–একঠো বাবু দিয়া। মাস্টারবাবু, আপকো ভি একঠো দিয়া।
–কোন বাবু?
–মালুম নেহি। একঠো গোরা বাবু, নয়া আদমি কোই হোগা।
কী ব্যাপার। কথা নেই বার্তা নেই, কোত্থেকে এক নতুন বাবু এসে স্টেশনমাস্টার আর দারোগাকে চিঠি দিয়ে গেল।
ক্ষিপ্রগতিতে খাম ছিঁড়তে ছিঁড়তে দারোগাবাবু বলল, কিধার হ্যায় বাবু?
–চলা গিয়া।
–বটে।
খাম খুলে দুজনেই চিঠি বার করলেন। তার চিঠি পড়বামাত্র দুজনেরই মুখের ভাব এক রকম হয়ে গেল–মড়ার মতো বিবর্ণ আর পাঙাশে।
দারোগার চিঠিতে লেখা ছিল সংক্ষেপে মাত্র এই কটি কথা :
বেশি চালিয়াতি না করে বাড়ি যাওনইলে বেঘোরে মারা পড়বে।–হিতৈষী।
আর গণেশবাবুর চিঠিতে লেখা লিছ :
মাস্টারমশাই, অন্ধকার রাত্রে আমায় পথ দেখিয়ে দিয়েছিলেন–আপনার কাছে আমি কৃতজ্ঞ। আপনি ভালো এবং নিরীহ লোক। তাই কাল রাত্রে আমি সামান্য কিছু কর্তব্য করে আপনাকে রক্ষা করেছি। আজ এই পর্যন্ত।কালো হাত।
.
আট
নীলকুঠির জঙ্গল।
আগে জঙ্গল ছিল না, পাশ দিয়ে যে-মরা নদীটা বালির মধ্যে লুকিয়ে গিয়েছে, ওরও অবস্থা ছিল এরকম–দূরের মহানন্দা তখন কানায় কানায় ঘোলা জল নিয়ে ঘূর্ণি ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে বয়ে যেত, আর তারই জলে ছায়া ফেলত নীলকুঠির ব্যারাকের মতো সমকোণের ধরনে গড়া মস্ত বাড়িটা।
আশেপাশের দশখানা গ্রামে সাহেবরা জোর করে নীলের চাষ করাত, বুকের রক্ত আর চোখের জলে মাটি ভিজিয়ে চাষারা ফলাত সেই সর্বনেশে ফসল। পেটের ভাত জুটত না–জুটত সাহেবের লাথি আর চাবুক। যারা অস্বীকার করত, সাহেবরা তাদের ধরে নিয়ে গিয়ে গুম করে ফেলত, পৃথিবীতে কেউ আর কোনওদিন তাদের দেখতে পেত না। তাদের ঘরবাড়ি জ্বালিয়ে দেওয়া হত, আত্মীয়-স্বজনেরা ত্রাহি ত্রাহি করে যেদিকে পারে পালিয়ে বাঁচত।
তারপর এল প্রজা-বিদ্রোহ। অত্যাচারে জর্জরিত মানুষগুলো মাখা তুলে দাঁড়াল। যবনিকা পড়ল নীলকরদের ভয়াবহ অত্যাচারের ওপরে। নীলকুঠি খালি হয়ে গেল।
নীলকুঠি খালি হল বটে, কিন্তু তবু মানুষ সহজে সেদিকে আসতে পারত না। সকলের মনের ভেতর জায়গা করে নিয়েছিল একটা বিচিত্র ভয়, একটা আশ্চর্য আতঙ্ক। দুপুরের বাতাসে ওই বাড়িটার দিক থেকে যেন কাঁদের দীর্ঘশ্বাস হু-হুঁ করে ভেসে আসত, মনে হত রাত্রের অন্ধকারে কারা যেন ওখানে গুমরে গুমরে কাঁদছে। লোকে ভয়ে ওদিকে হাঁটাই ছেড়ে দিল।
চলতে লাগল সময়ের স্রোত।
পাশের নদীটা আস্তে আস্তে মরে গেল–একটা বিকট ভয়ের মূর্তি নিয়ে নীলকুঠির জঙ্গল নিমগ্ন হয়ে রইল। মাঝে মাঝে জ্যোৎস্না রাত্রে নাকি দেখা যায়, কারা যেন ঘোড়া ছুটিয়ে ওই জঙ্গলের মধ্যে অদৃশ্য হয়ে যাচ্ছ। তারা মানুষ নয়–মানুষের ছায়ামূর্তি। কত লোক যে ওখানে ভয় পেয়েছে তার আর সীমাসংখ্যা নেই।
মাঝরাত্তিতে ওই জঙ্গলে যেতে হবে নিতাই সরকারকে! তাও আবার একা! এমন কথা কী। স্বপ্নেও ভাবতে পারে নাকি কেউ?
সারাটা দিন নিতাই ঘরের মধ্যে আফিংখোরের মতো বসে বসে ঝিমোতে লাগল। কী যে হবে বুঝতে পারছে না। ওদিকে শরীরী হোক আর অশরীরী হোক, রাত্রে শ্রীমন্ত রায়ের সেই বিভীষিকা তাকে মাত্র তিন দিনের সময় দিয়ে গেছে–আজকে শেষ রাত্রি। কালকে যে তার
অদৃষ্টে কী ঘটবে এক ভগবানই বলতে পারে সে কথা।
কিন্তু এই বন্ধুটি কে? শ্ৰীমন্ত রায়ের কথাই বা জানবে কী করে? মানিকপুর স্টেশনে যে-ঘটনাগুলো ঘটে গেল তারই বা অর্থ কী? সবকিছু একসঙ্গে মিলিয়ে সে দিশেহারা হয়ে গিয়েছিল।
পালিয়ে যাবে? পালিয়ে যাবে এখান থেকে? কিন্তু কোথায়? যে অশরীরী, তার হাত থেকে কোথাও কি নিস্তার আছে? তার চাইতে বন্ধুর উপদেশটাই কানে তোলা যাক। দেখা যাক–যদি কিছু হয়।
রাত এগারোটা। শুক্লা তৃতীয়ার চাঁদ বনের আড়ালে অস্ত গেছে। চারদিক থমথমে অন্ধকার। আকাশে যেনক্ষত্রগুলো জ্বলছিল তারাও যেন কী-একটা ভয়ে আড়ষ্ট আর পাণ্ডুর হয়ে গেছে। দূরের মাঠে আলেয়ার আগুন থেকে-থেকে স্কন্ধকাটার রাক্ষুসে হাসির মতো দপদপ করে উঠছিল–আর কোথায় যেন ককিয়ে ককিয়ে কাঁদছিল একটা কুকুর। অমন করে কুকুর কাঁদলে নাকি গৃহস্থের অমঙ্গল হয়।
নানা দুশ্চিন্তায় নিতাই এতক্ষণে যেন বেপরোয়া হয়ে গেছে। যা হওয়ার তা হোক, ব্যাপারটার একটা শেষ দেখবে সে। এমনিও ডুবছে, অমনিও ডুবছে কাজেই যাহয় একটা হেস্তনেস্ত করে নিতেই হবে।
কাপুরুষ সে নয়। কোনও কিছুকেই সে ভয় করে না, খুনখারাপিতে সে ভয় পায় না। তা যদি পেত তা হলে শ্ৰীমন্ত রায়ের পিঠে অমন করে ছোরা বিধিয়ে সে টাকাগুলো নিয়ে সরে পড়তে পারত না। ভয় তার মানুষকে নয়-অপদেবতাকে; শ্ৰীমন্ত রায়কে নয়–তার প্রেতাত্মাকে। মানুষের সঙ্গে একহাত মহড়া সে নিতে পারে, কিন্তু ভূতের সঙ্গে লড়াই করবে কেমন করে?
কিন্তু এখন মনে হচ্ছে, শ্ৰীমন্ত রায় মরেনি। যদি না মরে থাকে, তাহলে তাকে আর ভয় কিসের? তার সঙ্গে যদি চালাকি করতে আসে তাহলে সেও দেখে নেবে–সহজে ছাড়বে না। হিংস্র উত্তেজনায় নিতাইয়ের দাঁত কড়মড় করে বেজে উঠল।
কাঠের একটা পুরনো বাক্সের ভেতর থেকে নিতাই একটা রিভলভার বের করে আনল। দোনলা বন্দুকের কাজ নয়। রিভলভারের লাইসেন্স তার নেই, এটা বেআইনি অস্ত্র। দরকার হতে পারে বলে এটাকে সে কাছে রেখেছে। রিভলভারের পাঁচটা ঘরে সে কার্তুজ ভরে নিল, সঙ্গে নিল আরও কিছু বাড়তি কার্তুজ আর তিন শেন্স-এর একটা টর্চ। তারপর ঘাড়ে মাথায় একটা কালো রুমাল জড়িয়ে সে বাড়ি থেকে বেরিয়ে পড়ল।