বিরিঞ্চি অন্ধকারে অন্ধের মতো হাঁটতে লাগল।
–আর একটু ডাইনে, হাঁ, আরও দু-পা চলো–চলো বিরিঞ্চি।
বিরিঞ্চি চলতে লাগল পোভড়া বাড়ির আবর্জনায় হোঁচট খেতে খেতে-পায়ের তলায় জঙ্গল মাড়িয়ে মাড়িয়ে।
–দাঁড়াও–আবার কঠোর কণ্ঠের আদেশ এল।
বিরিঞ্চি মন্ত্রমুগ্ধের মতো দাঁড়াল।
–আমি অশরীরী কি না জানতে চেয়েছিলে। এইবার জানতে পারবে। তোমার কাছে টর্চ আছে?
বিরিঞ্চি বিহ্বল স্বরে বলল, আছে।
–এবার সেটা জ্বালাতে পারো।
পকেট থেকে আড়ষ্ট হাতে টর্চ বের করে বিরিঞ্চি। আলো ফেলল অদৃশ্য স্বর যেদিক থেকে আসছিল সেইদিকে।
কিন্তু মুহূর্তের সেই আলোতেই বিরিঞ্চির মাথার চুলগুলো খাড়া হয়ে গেল।
মাত্র চার-পাঁচ হাত দূরেই যে দাঁড়িয়ে আছে সে শ্ৰীমন্ত নয়। একটা নরকঙ্কালের মুখ–ভয়ঙ্কর কালো রক্তাক্ত হাতে একটা উদ্যত পিস্তল। তার মুখের অস্থির দাঁতগুলোয় খস্থ করে প্রেতের হাসি বাজছে।
হাত থেকে টর্চটা পড়ে গেল–একটা বোবা আর্তনাদ করে পিছিয়ে গেল বিরিঞ্চি। সঙ্গে সঙ্গেই আর একটা আর্তনাদ চারিদিক মুখর করে দিলে। ঠিক পেছনেই পোড়ো কুয়োটার মধ্যে সে উল্টে পড়ল–আছড়ে পড়ল বারো হাত নীচের শুকনো পাটকেল-ভরা গর্তটার মধ্যে : পড়ার সঙ্গে সঙ্গেই ঘাড়টা মটকে গেল তার।
কালো হাত তার পড়ে-যাওয়া টর্চটা তুলে নিয়ে কুয়োর মধ্যে ফেলল। ওই সে চেয়েছিল। বিরিঞ্চির বিষাক্ত রক্ত নিজের হাতে আর সে ঝরাতে চায়নি।
ঘাড় মটকে পড়ে কুয়োর তলায় ঝুলে আছে বিরিঞ্চি। আর টর্চের আলোয় স্পষ্ট দেখা গেল, ভাঙা ইটের ভেতর থেকে সক্রোধে গলা বার করে এক বিশাল, দুধরাজ গোখরো বিরাট ফণা তুলে বিরিঞ্চির অসাড় দেহে একটার পর একটা ছোবল মেরে চলেছে। টর্চের আলোয় তার হিংস্র চোখ দুটো ঝিলিমিল করে উঠল একবার।
.
এগারো
বাইরে ঝাঁ ঝাঁ করছিল রোদ।
নিজের কোয়ার্টারে হাঁ করে ঘুমুচ্ছেন গণেশবাবু। মুখের সামনে অনেকগুলি মাছি উড়ছিল ভনভন করে, তাদের জ্বালায় বিরক্ত হয়ে মাঝে মাঝে জেগে উঠেই আবার ঝিমিয়ে পড়ছিলেন তিনি। সামনে টেবিলের ওপরে একখানা কাগজ কী সব লেখা রয়েছে, এখান থেকে বদলি হবার জন্যে গণেশবাবু দরখাস্ত লিখছিলেন, লিখতে লিখতেই ঘুমিয়ে পড়েছেন।
ভেজানো দরজাটা খুলে নিঃশব্দ পায়ে একজন লোক ঢুকল। রেলের খালাসির মতো জাঙিয়া পরা, দেখলে সাধারণ একজন কুলি ছাড়া আর কিছু মনে হয় না। একবার আড়চোখে সে নিদ্রিত গণেশবাবুর দিকে তাকাল, তারপরে একখানা খাম আর একটা ছোট প্যাঁকেট বিছানার ওপরে রেখে তেমনি নিঃশব্দে বার হয়ে গেল।
একটু পরেই মানিকপুর স্টেশনে এল দেড়টার ট্রেন, স্টেশন ছেড়ে বেরিয়ে চলে গেল। আর গণেশবাবুর ঘুম ভাঙল তারও প্রায় আড়াই ঘণ্টা পরে, প্রায় বেলা চারটের সময়।
তখনই তাঁর চোখে পড়ল সেই প্যাঁকেটটা, আর সেই চিঠিখানা। গণেশবাবু সবিস্ময়ে বললেন, এ কী! এগুলো এখানে কে রেখে গেল। আগে তিনি প্যাঁকেটটা খুললেন। আর খোলবামাত্র ভীত বিস্ময়ে তাঁর বারোধ হয়ে গেল। প্যাঁকেটের ভেতর থেকে পড়ল রবারের মস্ত মস্ত দুটো দস্তানা, কঙ্কালের মাথা আঁকা একটা মুখোশ। দস্তানা দুটো সাধারণ হাতের প্রায় দ্বিগুণ, তার উল্টো পিঠে গঁদের আঠায় কতগুলো লোম আটকানো, আর তার মাঝে মাঝে লাল রং দেওয়া–সবটা মিলে মনে হয় সেটা যেন। রক্তরঞ্জিত।
গণেশবাবু জিনিসগুলোর দিকে অবাক চোখে তাকিয়ে রইলেন। তারপর আড়ষ্ট হাতে খুললেন খামখানা। তার ভেতরে এই চিঠিখানা ছিল :
প্রিয় গণেশবাবু,
গত এক সপ্তাহের মধ্যে আপনাদের এখানে অনেকগুলো ব্যাপার ঘটে গেছে, যেগুলো আপনাদের কাছে একটা বিচিত্র রহস্য মাত্র। কয়েকজন মানুষের প্রাণ গেছে–ঘটেছে। কতগুলো শোচনীয় দুর্ঘটনা। দুর্ভাগ্যক্রমে আপনিও সে-দুর্ঘটনার হাত একেবারে এড়াতে পারেননি। সেদিন আমি সময়মতো এসে পড়তে না পারলে ও-শয়তান দুটোর গ্রাস থেকে কিছুতেই আপনাকে বাঁচাতে পারতাম না।
কিন্তু আমি কে? সেই পরিচয়টা দেবার জন্যেই এই চিঠিখানা আপনাকে লেখা–এ-থেকেই যা-কিছু ঘটেছে তার রহস্যভেদ হয়ে যাবে। আমি এখানকার সকলের বিভীষিকা আমি কালো হাত।
চমকে উঠবেন না। আমি ভূত নই, প্রেত নই, কিছুই নই। নই যে, তার প্রমাণ ওই আলতা রাঙানো রবারের দস্তানা আর ওই মুখোশ। আজ ওদের প্রয়োজন ফুরিয়েছে, তাই আজ থেকে আবার আমি আপনাদের মতোই রক্ত-মাংসের মানুষ–আমি শ্ৰীমন্ত রায়।
কালো হাত রূপে একটা মানুষকে আমি খুন করেছি। একটা মানুষকে? না–একটা হিংস্র ভয়ঙ্কর পশুকে। তবু আমি নরহত্যা করেছি। এ-পাপের প্রায়শ্চিত্ত আমি করব। কেমন করে–আপনাকে তা জানিয়ে লাভ নেই। শুধু যেটুকু জানাবার, সেটুকুই লিখছি।
আমি শ্ৰীমন্ত রায়। ভদ্রলোকের ছেলে, বিশিষ্ট বনেদি পরিবারে আমার জন্ম, লেখাপড়াও যথেষ্ট শিখেছিলাম। কিন্তু ভদ্রলোকের মতো জীবন যাপন আমি করতে পারিনি, কুসঙ্গে পড়ে অধঃপাতে গেলাম। সুনাম গেল–সব গেল। অথচ টাকার অভাব। দৃশ্চরিত্র লোকের। কোথাও জায়গা জোটে না, আমারও জুটল না। দেনার জ্বালায় মাথার চুল অবধি বিকিয়ে যাচ্ছে, অথচ কোনও উপায় নেই। আমি যেন উন্মাদ হয়ে উঠলাম।
এই পতনের মূলে ছিল বিরিঞ্চি। আর নিতাই সরকার শয়তান, বিশ্বাসঘাতক। এরা দুজনেই আমাকে পাপের পথ দেখিয়ে দিল। অধোগতির যেটুকু বাকি ছিল তাও পূর্ণ হয়ে গেল–চুরি বাটপাড়ি বদমায়েসি সব শুরু করলাম। শেষে কেশবদাস মাগনিরামের সিন্দুক ভেঙে পঁচিশ হাজার টাকা লুঠ করলাম।