রামগর্জনের কর্মচারী বনোয়ারী একটা মস্ত গামলায় জিলিপির গোলা তৈরি করছে, ছটুলাল কচুরির ময়দা মাখছে। মস্ত মস্ত দুটো উনুন এখনও অল্প অল্প বেগুনে ধোঁয়া ছাড়ছে, একটু পরেই কয়লা গন-গন করে উঠবে, কচুরি আর জিলিপি ভাজা আরম্ভ হয়ে যাবে। রসগোল্লা, লেডিকেনি, চমচম আর সন্দেশ কাল রাতেই তৈরি হয়ে রয়েছে। ছটা বাজতে না বাজতেই খদ্দেরের আনাগোনা শুরু হবে। সকাল সাড়ে ছটার ট্রেনে যেসব যাত্রী নামবে তাদেরও অনেকেই স্টেশন থেকে বেরিয়ে রামগর্জনের দোকানে এসে বসবে। তারপর থেকে রাত এগারোটা পর্যন্ত সমানে বেচা-কেনা।
রামগর্জনবাবুর জয়গুরু মিষ্টান্ন ভাণ্ডার শহরের সব চেয়ে বড় মেঠাইয়ের দোকান। তাঁর মিঠাই লোকের আরও মিঠে লাগে তাঁর মধুর ব্যবহারে। বাপের আমলের ছোট ব্যবসাটিকে নিজের চেষ্টায় তিনি এত বড় করতে পেরেছেন, চমৎকার একটি দোতলা বাড়ি করেছেন। জমিজমা কিছু হয়েছে। তিনপুরুষ আগে তাঁরা উত্তর প্রদেশ থেকে এখানে এসেছিলেন। এখন আচার-ব্যবহার চাল-চলন আর কথাবার্তায় পুরো বাঙালী হয়ে গেছেন।
বাইরে থেকে দেখলে রামগর্জনের মতো সুখী আর কেউ নেই। নামে গর্জন থাকলে কী হয়–নেহাত গোবেচারি ভালো মানুষ তিনি। সবাই তাঁকে পছন্দ করে তাঁর মিঠাইকেও। এমন কি তাঁর চমচমে কামড় বসিয়ে কেউ যদি জিভের ওপর ডেয়ো পিঁপড়ের কামড় খায়, সেও তাঁর ওপর রাগ করে না। অথচ–
অথচ রামগর্জনবাবুর মনে সুখ নেই। একবিন্দুও নয়। তার কারণ তাঁর ছেলে রঘু। যার ভালো নাম রাঘবলাল রামগর্জন যাকে বলেন রাঘববোয়াল। একমাত্র ছেলে–একমাত্র সন্তান। তাকে নিয়েই তাঁর যত অশান্তি।
ছেলেটার চাল-চলন যে নেহাত খারাপ, তা নয়। বরং নিতান্তই গোবেচারা। এত বেশি গোবেচারা যে ক্লাসে পড়া জিজ্ঞেস করলে পর্যন্ত মুখ নিচু করে বসে থাকে।
এক-আধজন মাস্টার আছেন–তাঁরা কিছুতেই হাল ছাড়বার বান্দা নন। তাঁদেরই একজন হচ্ছেন গোপেশবাবু। তিনি রঘুর নীরবতা ভাঙবার পণ করে বসলেন। বারবার জিজ্ঞেস করতে লাগলেন, এই রোঘো শিগগির বল বাংলাদেশের মুখ্যমন্ত্রীর নাম কী?
এমন বিপদেও মানুষ পড়ে।
রঘু এর আগে একমনে একটা গুবরে পোকা লক্ষ করছিল। সেটা মিনিট কয়েক পরে মেঝেতে চিত হয়ে পড়ে আছে। প্রাণপণে হাত-পা ছুঁড়ছে আর গুরতর করে আওয়াজ ছাড়ছে। কতক্ষণে ওটা উবুর হতে পারবে এবং তারপর জানালা দিয়ে বোঁ করে বেরিয়ে যাবে রাঘবের সমস্ত মনোযোগটা সেদিকেই ছিল। এমন সময়ে বাংলা দেশের মুখ্যমন্ত্রী আচমকা তার ঘাড়ের ওপরে পড়ে সব গোলমাল করে দিলে।
এর মধ্যে গোপেশবাবু অক্লান্তভাবে জিজ্ঞেস করে যাচ্ছেন এবং স্থির লক্ষ্যে এগোচ্ছেন লাস্ট বেঞ্চের দিকে। এবং তাঁর হাতে যে-ছড়িটি আছে, তারও হাবভাব অত্যন্ত সন্দেহজনক।
অগত্যা রঘুকে উঠে দাঁড়াতে হল।
শিগগির বল, বাংলাদেশের মুখ্যমন্ত্রীর নাম কী? গুবরে পোকার আশা ছেড়ে দিয়ে রঘু ফস করে বলে ফেলল : রাঘবলাল সিং।
ক্লাসে হাসির বোমা ফাটল, কিন্তু গোপেশবাবু হাসতে পারলেন না; তাঁর মুখের চেহারা দেখে একবার সন্দেহ হল, এক্ষুনি বুঝি কেঁদে ফেলবেন; কিন্তু তাও করলেন না, যেখানে ছিলেন সেইখানেই জমে রইলেন কিছুক্ষণ, হাত থেকে বেতটা পাশের ছেলেটার নাকের ওপর খটাস করে খসে পড়ল। সে কাঁউকাঁউ করে উঠতে গোপেশবাবু তাকে দুটো থাবড়া মেরে বসিয়ে দিলেন, তারপর করজোড়ে রঘুকে বললেন, আপনি যে আমাদের মুখ্যমন্ত্রী সে তো জানতুম না স্যার! না জেনে কত বেয়াদবি করে ফেলেছি। নিজগুণে মার্জনা করবেন! সেই থেকে রঘু বাংলাদেশের মুখ্যমন্ত্রী।
আর মুখ্যমন্ত্রীকে পেলে কেউ কি ছাড়তে চায়, স্কুলও তাকে ছাড়েনি। পরপর দুবছর ক্লাস এইটেই রেখে দিয়েছে। ক্লাস টেন-এর ছেলেরা একবার টেবিলের ওপর তাকে বসিয়ে তার গলায় এক ছড়া মালা পরিয়েছিল, মানপত্রও দিয়েছিল একখানা। মানপত্রে একটা কাঁচকলা আঁকা ছিল আর মালার ভেতরে ছিল গোটা কয়েক বিছুটির পাতা–সেটা অবশ্য রঘু টের পেয়েছিল একটু পরেই।
তা, এসবের জন্য রামগর্জনবাবুর মন খারাপ হয় না। ছেলেটা একটু সাদাসিধে, পড়াশোনাতে মাথা নেই কিন্তু তাতে আসে যায় না কিছু। তাঁর মস্ত কারবার, বিশ্বাসী কর্মচারীও আছে–দুদিন সকালে বসলেই সব ঠিক হয়ে যাবে, আস্তে আস্তে চালাক-চতুর হয়ে উঠবে। গোলমালটা সেখানে নয়। চলতি কথায় আছে, ময়রা সন্দেশ খায় না। ময়রা হয়তো খায় না, কিন্তু তাঁর ছেলে খায় কি না, প্রবাদে একথা বলা হয়নি। রঘু সন্দেশ খেয়ে থাকে। এবং প্রচুর পরিমাণে।
রামগর্জন কৃপণ নয়। মিঠাই মণ্ডা-দই ক্ষীর রঘু যথেষ্ট খেতে পায়। কিন্তু তার কিছুতেই তৃপ্তি নেই। এক সের রসগোল্লা খেয়ে সে আর-এক সের খাবার জন্যে তৎক্ষণাৎ প্রস্তুত। একেই বলে আসলে গোল্লায় যাওয়া; শিবরাম চক্রবর্তীর গল্প না পড়েও রামগর্জনবাবু সে কথা বুঝতে পারেন। কিন্তু একথাই বুঝতে পারেন না যে, অতটুকু পেটে অত খাবার সে রাখে কোথায়!
আরে–দোকানের খাবার যদি সব তুই-ই খাবি তা হলে ব্যবসা করবি কী করে? সব যদি তোরই পেটে যায়–খদ্দেররা কি কেবল শালপাতার ঠোঙা নিয়ে তোকে পয়সা দিয়ে যাবে? একটু রয়ে-সয়ে খা না বাপু! জীবনভোরই তো খেতে পাবি তা হলে! এসব কথা রঘুকে বুঝিয়েছেন তিনি অনেকবার। রঘুও বুঝেছে মাথা নেড়েছে সঙ্গে সঙ্গেই। ভাব দেখে মনে হয়েছে যে এরপর থেকে সে প্রত্যেকদিনই একাদশী করতে থাকবে। তারপরেই হয়তো রামগর্জন কোনও কাজে একটু উঠে গেছেন, আর তাঁর দোকানের কর্মচারীরা একটু অন্যমনস্ক হয়েছে, সেই ফাঁকে বিশেষ কিছু করেনি রঘু-ডজনখানেক চমচম কিংবা গোটা ষোলো পান্তুয়া দেখতে-দেখতে সাবাড় করে বসেছে।