয়া! সে কী বিকট চিৎকার! যেন সাতটা ষাঁড় এক সঙ্গে হাঁকাহাঁকি করছে ভুট্টারামের গলায়!
–কৌন মার দিয়া? কিসকো মার দিয়া? কেইসে মার দিয়া?
আবার দলবল নিয়ে, তেমনি লাঠি ঠ্যাঙা বাগিয়ে ছুটে এল বৃন্দা সিং। খাঁটিয়ায় বসে পরিত্রাহি চ্যাঁচাচ্ছে ভুট্টরাম। আট-দশটা লম্বা লম্বা কাঁটা বিঁধে আছে তার গায়ে, আর সে সমানে চিৎকার করছে : একদম মার দিয়া–জান মে মার দিয়া–
সবাই ব্যাপারটা ভালো করে বোঝবার আগেই ছোট একটা শজারু কিষণলালের পায়ের তলা দিয়ে ঝুমঝুম করে কাঁটা বাজাতে বাজাতে খোলা দরজা দিয়ে সুড়ৎ করে বাইরে নেমে গেল।
.
আট
এমনি করে সুখে-দুঃখে রাঘবলালের আরও কিছুদিন কাটল। কিন্তু মনের অস্বস্তি যেন কিছুতেই কাটে না। বৃন্দা সিং আর তার দলবলের মতিগতি কিছু বোঝা গাচ্ছে না। আপাতত বেশ আছে; রুটি পাকাচ্ছে, খাচ্ছে-দাচ্ছে, ভালো মানুষের মতো দূরের গঞ্জে গিয়ে এটা-ওটা কিনে আনছে, আর এক-একদিন বেশ ঢোল বাজিয়ে প্রাণ খুলে গান গাইছে। আর রঘু কুস্তি করছে, লাঠি খেলছে, ডন-বৈঠক দিচ্ছে। এর মধ্যেই তার থলথলে ভুড়ি উধাও হয়েছে, গোলগাল মুখ ভেঙে চওড়া হয়ে উঠেছে চোয়ালের হাড়, ছাতি বেড়ে গেছে অনেকখানি, হাতের গুলি শক্ত হয়ে উঠেছে। এখন কিষণলাল তার সঙ্গে লাঠি খেলে, রঘু যখন ডান হাতে বাঁ হাতে চারের মতো ঘুরিয়ে তার মার আটকায়–তখন কিষণলাল খুশি হয়ে বলে, বহুৎ আচ্ছা-বহুৎ আচ্ছা।