Site icon BnBoi.Com

টেনিদার গল্প – নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায়

টেনিদার গল্প - নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায়

একটি ফুটবল ম্যাচ

গোলটা আমিই দিয়েছি। এখনও চিৎকার শোনা যাচ্ছে ওদের থ্রি চিয়ার্স ফর প্যালারাম—হিপ্ হিপ হুররে! এখন আমাকে ঘাড়ে করে নাচা উচিত ছিল সকলের। পেট ভরে খাইয়ে দেওয়া উচিত ছিল ভীমনাগের দোকানে কিংবা দেলখোস রেস্তোরায়। কিন্তু তার বদলে একদল পিনপিনে বিতিকিচ্ছি মশার কামড় খাচ্ছি আমি। চটাস করে মশা মারতে গিয়ে নিজের নাকেই লেগে গেল একটা রাম-থাপ্পড়। একটু উঁ-আঁ করে কাঁদব তারও উপায় নেই। প্যাচপেচে কাদার ভেতরে কচুবনের আড়ালে মূর্তিমান কানাই সেজে বসে আছি, আর আমার চারিদিকে মশার বাঁশি বাজছে।

—থ্রি চিয়ার্স ফর প্যালারাম। আবার চিৎকার শোনা গেল। একটা মশা পটাস করে হুল ফোটাল ডান গালে। ধাঁ করে চাঁটি হাঁকালুম—নিজের চড়ে নিজেরই মাথা ঘুরে গেল। অঙ্কের মাস্টার গোপীবাবুও কখনও এমন চড় হাঁকড়েছেন বলে মনে পড়ল না।

গেছি-গেছি বলে চেঁচিয়ে উঠতে গিয়ে বাপ বাপ করে সামলে নিলুম। দমদমার এই কচুবনে আপাতত আরও ঘণ্টাখানেক আমার মৌনের সাধনা। সন্ধ্যার অন্ধকার নামবার আগে এখান থেকে বেরুবার উপায় নেই।

চিৎকার ক্রমশ দূরে মিলিয়ে যাচ্ছে : থ্রি চিয়ার্স ফর প্যালারাম–হিপ হিপ হুররে।

আমি পটলডাঙার প্যালারামপালাজ্বরে ভুগি আর বাসক পাতার রস খাই। কিন্তু পটলডাঙা ছেড়ে শেষে এই দমদমার কচুবনে আমার পটল তোলবার জো হবে—একথা কে জানত!

আমাদের পটলডাঙা থান্ডার ফুটবল ক্লাবের আমি একজন উৎসাহী সদস্য। নিজে কখনও খেলি না, তবে সব সময়েই খেলোয়াড়দের প্রেরণা দিয়ে থাকি। আমাদের ক্লাব কোনও খেলায় গোল দিলে সাত দিন আমার গলা ভাঙা সারে না। হঠাৎ যদি কোনও খেলায় জিতে যায়—যা প্রায় কোনও দিনই হয় না—তা হলে আনন্দের চোটে আমার কষ্প দিয়ে পালাজ্বর আসে।

সদস্য হয়েই ছিলুম ভালো। গোলমাল বাধল খেলোয়াড় হতে গিয়ে।

দমদমার ভ্যাগাবন্ড ক্লাবের সঙ্গে ফুটবল ম্যাচ। তিনদিন আগে থেকে ছোটদির ভাঙা হারমোনিয়ামটা নিয়ে আমি ধ্রুপদ গাইতে চেষ্টা করছি। গান গাইবার জন্যে নয়—খেলার মাঠে যাতে সারাক্ষণ একটানা চেঁচিয়ে যেতে পারি—সেই উদ্দেশ্যে। তেতলার ঘর থেকে মেজদা যখন বড় একটা ডাক্তারির বই নিয়ে তেড়ে এল, তারপরেই বন্ধ করতে হল গানটা।

কিন্তু দমদমে পৌঁছেই একটা ভয়ঙ্কর দুঃসংবাদ শোনা গেল।

আমাদের দুই জাঁদরেল খেলোয়াড় ভণ্ট আর ঘন্টু দুই ভাই। দুজনেই মুগুর ভাঁজে আর দমাদ্দম ব্যাকে খেলে। বলের সঙ্গে সঙ্গে উড়িয়ে দেয় অন্য দলের সেন্টার ফরোয়ার্ডকে। আজ পর্যন্ত দুজনে যে কত লোকের ঠ্যাং ভেঙেছে তার হিসেব নেই।

কিন্তু শেষ পর্যন্ত ওরা পটলডাঙা থান্ডার ক্লাবেরই ঠ্যাং ভাঙল। একেবারে দুটো ঠ্যাং ভাঙল। একেবারে দুটো ঠ্যাংই একসঙ্গে।

কাশীতে ওদের কুট্টিমামা থাকে। তা থাক-কাশি-সর্দি-পালাজ্বর—যেখানে খুশি থাক। কিন্তু কুট্টিমামা কি আর বিয়ে করার দিন পেল না? ঠিক আজ দুপুরেই টেলিগ্রামটা এসে হাজির। আর বিশ্বাসঘাতক ভণ্ট আর ঘন্টু সঙ্গে সঙ্গে লাফাতে লাফাতে হাওড়া স্টেশনে। থান্ডার ক্লাবকে যেন দুটো আন্ডারকাট ঘুষি মেরে চিৎ করে ফেলে দিয়ে গেল!

দলের ক্যাপ্টেন পটলডাঙার টেনিদা বাঘের মতো গর্জন করে উঠল।মামার বিয়ের ঘ্যাঁট গেলবার লোভ সামলাতে পারলে না। ছোঃ। নরাধমলোভী কাপুরুষ। ছোঃ!

গাল দিয়ে গায়ের ঝাল মিটতে পারে, কিন্তু সমস্যার সমাধান হয় না। পটলডাঙা থান্ডার ক্লাবের সদস্যরা তখন বাসী মুড়ির মতো মিইয়ে গেছে সবাই। ভন্টু ঘন্টু নেই—এখন কে বাঁচাবে ভ্যাগাবন্ড ক্লাবের হাত থেকে? ওদের দুদে ফরোয়ার্ড ন্যাড়া মিত্তির দারুণ ট্যারা। আমাদের গোলকিপার গোবরা আবার ট্যারা দেখলে বেজায় ভেবড়ে যায়—কোন্ দিক থেকে যে বল আসবে ঠাহর করতে পারে না। ওই ট্যারা ন্যাড়াই হয়তো একগণ্ডা গোল ঢুকিয়ে দিয়ে বসে থাকবে।

এখন উপায়?

টেনিদার ছোকরা চাকর ভজুয়া গিয়েছিল সঙ্গে। বেশ গাঁট্টাগোট্টা চেহারা—মারামারি বাধলে কাজে লাগবে মনে করেই তাকে সঙ্গে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল। টেনিদা কটমট করে খানিকটা তার দিকে তাকিয়ে থেকে বললে, এই ভজুয়া ব্যাকে খেলতে পারবি?

ভজুয়া খৈনি টিপছিল। টপ করে খানিকটা খৈনি মুখে পুরে নিয়ে বললে, সেটা ফির কী আছেন ছোটবাবু?

—পায়ের কাছে বল আসবেধাঁই করে মেরে দিবি। পারবি না?

—হাঁ। খুব পারবে। বল ভি মারিয়ে দিবে—আদমি ভি মারিয়ে দিবে।—ভজুয়ার চোখে-মুখে জ্বলন্ত উৎসাহ।

–না না, আদমিকে মারিয়ে দিতে হবে না। শুধু বল মারলেই হবে। পারবি তো ঠিক?

–কেনো পারবে না? কাল রাস্তামে একঠো কুত্তা ঘেউঘেউ করতে করতে আইল তো মারিয়ে দিলাম একঠো জোরসে লাথি। এক লরি যাইতেছিলথ খাইয়ে একদম উত্সকো উপর চড়িয়ে গেল। বাস্—সিধা হাওড়া টিশন।

—থাম থাম—মেলা বকিসনি—টেনিদা একটা নিশ্চিন্ত দীর্ঘশ্বাস ফেলল; একটা ব্যাক তো পাওয়া গেল। আর একটা—আর একটা—এদিক ওদিক তাকাতে তাকাতে হঠাৎ চোখ পড়ল আমার ওপরে ঠিক হয়েছে। প্যালাই খেলবে।

—আমি।

একটা চীনেবাদাম চিবুতে যাচ্ছিলুম, সেটা গিয়ে গলায় আটকাল।

–কেন—তুই তো বলেছিলি, শিমুলতলায় বেড়াতে গিয়ে কাদের নাকি তিনটে গোল দিয়েছিলি একাই? সেসব বুঝি স্রেফ গুলপট্টি?

গুলপট্টি তো নির্ঘাত। চাটুজ্যেদের রকে বসে তেলেভাজা খেতে খেতে সবাই। দুটো-চারটে গুল দেয়, আমিও ঝেড়েছিলুম একটা। কিন্তু টেনিদা দুবার ম্যাট্রিকে গাড্ডা খেয়েছে, তার মেমোরি এত ভাল কে জানত?

বাদামটা গিলে ফেলে আমি বললুম, না, না, গুলপট্টি হবে কেন? পালাজ্বরে কাহিল করে দিয়েছে নইলে এতদিনে আমি মোহনবাগানে খেলতুম, তা জানো? এখন দৌড়োতে গেলে পিলেটা একটু নড়ে—এই যা অসুবিধে।

—পিলেই তো নড়াবি। পিলে নড়লে তোর পালাজ্বরও সরে পড়বে—এই বলে দিলুম। নে—নেমে পড়—

ফুর্‌—র্‌—র্‌—র্‌–

রেফারির বাঁশির আওয়াজ। আমি কী বলতে যাচ্ছিলুম, তার আগেই এক ধাক্কায় টেনিদা আমাকে ছিটকে দিলে মাঠের ভেতরে। পড়তে-পড়তে সামলে নিলুম। ভেবে দেখলুম, গোলমাল বেশি বাড়ানোর চাইতে দু-একটা গোল দেওয়ার চেষ্টা করাই ভাল।

যা থাকে কপালে! আজ প্যালারামেরই একদিন কি পালাজ্বরেরই একদিন!

খেলা শুরু হল।

ব্যাকে দাঁড়িয়ে আছি। ভেবেছিলুম ভজুয়া একাই ম্যানেজ করবে কিন্তু দেখা গেল, মুখ ছাড়া আর কোনও পুঁজিই ওর নেই। একটা বল পায়ের কাছে আসতেই রাম শট হাঁকড়ে দিলে। কিন্তু বলে পা লাগল না—উলটে ধড়াস করে শুকনো মাঠে একটা আছাড় খেল ভজুয়া। ভাগ্যিস গোলকিপার গোবা তক্কেতক্কে ছিলঅইলে ঢুকেছিল আর-কি একখানা।

হাই কিক দিয়ে গোবরা বলটাকে মাঝখানে পাঠিয়ে দিলে। রাইট আউট হাবুল সেন বলটা নিয়ে পাঁই-পাঁই করে ছুটল-ফাঁড়া কাটল এ-যাত্রা।

কিন্তু ফুটবল মাঠে সুখ আর কতক্ষণ কপালে থাকে। পরক্ষণেই দেখি বল দ্বিগুণ বেগে ফিরে আসছে আমাদের দিকে—আর নিয়ে আসছে ট্যারা ন্যাড়া মিত্তির।

ভজুয়া বোঁ-বোঁ করে ছুটল—কিন্তু ন্যাড়া মিত্তিরকে ছুঁতেও পারল না। খুট করে ন্যাড়া কাটিয়ে নিলে, ভজুয়া একেবারে লাইন টপকে গিয়ে পড়ল লাইনসম্যান ক্যাবলার ঘাড়ে।

কিন্তু ভজুয়ার যা খুশি হোক—আমার তো শিরে সংক্রান্তি। এখন আমি ছাড়া ন্যাড়া মিত্তির আর গোলকিপার গোবরার ভেতরে আর কেউ নেই। আর গোরাকে তো জানি। ন্যাড়ার ট্যারা চোখের দিকে তাকিয়ে হাঁ করে দাঁড়িয়ে থাকবে—কোন্ দিক দিয়ে বল যে গোলে ঢুকছে টেরও পাবে না।

—চার্জ! চার্জ!—সেন্টারহাফ টেনিদার চিৎকার : প্যালা, চার্জ—

জয় মা কালী! এমনিও গেছি—অমনিও গেছি। দিলুম পা ছুড়ে! কিমাশ্চর্যম। ন্যাড়া মিত্তির বোকার মতো দাঁড়িয়ে বলটা সোজা ছুটে চলে গেছে হাবুল সেনের কাছে।

—ব্রেভো, ব্রেভো প্যালা!—চারদিক থেকে চিৎকার উঠল : ওয়েল সেভড। তাহলে সত্যিই আমি ক্লিয়ার করে দিয়েছি। আমি পটলডাঙার প্যালারাম, ছেলেবেলায় টেনিস বল ছাড়া যে কখনও পা দিয়ে ফুটবল ছোঁয়নি—সেই আমি ঠেকিয়েছি দুর্ধর্ষ ন্যাড়া মিত্তিরকে! আমার চব্বিশ ইঞ্চি বুক গর্বে ফুলে উঠল। মনে হল, ফুটবল খেলাটা কিছুই নয়। ইচ্ছে করে এতদিন খেলিনি বলেই মোহনবাগানে চান্স পাইনি।

কিন্তু আবার যে ন্যাড়া মিত্তির আসছে! ওর পায়ে কি চুম্বক আছে! সব বল কি ওর পায়ে গিয়ে লাগবে?

দুবার অপদস্থ হয়ে ভজুয়া খেপে গিয়েছিল। মরিয়া হয়ে চার্জ করল। কিন্তু রুখতে পারল না। তবু এবারেও গোল বাঁচল। তবে গোবরা নয়—একরাশ গোবর। ঠিক সময়মতো তাতে পা পিছলে পড়ে গেল ন্যাড়া মিত্তির, আর আমি ধাঁই করে শট মেরে ক্লিয়ার করে দিলুম। ওদের লেফট আউটের পায়ে লেগে থ্রো হয়ে গেল সেটা।

কিন্তু আত্মবিশ্বাস ক্রমেই বাড়ছে। পটলডাঙার থান্ডার ক্লাবের চিৎকার সমানে শুনছি। ব্রেভো প্যালা-শাবাশ! আরে, আবার যে বল আসে! আমাদের ফরোয়ার্ডগুলো কি ঘোড়ার ঘাস কাটছে নাকি? গেল-গেল করতে করতে ওদের বেঁটে রাইট ইনটা শট করলে আমার পায়ের তলা দিয়ে বল উড়ে গেল গোলের দিকে।

গো-ও-ও-

ভ্যাগাবন্ড ক্লাবের চিৎকার। কিন্তু ওল আর নয়, স্রেফ কচু। অর্থাৎ বল তখন পোস্ট ঘেঁষে কচুবনে অন্তর্ধান করেছে।

গোল কিক্‌।

কিন্তু এর মধ্যেই একটা কাণ্ড করেছে ভজুয়া। বলকে তাড়া করতে গিয়ে শট করে দিয়ে গোল-পোস্টের গায়ে। আর তার পরেই আঁই-আঁই করতে করতে বসে পড়েছে পা চেপে ধরে।

ভজুয়া ইনজিওর্ড! ধরাধরি করে দু-তিনজন তাকে বাইরে নিয়ে গেল।

আপদ গেল! যা খেলছিল—পারলে আমিই ওকে ল্যাং মেরে দিতুম। গোলপোস্টটাই। আমার হয়ে কাজ সেরে দিয়েছে। কিন্তু এখন যে আমি একেবারে একা একা কুম্ভ রক্ষা করে নকল কুঁদিগড়! এলোপাথাড়ি কাটল কিছুক্ষণ। ভগবান ভরসা—আমাকে আর বল ছুঁতে হল না। গোটা দুই শট গোবরা এগিয়ে এসে লুফে নিলে, গোটা তিনেক সামলে নিলে হাফ ব্যাকেরা। তারপর হাফ-টাইমের বাঁশি বাজল।

আঃ—কোনওমতে ফাঁড়া কাটল এ-পর্যন্ত। বাকি সময়টুকু সামলে নিতে পারলে হয়!

পেটের পিলেটা একটু টনটন করছে বুকের ভেতরও খানিকটা ধড়ফড়ানি টের পাচ্ছি। কিন্তু চারদিক থেকে তখন থাণ্ডার ক্লাবের অভ্যর্থনা : বেড়ে খেলছিস প্যালা, শাবাশ! এমনকি ক্যাপ্টেন টেনিদা পর্যন্ত আমার পিঠ থাবড়ে দিলে : তুই দেখছি রেগুলার ফার্স্ট ক্লাস প্লেয়ার! না—এবার থেকে তোকে চান্স দিতেই হবে দু-একবার

এতে আর কার পিলে-টিলের কথা মনে থাকে। বিজয়গর্বে দু-গ্লাস লেবুর শরবত খেয়ে নিলুম। শুধু ভজুয়া কিছু খেল না—পায়ে একটা ফেটি বেঁধে বসে রইল গোঁজ হয়ে। টেনিদা দাঁত খিচিয়ে বললে, শুধু একনম্বরের বাক্যি-নরেশ! এক লাথসে কুত্তাকো লরিমে চড়া দিয়া! তবু একটা বল ছুঁতে পারলে না—ছছঃ—ছো?

ভজুয়া দু-চোখে জিঘাংসা নিয়ে তাকিয়ে রইল।

আবার খেলা শুরু হল। খোঁড়াতে খোঁড়াতে ভজুয়া আবার নামল মাঠে। আমার কানের কাছে মুখ এনে বললে, দেখিয়ে প্যালাবাবু ইস্ দফে হাম মার ডালেঙ্গে!

ভজুয়ার চোখ দেখে আমার আত্মারাম খাঁচাছাড়া। সর্বনাশ—আমাকে নয় তো?

—সে কী রে! কাকে?

—দেখিয়ে না—

কিন্তু আবার সে আসছে! ওই আসে—ওই অতি ভৈরব হরষে! আর কে? সেই ন্যাড়া মিত্তির! ট্যারা চোখে সেই ভয়ঙ্কর দৃষ্টি! এবার গোল না দিয়ে ছাড়বে বলে মনে হয় না!

ক্ষ্যাপা মোষের মতো ছুটল ভজুয়া। তারপরই বাপ বলে এক আকাশ-ফাটা চিৎকার! বল ছেড়ে ন্যাড়া মিত্তিরের পাঁজরায় লাথি মেরেছে ভজুয়া, আর ন্যাড়া মিত্তির ঝেড়েছে। ভজুয়ার মুখে এক বোম্বাই ঘুষি। তারপর দুজনেই ফ্ল্যাট এবং দুজনেই অজ্ঞান। ভজুয়া প্রতিশোধ নিয়েছে বটে, কিন্তু এটা জানত না যে ন্যাড়া মিত্তির নিয়মিত বক্সিং লড়ে।

মিনিট-তিনেক খেলা বন্ধ। পটলডাঙার থান্ডার ক্লাব আর দমদম ভ্যাগাবণ্ড ক্লাবের মধ্যে একটা মারামারি প্রায় বেধে উঠেছিল—দু-চারজন ভদ্রলোক মাঝখানে নেমে থামিয়ে দিলেন। ফের খেলা আরম্ভ হল। কিন্তু ভজুয়া আর ফিরল না ন্যাড়া মিত্তিরও না।

বেশ বোঝা যাচ্ছে, ন্যাড়া বেরিয়ে যাওয়াতে দলের কোমর ভেঙে গেছে ওদের। তবু হাল ছাড়ে না ভ্যাগাবণ্ড ক্লাব। বারবার তেড়ে আসছে। আর, কী হতচ্ছাড়া ওই বেঁটে রাইট-ইনটা!

—অফ সাইড। রেফারির হুইসল। আর-একটা ফাঁড়া কাটল।

পটলডাঙা ক্লাবের হাফ ব্যাকেরা এতক্ষণে যেন একটু দাঁড়াতে পেরেছে। আমার পা পর্যন্ত আর বল আসছে না। খেলার প্রায় মিনিট-তিনেক বাকি। এইটুকু কোনওমতে কাটাতে পারলেই মানে মানে বেঁচে যাই—পটলডাঙার প্যালারাম বীরদর্পে ফিরতে পারে পটলডাঙায়।

এই রে! আবার সেই বেঁটেটা! কখন চলে এসেছে কে জানে! এ যে ন্যাড়া মিত্তিরের ওপরেও এক কাঠি! নেংটি ইদুরের মতো বল মুখে করে দৌড়তে থাকে। আমি কাছে এগোবার আগেই বেঁটে কিক করেছে। কিন্তু থান্ডার ক্লাব বাঁয়ে শেয়াল নিয়ে নেমেছিল নির্ঘাত! ডাইভ করে বলটা ধরতে পারলে না গোবরা—তবু এবারেও বল পোস্ট ঘেঁষে বাইরে চলে গেল।

কিন্তু ন্যাড়া মিত্তিরকে যে-গোবরটা কাত করেছিল—সেটা এবার আমায় চিত করল। একখানা পেল্লায় আছাড় খেয়ে যখন উঠে পড়লুম তখন পেটের পিলেটায় সাইক্লোন হচ্ছে। মাথার ভেতরে যেন একটা নাগরদোলা ঘুরছে বোঁ-বোঁ করে। মনে হচ্ছে, কম্প দিয়ে পালাজ্বর এল বুঝি!

আর এক মিনিট। আর এক মিনিট খেলা বাকি। রেফারি ঘড়ির দিকে তাকাচ্ছে বারবার। ড্র যাবে নির্ঘাত। যা খুশি হোক—আমি এখন মাঠ থেকে বেরুতে পারলে বাঁচি। আমার এখন নাভিশ্বাস! গোবরে আছড়া খেলে মাথা এমন বোঁ-বোঁ করে ঘোরে কে জানত!

গোল-কিক।

আবছাভাবে গোবরার গলার স্বর শুনতে পেলুম : কিক কর, প্যালা—

শেষের বাঁশি প্রায় বাজল। চোখে ধোঁয়া দেখছি আমি। এইবার প্রাণ খুলে একটা কিক করব আমি! মোক্ষম কিক! জয় মা কালী

প্রাণপণে কিক করলুম। গো—ও-ওল—গো-ও-ও-ল। চিৎকারে আকাশ ফাটার উপক্রম। প্রথমটা কিছুই বুঝতে পারলুম না। এত জোরে কি শট মেরেছি যে আমাদের গোললাইন থেকেই ওদের গোলকিপারকে ঘায়েল করে দিয়েছি?

কিন্তু সত্য-দর্শন হল কয়েক সেকেন্ডের মধ্যেই। গোবরা হাঁ করে আমার মুখের দিকে তাকিয়ে। আমাদের গোলের নেটের ভেতরেই বলটা স্তম্ভিত হয়ে দাঁড়িয়ে। যেন আমার কীর্তি দেখে বলটাও হতভম্ব হয়ে গেছে।

তারপর?

তারপর খেলার মাঠ থেকে এক মাইল দূরের এই কচুবনে কানাই হয়ে বসে আছি। দুর থেকে এখনও ভ্যাগাবণ্ড ক্লাবের চিৎকার আসছে : থ্রি চিয়ার্স ফর প্যালারাম-হিপ হিপ হুরে!

একাদশীর রাঁচি যাত্রা

টেনিদা বললে, আমার একাদশী পিসেমশাই—

আমি বললুম, একাদশী পিসে! সে আবার কী রকম?

–কী রকম আর? হাড়কঞ্জুস। খাওয়া বন্ধ হয়ে যাবে বলে লোকে নাম করে না–একাদশী বলে। কালকে সন্ধেবেলায় তিনি রাঁচি গেলেন।

বললুম, ভালোই করলেন। রাঁচি বেশ জায়গা। হুডরু আছে, জোনা ফলস আছে। আমরা একবার ওখান থেকে নেতার হাট

বাধা দিয়ে টেনিদা বললে, তুই থাম না–কুরুবক কোথাকার। একটা কথা বলতে গেলেই বকবকানি শুরু করে দিবি। একাদশী পিসে ওসব হুডরু-জোনা-নেতার হাট কিছু দেখতে যাননি। তিনি গেছেন কাঁকেতে।

কাঁকে?–আমি চমকে বললুম, সেখানে তো

আমার পিঠে প্রকাণ্ড একটা থাবড়া বসিয়ে টেনিদা বললে, ইয়াহ–এতক্ষণে বুঝেছিস। সেখানে পাগলাগারদ। তোর নিজের জায়গা কিনা, তাই কাঁকে বলবার সঙ্গে সঙ্গেই খুশি হয়ে উঠলি!

আমি ব্যাজার মুখে বললুম, মোটেই না, কাঁকে কক্ষনো আমার নিজের জায়গা নয়। বরং বলটুদা বলছিল, তুমি নাকি চিড়িয়াখানার গাব্বে হাউসে দিন কয়েক থাকার কথা ভাবছ।

–গাব্বে হাউস?-খাঁড়ার মতো নাকটাকে আকাশে তুলে টেনিদা বললে, কে বলেছে? বলটু? ওই নাট-বলটুটা?

হুঁ । সে কাল আমায় আরও জিজ্ঞেস করছিল, কী রে প্যালা তোদের টেনিদার ল্যাজটা ক’ইঞ্চি গজাল?

টেনিদা খানিকক্ষণ গুম হয়ে রইল। তারপর বললে, অলরাইট। ফুটবলের মাঠে একবার বলটেকে পেলে আমি দেখিয়ে দেব।

আমি ভালোমানুষের মতো বললুম, সে তোমাদের ব্যাপার–তোমরা বুঝবে। কিন্তু একাদশী পিসের কথা কী বলছিলে?

টেনিদা দাঁত খিঁচিয়ে বললে, থাম–ফ্যাঁচ ফ্যাঁচ করিসনি। দিলে মেজাজ চটিয়ে এখন বলছে একাদশী পিসের কথা বলো। বলব না-ভাগ।

কিন্তু টেনিদার মেজাজ কী করে ঠাণ্ডা করতে হয় সে তো জানি। তক্ষুনি মোড় থেকে এক ঠোঙা তেলেভাজা কিনে আনলুম। আর গরম গরম আলুর চপে কামড় দিয়েই টেনিদা একেবারে জল হয়ে গেল।

-প্যালা, ইউ আর এ গুড বয়।

আমি বললুম, হুঁ।

–এই জন্যেই আমি তোকে এত ভালবাসি।

–সে তো দেখতেই পাচ্ছি।

–হাবুল সেন আর ক্যাবলাটার কিচ্ছু হবে না।

আমি বললুম, হবেই না তো। এই গরমের ছুটিতে আমাদের ফেলে–একটা গেল মামাবাড়িতে আম খেতে, আর একটা মা বাবার সঙ্গে বেড়াতে গেল শিলঙে। বিশ্বাসঘাতক।

টেনিদা বেগুনি চিবুতে চিবুতে বললে, বল–ট্রেটর। ওতে জোর বেশি হয়।

বললুম, মরুক গে, ওদের কথা ছাড়ো। কিন্তু তোমার সেই একাদশী পিসে

-ইয়েস-একাদশী পিসে। টেনিদা বললে, তাঁর কথাই বলতে যাচ্ছিলুম তোকে। আমার ঠিক রিয়েল পিসে নন–মার যেন কী রকম খুড়তুতো দাদামশাইয়ের মাসতুতো ভাইয়ের মামাতো শ্বশুরের

আমি ঘাবড়ে গিয়ে বললুম, থাক, এতেই হবে। মানে তিনি তোমার পিসেমশাই–এই তো?

হাঁ, পিসেমশাই। বাঁকুড়ায় উকিল। খুব পশার-বুঝলি? বাড়ি-গাড়ি, বিস্তর টাকা। এক ছেলে পঞ্জাবে ইঞ্জিনিয়ার, আর এক ছেলে যেন কোথায় প্রফেসারি করে। মানে এত পয়সাকড়ি যে এখন পিসে ইচ্ছা করলে সব ছেড়ে বসে বসে গড়গড়া টানতে পারেন। কিন্তু ওসবে একাদশী পিসের সুখ নেই। খালি টাকা টাকা–টাকা। কিন্তু তার একটা পয়সা খরচ করতে হলে তাঁর পাঁজরা ভেঙে যায়।

কী করেন তা হলে টাকা দিয়ে?

-কেন, ব্যাঙ্কে জমান। একটা কানাকড়িও তোলেন না তা থেকে। বলেন–গুরুর আদেশ। গুরু নাকি বলে দিয়েছেন ব্যাঙ্কের জমানো টাকা কখনও তুলতে নেই, তাতে পাপ হয়।

-সত্যিই ওঁর গুরু আছে নাকি?

-ঘোড়ার ডিম, সব বানানো। ওঁদের কে এক কুলগুরু নাকি একবার কিছু প্রণামীর আশায় ওঁর বাড়িতে এসেছিলেন–একাদশী পিসে মোটা একখানা আইনের বই নিয়ে তাঁকে এমন তাড়া লাগালেন যে গুরুদেব এক ছুটে বাঁকুড়ার বর্ডার পেরিয়ে একেবারে মানভূম–মানে পুরুলিয়া ডিসট্রিক্টে চলে গেলেন।

–ডেনজারাস!

-ডেনজারাস বলে ডেনজারাস! বাড়িতে লোকজন টেকে না–ঝি-চাকর আসে, কিন্তু মোটা মোটা চালের আধপেটা ভাত, আধপোড়া দু-একখানা রুটি, খোসাসুদ্ধ কড়াইয়ের দাল আর ডাঁটার চচ্চড়ি দিন তিনেক খেয়েই তারা বাপরে–মা-রে বলে ছুটে পালায়। যাওয়ার আগে যদি মাইনে চায়, একাদশী পিসে বলেন, মাইনে! চুক্তি ভঙ্গের দায়ে এক্ষুনি তোদের নামে এক নম্বর ঠুকে দেব।

পিসেমশাইয়ের বাড়িতে গোরু আছে, দুধও হয় কিন্তু দুধ পিসেমশাই কাউকে খেতে দেন না–বলেন, ও তো শিশুর খাদ্য। দুধ তিনি বিক্রি করেন। ঘি? আরে রামো–কোন ভদ্রলোকে ঘি খায়? এক সের তেলে তাঁর বাড়িতে ছমাস রান্না হয়। মাংস? পিসে বলেন, ছিঃ জীবহিংসা করতে নেই।

আমি জিজ্ঞেস করলুম, পরের বাড়িতে গিয়ে তিনি মাংস খান না?

–খাবেন না কেন? পেলেই খান। কিন্তু জীব-হিংসের পাপ তো অন্যের। পিসের কী দোষ?

-আর মাছ?

হুঁ, মাছ একটু অবিশ্যি না হলে তাঁর খাওয়া হয় না। দুটো ছোট-ছোট শিঙিমাছ আনলে তাঁর মাসখানেক চলে যায়।

–সে কী।

টেনিদা মিটমিট করে হাসল : বুঝতে পারছিস না? মাছ দুটোকে হাঁড়িতে জিইয়ে রাখা হয়। আর রোজ সকালে পিসেমশাই একখানা দাড়ি কামানোর ব্লেড দিয়ে সেই মাছদের ল্যাজ থেকে–এই মনে কর–আধ ইঞ্চির কুড়ি ভাগের এক ভাগ কেটে নেন।

আমি একটা বিষম খেলুম : কত বললে?

–আধ ইঞ্চির কুড়ি ভাগের এক ভাগ।

কাটতে পারে কেউ? ইমপসিবল!

–তুই ইমপসিবল বললেই হবে? যে-লোক ওভাবে পয়সা জমাতে পারে সে সব পারে। এমন ভাবে কাটেন যে মাছ দুটো টেরও পায় না–পরদিন সে ল্যাজ আবার গজিয়ে যায়। আর সেই ল্যাজের কাটা টুকরোটা দিয়ে এক বাটি ঝোল রান্না করে খান একাদশী পিসে–বলেন, শিঙিমাছের ঝোল খুব বলকারক।

আমি বললুম, তাতে আর সন্দেহ কী! কিন্তু মাছ দুটো মরে গেলে?

–বাড়িতে বিরাট ভোজ। সবাই সেদিন ঝোলে আঁশটে গন্ধ পায়। তারপর সাত দিন আর মাছ আসে না। পিসে বলেন–এত মাছ খাওয়া হয়েছে, এগুলো আগে হজম হোক!

–তা এখন পিসে হঠাৎ কাঁকে গেলেন কেন?

–আরে যেতে কি আর চেয়েছিলেন? তাঁকে যেতে হল। সেই কথাই বলি।

… এখন হয়েছে কী জানিস? সারা জীবন ওই কড়াইয়ের দাল আর ডাঁটা চচ্চড়ি খেতে-খেতে শেষকালে পিসিমা গেলেন দারুণ চটে।–ওদিকে টাকায় শেওলা জমে গেল, এদিকে আমরা না খেয়ে মরি! বিদ্রোহ করলেন পিসিমা।

বিদ্রোহ!

–তা ছাড়া আর কী! সামনা-সামনি কিছু বললেন না, কিন্তু চমৎকার প্ল্যান আঁটলেন একটা। পিসে তো কড়াইয়ের দাল, চচ্চড়ি আর তাঁর সেই মাছ খেয়ে নিয়মিত কোর্টে চলে যান। আর পিসিমা কী করেন? তক্ষুনি চাকরকে বাজারে পাঠান-গলদা চিংড়ি, ইলিশ, মাছ, পাকা পোনা, ভাল মাংস, ডিম এইসব আনান। সেগুলো তখন রান্না হয়, পিসিমা খান, ঝি-চাকর খায়–বাড়িতে যে-দুটো মড়াখেকো বেড়াল ছিল তারা দেখতে-দেখতে তেল-তাগড়া হয়ে যায়।

আমি বললুম, এ কিন্তু পিসিমার অন্যায়। পিসেকে ফাঁকি দিয়ে

টেনিদা রেগে বললে, কিসের অন্যায়? পিসে যদি কাঁড়ি কাঁড়ি টাকা রোজগার করেও না খেয়ে শিটকে হয়ে থাকেন–সে তাঁর খুশি। তাই বলে পিসিমা কষ্ট পেতে যাবেন কেন? আর অনেক দিনই ডাঁটা-চচ্চড়ি চিবিয়েছেন, চিবুতে চিবুতে দাঁতই পড়ে গেছে গোটাকয়েক, শেষ বয়সে ইচ্ছে হবে না একটু ভালোমন্দ খাবার?

–তা বটে।

-এইভাবেই বেশ চলে যাচ্ছিল। পিসেমশাই কিছুই টের পেতেন না। কেবল মধ্যে-মধ্যে বেড়াল দুটোর দিকে তাকিয়ে তাঁর মনে একটা কুটিল সন্দেহ দেখা দিত। পিসিমাকে জিজ্ঞেস করতেন, বেড়াল দুটো কী খাচ্ছে-টাচ্ছে বলো তো? এত মোটা হচ্ছে কেন? পিসিমা ভালোমানুষের মতো মুখ করে বলতেন, ওরা আজকাল খুব ইঁদুর মারছে–তাই। ও–ইঁদুর মারছে। শুনে পিসেমশাই খুব খুশি হতেন, বলতেন, ইঁদুর মারা খুব ভালো, ও ব্যাটারা ধান-চাল, কলাইটলাই খেয়ে ভারি লোকসান করে।

সবই তো ভালো চলছিল, কিন্তু সেদিন হঠাৎ

আমি জিজ্ঞেস করলুম, হঠাৎ?

–পিসেমশাই কোর্টে গিয়ে দেখলেন–কে মারা গেছেন, কোর্ট বন্ধ। একটু গল্প-গুজব করে, পরের পয়সায় দু-একটা পান-টান খেয়ে বেলা বারোটা নাগাদ হঠাৎ বাড়ি ফিরলেন তিনি। ফিরেই তিনি স্তম্ভিত! এ কী! সারা বাড়ি যে মাছের কালিয়ার গন্ধে ম-ম করছে। মাছের মুড়ো দিয়ে সোনামুগের ডালের সুবাসে বাতাস ভরে গেছে যে! এ তিনি কোথায় এলেন কার বাড়িতে এলেন! জেগে আছেন, না স্বপ্ন দেখছেন।

দরজায় গাড়ি থামার শব্দে ওদিকে তো পিসিমার হাত-পা পেটের ভেতর ঢুকে গিয়েছিল। কিন্তু পিসিমা দারুণ চালাক আর মাথাও খুব ঠাণ্ডা। তিনি এক গাল হেসে বললেন, এসো এসো। তুমি যাওয়ার পরেই তোমার এক মক্কেল-কী নাম ভুলে গেছি প্রকাণ্ড একটা রুইমাছ, ভালো সোনামুগের ডাল আর ফুলকপি পাঠিয়ে দিয়েছে। তাই রান্না করছিলুম।

অ–মক্কেল। পিসেমশাই একটু আশ্বস্ত হলেন কিন্তু তারপরেই আঁতকে উঠে বললেন, কিন্তু তেল, ঘি? মশলা-পাতি?

সব সে পাঠিয়ে দিয়েছিল।

তাই নাকি? তাই নাকি? তা হলে খুব ভালো–পিসেমশাইয়ের বোঁচা গোঁফের ফাঁকে একটু হাসি দেখা দিল : আমি ভাবতুম, মক্কেলগুলো সব বে-আক্কেলে–এর দেখছি একটু বুদ্ধি-বিবেচনা আছে। তা কোথাকার মক্কেল বললে? কী নাম?

নাম তো ভুলে গেছি।–পিসিমা বুদ্ধি খাটিয়ে বললেন, বোধহয় সোনামুখীর কোনও লোক। তিনি জানতেন সোনামুখীতে পিসের কিছু মক্কেল আছে।

সোনামুখী?–ভুরু কুঁচকে ভাবতে লাগলেন পিসে।

পিসি বললেন, হয়েছে হয়েছে, এখন তোমায় আর অত আকাশ-পাতাল ভাবতে হবে না। কত লোকের মামলা জিতিয়ে দিয়েছ, কে খুশি হয়ে দিয়ে গেছে, ও নিয়ে মাথা ঘামালে চলে? এখন এসো–মুড়িঘণ্টের ডাল আর মাছের কালিয়া দিয়ে দুটো ভাত খাও।

বাড়ি গন্ধে ভরাট–তাতে মাথা খারাপ হয়ে যায় পিসেমশাইয়ের পেটও চুঁই চুঁই করছিল। তবু একটু মাথাটা চুলকে বললেন, বামুনের ছেলে, এক সূর্যিতে দুবার ভাত খাব?

ভাত না খেলে। মাছই খাও একটু।

তা হলে ভাতও দাও দুটো। শুধু মাছে কি আর– পিসে ভেবে-টেবে বললেন, আর মক্কেলই তো খাওয়াচ্ছে–ওতে দোষ হবে না বোধহয়।

পিসিমা বললেন, না-কোনও দোষ হবে না।

অগত্যা পিসে বসে গেলেন। কিন্তু ডাল থেকে মুড়ো তুলে মুখে দিয়েই হঠাৎ একটা আর্তনাদ করলেন তিনি।

এ যে যজ্ঞির রামা।

পিসিমা বললেন, পরের পয়সায় তো।

কিন্তু কয়লা পুড়ল যে।

পিসিমা বললেন, কয়লা তো পোড়াইনি। চাকর দিয়ে শুকনো ডাল-পালা কুড়িয়ে আনিয়েছি।

কিন্তু কিন্তু-হাঁড়ি-ডেকচিগুলো?–বুকফাটা চিৎকার করলেন পিসেমশাই।

সেগুলো আগুনে পুড়ল না এতক্ষণ? ক্ষতি হল না তাতে? তারপর মাজতে হবে না? আরও ক্ষয়ে যাবে না সেজন্যে?–বলতে বলতে পিসেমশাই ডুকরে ডুকরে কেঁদে উঠলেন : গেল–আমার এত টাকার হাঁড়ি-ডেকচি ক্ষয়ে গেল আর কাঁদতে কাঁদতে ঠাস করে পড়ে গেলেন। পড়েই অজ্ঞান।

জ্ঞান হল বারো ঘণ্টা পরে। চোখ লাল–খালি ভুল বকছেন। থেকে-থেকে কঁকিয়ে কেঁদে উঠছেন :গেল–গেল–আমার হাঁড়ি-ডেকচি গেল।

ডাক্তার এসে বললেন, দারুণ শক পেয়ে পাগল হয়ে গেছে। রাঁচি পাঠিয়ে দেখুন–ওরা যদি কিছু করতে পারে।

তাই একাদশী পিসে কাঁকে চলে গেলেন। হয়তো ছমাস পরে ফিরবেন। এক বছর পরেও ফিরতে পারেন। আর নইলে পাকাপাকিভাবে থেকেও যেতে পারেন ওখানে। রাঁচির জল হাওয়ায় ভালোই থাকবেন আর মধ্যে মধ্যে হাঁড়ি-ডেকচির জন্যে কান্নাকাটি করবেন।

আমি বললুম, আচ্ছা টেনিদা, এখন একাদশী পিসি কী করবেন? বেশ নিশ্চিন্তে রোজ রোজ মাছ-মাংস-পোলাও-পায়েস খাবেন তো?

টেনিদা বললে, ছি প্যালা–তুই ভীষণ হার্টলেস।

আমি চুপ করে রইলুম। তেলেভাজার ঠোঙা শেষ হয়ে গিয়েছিল, একটা ল্যাজ-ন্যাড়া নেড়ী কুত্তার গায়ে সেটা ছুঁড়ে দিয়ে টেনিদা আমার কানে কানে বললে, এখন মানে যদ্দিন পিসে কাঁকেতে থাকে এই সময় বাঁকুড়ায় বেড়াতে যাওয়া যায়, না রে? যাবি তুই আমার সঙ্গে?

পরমানন্দে মাথা নেড়ে আমি বললুম, নিশ্চয়–নিশ্চয়।

কাঁকড়াবিছে

চাটুজ্জেদের রকে আমি, টেনিদা আর হাবুল সেন বসে মোড়ের বুড়ো হিন্দুস্থানীর কাছ থেকে কিনে-আনা তিনটে ভুট্টাপোড়া খুব তরিবত করে খাচ্ছিলুম। হঠাৎ কোত্থেকে লাফাতে লাফাতে ক্যাবলা এসে হাজির।

–ডি লা গ্র্যান্ডি মেফিস্টোফিলিস। মেরেছি একটাকে।

কচরকচর করে ভুট্টার দানা চিবুতে চিবুতে টেনিদা বললে, হঠাৎ এত লম্ফঝম্ফ যে? কী মেরেছিস? মাছি, না ছারপোকা?

একটা মস্ত কাঁকড়াবিছে। দেওয়ালের ফুটো থেকে বেরিয়ে দিব্যি ল্যাজ তুলে আমাদের ছেদিলালকে কামড়াতে যাচ্ছিল। ছেদিলাল আপন মনে গান গাইতে গাইতে গোরু দোয়াচ্ছে, কিচ্ছু টের পায়নি। আমি দেখেই একটা ইট তুলে ঝাঁ করে মেরে দিলুম-ব্যস-ঠাণ্ডা।

টেনিদা মুখটাকে কুচোচিংড়ির মত সরু আর বিচ্ছিরি করে বললে, ফুঃ।

ফুঃ মানে? ক্যাবলা চটে গেল; কাঁকড়াবিছের সঙ্গে চালাকি নাকি? একবার কামড়ালেই বুঝতে পারবে।

কাঁকড়াবিছের সঙ্গে চালাকি কে করতে যাচ্ছে? কিন্তু কলকাতায় কাঁকড়াবিছে? রাম রাম! ওরা তো ডেয়ো পিঁপড়ের বড়দা ছাড়া কিছু নয়। আসল কাঁকড়াবিছের কথা জানতে চাস তো আমার পচামামার গল্প শুনতে হবে।

গল্পের আরম্ভে ক্যাবলা তড়াক করে রকে উঠে বসল।

হাবুল বললে, পচামামা? এই নামটা এইবারে য্যান নূতন শুনত্যা আছি।

কাল শুনবি আরও, এখুনি হয়েছে কী!–ভুট্টার দানাগুলো শেষ করে টেনিদা এবার সবটা বেশ করে চেটে নিলে : আর যত শুনবি ততই চমকে যাবি।

আমি একবার মাথাটা চুলকে নিয়ে বললুম, একটা কথা জিজ্ঞেস করব টেনিদা?

ভুট্টার গোঁজটা ছুঁড়ে ফেলে দিয়ে টেনিদা মোটা গলায় বললে, ইয়েস, পারমিশন দিচ্ছি।

–তোমার কটি মামা আছে সবসুদ্ধ?

টেনিদা বললে, ফাইভ ফিফটিফাইভ। মানে পাঁচশো পঞ্চান্ন জন।

আমি কাকের মতো হাঁ করে বসে রইলুম, ক্যাবলা একটা খাবি খেল, আর হাবুল সেন ডুকরে উঠল : খাইছে!

ইউ শাট আপ হাবলা, চিল্লাসনি। মামা কী রকম জানিস? ঠিক রেকারিং ডেসিমেলের মতো-মানে, শেষ নেই। মনে কর মার পিসতুতো ভাইয়ের বড় শালার মেজ ভায়রা-তাকে কী বলে ডাকব?

আমরা একবাক্যে বললুম, মামা।

কিংবা মনে কর, আমার কাকিমার মাসতুতো বোনের খুড়তুতো ভাইয়ের

ক্যাবলা বললে, থাক, আর বলতে হবে না। মানে, মামা। বিশ্বময় মামা।

রাইট। পচামামা সেই বিশ্বময় মামার একজন।

আমি অধৈর্য হয়ে বললাম, সে তো হল। কিন্তু কাঁকড়াবিছে

টেনিদা দাঁত খিঁচিয়ে বললে, দাঁড়া না ঘোড়াড্ডিম। আগে সব জিনিসটা ক্লিয়ার করে নিতে হবে না? কুরুবকের মতো বেশি বকবক করবি তো তোর কানের ওপর এখুনি একটা কাঁকড়াবিছে ছেড়ে দেব।

হাবুল বললে, ছাইড়া দাও–প্যালার কথা ছাইড়া দাও! ওইটা একটা দুগ্ধপোইষ্য শিশু।

কী আমার ঠাকুর্দা এলেন রে–আমি হাবুলকে ভেংচি কাটলুম।

টেনিদা আমার মাথায় টাং করে একটা টোকা মেরে বললে, ইউ স্টপ! নাউ নো ঝগড়া। তাহলে দুই থাপ্পড় দিয়ে দুটোকেই তাড়িয়ে দেব এখান থেকে। এখন পচামামার গল্প শুনে যা। খবরদার, ডিসটার্ব করবিনে।

আমরা একবাক্যে বললুম, না–না।

–পচামামা, বুঝলি–একটা গলাখাঁকারি দিয়ে টেনিদা শুরু করলে : স্কুলে সাতবার ম্যাট্রিক পরীক্ষায় ফেল করেছিল। আটবারের বার টেস্টেও যখন অ্যালাও হতে পারল না, তখন দাদু-মানে পচামামার বাবা তাকে পেল্লায় একটা চড় মেরে বলল, নিকালে আমার বাড়ি থেকে হতভাগা মুখ, কুপুত্তুর, বোম্বেটে, অকালকুষ্মাণ্ড কোথাকার।

একসঙ্গে চার-চারটে ওইরকম জবরদস্ত গাল, আর গালের ওপর অমনি একখানা, কী বলে–জাড্যাপহ চাঁটি–

আমি জিজ্ঞাসা করলুম : জাড্যাপহ মানে কী?

–আমি কোত্থেকে জানব? শুনতে বেশ জাঁদরেল লাগে, তাই বললুম।

ক্যাবলা বলতে গেল : জাড্যাপহ, অর্থাৎ কিনা, যা জড়তা অপহরণ

-চুপ কর ক্যাবল-টেনিদা খেঁকিয়ে উঠল : তুই আর পণ্ডিতের মতো টিকটিক করিসনি! ফের যদি বিদ্যে ফলাবি–আমি আর গল্প বলবই না। মুখে বল্টু এঁটে বসে থাকব।

আমি ব্যস্ত হয়ে বললাম, না–না, আমরা আর কথা বলব না। গল্পটাই চলুক।

টেনিদা আবার শুরু করল : সেই জাড্যাপহ চাঁটি খেয়ে পচামামার মন উদাস হল। ম্যাট্রিক পরীক্ষার নিকুচি করেছে–এমন অপমান সহ্য করা যায়। পচামামা সেই রাতেই দেশান্তরী হল।

মানে বিদেশে আর যাবে কোথায়, তখনও পাকিস্তান হয়নি-সোজা দার্জিলিং মেলে উঠে পড়ল। নামল গিয়ে শিলিগুড়িতে। সেখান থেকে হাঁটতে হাঁটতে পাহাড় জঙ্গল ভেঙে, বাঙলা দেশের চৌহদ্দি পেরিয়ে একেবারে চলে গেল ভুটানে।

ইচ্ছে ছিল তিব্বতে গিয়ে অতীশ দীপঙ্কর-টর হবে, কিন্তু একে বেজায় শীত, তায় ভুটান তখন লালে লাল।

লালে লাল?-ক্যাবলা জিজ্ঞেস করলে; ভূটানীরা খুব দোল খেলে বুঝি?

–তোর মুণ্ডু! লেবু–লেবু, কমলালেবু। ভূটানী কমলা বিখ্যাত, জানিস তো? আর পাহাড় আলো করে সব বাগান, তাতে হাজারে হাজারে ফল পেকে টুক-টুক করছে ঝরে পড়ছে গাছতলায়। যত খুশি কুড়িয়ে খাও, কেউ কিচ্ছুটি বলবে না। এমনকি এদিক-ওদিক তাকিয়ে দুটো-চারটে ছিঁড়ে নিতে পারো–কে আর অত লক্ষ করতে যাচ্ছে!

মোদ্দা, ওই কমলালেবুর টানেই পচামামা ভূটানে আটকে গেল। যেখানে-সেখানে পড়ে থাকে আর পেটভরতি লেবু খায়। দেখতে দেখতে পচামামার ছিবড়ে বাদুড়চোষা চেহারাই পালটে গেল একদম। দাদু কিপটে লোক, তাঁর বাড়িতে পুঁইডাঁটা চচ্চড়ি, কড়াইয়ের ডাল আর খলসে মাছের ঝাল খেয়ে পচামামার বুদ্ধিটুদ্ধিগুলোতে মরচে পড়ে গিয়েছিল, কিন্তু কমলালেবুর রসে হঠাৎ সেগুলো চাঙা হয়ে উঠল।

ওদিকে সবচাইতে বড় বাগানের মালিক হল পেম্বাদোরজী শিরিং। নামটা, কী বলে-একটু ইয়ে হলেও লোকটি বেশ ভালোমানুষ। গোলগাল চেহারা, গায়ে ওদের সেই কালো আলখাল্লা, মাথায় কাঁচাপাকা চুলের লম্বা বিনুনি। মুখে পাঁচ-সাত গাছা দাড়ি, সব সময় মিঠে-মিঠে হাসি, আর রাতদিন চমরী গাইয়ের জমাট দুধের টুকরো চুষছে। পচামামা তাকে গিয়ে মস্ত একটা সেলাম ঠুকে বললে, শিরিং সাহেব, আমি একজন বিদেশী।

শিরিং হেসে বললে, সে জানি। আজ পনেরো দিন ধরে তুমি আমার বাগানের লেবু খেয়ে আধাসাট করছ। কিন্তু আমরা অতিথিবৎসল বলে তোমায় কিছু বলিনি। ভুটিয়া হলে আমার এই কুকরি দিয়ে মুণ্ডটি কচাৎ করে কেটে নিতুম।

শুনে পচামামার রক্ত জল হয়ে গেল। বললে, সাহেব, আমি খুব হাংগ্রি বলেই

শিরিং চমরী গাইয়ের দুধের টুকরো মুখে পুরে বললে, ঠিক আছে, আমি কিছু মাইণ্ড করিনি। ওই তো তোমার বাঙালীর পেট, কীই বা তুমি খেতে পারো। এখন বলল, কী চাও?

–শিরিং সাহেব–পচামামা হাত কচলাতে কচলাতে বললে, শুধু কমলালেবু চালান দিয়ে কীই বা লাভ হয় আপনার?

কম কী? লাখ খানেক।

আজ্ঞে, এই লাখ টাকা যদি পাঁচ লাখ হয়?

শুনে শিরিং সাহেব নড়ে বসল : তা কী করে হতে পারে?

–আপনি অরেঞ্জ স্কোয়াশ, অর্থাৎ বোতল-ভরতি করে কমলালেবুর রস বিক্রি করুন। তাতে লাভ অনেক বেশি হবে।

শিরিং হাসল : এ আর নতুন কথা কী? এই তো মাইল-পাঁচেক দূরে ডিক্রুজ বলে এক সায়েব একটা কারখানা করেছে। সে তো জুত করতে পারছে না। বাজারে দারুণ কম্পিটিশন-কলকাতা ও বোম্বাইতে অনেক বড় কোম্পানি, আমরা সুবিধে করতে পারব কেন?

পচামামা আবার একটা লম্বা সেলাম ঠুকল : যদি এমন অরেঞ্জ স্কোয়াশ তৈরি করতে পারি যা স্বাদে গন্ধে, যাকে বলে অতুলনীয়? মানে যা খেলে লোকে আর ভুলতে পারে না, একবার খেলে বারবার খেতে চায়?

–সে জিনিস তৈরি করবে কে? তুমি?

–চেষ্টা করে দেখতে পারি।

–তুমি কি কেমিস্ট?

–আমি এম. এস-সি।

পচামামা চাল মারল, বুঝতেই পারছিস। কিন্তু বিদেশ-বিভুয়ে এক-আধটু ওসব করতেই হয়, নইলে কাজ চলে না। পচামামা ভাবল, হুঁ-হুঁ–বাঙালীর ব্রেন–একটা কিছু করে ফেলবই।

শিরিং খানিকক্ষণ গম্ভীর হয়ে কী ভাবল। তারপর বললে, বেশ, চেষ্টা করে দেখো।

–কিন্তু দিন পনেরো সময় দিতে হবে।

–পনেরো দিন কেন?–শিরিং উৎসাহ দিয়ে বললে, এক মাস সময় দিচ্ছি। তুমি আমার আউট-হাউসে থাকো। এক্সপেরিমেন্টের জন্যে যা যা চাও সব দেব। যদি সাকসেসফুল হতে পারো, তোমাকে কারখানার চিফ কেমিস্ট করে দেব, আর মাসে দুহাজার টাকা করে মাইনে।

পচামামা এসে শিরিং সাহেবের আউট-হাউসে উঠল। সে কী রাজকীয় আয়োজন। এমন গদি-আঁটা বিছানায় পচামামাদের কেউ সাত জন্মে শোয়নি। দুবেলা এমন ভালো-ভালো খাবার খেতে লাগল যে তিন দিন পরে একবার করে পেটের অসুখে ভুগতে লাগল। আর সেইসঙ্গে চলল তার এক্সপেরিমেন্ট।

কখনও কমলালেবুর রসে আদা মেশাচ্ছে, কখনও মধু, কখনও চায়ের লিকার, কখনও ঝোলা গুড়, কখনও বা এক-আধ শিশি হোমিওপ্যাথিক ওষুধই ঢেলে দিচ্ছে–মানে, প্রাণে যা চায়। আর খেয়ে-খেয়ে দেখছে। কোনওদিন বা এক চামচে খেয়েই বমি করে ফেলল, কোনওদিন মুখে দিতে না দিতেই তিড়িং-তিড়িং করে লাফিয়ে উঠল, কোনওদিন নেহাত মন্দ লাগল না, আর কোনওদিন মুখ এমন টকে গেল যে, ঝাড়া আটচল্লিশ ঘন্টা কিছু আর দাঁতে কাটতে পারে না।

এদিকে এক মাস যায়-যায়। শিরিং সাহেব মাঝে মাঝে খবর নেয়, কদ্দূর হল। পচামামা বুঝতে পারল, এবারে পরস্মৈপদী রাজভোগ আর বেশিদিন চলবে না। এক মাসের ভেতর কিছু করতে না পারলে এই খাওয়ার সুখ সুদে-আসলে আদায় করে নেবে; পিটিয়ে তক্তা তো করে দেবেই, চাই কি কচাং করে মুণ্ডটিও কেটে নিতে পারে।

পচামামা রাত জেগে ভগবানের কাছে প্রার্থনা করে, আর এক্সপেরিমেন্ট চালায়। তারপর একদিন মধু, আদা, হোমিওপ্যাথিক ওষুধ আর পিঁপড়ের ডিম মিশিয়ে যেই এক্সপেরিমেন্ট করেছে।

ওঃ, কী বলব তোদের, কী তার স্বাদ, কী সুতার। এক-চামচে খেয়ে মনে হল যেন পোলাও, পায়েস, ছানার ডালনা, আলুকাবলি, বেলের মোর, দরবেশ, রাবড়ি-মানে যত ভালো-ভালো খাবার জিনিস রয়েছে, সব যেন কে একসঙ্গে তার মুখে পুরে দিলে। এমন অপূর্ব, এমন আশচর্য অরেজ্ঞ স্কোয়াশ পৃথিবীতে কেউ কখনও খায়নি।

–পচামামা তখনই গিয়ে শিরিং সাহেবকে সেলাম ঠুকল। বললে, আমি রেডি।–

-এক্সপেরিমেন্ট সাকসেসফুল?

শিরিং সাহেব খুশি হয়ে বললে, বেশ, তা হলে কালকে আমি ও আমার স্ত্রী, আমার ছেলে, আমার ম্যানেজার, আর আমার তিনজন বন্ধু আমরা তোমার অরেঞ্জ স্কোয়াশ খেয়ে দেখব। যদি ভালো লাগে, কালই কলকাতায় মেশিনের অর্ডার দেব, আর তুমি হবে আমার কারখানার চিফ কেমিস্ট, মাসে দুহাজার টাকা মাইনে।

কেল্লা ফতে। পচামামা নাচতে নাচতে চলে এল। সারা রাত ধরে স্বপ্ন দেখল, সে একটা মস্ত মোটরগাড়ি চেপে রাস্তা দিয়ে যাচ্ছে আর দুধারের লোক তাকে সেলাম ঠুকছে।

কিন্তু বরাত কি আর অত সহজেই খোলে রে? তাহলে কি আর আজ পচামামাকে লুঙ্গি আর গেঞ্জি পরে গাঁয়ে মুদিখানার দোকান করতে হয়? না–পেঁয়াজ আর মুসুরির ডালের ওজন নিয়ে খদ্দেরের সঙ্গে ঝগড়া করতে হয়?

যা হল, তা বলি।

পচামামা বুঝতে পেরেছিল, নিশ্চয় পিঁপড়ের ডিমের গুণেই তার তৈরি অরেঞ্জ স্কোয়াশ তখন স্বর্গের সুধা হয়ে উঠেছে। প্রাণ খুলে সে আট বোতল সুধা তৈরি করল তারপর নিশ্চিন্তে ঘুমুতে গেল। আর ঘুমিয়ে ঘুমিয়ে কী সুখের স্বপ্ন যে দেখল সে তো আগেই বলেছি।

পরের দিন শিরিং সাহেব তো দলবল নিয়ে পচামামার এক্সপেরিমেন্ট চাখতে বসেছে। সবটা মিলে বেশ একটা চমৎকার মোচ্ছবের আবহাওয়া। মস্ত টেবিলে দামী টেবিল ক্লথ পেতে দেওয়া হয়েছে, ফুলদানিতে ফুল সাজানো হয়েছে, গ্রামোফোনে নাচের রেকর্ড বাজছে, আর সাতজনের সামনে সাতটি রুপোর গ্লাস চকচক করছে।

পচামাম আহ্লাদে-আহ্লাদে মুখ করে গেলাসে তার এক্সপেরিমেন্ট ঢেলে দিলে। প্রথমে শিরিং সাহেব একটা চুমুক দিল, তারপরেই আর সবাই। তোদের বলব কী তক্ষুনি যেন বিপর্যয় ব্যাপার ঘটে গেল। প্রথমেই আঁক করে শিরিং সাহেব চেয়ারসুদ্ধ উলটে পড়ে গেল, শিরিং সাহেবের গিন্নি টেবিলে বমি করে ফেলল, তাদের ছেলে আই করে একটা আওয়াজ তুলে সেই-যে ঘর থেকে দৌড় লাগাল–পাক্কা তিন মাইল গিয়ে তারপরে বোধহয় সে থামল। ম্যানেজার হাত-পা ছুঁড়ে পাগলের মতো নাচতে লাগল–একজন অতিথি আর-একজনকে জড়িয়ে ধরে ঘরের মেঝেয় কুস্তি লড়তে লাগল, আর তিন নম্বর অতিথি হঠাৎ তেড়ে গিয়ে শিরিং সাহেবের কুকুরটার ল্যাজে ঘ্যাঁক করে কামড়ে দিলে!

পচামামা বুঝতে পারল, গতিক সুবিধের নয়। তার সুধা যেমনই হোক–খেয়ে এদের আরাম লাগেনি। আর মনে পড়ল, শিরিং সাহেবের কুকরিটাও নেহাত চালাকি নয়। কাজেই

থাকিতে চরণ, মরণে কি ভয়, নিমেষে যোজন ফরসা পচামামা দে-দৌড়। সারাদিন দৌড়ল, তারপর সন্ধেবেলা এক গভীর বনের ভেতর একটা ভাঙা মন্দিরে বসে হাঁপাতে লাগল। ভাবল, খুব বেঁচে গেছি এ-যাত্রা।

ওদিকে ঘণ্টাতিনেক বাদে মাথা-ফাথা একটু ঠাণ্ডা হলে শিরিং সাহেব হাঁক ছাড়ল : কোথায় সেই জোচ্চোর কেমিস্ট? বিষ খাইয়ে আমাদের মেরে ফেলবার জোগাড় করেছিল। শিগগির তার কান ধরে টেনে নিয়ে আয় এখানে, আমি নিজের হাতে তার মুণ্ডু কাটব।

তক্ষুনি লোক ছুটল চারদিকে।

ওদিকে পচামামা মন্দিরে বসে ভাবতে লাগল, ব্যাপারটা কী হল। সে নিজে বারবার তার আবিষ্কার চোখে দেখেছে, কী তার সোয়াদ-কী তার গন্ধ! রাতারাতি অমন করে সব বদলে গেল কী করে?

হয়েছিল কী, জানিস? পচামামার বাবুর্চিটা ছিল ভীষণ লোভী। সে এক ফাঁকে একটা বোতল থেকে একটু খেয়ে এমন মজে গেছে যে চুপি-চুপি আটটা বোতলই সাফ করে ফেলেছে। তারপরেই তার খেয়াল হয়েছে, সকালে তো শিরিং সাহেব তার গর্দান নেবে। তখন করেছে কী, পচামামার এক্সপেরিমেন্ট টেবিলে যা ছিল–মানে লেবুর রস, চাল-ধোয়া জল, টিংচার আইডিন, এক শিশি লাল কালি, খানিক ঝোলা গুড় আর বেশ কিছু গঁদের আঠা ঢেলে আটটি বোতল আবার তৈরি করে রেখেছে। আর তাই খেয়েই

পচামামা আর কিছু বুঝতে পারছে না। সামনে সেই ভাঙা মন্দিরটার ভেতরে বসে মশার কামড় খাচ্ছে, ভয়ে আর শীতে ঠকঠক করে কাঁপছে। ভাবছে, রাত্তিরটা কোনওমতে কাটলে হয়, তারপর আবার এক দৌড়, মাইল-দশেক পেরুতে পারলেই ভূটান বর্ডার ছাড়িয়ে লঙ্কাপাড়া চা বাগান–তখন আর তাকে কে পায়।

পচামামা যেখানে বসে আছে তার দু পাশে ভাঙা মেঝেতে বিস্তর ফুটোফাটা। সেই ফুটো দিয়ে ধীরে ধীরে কয়েকটি প্রাণী মুখ বের করল। কালো কটকটে তাদের রঙ, লম্বা লম্বা ল্যাজের আগা বঁড়শির মতো বাঁকানো চোখে সন্ধানী দৃষ্টি। শীতের দিন, ভালো খাওয়া-দাওয়া জোটে না–পেটে বেশ খিদে ছিল তাদের। ওদিকে পচামামার কোটের পকেট থেকে কেক, ডিমভাজা–এসবের বেশ মনোরম গন্ধ বেরুচ্ছে। পালাবার সময় পচামামা টেবিল থেকে যা পেয়েছে দু-পকেটে বোঝাই করে নিয়েছিল বুঝেছিল পরে এসব কাজে লাগবে।

সুড়সুড় করে দু-দিকের পকেটে তারা একে একে ঢুকে পড়ল। খাবারের ধ্বংসাবশেষ কিছু ছিল, তাই খেতে লাগল একমনে। পচামামা উদাস হয়ে বসে ছিল, এসব ব্যাপার কিছুই সে টের পেল না।

হঠাৎ তার মুখের ওপর টর্চের আলো। আর সঙ্গে সঙ্গে ভুটিয়া ভাষায় কে যেন বললে, এই যে, পাওয়া গেছে!

আর-একজন বললে, এবার কান ধরে টানতে টানতে নিয়ে চল। সকালে শিরিং সাহেব ওর মুণ্ডু কাটবে।

পচামামার রক্ত জল হয়ে গেল! সামনে দৈত্যের মতো জোয়ান দুই ভুটিয়া। কোমরে চকচকে কুকরির খাপ। অন্ধকারেও পচামামা দেখল, তার মুখের ওপর টর্চ ফেলে ঝকঝকে দাঁতে হাসতে হাসতে তারা তারই দিকে এগিয়ে আসছে।

পচামামা দাঁড়িয়ে পড়ল। পালাবার পথ বন্ধ। তবু মরিয়া হয়ে ভাঙা গলায় পেঁচিয়ে উঠল : সাবধান–এগিয়ো না, আমার দুই পকেটেই রিভলভার আছে।

-হাঃ–হাঃ–রিভলভার।–দুই মূর্তি ঝাঁপিয়ে পড়ল পচামামার ওপর। পচামামা কিছু বলবার আগেই দুজনের দুটো হাত তাকে জাপটে ধরল, আর দুটো বাঁ-হাত তার দু-পকেটে রিভলভার খুঁজতে লাগল। আর তক্ষুনি দুই জোয়ানের গগনভেদী আর্তনাদ! পচামামাকে ছেড়ে দিয়ে তারা সোজা মেঝের ওপর গড়াতে লাগল : ওরে বাপরে, মেরে ফেলেছে রে–গেলুম–গেলুম। ঠিক তখন বনের ভেতর দিয়ে পূর্ণিমার চাঁদের আলো পড়ল, সেই আলোয় পচামামা দেখল, দুজনের হাতেই এক এক জোড়া করে কালো কদাকার পাহাড়ি কাঁকড়াবিছে লটকে আছে, আর তার নিজের পকেটের ভেতরে সমানে আওয়াজ উঠছে খড়র, খড়র।

–উরিঃ দাদা। পচামামা একটানা গায়ের কোটটা ছুঁড়ে ফেলে দিল। তারপর ওদের পড়ে-থাকা টর্চটা কুড়িয়ে নিয়ে দৌড়দৌড় রাম দৌড়। সকালের জন্যেও অপেক্ষা করতে হল না, একটা চিতাবাঘের পিঠের ওপর হাই জাম্প দিয়ে, একটা পাইথনের ল্যাজ মাড়িয়ে, ডজন পাঁচেক শেয়ালকে আঁতকে দিয়ে রাত নটার সময় যখন লঙ্কাপাড়া চা বাগানে এসে আছাড় খেয়ে পড়ল, তখন তার মুখ দিয়ে গ্যাঁজলা উঠছে। বুঝলি ক্যাবলা, এই হল আসল পাহাড়ি কাঁকড়াবিছের গল্প। দুটো অমন বাঘা জোয়ানকে ধাঁ করে শুইয়ে দিলে। তোর কলকাতার কাঁকড়াবিছে ওদের কিছু করতে পারত? রামোরামো! টেনিদা থামল।

ক্যাবলা মাথা চুলকোতে লাগল। হাবুল বললে, একটা কথা জিগাইমু টেনিদা?

টেনিদা হাবুলের কথা নকল করে বললে, হ, জিগাও।

কাঁকড়াবিছায় কেক-বিস্কুট-ডিমভাজা খায়?

–এ তো আর তোর কলকাত্তিয়া নয়, পাহাড়ি কাঁকড়াবিছে। ওদের মেজাজই আলাদা। আমার কথা বিশ্বাস না হয় পচামামাকে জিজ্ঞেস কর।

–তেনারে পামু কই?

টেনিদা বললে, ধ্যাধ্যেড়ে কালীকেষ্টপুরে।

আমি জানতে চাইলুম : সে কোথায়?

টেনিদা বললে, খুব সোজা রাস্তা। প্রথমে আমতা চলে যাবি। সেখান থেকে দশ মাইল দামোদরে সাঁতার কাটবি। তারপর ডাঙায় উঠে চল্লিশ মাইল পঁচাত্তর গজ সাড়ে এগারো ইঞ্চি হাঁটলেই ধ্যাধ্যেড়ে কালীকেষ্টপুরে পৌঁছে যাবি। আচ্ছা তোরা তা হলে সেখানে রওনা হয়ে যা, আমি এখন একবার পিসিমার বাড়িতে চললুম। টা টা–

বলেই হাত নেড়ে লাফিয়ে পড়ল রক থেকে, ধাঁ করে হাওয়া হয়ে গেল।

কাক-কাহিনী

বাড়ির সামনে রকে বসে একটু করে ডালমুট খাচ্ছি, আর একটা কাক আমাকে লক্ষ করছে। শুধু লক্ষই করছে না, দিব্যি নাচের ভঙ্গিতে এগিয়ে আসছে, আমার মুখের দিকে তাকাচ্ছে, হঠাৎ কী ভেবে একটু উড়ে যাচ্ছে আবার নাচতে নাচতে চলে আসছে। কক্‌ কু বলে মিহি সুরে একবার ডাকলও একটুখানি।

ঠোঙাটা শেষ করে আমি ওর দিকে ছুড়ে দিলুম। বললুম, ছুঁচো, পালা।

আর ঠিক তক্ষুনি আমাদের পটলডাঙার টেনিদা এসে হাজির।

কাকটা ঠোঙাটা মুখে নিয়ে উধাও হয়েছে, টেনিদা ধপাৎ করে আমার পাশে বসে পড়ল।

মোটা গলায় জিজ্ঞেস করলে, তুই কাকটাকে ছুঁচো বললি নাকি?

বললুম বই কি।

বলিসনি, কক্ষনো বলিসনি। ওদের ওতে খুব অপমান হয়।

অপমান হয় তো বয়েই গেল আমার। আমি বিরক্ত হয়ে বললুম, কাকের মতো এমন নচ্ছার, এমন বিশ্ববকাটে জীব দুনিয়ায় আর নেই।

বলতে নেই রে প্যালা, বলতে নেই।—টেনিদার গলার কেমন যেন উদাস-উদাস হয়ে গেল :

তুই জানিসনে ওরা কত মহৎ-কত উদার! তোদের কত বায়নাক্কা—এটা খাব না, ওটা খাব না, সেটা খেতে বিচ্ছিরি কিন্তু কাকদের দিকে তাকিয়ে দ্যাখযা দিচ্ছিস তাই খাচ্ছে, যা দিচ্ছিস না তা-ও খেয়ে নিচ্ছে। মনে কিছুতে নাটি নেই। একবার চিন্তা করে দ্যাখ প্যালা, মন কত দরাজ হলে–

আমি বললুম, থামো। কাকের হয়ে তোমাকে আর ওকালতি করতে হবে না। আমি যাচ্ছি।

টেনিদা অমনি তার লম্বা হাতখানা বাড়িয়ে কঁাক করে ধরে ফেলল আমাকে। বললে, যাবি কোথায়? হতচ্ছাড়া হাবুল সেনের বাড়িতে গিয়ে আড্ডা দিবি, নইলে ক্যাবলার ওখানে গিয়ে ক্যারম খেলবি—এই তো? খবরদার চুপ করে বসে থাক। আজ আমি তোকে কাক সম্পর্কে জ্ঞান-মানে সাধুভাষায় আলোকদান করতে চাই।

অগত্যা বসে যেতে হল। টেনিদার পাল্লায় একবার পড়লে সহজে আর নিস্তার নেই।

টেনিদা খুব গম্ভীর হয়ে কিছুক্ষণ নাক-টাক চুলকে নিলে। তারপর বললে, আমার মোক্ষদা মাসিকে চিনিস?

বললুম, না।

-না চিনে ভালোই করেছিস। যাক গে, মোক্ষদা মাসি তো তেলিনীপাড়ায় থাকে। মাসির আর সব ভালো বুঝলি, কিন্তু এন্তার তিলের নাড় তৈরি করে আর কেউ গেলেই তাকে খেতে দেয়।

—সে তো বেশ কথা।—আমি শুনে অত্যন্ত উৎসাহ বোধ করলুম : তিলের নাড় খেতে তো ভালোই।

—ভালোই?—টেনিদা মুখটাকে বেগুনভাজার মতো করে বললে, মোক্ষদা মাসির নাড়ু একবার খেলে বুঝতে পারছিস। কী করে যে বানায় তা মাসিই বলতে পারে। মার্বেলের চাইতেও শক্ত কামড় দিলে দাঁত একেবারে ঝনঝন করে ওঠে। সকালবেলায় একটা মুখে পুরে নিয়ে চুষতে থাকসন্ধেবেলা দেখবি ঠিক তেমনটিই বেরিয়ে এসেছে।

জানলি, ওই তিলের নাড়র ভয়েই আমি তেলিনীপাড়ায় যেতে সাহস পাই না। কিন্তু কী বলে—এই বিজয়া-টিজয়া তো আছে, প্রণাম করতে দু-একবার যেতেই হয়। আর তক্ষুনি তিলের নাড়। গোটা আষ্টেক দিয়ে বসিয়ে দেবে। তার ওপর পাহারাওয়ালার মতো ঠায় দাঁড়িয়ে থাকবে—এক-আধটা যে এদিক-ওদিক পাচার করে দিবি, তারও জো-টি নেই। আর তোর মনে হবে, সারাদিন বসে স্রেফ লোহার গোলা চিবুচ্ছিস।

সেবারও আমার ঠিক এই দশা হয়েছে। মাসি আমাকে তিলের নাড় খেতে দিয়েছে, দু-দুটো ট্রেন ফেল হয়ে গেল–আধখানা নাড় কেবল খেতে পেরেছি। মাসি সমানে গল্প করছে—ছাগলের চারটে বাচ্চা হয়েছে, ভোঁদড় এসে রোজ পুকুরের মাছ খেয়ে যাচ্ছে—এই সব। এমনি সময় কী কাজে মাসি উঠে গেল আর উঠনে হাঁ করে বসে থাকা একটা কাকের দিকে তক্ষুনি একটা তিলের নাড় আমি ছুঁড়ে দিলুম। কাক সেটাকে মুখে করে সামনের জামরুল গাছটায় উড়ে বসল।

মোক্ষদা মাসি ফিরে এসে আবার ভোঁদড়ের গল্প আরম্ভ করেছে, আর ঠিক এমনি সময় মেসোমশাই ফিরছেন সেই জামরুল গাছের তলা দিয়ে। আর তখন

টপাৎ করে একটি আওয়াজ আর হাঁইমাই চিৎকার করে হাত তিনেক লাফিয়ে উঠলেন মেসোমশাই, তারপর স্রেফ শিবনেত্র হয়ে জামরুলতলায় বসে গেলেন।

আমরা ছুটে গিয়ে দেখি, মেসোমশাইয়ের টাকের ওপরটা ঠিক একটা টোম্যাটোর মতো ফুলে উঠেছে। তখন আন জল—আন পাখা—সে এক হইচই ব্যাপার।

কী হল বুঝেছিস তো? সেই তিলের নাড়! আরে, করাত দিয়ে যা কাটা যায় না, সে চিজ ম্যানেজ করবে কাকে? ঠিক যেন তাক করেই মেসোমশাইয়ের টাকে ফেলে দিয়েছে—একেবারে মোক্ষম ফেলা যাকে বলে। একটু সামলে নিয়েই মেসোমশাই মাসিকে নিয়ে পড়লেন। সোজা বাংলায় বললেন, তুমি যদি আর কোনও দিন তিলের নাড়ু বানিয়েছ, তা হলে তক্ষুনি আমি দাড়ি রেখে সন্নিসি হয়ে চলে যাব!

বুঝলি প্যালা, এইভাবে একটা মহাপ্রাণ কাক মোদা মাসির সেই মারাত্মক তিলের নাড় চিরকালের মতো বন্ধ করে দিলে। তাই তো তোকে বলছিলুম, কাককে কক্ষনো অছেদ্দা করতে নেই।

টেনিদার এই বাজে-মাকা গল্প শুনে আমি বললুম, বোগাস! সব বানিয়ে বলছ।

তাতে দারুণ চটে গেল টেনিদা। আমাকে বিচ্ছিরিভাবে দাঁত খিঁচিয়ে বললে, বোগাস? তুই এসব কী বুঝবি র‍্যা? তোর মগজে গোবর আছে বললে– গোবরেরও প্রেস্টিজ নষ্ট হয়। তেলিনীপাড়ার কাকের গল্প এখনও তো কিছু শুনিসইনি। জানিস, ওই কাকের জন্যেই মেসোমশাই আর তাঁর খুড়তুতো ভাই যদুবাবুর মধ্যে এখন গলায়-গলায় ভাব?

আমার কৌতুহল হল।

আগে বুঝি খুব ঝগড়া ছিল?

ঝগড়া মানে? রামঝগড়া যাকে বলে। সেই কোক্কালে দুজনের ভেতরে কী হয়েছিল কে জানে, সেই থেকে কেউ আর কারও মুখ পর্যন্ত দেখেন না। যদুবাবু খুব রসগোল্লা খেতে ভালোবাসেন বলে মেসোমশাই মিষ্টি খাওয়াই ছেড়ে দিয়েছেন—সকালে বিকেলে স্রেফ দু বাটি করে নিমপাতা বাটা খান। আর মেসোমশাই কোঁচা দুলিয়ে ফিনফিনে ধুতি পরেন বলে যদুবাবু মানে যদু মেসো, মোটা মোটা খাকি হাফ প্যান্ট পরে ঘুরে বেড়ান।

আমি বললুম, ব্যাপার তো খুব সাংঘাতিক।

সাংঘাতিক বলে সাংঘাতিক! একেবারে পরিস্থিতি বলতে পারিস। শেষ পর্যন্ত এমন একটা কাণ্ড ঘটে গেল যে দুজনে লাঠালাঠি হওয়ার জো।

হয়েছিল কি, মেসোমশাই আর যদু মেশোর দুই বাড়ির সীমানার ঠিক মাঝবরাবর একটা কয়েতবেলের গাছ। এদিকে বেল পড়লে এরা কুড়োয়, ওদিকে পড়লে ওরা। একদিন সেই গাছে কোত্থেকে একটা চাঁদিয়াল ঘুড়ি এসে লটকে গেল।

যদু মেসোর ছেলে পল্টন তো তক্ষুনি কাঠবেড়ালীর মতো গাছে উঠে পড়েছে। আর গাছে কাকের বাসানতুন বাচ্চা হয়েছে তাদের, পল্টনকে দেখেই তারা খা-খা করে তেড়ে এল। পল্টন হাঁ-হাঁ করে ওঠবার আগেই তাকে গোটা দশেক রাম ঠোক্কর।

চাঁদিয়াল ঘুড়ি মাথায় উঠল, বাবা রে মা-রে বলতে বলতে পল্টন গাছ থেকে কাটাকুমড়োর মতো ধপাৎ! ভাগ্যিস গাছের নীচে যদুমেসোর একটা খড়ের গাদা ছিল—তাতে পড়ে বেঁচে গেল পল্টননইলে হাত-পা আর আস্ত থাকত না।

মনে রাগ থাকলে—জানিসই তো, বাতাসের গলায় দড়ি দিয়েও ঝগড়া পাকানো যায়। পল্টন ভ্য-ভা করে কাঁদতে কাঁদতে ছুটল বাড়ির দিকে আর লাফাতে লাফাতে বেরিয়ে এলেন যদু মেসো। রাগ হলে তাঁর মুখ দিয়ে হিন্দী বেরোয়, চিৎকার করে তিনি বলতে লাগলেন : এই, তুমারা কাগ কাহে হামারা ছেলেকে ঠোকরায় দিয়া?

মেসোমশাই-ই বা ছাড়বেন কেন? তিনিও চেঁচিয়ে বলতে লাগলেন, ও কাগ হামারা নেহি, তুমারা হ্যায়। তুমি উসকো পুষা হ্যায়।

তুমি পুষা হ্যায়।

তোম্ পুষা যায়।

শেষে দুজনেই তাল ঠুকে বললেন, আচ্ছা-আচ্ছা, দেখ লেঙ্গা।

ওরা আর কী দেখবেন, মজা দেখতে লাগল কাকেরাই। মানে নতুন বাচ্চা হয়েছে, তাদের দুটো ভালোমন্দ খাওয়াতে কোন্ বাপ-মার ইচ্ছে হয় না তাই বল? তার ওপর কাগের ছা রাত্তির-দিন হাঁ করেই রয়েছে, তাদের রাক্ষুসে পেট ভরানোই কি চারটিখানি কথা? কাজেই পোকামাকড়ে আর শানায় না বাধ্য হয়েই কী বলে না বলিয়া পরের দ্রব্য গ্রহণ করতে হয় তাদের। ধর—সারা সকাল খেটেখুটে মোক্ষদা মাসি এক থালা বড়ি দিয়েছেন, কাকেরা এসে পাঁচ মিনিটে তার থ্রি-ফোর্থ ভ্যানিশ করে দিলে। ওদিকে আবার যদু মেসোর মেয়ে—মানে আমার বঁচিদি মাছ কুটে পুকুরে ধুতে যাচ্ছে—ঝপাট–ঝপাট-খান দুই মাছ তুলে নিয়ে চম্পট!

কাজেই ঝগড়াটা বেশ পাকিয়ে উঠল। কাক নিশ্চিন্ত কাজ গুছিয়ে যাচ্ছে আর দুই মেসো সমানে এ ওকে শাসাছেন : দেখ লেঙ্গা-দেখ লেঙ্গা!

শেষে আমার রিয়্যাল মেসোমশাই ভাবলেন, একবার সরেজমিনে তদন্ত করা যাক। মানে, কয়েতবেল গাছে যে-ডালে কাকের বাসা সেটা তাঁর দিকে না যদু মেশোর দিকে। গুটি গুটি গিয়ে যেই গাছতলায় দাঁড়িয়েছেন, ব্যস!

অমনি খা-খা করে আওয়াজ, আর টকাস টকাস! মেসোমশাইয়ের মাথায় টাক আছে। আগেই বলেছি, সেখানে কয়েকটা ঠোকর পড়তেই ঊর্ধ্বশ্বাসে ছুটে পালালেন তিনি। আর চিৎকার করে বলতে লাগলেন : কিকো কাক, এখন আমি বুঝতে পারা হ্যায়।

ওদিকে যদু মেসোও ভেবেছেন, কাকের বাসাটা কার দিকে পড়েছে দেখে আসি। যদু মেসো রোগা আর চটপটে, তায় হাফপ্যান্ট পরেন, তিনি সোজা গাছে উঠতে লেগে গেলেন। যেই একটুখানি উঠেছেন—অমনি কাকদের আক্রমণ! মেরে ফেললে–মেরে ফেললে–বলে যদু মেসোও খড়ের গাদায় পড়ে গেলেন, আর চেঁচিয়ে উঠলেন : কিকা কাক, এখুনি প্রমাণ হো গিয়া।

মেসোমশাই সোজা গিয়ে থানায় হাজির। দারোগাকে বললেন, যদু চাটুজ্যের পেট ক্রো আমার ফ্যামিলিকে ঠোকরাচ্ছে, আমার সম্পত্তি নষ্ট করে ফেলছে। আপনি এর বিহিত করুন।

—পেট ক্রো। কিছু বুঝতে না পেরে দারোগা একটা বিষম খেলেন।

—আজ্ঞে হ্যাঁ, পোষা কাক। যদু চাটুজ্জের পোষা কাক।

দারোগা বললেন, ইমপসিবল! কাক কখনও পোষ মানে? কাক কারও পোষা হতে পারে?

মেসোমশাই বললেন, পারে স্যার। আপনি ওই ধড়িবাজ যদু চাটুজ্যেকে জানেন না। ওর অসাধ্য কাজ নেই।

দারোগা তখন কান পেতে সব শুনলেন। তারপর মুচকে হেসে বললেন, আচ্ছা, আপনি এখন বাড়ি যান। আমি বিকেলে আপনার ওখানে যাব তদন্ত করতে।

মেসোমশাই বেরিয়ে যেতে না যেতেই যদু মেসে গিয়ে দারোগার কাছে হাজির।

স্যার, মধু চাটুজ্যে কয়েতবেল গাছে কাক পুষেছে আমার সঙ্গে শত্রুতা করবার জন্যে। সেই কাকের উপদ্রবে আমি ধনে-প্রাণে মারা গেলুম।

দারোগা ভুরু কুঁচকে বললেন, পেট ক্রো?

নির্ঘাত।

দারোগা যদু মেসোর কথাও সব শুনলেন। তারপর বললেন, ঠিক আছে। আমি বিকেলে যাব আপনার ওখানে তদন্ত করতে।

বাড়ি ফিরে দুই মেসোই সমানে এ-ওকে শাসাতে লাগলেন : আজ বিকালে পুলিশ আয়েগা, তখন বোঝা যাবে কৌন কাক পুষা হ্যায়।

দাবোগা এসে প্রথমেই মেসোমশাই—অর্থাৎ মধু চাটুজ্যের বাড়িতে ঢুকলেন। মেসোমশাই তাঁকে আদর করে বলেন, খুব করে চা আর ওমলেট খাওয়ালেন, কাকের বিশদ বিবরণ দিলেন। তারপর বললেন, ও সব যদু চাটুজ্যের শয়তানি। দেখুন না, দুপুরবেলা ছাতে আমার গিন্নি শুকনো লঙ্কা রোদে দিয়েছিলেন, তার অদ্ধেক ওর কাকে নিয়ে গেছে।

দারোগা বললেন, চলুন, ছাতে যাই।

কিন্তু ছাতে যেতেই দেখা গেল, তার এক কোণে ছোট একটা রুপোর ঝিনুক চিকচিক করছে।

দারোগা সেটা কুড়িয়ে নিয়ে বললেন, এ ঝিনুক কার? আপনার বাড়িতে তো কোনও বাচ্চা ছেলেপুলে নেই।

মোক্ষদা মাসি ঝাঁ করে বলে ফেললেন, ওটা ঠাকুরপোর ছোট ছেলে লোটনের, মুখপোড়া কাগে নিয়ে এসেছে।

শুনেই, দারোগা তেলে-বেগুনে জ্বলে উঠলেন। বটে! ওবাড়ি থেকে রূপোর ঝিনুক এনে আপনার ছাতে ফেলেছে। তবে তো এ কাক আপনার। দাঁড়ান—দেখাচ্ছি আপনাকে।

মেসোমশাই হাউমাউ করে উঠলেন, কিন্তু দারোগা কোনও কথা শুনলেন না। তক্ষুনি হনহনিয়ে চলে গেলেন যদু মেসোর বাড়িতে।

ওবাড়ির মাসি পুলিপিঠে তৈরি করে রেখেছিলেন, আদর করে দারোগাকে খেতে দিলেন। আর সেই ফাঁকে যদু মেসো সবিস্তারে বলে যেতে লাগলেন, মধু চাটুজ্যের কাকের জ্বালায় তিনি আর তিষ্ঠোতে পারছেন না।

তক্ষুনি—ঠন–ঠনাৎ! দারোগার সামনেই যেন আকাশ থেকে একটা চামচে এসে পড়ল।

দারোগা বললেন, এ কার চামচে?

যদু মেসো বলতে যাচ্ছিলেন, আমারই স্যার—কিন্তু পেল্লায় এক ধমকে দারোগা থামিয়ে দিলেন তাঁকে। বললেন, শাট আপ—আমার সঙ্গে চালাকি? ওই চামচে দিয়ে আমি মধুবাবুর ওখানে ওমলেট খেয়ে এলুম—এখনও লেগে রয়েছে। তা হলে কাক তো আপনারই—আপনিই তো তাকে চুরি করতে পাঠান। দাঁড়ান—দেখাচ্ছি–

যদু মেশোর দাঁতকপাটি লাগার উপক্রম! দারোগা হনহনিয়ে চলে গেলেন। তারপর পুলিশ পাঠিয়ে দুই মেসোকে থানায় নিয়ে গেলেন। বলির পাঁঠার মতো দাঁড়িয়ে রইলেন দুজন।

দারোগা চোখ পাকিয়ে বললেন, এ ওর নামে নালিশ করবেন আর?

দুই ভাই একসঙ্গে বললেন, না–না।

কোনওদিন আর ঝগড়া-ঝাঁটি করবেন?

না স্যার, কক্ষনো না।

তা হলে বলুন, ভাই-ভাই এক ঠাঁই।

ওঁরা বললেন, ভাই-ভাই এক ঠাঁই।

এ ওকে আলিঙ্গন করুন।

দুজনে পরস্পরকে জাপটে ধরলেন—প্রাণের দায়েই ধরলেন। আর মোটা মেসোমশাইয়ের চাপে রোগা যদু মেশোর চোখ কপালে উঠে গেল।

তারপর? তারপর থেকে দুভাই প্রাণের প্রাণ। কী যে ভালোবাসা—সে আর তোকে কী বলব প্যালা! তাই বলছিলুম, কাক অতি মহৎ-হৃদয় প্রাণী, পৃথিবীর অনেক ভালো সে করে থাকে—তাকে ছুঁচো-টুচো বলতে নেই!

গল্প শেষ করে টেনিদা আমাকে দিয়ে দু আনার আলুর চপ আনাল। একটু ভেঙে যেই মুখে দিয়েছে, অমনি–

অমনি ঝপাট!

কাক এসে ঠোঙা থেকে একখানা আলুর চপ তুলে নিয়ে চম্পট।

অতি মহৎ-হৃদয় প্রাণীসন্দেহ কী!

 কুট্টিমামার দন্ত-কাহিনী

আমি সগর্বে ঘোষণা করলাম, জানিস, আমার ছোট কাকা দাঁত বাঁধিয়েছে।

ক্যাবলা একটা গুলতি নিয়ে অনেকক্ষণ ধরে একটা নেড়ী কুকুরের ল্যাজকে তাক করছিল। কুকুরটা বেশ বসে ছিল, হঠাৎ কী মনে করে ঘোঁক শব্দে পিঠের একটা এঁটুলিকে কামড়ে দিলে তারপর পাঁই-পাঁই করে ছুট লাগাল। ক্যাবলা ব্যাজার হয়ে বললে, দ্যুৎ। কতক্ষণ ধরে টার্গেট করছি ব্যাটা পালিয়ে গেল। আমার দিকে ফিরে বললে, তোর ছোট কাকা দাঁত বাঁধিয়েছে–এ আর বেশি কথা কী। আমার বড় কাকা, মেজ কাকা, রাঙা কাকা সবাই দাঁত বাঁধিয়েছে। আচ্ছা, কাকারা সকলে দাঁত বাঁধায় কেন বল তো? এর মানে কী?

হাবুল সেন বললে, হঃ! এইটা বোঝেস নাই। কাকাগো কামই হইল দাঁত খিচানি। অত দাঁত খিচালে দাঁত খারাপ হইব না তো কী?

টেনিদা বসে বসে এক মনে একটা দেশলাইয়ের কাঠি চিবুচ্ছিল। টেনিদার ওই একটা অভ্যেস কিছুতেই মুখ বন্ধ রাখতে পারে না। একটা কিছু-না-কিছু তার চিবোনো চাই-ই চাই। রসগোল্লা, কাটলেট, ডালমুট, পকৌড়ি, কাজু বাদাম–কোনওটায় অরুচি নেই। যখন কিছু জোটে না, তখন চুয়িংগাম থেকে শুকনো কাঠি–যা পায় তাই চিবোয়। একবার ট্রেনে যেতে যেতে মনের ভুলে পাশের ভদ্রলোকের লম্বা দাড়ির ডগাটা খানিক চিবিয়ে দিয়েছিল–সে একটা যাচ্ছেতাই কাণ্ড! ভদ্রলোক রেগে গিয়ে টেনিদাকে ছাগল-টাগল কী সব যেন বলেছিলেন।

হঠাৎ কাঠি চিবুনো বন্ধ করে টেনিদা বললে, দাঁতের কথা কী হচ্ছিল র‍্যা? কী বলছিলি দাঁত নিয়ে?

আমি বললাম, আমার ছোট কাকা দাঁত বাঁধিয়েছে।

ক্যাবলা বললে, ইস–ভারি একটা খবর শোনাচ্ছেন ঢাকঢোল বাজিয়ে! আমার বড় কাকা, মেজ কাকা, ফুলু মাসি

টেনিদা বাধা দিয়ে বললে, থাম থাম্ বেশি ফ্যাচফ্যাচ করিসনি। দাঁত বাঁধানোর কী জানিস তোরা? হুঁ! জানে বটে আমার কুট্টিমামা গজগোবিন্দ হালদার। সায়েবরা তাকে আদর করে ডাকে মিস্টার গাঁজা-গাবিন্ডে। সে-ও দাঁত বাঁধিয়েছিল। কিন্তু সে-দাঁত এখন আর তার মুখে নেই–আছে ডুয়ার্সের জঙ্গলে!

–পড়ে গেছে বুঝি?

পড়েই গেছে বটে!–টেনিদা তার খাঁড়ার মতো নাকটাকে খাড়া করে একটা উঁচুদরের হাসি হাসল–যাকে বাংলায় বলে হাই ক্লাস! তারপর বললে, সে-দাঁত কেড়ে নিয়ে গেছে।

দাঁত কেড়ে নিয়েছে? সে আবার কী? আমি আশ্চর্য হয়ে বললাম, এত জিনিস থাকতে দাঁত কাড়তে যাবে কেন?

–কেন? টেনিদা আবার হাসল : দরকার থাকলেই কাড়ে। কে নিয়েছে বল দেখি? ক্যাবলা অনেক ভেবে-চিন্তে বললে, যার দাঁত নেই।

ইঃ, কী পণ্ডিত! টেনিদা ভেংচি কেটে বললে, দিলে বলে! অত সোজা নয়, বুঝলি? আমার কুট্টিমামার দাঁত যে-সে নয়–সে এক একটা মুলোর মতো। সেবাঘা দাঁতকে বাগানো যার-তার কাজ নয়।

–তবে বাগাইল কেডা? বাঘে? হাবুলের জিজ্ঞাসা।

–এঃ, বাঘে! বলছি দাঁড়া। ক্যাবলা, তার আগে দু আনার ডালমুট নিয়ে আয়

হাঁড়ির মতো মুখ করে ক্যাবলা ডালমুট আনতে গেল। মানে, যেতেই হল তাকে।

আমাদের জুলজুলে চোখের সামনে একাই ডালমুটের ঠোঙা সাবাড় করে টেনিদা বললে, আমার কুট্টিমামার কথা মনে আছে তো? সেই যে চা বাগানে চাকরি করে আর একাই দশজনের মতো খেয়ে সাবাড় করে? আরে, সেই লোকটা–যে ভালুকের নাক পুড়িয়ে দিয়েছিল?

আমরা সমস্বরে বললাম, বিলক্ষণ! কুট্টিমামার হাতের কাজ কি এত সহজেই ভোলবার?

টেনিদা বললে, সেই কুট্টিমামারই গল্প। জানিস তো–সায়েবরা ডেকে নিয়ে মামাকে চা বাগানে চাকরি দিয়েছিল? মামা খাসা আছে সেখানে। খায়-দায় কাঁসি বাজায়। কিন্তু বেশি সুখ কি আর কপালে সয় রে? একদিন জুত করে একটা বন-মুরগির রোস্টে যেই কামড় বসিয়েছে–অমনি ঝনঝনাৎ! কুট্টিমামার একটা দাঁত পড়ল প্লেটের ওপর খসে আর তিনটে গেল নড়ে।

হয়েছিল কী, জানিস? শিকার করে আনা হয়েছিল তো বন-মুরগি? মাংসের মধ্যে ছিল গোটাচারেক ছররা। বেকায়দায় কামড় পড়তেই অ্যাকসিডেন্ট, দাঁতের বারোটা বেজে গেল।

মাংস রইল মাথায় ঝাড়া তিন ঘন্টা নাচানাচি করলে কুট্টিমামা। কখনও কেঁদে বললে, পিসিমা গো তুমি কোথায় গেলে? কখনও ককিয়ে ককিয়ে বললে, ই-হি-হি-আমি গেলুম। আবার কখনও দাপিয়ে দাপিয়ে বললে, ওরে বনমুরগি রে–তোর মনে এই ছিল রে। শেষকালে তুই আমায় এমন করে পথে বসিয়ে গেলি রে!

পাকা তিন দিন কুট্টিমামা কিচ্ছুটি চিবুতে পারল না। শুধু রোজ সের-পাঁচেক করে খাঁটি দুধ আর ডজন-চারেক কমলালেবুর রস খেয়ে কোনওমতে পিত্তি রক্ষা করতে লাগল।

দাঁতের ব্যথা-ট্যথা একটু কমলে সায়েবরা কুট্টিমামাকে বললে, তোমাকে ডেনটিস্টের ওখানে যেতে হবে।

–অ্যা।

সায়েবরা বললে, দাঁত বাঁধিয়ে আসতে হবে।

ডেনটিস্টের নাম শুনেই তো কুট্টিমামার চোখ তালগাছে চড়ে গেল। কুট্টিমামার দাদু নাকি একবার দাঁত তুলতে গিয়েছিলেন। যে-ডাক্তার দাঁত তুলেছিলেন, তিনি চোখে কম দেখতেন। ডাক্তার করলেন কী–দাঁত ভেবে কুট্টিমামার দাদুর নাকে সাঁড়াশি আটকে দিয়ে সেটাকেই টানতে লাগলেন। আর বলতে লাগলেন : ইসকী প্রকাণ্ড গজদন্ত আর কী ভীষণ শক্ত! কিছুতেই নাড়াতে পারছি না।

কুট্টিমামার দাদু তো হাঁই-মাই করে বলতে লাগলেন, ওঁটা–ওঁটা আমার আঁক! আঁকা-টানের চোটে নাক বেরুচ্ছিল না–আঁক।

ডাক্তার রেগে বললেন, আর হাঁক-ডাক করতে হবে না–খুব হয়েছে। আরও গোটাকয়েক টানফান দিয়ে নাকটাকে যখন কিছুতেই কায়দা করতে পারলেন না–তখন বিরক্ত হয়ে বললেন : নাঃ, হল না। এমন বিচ্ছিরি শক্ত দাঁত আমি কখনও দেখিনি! এরকম দাঁত কোনও ভদ্রলোক তুলতে পারে না।

কুট্টিমামার দাদু বাড়ি ফিরে এসে বারো দিন নাকের ব্যথায় বিছানায় শুয়ে রইলেন। তেরো দিনের দিন উকিল ডাকিয়ে উইল করলেন : আমার পুত্র বা উত্তরাধিকারীদের মধ্যে যে-কেহ দাঁত বাঁধাইতে যাইবে, তাহাকে আমার সমস্ত সম্পত্তি হইতে চিরতরে বঞ্চিত করিব।

অবশ্যি কুট্টিমামার দাদুর সম্পত্তিতে কুট্টিমামার কোনও রাইট নেই–তবু দাদুর আদেশ তো! কুট্টিমামা গাঁইগুই করতে লাগলেন। ভাঙা ভাঙা ইংরেজীতে মাই নোজ-টোজও বলবার চেষ্টা করলেন। কিন্তু সায়েবের গোঁজানিস তো? ঝড়াং করে বলে দিলে, নো ফোকলা দাঁত উইল ডু! দাঁত বাঁধাতেই হবে।

কুট্টিমামা তো মনে মনে তনয়ে তারো তারিণী বলে রামপ্রসাদী গান গাইতে গাইতে, বলির পাঁঠার মতো কাঁপতে কাঁপতে গিয়ে ডেনটিস্টের কাছে হাজির। ডেনটিস্ট প্রথমেই তাঁকে একটা চেয়ারে বসালে। তারপর দাঁতের ওপরে খুর খুর করে একটা ইলেকট্রিক বুরুশ বসিয়ে সেগুলোকে অর্ধেক ক্ষয় করে দিলে। একটা ছোট হাতুড়ি দিয়ে ঠুকে ঠুকে বাকি সবকটা দাঁতকে নড়িয়ে ফেললে। শেষে বেজায় খুশি হয়ে বললে, এর দু-পাটি দাঁতই খারাপ। সব তুলে ফেলতে হবে।

শুনেই কুট্টিমামা প্রায় অজ্ঞান। গোটা-তিনেক খাবি খেয়ে বললেন, নাকটাও?

ডাক্তার ধমক দিয়ে বললেন, চোপরাও!

তারপর আর কী? একটা পেল্লায় সাঁড়াশি নিয়ে ডাক্তার কুরুৎ-কুরুৎ করে কুট্টিমামার সবকটা দাঁত তুলে দিলে। কুট্টিমামা আয়নায় নিজের মূর্তি দেখে কেঁদে ফেললেন। কিচ্ছুটি নেই মুখের ভেতর–একদম গাঁয়ের পেছল রাস্তার মতো মাঝে মাঝে গর্ত। ওঁকে ঠিক বাড়ির বুড়ি ধাই রামধনিয়ার মতো দেখাচ্ছিল।

কুট্টিমামা কেঁদে ফ্যাক ফ্যাক করে বললেন, ওগো আমার কী হল গো—

ডাক্তার আবার ধমক দিয়ে বললে, চোপরাও! সাত দিন পরে এসো বাঁধানো দাঁত পাবে।

বাঁধানো দাঁত নিয়ে কুট্টিমামা ফিরলেন। দেখতে শুনতে দাঁতগুলো নেহাত খারাপ নয়। খাওয়াও যায় একরকম। খালি একটা অসুবিধে হত। খাওয়ার অর্ধেক জিনিস জমে থাকত দাঁতের গোড়ায়। পরে আবার সেগুলোকে জাবর কাটতে হত।

তবু ওই দাঁত নিয়েই দুঃখে সুখে কুট্টিমামার দিন কাটছিল। কিন্তু সায়েবদের কাণ্ড জানিস তো? ওদের সুখে থাকতে ভূতে কিলোয় কিছুতেই তিনটে দিন বসে থাকতে পারে না। একদিন বললে, মিস্টার গাঁজা-গাবিণ্ডে, আমরা বাঘ শিকার করতে যাব। তোমাকেও যেতে হবে আমাদের সঙ্গে।

বাঘ-টাঘের ব্যাপার কুট্টিমামার তেমন পছন্দ হয় না। কারণ বাঘ হরিণ নয়–তাকে খাওয়া যায় না, বরং সে উলটে খেতে আসে। কুট্টিমামা খেতে ভালোবাসে, কিন্তু কুট্টিমামাকেই কেউ খেতে ভালোবাসে–একথা ভাবলে তাঁর মন ব্যাজার হয়ে যায়। বাঘগুলো যেন কী! গায়ে যেমন বিটকেল গন্ধ, স্বভাব-চরিত্তিরও তেমনি যাচ্ছেতাই।

কুট্টিমামা কান চুলকে বললে, বাঘ স্যার-ভেরি ব্যাড স্যা–আই নট লাইক স্যার

কিন্তু সায়েবরা সেকথা শুনলে তো! গোঁ যখন ধরেছে তখন গেলই। আর কুট্টিমামাকে চ্যাংদোলা করে নিয়ে চলে গেল।

গিয়ে ডুয়ার্সের জঙ্গলে এক ফরেস্ট বাংলোয় উঠল।

চারদিকে ধুন্ধুমার বন। দেখলেই পিত্তি ঠাণ্ডা হয়ে আসে। রাত্তিরে হাতির ডাক শোনা যায়বাঘ হুম হাম করতে থাকে। গাছের ওপর থেকে টুপ টুপ করে জোঁক পড়ে গায়ে। বানর এসে খামস ভেংচি কাটে। সকালে কুট্টিমামা দাড়ি কামাচ্ছিলেন। একটা বানর এসে ইলিক চিলিক এইসব বলে তাঁর বুরুশটা নিয়ে গেল। আর সে কী মশা। দিন নেই-রাত্তির নেই–সমানে কামড়াচ্ছে। কামড়ানোও যাকে বলে! দু-তিন ঘন্টার মধ্যেই হাতে পায়ে মুখে যেন চাষ করে ফেললে।

তার মধ্যে আবার সায়েবগুলো মোটর গাড়ি নিয়ে জঙ্গলের ভেতর ঢুকল বাঘ মারতে।

মিস্টার গাঁজা-গাবিন্ডে, তুমিও চলো।

কুট্টিমামা তক্ষুনি বিছানায় শুয়ে হাত পা ছুঁড়তে আরম্ভ করে দিলে। চোখ দুটোকে আলুর মতো বড় বড় করে, মুখে গাজলা তুলে বলতে লাগল : বেলি পেইন স্যার-পেটে ব্যথা স্যার–অবস্থা সিরিয়াস স্যার

দেখে সায়েবরা ঘোঁয়া-ঘোঁয়া–ঘ্যাঁয়োৎ-ঘ্যাঁয়োৎ করে বেশ খানিকটা হাসল।-ইউ গাঁজা-গাবিন্ডে, ভেরি নটি বলে একজন কুট্টিমামার পেটে একটা চিমটি কাটলে–তারপর বন্দুক কাঁধে ফেলে শিকারে চলে গেল।

আর যেই সায়েবরা চলে যাওয়া অমনি তড়াক করে উঠে বসলেন কুট্টিমামা। তক্ষুনি এক ডজন কলা, দুটো পাঁউরুটি আর এক শিশি পেয়ারার জেলি খেয়ে, শরীরটরির ভালো করে ফেললেন।

বাংলোর পাশেই একটা ছোট পাহাড়ি ঝরনা। সেখানে একটা শিমুল গাছ। কুট্টিমামা একখানা পেল্লায় কালীসিঙ্গির মহাভারত নিয়ে সেখানে এসে বসলেন।

চারদিকে পাখি-টাখি ডাকছিল। পেটটা ভরা ছিল, মিঠে মিঠে হাওয়া দিচ্ছিল–কুট্টিমামা খুশি হয়ে মহাভারতের সেই জায়গাটা পড়তে আরম্ভ করলেন–যেখানে ভীম বরাক্ষসের খাবার-দাবারগুলো সব খেয়ে নিচ্ছে।

পড়তে পড়তে ভাবের আবেগে কুট্টিমামার চোখে জল এসেছে, এমন সময় গ–গ

কুট্টিমামা চোখ তুলে তাকাতেই :

কী সর্বনাশ! ঝরনার ওপারে বাঘ!

কী রূপ বাহার! দেখলেই পিলে-টিলে উলটে যায়। হাঁড়ির মতো প্রকাণ্ড মাথা, আগুনের ভাঁটার মতো চোখ, হলদের ওপরে কালো কালো ডোরা, অজগরের মতো বিশাল ল্যাজ। মস্ত হাঁ করে, মুলোর মতো দাঁত বের করে আবার বললে, গর—র–র ৷

একেই বলে বরাত! যেবাঘের ভয়ে কুট্টিমামা শিকারে গেল না, সে বাঘ নিজে থেকেই দোরগোড়ায় হাজির। আর কেউ হলে তক্ষুনি অজ্ঞান হয়ে যেত, আর বাঘ তাকে সারিডন ট্যাবলেটের মতো টপাং করে গিলে ফেলত। কিন্তু আমারই মামা তো–ভাঙে তবু মচকায় না। তক্ষুনি মহাভারত বগলদাবা করে এক লাফে একেবারে শিমুল গাছের মগডালে।

বাঘ এসে গাছের নীচে থাবা পেতে বসল। দু-চারবার থাবা দিয়ে গাছের গুঁড়ি আঁচড়ায়, আর ওপর দিকে তাকিয়ে ডাকে : ঘঁর-র ঘুঁ–ঘু। বোধহয় বলতে চায় তুমি তো দেখছি পয়লা নম্বরের ঘুঘু!

কিন্তু বাঘটা তখনও ঘুঘুই দেখেছে-ফাঁদ দেখেনি। দেখল একটু পরেই। কিছুক্ষণ পরে বাঘটা রেগে যেই ঝাঁক করে একটা হাঁক দিয়েছে–অমনি দারুণ চমকে উঠেছে কুট্টিমামা, আর বগল থেকে কালীসিঙ্গির সেই জগঝম্প মহাভারত ধপাস করে নীচে পড়েছে। আর পড়বি তো পড় সোজা বাঘের মুখে। সেই মহাভারতের ওজন কমসে কম পাকা বারো সের–তার ঘায়ে মানুষ খুন হয় বাঘও তার ঘা খেয়ে উলটে পড়ে গেল। তারপর গোঁ-গোঁ-ঘেয়াং ঘেয়াং বলে বারকয়েক ডেকেই–এক লাফে ঝরনা পার হয়ে জঙ্গলের মধ্যে হাওয়া!

কুট্টিমামা আরও আধ ঘন্টা গাছের ডালের বসে ঠকঠক করে কাঁপল। তারপর নীচে নেমে দেখল মহাভারত ঠিক তেমনি পড়ে আছে তার গায়ে আঁচড়টিও লাগেনি। আর তার চারপাশে ছড়ানো আছে কেবল দাঁত বাঘের দাঁত। একেবারে গোনা-গুনতি বত্রিশটা দাঁত-মহাভারতের ঘায়ে একটি দাঁতও আর বাঘের থাকেনি। দাঁতগুলো কুড়িয়ে নিয়ে, মহাভারতকে মাথায় ঠেকিয়ে, কুট্টিমামা এক দৌড়ে বাংলোতে। তারপর সায়েবরা ফিরে আসতেই কুট্টিমামা সেগুলো তাদের দেখিয়ে বললে, টাইগার টুথ।

ব্যাপার দেখে সায়েবরা তো থ!

তাই তো–বাঘের দাঁতই বটে? পেলে কোথায়?

কুট্টিমামা ডাঁট দেখিয়ে বুক চিতিয়ে বললে, আই গো টু ঝরনা। টাইগার কাম। আই ডু বকসিং–মানে ঘুষি মারলাম। অল টুথ ব্রেক। টাইগার কাট ডাউন–মানে বাঘ কেটে পড়ল।

সায়েবরা বিশ্বাস করল কি না কে জানে, কিন্তু কুট্টিমামার ভীষণ খাতির বেড়ে গেল। রিয়্যালি গাঁজা-গাবিন্ডে ইজ এ হিরো! দেখতে কাকঁলাসের মতো হলে কী হয় হি ইজ এ গ্রেট হিরো! সেদিন খাওয়ার টেবিলে একখানা আস্ত হরিণের ঠ্যাং মেরে দিলেন কুট্টিমামা।

পরদিন আবার সায়েবরা শিকারে যাওয়ার সময় ওকে ধরে টানাটানিঃ আজ তোমাকে যেতেই হবে আমাদের সঙ্গে। ইউ আর এ বিগ পালোয়ান।

মহা ফ্যাসাদ। শেষকালে কুট্টিমামা অনেক করে বোঝালেন, বাঘের সঙ্গে বকসিং করে ওঁর গায়ে খুব ব্যথা হয়েছে। আজকের দিনটাও থাক।

সায়েবরা শুনে ভেবেচিন্তে বললে, অল রাইট অল রাইট।

আজকে কুট্টিমামা হুঁশিয়ার হয়ে গেছেন বাংলোর বাইরে আর বেরুলেনই না। বাংলোর বারান্দায় একটা ইজি চেয়ারে আবার সেই কালীসিঙ্গির মহাভারত নিয়ে বসলেন।

–ঘেঁয়াও–ঘুঁঙ

কুট্টিমামা আঁতকে উঠলেন। বাংলোর সামনে তারের বেড়া–তার ওপারে সেই বাঘ। কেমন যেন জোড়হাত করে বসেছে। কুট্টিমামার মুখের দিকে তাকিয়ে করুণ স্বরে বললে, ঘেঁয়াং কুঁই!

আর হাঁ করে মুখটা দেখাল!

ঠিক সেই রকম। দাঁতগুলো তোলবার পরে কুট্টিমামার মুখের যে-চেহারা হয়েছিল, অবিকল তা-ই! একেবারে পরিষ্কার–একটা দাঁত নাই! নির্ঘাত রামধনিয়ার মুখ।

বাঘটা হুবহু কান্নার সুরে বললে—ঘ্যাঁ–ঘ্যাঁ–ভ্যাঁও! ভাবটা এই, দাঁতগুলো তো সব গেল দাদা! আমার খাওয়া-দাওয়া সব বন্ধ! এখন কী করি?

কিন্তু তার আগেই এক লাফে কুট্টিমামা ঘরে ঢুকে দরজা বন্ধ করেছেন। বাঘটা আরও কিছুক্ষণ ঘাং-এ্যাং—ভ্যা–ভ্যা করে কেঁদে বনের মধ্যে চলে গেল।

পরদিন সকালে কুট্টিমামা জানালার পাশে দাঁড়িয়ে, বাঁধানো দাঁতের পাটি দুটো খুলে নিয়ে, বেশ করে মাজছিলেন। দিব্যি সকালের রোদ উঠেছে সায়েবগুলো ভোঁস ভোঁস করে ঘুমুচ্ছে তখনও, আর কুট্টিমামা দাঁড়িয়ে দাঁত মাজতে মাজতে ফ্যাকফ্যাক গলায় গান গাইছিলেন :এমন চাঁদের আলো, মরি যদি সে-ও ভালো

সকাল বেলায় চাঁদের আলোয় গান গাইতে গাইতে কুট্টিমামার বোধহয় আর কোনও দিকে খেয়ালই ছিল না। ওদিকে সেই ফোকলা বাঘ এসে জানলার বাইরে বসে রয়েছে ঝোপের ভেতরে। কুট্টিমামার দাঁত খোলা বুরুশ দিয়ে মাজাসব দেখছে এক মনে। মাজা-টাজা শেষ করে যেই কুট্টিমামা দাঁত দুপাটি মুখে পুরতে যাবেন–অমনিঃ ঘোঁয়াৎ ঘালুম।

অর্থাৎ তোফা–এই তো পেলুম।

জানলা দিয়ে এক লাফে বাঘ ঘরের মধ্যে।

টা-টাইগার–পর্যন্ত বলেই কুট্টিমামা ফ্ল্যাট।

বাঘ কিন্তু কিছুই করল না। টপাৎ করে কুট্টিমামার দাঁত দু-পাটি নিজের মুখে পুরে নিল কুট্টিমামা তখনও অজ্ঞান হননি–জ্বলজ্বল করে দেখতে লাগলেন, সেই দাঁত বাঘের মুখে বেশ ফিট করেছে। দাঁত পরে বাঘা আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে বেশ খানিকক্ষণ নিঃশব্দে বাঘা হাসি হাসল, তারপর টপ করে টেবিল থেকে টুথব্রাশ আর টুথপেস্টের টিউব মুখে তুলে নিয়ে জানলা গলিয়ে আবার

কুট্টিমামার ভাষায়–একেবারে উইন্ড! মানে হাওয়া হয়ে গেল।

টেনিদা থামল। আমাদের দিকে তাকিয়ে গর্বিতভাবে বললে, তাই বলছিলুম, দাঁত বাঁধানোর গল্প আমার কাছে করিসনি! হুঃ!

কুট্টিমামার হাতের কাজ

চিড়িয়াখানার কালো ভালুকটার নাকের একদিক থেকে খানিকটা রোঁয়া উঠে গেছে। সেদিকে আঙুল বাড়িয়ে আমাদের পটলডাঙার টেনিদা বললে, বল তো প্যালা–ভালুকটার নাকের ও-দশা কী করে হল?

আমি বললাম, বোধহয় নিজেদের মধ্যে মারামারি করেছে, তাই—

টেনিদা বললে, তোর মুণ্ডু!

–তা হলে বোধহয় চিড়িয়াখানার লোকেরা নাপিত ডেকে কামিয়ে দিয়েছে। মানুষ যদি গোঁফ কামায়, তাহলে ভালুকের আর দোষ কী?

–থাম থাম–বাজে ফ্যাক-ফ্যাক করিসনি। টেনিদা চটে গিয়ে বললে : যদি এখন এখানে কুট্টিমামা থাকত, তাহলে বুঝতিস সব জিনিস নিয়েই ইয়ার্কি চলে না।

–কে কুট্টিমামা?

–কে কুট্টিমামা?

–টেনিদা চোখ দুটোকে পাটনাই পেঁয়াজের মতো বড় বড় করে বললে : তুই গজগোবিন্দ হালদারের নাম শুনিসনি?

–কখনও না–আমি জোরে মাথা নাড়লাম : কোনওদিনই না! গজগোবিন্দ। অমন বিচ্ছিরি নাম শুনতে বয়ে গেছে আমার।

–বটে! খুব তত তড়পাচ্ছিস দেখছি। জানিস আমার কুট্টিমামা আস্ত একটা পাঁঠা খায়! তিন সের রসগোল্লা ঠুকে দেয় তিন মিনিটে?

–তাতে আমার কী? আমি তো তোমার কুট্টিমামাকে কোনওদিন নেমন্তন্ন করতে যাচ্ছি। প্রাণ গেলেও না।

–তা করবি কেন? অমন একটা জাঁদরেল লোকের পায়ের ধুলো পড়বে তোর বাড়িতে–অমন কপাল করেছিস নাকি তুই? পালাজ্বরে ভুগিস আর শিঙিমাছের ঝোল খাস–কুট্টিমামার মর্ম তুই কী বুঝবি র‍্যা? জানিস, কুট্টিমামার জন্যেই ভালুকার ওই অবস্থা।

এবারে চিন্তিত হলাম।

–তা তোমার কুট্টিমামার এসব বদ-খেয়াল হল কেন? কেন ভালুকের নাক কামিয়ে দিতে গেল খামকা তার চাইতে নিজের মুখ কামালেই তো ঢের বেশি কাজ দিত।

–চুপ কর প্যালা, আর বাজে বকালে রদ্দা খাবি–টেনিদা সিংহনাদ করল। আর তাই শুনে ভালুকটা বিচ্ছিরি রকম মুখ করে আমাদের ভেংচে দিলে।

টেনিদা বললে, দেখলি তো? কুট্টিমামার নিন্দে শুনে ভালুকটা পর্যন্ত কেমন চটে গেল।

এবার আমার কৌতূহল ঘন হতে লাগল।

–তা ভালুকটার সঙ্গে তোমার কুট্টিমামার আলাপ হল কী করে?

–আরে সেইটেই তো গল্প। দারুণ ইন্টারেস্টিং! হুঁ হুঁ বাবা, এ-সব গল্প এমনি শোনা যায় কিছু রেস্ত খরচ করতে হয়। গল্প শুনতে চাস–আইসক্রিম খাওয়া।

অগত্যা কিনতেই হল আইসক্রিম।

চিড়িয়াখানার যেদিকটায় অ্যাটলাসের মূর্তিটা রয়েছে, সেদিকে বেশ একটা ফাঁকা জায়গা দেখে আমরা এসে বসলাম। তারপর সারসগুলোর দিকে তাকিয়ে আইসক্রিম খেতে-খেতে শুরু করলাম টেনিদা :

আমার মামার নাম গজগোবিন্দ হালদার। শুনেই তো বুঝতে পারছিস ক্যায়সা লোক একখানা। খুব তাগড়া জোয়ান ভেবেছিস বুঝি? ইয়া ইয়া ছাতি–অ্যায়সা হাতের গুলি? উঁহু, মোটেই নয়। মামা একেবারে প্যাঁকাটির মতো রোগা–দেখলে মনে হয় হাওয়ায় উল্টে পড়ে যাবে। তার ওপর প্রায় ছ’হাত লম্বা মাথায় কোঁকড়া কোঁকড়া চুল দূর থেকে ভুল হয় বুঝি একটা তালগাছ হেঁটে আসছে। আর রং! তিন পোঁচ আলকাতরা মাখলেও অমন খোলতাই হয় না। আর গলার আওয়াজ শুনলে মনে করবি-ডজনখানেক নেংটি ইঁদুর ফাঁদে পড়ে চি-চি করছে সেখানে।

সেবার কুট্টিমামা শিলিগুড়ি স্টেশনের রেলওয়ে রেস্তোরাঁয় বসে বসে দশ প্লেট ফাউল কারি আর সের-তিনেক চালের ভাত খেয়েছে, এমন সময় গোঁ-গোঁ করে একটা গোঙানি। তার পরেই চেয়ার-ফেয়ার উল্টে একটা মেমসাহেব ধপাৎ করে পড়ে গেল কাটা কুমডোর মতো।

হইহই–রইরই। হয়েছে কী জানিস? চা বাগানের এক দঙ্গল সাহেব-মেম রেস্তোরাঁয় বসে খাচ্ছিল তখন। মামার খাওয়ার বহর দেখে তাদের চোখ তো উল্টে গেছে আগেই, তারপর আর দশ প্লেট খাওয়ার পরে মামা যখন আর দুপ্লেটের অর্ডার দিয়েছে, তখন আর সইতে পারেনি।

–ও গড। হেল্প মি, হেল্প মি।বলে তো একটা মেম ঠায়-অজ্ঞান। আর তোকে তো আগেই বলেছি মামার চেহারাখানা–কী বলে–তেমন ইয়ে নয়।

মামার চক্ষুস্থির।

দলে গোটা-চারেক সাহেবকাশীর ষাঁড়ের মতো তারা ঘাড়ে-গদানে ঠাসা। কুট্টিমামা ভাবলে, ওরা সবাই মিলে পিটিয়ে বুঝি পাটকেল বানিয়ে দেবে। মামা জামার ভেতর হাত ঢুকিয়ে পৈতে খুঁজতে লাগল–দুর্গানাম জপ করবে। কিন্তু সে পৈতে কি আর আছে, পিঠ চুলকোতে চুলকোতে কবে তার বারোটা বেজে গেছে।

ঘোঁৎ-ঘোঁৎ করে দুটো সায়েব তখন এগিয়ে আসছে তার দিকে। প্রাণপণে সেঁতো হাসি হেসে মামা বললেন, ইট ইজ নট মাই দোষ স্যর–আই একটু বেশি ইট স্যর।

কুট্টিমামার বিদ্যে ক্লাস ফাঁইভ পর্যন্ত কিনা, তাও তিনবার ফেল। তাই ইংরেজী আর এগুলো না।

তাই শুনে সায়েবগুলো ঘোঁ—ঘোঁ—ঘুঁক–ঘুঁক–হোয়া-হোয়া করে হাসল। আর মেমেরা খি—খি—পিঁ–পিঁ—চিঁ–হিঁ করে হেসে উঠল। ব্যাপার দেখেশুনে তাজ্জব লেগে গেল কুট্টিমামারঅনেকক্ষণ হোয়া-হোয়া করবার পরে একটা সাহেব এসে কুট্টিমামার হাত ধরল। কুট্টিমামা তো ভয়ে কাঠ–এই বুঝি হ্যাঁচকা মেরে চিত করে ফেলে দিলে। কিন্তু মোটেই তা নয়, সাহেব কুট্টিমামার হ্যাঁন্ড শেক করে বললেন, মিস্টার বাঙালী, কী নাম তোমার?

কুট্টিমামার ধড়ে সাহস ফিরে এল। যা থাকে কপালে ভেবে বলে ফেলল নামটা।

–গাঁজা-গাবিন্ডে হাল্ডার? বাঃ, খাসা নাম। মিস্টার গাঁজা-গাবিন্ডে, তুমি চাকরি করবে?

চাকরি! এ যে মেঘ না-চাইতে জল। কুষ্টিমামা তখন টো-টো কোম্পানির ম্যানেজার বাপের, অর্থাৎ কিনা আমাদের দাদুর বিনা-পয়সার হোটেলে রেগুলার খাওয়া-দাওয়া চলেছে। কুট্টিমামা খানিকক্ষণ হাঁ করে রইল।

সায়েবটা তাই দেখে হঠাৎ পকেট থেকে একটা বিস্কুট বের করে কুট্টিমামার হাঁ করা মুখের মধ্যে গুঁজে দিলে। মামা তো কেশে বিষম খেয়ে অস্থির। তাই দেখে আবার শুরু হল ঘোঁ-ঘোঁ–হোঁয়া-হোঁয়া-পিঁ-পিঁ–চি চি–হি-হি। এবারেও মেম পড়ে গেল চেয়ার থেকে।

হাসি-টাসি থামলে সেই সায়েবটা আবার বললেন, হ্যালো মিস্টার বাঙালী, আমরা আফ্রিকায় গেছি, নিউগিনিতে গেছি, পাপুয়াতেও গেছি। গরিলা, ওরাং, শিম্পাঞ্জি সবই দেখেছি। কিন্তু তোমার মতো একটি চিজ কোথাও চোখে পড়েনি। তুমি আমাদের চাবাগানে চাকরি নাও–তা হলে এক্ষুনি তোমায় দেড়শো টাকা মাইনে দেব। খাটনি আর কিছু নয়, শুধু বাগানের কুলিদের একটু দেখবে আর আমাদের মাঝেমাঝে খাওয়া দেখাবে।

এমন চাকরি পেলে কে ছাড়ে? কুট্টিমামা তক্ষুনি এক পায়ে খাড়া। সায়েবরা মামাকে যেখানে নিয়ে গেল, তার নাম জঙ্গলঝোরা টি এস্টেট। মংপু নাম শুনেছিস–মংপু? আরে, সেই যেখানে কুইনিন তৈরি হয় আর রবীন্দ্রনাথ যেখানে গিয়ে কবিতা-টবিতা লিখতেন। জঙ্গলঝোরা টি এস্টেট তারই কাছাকাছি।

মামা তো দিব্যি আছে সেখানে। অসুবিধের মধ্যে মেশবার মতো লোকজন একেবারে নেই, তা ছাড়া চারিদিকেই ঘন পাইনের জঙ্গল। নানারকম জানোয়ার আছে সেখানে। বিশেষ করে ভাল্লুকের আস্তানা।

তা, মামার দিন ভালোই কাটছিল। সস্তা মাখন, দিব্যি দুধ, অঢেল মুরগি। তা ছাড়া সায়েরা মাঝে-মাঝে হরিণ শিকার করে আনত, সেদিন মামার ডাক পড়ত খাওয়ার টেবিলে। একাই হয়তো একটা শম্বরের তিন সের মাংস সাবাড় করে দিত, তাই দেখে টেবিল চাপড়ে উৎসাহ দিত সায়েবরা–হোঁয়া হোঁয়া–হিঁ–হিঁ করে হাসত।

জঙ্গলঝোরা থেকে মাইল-তিনেক হাঁটলে একটা বড় রাস্তা পাওয়া যায়। এই রাস্তা সোজা চলে গেছে দার্জিলিঙেবাসও পাওয়া যায় এখান থেকে। কুট্টিমামাকে বাগানের ফুটফরমাস খাটাবার জন্যে প্রায়ই দার্জিলিঙে যেতে হত।

সেদিন মামা দার্জিলিঙ থেকে বাজার নিয়ে ফিরছিল। কাঁধে একটা বস্তায় সেরতিনেক শুঁটকী মাছ, হাতে একরাশ জিনিসপত্তর। কিন্তু বাস থেকে নেমেই মামার মেজাজ খারাপ হয়ে গেল।

প্রথম কারণ, সন্ধে ঘোর হয়ে এসেছে–সামনে তিন মাইল পাহাড়ি রাস্তা। এই তিন মাইলের দু’মাইল আবার ঘন জঙ্গল। দ্বিতীয় কারণ, হিন্দুস্থানী চাকর রামভরসার বাসস্ট্যান্ডে লণ্ঠন নিয়ে আসার কথা ছিল, সেও আসেনি। মামা একটু ফাঁপরেই পড়ে গেল বইকি।

কিন্তু আমার মামা গজগোবিন্দ হালদার অত সহজেই দমবার পাত্র নয়। শুঁটকী মাছের বস্তা কাঁধে নিয়ে জঙ্গলের পথ দিয়ে মামা হাঁটতে শুরু করে দিলে। মামার আবার আফিং খাওয়ার অভ্যেস ছিল, তারই একটা গুলি মুখে পুরে দিয়ে ঝিমুতে ঝিমুতে পথ চলতে লাগল।

দুধারে পাইনের নিবিড় জঙ্গল আরও কালো হয়ে গেছে অন্ধকারে। রাশি রাশি ফার্নের ভেতরে ভূতের হাজার চোখের মতো জোনাকি জ্বলছে। ঝিঁ ঝিঁ করে ঝিঁঝির ডাক উঠছে। নিজের মনে রামপ্রসাদী সুর গাইতে গাইতে কুট্টিমামা পথ চলছে :

নেচে নেচে আয় মা কালী
আমি যে তোর সঙ্গে যাব–
তুই খাবি মা পাঁঠার মুড়ো
আমি যে তোর প্রসাদ পাব।

জঙ্গলের ভেতর দিয়ে টুকরো-টুকরো জ্যোৎস্না ছড়িয়ে পড়েছিল। হঠাৎ মামার চোখে পড়ল, কালো কম্বল মুড়ি দিয়ে একটা লোক সেই বনের ভেতর বসে কোঁ-কোঁ করছে।

আর কে! ওটা নির্ঘাত রামভরসা।

রামভরসার ম্যালেরিয়া ছিল। যখন-তখন যেখানে-সেখানে জ্বর এসে পড়ল। কিন্তু ওষুধ খেত না–এমনকি এই কুইনিনের দেশে এসেও তার রোগ সারবার ইচ্ছে ছিল না। রামভরসা তার ম্যালেরিয়াকে বড্ড ভালোবাসত। বলত, উ আমার বাপ-দাদার ব্যারাম আছেন। উকে তাড়াইতে হামার মায়া লাগে!

কুট্টিমামার মেজাজ যদিও আফিং-এর নেশায় ঝুঁদ হয়ে ছিল, তবু রামভরসাকে দেখে চিনতে দেরি হল না। রেগে বললে, তোকে না আমি বাসস্ট্যান্ডে যেতে বলেছিলুম? আর তুই এই জঙ্গলের মধ্যে কোঁ-কো করছিস? নে–চল–

গোঁ-গোঁ আওয়াজ করে রামভরসা উঠে দাঁড়াল।

কুট্টিমামা নাক চুলকে বললে, ইঃ, গায়ের কম্বলটা দ্যাখো একবার! কী বদখৎ গন্ধ! কোনওদিন ধুসনি বুঝি? শেষে যে উকুন হবে ওতে! নে–চল ব্যাটা গাড়ল! আর এই শুঁটকী মাছের পুঁটলিটাও নে। তুই থাকতে ওটা আমি বয়ে বেড়াব নাকি?

এই বলে মামা পুঁটলিটা এগিয়ে দিলে রামভরসার দিকে।

–এঃ, হাত তো নয়, যেন নুলো বের করেছে! যাক, ওতেই হবে।

মামা রামভরসার হাতে পুঁটুলিটা গুঁজে দিলে জোর করে।

রামভরসা বললে, গোঁ-গোঁ–ঘোঁক!

–ইস! সায়েবদের সঙ্গে থেকে খুব যে সায়েবি বুলি শিখেছিস দেখছি! চল–এবার বাসামে ফিরে কুইনিন ইনজেকশন দিয়ে তোর ম্যালেরিয়া তাড়াব। দেখব কেমন সায়েব হয়েছিস তুই!

রামভরসা বললে, ঘুঁক-ঘুঁক!

–ঘুঁক–ঘুঁক? বাংলা-হিন্দী বলতে বুঝি আর ইচ্ছে করছে না? চল–পা চালা–কুট্টিমামা আগে-আগে, পিছে পিছে শুঁটকী মাছের পুঁটলি নিয়ে রামভরসা। মামা একবার পেছনে তাকিয়ে দেখলে, কেমন থপাস থপাস হাঁটছে রামভরসা।

–উঃ, খুব যে কায়দা করে হাঁটছিস! যেন বুট পড়ে বড় সায়েব হাঁটছেন।

রামভরসা বললে, ঘঁচাৎ!

–ঘঁচাৎ? চল বাড়িতে, তোর কান যদি কচাৎ করে কেটে না নিয়েছি, তবে আমার নাম গজগোবিন্দ হালদার নয়!

মাইল-খানেক হাঁটবার পর কুট্টিমামার কেমন সন্দেহ হতে লাগল।

পেছনে-পেছনে থপথপ করে রামভরসা ঠিকই আসছে, কিন্তু কেমন কচমচর করে আওয়াজ হচ্ছে যেন! মনে হচ্ছে, কেউ যেন বেশ দরদ দিয়ে তেলেভাজা আর পাঁপর চিবুচ্ছে। রামভরসা শুঁটকী মাছ খাচ্ছে নাকি? তা কী করে সম্ভব? রামভরসা রান্না করা শুঁটকীর গন্ধেই পালিয়ে যায়কাঁচা শুঁটকী সে খাবে কী করে!

মামা একবার পেছনে তাকিয়ে দেখল কিন্তু বিশেষ কিছু বোঝা গেল না। একে তো নেশায় চোখ বুজে এসেছে, তার ওপর এদিকে একেবারে চাঁদের আলো নেই, ঘুরঘুট্টি অন্ধকার। শুধু দেখা গেল, পেছনে-পেছনে সমানে থপথপিয়ে আসছে রামভরসা, ঠিক তেমনি গদাইলস্করি চালে।

পায়ের নীচে পাইনের অজস্র শুকনো কাঁটাওয়ালা পাতা ঝরে রয়েছে। মামা ভাবলে হয়তো তাই থেকেই আওয়াজ উঠেছে এইরকম।

তবু মামা জিজ্ঞেস করল, কী রে রামভরসা, শুঁটকী মাছগুলো ঠিক আছে তো?

রামভরসা জবাব দিলে, ঘু–ঘু।

–ঘু–ঘু? ইস, আজ যে খুব ডাঁটে রয়েছিস দেখছি–যেন আদত বাস্তুঘুঘু।

রামভরসা বললে,–হুঁ–হুঁ।

কুট্টিমামা বললে, সে তত বুঝতেই পারছি। আচ্ছা, চল তো বাড়িতে, তারপর তোরই একদিন কি আমারই একদিন।

আরও খানিকটা হাঁটবার পর মামার বড্ড তামাকের তেষ্টা পেল। সামনে একটা খাড়া চড়াই, তারপর প্রায় আধমাইল নামতে হবে। একটু তামাক না খেয়ে নিলে আর চলছে না।

মামার বাঁ কাঁধে একটা চৌকিদারি গোছের ঝোলা ঝুলত সব সময়ে; তাতে জুতোর কালি, দাঁতের মাজন থেকে শুরু করে টিকে-তামাক পর্যন্ত সব থাকত। মামা জুত করে একখানা পাথরের ওপর বসে পড়ল, তারপর কল্কে ধরাতে লেগে গেল। রামভরসাও একটু দূরে ওত পেতে বসে পড়ল–আর ফোঁসফোঁস করে নিঃশ্বাস ছাড়তে লাগল।

–কী রে, একটান দিবি নাকি?

–হুঁ–হুঁ।

–সে তো জানি, তামাকে আর তোমার অরুচি আছে কবে? আচ্ছা, দাঁড়া আমি একটু খেয়ে নিই, তারপর প্রসাদ দেব তোকে।

চোখ বুজে গোটা কয়েক সুখটান দিয়েছে কুট্টিমামা হঠাৎ আবার সেই কচর-মচর শব্দ। শুঁটকী মাছ চিবোবার আওয়াজ নির্ঘাত।

কুট্টিমামা একেবারে অবাক হয়ে চেয়ে রইল কিছুক্ষণ। তারপর রেগে ফেটে পড়ল :

–তবে রে বেল্লিক, এই তোর ভণ্ডামি?-শুঁটকী মাছ হাম হুঁতা নেই, রাম রাম।–দাঁড়া, দেখাচ্ছি তোকে।

বলেই হুঁকো-টুকো নিয়ে মামা তেড়ে গেল তার দিকে।

তখন হঠাৎ আকাশ থেকে মেঘ সরে গেল, জ্বলজ্বলে একটা চাঁদ দেখা গেল সেখানে। একরাশ ঝকঝকে দাঁত বের করে রামভরসা বললে, ঘোঁক-ঘরর–ঘরর—

আর যাবে কোথায়! হাতের আগুন-সুদ্ধ হুঁকোটা রামভরসার নাকের ওপর ছুঁড়ে দিয়ে ‘বাপ রে–গেছি রে’–বলে কুট্টিমামার চিৎকার। তারপরই ফ্ল্যাট, একদম অজ্ঞান।

রামভরসা নয়, ভালুক। আফিং-এর ঘোরে মামা কিচ্ছুটি বুঝতে পারেনি। ভালুকের জ্বর হয় জানিস তো? তাই দেখে মামা ওকে রামভরসা ভেবেছিল। গায়ের কালো রোঁয়াগুলোকে। ভেবেছিল কম্বল। আর শুঁটকী মাছের পুঁটলিটা পেয়ে ভালুক বোধহয় ভেবেছিল, এ-ও তো মজা মন্দ নয়। সঙ্গে সঙ্গে গেলে আরও বোধহয় পাওয়া যাবে। তাই খেতে-খেতে পেছনে আসছিল। খাওয়া শেষ হলেই মামার ঘাড় মটকাত।

কিন্তু ঘাড়ে পড়বার আগেই নাকে পড়ল টিকের আগুন। ঘোঁৎ-ঘোঁৎ আওয়াজ তুলে ভালুক তিন লাফে পগার পার।

বুঝলি প্যালা–ওইটেই হচ্ছে সেই ভালুক।

.

গল্প শুনে আমি ঘাড় চুলকোতে লাগলুম।

–কিন্তু ওইটেই যে সে-ভালুক-বুঝলে কী করে?

–হুঁ–হুঁ, কুট্টিমামার হাতের কাজ, দেখলে কি ভুল হওয়ার জো আছে? আরে–আরে, ওঁই-তো ডালমুট যাচ্ছে। ডাক–ডাক শিগগির ডাক—

ক্যামোফ্লেজ

চাটুজ্যেদের রোয়াকে গল্পের আড্ডা জমেছিল। আমি, ক্যাবলা, হাবুল সেন, আর সভাপতি আমাদের পটলডাঙার টেনিদা। একটু আগেই ক্যাবলার পকেট হাতড়ে টেনিদা চারগণ্ডা পয়সা রোজগার করে ফেলেছে, তাই দিয়ে আমরা তারিয়ে তারিয়ে কুলপি বরফ খাচ্ছিলাম।

শুধু হাঁড়ির মতো মুখ করে ক্যাবলা বসে আছে। হাতের শালপাতাটার ফাঁক দিয়ে ফোঁটায় ফোঁটায় কুলপির রস গড়িয়ে পড়ছে, ক্যাবলা খাচ্ছে না।

টেনিদা হঠাৎ তার বাঘা গলায় হুঙ্কার ছাড়লে, এই ক্যাবলা, খাচ্ছিস না যে?

ক্যাবলার চোখে তখন জল আসবার জো। সে জবাব দিলে না, শুধু মাথা নাড়ল।

–খাবি না? তবে না খাওয়াই ভালো। কুলপি খেলে ছেলেপুলের পেট খারাপ করে–বলতে না বলতেই থাবা দিয়ে টেনিদা ক্যাবলার হাত থেকে কুলপিটা তুলে নিলে, তারপর চোখের পলক পড়তে না পড়তে সোজা শ্রীমুখের গহ্বরে।

ক্যাবলা বললে, অ্যাঁ-অ্যাঁ-অ্যাঁ–

–অ্যাঁ-অ্যাঁ-অ্যাঁ! এর মানে কী? বলি, মানেটা কী হল এর?–টেনিদা বজ্রগর্ভ স্বরে জিজ্ঞাসা করলে।

ক্যাবলা এবারে কেঁদে ফেলল : আমার চারআনা পয়সা তুমি মেরে দিলে, অথচ আমি খাওয়ার জো। সে জবাবলা, খাচ্ছিস না যে, ভাবছিলাম সিনেমা দেখতে যাব–একটা ভালো যুদ্ধের বই–

–যুদ্ধের বই–টেনিদা দাঁত খিঁচিয়ে উঠল : বলি, যুদ্ধের বইতে কী দেখবার আছে র‍্যা? খালি দুড় দাঁড়ম, খালি ধুমধোক্কা, আর খানিকটা বাহাদুর কা খেল! যুদ্ধের গল্প যদি শুনতে চাস তবে শোন আমার কাছে।

–তুমি যুদ্ধের কী জানো?–আমি ভয়ে ভয়ে প্রশ্ন করলাম।

–কী বললি প্যালা?–টেনিদার হুঙ্কারে আমার পালাজ্বরের পিলে নেচে উঠল : আমি জানিনে? তবে কে জানে শুনি? তুই?

০০না, না, আমি আর জানব কোত্থেকে!–আমি তাড়াতাড়ি বললাম : বাসকপাতার রস খাই আর পালাজ্বরে ভুগি, ওসব যুদ্ধ ফুদ্ধ আমি জানব কেমন করে? তবে বলছিলাম কিনা–টেনিদার চোখের দিকে তাকিয়ে আমি সোজা মুখে ইস্কুপ এঁটে দিলাম।

–কিছুই বলছিলি না। মানে, কখনওই কিছু বলবি না।–টেনিদা চোখ দিয়েই যেন আমাকে একটা পেল্লায় রদ্দা কষিয়ে দিলে : ফের যদি যুদ্ধের ব্যাপার নিয়ে ঘাঁটাঘাঁটি করেছিস তবে ক্রুদ্ধ হয়ে নাকের ডগায় এমন একটি মুগ্ধবোধ বসিয়ে দেব যে, সোজা বুদ্ধদেব হয়ে যাবি–বুঝলি? মানে মিউজিয়ামে নাকভাঙা বুদ্ধদেব দেখেছিস তো, ঠিক সেই রকম।

আতঙ্কে আমি একেবারে ল্যাম্পপোস্ট হয়ে গেলাম।

টেনিদা গলা ঝেড়ে বললে, আমি যখন যুদ্ধে যাই–মানে বার্মা ফ্রন্টে যেবার গেলাম—

খুকখুক করে একটা চাপা আওয়াজ। হাবুল সেন হাসি চাপতে চেষ্টা করছে।

–হাসছিস যে হাবলা?–টেনিদা এবার হাবুলের দিকে মনোনিবেশ করলে।

মুহূর্তে হাবুল ভয়ে পানসে মেরে গেল। তোতলিয়ে বললে, এই ন্‌-ন্‌-না, ম্‌-মানে, ভাবছিলাম তুমি আবার কবে যু-যু-যুদ্ধে গেলে–

টেনিদা দারুণ উত্তেজনায় বোয়াকের সিমেন্টের উপর একটা কিল বসিয়ে দিয়ে উঃ উঃ করে উঠল। তারপর সেটাকে সামলে নিয়ে চিৎকার করে বললে, গুরুজনের মুখে মুখে তঙ্কো! ওই জন্যেই তো দেশ আজও পরাধীন! বলি, আমি যুদ্ধে যাই না-যাই তাতে তোর কী? গল্প চাস তো শোন, নইলে স্রেফ ভাগাড়ে চলে যা। তোদের মতো বিশ্ববকাটদের কিছু বলতে যাওয়াই ঝকমারি।

–না, না, তুমি বলে যাও, আর আমরা তর্ক করব না। হাবুল সভয়ে আত্মসমর্পণ করল।

টেনিদা কুলপির শালপাতাটা শেষ বার খুব দরদ দিয়ে চেটে নিলে, তারপর সেটাকে তালগোল পাকিয়ে ক্যাবলার মুখের ওপর ছুঁড়ে দিয়ে বললে, তবে শোন–

আমি তখন যুদ্ধ করতে করতে আরাকানের এক দুর্গম পাহাড়ি জায়গায় চলে গেছি। জাপানীদের পেলেই এমন করে ঠেঙিয়ে দিচ্ছি যে ব্যাটারা ‘ফুজিয়ামা টুজিয়ামা’ বলে ল্যাজ তুলে পালাতে পথ পাচ্ছে না। তেরো নম্বর ডিভিশনের আমি তখন কম্যানডার–তিন-তিনটে ভিক্টোরিয়া ক্রস পেয়ে গেছি।

ক্যাবলা ফস করে জিজ্ঞেস করলে, সে ভিক্টোরিয়া ক্রসগুলো কোথায়?

–অত খোঁজে তোর দরকার কী? বলি গল্প শুনবি না বাগড়া দিবি বল তো?

–যেতে দাও, যেতে দাও। অমৃতং ক্যাবলা ভাষিতং। তুমি গল্প চালিয়ে যাও টেনিদাহাবুল মন্তব্য করলে।

–যুদ্ধ করতে করতে সেই জায়গায় গিয়ে পৌঁছুলাম–যার নাম তোরা কাগজে খুব দেখেছিস। নামটা ভুলে যাচ্ছি–সেই যে কিসের একটা ডিম–

আমি বললাম, হাঁসের ডিম?

টেনিদা বললে, তোর মাথা।

ক্যাবলা বললে, তবে কি মুরগির ডিম?

টেনিদা বললে, তোর মুণ্ডু।

আমি আবার বললাম, তবে নিশ্চয় ঘোড়ার ডিম। তাও না? কাকের ডিম, বকের ডিম, ব্যাঙের ডিম–

ক্যাবলা বললে, ঠিক, ঠিক, আমার যেন মনে পড়েছে। বোধহয় টিকটিকির ডিম–

–অ্যাই, অ্যাই মনে পড়েছে।–টেনিদা এমনভাবে ক্যাবলার পিঠ চাপড়ে দিলে যে ক্যাবলা আর্তনাদ করে উঠল–ঠিক ধরেছিস, টিড্ডিম।…হ্যাঁ-যা বলছিলাম। টিজ্জিমে তখন পেল্লায় যুদ্ধ হচ্ছে। জাপানী পেলেই পটাপট মেরে দিচ্ছি। চা খেতে খেতে জাপানী মারছি, ঝিমুতে ঝিমুতে জাপানী মারছি, এমন কি যখন ঘুমিয়ে নাক ডাকাচ্ছি তখনও কোনও রকমে দু-চারটে জাপানী মেরে ফেলছি।

–নাক ডাকাতে ডাকাতে জাপানী মারা! সে আবার কী রকম?আমি কৌতূহল দমন করতে পারলাম না।

–হে-হে-হে-টেনিদা একগাল হাসল : সে ভারি ইন্টারেস্টিং! আমার এই কুতুবমিনারের মতো নাকই দেখেছিস, এর ডাক তো কখনও শুনিসনি। একেবারে যাকে বলে রণ-ভম্বর। ওই জন্যেই তো মেজকাকা গেল বছর বিলিতি ইঞ্জিনিয়ার ডেকে আমার ঘরটা সাউন্ডপ্রুফ করিয়ে নিলে, যাতে বাইরে থেকে ওর আওয়াজ কারও কানে না যায়। তা ছাড়া পাড়ার লোকেও কপোরেশনে লেখালেখি করছিল কিনা। একদিন তো পুলিশ এসে বাড়ি তছনছ–রোজ রাত্রে এবাড়িতে মেশিনগানের আওয়াজ পাওয়া যায়, নিশ্চয় এখানে বেআইনি অস্ত্রের কারখানা আছে। সে এক কেলেঙ্কারি কাণ্ড। যাক, সে-গল্প আর-একদিন হবে।

হ্যাঁ–গল্পটা বলি। রোজ রাত্রে ট্রেঞ্চ থেকে আমার নাকের এমনি আওয়াজ বেরুত যে আর সেন্ট্রি দরকার হত না। জাপানীরা ভাবত, সারা রাত বুঝি মেশিনগান চলছে, তাই পাহাড়ের ওপার থেকে তারা আর নাক গলাবার ভরসা পেত না। আমাদের যিনি সুপ্রিম কম্যান্ডার ছিলেন–নাম বোধহয় মিস্টার বোগাস–তাঁর মগজে শেষে একটা চমৎকার বুদ্ধি গজালে। তিনি একটা লোক রাখলেন। সে ব্যাটা সারারাত আমার পাশে বসে থাকত আর আমার নাকে একটার পর একটা সিসের গুলি, পাথরের টুকরো যা পারত বসিয়ে দিত। আধ সেকেন্ডের মধ্যেই দোনলা বন্দুকের দুটো গুলির মতো সেগুলো ছিটকে বেরিয়ে যেত–কত জাপানী যে ওতে ঠাণ্ডা হয়ে গেছে তার হিসেব নেই।

আমি বিড়বিড় করে আওড়ালাম : সব গাঁজা।

টেনিদা বিদ্যুৎবেগে আমার দিকে ফিরল : কী বললি?

না, না, বলছিলাম, এই আর কী–আমি সামলে গেলাম : কী মজা। ‘–হ্যাঁ, সে খুব মজার ব্যাপার। ওই জন্যেই তো একটা ভিক্টোরিয়া ক্রস পাই আমি–টেনিদা তার দুর্দান্ত নাকটাকে গণ্ডারের খাঁড়ার মতো সগৌরবে আকাশের দিকে তুলে ধরল।

–তারপর? এই নাকের জোরেই বুঝি যুদ্ধ জয় হল? হাবুল জানতে চাইল।

–অনেকটা। জাপানীদের যখন প্রায় নিকেশ করে ছেড়েছি, তখন হঠাৎ একটা বিতিকিচ্ছিরি কাণ্ড হয়ে গেল। আর সেইটেই হল আমাদের আসল গল্প।

–বলো, বলো–আমরা তিনজনে সমস্বরে প্রার্থনা জানালাম।

টেনিদা আবার শুরু করল : আমার একটা কুকুর ছিল। তোদের বাংলাদেশের ঘিয়ে ভাজা নেড়ী কুত্তো নয়, একটা বিরাট গ্রে-হাউন্ড। যেমন তার গাঁক গাঁক ডাক, তেমনি তার বাঘা চেহারা। আর কী তালিম ছিল তার। ঘণ্টার পর ঘণ্টা সে দুপায়ে খাড়া হয়ে হাঁটতে পারত। বেচারা অপঘাতে মারা গেল। দুঃখ হয় কুকুরটার জন্যে, তবে বামুনের জন্যে মরেছে, ব্যাটা নির্ঘাত স্বর্গে যাবে।

–কী করে মরল?–হাবুল প্রশ্ন করল।

–আরে দাঁড়া না কাঁচকলা। যত সব ব্যস্তবাগীশ, আগে থেকেই ফ্যাচফ্যাঁচ করে গল্পটা মাটি করে দিচ্ছে।

যাক, যা বলছিলাম। একদিন বিকেলবেলা, হাতে তখন কোনও কাজ নেই–আমি সেই কুকুরটাকে সঙ্গে করে বেড়াতে বেরিয়েছি। পাহাড়ি জঙ্গলে বেড়াচ্ছি হাওয়া খেয়ে। দুদিন আগেই জাপানী ব্যাটারা ওখান থেকে সরে পড়েছে, কাজেই ভয়ের কোনও কারণ ছিল না। কুকুরটা আগে আগে যাচ্ছে, আর আমি চলেছি পিছনে।

কিন্তু ওই বেঁটে ব্যাটাদের পেটে পেটে শয়তানি। দিলে এই টেনি শমকেই একটা লেঙ্গি কষিয়ে। যেতে যেতে দেখি পাহাড়ের এক নিরিবিলি জায়গায় এক দিব্যি আমগাছ। যত না পাতা, তার চাইতে ঢের বেশি পাকা আম তাতে। একেবারে কাশীর ল্যাংড়া। দেখলে নোলা শক্‌শক্‌ করে ওঠে।

–আরাকানের পাহাড়ে কাশীর ল্যাংডা।–আমি আবার কৌতূহল প্রকাশ করে ফেললাম।

–দ্যাখ প্যালা, ফের বাধা দিয়েছিস একটা চাঁটি হাঁকিয়ে—

–আহা যেতে দাও–যেতে দাও–হাবুল ঢাকাই ভাষায় বললে, পোলাপান।

–পোলাপান!–টেনিদা গর্জে উঠল : আবার বকরবকর করলে একেবারে জলপান করে খেয়ে ফেলব-এই বলে দিলাম, হুঁ!

হ্যাঁ, যা বলছিলাম। খাস কাশীর ল্যাংড়া। কুকুরটা আমাকে একটা চোখের ইঙ্গিত করে বললে, গোটা কয়েক আম পাড়ো।

ক্যাবলা বললে, কুকুরটা আম খেতে চাইল?

–চাইলই তো। এ তো আর তোদর এটুলি কাটা নেড়ী কুত্তো নয়, সেরেফ বিলিতি গ্রে-হাউন্ড। আম তো আম, কলা, মুলো, গাজর, উচ্ছে, নালতে শাক, সজনেডাঁটা সবই তরিবত করে খায়। আমি আম পাড়তে উঠলাম। আর যেই ওঠা–টেনিদা থামল।

–কী হল?

–যা হল তা ভয়ঙ্কর। আমগাছটা হঠাৎ জাপানী ভাষায় ‘ফুজিয়ামা-টুজিয়ামা’ বলে ডালপালা দিয়ে আমায় সাপটে ধরলে। তারপরেই বীরের মতো কুইক মার্চ। তিন-চারটে গাছও তার সঙ্গে সঙ্গে নিপ্পন বাজাই বলে হাঁটা আরম্ভ করলে।

–সে কী!–আমরা স্তম্ভিত হয়ে গেলাম : গাছটা তোমাকে জাপটে ধরে হাঁটতে আরম্ভ করলে।

–করলে তো। আরে, গাছ কোথায়? সেফ ক্যামোফ্লেজ।

–ক্যামোফ্লেজ। তার মানে?

–ক্যামোফেজ মানে জানিসনে? কোথাকার গাড়ল সব। টেনিদা একটা বিকট মুখভঙ্গি করে বলল : মানে ছদ্মবেশ। জাপানীরা ওব্যাপারে দারুণ এক্সপার্ট ছিল। জঙ্গলের মধ্যে কখনও গাছ সেজে, কখনও টিবি সেজে ব্যাটারা বসে থাকত। তারপর সুবিধে পেলেই—ব্যস!

–সর্বনাশ! তারপর?

–তারপর?–টেনিদা একটা উচ্চাঙ্গের হাসি হাসল : তারপর যা হওয়ার তাই হয়ে গেল।

–কী হল?–আমরা রুদ্ধশ্বাসে বললাম, কী করলে তারপর?

–আমাকে ধরে জঙ্গলের মধ্যে নিয়ে গেল। ক্যামোফ্লেজটা খুলে ফেললে, তারপর বত্রিশটা কোদালে কোদালে দাঁত বের করে পৈশাচিক হাসি হাসল। কোমর থেকে ঝকঝকে একটা তরোয়াল বের করে বললে, মিস্টার, উই উইল কাট ইউ!

–কী ভয়ানক ক্যাবলা আর্তনাদ করে বললে, তুমি বাঁচলে কী করে?

–আর কী বাঁচা যায়?–বললে ‘নিপ্পন বান্‌জাই’–মানে জাপানের জয় হোক তারপর তলোয়ারটা ওপরে তুলে–

হাবুল অস্ফুটস্বরে বললে, তলোয়ারটা তুলে?

–ঝাঁ করে এক কোপ! সঙ্গে সঙ্গে আমার মুৎ নেমে গেল। তারপর রক্তে রক্তময়!

–ওরে বাবা!–আমরা তিনজনে একসঙ্গে লাফিয়ে উঠলাম : তবে তুমি কি তা হলে–

–ভূত? দূর গাধা, ভূত হব কেন? ভূত হলে কারও কি ছায়া পড়ে? আমি জলজ্যান্ত বেঁচেই আছি–কেমন ছায়া পড়েছে–দেখতে পাচ্ছিস না?

আমাদের তিনজনের মাথা বোঁ-বোঁ করে ঘুরতে লাগল।

হাবুল অতি কষ্টে বলতে পারল : মুণ্ডু কাটা গেল, তা হলে তুমি বেঁচে রইলে কী করে?

–হুঁ হুঁ, আন্দাজ কর দেখি–টেনিদা আমাদের মুখের দিকে তাকিয়ে মিটিমিটি হাসতে লাগল।

–কিছু বুঝতে পারছি না–কোনওমতে বলতে পারলাম আমি। মনে মনে ততক্ষণ রাম নাম জপ করতে শুরু করেছি। টেনিদা বলে ভুল করে তা হলে কি এতকাল একটা স্কন্ধকাটার সঙ্গে কারবার করছি?

–দূর গাধা–টেনিদা বিজয়গর্বে বললে, কুকুরটা পালিয়ে এল যে?

–তাতে কী হল?

–তবু বুঝলি না? আরে এখানেও যে ক্যামোফ্লেজ।

–ক্যামোফ্লেজ!!

–আরে ধ্যাৎ। তোদের মগজে বিলকুল সব ঘুঁটে, এক ছটাকও বুদ্ধি নেই। মানে আমি টেনি শর্মা–চালাকিতে অমন পাঁচশো জাপানীকে কিনতে পারি। মানে আমি কুকুর সেজেছিলাম, আর কুকুরটা হয়েছিল আমি। বেঁটে ব্যাটাদের শয়তানি জানতাম তো! ওরা যখন আমার, মানে কুকুরটার মাথা কেটে ফেলেছে, সেই ফাঁকে লেজ তুলে আমি হাওয়া!

আর তার পরেই পেলাম তিন নম্বর ভিক্টোরিয়া ক্রসটা!

টেনিদা পরিতৃপ্তির হাসি নিয়ে আমাদের সকলের বোকাটে মুখগুলো পর্যবেক্ষণ করতে লাগল। তারপর একটা পৈশাচিক হুঙ্কার ছাড়ল : দু আনা পয়সা বার কর প্যালা, ওই গরম গরম চানাচুর যাচ্ছে—

ক্রিকেট মানে ঝিঁঝি

ডেসিম্যালের পরে আবার একটা ভেঙ্কুলাম, তার সঙ্গে ভগ্নাংশ। এমন জটিল জিনিসকে সরল করা অন্তত আমার কাজ নয়। পটলডাঙায় থাকি আর পটোল দিয়ে শিঙি মাছের ঝোল খাই—এসব গোলমালের মধ্যে পা বাড়িয়ে আমার কী দরকার?

পণ্ডিতমশায় যখন দাঁত খিঁচিয়ে লুট-লুঙকে মাথায় ঢোকাতে চেষ্টা করেন, তখন আমি আকুলভাবে ঘিলুন আর আলু প্রত্যয়ের কথা ভাবতে থাকি। ওর সঙ্গে যদি দাদখানি চাল প্রত্যয় থাকত তাহলে আর কোনও দুঃখ থাকত না। তবে চাঁটি আর গাঁট্টা প্রত্যয়গুলো বাদ দেওয়া দরকার বলেই আমার ধারণা।

কিন্তু অঙ্ক আর সংস্কৃতর ধাক্কা যদি বা সামলানো যায়—ক্রিকেট খেলা ব্যাপারটা আমার কাছে স্রেফ রহস্যের খাসমহল। ক্রিকেট মানে কী? বোধহয় ঝিঁঝি? দুপুরের কাঠফাটা রোদ্দুরে চাঁদিতে ফোস্কা পড়িয়ে ওসব ঝিঁঝি খেলা আমার ভালো লাগে না। মাথার ভেতরে ঝিঁঝি করতে থাকে আর মনে হয় মস্ত একটা হাঁ করে কাছে কেউ ঝিঁঝিট খাম্বাজ গাইছে। অবশ্য ঝিঁঝিট খাম্বাজ কী আমার জানা নেই—তবে আমার মনে হয়, ক্রিকেট অর্থাৎ ঝিঁঝি খেলার মতোই সেটাও ভয়াবহ।

অথচ কী গেরো দ্যাখো! পটলডাঙার থান্ডার ক্লাবের পক্ষ থেকে আমাকেই ক্রিকেট খেলতে হচ্ছে। গোড়াতেই কিন্তু বলে দিয়েছিলুম-ওসব আমার আসে না। আমি খুব ভালো চিয়ার আপ করতে পারি, দু-এক গেলাস লেমন স্কোয়াশও নয় খাব ওদের সঙ্গে—এমন কি লাঞ্চ খেতে ডাকলেও আপত্তি করব না। কিন্তু ও-সব খেলা-টেলার ভেতরে আমি নেই—প্রাণ গেলেও না।

কিন্তু প্রাণ যাওয়ার আগেই কান যাওয়ার জো। আমাদের পটলডাঙার টেনিদাকে মনে আছে তো? সেই খাঁড়ার মতো উঁচু নাক আর রণডম্বরুর মতো গলা—যার চরিতকথা তোমাদের অনেকবার শুনিয়েছি? সেই টেনিদা হঠাৎ গাঁক-গাঁক করে তার আধ মাইল লম্বা হাতখানা আমার কানের দিকে বাড়িয়ে দিলে।

–খেলবিনে মানে? খেলতেই হবে তোকে। বল করবি ব্যাট করবি—ফিল্ডিং করবিধাঁই করে আছাড় খাবি—মানে যা যা দরকার সবই করবি। সই না করিস, তোর ওই গাধার মতো লম্বা লম্বা কানদুটো একেবারে গোড়া থেকে উপড়ে নেব—এই পাকা কথা বলে দিলুম!

গণ্ডারের মতো নাকের চাইতে গাধার কান ঢের ভালো, আমি মনে মনে বললাম। গণ্ডারের নাক মানে লোককে গুঁতিয়ে বেড়ানো, কিন্তু গাধার কান ঢের কাজে লাগে—অন্তত চটপট করে মশা-মাছি তো তাড়ানো যায়।

কিন্তু সেই কানদুটোকে টেনিদার হাতে বেহাত হতে দিতে আমার আপত্তি আছে। কী করি, খেলতে রাজি হয়ে গেলাম।

তা, প্যান্ট-ট্যান্ট পরতে নেহাত মন্দ লাগে না। বেশ কায়দা করে বুক চিতিয়ে হাঁটছি, হঠাৎ হতভাগা ক্যাবলা বললে, তোকে খাসা দেখাচ্ছে প্যালা।

–সত্যি?

একগাল হেসে ওকে একটা চকোলেট দিতে যাচ্ছি, সঙ্গে সঙ্গে বলে ফেললে-বেগুনখেতে কাকতাড়ুয়া দেখেছিস? ওই যে, মাথায় কেলে হাঁড়ি পরে দাঁড়িয়ে থাকে? হুবহু তেমনি মনে হচ্ছে তোকে। আমি ক্যাবলাকে একটা চাঁটি দিতে যাচ্ছিলাম কিন্তু তার আর দরকার হল না। হাবুল সেন ঢাকাই ভাষায় বললে–আর তোরে ক্যামন দেখাইতে আছে? তুই তো বজ্ৰবাঁটুল—পেন্টুল পইরা য্যান চালকুমড়া সাজছস?

ক্যাবলা স্পিকটি নট। একেবারে মুখের মতো। আমি খুশি হয়ে চকোলেটটা হাবুল সেনকেই দিয়ে দিলাম।

হঠাৎ ক্যাপ্টেন টেনিদার হুঙ্কার শোনা গেল—এখনও দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে ভ্যারেণ্ডা ভাজছিস প্যালা? প্যাড পর—দস্তানা পর—তোকে আর ক্যাবলাকেই যে আগে ব্যাট করতে হবে!

আমাকে দিয়েই শুরু। পেটের মধ্যে পালাজ্বরের পিলেটা ধপাৎ করে লাফিয়ে উঠল একবার।

টেনিদা বললে, ঘাবড়াচ্ছিস কেন? যেই বল আসবে ঠাঁই করে পিটিয়ে দিবি। অ্যায়সা হাঁকড়াবি যে এক বলেই ওভার বাউন্ডারি—পারবি না?

—পারা যাবে বোধহয় কান-টান চুলকে আমি জবাব দিলাম।

—বোধহয় নয়, পারতেই হবে। তাড়াতাড়ি যদি আউট হয়ে যাস, তোকে আর আমি আস্ত রাখব না। মনে থাকবে?

এর মধ্যে হাবুল সেন আমার পায়ে আবার প্যাড পরিয়ে দিয়েছে, সেইটে পরে, হাতে ব্যাট নিয়ে দেখি নড়াচড়া করাই শক্ত!.

কাতর স্বরে বললাম : হাঁটতেই পারছি না যে! খেলব কী করে?

—তুই হাঁটতে না পারলে আমার বয়েই গেল! টেনিদা বিচ্ছিরি রকম মুখ ভ্যাংচাল : বল মারতে পারলে আর রান নিতে পারলেই হল!

–বা রে, হাঁটতেই যদি না পারি, তবে রান নেব কেমন করে?

—মিথ্যে বকাসনি প্যালা—মাথা গরম হয়ে যাচ্ছে আমার। হাঁটতে না পারলে দৌড়নো। যায় না? কেন যায় না—শুনি? তাহলে মাথা না থাকলেও কী করে মাথাব্যথা হয়? নাক না ডাকলেও লোকে ঘুমোয় কী করে? যা—যা, বেশি ক্যাঁচম্যাচ করিসনি। মাঠে নেমে পড়!

একেবারে মোক্ষ যুক্তি।

নামতেই হল অগত্যা। খালি মনে মনে ভাবছি প্যাড-ফ্যাড সুষ্ঠু পড়ে না যাই! ব্যাটটাকে। মনে হচ্ছে ভীমের গদার মতো ভারি—আগে থেকেই তো কজি টনটন করছে। আমি ওটাকে হাঁকড়াব না ওটাই আমায় আগে হাঁকড়ে দেবে—সেইটেই ঠাহর করতে পারছি না।

তাকিয়ে দেখি, পিছনে আর দুপাশে খালি চোরবাগান টাইগার ক্লাব। ওদের সঙ্গেই ম্যাচ কিনা!

কিন্তু এ আবার কী রকম ঝিঁঝি খেলা? ফুটবল তো দেখেছি সমানে সমানে লড়াই—এ-ওর পায়ে ল্যাং মারছে—সে তার মাথায় ঢু মারছে—আর বল সিধে এসপার ওসপার করবার জন্যে দুই গোলকিপার দাঁড়িয়ে আছে ঘুঘুর মতো। এ-পক্ষের একটা চিত হলে প্রায় সঙ্গে সঙ্গে ও-পক্ষের আর-একটা কাত। সে একরকম মন্দ নয়।

কিন্তু এ কী কাপুরুষতা! আমাদের দুজনকে কায়দা করবার জন্যে ওরা এগারো জন। সেইসঙ্গে আবার দুটো আমপায়ার। তাদের পেটে-পেটে যে কী মতলব তা-ই বা কে জানে! আমপায়ারদের গোল-গোল চোখ দেখে আমার তো প্রায় ভ্যামপায়ার বলে সন্দেহ হল!

তারপরে লোকগুলোর দাঁড়িয়ে থাকার ধরন দ্যাখো একবার! কেমন নাড়গোপালের মতো নুলো বাড়িয়ে উবু হয়ে আছে—যেন হরির লুটের বাতাসা ধরবে। সব দেখে-শুনে আমার রীতিমতো বিচ্ছিরি লাগল।

এই রেবল ছোড়ে যে! ব্যাট নিয়ে হাঁকড়াতে যাব—প্যাড-ট্যাড নিয়ে উলটে পড়ি আর কি! বলটা কানের কাছ দিয়ে বেরিয়ে গেল দমদম বুলেটের মতো—একটু হলেই কানটা উড়িয়ে নিত। একটা ফাঁড়া তো কাটল! কিন্তু ও কী? আবার ছেড়ে যে।

জয় মা ফিরিঙ্গি পাড়ার ফিরিঙ্গি কালী! যা-হোক একটা-কিছু এবার হয়ে যাবে! বলি দেবার খাঁড়ার মতো ব্যাটটাকে মাথার ওপর তুলে হাঁকিয়ে দিলাম। বলে লাগল না..স্রেফ পড়ল আমার হাঁটুর ওপরে। নিজের ব্যাটাঘাতে বাপরে বলে বসে পড়তেই দেখি, বলের চোটে স্টাম্প-ফাম্পগুলো কোথায় উড়ে বেরিয়ে গেছে।

—আউট–আউট।

চারিদিকে বেদম চিৎকার। আমপায়ার আবার মাথার ওপরে একটা হাত তুলে জগাই-মাধাইয়ের মতো দাঁড়িয়ে।

কে আউট হল? ক্যাবলা বোধহয়? আমি তক্ষুনি জানতাম, আমাকে কাকতাড়ুয়া বলে গাল দিয়েছে—আউট না হয়ে যায় কোথায়!

হাঁটুর চোটটা সামলে নিয়ে ব্যাট দিয়ে স্টাম্পগুলো সব ঠিক করতে যাচ্ছি হঠাৎ হতচ্ছাড়া আমপায়ার বলে বসল—তুমি আউট, চলে যাও।

আউট? বললেই হল? আউট হবার জন্যেই এত কষ্ট করে প্যাড আর পেন্টলুন পরেছি। নাকি? আচ্ছা দ্যাখো একবার! বয়ে গেছে আমার আউট হতে!

বললাম, আমি আউট হব না। এখন আউট হবার কোনও দরকার দেখছি না আমি।

আমি ঠিক বুঝেছিলাম ওরা আমপায়ার নয়, ভ্যামপায়ার। কুইনিন চিবোনোর মতো যাচ্ছেতাই মুখ করে বললে : দরকার না থাকলেও তুমি আউট হয়ে গেছ। স্টাম্প পড়ে গেছে। তোমার।

—পড়ে গেছে তো কী হয়েছে—আমি রেগে বললাম, আবার দাঁড় করিয়ে দিতে কতক্ষণ? ও-সব চালাকি চলবে না স্যার—এখনও আমার ওভার বাউন্ডারি করা হয়নি!

কেন জানি না, চারিদিকে ভারি যাচ্ছেতাই একটা গোলমাল শুরু হয়ে গেল। চোরবাগান। ক্লাবের লোকগুলোই বা কেন যে এরকম দাপাদাপি করছে, আমি কিছু বুঝতে পারলুম না।

তার মধ্যে আবার চালকুমড়ো ক্যাবলাটা ছুটে এল ওদিক থেকে।

—চলে যা—চলে যা প্যালা! তুই আউট হয়ে গেছিস। আর কতক্ষণ ধৈর্য থাকে এ-অবস্থায়? আমি চেঁচিয়ে বললাম, তোর ইচ্ছে থাকে তুই আউট হ-গে! আমি এখন ওভার বাউন্ডারি করব।

আমার কানের কাছে সবাই মিলে তখন সমানে কিচির-মিচির করছে। আমি কান দিতাম না—যদি না কটাং করে আমার কানে টান পড়ত।

তাকিয়ে দেখি–টেনিদা।

ধাঁই করে আমার কাছ থেকে ব্যাট নিয়ে কানে একটা চিড়িং মেরে দিল—তিড়িং করে লাফিয়ে উঠলাম আমি।

——যা উল্লুক! বেরো মাঠ থেকে। খুব ওস্তাদি হয়েছে, আর নয়!

রামছাগলের মতো মুখ করে অগত্যা আমায় চলে যেতে হল। মনে-মনে বললাম, আমাকে আউট করা! আউট কাকে বলে সে আমি দেখিয়ে দেব!

গিয়ে তো বসলাম কিন্তু কী তাজ্জব কাণ্ড! আমাদের দেখিয়ে দেবার আগেই চোরাবাগানের টাইগার ক্লাব আউট দেখিয়ে দিচ্ছে। কাররও স্টাম্প উল্টে পড়েছে, পিছনে যে লোকটা কাঙালি-বিদায়ের মতো করে হাত বাড়িয়ে বসে আছে, সে আবার খুটুস করে স্টাম্প লাগিয়ে দিচ্ছে। কেউ বা মারবার সঙ্গে সঙ্গেই লাফিয়ে উঠে বল লুফে নিচ্ছে। খালি আউট –আউট–আউট! এ আবার কী কাণ্ড রে বাবা!

আমাদের পটলডাঙা থাণ্ডার ক্লাব ব্যাট বগলে যাচ্ছে আর আসছে। এমন যে ডাকসাইটে টেনিদা, তারও বল একটা রোগাপটকা ছেলে কটাৎ করে পাকড়ে নিলে। হবেই তো! এদিকে মোটে দুজন—ওদিকে এগারো, সেইসঙ্গে আবার দুটো আমপায়ার। কোন্ ভদ্দরলোকে ঝিঁঝি খেলতে পারে কখনও!

ওই চালকুমড়ো ক্যাবলাটাই টিকে রইল শেষতক। কুড়ি না একুশ রান করল বোধহয়। পঞ্চাশ রান না পেরুতেই পটলডাঙা থাণ্ডার ক্লাব বেমালুম সাফ।

এইবার আমাদের পালা। ভারি খুশি হল মনটা। আমরা এগারো জন এবারে তোমাদের নিয়ে পড়ব। আমপায়ার দুটোও দেখি ওদের দল ছেড়ে আমাদের সঙ্গে এসে ভিড়েছে। কিন্তু ওদের মতলব ভালো নয় বলেই আমার বোধ হল।

ক্যাপ্টেন টেনিদাকে বললাম, আমপায়ার দুটোকে বাদ দিলে হয় না? ওরা নয় ওদের সঙ্গেই ব্যাট করুক।

টেনিদা আমাকে রদ্দা মারতে এল। বললে, বেশি ওস্তাদি করিসনি প্যালা? ওখানে দাঁড়া। একটা ক্যাচ ফেলেছিস কি ঘ্যাঁচ করে কান কেটে দেব। ব্যাট তো খুব করেছিস—এবার যদি ঠিকমতো ফিল্ডিং করতে না পারিস, তা হলে তোর পালাজ্বরের পিলে আমি আস্ত রাখব না!

হাবুল সেন বল করতে গেল।

প্রথম বলেই—ওরে বাপ রে! টাইগার ক্লাবের সেই রোগা ছোকরাটা কী একখানা হাঁকড়ালে! বোঁ করে বল বেরিয়ে গেল, একদম বাউন্ডারি। ক্যাবলা প্রাণপণে ছুটেও রুখতে পারলে না।

পরের বলেও আবার সেই হাঁকড়ানি। তাকিয়ে দেখি, কামানের গুলির মতো বলটা আমার দিকেই ছুটে আসছে।

একটু দূরেই ছিল আমাদের পাঁচুগোপাল। চেঁচিয়ে বললে, প্যালা—ক্যাচ—ক্যাচ–

–ক্যাচ! ক্যাচ! দূরে দাঁড়িয়ে ওরকম সবাই-ই ফ্যাচফ্যাঁচ করতে পারে! ওই বল ধরতে গিয়ে আমি মরি আর-কি! তার চাইতে বললেই হয়, পাঞ্জাব মেল ছুটছে প্যালা লুফে নে? মাথা নিচু করে আমি চুপ করে বসে পড়লাম—আবার বল বাউন্ডারি পার।

হইহই করে টেনিদা ছুটে এল।

–ধরলিনে যে?

–ও ধরা যায় না!

–ধরা যায় না? ইস—এমন চমৎকার ক্যাচটা, এক্ষুনি আউট হয়ে যেত।

–সবাইকে আউট করে লাভ কী? তা হলে খেলবে কে? আমরাই তো আউট হয়ে গেছি—এখন খেলুক না ওরা!

খেলুক না ওরা!–টেনিদা ভেংচি কাটল–তোর মতো গাড়লকে খেলায় নামানোই আমার ভুল হয়েছে! যা—যা–বাউন্ডারি লাইনে চলে যা!

চলে গেলাম। আমার কী! বসে বসে ঘাসের শিষ চিবুচ্ছি। দুটো-একটা বল এদিক-ওদিক দিয়ে বেরিয়ে গেল, ধরার চেষ্টা করেও দেখলাম। বোঝা গেল, ও সব ধরা যায় না। হাতের তলা দিয়ে যেমন শোলমাছ গলে যায়—তেমনি সুড়সুড় করে পিছলে বাউন্ডারি লাইন পেরিয়ে যেতে লাগল।

আর শাবাশ বলতে হবে চোরাবাগান টাইগার ক্লাবের ওই রোগা ছোকরাকে! ডাইনে মারছে, বাঁয়ে মারছে, চটাং করে মারছে, সাঁই করে মারছে, ধাঁই করে মারছে! একটা বলও বাদ যাচ্ছে না। এর মধ্যেই বেয়াল্লিশ রান করে ফেলেছে একাই। দেখে ভীষণ ভালো লাগল আমার। পকেটে চকোলেট থাকলে দুটো ওকে আমি খেতে দিতাম।

হঠাৎ বল নিয়ে টেনিদা আমার কাছে হাজির।

–ব্যাটিং দেখলাম, ফিল্ডিংও দেখছি। বল করতে পারবি?

এতক্ষণ ঝিঁঝি খেলা দেখে আমার মনে হয়েছিল–বল করাটাই সবচেয়ে সোজা। একপায়ে দাঁড়িয়ে উঠলাম—খুব পারব। এ আর শক্তটা কী?

—ওদের ওই রোগাপটকা গোসাঁইকে আউট করা চাই। পারবিনে?

—এক্ষুনি আউট করে দিচ্ছি–কিছু ভেবো না!

আমি আগেই জানি, আমপায়ার-দুটোর মতলব খারাপ। সেইজন্যেই আমাদের দল থেকে ওদের বাদ দিতে বলেছিলাম—টেনিদা কথাটা কানে তুলল না। যেই প্রথম বলটা দিয়েছি, সঙ্গে সঙ্গে বললেন–নো বল!

নো বল তো নো বল—তোদের কী! বলতেও যাচ্ছিলাম, কিন্তু গোসাঁই দেখি আবার ধাঁই করে হাঁকড়ে দিয়েছে, বাউন্ডারি তো তুচ্ছ—একেবারে ওভার বাউন্ডারি!

আর চোরাবাগান টাইগার ক্লাবের সে কী হাততালি! একজন তো দেখলাম আনন্দে ডিগবাজি খাচ্ছে!

এইবার আমার ব্রহ্মরন্ধ্রে আগুন জ্বলে গেল। মাথায় টিকি নেই—যদি থাকত, নিশ্চয় তেজে রেফের মতো খাড়া হয়ে উঠত। বটে—ডিগবাজি! আচ্ছা—দাঁড়াও! বল হাতে ফিরে যেতেই ঠিক করলাম—এবার গোসাঁইকে একেবারে আউট করে দেব! মোক্ষম আউট!

প্যাডটা বোধহয় ঢিলে হয়ে গেছে—গোসাঁই পিছন ফিরে সেটা বাঁধছিল। দেখলাম, এই সুযোগ। ব্যাট নিয়ে মুখোমুখি দাঁড়ালে কিছু করতে পারব না—এই সুযোগেই কর্ণবধ।

মামার বাড়িতে আম পেড়ে পেড়ে হাতের টিপ হয়ে গেছে আর ভুল হল না। আমপায়ার না ভ্যামপায়ার হাঁ-হাঁ করে ওঠবার আগেই বোঁ করে বল ছুঁড়ে দিলাম।

নির্ঘাত লক্ষ্য! গোসাঁইয়ের মাথায় গিয়ে খটাং করে বল লাগল। সঙ্গে সঙ্গেই—ওরে বাবা! গোসাঁই মাঠের মধ্যে ফ্ল্যাট!

আউট যাকে বলে! অন্তত এক হপ্তার জন্যে বিছানায় আউট!

আরে—এ কী, এ কী! মাঠসুদ্ধ লোক তেড়ে আসছে যে। মার মার করে আওয়াজ উঠছে যে! অ্যাঁ—আমাকেই নাকি?

ঊর্ধ্বশ্বাসে ছুটলাম। কান ঝিঁঝি করছে, প্রাণপণে ছুটতে ছুটতে এবারে টের পাচ্ছি—আসল ঝিঁঝি খেলা কাকে বলে!

খট্টাঙ্গ ও পলান্ন

ওপরের নামটা যে একটু বিদঘুটে তাতে আর সন্দেহ কী! খট্টাঙ্গ শুনলেই দস্তুরমতো খটকা লাগে, আর পলান্ন মানে জিজ্ঞেস করলেই বিপন্ন হয়ে ওঠা স্বাভাবিক নয়।

অবশ্য যারা গোমড়ামুখো ভালো ছেলে, পটাপট পরীক্ষায় পাশ করে যায়, তারা হয়তো চট করে বলে বসবে, ইঃ—এর আর শক্তটা কী! খট্টাঙ্গ মানে হচ্ছে খাট আর পলান্ন মানে হচ্ছে। পোলাও। এ না জানে কে!

অনেকেই যে জানে না তার প্রমাণ আমি আর আমার মতো সেই সব ছাত্র, যারা কমসে কম তিন-তিনবার ম্যাট্রিকে ঘায়েল হয়ে ফিরে এসেছে। কিন্তু ওই শক্ত কথা দুটোর মানে আমাকে জানতে হয়েছিল, আমাদের পটলডাঙার টেনিদার পাল্লায় পড়ে। সে এক রোমাঞ্চকর কাহিনী।

আচ্ছা গল্পটা তা হলে বলি।

খাটের সঙ্গে পোলাওয়ের সম্পর্ক কী? কিছুই না। টেনিদা খাট কিনল আর আমি পোলাও খেলাম। আহা সে কী পোলাও! এই যুদ্ধের বাজারে তোমরা যারা র‍্যাশনের চাল খাচ্ছ আর কড়মড় করে কাঁকর চিবুচ্ছ, তারা সে-পোলাওয়ের কল্পনাও করতে পারবে না। জয়নগরের খাসা গোপালভোগ চাল, পেস্তা, বাদাম, কিশমিশ–

কিন্তু বর্ণনা এই পর্যন্ত থাক। তোমরা দৃষ্টি দিলে অমন রাজভোগ আমার পেটে সইবে। তার চাইতে গল্পটাই বলা যাক।

টেনিদাকে তোমরা চেনো না। ছহাত লম্বা, খাড়া নাক, চওড়া চোয়াল। বেশ দশাসই জোয়ান, হঠাৎ দেখলে মনে হয় ভদ্রলোকের গালে একটা গালপাট্টা থাকলে আরও বেশি মানাত। জাঁদরেল খেলোয়াড়—গড়ের মাঠে তিন-তিনটে গোরার হাঁটু ভেঙে দিয়ে রেকর্ড করেছেন। গলার আওয়াজ শুনলে মনে হয় ষাঁড় ডাকছে।

এমন একটা ভয়ানক লোক যে আরও ভয়ানক বদরাগী হবে, এ তো জানা কথা।

আমি প্যালারাম বাঁড়ুজ্যে–বছরে ছমাস ম্যালেরিয়ায় ভুগি আর বাটি বাটি সাবু খাই। দুপা দৌড়াতে গেলে পেটের পিলে খটখট করে। সুতরাং টেনিদাকে দস্তুরমতো ভয় করে চলি শতহস্ত দূরে তো রাখিই। ওই বোম্বাই হাতের একখানা জুতসই চাঁটি পেলেই তো খাটিয়া চড়ে নিমতলায় যাত্রা করতে হবে।

কিন্তু অদৃষ্টের লিখন খণ্ডাবে কে?

সবে দ্বারিকের দোকান থেকে গোটা কয়েক লেডিকেনি খেয়ে রাস্তায় নেমেছি হঠাৎ পেছন থেকে বাজখাঁই গলা : ওরে প্যালা!

সে কী গলা! আমার পিলে-টিলে একসঙ্গে আঁতকে উঠল। পেটের ভেতরে লেডিকেনিগুলো তালগোল পাকিয়ে গেল একসঙ্গে। তাকিয়ে দেখি—আর কে? মূর্তিমান স্বয়ং।

—কী করছিস এখানে?

সত্যি কথা বলতে সাহস হল না বললেই খেতে চাইবে। আর যদি খাওয়াতে চাই তা হলে ওই রাক্ষুসে পেট কি আমার পাঁচ-পাঁচটা টাকা না খসিয়েই ছেড়ে দেবে! আর খাওয়াতে চাইলে—ওরে বাবা!

কাঁচুমাচু করে বলে ফেলোম, এই কেত্তন শুনছিলাম।

—কেত্তন শুনছিলে? ইয়ার্কি পেয়েছ? এই বেলা তিনটের সময় শেয়ালদার মোড়ে দাঁড়িয়ে কী কেত্তন শুনছিলে? আমি দেখিনি চাঁদ, এক্ষুনি দ্বারিকের দোকান থেকে মুখ চাটতে চাটতে বেরিয়ে এলে?

এই সর্বনাশ–ধরে ফেলেছে তো। গেছি এবারে। দুগানাম জপতে শুরু করে দিয়েছি ততক্ষণে, কিন্তু কার মুখ দেখে বেরিয়েছিলাম কে জানে, ফাঁড়াটা কেটে গেল! না চটে টেনিদা গোটা ত্রিশেক দাঁতের ঝলক দেখিয়ে দিলে আমাকে। মানে, হাসল।

–ভয় নেই—আমাকে খাওয়াতে হবে না। শ্যামলালের ঘাড় ভেঙে দেলখোসে আজ বেশ মেরে দিয়েছি। পেটে আর জায়গা নেই।

আহা বেচারা শ্যামলাল! আমার সহানুভূতি হল। কিন্তু আমাকে বাঁচিয়েছে আজকে। দধীচির মতো আত্মদান করে আমার প্রাণ, মানে, পকেট বাঁচিয়েছে।

টেনিদা বললে, এখন আমার সঙ্গে চল দেখি!

সভয়ে বললাম, কোথায়?

—চোরাবাজারে। খাট কিনব একখানা—শুনেছি শস্তায় পাওয়া যায়।

–কিন্তু আমার যে কাজ—

—রেখে দে তোর কাজ। আমার খাট কেনা হচ্ছে না, তোর আবার কাজ কিসের রে? ভারি যে কাজের লোক হয়ে উঠেছিস—অ্যাাঁ?–কথাটার সঙ্গে সঙ্গে ছোটখাটো একটি রদ্দা আমার পিঠে এসে পড়ল।

বাঃ–কী চমৎকার যুক্তি! টেনিদার খাট কেনা না হলে আমার কোনও আর কাজ থাকতে নেই। কিন্তু প্রতিবাদ করবে কে? সূচনাতেই যে রদ্দা পিঠে পড়েছে, তাতেই হাড়-পাঁজরাগুলো ঝনঝন করে উঠেছে আমার। আর একটি কথা বললেই সজ্ঞানে গঙ্গাপ্রাপ্তি অসম্ভব নয়।

–চল চল।

না চলে উপায় কী। প্রাণের চেয়ে দামি জিনিস সংসারে আর কী আছে?

চলতে চলতে টেনিদা বললে, তোকে একদিন পোলাও খাওয়াতে হবে। আমাদের জয়নগরের খাসা গোপালভোগ চাল—একবার খেলে জীবনে আর ভুলতে পারবি না।

কথাটা আজ পাঁচ বছর ধরে শুনে আসছি। কাজ আদায় করে নেবার মতলব থাকলেই টেনিদা প্রতিশ্রুতি দেয়, আমাকে গোপালভোগ চালের পোলাও খাওয়াবে। কিন্তু কাজটা মিটে গেলেই কথাটা আর টেনিদার মনে থাকে না। গোপালভোগ চালের পোলাও এ-পর্যন্ত স্বপ্নেই দেখে আসছি বসনায় তার রস পাবার সুযোগ ঘটল না।

বললাম, সে তো আজ পাঁচশো বার খাওয়ালে টেনিদা!

টেনিদা লজ্জা পেলে বোধহয়। বললে, না, না—এবারে দেখিস। মুশকিল কী জানিস-কয়লা পাওয়া যায় না—এ পাওয়া যায় না—সে পাওয়া যায় না।

পোলাও রাঁধতে কয়লা পাওয়া যায় না! গোপালভোগ চাল কী ব্যাপার জানি না, তা সেদ্ধ করতে কমন কয়লা লাগে তাও জানি না। কিন্তু কয়লার অভাবে পোলাও রান্না বন্ধ আছে। এমন কথা কে কবে শুনেছে? আমাদের বাসাতেও তো পোলাও মাঝে মাঝে হয়, কই র‍্যাশনের কয়লার জন্য তাতে তো অসুবিধে হয় না! হাইকোর্ট দেখানো আর কাকে বলে! ওর চাইতে সোজা বলে দাও না বাপু-খাওয়াব না। এমনভাবে মিথ্যে মিথ্যে আশা দিয়ে রাখবার দরকার কী?

টেনিদা বললে, ভালো একটা খাট যদি কিনে দিতে পারিস তা হলে তোর কপালে পলান্ন নাচছে, এ বলে দিলাম।

—পলান্ন!

-হ্যাঁ—মানে পোলাও! তোদের বুকড়ি চালের পোলাওকে কি আর পলান্ন বলে নাকি। হয় গোপালভোগ চাল, তবে না!

হায় গোপালভোগ! আমি নিঃশ্বাস ছাড়লাম।

তারপরে খাট কেনার পর্ব।

টেনিদা বললে, এমন একটা খাট চাই যা দেখে পাড়ার লোক স্তম্ভিত হয়ে যাবে! বলবে, হ্যাঁ—একটা জিনিস বটে! বাংলা নড়বড়ে খাট নয়—একেবারে খাঁটি সংস্কৃত খট্টাঙ্গ। শুনলেই অঙ্গপ্রত্যঙ্গ চমকে উঠবে!

কিন্তু এমন একটা খট্টাঙ্গ কিনতে গিয়েই বিপত্তি!

একেবারে বাঁশবনে ডোমকানা। গায়ে গায়ে অজস্র ফার্নিচারের দোকান। টেবিল, চেয়ার, সোফা, আলনা, আয়না, পালঙ্কের একেবারে সমারোহ। কোন দোকানে যাই?

চারদিক থেকে সে কী সংবর্ধনার ঘটা! যেন এরা এতক্ষণ ধরে আমাদেরই প্রতীক্ষায় দস্তুরমতো তীর্থের কাকের মতো হাঁ করে বসে ছিল।

—এই যে স্যার—আসুন—আসুন—

–কী লইবেন স্যার, লইবেন কী? আয়েন, আয়েন, একবার দেইখ্যাই যান—

—একবার দেখুন না স্যার—যা চান, চেয়ার, টেবিল, সোফা, খাট, বাক্স, ডেক্সো, টিপয়, আলনা, আয়না, র‍্যাক, ওয়েস্ট-পেপার বাসকেট, লেটার বক্স–

লোকটা যেভাবে মুখে ফেনা তুলে বলে যাচ্ছিল, মনে হচ্ছিল একেবারে ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়াল পর্যন্ত বলে তবে থামবে।

টেনিদা বললে, দুত্তোর—এ যে মহা জ্বালাতনে পড়লাম।

উপদেশ দিয়ে বললাম, চটপট যেখানে হয় ঢুকে পড়ো, নইলে এর পরে হাত-পা ধরে টানতে শুরু করে দেবে।

তার বড় বাকিও ছিল না। অতএব দুজনে একেবারে সোজা দমদম বুলেটের মতো সেঁধিয়ে গেলাম—সামনে যে-দোকানটা ছিল, তারই ভেতরে।

–কী চান দাদা, কী চাই?

–একখানা ভালো খাট।

—মানে পালং? দেখুন না, এই তো কত রয়েছে। যেটা পছন্দ হয়! ওরে ন্যাপলা, বাবুদের জন্যে চা আন, সিগারেট নিয়ে আয়–

—মাপ করবেন, চা-সিগারেট দরকার নেই। এক পেয়ালা চা খাওয়ালে খাটের দরে তার পাঁচ গুণ আদায় করে নেবেন তো। আমরা পটলডাঙার ছেলে মশাই, ওসব চালাকি বুঝতে পারি। বাঙাল পাননি–হুঁ!

দোকানদার বোকার মতো তাকিয়ে রইল। তারপর সামলে নিয়ে বললে, না খান তো না খাবেন মশাই ব্যবসার বদনাম করবেন না।

–না করবে না! ভারি ব্যবসা—চোরাবাজার মানেই তো চুরির আখড়া। চা-সিগারেট খাইয়ে আরও ভালো করে পকেট মারবার মতলব!

মিশকালো দোকানদার চটে বেগুনী হয়ে গেল : ইঃ, ভারি আমার ব্রাহ্মণ-ভোজনের বামুন রে! ওঁকে চা না খাওয়ালে আমার আর একাদশীর পারণ হবে না! যান যান মশাই অমন খদ্দের ঢের দেখেছি।

—আমিও তোমার মতো ঢের দোকানদার দেখেছি যাও–যাও—

এই রে-মারামারি বাধায় বুঝি! প্রাণ উড়ে গেল আমার। টেনিদাকে টেনে দোকান থেকে বার করে নিয়ে এলাম।

টেনিদা বাইরে বেরিয়ে বললে, ব্যাটা চোর।

বললাম, নিঃসন্দেহ। কিন্তু এখানে আর দাঁড়িয়ো না, চলো, অন্য দোকান দেখি।

অনেক অভ্যর্থনা এড়িয়ে আর অনেকটা এগিয়ে আর একখানা দোকানে ঢোকা গেল। দোকানদার একগাল হেসে বললে, আসুন—আসুন—পায়ের ধুলো দিয়ে ধন্য করান! এ তো আপনাদেরই দোকান।

—আমাদের দোকান হলে কি আর আপনি এখানে বসে থাকতেন মশাই? কোন কালে বার করে দিতাম, তারপর যা পছন্দ হয় বিনি পয়সায় বাড়িতে নিয়ে যেতাম।

এ-দোকানদারের মেজাজ ভালো—চটল না। একমুখ পান নিয়ে বাধিত হাসি হাসবার চেষ্টা করলে : হেঁঃ—হেঁঃ—হেঁঃ। মশাই রসিক লোক। তা নেবেন কী?

–একখানা ভালো খাট।

—এই দেখুন না। এ-খানা প্লেন, এ-খানাতে কাজ করা। এটা বোম্বাই প্যাটার্ন, এটা লন্ডন প্যাটার্ন, এটা ডি-লুক্স প্যাটার্ন, এটা মানে-না-মানা প্যাটার্ন–

–থামুন, থামুন। থাকি মশাই পটলডাঙা স্ট্রিটে—অত দিল্লি-বোম্বাই কামসকাটকা প্যাটার্ন দিয়ে আমার কী হবে! এই এ-খানার দাম কত?

—ও-খানা? তা ওর দাম খুবই সস্তা। মাত্র সাড়ে তিনশো।

–সা–ড়ে তিনশো?—টেনিদার চোখ কপালে উঠল।

—হ্যাঁ–সাড়ে তিনশো। এক ভদ্দরলোক পাঁচশো টাকা নিয়ে ঝুলোঝুলি পরশু তাঁকে দিইনি।

-কেন দেননি?

–আমার এসব রয়্যাল খাট মশাই-যাকে-তাকে বিক্রি করব? তাতে খাটের অমর্যাদা হয় যে। আপনাকে দেখেই চিনেছি বনিয়াদী লোক। তাই মাত্র সাড়ে তিনশোয় ছেড়ে দিচ্ছি—আপনি খাটের যত্ন-আত্তি করবেন।

আহা-লোকটার কী অন্তদৃষ্টি। ঠিক খদ্দের চিনেছে তো। আমার শ্রদ্ধাবোধ হল। কিন্তু টেনিদা বশীভূত হবার পাত্র নয়।

—যান—যান মশাই, এই খাটের দাম সাড়ে তিনশো টাকা হয় কখনও? চালাকি পেয়েছেন? কী ঘোড়ার ডিম কাঠ আছে এতে?

বলতে বলতেই খাটের পায়া ধরে এক টান—আর সঙ্গে সঙ্গেই মড়মড়মড়াৎ। মানে, খাটের পঞ্চত্ব-প্রাপ্তি।

–হায়—হায়—হায়—

দোকানদার হাহাকার করে উঠল : আমার পাঁচশো টাকা দামের জিনিস মশাই, দিলেন সাবাড় করে? টাকা ফেলুন এখন।

–টাকা। টাকা একেবারে গাছ থেকে পাকা আমের মতো টুপটুপ করে পড়ে, তাই না? খাট তো নয়—দেশলাইয়ের বাক্স, তার আবার দাম!

দোকানদার এগিয়ে এসেছে ততক্ষণে। খপ করে টেনিদার ঘাড় চেপে ধরেছে : টাকা ফেলুন—নইলে পুলিশ ডাকব।

বেচারা দোকানদার—টেনিদাকে চেনে না। সঙ্গে সঙ্গে জুজুৎসুর এক প্যাঁচে তিন হাত দূরে ছিটকে চলে গেল। পড়ল একটা টেবিলের ওপর সেখান থেকে নীচের একরাশ ফুলদানির গায়ে। ঝনঝন করে দু-তিনটে ফুলদানির সঙ্গে সঙ্গে গয়াপ্রাপ্তি হয়ে গেল—খণ্ড-প্রলয় দস্তুরমতো।

দোকানদারের আর্তনাদ—হইহই হট্টগোল। মুহূর্তে টেনিদা পাঁজাকোলা করে তুলে ফেলেছে আমাকে, তারপর বিদ্যুৎবেগে ভিড় ঠেলে বেরিয়ে এসেছে বৌবাজার স্ট্রিটে। আর বেমালুম ঘুষি চালিয়ে ফ্ল্যাট করে ফেলেছে গোটা তিনেক লোককে। তারপরেই তেমনি ব্লিৎক্রি করে সোজা লাফিয়ে উঠে পড়েছে একখানা হাওড়ার ট্রামে। যেন ম্যাজিক।

পিছনের গণ্ডগোল যখন বৌবাজার স্ট্রিটে এসে পৌঁছেছে, ততক্ষণে আমরা ওয়েলিংটন স্ট্রিট পেরিয়ে গেছি।

আমি তখনও নিঃশ্বাস ফেলতে পারছি না। উঃ—একটু হলেই গিয়েছিলাম আর কী। অতগুলো লোক একবার কায়দামতো পাকড়াও করতে পারলেই হয়ে গিয়েছিল, পিটিয়ে একেবারে পরোটা বানিয়ে দিত।

টেনিদা বললে, যত সব জোচ্চোর। দিয়েছি ঠাণ্ডা করে ব্যাটাদের।

আমি আর বলব কী। হাঁ করে কাতলা মাছের মতো দম নিচ্ছি তখনও। বহু ভাগ্যি যে পৈতৃক প্রাণটা রক্ষা পেল আজকে।

ট্রাম চীনেবাজারের মোড়ে আসতেই টেনিদা বললে, নাম—নাম।

—এখানে আবার কী?

—আয় না তুই।…এক ঝটকায় উড়ে পড়েছি ফুটপাথে।

টেনিদা বললে, চীনেদের কাছে সস্তায় ভালো জিনিস মিলতে পারে। আয় দেখি। বাঙালীর হাত থেকে রক্ষা পেয়েছি, আবার চীনেম্যানের পাল্লায়। নাঃ, প্রাণটা নিয়ে আর বাড়ি ফিরতে পারব মনে হচ্ছে না। প্যালারাম বাঁড়ুজ্যে নিতান্তই পটল তুলল আজকে। কার মুখ দেখে বেরিয়েছিলাম হায় হায়!

সভয়ে বললাম, আজ না হয়—

চল চল ঘাড়ে আবার একটি ছোট রদ্দা।

ক্যাঁক করে উঠলাম। বলতে হল, চলো।

চীনেম্যান বললে, কাম কাম, বাবু। হোয়াত্ ওয়ান্ত? (What want?)

টেনিদার ইংরেজী বিদ্যেও চীনেম্যানের মতোই। বললে, কট ওয়ান্ট্‌।

–কত্? ভেরি নাইস্‌ কত্। দেয়ার আর মেনি। হুইচ তেক? (Cot? Very nice cot. There are many. Which take?)

—দি।…একটা দেখিয়ে দিয়ে টেনিদা বললে, কত দাম?

—তু হান্দ্রে লুপিজ (Two hundred rupees)।

—অ্যাঁ—দুশো টাকা! ব্যাটা বলে কী! পাগল না: পেট খারাপ? কী বলিস্ প্যালা এর দাম দুশো হয় কখনও?

চুপ করে থাকাই ভালো। যা দেখছি তা আশাপ্রদ নয়। পুরনো খাট রং-চং করে একটু চেহারা ফিরাবার চেষ্টা হয়েছে। খাট দেখে একটুও পছন্দ হল না। কিন্তু টেনিদা যখন পছন্দ করেছে, তখন প্রতিবাদ করে মার খাই আর কি! না হয় ম্যালেরিয়াতেই ভুগছি, তাই বলে কি এতই বোকা?

বললাম, হুঁ, বড্ড বেশি বলছে।

টেনিদা বললে, সব ব্যাটা চোর। ওয়েল মিস্টার চীনেম্যান, পনেরো টাকায় দেবে?

—হো-হোয়াত? ফিতিন লুপিজ? দোস্ত জোক বাবু। গিভ এইতি লুপিজ। (What? Fifteen rupees? Dont joke, Babu! Give eighty rupees.)

–নাও–নাও চাঁদ—আর পাঁচ টাকা দিচ্ছি–

—দেন গিভ ফিপতি—

শেষ পর্যন্ত পঁচিশ টাকায় রফা হল।

খাট কিনে মহা উল্লাসে টেনিদা কুলির মাথায় চাপালে। আমাকে বললে, প্যালা, এবারে তুই বাড়ি যা—

পোলাও খাওয়ানোর কথাটা জিজ্ঞেস করতে ইচ্ছে হল কিন্তু লাভ কী। দোকানদার ঠেঙিয়ে সেই থেকে অগ্নিমূর্তি হয়ে আছে—পোলাওয়ের কথা বলে বিপদে পড়ব নাকি। মানে মানে বাড়ি পালানোই প্রশস্ত!

কিন্তু পোলাও ভোজন কপালে আছেই—ঠেকাবে কে?

পরের গল্পটুকু সংক্ষেপেই বলি। রাত্রে বাড়ি ফিরে খাটে শুয়েই টেনিদার লাফ। লক্ষ লক্ষ কোটি কোটি ছারপোকা কাঁকড়াবিছে, পিশু কী নেই সেই চৈনিক খাটে? শোবার সঙ্গে সঙ্গেই জ্বালাময়ী অনুভূতি।

খানিকক্ষণ জ্বলন্ত চোখে টেনিদা তাকিয়ে রইল খাটের দিকে। বটে, চালাকি। তিনটে গোরা আর চোরাবাজারের দোকানদার ঠ্যাঙানো রক্ত নেচে উঠেছে মগজের মধ্যে। তারপরেই একলাফে উঠনে অবতরণ, কুড়ল আনয়ন–এবং–

অতগুলো বাড়তি কাঠ দিয়ে আর কী হবে। দিন কয়েক কয়লার অভাব তো মিটল। আর ঘরে আছে গোপালভোগ চাল—অতএব–

অতএব পোলাও।

খট্টাঙ্গের জয় হোক। আহা-হা কী পোলাও খেলাম! পোলাও নয়—পলান্ন। তার বর্ণনা আর করব না, পাছে দৃষ্টি দাও তোমরা।

ঘুঁটেপাড়ার সেই ম্যাচ

চোরবাগান টাইগার ক্লাবের সঙ্গে পটলডাঙা থান্ডার ক্লাবের ফুটবল ম্যাচ হয়ে গেল। প্রথমে টাইগার ক্লাব ঝাঁ ঝাঁ করে আমাদের ছটা গোল ঢুকিয়ে দিলে, ওদের সেই ট্যারা ন্যাড়া মিত্তির একাই দিলে পাঁচখানা। আর বাকিটা দিলে আমাদের ব্যাক বলটুদা–সেমসাইডে।

তারপরেই পটলডাঙা থাণ্ডার ক্লাব পর পর ছটা গোল দিয়ে দিলে। টেনিদা দুটো, ক্যাবলা তিনটে, দলের সবচেয়ে ছোট্ট আর বিচ্ছু ছেলে কম্বল দিলে একটা। তখন ভারি একটা গোলমাল বেধে গেল, আর খেলাই হল না– রেফারি ফুঁ করে হুইসিল বাজিয়েখেলা শেষ করে দিলেন।

ব্যাপারটা এই :

আমাদের গোলকিপার পাঁচুগোপাল চশমা পরে। সেদিন ভুল করে ওর পিসিমার চশমা চোখে দিয়ে মাঠে নেমে পড়েছে। তারপরে আর কী- একসঙ্গে তিনদিকে তিনটে বল দেখতে পায়, ডাইনের বলটা ঠেকাতে যায় তো বাঁয়েরটা গোল হয়ে যায়। বলটুদা আবার বুদ্ধি করে একটা ব্যাক পাস করেছিল, তাতে করে একটা সেমসাইড।

এখন হল কী, ছটা গোল দিয়ে টাইগার ক্লাব কী রকম নার্ভাস হয়ে গেল। আনন্দের চোটে ওদের তিনজন খেলোয়াড় অজ্ঞান হয়ে পড়ল, বাকিরা কেবল লাফাতে লাগল, সেই ফাঁকে ছটা বল ফেরত গেল ওদের গোলে। তখন সেই ফুর্তির চোট লাগল থাণ্ডার ক্লাবে–আর কে যে কোন দলে খেলছে খেয়ালই রইল না। টেনিদা বেমক্কা হাবুল সেনকেই ফাউল করে দিলে, আর ন্যাড়া মিত্তির তখন নিজেদের গোলে বল ঢোকাবার জন্যে মরিয়া–থান্ডার ক্লাবের দুজন তাকে জাপটে ধরে মাঠময় গড়াগড়ি খেতে লাগল। ব্যাপার দেখে রেফারি খেলা বন্ধ করে দিলেন, আর কোত্থেকে একটা চোঙা এনে সমানে ভাঙা গলায় চ্যাঁচাতে লাগলেন; ড্র-ড্র-ড্রন গেম এক্ষুনি সব মাঠ থেকে কেটে পড়ো, নইলে পুলিশ ডাকব–হুঁ!

সেদিন সন্ধের পর এই নিয়ে দারুণ আলোচনা চলছিল আমাদের ভেতরে। হঠাৎ টেনিদা বললে, ছোঃ, বারোটা গোল আবার গোল নাকি? একবার একাই আমি বত্রিশটা গোল দিয়েছিলুম একটা ম্যাচে।

অ্যাঁ! চুয়িং গাম চিবুতে চিবুতে ক্যাবলা একটা বিষম খেল।

হাবুল বললে, হ, ফাঁকা গোলপোস্ট পাইলে আমিও বায়ান্নখান গোল দিতে পারি।

–নো স্যার, নো ফাঁকা গোল বিজনেস। দুদলে এ ডিভিসন বি ডিভিসনের কমসে কম বারোজন প্লেয়ার ছিল। যা-তা খেলা তো নয়– ঘুঁটেপাড়া ভার্সাস বিচালিগাম।

–খেলাটি কোথায় হয়েছিল?

ঘুঁটেপাড়ায়। কী পেলে, ইউসেবিয়ো, মুলার নিয়ে লাফালাফি করিস! জীবনে একটা ম্যাচে কখনও বত্রিশটা গোল দিয়েছে তোদের রিভেরা, জেয়ার জিনহো? ববি চার্লটন তো আমার কাছে বেবি রে!

একটা মোক্ষম চাল মারতাছে- বিড়বিড় করে আওড়াল হাবুল সেন।

হাবুলার কপাল ভালো যে টেনিদা সেটা ভালো করে শুনতে পেল না। বললে, কী বললি, মোক্ষদা মাসি? কী করে জানলি রে? ওই মোক্ষদা মাসির বাড়িতেই তো আমি গিয়েছিলুম ঘুঁটেপাড়ায়। সেইখানেই তো সেই দারুণ ম্যাচ। কিন্তু মোক্ষদা মাসির খবর তোকে বললে কে?

আমি জানি– হাবুল পণ্ডিতের মতো হাসল।

ওর ওস্তাদি দেখে আমার রাগ হয়ে গেল। বললুম, বল দেখি ঘুঁটেপাড়া কোথায়?

–ঘুইট্যাপাড়া আর কোথায় হইব? গোবরডাঙার কাছেই। গোবর দিয়াই তো ঘুইট্যা হয়।

ইয়াহ! টেনিদা এত জোরে হাবুলের পিঠ চাপড়ে দিলে যে হাবুল চ্যাঁ করে উঠল। নাকটাকে জিভেগজার মতো উঁচু করে টেনিদা বললে, প্রায় ধরেছিস। তবে ঠিক গোবরডাঙার কাছে নয়, ওখান থেকে দশ মাইল হেঁটে, দুই মাইল দৌড়ে

দৌড়তে হয় কেন?–ক্যাবলা জানতে চাইল।

–হয়, তাই নিয়ম। অত কৈফিয়ত চাসনি বলে দিচ্ছি। ওখানে সবাই দৌড়য়। হল?

ক্যাবলা বললে, হল। আর পথের বিবরণ দরকার নেই, গল্পটা বলল।

গল্প!–টেনিদা মুখটাকে গাজরের হালুয়ার মতো করে বললে, এমন একটা জলজ্যান্ত সত্যি ঘটনা, আর তুই বলছিস গল্প! শিগগির উইথড্র কর–নইলে এক চড়ে তোর নাক

আমি বললুম, নাগপুরে উড়ে যাবে।

ক্যাবলা বললে, বুঝেছি। আচ্ছা আমি উইথড্র করলুম। কিন্তু টেনিদা ইংরেজীতে উচ্চারণ উইথড্র নয়।

আবার পণ্ডিতী! টেনিদা গর্জন করল : টেক কেয়ার ক্যাবলা, ফের যদি বিচ্ছিরি একটা কুরুবকের মতো বকবক করবি তো এক্ষুনি একটা পুঁদিচ্চেরি হয়ে যাবে বলে দিচ্ছি তোকে। যা শিগগির আট আনার ঝাল-মুড়ি কিনে আন– তোর ফাইন!

আলুভাজা-আলুভাজা মুখ করে ক্যাবলা ফাইন আনতে গেল। ওর দুর্গতিতে আমরা কেউ দুঃখিত হলুম না বলাই বাহুল্য। সব কথাতেই ক্যাবলা ওরকম টিকটিকির মত টিকটিক করে।

বুঝলি ঝালমুড়ি চিবুতে চিবুতে টেনিদা বলতে লাগল : ছ দিনের জন্যে তো বেড়াতে গেছি মোক্ষদা মাসির বাড়িতে। মেসোমশাই ব্যবসা করেন আর মাসিমা যা রাঁধেন না, খেলে অজ্ঞান হয়ে যাবি। মাসির রান্না বাটি-চচ্চড়ি একবার খেয়েছিস তো ওখান থেকে নড়তেই চাইবি না–ঘুঁটেপাড়াতেই ঘুঁটের মতো লেপটে থাকবি।

আমার খুব মনের জোর, তাই বাটি-চচ্চড়ি আর ক্ষীরপুলির লোভ কাটিয়েও কলকাতায় ফিরে আসি। সেবারেও গেছি- দুটো দিন একটু ভালোমন্দ খেয়ে আসতে। ভরা শ্রাবণ, থেকে থেকেই ঝুপঝাপ বৃষ্টি। সেদিন সকালে মাসিমা তালের বড়া ভেজে ভেজে তুলছেন। আর আমি একটার-পর-একটা খেয়ে যাচ্ছি, এমন সময় কটা ছেলে এসে হাজির।

অনেকবার তো ঘুঁটেপাড়ায় যাচ্ছি, ওরা সবাই আমায় চেনে। বললে, টেনিবাবু, বড় বিপদে পড়ে আপনার কাছে ছুটে এলুম। আজ বিকেলে শিবতলার মাঠে বিচালিগ্রমের সঙ্গে আমাদের ফুটবল ম্যাচ। ওরা ছজন প্লেয়ার কলকাতা থেকে হায়ার করেছে, আমরাও ছজন এনেছি। কিন্তু মুশকিল হল, আমাদের এখানকার একজন জাঁদরেল খেলোয়াড় হঠাৎ অসুস্থ হয়ে পড়েছে। আপনাকেই আমাদের উদ্ধার করতে হচ্ছে দাদা।

জানিস তো, লোকের বিপদে আমার হৃদয় কেমন গলে যায়। তবু একটু কায়দা করে বললুম, সব হায়ার করা ভালোভালো প্লেয়ার, ওদের সঙ্গে কি আর আমি খেলতে পারব? তা ছাড়া এবছরে তেমন ফর্ম নেই আমার। ওরা তো শুনে হেসেই অস্থির।

কী যে বলেন স্যার, আপনি পটলডাঙার টেনিরাম শর্মা- আপনার ফর্ম তো সব কাজে সব সময়েই থাকে। প্রেমেন মিত্তিরের ঘনাদা, হেমেন্দ্রকুমারের জয়ন্ত, শিব্রামের হর্ষবর্ধন–এদের ফর্ম কখনও পড়তে দেখেছেন?

আমি হাতজোড় করে প্রণাম করে বললুম, ঘনাদা, জয়ন্ত, হর্ষবর্ধনের কথা বললেন–ওঁরা দেবতা– আমি তো স্রেফ নস্যি। ওঁরা যদি গরুড় পাখি হন, আমি স্রেফ চড়ুই।

ওরা বললে, অত বুঝিনে দাদা, আপনাকে ছাড়ছিনে। আমাদের ধারণা, মোহনবাগান ইস্টবেঙ্গল তো তুচ্ছ– আপনি ইচ্ছা করলে বিশ্ব একাদশে খেলতে পারেন। আর আপনি যদি চড়ুই পাখি হন, আমরা তো তা হলে–কী বলে, মশা।

আমি বললুম, ঘুঁটেপাড়ার মশাকে তুচ্ছ করবেন না মশাই, এক-একটা প্রায় এক ইঞ্চি লম্বা।

ওরা হেঁ-হেঁ করে চলে গেল, কিন্তু আমাকে রাজি করিয়েও গেল। আমার ভীষণ ভাবনা হল রে। থান্ডার ক্লাবে যা খেলি– তা খেলি, কিন্তু অতগুলো এ-ডিভিসন বি-ডিভিসন খেলোয়াড়ের সামনে! ওরা না হয় আপ করে গেল, কিন্তু আমি দাঁড়াব কী করে?

কিন্তু ফিরিয়েও তো দেওয়া যায় না। আমার নিজের প্রেস্টিজ-পটলডাঙার প্রেস্টিজ সব বিপন্ন! কোন্ দেবতাকে ডাকি ভাবতে-ভাবতে হঠাৎ মা নেংটীশ্বরীকে মনে পড়ে গেল। আরে সেই নেংটীশ্বরী- আরে সেই যে রে-কম্বল নিরুদ্দেশ-এর ব্যাপারে যে-দেবতাটির সঙ্গে আমাদের দেখা হয়ে গিয়েছিল। মনে-মনে বলতে লাগলুম, এ-বিপদে তুমিই দয়া করো মা–গোটা কয়েক নেংটি ইঁদুর পাঠিয়ে দাও তোমার–খেলার সময় ওদের পায়ে কুটুরকুটুর করে কামড়ে দিক। নিদেনপক্ষে পাঠাও সেই অবকাশরঞ্জিনী বাদুড়কে– সে ওদের সকলের চাঁদি ঠুকরে বেড়াক।

এসব প্রার্থনা-ট্রার্থনা করে শ-দেড়েক তালের বড়া খেয়ে আবার বেশ একটা তেজ এসে গেল। কেবল মনে হতে লাগল, আজ একটা এসপার-ওসপার হয়ে যাবে। তখন কি জানি, গুনে-গুনে বত্রিশটা গোল দিতে পারব, আমি একাই?

বিকেলে আকাশ জুড়ে কালো কালো হাতির পালের মতো মেঘ। মনে হল, দুর্দান্ত বৃষ্টি নামবে। তবু মাঠে গিয়ে দেখি বিস্তর লোক জড়ো হয়ে গেছে। এক দল হাঁকছে : বিচালিগ্রাম হিপ হিপ হুররে আর এক দল সমানে উত্তর চড়াচ্ছে : ঘুঁটেপাড়া হ্যাপ-হ্যাপ-হ্যাররে।

ক্যাবলা হঠাৎ আঁতকে উঠল–হ্যাপ-হ্যাপ-হ্যাররে মানে কী? কখনও তো শুনিনি।

-ওটা ঘুঁটেপাড়ার নিজস্ব স্লোগান। ওরা হিপ-হিপ বলছে কিনা, তাই পালটা জবাব। ওরাও যদি হিপ-হিপ করে, তা হলে এরা বলবে না, এদের নকল করছে? ওরা যদি বলত বিচালিগ্রাম জিন্দাবাদ–এরা সঙ্গে সঙ্গে বলত ঘুঁটেপাড়া মুর্দাবাদ।

–হ্যাঁ, মুর্দাবাদ! নিজেদেরই?

হ্যাঁ, নিজেদেরই। পরের নকল করে অপমান হওয়ার চাইতে মরে যাওয়া ভালো বুঝলি না?

-বিলক্ষণ! আচ্ছা বলে যাও।

–এতেই বুঝতে পারছিস, দুটো গ্রামে রেষারেষি কী রকম। দারুণ চিৎকারের মধ্যে তো খেলা শুরু হল। দু-মিনিটের মধ্যেই বুঝতে পারলুম, বিচালিগ্রামকে এঁটে ওঠা অসম্ভব। এরা ছজনেই এ-ডিভিশনের প্লেয়ার এনেছে–খেলায় তাদের আগুন ছোটে। আর ওদের গোলকিপার! সে একবারে ছহাত লাফিয়ে ওঠে, তার লম্বা লম্বা হাত বাড়িয়ে বল তো বল, বন্দুকের গুলি অব্দি পাকড়ে নিতে পারে।

ঘুঁটেপাড়ায় মাত্র দুজন এ-ডিভিশনের, বাকি চারজনই বি-ডিভিশনের। এ-মার্কা দুজনও ওদের তুলনায় নিরেস। খেলা শুরু হতে না হতেই বল এসে একেবারে ঘুঁটেপাড়ার ব্যাক লাইনে চেপে পড়ল, মাঝ-মাঠও আর পেরোয় না। আর ওদের গোলকিপার শুনিয়ে-শুনিয়ে বলতে লাগল : একটা বালিশ আর শতরঞ্চি দাও হে– একটু ঘুমিয়ে নেব।

আমি আর কী করব- মিডফিলডে দাঁড়িয়ে আছি, দাঁড়িয়েই আছি। নিতান্তই ঘুঁটেপাড়ার বাকি দশজনই ডিফেন্স লাইনে দাঁড়িয়ে আছে তাই গোল হচ্ছে না কিন্তু দেখতে-দেখতে ওরা গোটা পাঁচেক কর্নার কিক পেয়ে গেল। আর কতক্ষণ ঠেকাবে।

আমি তখনও মা নেংটিশ্বরীকে ডাকছি তো ডাকছিই। এমন সময় আকাশ ভেঙে ঝমঝম বৃষ্টি। এমন বৃষ্টি যে চারদিক অন্ধকার। কিন্তু পাড়াগেঁয়ে লোক, আর কলকাত্তাই খেলোয়াড়ের গোঁ-খেলা দাপটে চলতে লাগল। বল জলে ভাসছে- ধপাধপ আছাড়–এই ফাঁকেও পর-পর দুখানা গোল খেয়ে গেল ঘুঁটেপাড়া। ভাবলুম-যাঃ, হয়ে গেল।

বিচালিগ্রাম তারস্বরে চিৎকার করছে, হঠাৎ এদিকের লাইন্সম্যান ফ্ল্যাগ ফেলে মাঠে ঝাঁপিয়ে পড়ল। বললে, শিবতলার পুকুরে ভেসেছে রে– মাঠ ভর্তি মাছ!

অ্যাঁ-মাছ!

দেখতে দেখতে যেন ম্যাজিক। গাঁয়ের লোকে বর্ষায় পুকুর-ভাসা মাছ তো ধরেই, কলকাতার ছেলেগুলোও আনন্দে কেঁপে গেল। রইল খেলা, রইল বিচালিগ্রাম আর ঘুঁটেপাড়ার কম্পিটিশন– তিনশো লোক আর একুশজন খেলোয়াড়, দুজন লাইন্সম্যান সবাই কপাকপ মাছ ধরতে লেগে গেল। প্লেয়াররা জার্সি খুলে ফেলে তাতেই টকাটক মাছ তুলতে লাগল। খেলতে আর বয়ে গেছে তাদের।

এই রে, মস্ত একটা শোলমাছ পাকড়েছি।

আরে–একটা বাটামাছের ঝাঁক যাচ্ছে রে।

ইস–কী বড় বড় কই মাইরি। ধরধর

সে যে একখানা কী কাণ্ড, তোদের আর কী বলব। খেলার মাঠ ছেড়ে ক্রমেই দূরে-দূরে ছড়িয়ে পড়তে লাগল সবাই। শেষে দেখি, মাঠে আমরা দুজন। আমি আর রেফারি।

রেফারি ওখানকার স্কুলের ড্রিল-মাস্টার। বেজায় মারকুটে, ভীষণ রাগী। দাঁত খিঁচিয়ে বললেন, হাঁ করে দাঁড়িয়ে আছো কী? ইয়ু গো অন প্লেয়িং।

ঘাবড়ে গিয়ে বললুম, আমি একাই খেলব?

ইয়েস– একাই খেলবে। আমি তো খেলা বন্ধ করিনি।–ধমক দিয়ে রেফারি বললেন, খেলো। প্লেয়াররা মাঠ ছেড়ে মাছ ধরতে দৌড়লে খেলা বন্ধ করে দিতে হবে, রেফারিগিরির বইতে এমন কোনও আইন নেই।

তখন শুরু হল আমার গোল দেবার পালা। একবার করে বল নিয়ে গিয়ে গোল দিয়ে আসি, আর রেফারি ফুরর করে বাঁশি বাজিয়ে আবার সেন্টারে নিয়ে আসে। এই-ই চলতে লাগল।

ওদের দু-একজন বোধহয় টের পেয়ে ফেরবার কথা ভাবছিল, এমন সময় মা নেংটীশ্বরীর আর-এক দয়া। মাঠের কাছেই ছিল সারে সারে তালগাছ। হঠাৎ হু-হু করে ঝোড়ো হাওয়া, আর ঝপাসঝপাস করে পাকা তাল পড়তে লাগল।

তাল পড়ছে– তাল পড়ছে—

যারা ফিরতে যাচ্ছিল, তারা প্রাণপণে ছুটল তাল কুড়োতে।

এর মধ্যে আমি যা গোল দেবার দিয়েছি– মানে গুনে-গুনে বত্রিশটি। আমি গুনছি না, গোল দিতে দিতে আমার মাথা বোঁ-বোঁ করছে, আর ওই ভারি ভেজা বল বারবার সেন্টার থেকে জলের ওপর দিয়ে ঠেলে নিয়ে যাচ্ছি–চাড্ডিখানা কথা নাকি! একবার বলেছিলুম, অনেক তো গোল দিয়েছি স্যার, আর পারছি না–পা ব্যথা করছে। রেফারি আমায় তেড়ে মারতে এলেন, বিকট মুখ ভেংচে বললেন, ইয়ু গো অন গোলিং–আই সে।

গোলিং আবার ইংরেজী হয় নাকি ক্যাবলা বলতে যাচ্ছিল, টেনিদা একটা বাঘা ধমক দিয়ে বললে, ইয়ু শাটু আপ! যে মারকুটে মাস্টার, তার ইংরেজীর ভুল ধরবে কে? আমি গোল দিচ্ছি আর উনি গুনেই যাচ্ছেন, থার্টি–থার্টিওয়ান-থার্টিটু।

ওরে গোল দিচ্ছে বুঝি– বলে ওদের সেই গোলকিপারটা দৌড়ে এল। সে যে রকম জাঁদরেল, হয়তো একাই বত্রিশটা গোল ফেরত দিত, আমি আটকাতে পারতুম না– বেদম হয়ে গেছি তখন। কিন্তু রেফারি তক্ষুনি ফাইন্যাল হুইসেল বাজিয়ে দিলেন। দিয়ে বললেন, খেলা ফিনিশ। তারপর আমাকে বললেন, এখন যাও কই মাছ ধরো গে, তাল কুড়োও গে।

কিন্তু তখন কি আর মাছ, তাল কিছু আছে? খেলা ফিনিশের সঙ্গে তাও ফিনিশ। অতগুলো লোক!

টেনিদা একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল : তখন প্রাণের আনন্দে মাছ ধরে আর তাল কুড়িয়ে বিচালিগ্রাম চিল্লোতে লাগল : থ্রি চিয়ার্স ফর বিচালিগ্রাম, আর ঘুঁটেপাড়া চ্যাঁচাতে লাগল : থ্রি টিয়ার্স ফর ঘুঁটেপাড়া!

টিয়ার্স? মানে চোখের জল?-ক্যাবলা আবার বিস্মিত হল। হ্যাঁ–টিয়ার্স। পালটা জবাব দিতে হবে না? সে যাক। কিন্তু একটা ম্যাচে একাই বত্রিশটা গোল দিলুম, পেলে-ইউসেবিয়ো-রিভেরা-চার্লটন কাত করে দিলুম, কিন্তু একটা কই মাছ, একটা তালও পেলুম না–এ-দুঃখ মরলেও আমার যাবে না রে। –আবার বুকভাঙা দীর্ঘশ্বাস ফেলল টেনিদা।

চামচিকে আর টিকিট চেকার

বুঝলি প্যালা, চামচিকে ভীষণ ডেঞ্জারাস!…

একটা ফুটো শাল পাতায় করে পটলডাঙার টেনিদা ঘুগনি খাচ্ছিল। শালপাতার তলা দিয়ে হাতে খানিক ঘুগনির রস পড়েছিল, চট করে সেটা চেটে নিয়ে পাতাটা তালগোল পাকিয়ে ছুঁড়ে দিলে ক্যাবলার নাকের ওপর। তারপর আবার বললে, হুঁ হুঁ, ভীষণ ডেঞ্জারাস চামচিকে।

কী কইর‍্যা বোঝলা-কও দেখি?

বিশুদ্ধ ঢাকাই ভাষায় জানতে চাইল হাবুল সেন।

–আচ্ছা, বল চামচিকের ইংরেজী কী?

আমি, ক্যাবলা আর হাবুল সেন মুখ চাওয়া-চাওয়ি করলাম।

বল না।

শেষকালে ভেবে-চিন্তে ক্যাবলা বললে, স্মল ব্যাট। মানে ছোট বাদুড়!

–তোর মুণ্ডু।

আমি বললাম, তবে ব্যাটলেট। তা-ও নয়? তা হলে? ব্যাটস সান–মানে, বাদুড়ের ছেলে? হল না? আচ্ছা, ব্রিক ব্যাট কাকে বলে?

টেনিদা বললে থাম উল্লুক! ব্রিক ব্যাট হল থান ইট। এবার তাই একটা তোর মাথায় ভাঙব।

হাবুল সেন গম্ভীর মুখে বললে, হইছে।

কী হল?

–স্কিন মোল।

–স্কিন মোল?…টেনিদা খাঁড়ার মতো নাকটাকে মনুমেন্টের মতো উঁচু করে ধরল, সে আবার কী?

স্কিন মানে হইল চাম– অর্থাৎ কিনা চামড়া। আর আমাগো দ্যাশে ছুঁচারে কয় চিকা– মোল। দুইটা মিলাইয়া স্কিন মোল।

টেনিদা খেপে গেল : দ্যাখ হাবুল, ইয়ার্কির একটা মাত্রা আছে, বুঝলি? স্কিন মোল। ইঃ–গবেষণার দৌড়টা দেখ একবার।

আমি বললাম, চামচিকের ইংরেজী কী তা নিয়ে আমাদের জ্বালাচ্ছ কেন? ডিক্সনারি দ্যাখো গে!

–ডিক্সনারিতেও নেই। টেনিদা জয়ের হাসি হাসল।

তা হলে?

–তা হলে এইটাই প্রমাণ হল চামচিকে কী ভীষণ জিনিস! অর্থাৎ এমন ভয়ানক যে চামচিকেকে সাহেবরাও ভয় পায়! মনে কর না- যারা আফ্রিকার জঙ্গলে গিয়ে সিংহ আর গরিলা মারে, যারা যুদ্ধে গিয়ে দমাদম বোমা আর কামান ছোড়ে, তারা সুদ্ধ চামচিকের নাম করতে ভয় পায়। আমি নিজের চোখেই সেই ভীষণ ব্যাপারটা দেখেছি।

কী ভীষণ ব্যাপার?–গল্পের গন্ধে আমরা তিনজনে টেনিদাকে চেপে ধরলাম : বলল এক্ষুনি।

ক্যাবলা, তাহলে চটপট যা। গলির মোড় থেকে আরও দুআনার পাঁঠার ঘুগনি নিয়ে আয়। রসদ না হলে গল্প জমবে না।

ব্যাজার মুখে ক্যাবলা ঘুগনি আনতে গেল। দুআনার ঘুগনি একাই সবটা চেটেপুটে খেয়ে, মানে আমাদের এক ফোঁটাও ভাগ না দিয়ে, টেনিদা শুরু করলে : তবে শোন

সেবার পাটনায় গেছি ছোটমামার ওখানে বেড়াতে। ছোটমামা রেলে চাকরি করে– আসার সময় আমাকে বিনা টিকিটেই তুলে দিলে দিল্লি এক্সপ্রেসে। বললে, গাড়িতে চ্যাটার্জি যাচ্ছে ইনচার্জ– আমার বন্ধু। কোনও ভাবনা নেই–সেই-ই তোকে হাওড়া স্টেশনের গেট পর্যন্ত পার করে দেবে!

নিশ্চিন্ত মনে আমি একটা ফাঁকা সেকেন্ড ক্লাস কামরায় চড়ে লম্বা হয়ে পড়লাম।

শীতের রাত। তার ওপর পশ্চিমের ঠাণ্ডা-হাড়ে পর্যন্ত কাঁপুনি ধরায়।

কিন্তু কে জানত সেদিন হঠাৎ মাঝপথেই চ্যাটার্জির ডিউটি বদলে যাবে। আর তার জায়গায় আসবে কী নাম ওর– মিস্টার রাইনোসেরাস।

ক্যাবলা বললে, রাইনোসেরাস মানে গণ্ডার।

-থাম, বেশি বিদ্যে ফলাসনি।…টেনিদা দাঁত খিঁচিয়ে উঠল, যেন ডিক্সনারি একেবারে। সায়েবের বাপ-মা যদি ছেলের নাম গণ্ডার রাখে তাতে তোর কী র‍্যা? তোর নাম যে কিশলয় কুমার না হয়ে ক্যাবলা হয়েছে, তাতে করে কী ক্ষতি হয়েছে শুনি?

হাবুল সেন বললে, ছাড়ান দাও- ছাড়ান দাও। পোলাপান!

–হুঁ, পোলাপান! আবার যদি বকবক করে তো: জলপান করে ছাড়ব! যাক শোন। আমি তো বেশ করে গাড়ির দরজা-জানালা এঁটে শুয়ে পড়েছি। কিন্তু কিছুতেই ঘুম আসছে না। একে দুখানা কম্বলে শীত কাটছে না, তার ওপরে আবার খাওয়াটাও হয়ে গেছে বড্ড বেশি। মামাবাড়ির কালিয়ার পাঁঠাটা যেন জ্যান্ত হয়ে উঠে গাড়ির তালে তালে পেটের ভেতর শিং দিয়ে ঢুঁ মারছে। লোভে পড়ে অতটা না খেয়ে ফেলেই চলত।

পেট গরম হয়ে গেলেই লোকে নানা রকম দুঃস্বপ্ন দেখে– জানিস তো? আমিও স্বপ্ন দেখতে লাগলাম, আমার পেটের ভেতরে সেই যে বাতাপি না ইম্বল কে একটা ছিল– সেইটে পাঁঠা হয়ে ঢুকেছে। একটা রাক্ষস হিন্দী করে বলছে : এ ইম্বল– আভি ইসকো পেট ফাটাকে নিকাল আও–

বাপরে বলে আমি চেঁচিয়ে উঠলাম! চোখ চেয়ে দেখি, গাড়ির ভেতরে বাতাপি বা ইম্বল কেউ নেই– শুধু ফরফর করে একটা চামচিকে উড়ছে। একেবারে বোঁ করে আমার মুখের সামনে দিয়ে উড়ে চলে গেল–নাকটাই খিমচে ধরে আর কি!

এ তো আচ্ছা উৎপাত।

কোন দিক দিয়ে এল কে জানে? চারিদিকে তো দরজা-জানালা সবই বন্ধ। তবে চামচিকের পক্ষে সবই সম্ভব। মানে অসাধ্য কিছু নেই।

একবার ভাবলাম, উঠে ওটাকে তাড়াই। কিন্তু যা শীতকম্বল ছেড়ে নড়ে কার সাধ্যি। তা ছাড়া উঠতে গেলে পেট ফুঁড়ে শিং-টিং সুষ্ঠু পাঁঠাটাই বেরিয়ে আসবে হয়তো বা। তারপর আবার যখন সাঁ করে নাকের কাছে এল, তখন বসে পড়ে আর কি। আমার খাড়া নাকটা দেখে মনুমেন্টের ডগাই ভাবল বোধ হয়।

আমি বিচ্ছিরি মুখ করে বললাম, ফর-র-ফুস!–মানে চামচিকেটিকে ভয় দেখালাম। তাইতেই আঁতকে গেল কি না কে জানে সাঁ করে গিয়ে ঝুলে রইল একটা কোট-হ্যাঙ্গারের সঙ্গে। ঠিক মনে হল, ছোট একটা কালো পুঁটলি ঝুলছে!

ঠিক অমনি সময় ঘটাঘট শব্দে কামরার দরজা নড়ে উঠল।

এত রাত্তিরে কে আবার জ্বালাতে এল? নিশ্চয় কোনও প্যাসেঞ্জার। প্রথমটায় ভাবলাম, পড়ে থাকি ঘাপটি মেরে। যতক্ষণ খুশি খটখটিয়ে কেটে পড়ুক লোকটা। আমি কম্বলের ভেতরে মুখ ঢোকালাম।

কিন্তু কী একটা যাচ্ছেতাই স্টেশনে যে গাড়িটা থেমেছে কে জানে! সেই যে দাঁড়িয়ে আছে–একদম নট নড়নচড়ন! যেন নেমন্তন্ন খেতে বসেছে! ওদিকে দরজায় খটখটানি সমানে চলতে লাগল। ভেঙে ফেলে আর কি!

এমন বেয়াক্কেলে তোক তো কখনও দেখিনি! ট্রেনে কি আর কামরা নেই যে এখানে এসে মাথা খুঁড়ে মরছে! ভারি রাগ হল। দরজা না খুলেও উপায় নেই- রিজার্ভ গাড়ি তো নয় আর। খুব কড়া গলায় হিন্দীতে একটা গালাগাল দেব মনে করে উঠে পড়লাম।

ক্যাবলা হঠাৎ বাধা দিয়ে বললে, তুমি মোটেই হিন্দী জানো না টেনিদা!

–মানে?

–তুমি যা বললো তা একেবারেই হিন্দী হয় না। আমি ছেলেবেলা থেকে পশ্চিমে ছিলাম

-চুপ কর বলছি ক্যাবলা!–টেনিদা হুঙ্কার ছাড়ল; ফের যদি ভুল ধরতে এসেছিস তো এক চাঁটিতে তোকে চাপাটি বানিয়ে ফেলব! আমার হিন্দী শুনে বাড়ির ঠাকুর পর্যন্ত ছাপরায় পালিয়ে গেল, তা জানিস?

হাবুল বললে, ছাইড়্যা দাও– চ্যাংড়ার কথা কি ধরতে আছে?

–চ্যাংড়া! চিংড়িমাছের মতো ভেজে খেয়ে ফেলব। আমি বললাম, ওটা অখাদ্য জীব– খেলে পেট কামড়াবে, হজম করতে পারবে না। তার চেয়ে গল্পটা বলে যাও।

–হুঁ, শোন! টেনিদা ক্যাবলার ছ্যাবলামি দমন করে আবার বলে চলল :

উঠে দরজা খুলে যেই বলতে গেছি এই আপ কেইসা আদমি হ্যায় সঙ্গে সঙ্গে গাঁক গাঁক করে আওয়াজ।

–গাঁক—গাঁক?

–মানে সায়েব। মানে টিকিট চেকার।

–সেই রাইনোসেরাস? বকুনি খেয়েও ক্যাবলা সামলাতে পারল না।

–আবার কে? একদম খাঁটি সায়েব-পা থেকে মাথা ইস্তক।

সেই যে একরকম সায়েব আছে না? গায়ের রং মোষের মতো কালো, ঘামলে গা দিয়ে কালি বেরোয় তাদের দেখলে সায়েবের ওপরে ঘেন্না ধরে যায় মোটেই সেরকমটি নয়। চুনকাম করা ফর্সা রঙ হাঁড়ির মতো মুখ, মোটা নাকের ছ্যাঁদায় বড় বড় লালচে লোম হাসলে মুখ ভর্তি মুলো দেখা যায়, আর গলার আওয়াজ শুনলে মনে হয় ষাঁড় ডাকছে একেবারে সেই জিনিসটি। ঢুকেই চোস্ত ইংরেজীতে আমাকে বললে, এই সন্ধেবেলাতেই এমন করে ঘুমোচ্ছ কেন? এইটেই সবচেয়ে বিচ্ছিরি হ্যাবিট।

কী রকম চোস্ত ইংরেজী টেনিদা? আমি জানতে চাইলাম।

–সেসব শুনে কী করবি?…টেনিদা উঁচু দরের হাসি হাসল! শুনেও কিছু বুঝতে পারবি না–সায়েবের ইংরেজী কিনা! সে যাক। সায়েবের কথা শুনে আমার তো চোখ কপালে উঠল রাত বারোটাকে বলছে সন্ধেবেলা। তা হলে ওদের রাত্তির হয় কখন? সকালে নাকি?

তারপরেই সায়েব বললে, তোমার টিকিট কই?

আমার তো তৈরি জবাব ছিলই। বললাম, আমি পাটনার বাঁড়ুজ্যে মশাইয়ের ভাগনে। আমার কথা ক্রু-ইন-চার্জ চাটুজ্যেকে বলা আছে।

তাই শুনে সায়েবটা এমনি দাঁত খিচোল যে, মনে হল মুলোর দোকান খুলে বসেছে। নাকের লোমের ভেতরে যেন ঝড় উঠল, আর বেরিয়ে এল খানিকটা গরগরে আওয়াজ।

যা বললে, শুনে তো আমার চোখ চড়ক গাছ।

–তোমার বাঁড়ুজ্যে মামাকে আমি থোরাই পরোয়া করি। এসব ডাবলুটিরা ওরকম ঢের মামা পাতায়। তা ছাড়া চাটুজ্যের ডিউটি বদল হয়ে গেছে আমিই এই ট্রেনের ক্রু-ইন-চার্জ। অতএব চালাকি রেখে পাটনা-টু-হাওড়া সেকেন্ড ক্লাস ফেয়ার আর বাড়তি জরিমানা বের করো।

পকেটে সব সুদ্ধ পাঁচটা টাকা আছে- সেকেন্ড ক্লাস দূরে থাক, থার্ড ক্লাসের ভাড়াও হয় না; সর্ষের ফুল এর আগে দেখিনি এবার দেখতে পেলাম। আর আমার গা দিয়ে সেই শীতেও দরদর করে সর্ষের তেল পড়তে লাগল।

আমি বলতে গেলাম, দ্যাখো সায়েব–

-সায়েব সায়েব বোলো না–আমার নাম মিস্টার রাইনোসেরাস। আমার গণ্ডারের মতো গোঁ। ভাড়া যদি না দাও- হাওড়ায় নেমে তোমায় পুলিশে দেব। ততক্ষণে আমি গাড়িতে চাবি বন্ধ করে রেখে যাচ্ছি।

কী বলব জানিস প্যালা– আমি পটলডাঙার টেনিরাম- অমন ঢের সায়েব দেখেছি। ইচ্ছে করলেই সায়েবকে ধরে চলতি গাড়ির জানলা দিয়ে ফেলে দিতে পারতাম। কিন্তু আমরা বোষ্টুম–জীবহিংসা করতে নেই, তাই অনেক কষ্টে রাগটা সামলে নিলাম।

হাবুল সেন বলে বসল : জীবহিংসা কর না, তবে পাঁঠা খাও ক্যান?

–আরে পাঁঠার কথা আলাদা। ওরা হল অবোলা জীব, বামুনের পেটে গেলে স্বর্গে যায়। পাঁঠা খাওয়া মানেই জীবে দয়া করা! সে যাক। কিন্তু সায়েবকে নিয়ে এখন আমি করি কী? এ তো আচ্ছা প্যাঁচ কষে বসেছে! শেষকালে সত্যিই জেলে যেতে না হয়।

কিন্তু ভগবান ভরসা!

পকেট থেকে একটা ছোট খাতা বের করে সায়েব কী লিখতে যাচ্ছিল পেনসিল দিয়ে হঠাৎ সেই শব্দ—ফর-ফর-ফরাৎ!

চামচিকেটা আবার উড়তে শুরু করেছে। আমার মতোই তো বিনাটিকিটের যাত্রী চেকার দেখে ভয় পেয়েছে নিশ্চয়।

আর সঙ্গে সঙ্গেই সায়েব ভয়ানক চমকে উঠল। বললে, ওটা কী পাখি?

জবাব দিতে যাচ্ছিলাম, চামচিকে কিন্তু তার আগেই সায়েব হাঁইমাই করে চেঁচিয়ে উঠল। নাকের দিকে চামচিকের এত নজর কেন কে জানে- ঠিক সায়েবের নাকেই একটা ঝাঁপটা মেরে চলে গেল।

ওটা কী পাখি? কী বদখত দেখতে; সায়েব কুঁকড়ে এতটুকু হয়ে গেল! চুনকাম করা মুখটা তার ভয়ে পানসে হয়ে গেছে।

আমি বুঝলাম এই মওকা! বললাম, তুমি কি ও-পাখি কখনও দ্যাখোনি?

–নো-নেভার! আমি মাত্র ছমাস আগে আফ্রিকা থেকে ইণ্ডিয়ায় এসেছি। সিংহ দেখেছি- গণ্ডার দেখেছি কিন্তু

সায়েব শেষ করতে পারল না।

চামচিকেটা আর একবার পাক খেয়ে গেল। একটু হলেই প্রায় খিমচে ধরেছিল সায়েবের মুখ। বোধহয় ভেবেছিল, ওটা চালকুমড়ো।

সায়েব বললে, মিস্টার ও কি কামড়ায়?

আমি বললাম, মোক্ষম। ভীষণ বিষাক্ত! এক কামড়েই লোক মারা যায়। এক মিনিটের মধ্যেই।

–হোয়াট! বলে সায়েব লাফিয়ে উঠল। তারপরে আমার কম্বল ধরে টানাটানি করতে লাগল;

মিস্টার—প্লিজ–ফর গড সেক আমাকে একটা কম্বল দাও।

তারপর আমি ওর কামড়ে মারা যাই আর কি। ও সব চলবে না। আমি শক্ত করে কম্বল চেপে রইলাম।

–অ্যাঁ? তা হলে!–বলেই একটা অদ্ভুত কাণ্ড করে বসল সায়েব। বোঁ করে একেবারে চেন ধরে ঝুলে পড়ল প্রাণপণে। তারপর জানলা খুলে দিয়ে গলা ফাটিয়ে চ্যাঁচাতে লাগল। হেলপ-হেলপ–আর খোলা জানলা পেয়েই সাহেবের কাঁধের ওপর দিয়ে বাইরের অন্ধকারে চামচিকে ভ্যানিস।

সায়েব খানিকক্ষণ হতভম্ব হয়ে রইল। একটু দম নিয়ে মস্ত একটা নিঃশ্বাস ফেলে বললে, যাক–স্যামসিকেটা বাইরে চলে গেছে। এখন আর ভয় নেই–কী বলো?

আমি বললাম, না, তা নেই। তবে পঞ্চাশ টাকা জরিমানা দেবার জন্য তৈরি থাকো।

সাহেবের মুখ হাঁ হয়ে গেল : কেন?

–বিনা কারণে চেন টেনেছ গাড়ি থামল বলে। আর শোনো সায়েব- চামচিকে খুব লক্ষ্মী পাখি। কাউকে কামড়ায় না কাউকে কিছু বলে না। তুমি রেলের কর্মচারী হয়ে চামচিকে দেখে চেন টেনেছ–এ জন্যে তোমার শুধু ফাইন নয়– চাকুরিও যেতে পারে।

ওদিকে গাড়ি আস্তে আস্তে থেমে আসছে তখন। মিস্টার রাইনোসেরাস কেমন মিটমিট করে তাকাচ্ছে আমার দিকে। ভয়ে এখন প্রায় মিস্টার হেয়ার মানে খরগোশ হয়ে গেছে।

তারপরই আমার ডান হাত চেপে ধরল দুহাতে।

–শোনো মিস্টার, আজ থেকে তুমি আমার বুজুম ফ্রেণ্ড। মানে প্রাণের বন্ধু। তোমাকে আমি ফার্স্ট ক্লাস সেলুনে নিয়ে যাচ্ছি- দেখবে তোফা ঘুম দেবে। হাওড়ায় নিয়ে গিয়ে কেলনারের ওখানে তোমাকে পেট ভরে খাইয়ে দেব। শুধু গার্ড এলে বলতে হবে, গাড়িতে একটা গুণ্ডা পিস্তল নিয়ে ঢুকেছিল, তাই আমরা চেন টেনেছি। বলো–রাজি?

রাজি না হয়ে আর কী করি! এত করে অনুরোধ করছে যখন।

বিজয়গর্বে হাসলে টেনিদা : যা ক্যাবলা– আর চার পয়সার পাঁঠার ঘুগনি নিয়ে আয়।

চেঙ্গিস আর হ্যামলিনের বাঁশিওলা

টেনিদা বললে, আজকাল আমি খুব হিস্টরি পড়ছি।

আমরা বললুম, তাই নাকি।

যা একখানা বই হাতে পেয়েছি না, শুনলে তোদর চোখ কপালে উঠে যাবে। চুয়িং গামটাকে গালের আর একপাশে ঠেলে দিয়ে ক্যাবলা বললে, বইটার নাম কী, শুনি?

টেনিদা হযবরলর কাকেশ্বর কুচকুচের মতো গলায় বললে, স্তোরিয়া দে মোগোরা পুঁদিচ্চেরি বোনানজা বাই সিলিনি কামুচ্চি।

শুনে ক্যাবলার চশমাটা যেন এক লাফে নাকের নীচে ঝুলে পড়ল। হাবুল যেন আঁক করে একটা শব্দ করল। আমি একটা বিষম খেলুম।

ক্যাবলাই সামলে নিয়ে বললে– কী বললে?

স্তোরিয়া দে মোগোরা পুঁদিচ্চেরি—

থাক—থাক। এতেই যথেষ্ট। যতদূর বুঝছি দারুণ পুঁদিচ্চেরি।

আলবাত পুঁদিচ্চেরি! যাকে বাংলায় বলে ডেনজারাস। ল্যাটিন ভাষায় লেখা কিনা।

কুঁচো চিংড়ির মত মুখ করে হাবুল জিজ্ঞেস করলে, তুমি আবার ল্যাটিন ভাষা শিখলা কবে? শুনি নাই তো কোনওদিন।

খুশিতে টেনিদার নাকটা আট আনার সিঙাড়ার মতো ফুলে উঠল : নিজের গুণের কথা সব কী বলতে আছে রে। লজ্জা করে না? আমি আবার এ ব্যাপারে একটু—মানে মেফিস্টোফিলিস-বাংলায় যাকে বলে বিনয়ী।

ক্যাবলা বললে, ধেৎ! মেফিস্টোফিলিস মানে হল—

টেনিদা বললে, চোপ!

পশ্চিমে থাকার অভ্যেসটা ক্যাবলার এখনও যায়নি। মিইয়ে গিয়ে বললে, তব ঠিক হ্যায়, কোই বাত নেহি।

হ্যাঁ—কোই বাত নেহি।

এর মধ্যে হাবলা আমার কানে কানে বলছিল, হ ঘোড়ার ডিম, বিনয়ী না কচুর ঘণ্ট–কিন্তু টেনিদার চোখ এড়াল না। বাঘা গলায় জিজ্ঞেস করলে, হাবলা, হোয়াট সেয়িং? ইন প্যালাজ ইয়ার?

কিচ্ছু না টেনিদা, কিছু না।

কিচ্ছু না?—টেনিদা বিকট ভেংচি কাটল একটা : চালাকি পায়া হ্যায়? আমি তোকে চিনিনে? নিশ্চয়ই আমার বদনাম করছিলি। এক টাকার তেলেভাজা নিয়ে আয় এক্ষুনি।

আমার কাছে পয়সা নাই।

পয়সা নেই? ইয়ার্কি? ওই যে পকেট থেকে একটাকার নোট উঁকি মারছে একখানা? গো–কুইক—ভেরি কুইক—

.

তেলেভাজা শেষ করে টেনিদা বললে, দুঃখ করিসনি হাবলা এই যে ব্রাহ্মণ ভোজন করালি, তাতে বিস্তর পুণ্যি হবে তোর। আর সেই ব্যাটিন বইটা থেকে এখন এমন একখানা গপ্পো বলব না, যে তোর একটাকার তেলেভাজার ব্যথা বেমালুম ভুলে যাবি।

মুখ গোঁজ করে হাবুল বললে, হুঁ।

ক্যাবলা বললে, একটা কথা জিজ্ঞেস করব? হিস্টরির এমন চমৎকার বইখানা পাওয়া গেল কোথায়? ন্যাশনাল লাইব্রেরিতে নাকি?

ছোঃ! এ-সব বই ন্যাশনাল লাইব্রেরিতে পাওয়া যায়? ভীষণ রেয়ার। দাম কত জানিস? পঞ্চাশ হাজার টাকা।

অ্যাঃ।

ক্যাবলার চশমা লাফিয়ে আর একবার নেমে পড়ল। হাবুল কুট করে আমাকে চিমটি কাটল একটা, আমি চাটুজ্যেদের রোয়াক থেকে গড়িয়ে পড়তে-পড়তে সামলে নিলুম।

ক্যাবলা বোধ হয় আরও কিছু বলতে যাচ্ছিল, কিন্তু টেনিদা হঠাৎ চেঁচিয়ে উঠল :

স্টপ। অল সাইলেন্ট। আচ্ছা, হ্যামলিন শহরের সেই বাঁশিওয়ালার গল্পটা তোদের মনে আছে?

নিশ্চয়—নিশ্চয়–আমরা সাড়া দিলুম। সে-গল্প আর কে না জানে! শহরে ভীষণ ইঁদুরের উৎপাত বাঁশিওলা এসে তার জাদুকরী সুরে সব ইঁদুরকে নদীতে ড়ুবিয়ে মারল। শেষে শহরের লোকেরা যখন তার পাওনা টাকা দিতে চাইল না–তখন সে বাঁশির সুরে ভুলিয়ে সমস্ত বাচ্চা ছেলেমেয়েদের নিয়ে কোথায় যে পাহাড়ের আড়ালে চলে গেল, কে জানে!

টেনিদা বললে, চেঙ্গিস খাঁর নাম জানিস?

কে না জানে! যা নিষ্ঠুর আর ভয়ঙ্কর লোক!

টেনিদা বললে, চেঙ্গিস দেশে দেশে মানুষ মেরে বেড়াত কেন জানিস? হ্যামলিনের ওই বাঁশিওলাকে খুঁজে ফিরত সে। কোথাও পেত না, আর ততই চটে যেত, যাকে সামনে দেখত তারই গলা কুচ করে কেটে দিত।

ক্যাবলা বললে, এসব বুঝি ওই বইতে আছে?

আছে বইকি। নইলে আমি বানিয়ে বলছি নাকি? তেমন স্বভাবই আমার নয়।

আমরা একবাক্যে বললুম, না না, কখনও নয়।

টেনিদা খুশি হয়ে বললে, তা হলে মন দিয়ে শুনে যা। এ সব হিস্টরিক্যাল ব্যাপার, কোনও তক্কো করবিনে এ-নিয়ে। এখন হয়েছে কি, আগে মোঙ্গলদের দেশে লোকের বিরাট বিরাট গোঁফদাড়ি গজাত। এমন কি, ছেলেপুলেরা জন্মাতই আধ-হাত চাপদাড়ি আর চার ইঞ্চি

গোঁফ নিয়ে।

ক্যাবলা পুরনো অভ্যেসে বলে ফেলল :স্রেফ বাজে কথা। ওদের তো গোঁফ দাড়ি হয়ই বলতে গেলে।

ইউ-চোপ রাও!–টেনিদা চোখ পাকিয়ে বললে, ফের ডিসটার্ব করবি তো–

আমি বললুম, এক চড়ে তোর কান কানপুরে রওনা হবে।

ইয়াহ্– কারেকট।—টেনিদা আমার পিঠ চাপড়ে দেবার আগেই আমি তার হাতের নাগালের বাইরে সরে গেলুম : শুনে যা কেবল। সব হিস্টরি। দাড়ি আর গোঁফের জন্যেই মোঙ্গলরা ছিল বিখ্যাত। বারো হাত তেরো হাত করে লম্বা হত দাড়ি, গোঁফগুলো শরীরের দুপাশ দিয়ে পায়ের গোড়ালি পর্যন্ত ঝুলে পড়ত। তখন যদি মঙ্গোলিয়ায় যেতিস তো সেখানে আর তোক দেখতে পেতিস না, খালি মনে হত চারদিকে কেবল গোঁফ-দাড়িই হেঁটে বেড়াচ্ছে। কী বিটকেল ব্যাপার বল দিকি?

ওই রকম পেল্লায় দাড়ি নিয়ে হাঁটত কী করে?–আমি ধাঁধায় পড়ে গেলুম।

করত কী, জানিস? দাড়িটাকে পিঠের দিকে ঘুরিয়ে নিয়ে ঠিক বস্তার মতো করে বেঁধে রাখত। আর গোঁফটা মাথার ওপর নিয়ে গিয়ে বেশ চুড়োর মতো করে পাকিয়ে

হাবুল বললে, খাইছে।–বলেই আকাশজোড়া হাঁ করে একটা।

অমনভাবে হাঁ করবিনে হাবলা—টেনিদা হাত বাড়িয়ে কপ করে হাবুলের মুখটা বন্ধ করে দিলে : মুড নষ্ট হয়ে যায়। খোদ চেঙ্গিসের দাড়ি ছিল কত লম্বা, তা জানিস? আঠারো হাত। বারো হাত গোঁফ। যখন বেরুত তখন সাতজন লোক সঙ্গে সঙ্গে গোঁফ দাড়ি বয়ে বেড়াত। বিলেতে রানী-টানীদের মস্ত মস্ত পোশাক যেমন করে সখীরা বয়ে নিয়ে যেত না? ঠিক সেই রকম।

আর দাড়ি-গোঁফের জন্যে মোঙ্গলদের কী অহঙ্কার। তারা বলত, আমরাই পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ জাতি। এমন দাড়ি কোথাও খুঁজে পাবে নাকো তুমি, সকল দাড়ির রাজা সে যে-ই।

কিন্তু বুঝলি, সব সুখ কপালে সয় না। একদিন কোত্থেকে রাজ্যে ছারপোকার আমদানি হল, কে জানে! সে কী ছারপোকা। সাইজে বোধ হয় এক-একটা চটপটির মতন, আর সংখ্যায়—কোটি-কোটি, অবুদ, নিদ! কোথায় লাগে হ্যামলিন শহরের ইঁদুর!

সেই ছারপোকা তো দাড়িতে ঢুকেছে, গোঁফে গিয়ে বাসা বেঁধেছে। ছারপোকার জ্বালায় গোটা মঙ্গোলিয়া ইয়ে ব্বাস—গেছি রে—খেয়ে ফেললে রে বলে দাপাদাপি করতে লাগল। দুচারটে ধরা পড়ে বাকি সব যে দাড়ির সেই বাঘা জঙ্গলে কোথায় লুকিয়ে যায়, কেউ আর তার নাগাল পায় না! আর স্বয়ং সম্রাট চেঙ্গিস রাতে ঘুমুতে পারেন না—দিনে বসতে পারেন না—গেলুম গেলুম বলে রাতদিন লাফাচ্ছেন আর সঙ্গে লাফাচ্ছে দাড়ি-গোঁফ ধরে-থাকা সেই সাতটা লোক। গোটা মঙ্গোলিয়া যাকে বলে জেরবার হয়ে গেল!

হাবুল বললে, অত ঝাটে কাম কী, দাড়ি-গোঁফ কামাইয়া ফ্যালাইলেই তো চুইক্যা যায়।

কে দাড়ি কামাবে? মঙ্গোলিয়ানরা? যা না, বলে আয় না একবার চেঙ্গিস খাঁকে!—টেনিস বিদ্রুপ করে বললে, দাড়ি ওদের প্রেস্টিজ—গর্ব–বল না গিয়ে! এক কোপে মুণ্ডটি নামিয়ে দেবে।

হাবুল বললে, থাউক, থাউক, আর কাম নাই।

টেনিদা বলে চলল : হুঁ, খেয়াল থাকে যেন। যাই হোক, এমন সময় একদিন সম্রাটের সভায় এসে হাজির হ্যামলিনের সেই বাঁশিওলা। কিন্তু সভা আর কোথায়! দারুণ হট্টগোল সেখানে। পাত্র-মিত্র সেনাপতি-উজীর-নাজীর সব খালি লাফাচ্ছে, দাড়ি-চুল ঝাড়ছে—দুএকটা ছারপোকা বেমক্কা মাটিতে পড়ে গেল, সবাই চেঁচিয়ে উঠল : মার-মার—ওই যে–ওই–যে—

বাঁশিওলা করল কী, ঢুকেই পি করে তার বাঁশিটা দিলে বাজিয়ে। আর বাঁশির কী ম্যাজিক–সঙ্গে-সঙ্গে সভা স্তব্ধ! এমন কি দাড়ি-গোঁফের ভেতর ছারপোকাগুলো পর্যন্ত কামড়ানো বন্ধ করে দিলে। গম্ভীর গলায় বাঁশিওলা বললে, সম্রাট তেমুজিন

তেমুজিন আবার কোত্থেকে এল?—আমি জানতে চাইলুম।

ক্যাবলা বললে, ঠিক আছে। চেঙ্গিসের আসল নাম তেমুজিনই বটে।

টেনিদা আমার মাথায় কটাং করে একটা গাঁট্টা মারল, আমি আঁতকে উঠলাম।

হিস্টরি থেকে বলছি, বুঝেছিস বুরবক কোথাকার। সব ফ্যাক্টস! তোর মগজে তো কেবল খুঁটেক্যাবলা সমঝদার, ও জানে।

হাবুল বললে, ছাড়ান দাও—ছাড়ান দাও–প্যালাডা পোলাপান।

এইসব পোলাপানকে পেলে চেঙ্গিস্ খাঁ একেবারে জলপান করে ফেলত। যত সব ইয়ে—! একটু থেমে টেনিদা আবার শুরু করল : বাঁশিওলা বললে, সম্রাট তেমুজিন, আমি শহরের সব ছারপোকা এখনি নির্মূল করে দিতে পারি। একটিরও চিহ্ন থাকবে না। কিন্তু তার বদলে দশ হাজার মোহর দিতে হবে আমাকে।

ছারপোকার কামড়ে তখন প্রাণ যায় যায়, দশ হাজার মোহর তো তুচ্ছ। চেঙ্গিস বললেন, দশ হাজার মোহর কেন কেবল, পাঁচ হাজার ভেড়াও দেব তার সঙ্গে। তাড়াও দেখি ছারপোকা!

বাঁশিওলা তখন মাঠের মাঝখানে মস্ত একটা আগুন জ্বালাতে বললে। আগুন যেই জ্বলে উঠল, সঙ্গে সঙ্গে সে পিপিপি করে তার বাঁশিতে এক অদ্ভুত সুর বাজতে আরম্ভ করল। আর বললে– বিশ্বাস করবিনে—শুরু হয়ে গেল এক তাজ্জব কাণ্ড। দাড়ি-গোঁফ থেকে লক্ষ-লক্ষ কোটি-কোটি অবুদ-নির্বুদ ছারপোকা লাফিয়ে পড়ল মাটিতে–সবাই হাত-পা তুলে ট্যাঙ্গো-ট্যাঙ্গো জিঙ্গো-জিঙ্গো বলে হরিসংকীর্তনের মতো গান গাইতে গাইতে–

আমি আর থাকতে পারলুম না : ছারপোকা গান গায়।

চোপ—টেনিদা, হাবুল আর ক্যালা একসঙ্গে আমাকে থামিয়ে দিলে।

তখন সারা দেশ ছারপোকাদের নাচে-গানে ভরে গেল। চারদিক থেকে, সব দাড়ি-গোঁফ থেকে, কোটি-কোটি অবুদ-নিবুদ ছারপোকা লাইন বেঁধে নাচতে নাচতে গাইতে গাইতে গিয়ে। জয় পরমাত্ম্ বলে আগুনে ঝাঁপিয়ে পড়তে লাগল। ছারপোকা পোড়ার বিকট গন্ধে লোকের নাড়ি উলটে এল, নাকে দাড়ি চেপে বসে রইল সবাই।

দুঘণ্টার ভেতরেই মঙ্গোলিয়ার সব ছারপোকা ফিনিশ। সব দাড়ি, সব গোঁফ সাফ। কাউকে একটুও কামড়াচ্ছে না। চেঙ্গিস খোশ মেজাজে অর্ডার দিলেন রাজ্যের মহোৎসব চলবে সাতদিন।

বাঁশিওলা বললে, কিন্তু সম্রাট, আমার দশ হাজার মোহর? পাঁচ হাজার ভেড়া? আরে, দায় মিটে গেছে তখন, বয়ে গেছে চেঙ্গিসের টাকা দিতে। চেঙ্গিস বললেন, ইয়ার্কি? দশ হাজার মোহর, পাঁচ হাজার ভেড়া? খোয়াব দেখছিস নাকি? এই, দে তো লোকটাকে ছগণ্ডা পয়সা।

বাঁশিওয়ালা বললে, সম্রাট, টেক কেয়ার, কথার খেলাপ করবেন না। ফল তা হলে খুব ডেঞ্জারাস হবে।

অ্যাঁ! এ যে ভয় দেখায়! চেঙ্গিস চটে বললেন, বেতমিজ, কার সঙ্গে কথা কইছিস, তা জানিস? এই—কৌন হ্যায়—ইসকো কান দুটো কেটে দে তো।

কিন্তু কে কার কান কাটে? হ্যামলিনের বাঁশিওয়ালা তখন নতুন করে বাঁশিতে দিয়েছে ফঁ। আর সঙ্গে সঙ্গে আকাশ অন্ধকার করে উঠল ঝড়ের কালো মেঘ। চারদিকে যেন মধ্যরাত্রি নেমে এল। হু-হু করে দামাল বাতাস বইল আর সেই বাতাসে—

চড়াৎ–চড়াৎ-চড়াৎ

না, আকাশ জুড়ে মেঘ নয়–শুধু দাড়ি-গোঁফ। ঠোঁট থেকে, গাল থেকে চড়াৎ চড়াৎ করে সব উড়ে যেতে লাগল–জমাট বাঁধা দাড়ি-গোঁফের মেঘ আকাশ বেয়ে ছুটে চলল, আর সেই দাড়ির মেঘে, যেন গদির ওপর বসে, বাঁশি বাজাতে বাজাতে হ্যামলিনের বাঁশিওলাও উধাও।

আকাশ পরিষ্কার হয়ে গেলে সারা মঙ্গোলিয়া এ-ওর দিকে থ হয়ে চেয়ে রইল। জাতির গর্ব দাড়ি-গোঁফের প্রেস্টিজ—সব ফিনিশ! সব মুখ একেবারে নিখুঁত করে প্রায় কামানো, কারও কারও এখানে-ওখানে খাবলা-খাবলা একটু টিকে রয়েছে এই যা। সর্বনেশে বাঁশি। তাদের সর্বনাশ করে গেছে।

রইল মহোৎসব, রইল সব। একমাস ধরে তখন জাতীয় শোক। আর দাড়ি-গোঁফ সেই যে গেল, একবারেই গেল–মোঙ্গলদের সেই থেকে ওসব গজায়ই না, ওই দু-চারগাছা খাবলা খাবলা যা দেখতে পাস। হ্যামলিনের বাঁশিওলা-হুঁ হুঁ, তার সঙ্গে চালাকি!

আর সেই রাত্রেই চেঙ্গিস মানুষ মারতে বেরিয়ে পড়ল। বাঁশিওয়ালাকে তো পায় না–কাজে কাজেই যাকে সামনে দেখে, তার মুণ্ডুটিই কচাৎ! বুঝলি—এ হল রিয়্যাল ইতিহাস। স্তোরিয়া দে মোগোরা পুঁদিচ্চেরি বোনানজা বাই সিলিনি কামুচ্চি ফিফথ সেনচুরি বি-সি!

টেনিদা থামল।

ক্যাবলা বিড় বিড় করে বললে, সব গাঁজা।

ভালো করে টেনিদা শুনতে না পেয়ে বললে, কী বললি, প্রেমেন মিত্তিরের ঘনাদা, কী যে বলিস! তাঁর পায়ের ধুলো একটু মাথায় দিলে পারলে বর্তে যেতুম রে!

টিকটিকির ল্যাজ

ক্যাবলাদের বসবার ঘরে বসে রেডিয়োতে খেলার খবর শুনছিলুম আমরা। মোহনবাগানের খেলা। আমি, টেনিদা, আর ক্যাবলা খুব মন দিয়ে শুনছিলুম, আর থেকে-থেকে চিৎকার করছিলুম—গো-গো–গোল। দলের হাবুল সেন হাজির ছিল না–সে আবার ইস্টবেঙ্গলের সাপোর্টার। মোহনবাগানের খেলায় হাবলার কোনও ইন্টারেস্ট নেই।

কিন্তু চেঁচিয়েও বেশি সুবিধে হল না– শেষ পর্যন্ত একটা পয়েন্ট। আমাদের মন-মেজাজ এমনি বিচ্ছিরি হয়ে গেল যে, ক্যাবলার মার নিজের হাতে তৈরি গরম গরম কাটলেটগুলো পর্যন্ত খেতে ইচ্ছে করছিল না। এই ফাঁকে টেনিদা আমার প্লেট থেকে একটা কাটলেট পাচার করল- মনের দুঃখে আমি দেখেও দেখতে পেলুম না। কিছুক্ষণ উদাস হয়ে থেকে ক্যাবলা বললে, দ্যুৎ!

আমি বললুম, হুঁ।

টেনিদা হাড়-টাড় সুদ্ধ চিবিয়ে কাটলেটগুলো শেষ করল, তারপর কিছুক্ষণ খুব ভাবুকের মতো চেয়ে রইল সামনের দেয়ালের দিকে। একটা মোটা সাইজের টিকটিকি বেশ একমনে কুপকুপ করে পোকা খাচ্ছিল, তাকে লক্ষ্য করতে করতে টেনিদা বললে, ওই যে!

আমি জিজ্ঞেস করলুম, ওই যে, কী?

মোহনবাগান।

–মোহনবাগান মানে?

টিকটিকি। মানে টিকটিকির ল্যাজ।

শুনে আমি আর ক্যাবলা একসঙ্গে চেঁচিয়ে উঠলুম, খবরদার টেনিদা, মোহনবাগানের অপমান কোরো না।

টেনিদা নাক-টাক কুঁচকে মুখটাকে পাঁপর ভাজার মতো করে বললে, আরে খেলে যা। বললুম কী, আর কী বুঝল এ-দুটো!

–এতে বোঝবার কী আছে শুনি। তুমি মোহনবাগানকে টিকটিকির ল্যাজ বলছ

-চুপ কর প্যালা–মিথ্যে কুরবকের মতো বকবক করিসনি। যদি বাবা কচুবনেশ্বরের কথা জানতিস তা হলে বুঝতিস-টিকটিকির রহস্য কী!

কচুবনেশ্বর। সে আবার কী? এবার ক্যাবলার জিজ্ঞাসা।

–সে এক অত্যন্ত ঘোরালো ব্যাপার। যাকে ফরাসী ভাষায় বলে পুঁদিচ্চেরি!

–পুঁদিচ্চেরি তো পণ্ডিচেরি। সে তো একটা জায়গার নাম। ক্যাবলা প্রতিবাদ করল।

-শট আপ। জায়গার নাম! টেনিদা দাঁত খিঁচিয়ে বললে, ভারি ওস্তাদ হয়ে গেছিস যে। আমি বলেছি যে, পুঁদিচ্চেরি মানে ব্যাপার অত্যন্ত সাংঘাতিক ব্যস! এ-নিয়ে তক্কো করবি তো এক চড়ে তোর কান

আমি বললুম–কানপুরে উড়ে যাবে।

রাইট।–টেনিদা গম্ভীর হয়ে বললে, এবার তা হলে বাবা কচুবনেশ্বরের কথাটা বলি। ঠাকুর-দেবতার ব্যাপার, খুব ভক্তি করে শুনবি। যদি তক্কো-টকো করিস তা হলে…

আমরা সমস্বরে বললুম-না-না।

টেনিদা শুরু করল :

সেবার গরমের ছুটিতে সেজ পিসিমার কাছে বেড়াতে গেছি ঘুঁটেপুকুরে। খাসা জায়গা। গাছে গাছে আম, জাম, কাঁঠাল, কলা

আমি বললুম-আহা, শুনেই যে লোভ হচ্ছে। ঘুঁটেপুকুরটা কোথায় টেনিদা?

ক্যাবলা ব্যাজার হয়ে বললে আঃ, গল্প থামিয়ে দিস নে। ঘুঁটেপুকুর কোথায় হবে আবার? নিশ্চয় গোবরডাঙার কাছাকাছি।

টেনিদা বললেনা, না গোবরডাঙার কাছে নয়। রানাঘাট ইসটিশন থেকে বারো মাইল দূরে। দিব্যি জায়গা রে। চারদিকে বেশ শ্যামল প্রান্তর-টান্তর–পাখির কাকলি-টাকলি কিছুরই অভাব নেই। কিন্তু তারও চাইতে বেশি আছে আম, জাম, কাঁঠাল, কলা। খেয়ে খেয়ে আমার গা থেকে এমনি আম-কাঁঠালের গন্ধ বেরুত যে, রাস্তায় আমার পেছনে-পেছনে আট-দশটা গোরু বাতাস শুকতে-শুকতে হাঁটতে থাকত। একদিন তো-কিন্তু না, গোরুর গল্প আজ আর নয় বাবা কচুবনেশ্বরের কথাই বলি।

হয়েছে কী জানিস, আমি যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই ঘুঁটেপুকুর ফুটবল ক্লাব তো আমায় লুফে নিয়েছে। আমি পটলডাঙার থাণ্ডার ক্লাবের ক্যাপটেন- একটা জাঁদরেল সেন্টার ফরোয়ার্ড–সেও ওদের জানতে বাকি নেই।

দুদিন ওদের সঙ্গে খেলেই বুঝতে পারলুম- ওদের নাম হওয়া উচিত ছিল বাতাবি নেবু স্পোর্টিং ক্লাব। মানে বাতাবি নেবু পর্যন্তই ওদের দৌড়, ফুটবলে পা ছোঁয়াতে পর্যন্ত শেখেনি। কিছুদিন তালিম-টালিম দিয়ে এক রকম দাঁড় করানো গেল। তখন ঘুঁটেপুকুরে পাঁচুগোপাল কাপের খেলা চলছিল। বললে বিশ্বাস করবিনে, আমার তালিমের চোটে ঘুঁটেপুকুর ক্লাব তিন-তিনটে গেঁয়ো টিমকে হারিয়ে দিয়ে একেবারে ফাইনালে পৌঁছে গেল। অবিশ্যি সব কটা গোল আমিই দিয়েছিলুম।

ফাইনালে উঠেই ল্যাঠা বাধল।

ওদিক থেকে উঠে এসেছে চিংড়িহাটা হিরোজ–মানে এ-তল্লাটে সব চেয়ে জাঁদরেল দল। তাদের খেলা আমি দেখেছি। এদের মতো আনাড়ি নয়–এক-আধটু খেলতে-খেলতে জানে। সব চেয়ে মারাত্মক ওদের গোলকিপার বিলটে ঘোষ। বল তো দূরের কথা, গোলের ভেতরে মাছি পর্যন্ত ঢুকতে গেলে কপাৎ করে লুফে নেয়। আর তেমনি তাগড়াই জোয়ান কাছে গিয়ে চার্জফার্জ করতে গেলে দাঁত-মুখ আস্ত নিয়ে ফিরতে হবে না।

স্পষ্ট বুঝতে পারলুম, ঘুঁটেপুকুরের পক্ষে পাঁচুগোপাল কাপ নিতান্তই মরীচিকা!

ঘুঁটেপুকুর ক্লাব চুলোয় যাক– সে জন্যে আমার কোনও মাথাব্যথা নেই। কিন্তু আমি টেনি শর্মা, খাস পটলডাঙা থাণ্ডার ক্লাবের ক্যাপ্টেন আসল কলকাতার ছেলে, আমার নাকের সামনে দিয়ে চিংড়িহাটা ড্যাং-ড্যাং করতে করতে কাপ নিয়ে যাবে। এ-অপমান প্রাণ থাকতে সহ্য করা যায়? তার ওপর এক মাস ধরে ঘুঁটেপুকুরের আম কাঁঠাল এন্তার খেয়ে চলেছি–একটা কৃতজ্ঞতাও তো আছে?

কিন্তু কী করা যায়।

দুপুরবেলা বসেবসে এই সব ভাবছি, এমন সময় শুনতে পেলুম, সেজ পিসিমা কাকে যেন বলছেন–বসেবসে ভেবে আর কী করবে–বাবা কচুবনেশ্বরের থানে গিয়ে ধন্না দাও।

কচুবনেশ্বর! ওই বিটকেল নামটা শুনেই কান খাড়া করলুম।

সেজ পিসিমা আবার বললেন- বাবার থানে ধন্না দাও–জাগ্রত দেবতা– তোমার ছেলে নির্ঘাত পরীক্ষায় পাশ করে যাবে।

গলা বাড়িয়ে দেখলুম, পিসিমা দত্ত-গিন্নির সঙ্গে কথা কইছেন। দত্ত-গিন্নি বললেন– তা হলে তাই করব, দিদি। হতচ্ছাড়া ছেলে দুবার পরীক্ষায় ডিগবাজি খেলে, উনি বলছেন এবারেও ফেল করলে লাঙলে জুড়ে চাষ করাবেন।

দত্ত-গিন্নির ছেলে চাষ করুক- আমার আপত্তি নেই, কিন্তু বাবা কচুবনেশ্বরের কথাটা কানে লেগে রইল। আর দত্ত-গিন্নি বেরিয়ে যেতে না যেতেই আমি পিসিমাকে পাকড়াও করলুম।

বাবা কচুবনেশ্বর কে পিসিমা?

শুনেই পিসিমা কপালে হাত ঠেকালেন। বললেন– দারুণ জাগ্রত দেবতা রে। গাঁয়ের পুব দিকে কচুবনের মধ্যে তাঁর থান। পয়লা শ্রাবণ ওখানে মোচ্ছব হয়- কচু সেদ্ধ, কচু ঘন্ট, কচুর ডালনা, কচুর অম্বল, আর কচুর পোলাও দিয়ে তাঁর ভোগ হয়।

টেনিদার গল্প শুনতে-শুনতে আমার জানতে ইচ্ছে হল, কচুপোড়াটাই বা বাদ গেল কেন। কিন্তু ঠাকুর-দেবতাদের কচুপোড়া খেতে বললে নিশ্চয় তাঁরা চটে যাবেন– তাই ব্যাপারটা চেপে গেলুম। জিজ্ঞেস করলুম, কচুর পোলাও খেতে কেমন লাগে টেনিদা!

টেনিদা খ্যাঁক-খ্যাঁক করে বললে- আঃ, কচু খেলে যা। আমি কি কচুর পোলাও খেয়েছি নাকি যে বলব! ইচ্ছে হয় পয়লা শ্রাবণ ঘুঁটেপুকুরে গিয়ে খেয়ে আসিস।

ক্যাবলা অধৈর্য হয়ে বললে, টিকটিক করিস নে প্যালা, গল্পটা বলতে দে। তুমি থেমো না টেনিদা, চালিয়ে যাও।

টেনিদা বললে, সেজ পিসিমার ভক্তি দেখে আমারও দারুণ ভক্তি হল। আর ভেবে দ্যাখ কচু সেদ্ধ, কচু ঘন্ট, কচুর অম্বল, কচুর কালিয়া–মানে এত কচু ম্যানেজ করা চাট্টিখানি কথা! আমার তো কচু দেখলেই গলা কুটকুট করে। কচু ভোগের বহর দেখে মনে হল, দেবতাটি তো তবে সামান্যি নয়।

জিজ্ঞেস করলুম– বাবা কচুবনেশ্বরের কাছে ধরনা দিয়ে ফুটবল ম্যাচ জেতা যায়, পিসিমা?

পিসিমা বললেন- ফুটবল ম্যাচ বলছিস কী? বাবার অসাধ্য কাজ নেই। এই তো, ওবাড়ির মেন্টির মাথায় এমন উকুন হল যে, তিনবার ন্যাড়া করে দিয়েও উকুন যায় না। কত মারা হল, কত কবিরাজী তেল–উকুন যে-কে সেই! শেষে মেন্টির মা কচুবনেশ্বরের থানে ধন্না দিয়ে আধ ঘণ্টা চুপ করে পড়ে থেকেছে–

ব্যস, হাতে টুপ করে কিসের একটা শেকড় পড়ল। সেই শেকড় বেটে লাগিয়ে দিতেই একদিনে উকুন ঝাড়ে বংশে সাফ। আর মেন্টির যা চুল গজাল–সে যদি দেখতিস! একেবারে হাঁটু পর্যন্ত।

আমি তড়াক করে লাফিয়ে উঠলম। বললুম- বাবার থান কোন দিকে পিসিমা?

ওই তো সোজা পুবদিক বরাবর একেবারে নদীর ধারেই। কচুবনের ভেতরে বাবার থান, অনেক দূর থেকেই তো দেখা যায়। তুই সেখানে ধন্না দিতে যাবি নাকি রে? তোর আবার কী হল?

-কিছু হয়নি বলে সোজা পিসিমার সামনে থেকে চলে এলুম। মনে-মনে ঠিক করলুম, কাউকে জানতে দেওয়া নয়- চুপিচুপি একাই গিয়ে ঘণ্টাখানেক ধরনা দেব। একটা শেকড়-টেকড় যদি পেয়ে যাই–বেটে খেয়ে নেব, তারপর কালকের খেলায় আমাকে আর পায় কে? ওই ডাকসাইটে বিলটে ঘোষের হাতের তলা দিয়েই তিন তিনখানা গোল ঢুকিয়ে দেব।

একটু পরেই রামায়ণ খুলে সুর করে সূর্পনখার নাসাচ্ছেদন পড়তে-পড়তে পিসিমা যেই ঘুমিয়ে পড়েছে, আমি সোজা একেবারে কচুবনেশ্বরের খোঁজে বেরিয়ে পড়লুম।

বেশি হাঁটতে হল না। আমবাগানের ভেতর দিয়ে সিকি মাইলটাক যেতেই দেখি সামনে একটা মজা নদী আর তার পাশেই কচুর জঙ্গল। সে কী জঙ্গল। দুনিয়া সুদ্ধ সব লোককে কচু ঘণ্ট খাইয়ে দেওয়া যায়- কচুপোড়া খাওয়ানোও শক্ত নয়, এমন বন সেখানে। আর তারই মাঝখানে একটা ছোট মন্দিরের মতো বুঝলুম ওইটেই হচ্ছে বাবার থান।

বন ঠেলে তো মন্দিরে পৌঁছানো গেল। কচুর রসে গা একটু চিড়বিড় করছিল কিন্তু ওটুকু কষ্ট না করলে কি আর কেষ্ট মেলে। গিয়ে দেখি, মন্দিরে মূর্তি-ফুর্তি নেই- একটা বেদী, তার ওপর গোটা কয়েক রং-চটা নয়া পয়সা, কিছু চাল, আর একরাশ কচুর ফুল শুকিয়ে রয়েছে। সাষ্টাঙ্গে প্রণাম করে মন্দিরের বারান্দায় ধরনা দিলুম।

চোখ বুজে লম্বা হয়ে শুয়ে আছি। হাত দুটো মেলেই রেখেছি কোন্ হাতে টুপ করে বাবার দান পড়বে বলা যায় না তো। পড়ে আছি তো আছিই–একরাশ মশা এসে পিন-পিন করে কামড়াচ্ছে কানের কাছে গোটা দুই গুবরেপোকা ঘুরঘুর করছে, কচু লেগে হাত-পা কুটকুট করছে। কিন্তু মশা তাড়াচ্ছি না, গা চুলকোচ্ছি না, খালি দাঁত-মুখ সিঁটিয়ে প্রাণপণে প্রার্থনা করছি–দোহাই বাবা কচুবনেশ্বর, একটা শেকড়-টেকড় চটপট ফেলে দাও চিংড়িহাটার বিলটে ঘোষকে ঠাণ্ডা করে দিই। বেশি দেরি কোরো না বাবা-গা-হাত ভীষণ চুলকোচ্ছে, আর দারুণ মশা! আর তা ছাড়া থেকে-থেকে বনের ভেতর কী যেন খ্যাঁক-খ্যাঁক করে ডাকছে– যদি পাগলা শেয়াল হয় তা হলে এক কামড়েই মারা যাব। দোহাই বাবা, দেরি কোরো না– যা দেবার দিয়ে দাও, কুইক কচুবনেশ্বর।

যেই বলেছি অমনি বাঁ হাতে কী যেন টপাস করে পড়ল।

ইউরেকা বলে যেই লাফিয়ে উঠেছি–দেখি, শেকড়ের মতোই কী একটা পড়েছে বটে! কিন্তু এ কী! শেকড়টা তুরুক-তুরুক করে অল্প-অল্প লাফাচ্ছে যে!

মন্ত্রপূত জ্যান্ত শেকড় নাকি?

আর তখুনি মাথার ওপর ট্যাক-ট্যাক-টিকিস করে আওয়াজ হল। দেখি, দুটো টিকটিকি দেওয়ালের গায়ে লড়াই করছে তাদের একটার ল্যাজ নেই। মানে, মারামারিতে খসে পড়েছে।

রহস্যভেদ হয়ে গেল সঙ্গে সঙ্গেই। তা হলে আমার হাতে শেকড় পড়েনি, পড়েছে টিকটিকির কাটা ল্যাজ! টিপে দেখলুম রবারের মতো আর অল্প-অল্প নড়ছে তখনও।

দুবুদ্ধি হলে যা হয়–ভীষণ রাগ হয়ে গেল আমার মনে হল, বাবা কচুবনেশ্বর আমায় ঠাট্টা করলে। এতক্ষণ গায়ের কুটকুটুনি আর মশার কামড় সহ্য করে শেষে কিনা টিকটিকির ল্যাজ! গোঁ গোঁ করে উঠে পড়লুম। তক্ষুনি আবার সেই শিয়ালটা খ্যাঁক খ্যাঁক করে ডেকে উঠল–মনে হল এখানে থাকাটা আর ঠিক নয়। মন্দির থেকে নেমে কচুবন ভেঙে সোজা বাড়ি চলে এলুম– আধ সের সর্ষের তেল মেখে এক ঘন্টা পরে পায়ের জ্বলুনি খানিকটা বন্ধ হল।

টেনিদা এই পর্যন্ত বলতে আমি আর ধৈর্য রাখতে পারলুম না। ফস করে জিজ্ঞেস করলুম– সেই টিকটিকির ল্যাজটা কী হল?

আঃ থাম না–আগে থেকে কেন বাগড়া দিচ্ছিস? ফের যদি কথা বলবি, তা হলে দেওয়ালের ওই টিকটিকিটক পেড়ে তোর মুখে পুরে দেব বলে টেনিদা আমার দিকে বজ্ৰদৃষ্টিতে তাকাল।

ক্যাবলা বললে ছেড়ে দাও ওর কথা, তুমি বলো।

বলবার আর আছে কী–টেনিদা দীর্ঘশ্বাস ফেলল : ভুল যা হয়ে গেল, তার শাস্তি পেলুম পরের দিনই।

ইস্কুলের মাঠে পাঁচুগোপাল কাপের ফাইনাল ম্যাচ। ঘুঁটেপুকুর ক্লাবকে বলেছি, প্রাণ দিয়েও কাপ জিততে হবে। আর সত্যি কথা বলতে কী-বাতাবি নেবু স্পোর্টিং আজ সত্যিই ভালো খেলছে। এমন কি আমরা হয়তো দু-একটা গোলও দিয়ে ফেলতে পারতুম– যদি ওই দুরন্ত-দুর্ধর্ষ বিলটে ঘোষটা না থাকত। আমাদের গোলকিপার প্যাঁচাও খুব ভালো খেলেছে- দু-দুবার যা সেভ করলে, দেখবার মত।

হাফ-টাইম পর্যন্ত ড্র। কিন্তু বুঝতে পারছিলুম–ঘুঁটেপুকুরের দম ফুরিয়ে আসছে, পরের পঁচিশ মিনিট ঠেকিয়ে রাখা শক্ত হবে। হাফ-টাইম হওয়ার আগেই আমি একটা মতলব এঁটে ফেলেছিলুম। মাঠের ধারে বাদাম গাছ থেকে হাওয়ায় পাতা উড়ে উড়ে পড়ছিল, তাই দেখেই প্ল্যানটা এল। মানে, মতলবটা মন্দ নয়। কিন্তু জানিস তো– মরি অরি পারি যে-কৌশলে।

হাফ-টাইম হতেই সেজ পিসিমার বাড়ির রাখাল ভেটকির কানে কানে আমি একটা পরামর্শ দিলুম। ভেটকিটা দেখতে বোকা-সোকা হলেও বেশ কাজের ছেলে। শুনেই একগাল হেসে সে দৌড় মারল।

আবার খেলা আরম্ভ হল। হাওয়ায় বাদামের পাতা উড়ে আসছে, আমি আড়চোখে তা দেখছি আর ভাবছি ভেটকি কখন আসে। এর মধ্যে চিংড়িহাটা আমাদের দারুণ চেপে ধরেছে– জান কবুল করে বাঁচাচ্ছে প্যাঁচা! আমিও ফাঁক পেলে ওদের গোলে হানা দিচ্ছি..কিন্তু বিলটে ঘোষটা যেন পাঁচিল হয়ে গোল আটকাচ্ছে।

আমি শুধু ভাবছি…ভেটকি গেল কোথায়?

অনেক দূর থেকে একটা বল গড়াতে গড়াতে আমাদের গোলের দিকে চলেছিল। একটা কড়ে আঙুল আলতো করে ছুঁইয়েও তাকে ঠেকানো যায়। কিন্তু এ কী ব্যাপার! হঠাৎ প্যাঁচা হালদার দারুণ চিৎকার ছেড়ে শূন্যে লাফিয়ে উঠল–প্রাণপণে পা চুলকোতে লাগল আর সেই ফাঁকে

সোজা গোল!

শুধু প্যাঁচা হালদার? ফুলব্যাক কুচো মিত্তির লাফাতে লাফাতে সেই-যে বেরিয়ে গেল, আর ফিরলই না। প্যাঁচা সমানে পা চুলকোতে লাগল, আর পর-পর আরও চারটে গোল। মানে ফাঁকা মাঠেই গোল দিয়ে দিলে বলা যায়!

হয়েছিল কী জানিস? ভেটকিকে বলেছিলুম, গাছ থেকে একটা লাল পিঁপড়ের বাসা ছিঁড়ে এনে উড়ো পাতার সঙ্গে ওদের গোলের দিকে ছেড়ে দিতে, তা হলেই বিলটে ঘোষ একেবারে ঠাণ্ডা! ভেটকি দৌড়ে গেছে, বাসাও এনেছে- কিন্তু ওটা এমন বেল্লিক যে, হাফ টাইমে যে সাইডবদল হয় সে আর খেয়ালই করেনি। একেবারে প্যাঁচা হালদারের গায়েই ছেড়ে দিয়েছে। যখন টের পেয়েছে, তখন আর

একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে টেনিদা থামল।

–কিন্তু কচুবনেশ্বরের টিকটিকির ল্যাজ?– আমি আবার কৌতূহল প্রকাশ করলুম।

আরে, আসল দুঃখু তো সেইখানেই। চিংড়িহাটা যখন কাপ নিয়ে চলে গেল, তখন পরিষ্কার দেখলুম, ওদের ক্যাপ্টেন বিলটে ঘোষের কালো প্যান্টে একটা নীল তাপ্পি মারা।

–তাতে কী হল? ক্যাবলা জিজ্ঞেস করলে।

–তাইতেই সব। নইলে কি ভেটকিটা এমন ভুল করে, বিলটের বদলে প্যাঁচার গায়ে পিঁপড়ের বাসা ছেড়ে দেয়! সবই সেই বাবা কচুবনেশ্বরের লীলা।

–কিছুই বুঝতে পারলুম না–হাঁ করে চেয়ে রইলুম টেনিদার মুখের দিকে।

আর টেনিদা খপ করে আমার মুখটা চেপে বন্ধ করে দিয়ে বললে, আরে, বাবার থান থেকে বেরিয়েই দেখি সামনের নদীর ধারে দড়ি টাঙিয়ে ধোপারা জামাকাপড় শুকোতে দিয়েছে। হাতে টিকটিকির ল্যাজটা তখনও ছিল– কী ভেবে আমি সেটাকে একটা কালো প্যান্টের পকেটে গুঁজে দিয়েছিলুম আর সেই প্যান্টটায় নীল রঙের একটা তাপ্পি মারা ছিল।

আবার দীর্ঘশ্বাস ফেলল টেনিদা। আর মাথার ওপরে টিকটিকিটা ডেকে উঠল : টিকিস-টিকিস ঠিক ঠিক?

 টেনিদা আর ইয়েতি

ক্যাবলা বলে, ইয়েতি-ইয়েতি। সব বোগাস।

চ্যাঁ চ্যাঁ করে চেঁচিয়ে উঠল হাবুল সেন।

হ, তুই কইলেই বোগাস হইব! হিমালয়ের একটা মঠে ইয়েতির চামড়া রাইখ্যা দিছে জানস তুই?

ওটা কোনও বড় বানরের চামড়াও হতে পারে।–চশমাসুদ্ধ নাকটাকে আরও ওপরে তুলে ক্যাবলা গম্ভীর গলায় জবাব দিলে।

হাবুল বললে, অনেক সায়েব তো ইয়েতির কথা লেখছে।

কিন্তু কেউই চোখে দেখেনি। যেমন সবাই ভূতের গল্প বলে–অথচ নিজের চোখে ভূত দেখেছে–এমন একটা লোক খুঁজে বের কর দিকি?

এইবারে আমি কিছু বলতে যাচ্ছিলাম, এমন সময় টেনিদা এসে চাটুজ্যেদের রোয়াকে পৌঁছে গেল। একবার কটমট করে আমাদের তিনজনের দিকে তাকিয়ে মোটা গলায় বললে, কী নিয়ে তোরা তক্কো করছিলি র‍্যা?

আমি বললুম, ইয়েতি।

অ–ইয়েতি।–টেনিদা জাঁকিয়ে বসে পড়ল : তা তোরা ছেলেমানুষ–ও-সব তোরা কী জানিস? আমাকে জিজ্ঞেস কর।

হাবুল বললে, ইস কী আমার একখানা ঠাকুর্দা আসছেন রে।

টেনিদা বললে, চোপরাও। গুরুজনকে অচ্ছেদ্দা করবি তো এক চড়ে তোর কান আমি–

আমি ফিল আপ দি গ্যাপ করে দিলুম : কানপুরে পৌঁছে দেব।

ইয়া–ইয়া কারেক্ট।–বলে টেনিদা এমন জোরে আমার পিঠে থাবড়ে দিলে যে হাড়-পাঁজরাগুলো পর্যন্ত ঝনঝন করে উঠল। তারপর বললে, ইয়েতি? সেই যে কী বলে–অ্যাব–অ্যাব–অ্যাবো

ক্যাবলা বললে, অ্যাবোমিনেবল স্নোম্যান।

মরুক গে ইংরিজিটা বড় বাজে ইয়েতিই ভাল। তোরা বলছিস নেই? আমি নিজের চক্ষে ইয়েতি দেখেছি।

তুমি!–আমি আঁতকে উঠলুম।

অমন করে চমকালি কেন, শুনি?–চোখ পাকিয়ে টেনিদা বললে, আমি ইয়েতি দেখব না তো তুই দেখবি? সেদিনও পটোল দিয়ে শিঙিমাছের ঝোল খেতিস, তোর আস্পর্ধা তো কম নয়।

হাবুল বললে, না–না, প্যালা দেখব ক্যান? আমরা ভাবতা ছিলাম–ইয়েতি তো দেখব প্রেমেন মিত্তিরের ঘনাদা তুমি ওই সব ভ্যাজালে আবার গেলা কবে?

ঘনাদার নাম শুনে টেনিদা কপালে হাত ঠেকাল : ঘনাদা। তিনি তো মহাপুরুষ। ইয়েতি কেন–তার দাদামশাইয়ের সঙ্গেও তিনি চা-বিস্কুট খেতে পারেন। তাই বলে আমি একটা ইয়েতি দেখতে পাব না, একথার মানে কী?

ক্যাবলা বললে, তুমিও নিশ্চয় দেখতে পারো–তোমারও অসাধ্য কাজ নেই। কিন্তু কবে দেখলে, কোথায় দেখলে।

শুনতে চাস?–কথা কেড়ে নিয়ে টেনিদা বললে, তা হলে সামনের ভুজাওলার দোকান থেকে ছ আনার ঝালমুড়ি নিয়ে আয় কুইক।–আর তৎক্ষণাৎ আমার পিঠে একটা বাঘাটে রদ্দা কষিয়ে বললে, নিয়ায় না–কুইক।

রদ্দা খেয়ে আমার পিত্তি চটে গেল। বললুম, আমার কাছে পয়সা নেই।

তা হলে ক্যাবলাই দে। কুইক।

রদ্দার ভয়ে ক্যাবলাই পয়সা বের করল। শুধু কুইক নয়, ভেরি কুইক।

ঝালমুড়ি চিবুতে চিবুতে টেনিদা বললে, এই গরমের ছুটিতে এক মাস আমি কোথায় ছিলুম বল দিকি?

আমি বললুম, গোবরডাঙায়। সেখানে পিসিমার বাড়িতে তুমি আম খেতে গিয়েছিলে।

ওটা তো তোদের ফাঁকি দেবার জন্যে বলেছি। আমি গিয়েছিলুম হিমালয়ান এক্সপিডিশনে।

অ্যা–সৈত্য কইতাছ?–হাবুল হাঁ করল।

আমি কখনও মিথ্যে কথা বলি?-টেনিদা গর্জন করল।

বালাই ষাট–তুমি মিথ্যে বলবে কেন?–ক্যাবলা ভালোমানুষের মতো বললে, কোথায় গিয়েছিলে? এভারেস্টে উঠতে?

ছো–ছো–ও তো সবাই উঠছে, ডাল-ভাত হয়ে গেছে। আর কদিন পরে তো স্কুলের ছেলেমেয়েরা এভারেস্টের চুড়োয় বসে পিকনিক করবে। আমি গিয়েছিলুম আরও উঁচু চুড়োর খোঁজে।

আছে নাকি?–আমরা তিনজনেই চমকালুম।

কিছুই বলা যায় না হিমালয়ের কয়েকটা সাইড তো মেঘে কুয়াশায় চিরকালের মতো অন্ধকার–এখনও সেসব জায়গার রহস্যই ভেদ হয়নি। লাস্ট ওয়ারের সময় দুজন আমেরিকান পাইলট বলেছিল না? পঁয়ত্রিশ হাজার ফুট ওপরেও তারা পাহাড়ের চুড়ো দেখেছিল একটা তারপর সে যে কোথায় হারিয়ে গেল

তুমি সেই চুড়ো খুঁজে পেয়েছ টেনিদা?আমি জানতে চাইলুম।

থাম ইডিয়ট। তা হলে তো কাগজে কাগজে আমার ছবিই দেখতে পেতিস। আমি কি আর তবে তোদের ওই সিটি কলেজের ক্লাসে বসে থাকতুম, আর প্রক্সি দিতুম? কবে আমাকে মাথায় তুলে সবাই দিল্লি-টিল্লি নিয়ে যেত আমি, কী, বলে,–একটা পদ্ম-বিভীষণ হয়ে যেতুম।

ক্যাবলা বললে, উঁহু, পদ্মবিভূষণ।

একই কথা।–ঝালমুড়ির ঠোঙা শেষ করে টেনিদা বললে, চুপ কর–এখন ডিসটার্ব করিসনি। না নতুন চুড়ো খুঁজে পেলুম না। সেই-যে, কী বলে–পাহাড়ের কী তুষারঝড়–

ক্যাবলা বললে, ব্লিজার্ড।

হ্যাঁ, এমন ব্লিজার্ড শুরু হল যে শেরপা-টেরপা সব গেল পালিয়ে। আমি আর কী করি, খুব মন খারাপ করে চলে এলুম কালিম্পঙে। সেখানে কুট্টিমামার ভায়রাভাই হরেকেষ্টবাবু ডাক্তারি করেন, উঠলুম তাঁর ওখানে।

তা হলে ইয়েতি দেখলে কোথায়?–আমি জানতে চাইলুম :সেই ব্লিজার্ডের ভেতর?

উঁহু, কালিম্পঙে।

কালিম্পঙে ইয়েতি। হাবুল চেঁচিয়ে উঠল : চাল মারনের জায়গা পাও নাই? আমি যাই নাই কালিম্পঙে? সেইখানে ইয়েতি? তাইলে তো আমাগো পটলডাঙায়ও ইয়েতি লাইমা আসতে পারে।

টেনিদা ভীষণ গম্ভীর হয়ে বললে, পারে–অসম্ভব নয়।

অ্যাঁ!–আমরা তিনজনে একসঙ্গে খাবি খেলুম।

টেনিদা বলল, হ, পারে। ওরা ইনভিজিবল–মানে প্রায়ই অদৃশ্য হয়ে থাকে। তাই লোকে ওদের পায়ের দাগ দেখে, কিন্তু ওদের দেখতে পায় না। যেখানে খুশি ওরা যেতে পারে, যখন খুশি যেতে পারে। আবার ইচ্ছে করলেই রূপ ধরতে পারে কিন্তু সেরূপ না দেখলেই ভালো। আমি কালিম্পঙে দেখেছিলুম–আর দেখতে চাই না।

আমি বললুম, কিন্তু ওখানে ইয়েতি এল কী করে?

ইয়েতি কোথায় নেই–কে জানে! হয়তো–এই যে আমরা কথা কইছি ঠিক এখুনি আমাদের পিছনে একটা অদৃশ্য ইয়েতি দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে হাসছে।

আমরা ভীষণ চমকে তিনজনে পিছন ফিরে তাকালুম।

টেনিদা বললে, উঁহু, ইচ্ছে করে দেখা না দিলে কিছুতেই দেখতে পাবি না। ও কি এত সহজেই হয় রে বোকার দল? ওর জন্যে আলাদা কপাল থাকা চাই।

ক্যাবলা বললে, তোমার সেই কপাল আছে বুঝি?

হাঁটু থাবড়ে টেনিদা বললে, আলবাত।

হাবুল বললে, কালিম্পঙে ইয়েতি দ্যাখলা তুমি?

দেখলুম বইকি।

ক্যাবলা বললে, রেস্তোরাঁয় বসে ইয়েতিটা বুঝি চা খাচ্ছিল? না কি বেড়াতে গিয়েছিল চিত্রভানুর ওদিকটায়?

ইয়ারকি দিচ্ছিস?–বাঘা গলায় টেনিদা বললে, ইয়েতি তোর ইয়ারকির পাত্তর?

হাবুল বললে, ছাড়ান দাও-পোলাপান।

পোলাপান? ওটাকে জলপান করে ফেলা উচিত। ফের যদি কুরুবকের মতো বকবক করবি ক্যাবলা, তা হলে এক ঘুষিতে তোর চশমাসুদ্ধ নাক আমি

আমি বললুম, নাসিকে উড়িয়ে দেব।

ইয়া–একদম কারেক্ট?–বলে আমার পিঠ চাপড়াতে গিয়ে টেনিদার হাত হাওয়ায় ঘুরে এল–আগেই চট করে সরে গিয়েছিলাম আমি।

ব্যাজার মুখে টেনিদা বললে, দুৎ–দরকারের সময় একটা পিঠ পর্যন্ত হাতের কাছে পাওয়া যায় না। রাবিশ।

হাবুল বললে, কিন্তু ইয়েতি।

দাঁড়া না ঘোড়াড্ডিম–একটু মুড আনতে দে।–টেনিদা মুখটাকে ঠিক গাজরের হালুয়ার মতো করে, নাকের ডগাটা খানিক খুচখুচ করে চুলকে নিলে। তারপর বললে, হুঁ ইয়েতির সঙ্গে ইয়ার্কিই বটে। আমিও ইয়েতি নিয়ে একটু ইয়ার্কিই করতে গিয়েছিলুম। তারপরেই বুঝতে পারলুম–আর যেখানে ইচ্ছে চালিয়াতি করো–ওঁর সঙ্গে ফাজলেমি চলে না।

আমি বললুম, চলল না ফাজলেমি?

না।–খুব ভাবুকের মতো একটু চুপ করে থেকে টেনিদা বললে, হল কী জানিস, এক্সপিডিশন থেকে ফিরে কালিম্পঙে এসে বেশ রেস্ট নিচ্ছিলুম। আর ডাক্তার হরেকেষ্টবাবুর বাড়িতেও অনেক মুরগি–রোজ সকালে ককরককর করে তারা ঘুম ভাঙাত, আর দুপুরে, রাত্তিরে কখনও কারি, কখনও কাটলেট, কখনও রোস্ট হয়ে খাবার টেবিলে হাজির হত। বেশ ছিলুম রে–তা ওখানে একদিন এক ফরাসী টুরিস্টের সঙ্গে আলাপ হল। জানিস তো আমি খুব ভালো ফরাসী বলতে পারি।

ক্যাবলা বললে, পায়রা বুঝি?

পারি না? ডি-লা গ্র্যান্ডি মেফিস্টোফিলিস ইয়াক ইয়াক–তা হলে কোন ভাষা?

হাবুল বললে, যথার্থ। তুমি কইয়া যাও।

লোকটার সঙ্গে তো খুব খাতির হল। এসব টুরিস্টদের ব্যাপার কী জানিস তো? সব কিছু সম্পর্কেই ওদের ভীষণ কৌতূহল। ইন্ডিয়ানদের টিকি থাকে কেন–তোমাদের কাকেদের রং এত কালো কেন, তোমাদের দেবতা কি খুব ভয়ানক যে তোমরা হরিবল-হরিবল (মানে হরিবোল আর কি!) চ্যাঁচাও-ইন্ডিয়ান গুবরে পোকা কি পাখিদের মতো গান গাইতে পারে, এ দেশের ছুঁচোরা কি শুয়োরের বংশধর? এই সব নানা কথা জিজ্ঞেস করতে করতে সে বললে–আচ্ছা মঁসিয়ো, তুমি তো হিমালয়াজে গিয়েছিলে, সেখানে ইয়েতি দেখেছ?

আমার হঠাৎ লোকটাকে নিয়ে মজা করতে ইচ্ছে হল। তার নাম ছিল লেলেফাঁ। আমি বেশ কায়দা করে তাকে বললুম, তুমি আছ কোথায় হে মঁসিয়ো লেলেফা? ইয়েতি দেখেছি মানে? আমি তো ধরেই এনেছি একটা।

–অ্যা, ধরে এনেছ?–লোকটা তিনবার খাবি খেল : কই, আজ পর্যন্ত কেউ তো ধরতে পারেনি।

আমি লেলেফাঁর বুকে দুটো টোকা দিয়ে বললুম, আমি পটলডাঙার টেনি শর্মা–সবাই যা পারে না, আমি তা পারি। আমার বাড়িতেই আছে ইয়েতি।

–অ্যাঁ!

–হ্যাঁ।

মঁসিয়ো লেলেফাঁ খানিকটা হাঁ করে রইল, তারপর ভেউভেউ করে কাঁদার মতো মুখ করলে, আবার কপ কপ করে তিনটে খাবি খেল–যেন মশা গিলছে। শেষে একটু সামলে নিলে চোটটা।

–আমায় দেখাবে ইয়েতি?

–কেন দেখাব না?

শুনে এমন লাফাতে লাগল লেলেফাঁ যে একটা পাথরে হোঁচট খেয়ে চিতপাত হয়ে পড়ে গেল। আর একটু হলেই গড়িয়ে হাত তিরিশেক নীচে একটা গর্তে পড়ে যেত, আমি ওর ঠ্যাং ধরে টেনে তুললুম। উঠেই আমাকে দুহাতে জাপটে ধরল সে আর পাক্কা তিন মিনিট ট্যাঙো ট্যাঙো বলে নাচতে লাগল।

–চলল, এক্ষুনি দেখাবে।

আমি বললুম, সে হয় না মসিয়য়া, যখন তখন তাকে দেখানো যায় না। সে উইকে সাড়ে তিন দিন ঘুমোয়, সাড়ে তিন দিন জেগে থাকে। ঘুমের সময় তাকে ডিস্টার্ব করলে সে এক চড়ে তোমার মুণ্ডু

আমি জুড়ে দিলুম, কাঠমুণ্ডুতে উড়িয়ে দেবে।

টেনিদা বললে, রাইট। লেলেফাঁকে বললুম-কাল থেকে ইয়েতি ঘুমুচ্ছে। জাগবে, পরশু বারোটার পর। তারপর খেয়েদেয়ে যখন চাঙ্গা হবে–মানে তার মেজাজ বেশ খুশি থাকবে, তখন–মানে পরশু সন্ধের পর তোমাকে ইয়েতি দেখাব।

লেলেফাঁ বললে, আমার ক্যামেরা দিয়ে তার ছবি তুলতে পারব তো?

খবরদার, ও কাজটিও কোরো না। ইয়েতিরা ক্যামেরা একদম পছন্দ করে না চাই কি খ্যাঁচ করে তোমায় কামড়েই দেবে হয়তো। তখন হাইড্রোফোবিয়া হয়ে মারা পড়বে।

ইয়েতি কামড়ালে হাইড্রোফোবিয়া হয়?

হাইড্রোফোবিয়া তো ছেলেমানুষ। কালাজ্বর হতে পারে, পালাজ্বর হতে পারে, কলেরা হতে পারে, চাই কি ইন্দ্রলুপ্ত–এমন কি সনন্ত ষঙন্ত প্রত্যয় পর্যন্ত হয়ে যেতে পারে।

ক্যাবলা প্রতিবাদ করল : সনন্ত ষঙন্ত প্রত্যয় কী করে

ইয়ু শাটাপ ক্যাবলা–সব সময় টিকটিকির মতো টিকিস-টিকিস করবিনি বলে দিচ্ছি। শুনে লেলেফাঁ ফরাসীতে বললে, মি ঘৎ। মানে-হে ঈশ্বর।

ক্যাবলা বললে, ফরাসীরা কি মি ঘৎ বলে নাকি

শাটাপ আই সে!–টেনিদা চেঁচিয়ে উঠল :ফের যদি তক্কো করবি, তা হলে এখুনি এক টাকার আলুর চপ আনতে হবে তোকে। যাকে বলে ফাইন।

ক্যাবলা কুঁকড়ে গেল, বললে, মী ঘৎ। থাক, আর তর্ক করব না, তুমি বলে যাও।

তবু তোকে আট আনার আলুর চপ আনতেই হবে। তোর ফাইন। যা–কুইক।

আমি বললুম, হুঁ, ভেরি কুইক।

বেগুনভাজার চাইতেও বিচ্ছিরি মুখ করে ক্যাবলা চপ নিয়ে এল।

বেড়ে ভাজে লোকটা–চপে কামড় দিয়ে টেনিদা বললে, যাকে বলে মেফিস্টোফিলিস।

আমি আকুল হয়ে বললাম, কিন্তু ইয়েতি?

ইয়েস ই য়ে স, ই য়ে তি। বুঝলি, আমার মাথায় তখন একটা প্ল্যান এসে গেছে। বাড়ি গিয়ে হরেকেষ্টবাবুকে বললুম সেটা। কুট্টিমামার ভায়রাভাই তো, খুব রসিক লোক, রাজি হয়ে গেলেন। তারপর ম্যানেজ করলুম কাইলাকে।

হাবুল বললে, কাইলা কেডা?

ও একজন নেপালী ছেলে–আমাদের বয়েসীই হবে। হরেকেষ্টবাবুর ডাক্তারখানায় চাকরি করে। খুব ফুর্তিবাজ সে। বললে, দাজু, রামরো রামরো। মানে–দাদা, ভালো, খুব ভালো।

ওদিকে সায়েবের আর সময় কাটে না।

–তোমার ইয়েতি কি এখনও ঘুমুচ্ছে?

নাক ডাকাচ্ছে।

সময়মতো জাগবে তো?

সময়মতো মানে? ঠিক বারোটায় উঠে বসবে। এক সেকেন্ডও লেট হবে না।

যা হোক–দিন তো এল। হরেকেষ্টবাবুর দোতলার হলঘরে আমি একটা কালো পর্দা টাঙালুম। প্ল্যান হল, খুব একটা ডিম লাইট থাকবে–আমি ধীরে ধীরে পর্দা সরিয়ে দেব। ইয়েতিকে দেখা যাবে। মাত্র দু মিনিট কি আড়াই মিনিট। তারপরেই আবার পর্দা ফেলে দেব।

আমি বললুম, কিন্তু ইয়েতি

ইয়ু শাটাপ–পটোল দিয়ে শিঙিমাছের ঝোল! আরে, কিসের ইয়েতি? হরেকেষ্টবাবুর বাড়িতে মস্ত একটা ভালুকের চামড়া ছিল, প্ল্যান করেছিলুম কাইলা সেটা গায়ে পড়বে, আর একটা বিচ্ছিরি নেপালী মুখোশ এঁটে গোটা কয়েক লাফ দেবে–চেঁচিয়ে বলবে–দ্রাম-দ্রুম-ইয়াহু-মিয়াহু! ব্যস–আর দেখতে হবে না, ওতেই মঁসিয়ো লেলেফার দাঁতকপাটি লেগে যাবে।

সব সেইভাবে ঠিক করা রইল। সায়েব যখন এল, তখন ঘরে একটা মিটমিটে আলো সামনে একটা কালো পর্দা, তার ওপর আমি কাল থেকে সায়েবকে ইয়েতি সম্পর্কে অনেক ভীষণ ভীষণ গল্প বলছিলুম। বুঝতে পারলুম, ঘরে ঢুকেই তার বুক কাঁপছে।

মজা দেখবার জন্যে হরেকেষ্ট ছিলেন, তাঁর কম্পাউন্ডার গোলোকবাবুও বসে ছিলেন। বেশ অ্যাটমসফিয়ার তৈরি হয়ে গেলে-ওয়ান-টু-থ্রি বলে আমি পদার্টা সরিয়ে দিলুম। আর

আমরা একসঙ্গে বললুম, আর?

এ কী! এ তো কাইলা নয়! তার ভালুকের চামড়া পড়ে গেছে, মুখোশ ছিটকে গেছে চিতপাত অবস্থায় ব্যাঙের মতো হাত-পা ছড়িয়ে সে ঠায় অজ্ঞান। আর সামনে দাঁড়িয়ে আছে ছাদ-পর্যন্ত-ছোঁওয়া এক মূর্তি। সে যে কী রকম দেখতে আমি বোঝাতে পারব না। মানুষ নয়, গরিলা নয়–অথচ গায়ে তার কাঁটা কাঁটা বাদামী রোঁয়া–চোখ দুটো জ্বলছে যেন আগুনের ভাঁটা। তিনটে সিংহের মতো গর্জন করে সে পরিষ্কার বাংলায় বললে, ইয়েতি দেখতে চাওনা? তবে নকল ইয়েতি দেখবে কেন-আসলকেই দেখো। বলে হাঃহাঃ করে ঘর-ফাটানো হাসি হাসল–তিরিশখানা ছোরার মতো ধারালো দাঁত তার ঝলকে উঠল, তারপর চোখের সামনে তার শরীরটা যেন গলে গেল, তৈরি হল একরাশ বাদামী ধোঁয়া-সেটা আবার মিলিয়ে গেল দেখতে-দেখতে। আর আমাদের গায়ের ওপর দিয়ে বয়ে গেল যেন হিমালয়ের সেই ব্লিজার্ডের মতো একটা ঝড়ো হাওয়া, রক্ত জমে গেল আমাদের বন্ধ দরজার পাল্লা দুটো তার ধাক্কায় ভেঙে দশ হাত দূরে ছিটকে পড়ল। তারপর সেই হাওয়াটা হা-হা করতে করতে শাল আর পাইন বনে ঝাঁপটা মেরে একেবারে নাথুলার দিকে ছুটে গেল।

আমি তো পাথর। সায়েব মেঝেতে পড়ে কেবল গি গি করছে। কম্পাউন্ডার অজ্ঞান। হরেকেষ্টবাবু চেয়ারে চোখ উল্টে আছেন, আর বিড়বিড় করে বলছেন–কোরামিন-কোরামিন! সায়েবকে নয়–আমাকে দাও–এখুনি হার্ট ফেল করবে আমার।

টেনিদা থামল। বললে, বুঝলি, এই হচ্ছে আসল ইয়েতি। তাকে নিয়ে ফষ্টিনষ্টি করতে যাসনি-মারা পড়ে যাবি। আর তাকে কখনও দেখতেও চাসনিনা দেখলেই বরং ভালো থাকবি।

আমরা থ হয়ে বসে রইলুম খানিকক্ষণ। তারপর ক্যাবলা বললে, স্রেফ গুলপট্টি।

গুলপট্টি?–টেনিদা কটকট করে তাকাল ক্যাবলার দিকে; ওরা অন্তর্যামী। বেশি যে বকবক করছিস, হয়তো এখুনি একটা অদৃশ্য ইয়েতি তার সিংহের মতো থাবা তোর কাঁধের ওপর বাড়িয়ে দিয়ে

ওরে বাবা রে! এক লাফে রোয়াক থেকে নেমে পড়ে বাড়ির দিকে টেনে দৌড় লাগাল ক্যাবলা।

ঢাউস

চাটুজ্যেদের রোয়াকে বসে টেনিদা বললে, ডি-লা-গ্র্যান্ডি মেফিস্টোফিলিস ইয়াক ইয়াক। আমি আশ্চর্য হয়ে বললুম, তার মানে কী?

টেনিদা টক টক করে আমার মাথার ওপর দুটো টোকা মারল। বললে, তোর মগজ-ভর্তি খালি শুকনো খুঁটে–তুই এসব বুঝবিনি। এ হচ্ছে ফরাসী ভাষা।

আমার ভারি অপমান বোধ হল।

-ফরাসী ভাষা? চালিয়াতির জায়গা পাওনি? তুমি ফরাসী ভাষা কী করে জানলে? টেনিদা বললে, আমি সব জানি।

–বটে?–আমি চটে বললুম, আমিও তা হলে জার্মান ভাষা জানি।

–জার্মান ভাষা?–টেনিদা নাক কুঁচকে বললে, বল তো?

আমি তক্ষুনি বললুম, হিটলার-নাৎসি—বার্লিন–কটাকট!

হাবুল সেন বসে বসে বেলের আঠা দিয়ে একমনে একটা ছেঁড়া ঘুড়িতে পট্টি লাগাচ্ছিল। এইবার মুখ তুলে ঢাকাই ভাষায় বললে, হঃ, কী জার্মান ভাষাড়াই কইলি রে প্যালা! খবরের কাগজের কতগুলিন নাম–তার লগে একটা কটাকট জুইড়া দিয়া খুব ওস্তাদি কোরতে আছ! আমি একটা ভাষা কমু? ক দেখি—’মেকুরে হুড়ম খাইয়া হক্কৈড় করছে’–এইডার মানে কী?

টেনিদা ঘাবড়ে গিয়ে বললে, সে আবার কী রে! ম্যাডাগাস্কারের ভাষা বলছিস বুঝি?

–ম্যাডাগাস্কার না হাতি!–বিজয়গর্বে হেসে হাবুল বললে, মেকুর কিনা বিড়াল, হুড়ম খাইয়া কিনা মুড়ি খাইয়াহকৈড় করছে–মানে এঁটো করেছে।

হেরে গিয়ে টেনিদা ভীষণ বিরক্ত হল।

–রাখ বাপু তোর হুড়ম দুড়ম–শুনে আক্কেল গুড়ুম হয়ে যায়। এর চাইতে প্যালার জামান কটাকট’ও ঢের ভালো।

বলতে বলতে ক্যাবলা এসে হাজির। চোখ প্রায় অদ্ধেকটা বুজে, খুব মন দিয়ে কী যেন চিবুচ্ছে। দেখেই টেনিদার চোখ দুটো জুলজুল করে উঠল।

–অ্যাই, খাচ্ছিস কী রে?

আরও দরদ দিয়ে চিবুতে চিবুতে ক্যাবলা বললে, চুয়িং গাম।

–চুয়িং গাম!

–টেনিদা মুখ বিচ্ছিরি করে বললে, দুনিয়ায় এত খাবার জিনিস থাকতে শেষে রবার চিবুচ্ছিস বসে বসে। এর পরে জুতোর সুখতলা খাবি এই তোকে বলে দিলুম। ছ্যাঃ।

আমি বললুম, চুয়িং গাম থাক। কাল যে বিশ্বকর্মা পুজো–সেটা খেয়াল নেই বুঝি?

টেনিদা বললে, খেয়াল থাকবে না কেন? সেই জন্যেই তো বলছিলুম, ডি-লা-গ্র্যান্ডি মেফিস্টোফিলিস–

ক্যাবলা পট করে বললে, মেফিস্টোফিলিস মানে শয়তান।

–শয়তান!–চটে গিয়ে টেনিদা বললে, থাম থাম, বেশি পণ্ডিতি করিসনি। সব সময় এই ক্যাবলাটা মাস্টারি করতে আসে। কাল যখন মেফিস্টোফিলিস ইয়াক ইয়াক ইয়াক করে আকাশে উড়বে–তখন টের পাবি।

–তার মানে?–আমরা সমস্বরে জিজ্ঞাসা করলুম।

–মানে? মানে জানবি পরে–টেনিদা বললে, এখন বল দিকি, কাল বিশ্বকর্মা পুজোর কী রকম আয়োজন হল তোদের?

আমি বললুম, আমি দু ডজন ঘুড়ি কিনেছি।

হাবুল সেন বললে, আমি তিন ডজন।

ক্যাবলা চুয়িং গাম চিবুতে চিবুতে বললে, আমি একটাও কিনিনি। তোদর ঘুড়িগুলো কাটা গেলে আমি সেইগুলো ধরে ওড়াব।

টেনিদা মিটমিট করে হেসে বললে, হয়েছে, বোঝা গেছে তাদের দৌড়। আর আমি কী ওড়াব জানিস? আমি–এই টেনি শর্মা?–টেনিদা খাড়া নাকটাকে খাঁড়ার মতো উঁচু করে নিজের বুকে দুটো টোকা মেরে বললে, আমি যা ওড়াব–তা আকাশে বোঁ বোঁ করে উড়বে, গোঁ গোঁ করে এরোপ্লেনের মতো ডাক ছাড়বে-হুঁ হুঁ! ডি-লা-গ্র্যান্ডি—

বাকিটা ক্যাবলা আর বলতে দিলে না। ফস করে বলে বসল : ঢাউস ঘুড়ি বানিয়েছ বুঝি?

–বানিয়েছ বুঝি?–টেনিদা রেগে ভেংচে বললে, তুই আগে থেকে বলে দিলি কেন? তোকে আমি বলতে বারণ করিনি?

ক্যাবলা আশ্চর্য হয়ে বললে, তুমি আমাকে ঢাউস ঘুড়ির কথা বললেই বা কখন, বারণই বা করলে কবে? আমি তো নিজেই ভেবে বললুম।

–কেন ভাবলি?–টেনিদা রকে একটা কিল মেরেই উঃ উঃ করে উঠল : বলি, আগ বাড়িয়ে তোকে এসব ভাবতে বলেছে কে র‍্যা? প্যালা ভাবেনি, হাবলা ভাবেনি–তুই কেন। ভাবতে গেলি?

হাবুল সেন বললে, হুঁ, ওইটাই ক্যাবলার দোষ। এত ভাইব্যা ভাইব্যা শ্যাষে একদিন ও কবি হইব।

আমি মাথা নেড়ে বললুম, হুঁ, কবি হওয়া খুব খারাপ। আমার পিসতুতো ভাই ফুচুদা একবার কবি হয়েছিল। দিনরাত কবিতা লিখত। একদিন রামধন ধোপার খাতায় কবিতা করে লিখল :

পাঁচখানা ধুতি, সাতখানা শাড়ি
এসব হিসাবে হইবে কিবা?
এ-জগতে জীব কত ব্যথা পায়
তাই ভাবি আমি রাত্রি-দিবা।
রামধনের ওই বৃদ্ধ গাধা
মনটি তাহার বড়ই সাদা–
সে-বেচারা তার পিঠেতে চাপায়ে
কত শাড়ি ধুতি-প্যান্ট লইয়া যায়–
মনোদুখে খালি বোঝ টেনে ফেরে গাধা
একখানা ধুতি-প্যান্ট পরিতে না পায়!

টেনিদা বললে, আহা-হা, বেশ লিখেছিল তো! শুনে চোখে জল আসে!

হাবুল মাথা নেড়ে বললে, হ, খুবই করুণ।

আমি বললুম, কবিতাটা পড়ে আমারও খুব কষ্ট হয়েছিল। কিন্তু পিসিমা ধোপার হিসেবের খাতায় এইসব দেখে ভীষণ রেগে গেল! রেগে গিয়ে হাতের কাছে আর কিছু না পেয়ে একটা চাল কুমড়ো নিয়ে ফুচুদাকে তাড়া করলে। ঠিক যেন গদা হাতে নিয়ে শাড়িপরা ভীম দৌড়োচ্ছে।

টেনিদা বললে, তোর পিসিমার কথা ছেড়ে দে–ভারি বেরসিক। কিন্তু কী প্যাথেটিক কবিতা যে শোনালি প্যালা–মনটা একেবারে মজে গেল। ইস–সত্যিই তো। গাধা কত ধুতি-প্যান্ট-শাড়ি টেনে নিয়ে যায়, কিন্তু একখানা পরিতে না পায়।–বলে টেনিদা উদাস হয়ে দূরের একটা শালপাতার ঠোঙার দিকে তাকিয়ে রইল।

সান্ত্বনা দিয়ে হাবুল বললে, মন খারাপ কইর্যা আর করবা কী। এই রকমই হয়। দ্যাখো না–গোবর হইল গিয়া গোরর নিজের জিনিস, অন্য লোকে তাই দিয়া ঘুঁইট্যা দেয়। গোরু একখানা ঘুঁইট্যা দিতে পারে না।

দাঁত খিঁচিয়ে টেনিদা বললে, দিলে সব মাটি করে। এমন একটা ভাবের জিনিসধাঁ করে তার ভেতর গোবর আর খুঁটে নিয়ে এল। নে–ওঠ এখন, ঢাউস ঘুড়ি দেখবি চল।

.

–ডি-লা-এ্যান্ডি মেফিস্টোফিলিস ইয়াক ইয়াক—

বলতে বলতে আমরা যখন গড়ের মাঠে পৌঁছলুম তখন সবে সকাল হচ্ছে। চৌরঙ্গির এদিকে সূর্য উঠছে আর গঙ্গার দিকটা লালে লাল হয়ে গেছে। দিব্যি ঝিরঝির করে হাওয়া দিচ্ছেকখনও কখনও বাতাসটা বেশ জোরালো। চারদিকে নতুন ঘাসে যেন ঢেউ খেলছে। সত্যি বলছি আমি পটলডাঙার প্যালারাম, পটোল দিয়ে শিঙিমাছের ঝোল খাইআমারই ফুচুদার মতো কবি হতে ইচ্ছে হল।

কখন যে সুর করে গাইতে শুরু করেছি–রবি মামা দেয় হামা গায়ে রাঙা জামা ওই–সে আমি নিজেই জানিনে। হঠাৎ মাথার ওপর কটাৎ করে গাট্টা মারল টেনিদা।

–অ্যাই সেরেছে! এটা যে আবার গান গায়।

–তাই বলে তুমি আমার মাথার ওপর তাল দেবে নাকি?

–আমি চটে গেলম।

তাল বলে তাল! আবার যদি চামচিকের মতো চিচি করবি, তাহলে তোর পিঠে গোটাকয়েক ঝাঁপতাল বসিয়ে দেব সে বলে দিচ্ছি। এসেছি ঘুড়ি ওড়াতে–উনি আবার সুর ধরেছেন!

আমার মনটা বেজায় বিগড়ে গেল। খামকা সকালবেলায় নিরীহ ব্রাহ্মণ-সন্তানের মাথায় গাঁট্টা মারলে। মনে মনে অভিশাপ দিয়ে বললুম, হে ভগবান, তুমি ওড়বার আগেই একটা খোঁচা-টোঁচা দিয়ে টেনিদার ঢাউস ঘুড়ির ঢাউস পেটটা ফাঁসিয়ে দাও। ওকে বেশ করে আকেল পাইয়ে দাও একবার।

ভগবান বোধহয় সকালে দাঁতন করতে করতে গড়ের মাঠে বেড়াতে বেরিয়েছিলেন। আমার প্রার্থনা যে এমন করে তাঁর কানে যাবে–তা কে জানত।

ওদিকে বিরাট ঢাউসকে আকাশে ওড়াবার চেষ্টা চলছে তখন। টেনিদা দড়ির মস্ত লাটাইটা ধরে আছে–আর হাবুল সেন হাঁপাতে হাঁপাতে প্রকাণ্ড ঢাউসটাকে ওপরে তুলে দিচ্ছে। কিন্তু ঢাউস উড়ছে নাঘপাৎ করে নীচে পড়ে যাচ্ছে।

টেনিদা ব্যাজার হয়ে বললে, এ কেমন ঢাউস রে। উড়ছে না যে!

হাবুল সেন মাথা নেড়ে বললে, হ, এইখান উড়ব না। এইটার থিক্যা মনুমেন্ট উড়ান সহজ।

শুনে আমার যে কী ভালো লাগল। খামকা ব্রাহ্মণের চাঁদিতে গাঁট্টা মারা! হুঁ হুঁ। যতই পটোল দিয়ে শিঙিমাছের ঝোল খাই, ব্ৰহ্মতেজ যাবে কোথায়! ও ঘুড়ি আর উড়ছে না–দেখে নিয়ো।

খালি ক্যাবলা মিটমিট করে হাসল। বললে, ওড়াতে জানলে সব ঘুড়িই ওড়ে।

ওড়ে নাকি? টেনিদা দাঁত খিঁচিয়ে বললে, তবে দে না উড়িয়ে।

ক্যাবলা বললে, তোমার ঘুড়ি তুমি ওড়াবে, আমি ওসবের মধ্যে নেই। তবে বুদ্ধিটা বাতলে দিতে পারি। অত নীচ থেকে অত বড় ঘুড়ি ওড়ে? ওপর থেকে ছাড়লে তবে তো হাওয়া পাবে। ওই বটগাছটার ডাল দেখছ? ওখানে উঠে ঘুড়িটা ছেড়ে দাও। ডালটা অনেকখানি এদিকে বেরিয়ে এসেছে–ঘুড়ি গাছে আটকাবে না–ঠিক বোঁ করে উঠে যাবে। আকাশে।

টেনিদা বললে, ঠিক। একথাটা আমিই তো ভাবতে যাচ্ছিলুম। তুই আগে থেকে ভাবলি কেন র‍্যা? ভারি বাড় বেড়েছেনা? তোকে পানিশমেন্ট দিলুম। যা গাছে ওঠ

ক্যাবলা বললে, বা-রে। লোকের ভালো করলে বুঝি এমনিই হয়? দাঁত খিঁচিয়ে টেনিদা বললে, তোকে ভালো করতে কে বলেছিল–শুনি? দুনিয়ায় কারও ভালো করেছিস কি মরেছিস। যা–গাছে ওঠ–

–যদি কাঠপিঁপড়ে কামড়ায়?

কামড়াবে। আমাদের বেশ ভালোই লাগবে।

–যদি ঘুড়ি ছিঁড়ে যায়?

–তোর কান ছিঁড়ব! যা–ওঠ বলছি—

কী আর করে–যেতেই হল ক্যাবলাকে। যাওয়ার সময় বললে, ঘুড়ির দড়িটা ওই গোলপোস্টে বেঁধে দিয়ে টেনিদা। অত বড় ঢাউস খুব জোর টান দেবে কিন্তু।

টেনিদা নাক কুঁচকে মুখটাকে হালুয়ার মতো করে বললে, যা বেশি বকিসনি। ঘুড়ি উড়িয়ে উড়িয়ে বুড়ো হয়ে গেলুম–তুই এসেছিস ওস্তাদি করতে। নিজের কাজ কর।

ক্যাবলা বললে, বহুৎ আচ্ছা।

হু হু করে হাওয়া বইছে তখন। ডালের ডগায় উঠে ক্যাবলা ঢাউসকে ছেড়ে দিলে। সঙ্গে সঙ্গে গোঁ গোঁ করে ডাক ছেড়ে সেই পেল্লায় ঢাউস আকাশে উড়ল।

টেনিদার ওপর সব রাগ ভুলে গিয়ে মুগ্ধ হয়ে চেয়ে আছি। কী চমৎকার যে দেখাচ্ছে ঢাউসকে। মাথার দুধারে দুটো পতাকা যেন বিজয়গর্বে পতপত উড়ছে-গোঁ-গোঁ আওয়াজ তুলে ঘুড়ি ওপরে উঠে যাচ্ছে। টেনিদা চেঁচিয়ে উঠল : ডি-লা-গ্র্যান্ডি–

কিন্তু আচমকা টেনিদার চ্যাঁচানি বন্ধ হয়ে গেল। আর হাঁউমাউ করে ডাক ছাড়ল হাবুল।

–গেল—গেল—

কে গেল? কোথায় গেল?

কে আর যাবে! অমন করে কেই বা যেতে পারে টেনিদা ছাড়া? তাকিয়ে দেখেই আমার চোখ চড়াৎ করে কপালে উঠে গেল। কপালে বললেও ঠিক হয় না, সোজা ব্ৰহ্মতালুতে।

শুধু ঢাউসই ওড়েনি। সেই সঙ্গে টেনিদাও উড়ছে। চালিয়াতি করে লাটাই ধরে রেখেছিল হাতে, বাঘা ঢাউসের টানে সোজা হাত-দশেক উঠে গেছে ওপরে!

এক লাফে গাছ থেকে নেমে পড়ল ক্যাবলা। বললে, পাকোপাকড়ো

কিন্তু কে কাকে পাকড়ায়! ততক্ষণে টেনিদা পনেরো হাত ওপরে। সেখান থেকে তার আর্তনাদ শোনা যাচ্ছে :হাবুল রে–প্যালা রে-ক্যাবলা রে–

আমরা তিনজন একসঙ্গে চেঁচিয়ে উঠলুম :–ছেড়ে দাও, লাটাই ছেড়ে দাও—

টেনিদা কাঁউ কাঁউ করে বললে, পড়ে যে হাত-পা ভাঙব!

হাবুল বললে, তবে আর কী করবা! উইড়া যাও—

ঢাউস তখন আরও উপরে উঠেছে। জোরালো পুবের হাওয়ায় সোজা পশ্চিমমুখো ছুটেছে গোঁ-গোঁ করতে করতে। আর জালের সঙ্গে মাকড়সা যেমন করে ঝোলে, তেমনি করে মহাশূন্যে ঝুলতে ঝুলতে চলেছে টেনিদা।

পেছনে পেছনে আমরাও ছুটলুম। সে কী দৃশ্য! তোমরা কোনও রোমাঞ্চকর সিনেমাতেও তা দ্যাখোনি!

ওপর থেকে তারস্বরে টেনিদা বললে, কোথায় উড়ে যাচ্ছি বল তো?

ছুটতে ছুটতে আমরা বললুম, গঙ্গার দিকে।

–অ্যাঁ–ত্ৰিশূন্য থেকে টেনিদা কেঁউ কেঁউ করে বললে, গঙ্গায় পড়ব নাকি?

হাবুল বললে, হাওড়া স্টেশনেও যাইতে পারো।

-অ্যাঁ!

আমি বললুম, বর্ধমানেও নিয়ে যেতে পারে।

–বর্ধমান! বলতে বলতে শুন্যে একটা ডিগবাজি খেয়ে গেল টেনিদা।

ক্যাবলা বললে, দিল্লি গেলেই বা আপত্তি কী?সোজা কুতুবমিনারের চূড়ায় নামিয়ে দেবে এখন।

টেনিদা তখন প্রায় পঁচিশ হাত ওপরে। সেখান থেকে গোঙাতে গোঙাতে বললে, এ যে আরও উঠছে। দিল্লি গিয়ে থামবে তো? ঠিক বলছিস?

আমি ভরসা দিয়ে বললুম, না থামলেই বা ভাবনা কী? হয়ত মঙ্গলগ্রহেও নিয়ে যেতে পারে।

–মঙ্গলগ্রহ!–আকাশ ফাটিয়ে আর্তনাদ করে টেনিদা বললে, আমি মঙ্গলগ্রহে এখন যেতে চাচ্ছি না। যাওয়ার কোনও দরকার দেখছি না!

ক্যাবলা বললে, তবু যেতেই হচ্ছে। যাওয়াই তো ভালো টেনিদা। তুমিই বোধহয় প্রথম মানুষ যে মঙ্গলগ্রহে যাচ্ছ। আমাদের পটলডাঙার কত বড় গৌরব সেটা ভেবে দ্যাখো।

–চুলোয় যাক পটলডাঙা। আমি কিন্তু টেনিদা আর বলতে পারলে না, তক্ষুনি শূন্যে আর-একটা ডিগবাজি খেলে। খেয়েই আবার কাঁউ কাঁউ করে বললে, ঘুরপাক খাচ্ছি যে! আমি মোটেই ঘুরতে চাচ্ছি না–তবু বোঁ বোঁ করে ঘুরে যাচ্ছি।

ঘুড়ি তখন ক্যালকাটা গ্রাউন্ডের কাছাকাছি। আমরা সমানে পিছনে ছুটছি। ছুটতে ছুটতে আমি বললুম, ওরকম ঘুরতে হয়। ওকে মাধ্যাকর্ষণ বলে। সায়েন্স পড়োনি?

অনেক ওপর থেকে টেনিদা যেন কী বললে। আমরা শুনতে পেলুম না। কেবল কাঁউ কাঁউ করে খানিকটা আওয়াজ আকাশ থেকে ভেসে এল।

কিন্তু ওদিকে ঢাউস যত গঙ্গার দিকে এগোচ্ছে তত হাওয়ার জোরও বাড়ছে। পিছনে ছুটে আমরা আর কুলিয়ে উঠতে পারছি না। টেনিদা উড়ছে আর ডিগবাজি খাচ্ছে, ডিগবাজি খাচ্ছে আর উড়ছে।

স্ট্যান্ড রোড এসে পড়ল প্রায়। ঘুড়ি সমানে ছুটে চলেছে। এখুনি গঙ্গার ওপরে চলে যাবে। আমাদের লিডার যে সত্যিই গঙ্গা পেরিয়ে বর্ধমান হয়ে দিল্লি ছাড়িয়ে মঙ্গলগ্রহেই চলল। আমরা যে অনাথ হয়ে গেলুম।

আকাশ থেকে টেনিদা আবার আর্তস্বরে বললে, সত্যি বলছি–আমি মঙ্গলগ্রহে যেতে চাই না– কিছুতেই যেতে চাই না—

আমরা এইবারে একবাক্যে বললুম, না–তুমি যেয়ো না।

–কিন্তু নিয়ে যাচ্ছে যে!

–তা হলে তাড়াতাড়ি ফিরে এসো।–ক্যাবলা জানিয়ে দিলে।

–আর পৌঁছেই একটা চিঠি লিখো–আমি আরও মনে করিয়ে দিলুম : চিঠি লেখাটা খুব দরকার।

টেনিদা বোধহয় বলতে যাচ্ছিল নিশ্চয়ই চিঠি লিখবে, কিন্তু পুরোটা আর বলতে পারলে না। একবার কাঁউ করে উঠেই কোঁক করে থেমে গেল। আমরা দেখলুম, ঢাউস গোঁত্তা খাচ্ছে।

সে কী গোঁত্তা! মাথা নিচু করে বোঁ-বোঁ শব্দে নামছে তো নামছেই। নামতে নামতে একেবারে ঝপাস করে সোজা গঙ্গায়। মঙ্গলগ্রহে আর গেল নামত বদলে পাতালের দিকে রওনা হল।

আর টেনিদা? টেনিদা কোথায়? সেও কি ঘুড়ির সঙ্গে গঙ্গায় নামল?

না–গঙ্গায় নামেনি। টেনিদা আটকে আছে। আটকে আছে আউটরাম ঘাটের একটা মস্ত গাছের মগডালে। আর বেজায় ঘাবড়ে গিয়ে একদল কাক কাকা করে টেনিদার চারপাশে চক্কর দিচ্ছে।

ছুটতে ছুটতে আমরা গাছতলায় এসে হাজির হলুম। কেবল আমরাই নই। চারিদিক থেকে তখন প্রায় শ-দুই লোক জড়ো হয়েছে সেখানে। পোর্ট কমিশনারের খালাসি, নৌকোর মাঝি, দুটো সাহেব–তিনটে মেম।

-ওঃ মাই–হোয়াজজাট (হোয়াটস দ্যাট)?–বলেই একটা মেম ভিরমি গেল।

কিন্তু তখন আর মেমের দিকে কে তাকায়? আমি চেঁচিয়ে বললুম, টেনিদা, তা হলে মঙ্গলগ্রহে গেলে না শেষ পর্যন্ত?

টেনিদা ঢাউস ঘুড়ির মতো গোঁ-গোঁ আওয়াজ করে বললে, কাকে ঠোকরাচ্ছে!

–নেমে এসে তা হলে।

টেনিদা গাঁ-গাঁ করে বললে, পারছি না! ওফ–কাকে মাথা ফুটো করে দিলে রে পালা। পোর্ট কমিশনারের একজন কুলি তখুনি ফায়ার ব্রিগেডে টেলিফোন করতে ছুটল। ওরাই এসে মই বেয়ে নামিয়ে আনবে।

চাটুজ্যেদের রকে বসে আমি বললুম, ডি-লা-গ্র্যান্ডি–

সারা গায়ে আইডিন-মাখানো টেনিদা কাতর স্বরে বললে, থাক, ও আর বলিসনি। তার চাইতে একটা করুণ কিছু বল। তোর ফুচুদার লেখা রামধনের ওই বৃদ্ধ গাধার কবিতাটাই শোনা। ভারি প্যাথেটিক। ভারি প্যাথেটিক।

তত্ত্বাবধান মানে–জীবে প্রেম

রবিবারের সকালে ডাক্তার মেজদা কাছাকাছি কোথাও নেই দেখে আমি মেজদার স্টেথিসকোপ কানে লাগিয়ে বাড়ির হুলোবেড়াল টুনির পেট পরীক্ষা করছিলাম। বেশ গুরগুর করে আওয়াজ হচ্ছে, মানে এতদিন ধরে যতগুলো নেংটি ইঁদুর আরশোলা টিকটিকি খেয়েছে। তারা ওর পেটের ভেতরে ডাকাডাকি করছে বলে মনে হচ্ছিল। আমি টুনির পেট সম্পর্কে এইসব দারুণ দারুণ চিন্তা করছি, এমন সময় বাইরে থেকে টেনিদা ডাকল : প্যালা, কুইক–কুইক!

স্টেথিসকোপ রেখে এক লাফে বেরিয়ে এলুম বাড়ি থেকে।

–কী হয়েছে টেনিদা?

টেনিদা গম্ভীর হয়ে বললে, পুঁদিচ্চেরি।

মনে কোনওরকম উত্তেজনা এলেই টেনিদা ফরাসী ভাষায় কথা বলতে থাকে। তখন কে বলবে, স্রেফ ইংরিজির জন্যেই ওকে তিন-তিনবার স্কুল ফাঁইন্যালে আটকে যেতে হয়েছে।

আমি বললুম, পুঁদিচ্চেরি মানে?

–মানে ব্যাপার অত্যন্ত সাঙ্ঘাতিক। এক্ষুনি তোকে আমার সঙ্গে যেতে হবে। ক্যাবলা কিংবা হাবুল সেন কাউকে বাড়িতে পেলুম না–তাই সঙ্গে তোকেই নিয়ে যেতে এসেছি।

–কোথায় নিয়ে যাবে?

–কালীঘাটে।

–কালীঘাটে কেন?–আমি উৎসাহ বোধ করলুম। কোথাও খাওয়াটাওয়ার ব্যবস্থা আছে বুঝি?

–এটার দিনরাত খালি খাওয়ার চিন্তা!–বলে টেনিদা আমার দিকে তাক করে চাঁটি তুলল, সঙ্গে সঙ্গে এক লাফে তিন হাত দূরে ছিটকে গেলুম আমি।

–মারামারি কেন আবার? কী বলতে চাও, খুলেই বলো না।

চাঁটিটা কষাতে না পেরে ভীষণ ব্যাজার হয়ে টেনিদা বললে, বলতে আর দিচ্ছিস কোথায়?সমানে চামচিকের মতো চাঁকাক করছিস তখন থেকে। হয়েছে কী জানিস, আমার পিসতুতো ভাই ডোম্বলদার ফ্ল্যাটটা একটু তত্ত্বাবধান–মানে সুপারভাইজ করে আসতে হবে।

–তোমার ভোম্বলদা কী করছেন? কম্বল গায়ে দিয়ে লম্বা হয়ে পড়ে আছেন?

–আরে না না! ডোম্বলদা, ডোম্বল-বৌদি, মায় ডোম্বলদার মেয়ে ব্যাধি-সবাই মিলে ঝাঁসি না গোয়ালিয়র কোথায় বেড়াতে গেছে। আজই সকালে সাড়ে দশটার গাড়িতে ওরা আসবে। এদিকে আমি তো স্রেফ ভুলে মেরে বসে আছি, বাড়ির কী যে হাল হয়েছে কিছু জানি না। চল–দুজনে মিলে এই বেলা একটু সাফ-টাফ করে রাখি।

শুনে পিত্তি জ্বলে গেল। আমি তোমার ডোম্বলদার চাকর নাকি যে ঘর ঝাঁট দিতে যাব? তোমার ইচ্ছে হয় তুমি যাও।

টেনিদা নরম গলায় আমাকে বোঝাতে লাগল তখন।–ছি প্যালা, ওসব বলতে নেই-পাপ হয়। চাকরের কথা কেন বলছিস র‍্যা–এ হল পরোপকার। মানে জীবসেবা। আর জানিস তো–জীবে প্রেম করার মতো এমন ভালো কাজ আর কিচ্ছুটি নেই?

আমি মাথা নেড়ে বললুম, তোমার ভোলদাকে প্রেম করে আমার লাভ কী? তার চেয়ে আমার হুলো বেড়াল টুনিই ভাল। সে ইঁদুর-টিদুর মারে।

টেনিদা একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললে, কলেজে ভর্তি হয়ে তুই আজকাল ভারি পাখোয়াজ হয়ে গেছিস ভারি ডাঁট হয়েছে তোর! আচ্ছা চল আমার সঙ্গে বিকেলে তোকে চাচার হোটেলে কাটলেট খাওয়াব।

–সত্যি?

–তিন সত্যি। কালীঘাটের মা কালীর দিব্যি।

এরপরে জীবকে–মানে ভোলদাকে প্রেম না করে আর থাকা যায়? দারুণ উৎসাহের সঙ্গে আমি বললুম, আচ্ছা চলো তাহলে।

বাড়িটা কালীঘাট পার্কের কাছেই। তেতলার ফ্ল্যাটে ভোলা থাকেন, ভোম্বল-বৌদি থাকেন, আর তিন বছরের মেয়ে ব্যাম্বি থাকে।

টেনিদা চাবি খুলতে যাচ্ছিল, আমি হাঁ-হাঁ করে বাধা দিলুম।

–আরে আরে, কার ঘর খুলছ? দেখছ না–নেমপ্লেট রয়েছে অলকেশ ব্যানার্জি, এম. এস. সি.?

–ডোম্বলদার ভালো নামই তো অলকেশ।

শুনেই মন খারাপ হয়ে গেল। এমন নামটাই বরবাদ? ডোম্বলদার পোশাকি নাম দোলগোবিন্দ হওয়া উচিত। ভূতেশ্বর হতেও বাধা নেই, এমনকি কালীচরণও হতে পারে। কিন্তু অলকেশ একেবারেই বেমানান–আর অলকেশ হলে কিছুতেই ভোলা হওয়া উচিত নয়।

দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে এসব ভাবছি আর নাক চুলকোচ্ছি, হঠাৎ টেনিদা একটা হাঁক ছাড়ল।

–ওখানেই দাঁড়িয়ে থাকবি নাকি হাঁ করে? ভেতরে আয়।

ঢুকে পড়লুম ভেতরে।

গোছাবার সাজাবার কিছু নেই–সবই ভোম্বল-বৌদি বেশ পরিপাটি করে রেখে গেছেন। দিব্যি বসবার ঘরটি–আমি আরাম করে একটা সোফার ওপর বসে পড়লুম।

–এই, বসলি যে?

–কী করব, করবার তো কিছুই নেই।

–তা বটে।–টেনিদা হতাশ হয়ে চারদিকে তাকিয়ে দেখল একবার,ধুলো-টুলোও তো বিশেষ পড়েনি দেখছি।

–বন্ধ ঘরে ধুলো আসবে কোত্থেকে?

–হুঁ, তাই দেখছি। কিছুক্ষণ নাক-টাক চুলকে টেনিদা বললে, কোনও উপকার না করে চলে গেলে মনটা যে বড় হু-হুঁ করবে র‍্যা! আচ্ছা–একটা কাজ করলে হয় না? ঘরে ধুলো না থাকলেও মেজের ওই কার্পেটটায় নিশ্চয় আছে। আর ধুলো থাকবে না অথচ কার্পেট থাকবে–এ কখনও হতেই পারে না, এমন কোনওদিন হয়নি। আয়–বরং এটাকে—

কার্পেট ঝাড়বার প্রস্তাবটা আমার একেবারেই ভালো লাগল না। আপত্তি করে বললুম, কার্পেট নিয়ে আবার টানাটানি কেন? ও যেমন আছে তেমনি থাক না। খামকা–

–শাট আপ! কাজ করবি নে তো মিথ্যেই ট্রাম ভাড়া দিয়ে তোকে কালীঘাটে নিয়ে এলম নাকি? সোফায় বসে আর নবাবী করতে হবে না প্যালা, নেমে আয় বলছি–

অগত্যা নামতে হল, সোফা আর টেবিল সরাতে হল, কার্পেট টেনে তুলতে হল, তারপর একবার মাত্র একটি বার ঝাড়া দিতেই ডি লা গ্র্যান্ডি মেফিস্টোফিলিস!

ঘরের ভেতরে যেন ঘূর্ণি উঠল একটা! চোখের পলকে অন্ধকার।

টালা থেকে ট্যাংরা আর শেয়ালদা থেকে শিয়াখালা পর্যন্ত যত ধুলো ছিল একসঙ্গে পাক খেয়ে উঠল।–সেরেছে, সেরেছে, বলে এক বাঘা চিৎকার দিলুম আমি, তারপর দুলাফে আমরা বেরিয়ে পড়লুম ঘর থেকে নাকে ধুলো, কানে ধুলো, মুখে ধুলো, মাথায় ধুলো। পুরো দশটি মিনিট খক-খক খকখক করে কাশির প্রতিযোগিতা। এর মধ্যে আবার কোত্থেকে গোটা দুই আরশোলা আমার নাকের ওপর ডিগবাজি খেয়েও গেল।

কাশি বন্ধ হলে মাথা-টাথা ঝেড়ে, মুখ-ভর্তি কিচকিচে বালি নিয়ে আমি বললুম, এটা কী হল টেনিদা?

টেনিদা গাঁক-গাঁক করে বললে, হুঁ! কেমন বেয়াড়া হয়ে গেল রে! মানে এত ধুলো যে ওর ভেতরে থাকতে পারে–বোঝাই যায়নি। ইস–ঘরটার অবস্থা দেখছিস?

হ্যাঁ-দেখবার মতো চেহারাই হয়েছে এবার। দরজা দিয়ে তখনও ধোঁয়ার মতো ধুলো বেরুচ্ছে–সোফা, টেবিল, টিপয়, বুক-কেস, রেডিয়ো-সব কিছুর ওপর নিট তিন ইঞ্চি ধুলোর আস্তর! ভোল-বৌদি ঘরে পা দিয়েই স্রেফ অজ্ঞান হয়ে পড়বেন।

দু-হাতে মাথা চুলকোতে চুলকোতে টেনিদা বললে, ইঃ–একেবারে নাইয়ে দিয়েছে রে!

আমি বললুম, ভালোই তো হল। কাজ করতে চাইছিলে, করো এবার প্রাণ খুলে! সারা দিন ধরেই ঝাঁট দিতে থাকো!

দাঁত খিচোতে গিয়েই বালির কিচকিচানিতে টেনিদা খপাৎ করে মুখ বন্ধ করে ফেলল।

–তা ঝাঁট তো দিতেই হবে। বাড়িতে এসে এই দশা দেখবে নাকি ভোম্বলদা?

–আবার ঝাড়তে হবে কার্পেট!

–নিকুচি করেছে কার্পেটের! চল–ঝাটা খুঁজে বের করি।

ঝাঁটা আর পাওয়া যায় না। বসবার ঘরে নয়–শোবার ঘরে নয়, শেষ পর্যন্ত রান্নাঘরে এসে হাজির হলুম আমরা।

-আরে ওই তো ঝাঁটা!

তার আগে জাল-দেওয়া মিট-সেফের দিকে নজর পড়েছে আমার।

–টেনিদা!

–কী হল আবার?–টেনিদা খ্যাঁক-খ্যাঁক করে বললে, সারা ঘর ধুলোয় এককার হয়ে রয়েছে–এখন আবার ডাকাডাকি কেন? আয় শিগগির–একটু পরেই তো ওরা এসে পড়বে!

–আমি বলছিলুম কীকান দুটো একবার চুলকে নিয়ে জবাব দিলুম : মিট-সেফের ভেতর যেন গোটা-তিনেক ডিম দেখা যাচ্ছে।

–তাতে কী হল?–একটা মাখনের টিনও দেখতে পাচ্ছি। টেনিদার মনোযোগ আকৃষ্ট হল।

–আচ্ছা, বলে যা।

–দুটো কেরোসিন স্টোভ দেখতে পাচ্ছি দু-বোতল তেল দেখা যাচ্ছে–ওখানে শেলফের ওপর একটা দেশলাইও যেন চোখে পড়ছে।

–হুঁ, তারপর? আমি ওয়াশ-বেসিনটা খুলোম।

–এতেও জল আছে–দেখতে পাচ্ছ তো?

–সবই দেখতে পাচ্ছি। তারপর?

আমি আর একবার বাঁ কানটা চুলকে নিলুম : মানে সামনে এখন অনেক কাজ–যাকে বলে দুরূহ কর্তব্য। ঘর থেকে ওই মনখানেক ধুলো ঝেটিয়ে বের করতে ঘন্টাখানেক তো মেহনত করতে হবে অন্তত? আমি বলছিলুম কী, তার আগে একটু কিছু খেয়ে নিলে হয় না? ধরো তিনটে ডিম দিয়ে বেশ বড় বড় দুটো ওমলেট হতে পারে—

–ব্যস-ব্যস, আর বলতে হবে না! টেনিদার জিভ থেকে সড়াক করে একটা আওয়াজ বেরুল : এটা মন্দ বলিসনি। পেট খুশি থাকলে মেজাজটাও খুশি থাকে। আর এই যে একটা বিস্কুটের টিনও দেখতে পাচ্ছি–

পত্রপাঠ টিনটা টেনে নামাল টেনিদা, কিন্তু খুলেই মুখটা গাজরের হালুয়ার মতো করে বললে, ধেৎ!

–কী হল, বিস্কুট নেই?

–নাঃ, কতগুলো ডালের বড়ি! ছ্যা-ছ্যাঁ!–টেনিদা ব্যাজার হয়ে বললে, জানিস, ভোম্বল-বৌদি এম. এ. পাশ, অথচ বিস্কুটের টিনে বড়ি রাখে। রামমাঃ।

আমি বললুম, তাতে কী হয়েছে? আমার এলাহাবাদের সোনাদিও তো কীসব থিসিস লিখে ডাক্তার হয়েছে–সেও তো ডালের বড়ি খেতে খুব ভালোবাসে।

–রেখে দে তোর সোনাদি!–টেনিদা ঠক করে বড়ির টিনটাকে একপাশে ঠেলে দিয়ে। বললে, বলি, মতলব কী তোর? খালি তক্কোই করবি আমার সঙ্গে, না ওমলেট-টোমলেট ভাজবি?

-আচ্ছা, এসো তা হলে, লেগে পড়া যাক।

লেগে যেতে দেরি হল না। সসপ্যান বেরুল, ডিম বেরুল, চামচে বেরুল, লবণ বেরুল, লঙ্কার গুঁড়োও পাওয়া গেল খানিকটা। শুধু গোটা-দুই পেঁয়াজ পাওয়া গেলেই আর দুঃখ থাকত না কোথাও।

টেনিদা বললে, ডি লা গ্র্যান্ডি। আরে, ওতেই হবে। তুই ডিম তিনটে ফেটিয়ে ফ্যাল–আমি স্টোভ ধরাচ্ছি ততক্ষণে।

ওমলেট বরাবর খেয়েই এসেছি, কিন্তু কী করে যে ফেটাতে হয় সেটা কিছুতেই মনে করতে পারলুম না। নাকি, ফোঁটাতে বলছে? তা হলে তো তা দিতে হয়। কিন্তু তা দিতে থাকলে ও কি আর ডিম থাকবে? তখন তো বাচ্চা বেরিয়ে আসবে। আর বাচ্চা বেরিয়ে এলে আর ওমলেট খাওয়া যাবে না–তখন চিকেন কারি রান্না করতে হবে। আর তা হলে–

টেনিদা বললে, অমন টিকটিকির মতো মুখ করে বসে আছিস কেন র‍্যা? তোকে ডিম ফেটাতে বললুম না?

–ফেটাতে বলছ? মানে ফাটাতে হবে? নাকি ফোঁটাতে বলছ? ফোঁটাতে আমি পারব সাফ বলে দিচ্ছি তোমাকে।

–কী জ্বালা!–টেনিদা খেঁকিয়ে উঠল : কোনও কাজের নয় এই হতচ্ছাড়াটাখালি খেতেই জানে! ডিম কী করে ফেটাতে হয় তাও বলে দিতে হবে? গোড়াতে মুখগুলো একটু ভেঙে নে–তারপর পেয়ালায় ঢেলে চামচ দিয়ে বেশ করে নাড়তে থাক। বুঝেছিস?

আরে তাই তো! এতক্ষণে মালুম হল আমার। আমাদের পটলডাঙার ‘দি গ্রেট আবোর-খাবো রেস্তোরাঁ’র বয় কেষ্টাকে অনেকবার কাঁচের গেলাসে ডিমের গোলা মেশাতে দেখেছি বটে।

পয়লা ডিমটা ভাঙতেই একটা বিচ্ছিরি বদ গন্ধে সারা ঘর ভরে উঠল। দোসরা ডিম থেকেও সেই খোশবু।

নাক টিপে ধরে বললুম, টেনিদা–যাচ্ছেতাই গন্ধ বেরুচ্ছে কিন্তু ডিম থেকে!

টেনিদা স্টোভে তেল ভরতে-ভরতে বললে, ডিম থেকে কবে আবার গোলাপ ফুলের গন্ধ বেরোয়? নাকি ডিম ভাঙলে তা থেকে হালুয়ার সুবাস বেরুবে? নে–নিজের কাজ করে যা।

–পচা বলে মনে হচ্ছে আমার।

–তোর মাথার ঘিলুগুলোই পচে গেছে–টেনিদা চটে বললে, একটা ভালো কাজের গোড়াতেই তুই বাগড়া দিবি! নে–হাত চালা। তোর ইচ্ছে না হয় খাসনি–আমি যা পারি ম্যানেজ করে নেব।

–করো, তুমিই করো তবে বলে যেই তেসরা নম্বর ডিম মেজেতে ঠুকেছি—

গলগল করে মেজে থেকে যে বস্তু বেরিয়ে এল, তার যে কী নাম দেব তা আমি আজও জানি না। আর গন্ধ? মনে হল দুনিয়ার সমস্ত বিকট বদ গন্ধকে কে যেন ওর মধ্যে ঠেসে রেখেছিল–একেবারে বোমার মতো ফেটে বেরিয়ে এল তারা। মনে হল, এক্ষুনি আমার দম আটকে যাবে।

–গেছি–গেছি বলে আমি একদম ঠিকরে পড়লুম বাইরে। সেই দুর্ধর্ষ মারাত্মক গন্ধের ধাক্কায় বোঁ করে যেন মাথাটা ঘুরে গেল, আর আমি দেওয়ালে ঠেস দিয়ে বসে পড়লুম শিবনেত্র হয়ে।

–উঁরে ব্বাপ–ই কীঁ গন্ধ র‍্যা!–টেনিদার একটা আর্তনাদ শোনা গেল। তারপর—

এবং তারপরেই–

টেনিদাও খুব সম্ভব একটা লাফ মেরেছিল। এবং পেল্লায় লাফ। পায়ের ধাক্কায় জ্বলন্ত কেরোসিন স্টোভটা তেল ছড়াতে ছড়াতে বলের মতো গড়িয়ে এল–সোজা গিয়ে হাজির হল ডোম্বলদার শোবার ঘরের দরজার সামনে। আর ডোম্বল-বৌদির সাধের সম্বলপুরী পদ দাউদাউ করে জ্বলে উঠল তৎক্ষণাৎ!

টেনিদা বললে, আগুন–আগুনফায়ার ব্রিগেড বসবার ঘরে টেলিফোন আছে। প্যালা-দৌড়ে যা–জিরো ডায়েলফায়ার ব্রিগেড–

ঊর্ধ্বশ্বাসে ফোন করতে ঢুকেছি, সেই পাকার কার্পেটে পা আটকে গেল। হাতে টেলিফোনও তুলেছিলুম, সেইটে সুদুই ধপাস করে রাম-আছাড় খেলুম একটা। ক্র্যাংকড়াৎ করে আওয়াজ উঠল। টেলিফোনের মাউথ-পিসটা সঙ্গে সঙ্গে ভেঙে দু-টুকরো। যাক, নিশ্চিন্দি! ফায়ার ব্রিগেডকে আর ডাকতে হল না!

উঠে বসবার আগেই ঝপাস–ঝপাস!

টেনিদা দৌড়ে বাথরুমে ঢুকেছে, আর দুবালতি পনেরো দিনের পচা জল চৌবাচ্চা থেকে তুলে এনে ছুঁড়ে দিয়েছে সম্বলপুরী পদার ওপর। আধখানা পর্দা পুড়িয়ে আগুন নিবেছে, কিন্তু শোবার ঘরে জলের ঢেউ খেলছে–বিছানা-পত্ৰ ভিজে একাকার, খানিকটা জল চলকে গিয়ে ড্রেসিং টেবিলটাকেও সাফ-সুফ করে দিয়েছে।

নিজেদের কীর্তির দিকে তাকিয়ে হাঁ করে দাঁড়িয়ে রইলুম আমরা। বাড়ি-ভর্তি পচা ডিম আর পোড়া কাপড়ের গন্ধবসবার ঘরে দুইঞ্চি ধুলোর আস্তর–শোবার ঘর আর বারান্দা জলে থইথই–আধ-পোড়া পদাটা থেকে জল চুঁইয়ে পড়ছে, টেলিফোনটা ভেঙে চুরমার।

একেই বলে বাড়ি সুপারভাইজ করা–এর নামই জীবে প্রেম!

ঠিক তখনই নীচ থেকে ট্যাক্সির হর্ন বেজে উঠল–ভ্যাঁ–ভ্যঁপ–প!

টেনিদা নড়ে উঠল সঙ্গে সঙ্গে মাথা সাফ হয়ে গেছে ওর। চিরকালই দেখে আসছি এটা।

–প্যালা, কুইক।

কিসের কুইক সেকথাও কি বলতে হবে আর? আমিও পটলডাঙার ছেলেট্যাক্সির হর্ন শুনেই বুঝতে পেরেছি সব। সিঁড়ি দিয়ে তো নামলুম না–যেন উড়ে পড়লুম রাস্তায়!

ট্যাক্সি থেকে ভোম্বলদা নামছেন, ভোম্বল-বৌদি নামছেন, ডোম্বলদার ছোঁকরা চাকর জলধরের কোলে ব্যাম্বি নামছে।

আমাদের দেখেই ভোম্বলদা চেঁচিয়ে উঠলেন–কীরে টেনি, বাড়িঘর সব–

–সব ঠিক আছে ভোম্বলদা–একেবারে ছবির মতো সাজিয়ে দিয়ে এসেছি বলেই টেনিদা চাবির গোছাটা ছুঁড়ে দিলে ভোলার দিকে। তারপর হতভম্ব ডোম্বলদা একটা কথা বলবার আগেই দু-জনে দুলাফে একটা দুনম্বর চলতি বাসের ওপর।

আর দাঁড়ানো চলে এরপর? এক সেকেণ্ডও?

দধীচি, পোকা ও বিশ্বকর্মা

আপাতত গভীর অরণ্যে ধ্যানে বসে আছি। বেশ মন দিয়েই ধ্যান করছি। শুধু কতকগুলো পোকা উড়ে উড়ে ক্রমাগত নাকে মুখে এসে পড়ছে আর এমন বিশ্রী লাগছে যে কী বলব! নাকে ঢুকে সুড়সুড়ি দিচ্ছে, কানের ভেতর ঢুকে ওই গভীর গহুরটার ভেতরে কোনও জটিল রহস্য আছে কিনা সেটাও বোঝবার চেষ্টা করছে। একবার ঢোক গিলতে গিয়ে ডজনখানিক খেয়েও ফেলেছি। খেতে বেশ মৌরি মৌরি লাগল—কিন্তু যা বিকট গন্ধ! বমি করতে পারতাম, কিন্তু ধ্যান করতে বসলে তো আর বমি করা যায় না। তাড়াব—সে-উপায়ও নেই, কারণ এখন আমি সমাধিস্থ—একেবারে নিবাত-নিষ্কম্প হয়েই থাকতে হবে আমাকে।

আমি গোড়াতেই বুঝেছিলাম এরকম হবে। হাবুলকেও বলেছিলাম কথাটা। কিন্তু সে তখন ইন্দ্ৰত্ব লাভ করে কৈলাসে শিবের কাছে যাওয়ার কথা ভাবছে, আমলই দিলে না। বললে, যাঃ যাঃ, এসব ওসব ফ্যাচফ্যাঁচ করিসনি। অরণ্যে পোকা থাকেই এবং নাকে মুখেও তারা পড়ে। চুপচাপ বরদাস্ত করে যানইলে মহর্ষি হবি কেমন করে?

তা বটে। তবে একটা জিনিস বুঝেছি মহর্ষিদের মেজাজ অমন ভীমরুলের চাকের মতো কেন, আর কথায় কথায়ই তাঁরা অমন তেড়ে ব্রহ্মশাপ ঝাড়েন কেন! আরে বাপু, ধৈর্যের একটা সীমা তো আছে মানুষের। নাকে মুখে অমন পোকার উপদ্রব হলে শান্তনুর মতো শান্ত মানুষও যে দুর্বাসা হতে বাধ্য, এ ব্যাপারে আমার আর তিলমাত্রও সন্দেহ নেই।

আচ্ছা জ্বালাতনেই পড়া গেল বাস্তবিক। সত্যি বলছি, আমি প্যালারাম বাঁড়ুজ্যে, পালাজ্বরে ভুগি আর বাসকপাতার রস খাই, আমার কী দায়টা পড়েছে মহর্ষি-টহর্ষির মতো গোলমেলে ব্যাপারে পা বাড়িয়ে? পটলডাঙার গলিতে থাকি, পটোল দিয়ে শিংমাছের ঝোল আর আতপ চালের ভাত আমার বরাদ্দ, একমুঠো চানাচুর খেয়েছি কি পেটের গোলমালে আমার পটল তুলবার, জো! এ-হেন আমি—একেবারে গোরুর মতো বেচারা লোক, আমিই শেষে পড়ে গেলাম ছহাত লম্বা আর বিয়াল্লিশ ইঞ্চি বুক-ওলা টেনিদার পাল্লায়।

আর টেনিদার পাল্লায় পড়া মানে যে কী, যারা পড়োনিউহু, ভাবতেই পারবে না। গড়ের মাঠের গোরা থেকে চোরাবাজারের চালিয়াত দোকানদার পর্যন্ত ঠেঙিয়ে একেবারে রপ্ত। হাত তুললেই মনে হবে রদ্দা মারলে, দাঁত বার করলেই বোধ হবে কামড়ে দিলে বোধ হয়। এই ভৈরব ভয়ঙ্কর লোকের খপ্পরে পড়েই আমাকে এখন মহর্ষি হয়ে ধ্যান করতে হচ্ছে।

কী আর করি! বসে আছি তো বসেই আছি। অরণ্যের ভেতরে একটা ফুটো—সেখান দিয়ে দেখছি হতভাগ্য হাবুলের নাক বেরিয়ে আছে। পোকার কামড়ে জেরবার হয়ে ভাবছি। ওই নাকেই একটা ধাঁ করে ঘুষি বসাব কিনা, এমন সময় শিষ্য দধিমুখের প্রবেশ।

দধিমুখ বললে, প্রভু আছে নিবেদন।

বললাম, কহ বৎস, শুনিব নিশ্চয়।

দধিমুখ বললে, কালি নিশিশেষে

দেখিলাম আশ্চর্য স্বপন।
দেখিলাম প্রভু যেন দেবদেহ ধরি
আরোহিয়া অগ্নিময় রথে,
চলেছেন মহাব্যোমে ছায়াপথ করি বিদারণ!
সত্ৰাসে কহিনু কাঁদি–
ওয়াকওয়াক্ থুঃ।

আর কী, পোকা! থু থু করে দধিমুখ সেটা আমার গায়েই ঝেড়ে দিলে, শিষ্যের আস্পর্ধাখানা দ্যাখো একবার। রাগে আমার শরীর জ্বলে গেল,—টিকি খাড়া হয়ে উঠল ব্রহ্মতেজে। কিন্তু শিষ্যকে শাপ দিলেই তো সব মাটি। মনে মনে ভাবলাম, দাঁড়াও চাঁদ, তোমাকেও শায়েস্তা করতে হচ্ছে।

হেসে বললাম, আছে, আছে রহস্য অদ্ভুত।

নিরেট মগজ তব সহজে তো বুঝিবে না সেটা,
কাছে এসো কহি কানে কানে।

দধিমুখ হাঁ করে তাকিয়ে রইল। আমার মুখ থেকে যা আশা করছিল তা শুনতে পায়নি কী যে করবে ঠিক বুঝতে পারছে না। দধিমুখ অসহায়ভাবে একবার চারদিকে তাকাল।

আমি বললাম, দাঁড়াইয়া কেন?

কাছে এসো, মুখ আনো কানের নিকটে,
তবে তো জানিবে সেই অদ্ভুত বারতা।
এসো বৎস–
বালক, আরও কাছে আয়–কাছে আয় না—

দধিমুখের বয়স অল্প—একেবারে আনাড়ি। ইতস্তত করে, যেই আমার কানের কাছে মুখ আনা, অমনি আমি পালটা জবাব দিলাম। মস্ত একটা হাঁ করলাম, সঙ্গে সঙ্গেই এক ঝাঁক পোকা পড়ল মুখের ভেতর। আর পত্রপাঠ সেগুলো থুথু শব্দে ফেরত গেল দধিমুখের গালে, নাকে, মুখে, কপালে। শিষ্যকে গুরুর স্নেহাশিস!

দধিমুখ অ্যাঁ-অ্যাঁ করে উঠল। সঙ্গে সঙ্গে ঝড়াং করে ড্রপ সিন। খট করে বাঁশটা আমার নাকে পড়ল, তারপর সোজা নীচে। সিন শেষ হওয়ার আগেই দ্বিতীয় অঙ্ক সমাপ্ত।

তক্ষুনি স্টেজের ভেতর ছুটে এল ইন্দ্রবেশী হাবুল আর বিশ্বকর্মবেশী টেনিদা। টেনিদা বললে, এটা কী হল—অ্যাাঁ? এর মানেটা কী, শুনি?

আমি বিদ্রোহ করে বললাম, কিসের মানে?

টেনিদা দাঁত খিচিয়ে উঠল : প্লে-টা তুই মাটি করবি হতভাগা? কেন ওভাবে থুতু দিলি ক্যাবলার মুখে? একদম বরবাদ হয়ে গেল সিনটা। কী রকম হাসছে অডিয়ান্স—তা দেখছিস?

আমি বললাম, ক্যাবলাই তো থুতু দিয়েছে আগে।

টেনিদা বললে, হুম। দুটোর মাথাই একসঙ্গে ঠুকে দেব এক জোড়া বেলের মতো। যাক যা হয়ে গেছে সে তো গেছেই। এখন পরের সিনগুলোকে ভালো করে ম্যানেজ করা চাই–বুঝলি? যদি একটু বেয়াড়াপনা করিস তো একটা চাঁটির চোটে নাক একেবারে নাসিকে পাঠিয়ে দেব।

আমি বললাম, তুমি তো বলেই খালাস। কিন্তু স্টেজে হাঁ করে বসে ওই পোকা হজম করবে কে, সেটা শুনি?

টেনিদা হুঙ্কার করল, তুই করবি। আলবাত তোকেই করতে হবে। থিয়েটার করতে পারবি আর পোকা খেতে পারবি না? দরকার হলে মশা খেতে হবে, মাছি খেতে হবে–

হাবুল যোগ দিয়ে বললে, ইঁদুর খেতে হবে, বাদুড় খেতে হবে–

টেনিদা বললে, মাদুর খেতে হবে, এমন কি খাট-পালং খাওয়াও আশ্চর্য নয়। হুঁ হুঁ বাবা, এর নাম থিয়েটার।

–থিয়েটার করতে গেলে ওসব খেতে হয় নাকি?—আমি ক্ষীণ প্রতিবাদ জানালাম।

—হয় হয়। তুই এ-সবের কী বুঝিস র‍্যা—অ্যাাঁ? দানীবাবুর নাম শুনেছিস, দানীবাবু? তিনি যখন সীতার ভূমিকায় প্লে করতেন, তখন মনুমেন্ট খেয়ে নামতেন, সেটা জানিস?

—মনুমেন্ট খেয়ে!

—হ্যাঁ হ্যাঁ—মনুমেন্ট খেয়ে। যাঃ—যাঃ ক্যাঁচম্যাচ করিসনি। এক্ষুনি সিন উঠবে—কেটে পড়—নিজের পার্ট মুখস্থ করগে।

বেগুন-খেতে কাক-তাড়ানো কেলে হাঁড়ির মতো মুখ করে আমি স্টেজের একধারে এসে বসলাম। মনুমেন্ট খাওয়া! চালিয়াতির আর জায়গা পাওনি-মানুষে কখনও মনুমেন্ট খেতে পারে। কিন্তু প্রতিবাদ করলেই চাঁটি, তাই অমন বোম্বাই চালখানাও হজম করে গেছি।

থিয়েটার করতে এলেই পোকা খেতে হবে! কেন রে বাপু, তোমাদের সঙ্গে থিয়েটার না করতে পারলে তো আমার আর শিঙিমাছের ঝোল হজম হচ্ছিল না কিনা! আমি প্যালারাম বাঁড়ুজ্যে, আমার পেটজোড়া পিলে—দায় পড়েছিল আমার একমুখ কুটকুটে দাড়ি নিয়ে দধীচি সাজতে! যত সব জোচ্চোরের পাল্লায় পড়ে পড়ে এখন আমার এই হাঁড়ির হাল।

দিব্যি বসেছিলাম চাটুজ্যেদের রোয়াকে—ওরা উঠনে হাত-পা নেড়ে রিহার্সেল দিচ্ছিল। কিন্তু দধীচি সাজবার ছেলে পাওয়া যাচ্ছিল না। টেনিদা তার ভাঁটার মতো চোখ পাকিয়ে এদিক ওদিক তাকাতে তাকাতে এসে খপ করে আমার কাঁধটা ধরে ফেলল : অ্যাই পাওয়া গেছে।

আমি বললাম, অ্যাঁ-অ্যাঁ—

টেনিদা বাঘাটে গলায় বললে, অ্যাঁ-অ্যাঁ নয়, হ্যাঁ হ্যাঁ। দিব্যি মুনি-ঋষির মতো চেহারা তোর, বেশ অহিংস ছাগল ছাগল ভাব। গালে ছাগলের মতো দাড়ি লাগিয়ে দেব,যা মানাবে, আঃ! দেখাবে একেবারে রায়বাড়ির কেশোবুড়োটার মতো।

আপাতত এই তার পরিণতি।

এ-অঙ্কে আমার পার্ট নেই, তাই স্টেজের অন্ধকার একটা কোনায় ঝিম মেরে বসে আছি। দাড়িটা হাতে খুলে নিয়েছি, আর মশা তাড়াচ্ছি প্রাণপণে। নাঃ—এ অসম্ভব। আবার স্টেজে গেলেই ধ্যানে বসতে হবে এবং ধ্যানে বসা মানেই পোকা। আর কী মারাত্মক সে পোকা।

কী করা যায়?

রাগে হাড়-পিত্তি জ্বলছে। দয়া করে পার্ট করছি এই ঢের, তার ওপর আবার অপমান। এমন করে শাসানো। চাঁটি হাঁকড়ে নাক নাসিকে উড়িয়ে দেবে। ইস, শখখানা দ্যাখো একবার। না হয় তোমার আছেই পিরামিডের মতো উঁচু একটা অতিকায় নাক, আর আমার নাকটা না হয় চীনেম্যানদের মতো থ্যাবড়া, তাই বলে নাক নিয়ে অপমান। আচ্ছা, দাঁড়াও, দাঁড়াও। এই খাঁদা নাককেই–মৈনাকের মতো উঁচু করে তোমার ভরাড়ুবি করে ছাড়ব।

কিন্তু কী করা যায় বাস্তবিক?

ভেবে কূল-কিনারা পাচ্ছি না, ও-দিকে স্টেজে তখন দারুণ বক্তৃতা দিচ্ছে টেনিদা। এমন এক-একটা লাফ মারছে যে চাটুজ্যেদের ছারপোকা-ভরা পুরনো তক্তপোশটা একেবারে মড়মড় করে উঠছে। থিয়েটার করছে না হাই-জাম্প দিচ্ছে বোঝা মুস্কিল।

স্টেজ-ম্যানেজার হাবুল পাশ দিয়ে যাচ্ছিল। বললে, এই প্যালা, অমন ভূতের মতো অন্ধকারে বসে আছিস যে?

বললাম, একটু চা খাওয়া না ভাই হাবুল, গলাটা শুকিয়ে কাঠ হয়ে গেছে।

হাবুল নাকটা কুঁচকে বললে, নেঃ নেঃ, অত চা খায় না। যা পার্ট করছিস, আবার চা!

অ্যাডিং ইনসাল্ট টু ইনজুরিঅ্যাঁ। আমি অন্ধকারে দাঁত বের করে হাবুলকে ভেংচে দিলাম, হাবুল দেখতে পেলে না।

চম্পট দেব নাকি দাড়িকাড়ি নিয়ে? সোজা চলে যাব বাড়িতে? দধীচির সিনে যখন দেখবে আমি বেমালুম হাওয়া—তখন টের পাবে মজাটা কাকে বলে। উহু—তাতে সুবিধে হবে না। তারপর কাল সকালে আমায় বাঁচায় কে? পটলডাঙার বিখ্যাত টেনিদার বিখ্যাত চাঁটিতে স্রেট পটল তুলে বসতে হবে।

না-না, ওসব নয়। সাপও মরবে, লাঠিও ভাঙবে না। এমন জব্দ করে দেব যে কিল খেয়ে কিলটি সোনামুখ করে গিলে নিতে হবে। টেনিদার বত্রিশ পাটি দাঁতের সঙ্গে আর একটি দাঁত গজিয়ে দেব—যার নাম আক্কেল দাঁত। আর সেই সঙ্গে টেনিদার ধামাধরা ওই স্টেজ-ম্যানেজার শ্রীমান হাবুল সেনকেও টেরটি পাইয়ে দিতে হচ্ছে।

ভগবানকে ডেকে বললাম, প্রভু, আলো দাও—এ অন্ধকারে পথ দেখাও! এবং প্রভু আলো দিলেন।

হাবুলকে বললাম, ভাই, পাঁচ মিনিটের জন্যে একটু বাড়ি থেকে আসছি।

হাবুল আঁতকে বললে, কেন?

—এই পেটটা একটু কেমন কেমন—

হাবুল বললে, সেরেছে। যত সব পেটরোগা নিয়ে কারবার—শেষটায় ডোবাবে বোধ হচ্ছে। একটু পরেই যে তোর পার্ট রে।

আমি বললাম, না, না, এক্ষুনি আসছি।

মনে মনে বললাম, পেট কার কেমন একটু পরেই দেখা যাবে এখন। মনুমেন্ট খাইয়ে পার্ট করাতে চাও—দেখি আরও কত গুরুপাক জিনিস হজম করতে পারো।

ঠিক পাঁচ মিনিটের মধ্যেই আমি ফিরলাম। ডাক্তার ছোটকাকার ওষুধের আলমারিটা হাতড়াতে বেশি সময় লাগেনি—একেবারে মোক্ষম ওষুধটি নিয়ে এসেছি। হিসেব করে দেখেছি আমার পার্ট আসতে আরও প্রায় ঘণ্টাখানেক দেরি—এর মধ্যেই কাজ হয়ে যাবে।

চায়ের বড় কেটলিটা যেখানে উনানের ওপর ফুটছে, সেখানে গেলাম। তখন কেটলির দিকে কারও মন নেই, সবাই উইংসে ঝুঁকে পড়ে প্লে দেখছে। টেনিদা লাফাচ্ছে ভীমসেনের মতো—আর সে কী ঘন ঘন ক্ল্যাপ। দাঁড়াও দাঁড়াওকত ক্ল্যাপ চাও দেখব।

পিরামিডের মতো নাক উঁচু করে বিজয়-গৌরবে ফিরে এল টেনিদা। একগাল হাসি ছড়িয়ে বললে, কেমন পার্ট হল রে হাবুল?

হাবুল কৃতার্থভাবে বললে, চমৎকার, চমৎকার। তুমি ছাড়া এমন পার্ট আর কে করতে পারত? অডিয়ান্স বলছে, শাবাশ, শাবাশ!

অডিয়ান্স কেন শাবাশ শাবাশ বলছে আমি জানি। তারা বুঝতেই পারেনি যে ওটা ভীমের না বিশ্বকর্মার পার্ট। কিন্তু আসল পার্ট করতে আর একটুখানি দেরি আছে—আমি মনে মনে বললাম।

স্টেজ কাঁপিয়ে টেনিদা হুঙ্কার ছাড়লে, চা—ওরে চা আন—

হাবুল উৰ্বশ্বাসে ছুটল।

 

আবার ড্রপ উঠেছে। দধীচির ভূমিকায় আমি ধ্যানস্থ হয়ে বসে পোকা খাচ্ছি। শিষ্য দধিমুখ এবার দূরে দাঁড়িয়ে আছে—আগের অভিজ্ঞতাটা ভোলেনি।

বিশ্বকর্মা আর ইন্দ্রের প্রবেশ। টেনিদা আর হাবুল।

হাবুল বললে, প্রভু, গুরুদেব,
আসিয়াছি শিবের আদেশে।
তব অস্থি দিয়া।
যেই বজ্র হইবে নির্মাণ—

টেনিদা বললে,

দেখাইব বিশ্বকর্মা যশ।
হেন অস্ত্র তুলিব গড়িয়া,
ঘোরনাদে কাঁপাইবে সসাগরা ব্রহ্মাণ্ড বিশাল
দীপ্ততেজে দগ্ধ হবে স্থাবর-জঙ্গম,–

তারপরেই স্বগতোক্তি করলে, উঃ, জোর কামড় মেরেছে পেটে মাইরি!

হাবুল চাপা গলায় বললে, আমারও পেটটা যেন কেমন গোলাচ্ছে রে!

আড়চোখে আমি একবার তাকিয়ে দেখলাম মাত্র। মনুমেন্ট খেয়ে হজম করতে পারো, দেখিই না হজমের জোর কত! আমি বললাম, তিষ্ঠ, তিষ্ঠ—

আগে করি ইষ্ট নাম ধ্যান–
ধ্যান ভঙ্গ যতক্ষণ নাহি হয়,
চুপচাপ থাকো ততক্ষণ।
তারপরে তনুত্যাগ করিব নিশ্চয়।

আমি ধ্যানে বসলাম। সহজে এধ্যান ভাঙছে না। পোকার উপদ্রব লেগেই আছে—তা থাক। আমি কষ্ট না করলে টেনিদা আর হাবুলের কেষ্ট মিলবে না। গরম চায়ের সঙ্গে কড়া পার্গেটিভ—এখনই কী হয়েছে!

টেনিদা মুখ বাঁকা করলে, শিগগির ধ্যান শেষ কর মাইরি। জোর পেট কামড়াচ্ছে রে!

আমি বললাম, চুপ। ধ্যান ভঙ্গ করিয়ো না

ব্ৰহ্মশাপ লাগিবে তা হলে—

ধ্যান কি সত্যি সত্যিই করছি নাকি! আরে ধ্যাৎ! আমি আড়চোখে দেখছি টেনিদার মুখ ফ্যাকাশে মেরে গেছে। হাবুলের অবস্থাও তথৈবচ। ভগবান করুণাময়।

টেনিদা কাতরস্বরে বললে, ওরে প্যালা, গেলাম যে। দোহাই তোর, শিগগির ধ্যান শেষ কর—তোর পায়ে পড়ছি প্যালা–

হাবুল বললে, ওরে, আমারও যে প্রাণ যায়–

আমি একেবারে নট-নড়নচড়ন। সামলাও এখন। মুনি-ঋষির ধ্যান-দেহত্যাগের ব্যাপার—এ কী সহজে ভাঙবার জিনিস!

–বাপস গেলাম—এক লক্ষে টেনিদা অদৃশ্য। একেবারে সোজা অন্ধকার আমতলার দিকে। পেছনে পেছনে হাবুল।

আর থিয়েটার?

সে কথা বলে আর কী হবে!

দশাননচরিত

আমি খুব উত্তেজিত হয়ে টেনিদাকে বললুম, ‘হ্যারিসন রোডের লোকে একটা পকেটমারকে ধরেছে।’

টেনিদা আমার দিকে কী রকম উদাসভাবে চেয়ে রইল খানিকক্ষণ।

‘তারপর?’

‘তারপর আর কী! থানায় নিয়ে গেল।‘

‘লোকে পিটতে চেষ্টা করেনি?’

‘করেনি আবার? ভাগ্যিস একজন পুলিশ এসে পড়েছিল। সে হাতজোড় করে বললে–দাদারা, মেরে আর কী করবেন? মার খেয়ে খেয়ে এদের তো গায়ের চামড়া গণ্ডারের মতো পুরু হয়ে গেছে। অনর্থক আপনাদের হাত ব্যথা হয়ে যাবে। তার চাইতে ছেড়ে দিন–এ মাসখানেক জেলখানায় কাটিয়ে আসুক, ততদিন আপনাদের পকেটগুলো নিরাপদে থাকবে।’

‘বেশ হয়েছে।’–বলে টেনিদা গম্ভীর হয়ে গেল। তারপর মস্ত একটা ঠোঙা থেকে একমনে কুড়কুড় করে ডালমুট খেতে লাগল।

আমি ওর পাশে বসে পড়ে বললুম, ‘আমাকে ডালমুট দিলে না?’

‘তোকে?–টেনিদা উদাস হয়ে ডালমুট খেতে খেতে বললে, না–তোকে দেবার মতো মুড নেই এখন। আমি এখন ভীষণ ভাবুক-ভাবুক বোধ করছি।’

‘ভাবুক-ভাবুক!’–শুনে আমার খুব উৎসাহ হল : ‘তুমি কবিতা লিখবে বুঝি?’

টেনিদা বিরক্ত হয়ে বলল, ‘দুত্তোর কবিতা! ওসবের মধ্যে আমি নেই। যারা কবিতা লেখে–তারা আবার মনিষ্যি থাকে নাকি? তারা রাস্তায় চলতে গেলেই গাড়ি চাপা পড়তে পড়তে বেঁচে যায়, নেমন্তন্নবাড়িতে তাদের জুতো চুরি হয়, বোশেখ মাসের গরমে যখন লোকের প্রাণ আইঢাই করে তখন তারা দোর বন্ধ করে পদ্য লেখে—”বাদলরাণীর নূপুর বাজে তাল-পিয়ালের বনে!” দুদ্দুর!’

আমি আশ্চর্য হয়ে বললুম, ’বোশখ মাসের দুপুরে বাদলরাণীর কবিতা লেখে কেন?’

টেনিদা মুখটাকে ডিমভাজার মতো করে বললে, ‘এটাও বুঝতে পারলি না? বোশেখ মাসে কবিতা লিখে না পাঠালে আষাঢ় মাসে ছাপা হবে কী করে? যা–যা, কবিতা লেখার কথা আমাকে আর তুই বলিসনি। যত্তো সব ইয়ে–!’

আমি বললুম, ‘তবে তুমি ওরকম ভাবুক-ভাবুক হয়ে গেলে কেন!’

‘ওই পকেটমারের কথা শুনে।‘

‘পকেটমারের কথা শুনে কেউ ভাবুক হয় নাকি আবার?’ আমি বললুম, ‘সবাই তো তাকে রে-রে-রে করে ঠ্যাঙাবার জন্যে দৌড়ে যায়। আমারও যেতে ইচ্ছে করে। এই তো সেদিন হাওড়ার ট্রামে আমার বড় পিসেমশায়ের পকেট থেকে—’

‘ইউ শাট আপ প্যালা—’ টেনিদা চটে গেল : কুরুবকের মতো সব সময় বকবক করবি না–এই বলে দিচ্ছি তোকে। পঞ্চাননের ঠাকুর্দা দশাননের কথা যদি জানতিস, তা হলে বুঝতে পারতিস–এক-একটা পকেটমারও কী বলে গিয়ে–এই মহাপুরুষ হয়ে যায়।’

‘কে পঞ্চানন? কে-ই বা দশানন? আমি তো তাদের কাউকেই চিনি না।’

‘দুনিয়াসুদ্ধ সবাইকে তুই চিনিস নাকি? জাপানের বিখ্যাত গাইয়ে তাকানাচিকে চিনিস তুই?’

আমি বললুম, ‘না।’

‘লন্ডনের মুরগির দোকানদার মিস্টার চিকেনসনের সঙ্গে তোর আলাপ আছে?’

‘উহুঁ।‘

‘ফ্রান্সের সানাইওলা মঁসিয়ো প্যাঁকে দেখেছিস কোনওদিন?’

‘না–দেখিনি। দেখতেও চাই না কখনও।‘

‘তা হলে?’–টেনিদা আলুকাবলির মতো গম্ভীর হয়ে গেল : ‘তা হলে পঞ্চাননের ঠাকুর্দা দশাননকেই বা তুই চিনবি কেন?’

‘ঢের হয়েছে, আর চিনতে চাই না। তুমি যা বলছিলে বলে যাও।’

‘বলতেই তো যাচ্ছিলুম–টেনিদা আবার কিছুক্ষণ কুড়মুড় করে ডালমুট চিবিয়ে ঠোঙাটা আমার হাতে ধরিয়ে দিয়ে বললে, ‘খা। আমি তোকে ব্যাপারটা বলি ততক্ষণে।‘

আমি ঠোঙাটা হাতে নিয়ে দেখলুম খালি। ফেলে দিতে যাচ্ছি হঠাৎ দেখি একেবারে নীচের দিকে, টেনিদার চোখ এড়িয়ে কী করে একটা চীনেবাদামের দানা আটকে আছে। সেটা বের করেই আমি মুখে পুরে দিলুম। আড়চোখে দেখে টেনিদা বললে, ‘ইস, একটা বাদাম ছিল নাকি রে? একদম দেখতেই পাইনি। যাকগে, ওটা তোকে বকশিশ করে দিলুম।’

আমি বললুম, ‘সবই পঞ্চাননের ঠাকুর্দা দশাননের দয়া।‘

টেনিদা বললে, ‘যা বলেছিস। আচ্ছা, এবার দশাননের কথাই বলি।‘

–বুঝলি, কখনও যদি তুই ঘুঁটেপাড়ায় যাস—’

‘আমি বললুম, খুঁটেপাড়া আবার কোথায়?’

‘সে গোবরডাঙা থেকে যেতে হয়-সাত ক্রোশ হেঁটে। মানে, যাওয়া খুব মুস্কিল। কিন্তু যদি কখনও যাস-দেখবি দশানন হালদারের নাম শুনলে লোকে এখনও মাটিতে মাথা নামিয়ে পেন্নাম করে। বলে, “এমন ধার্মিক, এমন দানবীর আর হয় না। ইস্কুল করেছেন, গরিব-দুঃখীকে দুবেলা খেতে দিয়েছেন, মন্দির গড়েছেন, পুকুর কেটেছেন।” কিন্তু আসলে এই দশানন কে ছিল, জানিস? এক নম্বরের পকেটমার।‘

‘পকেটমার?’

‘তবে আর বলছি কী? অমন ঘোড়ে পকেটমার আর দুজন জমেছে কিনা সন্দেহ। পাঠশালায় যেদিন প্রথম পড়তে গেল, সেদিনই পণ্ডিতমশাইয়ের ফতুয়ার পকেট থেকে তাঁর নস্যির ডিবে চুরি করে নিলে। পণ্ডিত তাকে কষে বেত-পেটা করে তাড়িয়ে দিলেন। বাপকাকা-দাদা–তার হাত থেকে কারও পকেটের রেহাই ছিল না। যত পিট্টি খেত, ততই তার রোখ চেপে যেত। শেষে যখন একদিন বাড়িতে গুরুদেব এসেছেন আর দশানন তার ট্যাক থেকে প্রণামীর বারো টাকা আনা পয়সা মেরে নিয়েছে–সেদিন দশাননের বাপ শতানন হালদারের আর সইল না। বাড়ির মোষবলির খাঁড়াটা উঁচিয়ে দশাননকে সে এমন তাড়া লাগাল যে দশানন এক দৌড়ে একেবারে কলকাতায় পৌঁছে তবে হাঁফ ছাড়ল।

‘আর জানিস তো, কলকাতা মানেই পকেটমারের স্বর্গ। অনেক গুণী তোক তো আগে থেকেই ছিল, কিন্তু বছরখানেকের ভেতর দশানন তাদের সম্রাট হয়ে উঠল। তার উৎপাতে লোকে পাগল হয়ে গেল। টালা থেকে টালিগঞ্জ আর শেয়ালদা থেকে শালকে পর্যন্ত, কারও পকেটের টাকাকড়ি কলম থেকে মায় সুপুরির কুচি কিংবা এলাচ-দানা পর্যন্ত বাদ যেত না।

‘ধরা যে পড়ত না, তা নয়। দুমাস ছ’মাস জেল খাটত, তারপর বেরিয়ে এসে আবার যে-কে সেই। পুলিশ সুষ্ঠু জেরবার হয়ে উঠল। তখন দেশে ইংরেজ রাজত্ব ছিল, জানিস তো? পুলিশ কমিশনার ছিল এক কড়া সাহেব–মিস্টার প্যান্থার না কী যেন নাম। লোকে তার কাছে গিয়ে ধরনা দিতে লাগল। প্যান্থার তাদের বললে, “পকেটমারকে ফাঁসি ডেওয়া যায় না–নটুবা আমি ডশাননকে টাই ডিম। এবার ঢারিতে পারিলে টাহাকে এমন শিক্ষা ডিব যে সে আর পকেট কাটিবে না।”

‘ধরা অবশ্য দশানন কদিন বাদেই পড়ল। পকেটমারের ব্যাপার তো জানিস, ওরা প্রায়ই জেলে গিয়ে মুখ বদলে আসে–ওদের ভালোই লাগে বোধ হয়। কিন্তু এবার দশানন ধরা পড়বামাত্র তাকে নিয়ে যাওয়া হল প্যান্থার সাহেবের কাছে। সাহেব বললে, “ওয়েল ডশানন, টুমি টো কলিকাটায় লোককে ঠাকিটে ডিবে না। টাই এবার টোমার একটা পাকা বাবসটো করিতেছি।”–এই বলে সে হুকুম দিলে, “ইহাকে লঞ্চে করিয়া লইয়া গিয়া সুরবনে (মানে সুন্দরবনে) ছাড়িয়া ডাও-সেখানে গিয়া এ কাহার পকেট মারে ডেখিব। ঝঘের তো আর পকেট নাই।”

‘দশানন বিস্তর কান্নাকাটি করল, “আর করব না স্যার-এ-যাত্ৰা ছেড়ে দিন স্যার” বলে অনেক হাতে পায়ে ধরল, কিন্তু চিড়ে ভিজল না। সাহেব ঠাট্টা করে বললে, “যাও–বাঘের পকেট মারিটে চেষ্টা করো। যডি পায়রা, টোমাকে রায় সাহেব উপাঢ়ি ডিব।”

‘তারপরে আর কী? পুলিশ লঞ্চে করে দশাননকে নিয়ে গেল সুন্দরবনে। সেখানে তাকে নামিয়েই তারা দে-চম্পট। তাদেরও তো বাঘের ভয় আছে।

‘এদিকে দশাননের তো আত্মারাম খাঁচাছাড়া। জলে গিজগিজ করছে কুমির–ঝোপে ঝোপে মানুষখেকো বাঘ–সুন্দরবন মানেই যমের আড়ত। এর চাইতে সাহেব যে তাকে ফাঁসিতে ঝোলালেও ভালো করত!

‘বেলা পড়ে আসছিল, একটু দূরেই কোথায় হালুম-হালুম ডাক শোনা গেল। দশানন একেবারে চোখ-কান বুজে ছুটল। সুঁদরী গাছের শেকড়ে হোঁচট খেয়ে, গোলপাতার ঝোপে আছাড় খেয়ে-দৌড়তে দৌড়তে দেখে সামনে এক মস্ত ভাঙা বাড়ি। আদ্যিকালের পুরনোইট-কাঠ খসে পড়ছে, তবু অনেকখানি এখনও দাঁড়িয়ে। মরিয়া হয়ে দশানন ঢুকে গেল তারই ভেতরে। হাজার হোক, বাড়ি তো বটে!

‘ভাঙা সিঁড়ি দিয়ে দোতলায় উঠতেই দেখে সামনে একটা মস্ত ঘর। দরজায় তার মাকড়সার জাল, ভেতরে কত জন্মের ধুলো। তবু ঘরটা বেশ আস্ত আছে। একটু সাফসুফ করে নিলে শাওয়াও যাবে একপাশে। দেশলাই জ্বেলে, সাবধানে সব দেখে নিলে দশানন। না–সাপ-খোপ নেই। আর দোতলার ঘর-বাঘও চট করে এখানে উঠে আসবে না। শুধু দশানন ঘরে ঢুকতে ঝটপট করে কতগুলো চামচিকে বেরিয়ে এল–তা বেরোক, চামচিকেকে তার ভয় নেই।

‘ক্যানিং-এর বাজার থেকে পুলিশ তাকে এক চাঙারি খাবার দিয়েছিল, মনের দুঃখে তাই খানিকটা খেল দশানন। বাইরে তখন দারুণ অন্ধকার নেমেছে। ঝিঝি ডাকছে, পোকা ডাকছে–অনেক দূর থেকে বাঘের ডাকও আসছে। “জয় মা কালী” বলে কাপড় জড়িয়ে ঘরের এক কোনায় শুয়ে পড়ল দশানন। রাতটা তো কাটুককাল সকালে যা হয় দেখা যাবে।

‘বাঘের ডাক, ঝিঝির শব্দ, জঙ্গলের পাতায়-পাতায় হাওয়ায় আওয়াজ আর মশার কামড়ের ভেতরে ভয়-ভাবনায় কখন যে দশানন ঘুমিয়ে পড়েছে জানে না। কতক্ষণ ধরে ঘুমুচ্ছিল, তাও না। হঠাৎ একসময়ে সে চমকে জেগে উঠল। দেখল, ভাঙা জানলা দিয়ে ঘরের ভেতরে জ্যোৎস্না পড়েছে–আর সেই জ্যোৎস্নার মাঝখানে দাঁড়িয়ে এক বিরাট পুরুষ। তার পোশাক-আশাক থিয়েটারের মোগল সেনাপতির মতো। মুখে লম্বা দাড়ি, মাথায় পাগড়ি। আগুনের মতো তার চোখ দুটো দপদপ করে জ্বলছে।

‘দশাননের হাত-পা ঠাণ্ডা হয়ে গেল। বুঝতে বাকি রইল না–এটা ভূত। তাও যে-সে ভূত নয়–একেবারে মোগলাই ভূত।

‘ভূত বাজখাই গলায় বললে, “এই বেতমিজ, তুই কে রে? আমার প্রাসাদে ঢুকেছিস কেন?”

‘দশানন একটু সামলে নিলে। উঠে সামনে এসে একেবারে মাটিতে লুটিয়ে প্রণাম করলে ভূতকে। বললে, “হুজুর, আমায় মাপ করবেন। আমি কিছুই জানতুম না। সন্ধেবেলায় বাঘের ভয়ে ছুটতে ছুটতে এখানে এসে আশ্রয় নিয়েছি। দয়া করে রাতটার মতো আমায় থাকতে দিন। ভেরে উঠেই চলে যাব।”

‘ভূত খুশি হল। চাপদাড়ির ফাঁকে হেসে বললে, “ঠিক আছে, থেকে যা। তুই যখন আমার আশ্রয় নিয়েছিস, তখন তোকে কিছু বললে আমার গুণাহ (মানে পাপ) হবে। কিন্তু তোর বাড়ি কোথায়?”

“আজ্ঞে বাংলাদেশে।”

“বেশ–বেশ, উঠে দাঁড়া।”

‘দশানন উঠে ভূতের সামনে দাঁড়াল। ভূত খুব মন দিয়ে দেখতে লাগল তাকে। তারপর বললে, “তোর বেশ সাহস-টাহস আছে দেখছি। আমার একটা কাজ করতে পারবি?”

“আজ্ঞে, হুকুম করলেই পারি।”–দশানন খুব বিনীত হয়ে হাত কচলাতে লাগল।

“তুই একবার নবাব সিরাজদ্দৌলার কাছে যেতে পারিস?”

“আজ্ঞে কার কাছে?”–দশানন ঘাবড়ে গেল।

“কেন–বাংলা-বিহার-উড়িষ্যার নবাব সিরাজদ্দৌলার নাম শুনিসনি?”–ভূত খুব আশ্চর্য হল : তুই কোথাকার গাধা রে!”

“নাম জানি বই কি হুজুর, বিলক্ষণ জানি।”–দশানন মাথা চুলকে বললে, “কিন্তু তিনি তো অনেকদিন আগে মারা গেছেন–আমি কী করে তাঁর কাছে”।

“মারা গেছেন? নবাব সিরাজদ্দৌলা! সে কি রে! পলাশীর যুদ্ধের পরে তিনি রাজমহলের দিকে রওনা হলেন, আমাকে বললেন—’মনসবদার জবরদস্ত খাঁ, তুমি আমার এইসব মণিমুক্তাগুলো নিয়ে কোথাও লুকিয়ে থাকো এখন। আমি এরপরে আবার ইংরেজের সঙ্গে যুদ্ধ করব, তখন তোমাকে দরকার হবে–তোমায় আমি ডেকে পাঠাব। ততক্ষণ তুমি সুন্দরবনের প্রাসাদে গিয়ে লুকিয়ে থাকো।” সেই থেকে আমি আছি এখানে। কবে আমার এন্তেকাল (মানে মৃত্যু হয়েছে, কিন্তু নবাবের ডাক শোনবার জন্যে আমি বসে আছি, আর আমার দুই জেবে (মানে পকেটে) লাখ লাখ টাকার হীরে-মোতি বয়ে বেড়াচ্ছি। দেখবি?”

বলেই জবরদস্ত খাঁ তার জেবের পকেট থেকে দু-হাত ভর্তি করে মণিমুক্তো বের করল। চাঁদের আলোয় সেগুলো ঝলমল করতে লাগল, দেখে চোখ ঠিকরে বেরুল দশাননের। মাথা ঘুরে যায় আর কি।

‘জবরদস্ত খাঁ সেগুলো আবার পকেটে পুরে বললে—”আর তুই বলছিস নবাব বেঁচে নেই? না-হতেই পারে না। তা হলে নিজেকেই এবার আমায় খুঁজতে যেতে হচ্ছে।”

‘দশানন চুপ করে রইল।

‘জবরদস্ত খাঁ বললে, “প্রথমে যাই মুর্শিদাবাদে, তারপরে যাব রাজমহল, তারপর মুঙ্গের পর্যন্ত ঘুরে আসব। তুই আজ রাতে আমার প্রাসাদে থাকতে পারিস। কোনও ভয় নেই—মন্‌সবদার জবরদস্ত খাঁর মঞ্জিলে বাঘও ঢুকতে সাহস পাবে না। কিন্তু কাল সকালেই কেটে পড়বি। ফিরে এসে যদি দেখি তুই রয়েছিস, তা হলে তক্ষুনি কিন্তু তোর গান নিয়ে নেব।”

‘এই বলেই, জবরদস্ত খাঁ ধাঁ করে চাঁদের আলোর মধ্যে মিশে গেল।

‘আর দশানন? যা থাকে কপালে বলে, তক্ষুনি বেরিয়ে পড়ল ভূতের বাড়ি থেকে। অন্ধকারে খানিক হেঁটে একটা গাছে উঠে রাত কাটালে! সকালে নদীর ধারে গিয়ে দূরে একটা জেলেদের নৌকো চোখে পড়ল–বিস্তর ডাকাডাকি করে, তাদের নৌকোয় উঠে দেশে চলে এল।

‘আর তারপর?

‘তারপর দেশে ফিরে অতিথিশালা করল, পুকুর কাটাল, গরিবকে দান-ধ্যান করতে লাগল, মহাপুরুষ হয়ে গেল—’

আমি বাধা দিয়ে বললুম, ‘বা-রে, টাকা পেল কোথায়?’

‘টাকার অভাব কী রে গর্দভ? জবরদস্ত খাঁর পকেট মেরে এক থাবা মণি-মুক্তো তুলে নিয়েছিল না?

‘অ্যাঁ!’–আমি খাবি খেলুম : ‘ভূতের পকেট কেটে?’

‘যে কাটতে পারে–ভূতের পকেটই বা সে রেয়াত করবে কেন?’–টেনিদা হাসল : ‘অমন এক্সপার্ট হাত। কিন্তু ওইতেই তো তার স্বভাব-চরিত্তির একেবারে বদলে গেল। স্বয়ং নবাব সিরাজদ্দৌলার মণি-মুক্তো–সেগুলো কি আর বাজে খরচ করা যায় রে? ওসব বেচে লাখ লাখ টাকা পেল দশানন; আর তাই দিয়ে পরের উপকার করতে লাগল–মহাপুরুষ বনে গেল একেবারে।’

‘আর প্যাস্থার সাহেব?’

‘বাঘের পকেট কাটলে রায়সাহেব উপাধি দেবে বলেছিল, ভূতের পকেট কেটেছে জানলে তো মহারাজা-টহারাজা করে দিত। কিন্তু জানিস তো–ইংরেজ নবাবের শত্রু। শুনলেই কেড়ে নিত ওগুলো। তাই বলছিলুম প্যালা, পকেটমারকেও তুচ্ছ করতে নেই, সেও যে কখন কী হয়ে যায়—’

আমি বললুম, ‘বাজে কথা–সব বানানো।‘

‘বানানো?’ টেনিদা দাঁত খিঁচিয়ে বললে, ‘ইউ প্যালাইউ গেট আউট–।‘

গেট-আউট আর কী করে হয়, রাস্তার ধারেই তো বসেছিলুম দু-জনে। আমি টেনিদার গাঁট্টা এড়াবার জন্যে ঝাঁ করে পটলডাঙা স্ট্রিটে লাফিয়ে পড়লুম।

দি গ্রেট ছাঁটাই

–ডিলা-গ্র্যাণ্ডি মেফিস্টোফিলিস—

এই পর্যন্ত যেই বলেছি, অমনি খ্যাঁক-খ্যাঁক করে তেড়ে এসেছে টেনিদা।

–টেক কেয়ার প্যালা, সাবধান করে দিচ্ছি। মেফিস্টোফিলিস পর্যন্ত সহ্য করেছি, কিন্তু ‘ইয়াক ইয়াক’ বলবি তো এক চাঁটিতে তোর কান দুটোকে কোন্নগরে পাঠিয়ে দেব।

সেই ঢাউস ঘুড়িতে ওড়বার পর থেকেই বিচ্ছিরি রকমের চটে রয়েছে টেনিদা। ইয়াক শব্দ শুনলেই ওর মনে হয়, এক্ষুনি বুঝি ঝপাং করে গঙ্গার জলে গিয়ে পড়বে। সেদিন গণেশমামা কায়দা করে ইংরেজীতে বলছিল :ইয়া-ইয়া। শুনে টেনিদা তাকে মারে আর কি।

শেষে হাবুল সেন গিয়ে ঠাণ্ডা করে : আহা, খামকা চেইত্যা যাওয়া ক্যান? পেন্টুলুন পইর্যা ইংরাজী কইত্যাছে।

টেনিদা দাঁত খিঁচিয়ে বলেছি, কেন, স্বাধীন ভারতে ইংরেজী ফলাবার দরকারটা কী? এই জন্যেই জাতির আজ বড় দুর্দিন!..শেষ কথাটা টেনিদা আমাদের পাড়ার শ্রদ্ধানন্দ পার্ক থেকে মেরে দিয়েছে। ওখানে অনেক মিটিং হয়, আর সবাই বলে, জাতির আজ বড় দুর্দিন। কাউকে বলতে শুনিনি, জাতির আজ ভারি সুদিন। অথচ যাওয়ার সময় দেখি, দিব্যি পান চিবুতে চিবুতে মোটরে গিয়ে উঠল। মরুক গে, জাতির দিন যেমনই হোক আমার আজকের দিনটা দারুণ রকমের ভালো। মানে, আজ সন্ধেয় আমাদের বল্টুদার পিসতুতো ভাই হুলোদর বউভাত। বল্টুদা আমাকে খেতে বলেছে। আমি বললুম, বা-রে মন খুশি হলে একটুখানি ফুর্তিও করতে পারব না?

–ফুর্তি? বলি হঠাৎ এত ফুর্তিটা কিসের? আমি সকাল থেকে একটুখানি আলুকাবলি খেতে পাইনি–চার পয়সার ডালমুটও না। মনের দুঃখে মরমে মরে আছি, আর তুই কুচো চিংড়ির মতো লাফাচ্ছিস?

বললুম, লাফাব না তো কী? আজ হুলোদার বউভাত।

–হুঁলোদার বউভাত?–টেনিদা খাঁড়ার মতো নাকটার ভেতর থেকে ফুড়ত করে একটা আওয়াজ বের করে বললে, তাতে তোর কী?

–দারুণ খ্যটি হবে সন্ধেবেলায়।

–হুলোদার বউভাতে খ্যাঁটি?

টেনিদার নাক থেকে আবার ফুড়ত করে আওয়াজ বেরুল : মানে নেংটি ইঁদুরের কালিয়া, টিকটিকির ডালনা, আরশোলার চাটনি–

–কক্ষনো না। –আমি ভীষণভাবে আপত্তি করে বললুম, লুচি-পোলাও-মাংস চপ-ফ্রাই-দই-ক্ষীর-দরবেশ–

টেনিদা প্রায় হাহাকার করে উঠল : আর বলিসনি, আমি এক্ষুনি হার্টফেল করব। সকাল থেকে একটুখানি আলুকাবলি অবধি খাইনি, আর তুই আমাকে এমন করে দাগা দিচ্ছিস? গো-হত্যের পাপে পড়ে যাবি প্যালা, এই বলে দিচ্ছি তোকে।

শুনে আমার দুঃখু হল। আমি চুপ করে রইলুম।

–হ্যাঁ রে, আমাকে তো বলেনি।

আমি বললুম, না বলেনি।

–আমি যদি তোর সঙ্গে যাই? মানে, তোর তো পেট-টেট ভালো নয়–বেশি খেয়ে-টেয়ে একটা কেলেঙ্কারি যাতে না করিস, সেইজন্যে যদি তোকে পাহারা দিতে।

আমি বললুম, চালাকি চলবে না। হুলোদার বাবা ভীষণ রাগী লোক। কান পর্যন্ত গোঁফ। দু’বেলা দুটো একমনী মুগুর ভাঁজেন। বিনা নেমন্তন্নে খেতে গেলে তোমাকে ছাদ থেকে ফুটপাথে ফেলে দেবেন।

টেনিদা ভারি ব্যাজার হয়ে গেল। বললে, আমি দেখছি, যেসব বাবার বড় বড় গোঁফ থাকে তারাই এমনি যাচ্ছেতাই হয়। বোধ হয় নিজেদের বাঘ-সিঙ্গী বলে ভাবে। আর যেসব বাবা গোঁফ কামায় মেজাজ খুব মোলায়েম। দেখ লই মনে হয় এক্ষুনি মিহি গলায় বলবে, খোকা, দুটো রসগোল্লা খাবে? আর গোঁফওয়ালা বাবাদের ছেলেরা দুবেলা গাট্টা খায়।

এই সকালবেলায় গোঁফ নিয়ে বকবকানি আমার ভালো লাগল না। চলে যাওয়ার জন্যে পা বাড়িয়েছি, অমনি টেনিদা বললে, খ্যাঁট তো সন্ধেবেলায়–এখুনি গিয়ে কলাপাতা কাটবি নাকি? ·

কলাপাতা কাটব কেন? আমি কি ওদের চাকর রামধনিয়া? আমি যাচ্ছি চুল কাটতে। বলে ডাঁটের মাথায় চলে যাচ্ছি, টেনিদা আবার পিছু ডাকল–কোথায় চুল কাটবি? সেলুনে?–চল, আমি তোর সঙ্গে যাই।

আমার মনে নিদারুণ একটা সন্দেহ হল।

–আবার তুমি কেন? আমি চুল ছাঁটতে যাচ্ছি–তোমার যাবার কী দরকার?

টেনিদা বললে, দরকার আছে বই কি! বউভাতের নেমন্তন্ন খাবি যা-তা করে চুল হেঁটে গেলে মান থাকবে নাকি? এমন একখানা মোম ছাঁট লাগাবি যে, লোকে দেখলেই হ করে থাকবে। চল, আমি তোর চুল কাটার তদারক করব।

কথাটা আমার মনে লাগল। সত্যিই তো টেনিদা একটা চৌকস লোকদশরকম বোঝে। আর, চুপি-চুপি বলতে দোষ নেই, একা সেলুনে ঢুকতে আমারও কেমন গা ছমছম করে। যেরকম কচাকচ কাঁচি-কাচি চালায় মনে হয় কখন কচাং করে একটা কানই বা কেটে নেবে।

বললুম, চলো তা হলে।

প্রথমেই চোখে পড়ল, ওঁ তারকব্রহ্ম সেলুন।

যেই ঢুকতে যাচ্ছি, অমনি হাঁ-হাঁ করে বাধা দিল টেনিদা–খবর্দার প্যালা, খবর্দার। ওখানে ঢুকেছিস কি মরেছিস!

-কেন!

–নাম দেখছিস না? ওঁ তারকব্রহ্ম। ওখানে ঢুকলে কী হবে জানিস? সব চুলগুলো কদমছাঁট করে দেবে আর চাঁদির ওপর টিকি বানিয়ে দেবে একখানা; হয়তো টিকির সঙ্গে ফ্রিতে একটা গাঁদা ফুলও বেঁধে দিতে পারে–কিচ্ছুই বলা যায় না।

ঘাবড়ে গিয়ে বললুম, না, আমি টিকি চাই না, ফ্রি গাঁদা ফুলেও দরকার নেই।

–তবে চটপট চলে আয় এখান থেকে। দেখছিস না একটা হোঁতকা লোক কেমন জুলজুল করে তাকাচ্ছে? আর দেরি করলে হয়তো হাত ধরে হিড়হিড় করে ভেতরে টেনে নিয়ে যাবে।

তক্ষুনি পা চালিয়ে দিলুম। একটু এগোতেই বিউটি-ডি-সেলুনিকা।

একে বিউটি, তায় আবার সেলুনিকা! দেখেই আমার কেমন ভাব এসে গেল। বলতে ইচ্ছে করল : সত্যিই সেলুকাস, কী বিচিত্র এই দেশ। তারপর কী যেন রাতে প্রচণ্ড সূর্য-টুর্য-ও-সব আর মনে পড়ল না।

–টেনিদা এইখানেই ঢোকা যাক!

শুনেই টেনিদা দাঁত খিঁচিয়ে উঠল, হ্যাঁ, এইখানেই ঢুকবি বই কি! পটোল দিয়ে শিঙিমাছের ঝোল খাস, তোর বুদ্ধি আর কত হবে!

–কেন? নামটা তো–

–হ্যাঁ, নামটাই তো! ঢুকেই দ্যাখ না একবার। ঠিক কবিদের মতো বাবরি বানিয়ে দেবে। পেছন থেকে দেখলে মনে হবে, মেমসায়েব হেঁটে যাচ্ছে। আর কেউ যদি তোকে ঠ্যাঙাতে চায়, তা হলে ওই বাবরি চেপে ধরে–

শুনেই আমার বুক দমে গেল। এমনিতেই ছোটকাকা আমার কান পাকড়াবার জন্যে তকে তকে থাকে, বাবরি পেলে কি আর রক্ষে থাকবে! কান প্লাস বাবরি একেবারে দুদিক থেকে আক্রমণ!

–না–না, তবে থাক।

.

আমি বাঁইবাঁই করে প্রায় সিকি-মাইল এগিয়ে গেলুম। আর টেনিদা লম্বা-লম্বা ঠ্যাঙে তিন লাফেই ধরে ফেলল আমাকে : বুঝলি প্যালা, সেলুন ভারি ডেঞ্জারাস জায়গা। বলতে গেলে সুন্দরবনের চাইতেও ভয়াবহ। বুঝেসুঝে ঢুকতে না পারলেই স্রেফ বেঘোরে মারা যাবি। সেইজন্যেই তো তোর সঙ্গে এলুম। আর দেখলি তো, না থাকলে এতক্ষণে হয়তো তোর ঘাড় ফাঁপানো বাবরি কিংবা দেড়-হাত টিকি বেরিয়ে যেত।

–কিন্তু চুল তো ছাঁটতেই হবে টেনিদা।

–আলবাত ছাঁটাতেই হবে। টেনিদার গলার আওয়াজ গম্ভীর হয়ে উঠল; চুল না ছাঁটলে কি চলে? ছাঁটবার জন্যেই তো চুলের জন্ম। যদি চুল ছাঁটবার ব্যবস্থা না থাকত, তা হলে কি আর চুল গজাত? দ্যাখ না ক্ষুর আছে বলেই মানুষের মুখে গোঁফ উঠেছে। তবু সংসারে এমন এক-একটা পাষণ্ড লোক আছে যারা গোঁফ কামায় না, আর ক্ষুরকে অপমান করে।

নিশ্চয় হুলোদার বাবার কথা বলছে। আমার কিন্তু ওসব ভালো লাগছিল না। বলতে যাচ্ছি ‘গোঁফ-টোফ এখন থামাও না বাপু’–এমন সময় দেখি আর-একটা সেলুন। সুকেশ কর্তনালয়! আবার ইংরেজী করে লেখা : দি বেস্ট হেয়ার কাটিং।

–টেনিদা, ওই তো সেলুন।

–সেলুন?–টেনিদা ভুরু কোঁচকালে, তারপর নাক বাঁকিয়ে পড়তে লাগল : সুকেশ কর্তনালয়। কর্তনালয়! বাপস।

–বাপস!–বাপস কেন?

টেনিদা এবার বুক চিতিয়ে সোজা হয়ে দাঁড়াল। কটমট করে কিছুক্ষণ তাকাল আমার দিকে। তারপর হঠাৎ আমার চাঁদির ওপর পটাং করে গোটা দুই টোকা মেরে বললে, গাঁট্টা খেতে পারবি?

আমি বিষম চমকে উঠে বললুম, মিছিমিছি আমি গাঁট্টা খাব? আমার কী দরকার?

–গুরুজনের মুখে-মুখে তক্কো করিস ক্যান র‍্যা? যা বলছি জবাব দে। খেতে পারবি গাঁট্টা? পাঁচ-দশ পনেরোটা?

আমি তাড়াতাড়ি বললুম, একটাও না, একটা খেতেও রাজি নই।

–সাতটা চাঁটি?

বললুম, কী বিপদ! হচ্ছে সেলুনের কথা–চাঁটি আসে কোত্থেকে?

–আসে, আসে। চাঁটাবার মওকা পেলেই আসে। নে– জবাব দে এখন। খাবি চাঁটি?

–কক্ষনো না।

–না?–টেনিদার গলা আরও গম্ভীর : ‘জাড্যাপহ’ শব্দের মানে জানিস?

–না।

–উড়ম্বর?

–না, তাও জানি না। আমি বিব্রত হয়ে বললুম, যাচ্ছি চুল কাটতে– তুমি কেন যে এসব ফ্যাচাং

কথাটা শেষ করার আগেই টেনিদা গর্জন করে উঠল : স্তব্ধ হও, রে-রে বাচাল।

তারপর আবার গদ্য করে বললে, জানিস্ কুটমল মানে কী? বল দেখি, মকুণিকা অর্থ কী?

আমি কাতর হয়ে বললুম, কী যে বলছ টেনিদা, কোনও মানে হয় না। তুমি কি পাগল, না পারশে মাছ যে খামকা এইসব বকবক করে–

টেনিদা আবার আমার চাঁদিতে পটাং করে একটা টোকা মারল–ওরে গাধা! সেলুল্পে। নাম দেখেও বুঝতে পারিসনি? কর্তনালয়, তার ওপর আবার সুকেশ! ওরকম নাম কে দিতে পারে? কোনও হেড পণ্ডিত নিশ্চয় ইস্কুল থেকে পেনশন নিয়ে এখন সেলুন খুলেছে। যেই ঢুকবি অমনি হয়তো জিজ্ঞেস করবে, আপনার শিরোরুহ কি সমূলে উৎপাটিত হইবে? তুই বুঝতে পারবি না, হাঁ করে তাকিয়ে থাকবি। তখন রেগে তোকে চাঁটি-গাঁট্টা লাগিয়ে বলবে, ‘অরে-রে অনড়বান, সত্বর বিদ্যালয়ে গমনপূর্বক প্রথম ভাগ পাঠ কর’—না–না ‘পাঠ করহ’।

শুনে, আমার পালাজ্বরের পিলে তড়াক করে লাফিয়ে উঠল। তবুও সাহসের ভান করে বললুম, যত সব বাজে কথা, গিয়েই দেখি না একবার।

টেনিদা বললে, যা না, যেতেই তো বলছি তোকে। যা ঢুকে পড়, এক্ষুনি যা—

এমনভাবে উৎসাহ দিলে আর যাওয়া যায় না, আমি তৎক্ষণাৎ এদিকের ফুটপাথে চলে এলুম।

–কিন্তু সেলুনে কি ঢোকা যাবে না টেনিদা?

টেনিদা চিন্তা করে করে অনেকক্ষণ ধরে আস্তে-আস্তে মাথা নাড়ল : আমার মনে হচ্ছে ঢোকা উচিত নয়। একটু ভালো বাংলা-টাংলা যদি জানতিস তা হলেও বা কথা ছিল।

–তবে চুল কাটা হবে না?–আমার পালাজ্বরের পিলে হাহাকার করে উঠল : কিন্তু ভালো করে চুল ছাঁটতে না পারলে হুলোদার বউভাতে যাব কী করে?

টেনিদা বললে, দাঁড়া ভেবে দেখি। তার আগে চারটে পয়সা দে।

–আবার পয়সা কেন?

–ডালমুট খাব, খেলে মগজ সাফ হবে, তখন বুদ্ধি বাতলে দেব।

কী আর করি, দিতেই হল চার পয়সা।

টেনিদা ওই চার পয়সার ডালমুখ কিনে বেশ নিশ্চিন্তে বুদ্ধি সাফ করতে লাগল, আমাকে একটুও দিলে না।

–টেনিদা, একবার ছোটকাকার অফিসে গেলে কেমন হয়?

টেনিদার ডালমুট চিবোনো বন্ধ হল : সে কী-রে। তোর ছোটকাকার সেলুন আছে নাকি?

–না-না, সেলুন না। ছোটকাকা বলছিল ওদের অফিসে ছাঁটাই হচ্ছে। গেলে আমার চুলটাও নিশ্চয় ছাঁটাই করে দেবে।

টেনিদা বিরক্ত হয়ে বললে, দুর বোকা–অফিসে কি চুল ছাঁটে? সে অন্য ছাঁটাই।

–কী ছাঁটাই?

–বোধ হয় জামাকাপড় ছাঁটাই। কান-টানও হতে পারে। কী জানি, ঠিক বলতে পারব। তবে চুল ছাঁটে না। তা হলে আমার কুট্টিমামার ধামার মতো চুলগুলো কবে হেঁটে দিত।

তাই তো।–মনটা দমে গেল।

–তবে কী করা যায়? টেনিদা ডালমুটের তলার নুনটা চাটতে-চাটতে বললে, ওই তো গাছটার তলায় ইট পেতে পরামানিক বসে আছে, চল ওর কাছে–

–কিন্তু পরামানিক?–আমি গজগজ করে বললুম, ওরা ভালো চুল কাটে না।

–তোকে বলেছে।–টেনিদা রেগে বললে, ওই বিড়ালই বনে গেলে বাঘ হয়–বুঝলি? এখন নিতান্ত ফুটপাথে বসে আছে, তাই ওর কদর নেই। একটা সেলন খুললেই ওর নাম হবে ‘দি গ্রেট কাটার’। চল চল আমার পিঠে একটা থাবড়া দিয়ে টেনিদা বললে, আমি আছি না সঙ্গে? এমন ডিরেকশন দিয়ে দেব লোকে বলবে, প্যালা ঠিক, সায়েব বাড়ি থেকে চুল ছেঁটে এসেছে। কোনও ভাবনা নেই–আয়–

কী আর করি, পরামানিকের সামনে বসেছি ইট পেতে। টেনিদা থাবা গেড়ে দাঁড়িয়ে আছে সামনে। দেখছে মনের মতো ছাঁট হয় কি না।

কুরকুর করে কাঁচি চলেছে, আমিও বসে আছি নিবিষ্টমনে। হঠাৎ টেনিদা হাঁ হাঁ করে উঠল : এ পরামানিক জী, ঠারো ঠারো।

পরামানিক আশ্চর্য হয়ে বললে, ক্যা ভৈল বা?

–ভৈল না। মানে, ঠিক হচ্ছে না। অ্যায়সা নেহি। ও-ভাবে ছাঁটলে চলবে না।

পরামানিক বললে, তো কেইসা?

আমি বিরক্ত হয়ে বললুম, কেন বাগড়া দিচ্ছ টেনিদা? বেশ তো কাটছে–কাটুক না।

টেনিদা দাঁত বের করে বললে, কাটুক না। যা-তা করে কাটলেই হল? এ হল বউভাতের ছাঁট, এর কায়দাই আলাদা। যা খুশি কেটে দেবে, আর শেষে লোকে আমারই বদনাম করে বলবে, ছি–ছি–পটলডাঙার টেনিরাম কাছে থাকতেও প্যালা যাচ্ছেতাই চুল ছেঁটে এসেছে! রামোঃ!

পরামানিক অধৈর্য হয়ে বললে, কেইসা ছাঁটাই?. বোলিয়ে না।

–বোলতা তো হ্যাঁয়!–টেনিদা আমার মাথায় আঙুল দেখিয়ে বলে চলল : হিঁয়া দু ইঞ্চি ছাঁটকে দেও, হিয়া তিন ইঞ্চি–

আমি কাতর হয়ে বললুম, আমার কায়দায় দরকার নেই টেনিদা–ও যেমন কাটছে কাটুক।

–শট আপ! ছেলেমানুষ তুই–গুরুজনের মুখে-মুখে কথা বলিস কেন?–শুনো জী পরামানিক, হিয়া-সে চার ইঞ্চি কাট দেও– হিঁয়া ফের এক ইঞ্চি–হিঁয়া দু ইঞ্চি ঘাড় ছাঁচকে দেও–

পরামানিক এবার রেগে গেল! ওইসা নেহি হোতা।

টেনিদা বললে, জরুর হোতা। তুম কাটো।

পরামানিক বললে, নেহি ওইসা কভি নেহি হোতা।

আমি কাঁদো কাঁদো হয়ে বললুম, দোহাই টেনিদা, পায়ে পড়ছি তোমার, ওকে কাটতে দাও

টেনিদা গর্জন করে বললে, চোপ রাও। তুম কাটো পরামানিক জী—

পরামানিকের আত্মসম্মানে ঘা লেগেছে তখন। নিজের সংকল্পে সে অটল।

–নেহি, হোতা নেহি।

–আলবাত হোতা। কয়ঠো ছাঁট দেখা তুম? তুম ছাঁটের কেয়া জানতা? কাটো–

–নেহি কাটেগা। বদনাম হো যায়েগা হামকো। ওইসব নেহি হোতা।

–নেহি হোতা?–টেনিদা এবার চেঁচিয়ে উঠল : সব হোতা। আকাশে শুটনিক হোতা মাথামে টাক হোতা– মুরগি আজ ঠ্যাং নিয়ে চলে বেড়াতা, কাল সেই ঠ্যাং প্লেটমে কাটলেট হো-যাতা। সব হোতা, তুমি নেহি জানতা!

–হাম নেহি জানতা?

–নেহি জানতা।–টেনিদার গলার স্বর বজ্রকঠোর।

–আপ জানতে হেঁ- পরামানিক এবার চ্যালেঞ্জ করে বসল।

–জরুর জানতা হেঁ!–টেনিদা গরুণ উত্তেজিত।

–তো কাটিয়ে।

পরামানিকের বলবার অপেক্ষা মাত্র। পটাং করে টেনিদা তার কাঁচি হাত থেকে কেড়ে নিলে। আর আমি—’বাবা-রে-মা-রেপিসিমা-রে’–বলে চেঁচিয়ে লাফিয়ে ওঠবার আগেই আমার চুলে টেনিদার কাঁচি চলতে লাগল : এই দেখো চার ইঞ্চি–এই দেখো পাঁচ ইঞ্চি এই দেখো–ইয়ে তিন ইঞ্চি—দেখো–

কিন্তু পরামানিক দেখবার আগেই আমি চোখে সর্ষে ফুল দেখছি তখন। উঠে প্রাণপণে ছুট মেরেছি আর তারস্বরে চেঁচাচ্ছি : মেরে ফেললে ডাকাত–খুন–

আমার পেছনে রাস্তার লোক ছুটছে, কুকুর ছুটছে, পরামানিক ছুটছে, পুলিশ ছুটছে। আর সকলের আগে ছুটছে কাঁচি হাতে টেনিদা। বলছে, দাঁড়া প্যালা– দাঁড়া। একবার ওকে ভালো করে দেখিয়ে দিই, ছাঁট কাকে বলে–

হুলোদার বউভাতে সবাই পোলাও-মাংস-ফ্রাই-সন্দেশ খাচ্ছে এতক্ষণে, আর আমি? একেবারে মোক্ষম ছাঁট দিয়ে বিছানায় চুপচাপ শুয়ে আছি। অর্থাৎ ন্যাড়া হওয়া ছাড়া উপায় ছিল না। এই ছাঁট নিয়ে কোনওমতেই বউভাতের নেমন্তন্ন খেতে যাওয়া চলে না। আর চাটুজ্যেদের রোয়াক থেকে কে যেন আমাকে শুনিয়ে-শুনিয়ে চিৎকার করে বললে, ডি-লা গ্রাণ্ডি মেফিস্টোফিলিস ইয়াক ইয়াক! মনে হল, টেনিদারই গলা।

নিদারুণ প্রতিশোধ

চাটুজ্যেদের রোয়াকে বসে পটলডাঙার টেনিদা বেশ মন দিয়ে তেলেভাজা খাচ্ছিল। আমাকে দেখেই কপকপ করে বাকি বেগুনি দুটো মুখে পুরে দিয়ে বললে, এই যে শ্রীমান প্যালারাম, কাল বিকেলে কোথায় গিয়েছিলে? খেলার মাঠে তোর যে টিকিটাও দেখতে পেলুম না, বলি ব্যাপারখানা কী?

আমি বললুম, আমি মেজদার সঙ্গে সাকাস দেখতে গিয়েছিলাম।

–বটে-বটে! তা কী রকম দেখলি?

–খাসা! ডি-লা-গ্র্যান্ডি মেফিস্টোফিলিস যাকে বলে! হাতি, বাঘ, সিঙ্গি, ফ্লায়িং ট্রাপিজ, মোটর সাইকেল কত কী! কিন্তু জানো টেনিদা, সব চাইতে ভালো হল শিম্পাঞ্জির খেলা। চা খেল, চুরুট ধরাল।

–আরে ছোঃ ছোঃ!–টেনিদা নাকটাকে কুঁচকে পাতিনেবুর মতো করে বললে, রেখে দে তোর শিম্পাঞ্জি। আমার কুট্টিমামার বন্ধু রামগিদ্ধড়বাবু একবার একটা গোদা হনুমানের যে-খেল দেখেছিলেন, তার কাছে কোথায় লাগে তোর সাকাসের শিম্পাঞ্জি! নস্যি–স্রেফ নস্যি।

–তাই নাকি?–আমি টেনিদার কাছে ঘন হয়ে বললুম : রামগিদ্ধড়বাবু কোথায় দেখলেন সে-খেলা?

–উড়িষ্যায়।

আমি মাথা নেড়ে বললুম, বুঝেছি। পুরীতে গিয়ে জগন্নাথের মন্দিরে আমি কয়েকটা বড় হনুমান দেখেছিলুম।

ধ্যাত্তোর পুরী। ওগুলো আবার মনিষ্যি–থুড়ি হনুমান নাকি? গাদাগাদা জগন্নাথের পেসাদ খেয়ে নাদাপেট নিয়ে বসে আছে-গলায় একটা করে মাদুলি পরিয়ে দিলেই হয়। হনুমান দেখতে গেলে জঙ্গলে যেতে হয়, মানে কেওনঝড়ের জঙ্গলে।

–কেওনঝড়! সে আবার কোথায়?

–তাই যদি জানবি, তা হল পটলডাঙায় বসে পটোল দিয়ে শিঙিমাছের ঝোল খাবি কেন র‍্যা? নে, গপ্পো শুনবি তো এখন মুখে ইস্কুপ এঁটে চুপটি করে বসে থাকবকের মতো বকবক করিসনি।

–বক তো বকবক করে না—ক্যাঁ-ক্যাঁ করে।

–চোপ রাও! বক বকবক করে না? তা হলে তো কোন্‌দিন বলে বসবি কাক কাকা করে না, পাঁঠার মতো ভ্যাঁ-ভ্যাঁ করে ডাকে।

–হয়েছে, হয়েছে, তুমি বলে যাও।

–বলবই তো, তোকে আমি তোয়াক্কা করি নাকি? এখন আমাকে ডিসটার্ব করিসনি। মন দিয়ে রামগিদ্ধড়বাবুর গল্প শুনে যা বিস্তর জ্ঞান লাভ করতে পারবি। হয়েছে কী, রামগিদ্ধড়বাবু কনট্রাকটারের কাজ করতেন। মানে, পুল-টুল রাস্তাঘাট এইসব বানাতে হত তাঁকে। সেই কাজেই তাঁকে সেবার কেওনঝড়ের জঙ্গলে যেতে হয়েছিল।

কুলি, তাঁবু, জিপগাড়ি–এইসব নিয়ে সে-এক এলাহি কাণ্ড। বনের ভেতরেই একটুখানি ফাঁকা জায়গা দেখে রামগিদ্ধড় তাঁবু ফেলেছেন। মাইল দুই দুরে পাহাড়ি নদীর ওপর একটা পুল তৈরি হচ্ছে, সকালে বিকালে সেখানে জিপ নিয়ে রামগিদ্ধড়বাবু কাজ দেখতে যান।

জঙ্গলে এনতার হনুমান, গাছে গাছে তাদের আস্তানা। কিন্তু লোকজনের উৎপাতে আর জিপের আওয়াজে তারা এদিক-ওদিক পালিয়ে গেল। রামচন্দ্রজী তো আর নেই-কার ওপরে আর ভরসা রাখবে বল্? কুলিরা অবিশ্যি মাঝে মাঝে ঢোল আর খঞ্জনি বাজিয়ে রামা হে রামা হো’ বলে গান গাইত, কিন্তু সেই বিকট চিৎকার শুনে কি আর অবোলা জীব কাছে আসতে সাহস পায়?

তবু একটা কাণ্ড ঘটল।

সেদিন দুপুরবেলা তাঁবুর বাইরে বসে রামগিদ্ধড় চাপাটি খাচ্ছিলেন। হঠাৎ দেখলেন, সামনে গাছের ডালে বসে একটা গোদা হনুমান জুলজুল করে তাকাচ্ছে। মুখের চেহারাটা ভারি করুণ–’কাঙালকে কিছু দিয়ে দিন দাতা’–ভাবখানা এই রকম।

রামগিদ্ধড়বাবুর ভারি মায়া হল। একটা চাপাটি ছুঁড়ে দিলেন, হনুমান সেটা কুড়িয়ে নিয়ে মাথাটা একবার সামনে ঝুঁকিয়ে দিলে, যেন বললে, ‘সেলাম হুজুর। তার পরেই টুপ করে গাছের ডালে কোথায় হাওয়া হয়ে গেল।

পরের দিন রামগিদ্ধড় যেই খেতে বসেছেন, ঠিক হনুমানটা এসে হাজির। আজও রামগিদ্ধড় তাকে একটা চাপাটি দিলেন, সে-ও তেমনি করেই তাঁকে সেলাম দিয়ে, চাপাটি নিয়ে উধাও হল।

এমনি চলতে লাগল মাসখানেক ধরে। রোজ খাওয়ার সময় হনুমানটা আসে, তার বরাদ্দ চাপাটিখানা নিয়ে চলে যায়, যাওয়ার সময় তেমনি মাথা ঝুঁকিয়ে সেলাম করে। আর কোনওরকম বিরক্ত করে না, কোনওদিন একখানার বদলে দুখানা চাপাটি চায় না। মানে সেই বর্ণ-পরিচয়ের সুবোধ বালক গোপালের মতো আর কি–যাহা পায়, তাহাই খায়।

তা খাচ্ছিল, চলছিলও বেশ, রামগিদ্ধড়বাবুই একদিন গোলমালটা পাকিয়ে বসলেন। সেদিন কুলিদের সঙ্গে বকাবকি করে মেজাজ অত্যন্ত খারাপ–অন্যমনস্কভাবে খেয়েই চলেছেন। ওদিকে সেই গোপাল-মাকা সুবোধ হনুমান যে কখন থেকে ঠায় বসে আছে, সেদিকে তাঁর খেয়ালই নেই। ধীরে-সুস্থে সব কটা চাপাটি চিবুলেন, বড় একবাটি দুধ খেলেন, তারপর মোটাসোটা গোঁফজোড়া মুছতে-মুছতে উঠে গেলেন। হনুমানের কথা তাঁর মনেও পড়ল না।।

পরদিন যেই চাপাটির থালা নিয়ে বসেছেন–অমনি হুপ করে এক আওয়াজ। ব্যাপার কী যে হল ভালো করে ঠাহর করবার আগেই রামগিদ্ধড় দেখলেন, থালার আটখানা চাপাটি বেমালুম ভ্যানিশ। তাঁর নাকের সামনে মস্ত একটা ল্যাজ একবার চাবুকের মতো দুলে গেল, ‘হুপ করে শব্দ, আর একবার গাছের ডাল ঝরঝর করে নড়ে উঠল ব্যস, কোথাও আর কিছু নেই।

দু-একজন কুলি হইহই করে উঠল, ঠাকুর হায়-হায় করতে লাগল আর রামগিদ্ধড় স্রেফ হাঁ করে রইলেন। আঁ–এইসা বেইমানি! রোজ রোজ হতচ্ছাড়া হনুমানকে চাপাটি খিলাচ্ছি–আর সে কিনা অ্যায়সা বেতমিজ। আর কোনও জানোয়ার হলে রামগিদ্ধড় তাকে গুলি করে মারতেন, কিন্তু মহাবীরজীর জাতভাইকে তো আর সত্যিই গুলি করা যায় না। সে তো মহাপাপ।

রাগের চোটে রামগিদ্ধড় মুখের এক গোছা গোঁফই টেনে ছিঁড়ে ফেললেন। বললেন, দাঁড়াও–রামগিদ্ধড় চৌধুরী খাস বালিয়া জিলার রাজপুত। আমিও তোমায় ঠাণ্ডা করে দিচ্ছি। পরদিন ঠাকুর-কে ডেকে বললেন, এখানে সব চাইতে ঝাল যে মিরচাই–মানে লঙ্কা পাওয়া যায়, তারই বাটনা কর ছটাকখানেক। আর তাই দিয়ে তৈরি কর দুখানা চাপাটি। তারপর আমি দেখে নিচ্ছি হনুমানজীকে–

খেতে বসেই কোনওদিকে না তাকিয়ে–মানে থালাসুন্ধু লোপাট হওয়ার কোনও চান্স না দিয়েই রামগিদ্ধড় সেই লঙ্কাবাটা ভর্তি চাপাটি দুখানা ছুঁড়ে দিলেন মাটিতে। আবার শব্দ হল ‘হুপ’–হনুমান নেমে পড়ল, কুড়িয়ে নিলে চাপাটি, রোজকার মতো সেলাম করলে, তারপরেই টুপ করে গাছের ডালে। রামগিদ্ধড়ের কুলিরা তাঁর দুপাশে লাঠি হাতে দাঁড়িয়ে রইল যাতে কোনও অঘটন না ঘটে। আর দু মিনিটের ভেতরেই গাছের ওপর থেকে নিদারুণ এক চিৎকার শোনা গেল। হনুমান এ-ডাল থেকে ও-ডালে লাফিয়ে বেড়াতে লাগল, আওয়াজ হতে লাগল : খ্যাঁ—খ্যা–খ্যাঁ, খোঁ-খোঁ উপুস-গুপুস! পাখিরা চিৎকার করে পালাতে লাগল, গাছের ঘেঁড়া পাতা উড়তে লাগল চারদিকে। মানে, দ্বিতীয়বার হনুমানের মুখ পুড়ল, আর শুরু হয়ে গেল দস্তুরমতো লঙ্কাকাণ্ড।

গাছ থেকে হনুমান চেঁচাতে লাগল : খ্যাঁ-খ্যাঁ-খোঁ-খ্যাঁ, আর নীচ থেকে সদলবলে রামগিদ্ধড় হাসতে লাগলেন : হাঃহাঃ-হো-হোঃ। হনুমান আজ আচ্ছা জব্দ হয়েছে। রামগিদ্ধড়ের চাপাটি লুঠ! মানুষ চেনো না! বোঝো এখন।

খানিকক্ষণ দাপাদাপি করে হনুমান কোনদিকে ছটকে পড়ল কে জানে। আর রামগিদ্ধড় আরও আধ ঘণ্টা ভুড়ি কাঁপানো অট্টহাসি হেসে তাঁর সেই জিপগাড়ি নিয়ে বেরিয়ে পড়লেন। কাজ দেখতে। হনুমানের মুখ পুড়িয়ে মনে মনে তো বেজায় খুশি হয়েছেন, কিন্তু রামায়ণে রাবণের যে কী দশা হয়েছিল, সেটা বেমালুম ভুলে গেছেন তখন, টের পেলেন বিকেলেই।

কাজ দেখে যখন ফিরে আসছেন, বনের মধ্যে তখন ছায়া নেমেছে। দিব্যি ঝিরঝিরে হাওয়া বইছে, চারিদিকে পাখিটাখি ডাকছে, রামগিদ্ধড়ের মেজাজটাও ভারি খুশি হয়ে রয়েছে। আস্তে-আস্তে জিপ চলেছে আর রামগিদ্ধড় গুনগুন করে গান গাইছেন : আরে হাঁবনমে চলে রামচন্দ্রজী, সাথমে চলে লছমন ভাই-এই সময় জিপের ড্রাইভার বাঁটকুল। সিং বললে, আরে এ কোন্ বেকুবের কাণ্ড। রাস্তাজুড়ে গাছের ডাল ভেঙে রেখেছে। এখন যাই কী করে? রামগিদ্ধড় দেখলেন তাই বটে। ছোট বড় ডালপালা দিয়ে বনের ছোট পথটি যেন একেবারে ব্যারিকেড করে রাখা হয়েছে। বুনো লোকগুলোর কারবারই আলাদা। বিরক্ত হয়ে বললেন, গাড়ি থামিয়ে রাস্তা সাফ করো বাঁটকুল সিং! বাঁটুল সিং জিপ থেকে নেমে রাস্তা পরিষ্কার করতে যাচ্ছে, আর ঠিক তখন–গুপ–গাপ, হুপ—হুপ–গবাৎ–

সমস্ত বন যেন একসঙ্গে ডাক ছেড়ে উঠল। গাছের মাথায় মাথায় ঝড় বয়ে গেল, আর বললে বিশ্বাস করবিনে প্যালা, দুপ-দাপ শব্দে কোত্থেকে কমসে কম দেড়শো হনুমান লাফিয়ে পড়ে রামগিদ্ধড়বাবুর জিপগাড়ি ঘেরাও করে ফেললে। দ্বিতীয় লঙ্কাকাণ্ডের পর এ যেন দ্বিতীয় রাবণবধের ব্যবস্থা।

ব্যাপার দেখেই তো বাঁটুল সিংয়ের হয়ে গেছে। সে তো আরে বাপ বলে বনবাদাড় ভেঙে দৌড়! রামগিদ্ধড়ও জিপ থেকে লাফিয়ে পড়লেন, কিন্তু সঙ্গে সঙ্গে গোদা হনুমান তাঁকে জাপটে ধরলে।

–বাবা-রে মা-রে–গেছি রে–বলে পরিত্রাহি হাঁক ছাড়লেন রামগিদ্ধড়, কিন্তু দেড়শো হনুমানের গুপ গাপ শব্দে তাঁর চ্যাঁচানি কোথায় তলিয়ে গেল। তখন কী হল বল দিকি? দুটো হনুমান তাঁর দুকান শক্ত করে পাকড়ে ধরলে, একটা তাঁর দু’গালে ঠাঁই ঠাঁই করে বেশ ক’বার চড়িয়ে দিলে।

–জান গিয়া জান গিয়া বলে যেই রামগিদ্ধড় চেঁচিয়ে উঠে হাঁক ছেড়েছেন, সঙ্গে সঙ্গে সেই যে হনুমানসকালে যাকে খুব জব্দ করেছিলেন, সে রামগিদ্ধড়ের মুখের ভেতর একখানা চাপাটি গলা পর্যন্ত ঠেসে দিলে।

কোন চাপাটি বুঝেছিস তো? মানে, লঙ্কা বাটায় লাল টুকটুকে সেই দোসরা নম্বরের চিজটি। জিভে সেটা লাগতে না লাগতেই রামগিদ্ধড়ের মুখে যেন আগুন জ্বলে উঠল। একবার ফেলে দিতে গেলেন মুখ থেকে কিন্তু সাধ্য কী! তক্ষুনি দুগালে ধুমধাম করে দুই থাপ্পড়!

অগত্যা রামগিদ্ধড় নিজের কীর্তি সেই চাপাটি খেলেন, মানে খেতেই হল তাঁকে। দেড়শো হনুমানের সঙ্গে তো আর চালাকি নয়। দেড়শো হাতের দেড়শোটি চাঁটি খেলে রামগিদ্ধড়ও রাম-ইঁদুর হয়ে যাবেন। কিন্তু চাঁটি বাঁচাতে যা খেলেন তা চাপাটি নয়–সোজাসুজি দাবানল যাকে বলে। চিবুনি দিতেই চোখ দিয়ে দরদর করে জল পড়তে লাগল, মনে হতে লাগল, গলা থেকে চাঁদি পর্যন্ত কী বলে–একেবারে লেলিহান শিখায় জ্বলছে। রামগিদ্ধড় কেবল তারস্বরে বলতে পারলেন : জল–তার পরেই সব অন্ধকার।

ওদিকে কুলির দল আর বন্দুক-টক নিয়ে বাঁটকুল যখন ফিরে এল, তখন হনুমানদের এতটুকু চিহ্ন কোথাও নেই। কেবল রামগিদ্ধড় পথের মাঝখানে অজ্ঞান হয়ে পড়ে আছেন। তারপর সেই চাপাটির চোট সামলাতে পাক্কা একটি মাস হাসপাতালে।

তাই বলছিলুম, আমার কাছে সার্কাসের শিম্পাঞ্জির গপ্পো আর করিসনি। আসল খেল দেখতে চাস তো সোজা কেওনঝড়ের জঙ্গলে চলে যা।

এই বলে পটলডাঙার টেনিদা আমার চাঁদিতে কড়াং করে একটা গাট্টা মারল আর তার পরেই তিন-চারটে বড় বড় লাফ দিয়ে সোজা শ্ৰদ্ধানন্দ পার্কের দিকে হাওয়া হয়ে গেল।

ন্যাংচাদার ‘হাহাকার’

ক্যাবলা বললে বড়দার বন্ধু গোবরবাবু ফিলিমে একটা পার্ট পেয়েছে।

টেনিদা চার পয়সার চীনেবাদাম শেষ করে এখন তার খোলাগুলোর ভেতর খোঁজাখুঁজি করছিল। আশা ছিল, দু-একটা শাঁস এখনও লুকিয়ে থাকতে পারে। যখন কিছু পেলে না, তখন খুব বিরক্ত হয়ে একটা খোলাই তুলে নিলে, কড়মড় করে চিবুতে চিবুতে বললে, বারণ কর ক্যাবলা–এক্ষুনি বারণ করে দে।

ক্যাবলা আশ্চর্য হয়ে বললে, কাকে বারণ করব? গোবরবাবুকে?

–আলবাত। নইলে তোর গোবরবাবু স্রেফ ঘুঁটে হয়ে যাবে।

ঘুঁটে হবে কেন? সেই যে কী বলে–মানে স্টার হবে।…আমি বলতে চেষ্টা করলুম।

স্টার হবে? আমার ন্যাংচাদাও স্টার হতে গিয়েছিল, বুঝলি? এখন নেংচে-নেংচে হাঁটে আর সিনেমা হাউসের পাশ দিয়ে যাবার সময় কানে আঙুল দিয়ে, চোখ বুজে খুব মিহি সুরে দীনবন্ধু, কৃপাসিন্ধু কৃপাবিন্দু বিতরো–এই গানটা গাইতে-গাইতে পেরিয়ে যায়।

বুঝতে পারছি। …হাবুল সেন মাথা নাড়ল : তোমার ন্যাংচাদা-রে ফিলিমের লোকেরা মাইরা ল্যাংড়া কইরা দিচ্ছে।

হঃ, মাইর‍্যা ল্যাংড়া করছে!–টেনিদা ভেংচে বললে, খামকা বকবক করিসনি, হাবুল। যেন এক নম্বরের কুরুবক।

ক্যাবলা বললে-কুরুবক তো ভালোই। এক রকমের ফুল।

–থাম, তুই আর সবজান্তাগিরি করিসনি। কুরুবক যদি ফুল হয়, তা হলে কানিবকও একরকমের গোলাপফুল। তা হলে পাতিহাঁসও এক রকমের ফজলি আম! তা হলে কাকগুলোও এক রকমের বনলতা হতে পারে।

ক্যাবলা বললে-বা-রে, তুমি ডিকশনারি খুলে দ্যাখো না।

শাট আপ! ডিকশনারি। আমিই আমার ডিকশনারি। আমি বলছি কুরুবক এক ধরনের বক–খুব খারাপ, খুব বিচ্ছিরি বক। যদি চালিয়াতি করবি তো এক চাঁটিতে তোর দাঁত

–দাঁতনে পাঠিয়ে দেব।–আমি জুড়ে দিলুম : কিন্তু বকের বকবকানি এখন বন্ধ করো বাপু। কী ন্যাংচাদার গল্প যেন বলছিলে?

–অঃ, ফাঁকি দিয়ে গল্প শোনার ফন্দি? টেনি শর্মাকে অমন আনরাইপ চাইল্ড মানে কাঁচা ছেলে পাওনি বুঝেছ, প্যালারাম চন্দর? ন্যাংচাদার রোমহর্ষক কাহিনী যদি শুনতে চাও তা হলে এক্ষুনি পকেট থেকে ঝাল-নুনের শিশিটা বের করো। একটু আগেই লুকিয়ে লুকিয়ে চাটা হচ্ছিল, আমি বুঝি দেখতে পাইনি?

কী ডেঞ্জারাস চোখ-দেখেছ? কত হুঁশিয়ার হয়ে খাচ্ছি ঠিক দেখে ফেলেছ। সাধে কি ইস্কুলের পণ্ডিতমশাই টেনিদাকে বলতেন, বাবা ভজহরি–তুমি হচ্ছ পয়লা নম্বরের শিরিগাল…মানে ফকস!

দেখেছে যখন, কেড়েই নেবে। কী আর করি–মানে-মানে দিতেই হল শিশিটা।

প্রায় অর্ধেকটা ঝাল-নুন একেবারে চেটে নিয়ে টেনিদা বললে ন্যাংচাদা-মানে আমার বাগবাজারের মাসতুতো ভাই

হাবুল বললে-চোরে-চোরে।

–অ্যাঁ! কী বললি?

–না-না, আমি কিছু কই নাই। কইতাছিলাম, একটু জোরে-জোরে কও!

–জোরে?–টেনিদা দাঁত খিঁচিয়ে নাকটাকে আলুসেদ্ধর মতো করে বললে, আমাকে কি অল ইন্ডিয়া রেডিয়ো পেলি যে, খামকা হাউমাউ করে চ্যাঁচাব? মিথ্যে বাধা দিবি তো এক গাট্টায় চাঁদি

আমি বললুম-চাঁদপুরে পাঠিয়ে দেব।

–যা বলেছিস!–বলেই টেনিদা আমার মাথায় টকাস করে গাঁট্টা মারতে যাচ্ছিল, আমি চট করে সরে গিয়ে মাথা বাঁচালুম।

আমাকে গাঁট্টা মারতে না পেরে ব্যাজার হয়ে টেনিদা বললে–দরকারের সময় হাতের কাছে কিছু পাওয়া যায় না-বোগাস। মরুক গে–ন্যাংচাদার কথাই বলি। খবরদার কথার মাঝখানে ডিসটার্ব করবি না কেউ।

হ্যাঁ, যা বলছি। আমার বাগবাজারের মাসতুতো ভাই ন্যাংচাদার ছিল ভীষণ ফিলিমে নামবার শখ! বায়োস্কোপ দেখে-দেখে রাতদিন ওর ভাব লেগেই থাকত। বললে বিশ্বাস করবিনে, বাজারে কাঁচকলা কিনতে গেছে-হঠাৎ ওর ভাব এসে গেল। বললে, ওগো তরুণ কদলী! এই নিষ্ঠুর সংসার তোমাকে ঝোলের মধ্যে রান্না করে করে খায়–তোমার অরুণ, হিয়ার করুণ ব্যথা কে বুঝবে! এই বলে, খুব কায়দা করে একটা দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেলে ওফ বলতে যাচ্ছে, এমন সময় কাঁচকলাওয়ালা বললে, কোথাকার এঁচোড়ে পাকা ছেলে রে। দিতে হয় কান ধরে এক থাপ্পড়। ন্যাংচাদা আমার কানে কানে বললে—অহো–কী নৃশংস মনুষ্য–দেখেছিস?

এমন ভাবের মাথায় কেউ কি আই-এ পাশ করতে পারে? ন্যাংচাদা সব সাবজেক্টে ফেল করে গেল। আর মেসোমশাই অফিস থেকে ফিরে এসে যা-যা বললেন, সে আর তোদের শুনে কাজ নেই। মোদ্দা, অপমানে ন্যাংচাদার সারারাত কান কটকট করতে লাগল। প্রতিজ্ঞা করল, হয় ফিলিমে নেমে প্রতিভায় চারিদিক অন্ধকার করে দেবে–নইলে এ-পোড়া কান আর রাখবে না।

-খুব ইচ্ছেশক্তি থাকলে, মানে মনে খুব তেজ এসে গেলে বুঝলি, অঘটন একটা ঘটেই যায়। ন্যাংচাদা তো মনের দুঃখে সকালবেলা দি গ্র্যান্ড আবার খাবো রেস্তোরাঁয় ঢুকে এক পেয়ালা চা আর ডবল ডিমের মামলেট নিয়ে বসেছে। এমন সময় খুব সুট-টাই হাঁকড়ে এক ছোকরা এসে বসলো ন্যাংচাদার টেবিলে। ন্যাংচাদা দেখলে, তার কাছে একটা নীল রঙের ফাইল..আর তার ওপরে খুব বড় বড় করে লেখা ইউরেকা ফিলিম কোং। নবতম অবদান-হাহাকার।

ন্যাংচাদার মনের অবস্থা তো বুঝতেই পারছিস। উত্তেজনায় তার কানের ভেতর যেন তিনটে করে উচ্চিংড়ে লাফাতে লাগল, নাকের মধ্যে যেন আরশোলারা সুড়সুড়ি দিতে লাগল। তার সামনেই জলজ্যান্ত ফিলিমের লোক বসে–তাতে আবার নবতম অবদান। একেই বলে মেঘ না চাইতে জল। কে বলে, কলিযুগে ভগবান নেই।

ন্যাংচাদা বাগবাজারের ছেলে–তুখোড় চিজ। তিন মিনিটে আলাপ জমিয়ে নিলে। লোকটার নাম চন্দ্রবদন চম্পটী–সে হল হাহাকার ফিলিমের একজন অ্যাসিসট্যান্ট। মানে, ছবির ডিরেকটারকে সাহায্য করে আর কি।

হাবুল বললে সহকারী পরিচালক।

–চোপরাও।–টেনিদা হাবুলকে এক বাঘা ধমক লাগিয়ে বলে চলল, চন্দ্রবদনকে ন্যাংচাদা ভজিয়ে ফেললে। তার বদনে দুটো ডবল ডিমের মামলেট, চারটে টোস্ট আর তিন কাপ চা ঘুষ দিয়ে–শেষে হাতে চাঁদ পেয়ে গেল ন্যাংচাদা। ওঠবার সময় চন্দ্রবদন বললে–এত করে বলছেন যখন–বেশ, আপনাকে আমি ফিলিমে চান্স দেব। কাল বেলা দশটার সময় যাবেন বরানগরের ইউরেকা ফিলিমে–নামিয়ে দেব জনতার দৃশ্যে।

হাত কচলাতে কচলাতে ন্যাংচাদা বললে, স্টুডিয়োটা কোথায়, স্যর?

চন্দ্রবদন জায়গাটা বাতলে দিলে। বললে–দেখলেই চিনতে পারবেন। উঁচু পাঁচিল বাইরে লেখা রয়েছে ইউরেকা ফিলিম কোং। আচ্ছা আসি এখন, ভেরি বিজি, টা-টা–

হাত নেড়ে চন্দ্রবদন তড়াক করে একটা চলতি বাসে উঠল।

সেদিন রাত্তিরে তো ন্যাংচাদার আর ঘুম হয় না। বার বার বিছানা থেকে উঠে আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে জনতার দৃশ্যে পাট করছে। মানে, কখনও স্তম্ভিত হয়ে যাচ্ছে কখনও জয়ধ্বনি করছে, কখনও অট্টহাসি হাসছে। অবিশ্যি হাসি আর জয়ধ্বনিটা নিঃশব্দেই হচ্ছে–পাশের ঘরেই আবার মেসোমশাই ঘুমোন কিনা।

সারা রাত ধরে জনতার দৃশ্য সড়গড় করে নিয়ে ন্যাংচাদা সকাল নটার আগেই সোজা ব্যারাকপুর ট্রাঙ্ক রোডের বাসে চেপে বসল। তারপর জায়গাটা আঁচ করে নেমে পড়ল বাস থেকে।

খানিকটা হাঁটতেই–আরে, ওই তো উঁচু পাঁচিল। ওইটেই নিশ্চয় ইউরেকা ফিলিম।

গুটিগুটি পায়ে এগিয়ে গেল ন্যাংচাদা। বাইরে একটা মস্ত লোহার গেট–ভেতর থেকে বন্ধ। তার ওপরে বোর্ডে কী একটা নাম লেখা আছে কিন্তু লতার ঝাড়ে নামটা পড়া যাচ্ছে না-দেখা যাচ্ছে কেবল তিনটে হরফ-এল, ইউ, এম।

এল-ইউ-এম! লাম। মানে ফিলাম। তার মানেই ফিলিম।

ক্যাবলা আপত্তি করলে, লাম! লাম কেন হবে? এফ-আই-এল-এম ফিলম।

টেনিদা রেগেমেগে চিৎকার করে উঠল : সায়লেন্স! আবার কুরুবকের মতো বকবক করছিস? এই রইল গল্প–আমি চললুম।

প্রায় চলেই যাচ্ছিল, আমরা টেনেটুনে টেনিদাকে বসালুম। হাবুল বললে, ছাইড়া দ্যাও ক্যাবলার কথা–চ্যাংড়া!

–চ্যাংড়া! ফের ডিসটার্ব করলে ট্যাংড়া মাছ বানিয়ে দেব বলে রাখছি। হুঁ! লোহার গেট বন্ধ দেখে ন্যাংচাদা গোড়াতে তো খুব ঘাবড়ে গেল। ভাবলে, চন্দ্রবদন নির্ঘাত গুলপট্টি দিয়ে দিব্যি পরস্মৈপদী খেয়েদেয়ে সটকান দিয়েছে। তারপর ভাবলে, অন্যদিকেও তো দরজা থাকতে পারে। দেখা যাক।

পাঁচিলের পাশ দিয়ে ঘুরঘুর করছে–গেট-ফেট তো দেখা যাচ্ছে না। খুব দমে গেছে, এমন সময় হঠাৎ ভীষণ মোটা গলায় কে বললে, হু আর ইউ?

ন্যাংচাদা তাকিয়ে দেখল, পাঁচিলের ভেতর একটা ছোট ফুটো। তার মধ্যে কার দুটো জ্বলজ্বলে চোখ আর একজোড়া ধুমসো গোঁফ দেখা যাচ্ছে। সেই গোঁফের তলা থেকে আবার আওয়াজ এল : হু আর ইউ?

ন্যাংচাদা বললে, আমি–মানে আমাকে চন্দ্রবদনবাবু ফিলিমে পার্ট করতে ডেকেছিলেন। এটাতে তো ইউরেকা ফিলিম?

–ইউরেকা ফিলিম?-গোঁফের তলা থেকে বিচ্ছিরি দাঁত বের করে কেমন খ্যাঁক-খেঁকিয়ে হাসল লোকটা। তারপর বললে, আলবাত ইউরেকা ফিলিম। পার্ট করবে? ভেতরে চলে এসো।

-গেট যে বন্ধ। ঢুকব কী করে?

–পাঁচিল টপকে এসো। ফিলিমে নামবে আর পাঁচিল টপকাতে পারবে না, কী বলো?

ন্যাংচাদা ভেবে দেখলে, কথাটা ঠিক। ফিলিমের কারবারই আলাদা। দ্যাখ না–বোঁ করে লোকে নল বেয়ে চারতলায় উঠে পড়ছে, ঝপাং করে পাঁচতলার থেকে নিচে লাফিয়ে পড়ছে–একটা চলতি ট্রেন থেকে লাফিয়ে আর একটা ট্রেনে চলে যাচ্ছে। এসব না করতে পারলে ফিলিমে নামাবেই বা কেন? ন্যাংচাদা বুঝতে পারলে, এখানে পাঁচিল টপকে ভেতরে যাওয়াই নিয়ম, ওইটেই প্রথম পরীক্ষা।

ন্যাংচাদা কী আর করে? দেওয়ালের খাঁজে-খাঁজে পা দিয়ে উঠতে চেষ্টা করতে লাগল। দুপা ওঠে–আর সড়াৎ করে পিছলে পড়ে যায়। শখের সিলকের পাঞ্জাবি ছিঁড়ল, গায়ের নুনছাল উঠে গেল, ঠিক নাকের ডগায় আবার কুটুস করে একটা কাঠপিঁপড়ে কামড়ে দিলে। ভেতরে বোধহয় আরও কিছু লোক জড়ো হয়েছে তারা সমানে বলছে-হেঁইয়ো জোয়ান–আর একটু–আর একটু

প্রাণ যায় যায় কিন্তু ন্যাংচাদা হার মানবার পাত্তর নয়। একে বাগবাজারের ছেলে, তায় জনতার দৃশ্যে পার্ট করতে এসেছে। আধঘণ্টা ধ্বস্তাধ্বস্তি করে ঠিক উঠে গেল পাঁচিলের ওপর। বসে একটু দম নিতে যাচ্ছে, অমনি তলা থেকে কারা বললে, আয় রে আয়–চলে আয় দাদা–আয় রে, আমার কুমড়োপটাশ

আর বলেই ন্যাংচাদার পা ধরে হ্যাঁচকা টান। ন্যাংচাদা একেবারে ধপাস করে নীচে পড়ল। কুমড়োপটাশের মতোই।

কোমরে বেজায় চোট লেগেছিল, বাপ-রে মা-রে বলতে বলতে ন্যাংচাদা উঠে দাঁড়াল। দেখলে পাঁচিলে-ঘেরা মস্ত জায়গাটা সামনে খানিক মাঠের মতো–একটু দূরে একটা বড় বাড়ি, পাশেই একটা ছোট ডোবা–তাতে জল নেই, খানিক কাদা। আর তার সামনে পাঁচ-সাতজন লোক দাঁড়িয়ে নানারকম মুখভঙ্গি করছে।

একজন একটা হুঁকো টানছে–তাতে কলকে টলকে কিচ্ছুটি নেই। আর একজনের ছেঁড়া সাহেবি পোশাক কিন্তু টুপির বদলে মাথায় একটা ভাঙা বালতি বসানো। একজনের গলায় ছেঁড়া জুতোর মালা। আর একজন মুখে লম্বা-লম্বা গোঁফ-দাড়ি সমানে চেঁচিয়ে বলছে : কুকুর আসিয়া এমন কামড় দিল পথিকের পায়। বলেই সে এমন ভাবে ঘ্যাঁক করে দৌড়ে এল যে, ন্যাংচাদাকে কামড়ে দেয় আর কি।

সেই সাহেবি পোশাক পরা লোকটা ধাঁ করে রদ্দা মেরে কুকুর আসিয়া এমন কামড়কে দূরে সরিয়ে দিলে। তারপর বললে–বন্ধুগণ, আমাদের নতুন অভিনেতা এসে গেছেন। বেশ চেহারাটি।

সকলে চেঁচিয়ে বললে, হিরো আলবাত হিরো।

ন্যাংচাদা প্রথমে ঘাবড়ে গিয়েছিল। কিন্তু হিরো শুনেই চাঙ্গা হয়ে উঠল। বুঝল, সিনেমায় তো নানারকম পার্ট করতে হয়–তাই ওরা সব ওইরকম সেজেছে, যাকে বলে মেক আপ। তারপর তাকেই হিরো করতে চায়! ন্যাংচাদা নাক আর কোমরের ব্যথা ভুলে একেবারে আকৰ্ণবিস্তৃত হাসি হাসল। বললে, তা আজ্ঞে, হিরোর পার্টও আমি করতে পারব–পাড়ার থিয়েটারে দুবার আমি হনুমান সেজেছিলুম। কিন্তু চন্দ্রবদনবাবু কোথায়?

সেই জুতোর মালা-পরা লোকটা বললে, চন্দ্রবদন শ্বশুরবাড়ি গেছে–জামাইষষ্ঠীর নেমন্তন্ন খেতে। আমি হচ্ছি সুর্যবদন ডিরেকটার।

বালতি মাথায় লোকটা তাকে ধাঁই করে এক চাঁটি দিলে : ইউ ব্লাডি নিগার! তুই ডিরেকটার কীরে? তুই তো একটা হুঁকোবরদার। আমি হচ্ছি ডিরেকটার–আমার নাম হচ্ছে তারাবদন।

সূর্যবদন চাঁটি খেয়ে বিড়বিড় করতে লাগল। আর যে-লোকটা কামড়াতে এসেছিল, সে সমানে বলতে লাগল :

সকালে উঠিয়া আমি মনে-মনে বলি
আজি কি সুন্দর নিশি পূর্ণিমা উদয়
একা ননী পাড়ে ছানা আমগাছে চড়ে
মহৎ যে হয় তার সাধু ব্যবহার

তারাবদন ধমকে দিয়ে বললে, চুপ! এখন রিহার্সেল হবে। তারপর হিরোবাবু-তোমার নাম কী?

ন্যাংচাদা বললে, আমার ভালো নাম বিষ্ণুচরণ–ডাকনাম ন্যাংচা।

-ন্যাংচা! আহা–খাসা নাম! শুনলেই খিদে পায়। তারপর ফিসফিসিয়ে বললে, জানো-আমার ডাক নাম চমচম!

ন্যাংচাদা বলতে যাচ্ছে, তাই নাকি হঠাৎ চমচম চেঁচিয়ে উঠল : কোয়ায়েট! সব চুপ। রিহার্সেল হবে। মিস্টার ন্যাংচা—

ন্যাংচাদা বললে, আজ্ঞে?

–এক পা তুলে দাঁড়াও।

ন্যাংচাদা তাই করলে।

এবার দুপা তুলে দাঁড়াও।

ন্যাংচাদা ঘাবড়ে গিয়ে বললে, আজ্ঞে, দুপা তুলে কি

বলতেই তারাবদন চটাস করে একটা চাঁটি বসিয়ে দিলে ন্যাংচাদার গালে। বললে, রে বর্বর, স্তব্ধ করো মুখর ভাষণ! যা বলছি, তাই করো। ফিলিমে পার্ট করতে এসেছ দুপা তুলে দাঁড়াতে পারবে না! এয়ার্কি নাকি?

চাঁটি খেয়ে ন্যাংচাদার তো মাথা ঘুরে গেছে। কাঁউমাউ করে দুপা তুলে দাঁড়াতে গেল। আর যেই দুপা তুলতে গেছে, ধপাস করে পড়ে গেল মাটিতে।

সবাই চেঁচিয়ে উঠল : শেমশেম, পড়ে গেলি! ফাই–ফাই! :

ন্যাংচাদা ভীষণ অপ্রস্তুত হয়ে গেল। ফিলিমে নামতে গেলে নিশ্চয় দুপা তুলে দাঁড়াতে হয় কিন্তু কী করে যে সেটা পারা যায় কিছুতেই ভেবে পেল না।

তারাবদন ন্যাংচাদার জুলপি ধরে এমন হ্যাঁচকা মারল যে, তড়বড়িয়ে লাফিয়ে উঠতে হল বেচারিকে। তারপর তারাবদন বললে, এবার গান করো।

কী গান গাইব?

–যে গান খুশি। বেশ উপদেশপূর্ণ গান।

ন্যাংচাদা এক্কেবারে গাইতে পারে না..বুঝলি? মানে আমাদের প্যালার চাইতেও যাচ্ছেতাই গান গায়–একবার রাস্তায় যেতে-যেতে এমন তান ছেড়েছিল যে, শুনে একটা কাবলীওলা আচমকা আঁতকে উঠে ড্রেনের মধ্যে পড়ে গিয়েছিল। কিন্তু হিরো হওয়ার আনন্দে সেই ন্যাংচাদাই ভীমসেনী গলায় গান ধরল :

ভুবন নামেতে ব্যাদড়া বালক
তার ছিল এক মাসি–
ভূবনের দোষ দেখে দেখিত না
সে মাসি সর্বনাশী

এইটুকু কেবল গেয়েছে…হঠাৎ সবাই চেঁচিয়ে উঠল : স্টপ

তারাবদন বললে, না…আর গান না। এবার নাচো

-নাচব?

নিশ্চয় নাচবে।

–আমি তো নাচতে জানিনে।

নাচতে জানো না…হিরো হতে এসেছ? মামাবাড়ির আবদার পেয়েছো…না? বলেই কড়াৎ করে ন্যাংচাদার জুলপিতে আর-এক টান।

গেলুম গেলুম..বলে ন্যাংচাদা নাচতে লাগল। মানে ঠিক নাচ নয়…লাফাতে লাগল ব্যথার চোটে।

সকলে বললে, এনকোর…এনকোর!

যেই এনকোর বলা…অমনি তারাবদন আর-একটা পেল্লায় টান দিয়েছে ন্যাংচাদার জুলপিতে। পিসিমা গো গেছি..বলে ন্যাংচাদা এবার এমন নাচতে লাগল যে, তার কাছে কোথায় লাগে তোদের উদয়শংকর।

তারাবদন বললে, রাইট। ও-কে! কাট।

কাট! কাকে কাটবে? ন্যাংচাদা ভয় পেয়ে থমকে গেছে। তারাবদন বললে, এবার তা হলে সন্তরণের দৃশ্য। কী বলো বন্ধুগণ?

সঙ্গে সঙ্গে সকলে চেঁচিয়ে বললে, ঠিক…এবারে সন্তরণের দৃশ্য।

ন্যাংচাদা আরে আরে…করছ কী… বলতে বলতে সবাই ওকে চ্যাংদোলা করে তুলে ফেলল। তারপর চক্ষের পলকে নিয়ে ছুঁড়ে ফেললে সেই ডোবাটার ভেতরে।

কাদা মেখে ভূত হয়ে উঠতে যাচ্ছে…সবাই আবার ঠেলে ডোবার মধ্যে ফেলে দিলে। বলতে লাগল : সন্তরণ…সন্তরণ!

আর সন্তরণ। ন্যাংচাদার তখন প্রাণ যাওয়ার জো। সারা গা…জামাকাপড় কাদায় একাকার…নাকে-মুখে দুর্গন্ধপচা পাঁক ঢুকে গেছে, আর বিছুটির মতো সে কী জ্বলুনি। ন্যাংচাদা যেমনি উঠতে চায় অমনি সবাই তক্ষুনি তাকে ডোবায় ফেলে দেয়। আর চাঁচাতে থাকে : সন্তরণ…সন্তরণ

শেষে ন্যাংচাদা আকাশ ফাটিয়ে হাহাকার করতে লাগল..মানে হাহাকার ফিলিমে পার্ট করতে এসেছিল কিনা : বাঁচাও…বাঁচাও…আমাকে মেরে ফেললে..আমি আর ফিলিমে পার্ট করব না…

প্রাণ যখন যাবার দাখিল তখন কোত্থেকে তিন-চারজন খাকী শার্ট-প্যান্ট পরা লোক লাঠি  হাতে দৌড়ে এল সেদিকে। আর তক্ষুনি তারাবদনের দল এক্কেবারে হাওয়া।

ন্যাংচাদার তখন প্রায় নাভিশ্বাস। খাকীপরা লোকগুলো তাকে পাঁক থেকে টেনে তুলে কিছুক্ষণ হাঁ করে মুখের দিকে চেয়ে রইল। শেষে বললে, ক্যা তাজ্জব! ই নৌতুন পাগলা ফির কাঁহাসে আসলো?

ব্যাপার বুঝলি? আরে…ওটা মোটেই ফিলিম স্টুডিয়ো নয়…লাম..মানে লুনাটিক অ্যাসাইলাম…অর্থাৎ কিনা পাগলা গারদ। উঁচু পাঁচিল আর লাম দেখেই ন্যাংচাদা ঘাবড়ে গিয়েছিল।

সেই থেকে ন্যাংচাদা নেংচে-নেংচে হাঁটে…আর সিনেমা হল দেখলেই চোখ বুজে করুণ গলায় গাইতে থাকে : দীনবন্ধু, কৃপাসিন্ধু..।

টেনিদা থামল। আমার ঝালমুনের শিশি ততক্ষণে সাফ। হাত চাটতে-চাটতে বললে, তাই বলছিলুম, তোর গোবরবাবুকে বারণ করে দে। আরে–আসলে ফিলিম স্টুডিয়োগুলোও এমনি পাগলা গারদ…গোবরবাবুকে স্রেফ ঘুঁটেচন্দর বানিয়ে ছেড়ে দেবে!

 পরের উপকার করিও না

আমি প্যালারাম, ক্যাবলা আর হাবুল সেন—তিনজনে নেহাত গো-বেচারার মতো কাঁচুমাচু মুখ করে বসে আছি। তাকিয়ে আছি কাঠগড়ার আসামীর দিকে। তার মুখ আমাদের চেয়েও করুণ। ছ ফুট লম্বা অমন জোয়ানটা ভয়ে কেম্নের মতো কুঁকড়ে গেছে। গণ্ডারের খাঁড়ার মতো খাড়া নাকটাও যেন চেপসে গেছে একটা থ্যাবড়া ব্যাংয়ের মতো। সাধুভাষায় যাকে বলে, দস্তুরমতো পরিস্থিতি।

কে আসামী?

আর কে হতে পারে? আমাদের পটলডাঙার সেই স্বনামধন্য টেনিদা। গড়ের মাঠের গোরা ঠ্যাঙানোর সেই প্রচণ্ড প্রতাপ এখন একটা চায়ের কাপের মতো ভ্যাবাচ্যাকা হয়ে গেছে। চায়ের কাপ না বলে চিরতার গেলাসও বলতে পারা যায় বোধহয়।

-হুজুর ধর্মাবতার—

ফরিয়াদি পক্ষের উকিল লাফিয়ে উঠলেন। মনে হল যেন হাত দশেক ছিটকে উঠল একটা কুড়ি-নম্বরী ফুটবল। গলার আওয়াজ তো নয়—যেন আট-দশটা চীনে-পটকা ফাটল একসঙ্গে। ধর্মাবতার চেয়ারের ওপর আঁতকে উঠে পড়তে পড়তে সামলে গেলেন।

—অমন বাজখাঁই গলায় চেঁচাবেন না মশাই, পিলে চমকে যায়। জজ সাহেব ভূ কোঁচাকালেন : কী বলতে হয় ঝটপট বলে ফেলুন।

উকিল একটা ঘুষি বাগিয়ে তাকালেন টেনিদার দিকে। একরাশ কালো কালো আলপিনের মতো গোঁফগুলো তাঁর খাড়া হয়ে উঠল।

–ধর্মাবতার, আসামী ভজহরি মুখুজ্জে (আমাদের টেনিদা) কী অন্যায় করেছে, তা আপনি শুনেছেন। অবোলা জীবের ওপর ভীষণ অত্যাচার সে করেছে, তার নিন্দের ভাষা নেই। একটা ছাগল পরশু থেকে কাঁচা ঘাস পর্যন্ত হজম করতে পারছে না। আর-একটা সমানে বমি করছে। আর-একটা তিন দিন ধরে যা পাচ্ছে তাই খাচ্ছে ফরিয়াদির একটা ট্যাঁক-ঘড়ি সুষ্ঠু চিবিয়ে ফেলেছে!

রোগা সিঁটকে একটা লোক, হলধর পালুইসে-ই ফরিয়াদি। হলধর ফোঁসফোঁস করে কাঁদতে লাগল।

–খুব ভালো ঘড়ি ছিল হুজুরকী শক্ত! আমার ছেলে ওইটে ছুঁড়ে ছুঁড়ে আম পাড়ত। চলত না বটে, তবু ঘড়ির মতো ঘড়ি ছিল একটা বলে, হলধর এবার ভেউ-ভেউ করে কেঁদে ফেলল। কান্নার বেগ একটু কমলে বললে, ঘড়ি না-হয় যাক হুজুর, কিন্তু আমার অমন তিনটে ছাগল! বুঝি পাগল হয়ে গেল হুজুর—একেবারে উদ্দাম পাগল।

জজ কানে একটা দেশলাইয়ের কাঠি দিয়ে চুলকোতে চুলকোতে বিরক্ত মুখে বললেন, আঃ জ্বালাতন! আরে বাপু, তুমি তো দেখছি একটা ছাগল! ছাগল কখনও পাগল হয়? সে যাক, অপরাধের গুরুত্ব চিন্তা করে আমি আসামী ভজহরি মুখুজ্যেকে তিন টাকা জরিমানা করলাম। এই তিন টাকা ফরিয়াদি হলধর পালুইকে দেওয়া হবে তার ছাগলদের রসগোল্লা খাওয়াবার জন্যে।

জজ উঠে পড়লেন।

টেনিদা আমাদের দিকে করুণ দৃষ্টিতে তাকাচ্ছে। ভাবটা এই; এ-যাত্ৰা তরিয়ে দে! আমার ট্যাঁক তো গড়ের মাঠ।

আমি, ক্যাবলা আর হাবুল সেন—চার মূর্তির তিন মূর্তি–চাঁদা করে তিন টাকা জমা দিয়ে টেনিদাকে খালাস করে আনলাম।

নিঃশব্দে চারজনে পথ দিয়ে চলেছি। কে যে কী বলব ভেবে পাচ্ছি না।

খানিক পরে আমি বললাম, খুব ফাঁড়া কেটে গেছে।

ক্যাবলা বললে, হ্যাঁ-জেল হয়ে যেতে পারত।

হাবুল ঢাকাই ভাষায় বললে, হ, দ্বীপান্তরও হইতে পারত। একটা ছাগলা যদি মইর্যা যাইতগা, তাইলে ফাঁসি হওনই বা আশ্চর্য আছিল কী।

এতক্ষণ পরে টেনিদা গাঁকগাঁক করে উঠল : চুপ কর, মেলা বাজে বকিসনি। ইঃ, ফাঁসি। ফাঁসি হওয়া মুখের কথা কিনা।

আবার নিস্তব্ধতা। টেনিদার পেছু-পেছু আমরা গড়ের মাঠের দিকে এগিয়ে চললাম। খানিক পরে আমিই আবার জিজ্ঞাসা করলাম, চানাচুর খাবে টেনিদা?

–নাঃ—টেনিদার মুখে-মুখে একটা গভীর বৈরাগ্য।

—আইসক্রিম কিনুম?—হাবুল সেনের প্রশ্ন।

–কিচ্ছু না।—টেনিদা একটা বুকফাটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল : মন খিঁচড়ে গেছে বুঝলি প্যালা। সংসারে কারও উপকার করতে নেই।

আমি বললাম, নিশ্চয় না!

—উপকারীকে বাঘে খায়।–ক্যাবলা বললে।

আমার মনের কথাটা বলে দিয়েছিস বলে টেনিদা ক্যাবলার পিঠ চাপড়ে দিলে ক্যাবলা উঃ উঃ করে উঠল।

হাবুল বললে, বিনা উপকারেই যখন পৃথিবী চলতে আছে, তখন উপকার করতে গিয়ে খামকা ঝামেলা বাড়াইয়া হইব কী?

—যা কইছস!–মনের আবেগে টেনিদা এবার হাবুলের ভাষাতেই হাবুলকে সমর্থন জানাল। তারপর গর্জন করে বললে, আমি আর-একখানা নতুন বর্ণ-পরিচয় লিখব। তার প্রথম পাঠ থাকবে : কখনও পরের উপকার করিও না।

ক্যাবলা বললে, সাধু, সাধু।

টেনিদা দাঁত খিঁচিয়ে বললে, সাধু! খবরদার–সাধু-ফাধুর নাম আমার কাছে আর করবিনে। যদি ব্যাটাকে পাই বলে, প্রচণ্ড একটা ঘুষি হাঁকাল আকাশের দিকে।

ব্যাপারটা তা হলে খুলেই বলি গোড়া থেকে।

মানুষের অনেক রকম রোগ হয় : কালাজ্বর, পালাজ্বর, নিমোনিয়া, কলেরা, পেটফাঁপা—এমনকি ঝিনঝিনিয়া পর্যন্ত। সব রোগের ওষুধ আছে, কিন্তু একটি রোগের নেই। সে হল পরোপকার। যখন চাগায় তখন অন্য লোকের প্রাণান্ত করে ছাড়ে।

টেনিদাকে একদিন এই রোগে ধরল। ছিল বেশ, পরের মাথায় হাত বুলিয়ে খাচ্ছিল-দাচ্ছিল, বাঁশি বাজাচ্ছিল। হঠাৎ কী যে হল কালীঘাটের এক সাধুর সঙ্গে তার দেখা হয়ে গেল।

হাতে চিমটে, মাথায় জটা, লেংটি পরা এক বিরাটকায় সাধু। খানিকক্ষণ কটমট করে টেনিদার দিকে তাকিয়ে হেঁড়ে গলায় বললে, দে পাঁচসিকে পয়সা।

পাঁচসিকে পয়সা! টেনিদা বলতে যাচ্ছিল, ইয়ার্কি নাকি! কিন্তু সাধুর বিশাল চেহারা, বিরাট চিমটে আর জবাফুলের মতো চোখ দেখে ভেবড়ে গেল। তো-তো করে বললে, পাঁচসিকে তো নেই বাবা, আনাসাতেক হবে!

—আনা-সাতেক? আচ্ছা তাই দে, আর একটা বিড়ি।

–বিড়ি তো আমরা খাইনে বাবাঠাকুর।

—হুঁ, গুডবয় দেখছি। তা বেশ। বিড়ি-ফিড়ি কক্ষনো খাসনি—ওতে যক্ষ্মা হয়। যাক—পয়সাই দে।

পয়সা হাতে পেয়ে সাধুর হাঁড়ির মতো মুখখানা খুশিতে ভরে উঠল। ঝুলি থেকে একটা জবা ফুল বের করে টেনিদার মাথায় দিয়ে বললে, তুই এখানে কেন রে?

–আজ্ঞে প্যাঁড়া খেতে এসেছিলাম।

সাধু বললে, তা বলছি না। তুই যে মহাপুরুষ রে। তোকে দেখে মনে হচ্ছে, পরোপকার করে তুই দেশজোড়া নাম করবি।

—পরোপকার।—টেনিদা একটা ঢোক গিলে বললে, দুনিয়ায় অনেক সকাজ করেছি। বাবা। মারামারি, পরের মাথায় হাত বুলিয়ে ভীমনাগের সন্দেশ খাওয়া, ইস্কুলের সেকেন্ড পণ্ডিতের টিকি কেটে নেওয়া কিন্তু কখনও তো পরোপকার করিনি!

–করিসনি মানে?—সাধু হেঁড়ে গলায় বললে, তুই ছোকরা তো বড্ড এঁড়ে তক্কো করিস। এই আমাকে নগদ সাত আনা পয়সা দিলি, খেয়াল নেই বুঝি? আমার কথা শোন। সংসার-টংসার ছেড়ে স্রেফ হাওয়া হয়ে যা। দুনিয়ায় মানুষের অশেষ দুঃখু—সেই দুঃখু দূর করতে আদা-নুন খেয়ে লেগে পড়। আর্তের সেবা কর—দেখবি তিন দিনেই তোর নামে টি-টি পড়ে যাবে। দে-দে একটা বিড়ি দে—

–বললাম যে বাবাঠাকুর, আমি বিড়ি খাই না।

—ওহো, তাও তো বটে! বেশ, বেশ, বিড়ি কখনও খাসনি। আর শোন—পরের উপকারে নশ্বর জীবন বিলিয়ে দে। আজ থেকেই লেগে যা–বলে কান থেকে একটা আধপোড়া বিড়ি নামিয়ে, সেটা ধরিয়ে সাধু ভিড়ের মধ্যে অদৃশ্য হল।

টেনিদা খানিকক্ষণ ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে দাঁড়িয়ে রইল। তারপরেই কালীঘাটের মা কালীর মহিমাতেই কি না কে জানে সাধুর কথাগুলো তার মাথার মধ্যে পাক খেতে লাগল। পরোপকার? সত্যিই তো, তার মতো কি আর জিনিস আছে! জীবন আর কদিনের? সবই তো মায়া—স্রেফ ছলনা। সুতরাং যেকদিন বাঁচা যায়—লোকের ভালো করেই কাটিয়ে দেওয়া যাক।

সেই রাত্রেই সংসার ছাড়ল টেনিদা। মানে কলকাতা ছাড়ল।

গেল দেশে। কলকাতা থেকেই মাইল-দশেক দূরে ক্যানিং লাইনে বাড়ি। গাঁয়ের নাম। ধোপাখোলা। দেশের বাড়িতে দূর-সম্পর্কের এক বুড়ি জ্যাঠাইমা থাকেন। কানে খাটো। টেনিদাকে দেখে জিজ্ঞাসা করলেন, হ্যাঁ রে, এমন অসময়ে দেশে এলি যে?

—পরোপকার করব জেঠিমা!

—পুরী খেতে এসেছিস? পুরী এখানে কোথায় বাবা? পোড়া দেশে কি আর ময়দাফয়দা কিছু আছে? ইংরেজ রাজত্বে আর বেঁচে সুখ নেই।

–ইংরেজ রাজত্ব কোথায় জেঠিমা? এখন তো আমরা স্বাধীন, মানে-টেনিদা বাংলা করে বুঝিয়ে দিলে, ইন্ডিপেন্ডেন্ট।

–কোট-প্যান্ট?—জেঠিমা বললেন, ছি বাবা, আমি বিধবা মানুষ, কোট-প্যান্ট পরব কেন? থান পরি।

—দুত্তোর—এ যে মহা জ্বালা হল। আমি বলছিলাম, দেশে রোগবালাই কিছু আছে?

-মালাই। মালাই খাবি? দুধই পাওয়া যায় না। গো-মড়কে সব গোক উচ্ছন্ন হয়ে গেছে।

–উঃ কানে হাত দিয়ে টেনিদা বাড়ি থেকে বেরিয়ে পড়ল।

কিন্তু দিন-তিনেক গ্রামে ঘুরে টেনিদা বুঝতে পারল, সত্যিই পরোপকারের অখণ্ড সুযোগ আছে। গ্রাম জুড়ে দারুণ ম্যালেরিয়া। পেটভরা পিলে নিয়ে সারা গাঁয়ের লোক রাত-দিন বোঁ-বোঁ করছে। সেইদিনই কলকাতায় ফিরল টেনিদা। পাঁচ বোতল তেতো পাঁচন কিনে নিয়ে দেশে চলে গেল। কিন্তু দুনিয়াটা যে কী যাচ্ছেতাই জায়গা, সেটা টের পেতে তার দেরি হল না।

অসুখে ভুগে মরবে, তবু ওষুধ খাবে না।

একটা জামগাছের নীচে বসে ঝিমুচ্ছিল গজানন সাঁতরা। সন্দেহ কী—নির্ঘাত ম্যালেরিয়া। টেনিদা গজাননের দিকে এগিয়ে এল। তারপর গজানন ব্যাপারটা বুঝতে না বুঝতে এবং ট্য-ফোঁ করে উঠবার আগেই টেনিদা তার মুখে আধ বোতল জ্বরারি পাঁচন ঢেলে দিলে। যেমন বিচ্ছিরি, তেমনি তেতো! আসলে গজাননের জ্বর-ফর কিছু হয়নি—খেয়েছিল খানিকটা তাড়ি। যেমন পাঁচন মুখে পড়া—নেশা ছুটে গিয়ে তড়াক করে লাফিয়ে উঠল। তারপর সোজা মারমার শব্দে টেনিদাকে তাড়া করল।

কিন্তু ধরতে পারবে কেন? লম্বা লম্বা ঠ্যাং ফেলে টেনিদা ততক্ষণে পগার পার।

কী সাঙ্ঘাতিক লোক এই গজানন। পরোপকার বুঝল না, বুঝল না টেনিদার মধ্যে আজ মহাপুরুষ জেগে উঠেছে। তবু হাল ছাড়লে চলবে না। পরের ভালো করতে গেলে অমন কিছু-না-কিছু হয়ই। মনকে সান্ত্বনা দিয়ে টেনিদা স্বগতোক্তি করলে, এই দ্যাখো না বিদ্যাসাগর মশাই—

পরদিন বিকেলে সে গেল গ্রামের পাঁচুমামার বাড়িতে।

একটা ভাঙা ইজিচেয়ারে শুয়ে পাঁচুমামা উঃ-আঃ করছেন।

–কী হয়েছে মামা?–বগল থেকে পাঁচনের, বোতলটা বাগিয়ে দাঁড়াল টেনিদা।

—এই গেঁটে বাত বাবা! গাঁটে গাঁটে ব্যথা। করুণ স্বরে পাঁচুমামা জানাল।

–বাত? ওঃ—টেনিদা মুহূর্তের জন্যে কেমন দমে গেল। তারপরেই উৎসাহের চিহ্ন ফুটে উঠল তার চোখেমুখে।

–আর ম্যালেরিয়া? ম্যালেরিয়া কখনও হয়নি?

–হয়েছিল বইকি। গত বছর।

–হতেই হবে!—বিজ্ঞের মতো গম্ভীর গলায় টেনিদা বললে, ওই হল রোগের জড়। ওই ম্যালেরিয়া থেকেই সব। কিন্তু ভেব না তফাত সব ভালো করে দিচ্ছি।

—ভালো করে দিবি?—পাঁচুমামার মুখে-চোখে কৃতজ্ঞতা ফুটে বেরুল : তুই তা হলে ডাক্তার হয়ে এসেছিস? কই শুনিনি তো!

ডাক্তার কী বলছ মামাতার চেয়ে ঢের বড়। একেবারে মহাপুরুষ।

অগাধ বিস্ময়ে পাঁচুমামা হাঁ করলেন। টেনিদার দিকেই মুখ করে ছিলেন : কাজেই হাঁ করার সঙ্গে সঙ্গেই আর কথা নয়-জ্বরারি পাঁচন চলে গেল মামার গলার মধ্যে।

—ওয়াক-ওয়াক! ওরে বাবারে-ডাকাত রে—মেরে ফেললে রেওয়া-ওয়াক্‌-গেছি গেছি—পাঁচুমামা হাহাকার করে উঠলেন।

টেনিদা ততক্ষণে বাড়ির চৌহদ্দির বাইরে। শুনতে পেল, ভেতর থেকে মামা অশ্রাব্য ভাষায় তাকে গাল দিচ্ছেন। তা দিন-তাতে কিছু আসে যায় না। পরোপকার তো হয়েছে। এর দাম মামা বুঝবে যথাসময়ে। তৃপ্তির হাসি নিয়ে টেনিদা পথ চলল।

খানিক দূর আসতেই চোখে পড়ল একটা আমগাছতলায় একটি বছর-আটেকের ছেলে দাঁড়িয়ে প্রাণপণে চ্যাঁচাচ্ছে।

-এই, কী নাম তোর?

ছেলেটা ফোঁপাতে ফোঁপাতে বললে, সাচ্চু।

–লাড্ডু! তা অমন করে কাঁদছিস কেন? চোখের জলে যে হালুয়া হয়ে যাবি-আর লাড্ড থাকবি না। কী হয়েছে তোর?

–বড়দা চাঁটি মেরেছে।

—কেন, তোকে তবলা ভেবেছিল বুঝি?

–না। লাচ্ছু বললে, আমি কাঁচা আম খেতে চেয়েছিলাম।

—এই কার্তিক মাসে কাঁচা আম খেতে চেয়েছিস! শুধু চাঁটি নয়, গাঁট্টা খাওয়ার মতো শখ।

টেনিদা চলে যাচ্ছিল, কী মনে হতেই ফিরে দাঁড়াল হঠাৎ।

—তোর টক খেতে খুব ভালো লাগে বুঝি? লাড়ু মাথা নাড়ল।

—হুঁ—নির্ঘাত ম্যালেরিয়ার লক্ষ্মণ! তোর জ্বর হয়?

-হয় বইকি।

—তবে আর কথা নেই—টেনিদা বোতল বের করে বললে, হাঁ কর—

লা আশান্বিত হয়ে বললে, আচার বুঝি?

—আচার বলে আচার। দুরাচার, কদাচার, সদাচারসক্কলের সেরা এই আচার। হাঁ কর-হাঁ কর ঝটপট—

লাড়ু হাঁ করল।

তার পরের ঘটনা খুব সংক্ষিপ্ত। বাপরে মা-রে বড়দা-রে বলে লাড্ড চেঁচিয়ে উঠল।

টেনিদা দ্রুত পা চালাল।

–বাপ—

পিঠের উপর একটা ঢিল পড়তেই চমকে উঠল টেনিদা। লাড়ু ঢিল চালাচ্ছে। অতএব যঃ পলায়তি এবং প্রাণপণে। লাড়ু বাচ্চা হলেও ঢিলে বেশ জোর আসছে, হাতের তাকও তার ফসকায় না।

কিন্তু আর চলে না। গ্রামের লোক খেপে উঠেছে তার ওপর। বাড়ির ত্রিসীমানায় দেখলে হইহই করে ওঠে। রাস্তায় দেখলে তেড়ে আসে। তাকে দেখলে ছেলেপুলে পালাতে পথ পায় না।

জ্যাঠাইমা বললেন, তুই কী শুরু করেছিস বাবা? লোকে যে তোকে ঠ্যাঙাবার ফন্দি আঁটছে।

টেনিদা গম্ভীর হয়ে রইল। পরে বললে, পরের জন্যে আমি প্রাণ দেব জেঠিমা!

–কী বললি? ঘরের লোকের কান কেটে নিৰি? কী সর্বনাশ! ওগো, আমাদের টেনু কি পাগল হয়ে গেল গোমড়াকান্না জুড়লেন জ্যাঠাইমা।

উদাস ব্যথিত মনে পথে বেরিয়ে পড়ল টেনিদা। কী অকৃতজ্ঞ, নরাধম দেশ। এই দেশের উপকারের জন্যে সে মরিয়া হয়ে ঘুড়ে বেড়াচ্ছে, অথচ কেউ বুঝছে না তার কদর! ছিঃ ছিঃ। এইজন্যেই দেশ আজ পরাধীনথুড়ি স্বাধীন। কিন্তু কী করা যায়? কীভাবে মানুষগুলোর উপকার করা যায়?

টেনিদা শূন্য মনে একটা গাছতলায় এসে বসল। ভরা দুপুর। কার্তিক মাসের নরম রোদের সঙ্গে ঝিরঝিরে হাওয়া। আকুল হয়ে চিন্তা করতে করতে হঠাৎ চটকা ভেঙে গেল।

একটু দূরে একটা নিমগাছের নীচে একটা ছাগল ঝিমুচ্ছে। ঝিমুচ্ছে! ভারি খারাপ লক্ষণ। এখানকার জলে হাওয়ায় ম্যালেরিয়া। ছাগলকেও ধরেছে। ধরাই স্বাভাবিক। আহা—অবোলা জীব! উপকার করতে হয়, তো ওদেরই। কেউ কখনও ওদের দুঃখ বোঝে না। আহা!

তা ছাড়া সুবিধেও আছে। মানুষের মতো এরা অকৃতজ্ঞ নয়। উপকার করতে গেলে তেড়ে মারতেও আসবে না। ঠিক কথা—আজ থেকে সেই অসহায় প্রাণীগুলোর ভালো করাই তার ব্রত। ছিঃ ছিঃ! কেন এতদিন তার একথা মনে হয়নি।

পাঁচনের বোতল বাগিয়ে নিয়ে টেনিদা ছাগলের দিকে পা বাড়াল?

তারপর?

তারপরের গল্প তো আগেই বলে নিয়েছি।

পেশোয়ার কী আমীর

চাটুজ্যেদের রকে বসে আমি একটা পাকা আমকে কায়দা করতে চেষ্টা করছিলাম। কিন্তু বেশিক্ষণ খেতে হল না। গোটা-চারেক কামড় দিয়েই ফেলে দিতে হল—অ্যায়সা টক। দাঁতগুলো শিরশির করতে লাগল—মেজাজটা বেজায় খিঁচড়ে গেল আমার। বাড়িতে মাংস এসেছে দেখেছি-রাত্তিরে জুত করে হাড় চিবুতে পারব কি না কে জানে!

এই সময় কোত্থেকে পটলডাঙার টেনিদা এসে হাজির। গাঁক গাঁক করে বললে, এই প্যালা, আমটা ফেলে দিলি যে?

–যাচ্ছেতাই টক। খাওয়া যায় নাকি?

—টক? টেনিদা ধুপ করে আমার পাশে বসে পড়ে বললে, টক বলে বুঝি গেরাহ্যি হল না? সংসারে টক যদি না থাকত, তাহলে আচার পেতিস কোথায়? টক যদি না থাকত তাহলে কী করে দই জমত? টক যদি না থাকত তাহলে চালকুমড়োর সঙ্গে কামরাঙার তফাত

কী থাকত? টক যদি না থাকত তাহলে পিঁপড়েরা কী করে টক-টক হত? টক না থাকলে

টক না থাকলে পৃথিবীতে আরও অনেক অঘটন ঘটত–কিন্তু সে-সবের লম্বা লিস্টি শোনবার মতো উৎসাহ আমার ছিল না। আমি বাধা দিয়ে বললুম, তাই বলে অত টক আম কোনও ভদ্দরলোকে খেতে পারে নাকি?

আমের গন্ধে কোত্থেকে একটা মস্ত নীল রঙের কাঁঠালে-মাছি এসেছে, সেটা শেষতক টেনিদার খাঁড়ার মতো মস্ত নাকটার ওপর বসবার চেষ্টা করছিল। আমার কথা শুনে টেনিদার সেই পেল্লায় নাকের ভেতর থেকে রণ-ডরুর মতো একটা বিদঘুটে আওয়াজ বেরুল। মাছিটা শূন্যে বার-দুই ঘুরপাক খেয়ে বোঁ করে মাটিতে পড়ে গেল ভিরমি খেল না হার্টফেলই করল কে জানে?

টেনিদা বললে, ইস-স্‌-স্‌। খুব যে ভদ্দরলোক হয়ে গেছিস দেখছি। তবু যদি পালাজ্বরে ভুগে দু-বেলা পটোল দিয়ে শিঙিমাছের ঝোল না খেতিস! তুই কি আমার গাবলু মামার চাইতেও ভদ্দরলোক? জানিস, গাবলু মামা এখন চারশো টাকা মাইনে পায়?

আমি ব্যাজার হয়ে বললুম, জেনে আমার লাভ কী? তোমার গাবলু মামা তো আমায় টাকা ধার দিতে যাচ্ছে না?

—তোর মত অখাদ্যিকে টাকা ধার দিতে বয়ে গেছে গাবলু মামার? টেনিদার নাক দিয়ে আবার একটা আওয়াজ বেরুল : জানিস—তিনবার আই-এ ফেল করা গাবলু মামা অত বড় চাকরিটা পেল কী করে? স্রেফ টক আমের জন্যে।

—টক আমের জন্যে? আমি হাঁ করে রইলুম : টক আম খেলে বুঝি ওই রকম চাকরি হয়?

—খেলে নয় রে গাধা-খাওয়ালে। তবে, তাক বুঝে খাওয়াতে জানা চাই। বলছি তোকে ব্যাপারটা অনেক জ্ঞান লাভ করতে পারবি। তার আগে গলির মোড় থেকে দুআনার ডালমুট নিয়ে আয়।

জ্ঞানলাভ করতে চাই আর না চাই, টেনিদা যখন ডালমুট খেতে চেয়েছে—তখন খাবেই। পকেটে পয়সা থাকলে ও ঠিক টের পায়। কী করি, আনতেই হল ডালমুট।

—তুই পেটরোগা, এ সব তোর খেতে নেই বলে এ্যাচকা টানে টেনিদা ঠোঙাটা কেড়ে নিলে। আমি ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে রইলুম। খেতে যখন দেবে না, তখন বেশ করে নজর দিয়ে দিই। পরে টের পাবে।

টেনিদা ভূক্ষেপ করলে না। বললে, তবে শোন। আমার মামার বাড়ি কোথায় জানিস তো? খঙ্গপুরে। সেই খঙ্গাপুর—যেখানে রেলের ইঞ্জিন-টিঞ্জিন আছে?

সেবার গরমের ছুটিতে মামাবাড়ি বেড়াতে গেছি। ওই যে একটা ছড়া আছে না–মামাবাড়ি ভারি মজা—কিল চড় নাই? কথাটা একদম বোগাস-বুঝলি? কক্ষনো বিশ্বাস করিসনি।

অবিশ্যি মামাবাড়িতে ভালো লোক একেবারে নেই তা নয়। দিদিমা, দাদু এরা বেশ খাসা লোক। বড় মামিরাও মন্দ নয়। কিন্তু ওই গাবলু মামা-টামা–বুঝলি, ওরা ভীষণ ডেঞ্জারাস হয়।

বললে বিশ্বাস করবিনে, সাতদিনের মধ্যে গাবলু মামা দুবার আমার কান টেনে দিলে। এমন কিছু করিনি, কেবল একদিন ওর ঘড়িটায় একটু চাবি দিয়েছিলুম—তাতে নাকি স্পিংটা কেটে গিয়েছিল। আর একদিন ওর শাদা নাগরাটা কালো কালি দিয়ে একটু পালিশ করেছিলুম, আর নেটের মশারিতে কাঁচি দিয়ে একটা গ্র্যাণ্ড জানলা বানিয়ে দিয়েছিলুম। এর জন্যে দুদিন আমার কান ধরে পাক দিয়ে দিলে। কী ভীষণ ছোটলোক বল দিকি।

তা করে করুক—গাবলু মামা-খড়গপুরে দিনগুলো আমার ভালোই কাটছিল। দিব্যি খাওয়া-দাওয়া—মজাসে ইস্টিশানে রেল দেখে বেড়ানো, হাঁটতে হাঁটতে একেবারে কাঁসাইয়ের পুল পর্যন্ত চলে যাওয়া, সেখানে বেশ চড়ইভাতি—আরও কত কী। বেশ ছিলুম।

বেশ মনের মতো বন্ধুও জুটে গিয়েছিল একটি। তার ডাকনাম ঘটা—ভালো নাম ঘটকৰ্পর। ওর ছোট ভাইয়ের নাম ক্ষপণক, ওর দাদার নাম বরাহ। ওদের বাবা গোবর্ধনবাবুর ইচ্ছে ছিল,—ওদের ন-ভাইকে নিয়ে নবরত্ন সভা বসাবেন বাড়িতে।

কিন্তু ক্ষপণকের পর আর ভাই জন্মাল না—খালি বোন আর বোন। রেগে গিয়ে গোবর্ধনবাবু তাদের নাম দিতে লাগলেন, জ্বালামুখী, মুণ্ডমালিনী এইসব। এমনকি খনা নাম পর্যন্ত রাখলেন না কারওর।

তা এই তিন রত্নেই যথেষ্ট—একেবারে তিন তিরিখে নয়! এক-একটা বিচ্ছু অবতার। আর ঘটা তো একেবারে সাক্ষাৎ শয়তানির ঘট!

আগে কি আর বুঝতে পেরেছিলুম? তা হলে ঘটার ত্রিসীমানায় কে যায়। ওর ঠাকুরমার ভাঁড়ার থেকে আচার-টাচার চুরি করে এনে আমায় খাওয়াত—আমি ভাবতুম অমন ভালো ছেলে বুঝি দুনিয়ায় আর হয় না!

কিন্তু শেষকালে এই ঘটাই আমাকে এমন একখানা লেঙ্গি মেরে দিলে যে কী বলব।

একদিন দুপুরবেলা গাবলু মামা বেশ প্রেসে নাক ডাকিয়ে ঘুমুচ্ছে, আর আমি দরজার ফাঁক দিয়ে উঁকিঝুঁকি মারছি। একটা ছিপ চাঁছব—গাবলু মামার দাড়ি কামানোর চকচকে ক্ষুরটা হাত-সাফাই করতে পারলে ভীষণ সুবিধে হয়।

এমন সময় ফিসফিস করে ঘটা আমার কানে কানে বললে, এই টেনি, আম খাবি?

কেন খাব না—খেতে আর ভয় কী! আর আমায় জানিস তো প্যালা-খাওয়ার ব্যাপারে কাপুরুষতা আমার একদম বরদাস্ত হয় না। সঙ্গে সঙ্গে দুহাত তুলে লাফিয়ে উঠে আমি বললুম, কোথায় রে?

—আমাদের বাগানে।

আমি বললুম, ওরে বাবা!

বলবার কারণ ছিল। গোবর্ধনবাবুর খুব ভালো একটা আমের বাগান আছে বাছাই বাছাই কলমের আম। ল্যাংড়া, বোম্বাই, মিছরিভোগ—আরও কত কী! দেড় মাইল দূর থেকেও আমের গন্ধে জিভে জল আসে। কিন্তু কাছে যায় সাধ্যি কার। যমদূতের মতো একটা অ্যায়সা জোয়ান মালী রাতদিন খাড়া পাহারা দিচ্ছে সেখানে। একটু উঁকিঝুঁকি দিয়েছ কি সঙ্গে সঙ্গে বাজখাঁই গলায় হাঁক পাড়বে, ইখানে হৈচ্ছে কী? ওসব চলিবেনি! না পালাইছ তো পিট্টি খাইছ?

ঘটা বললে, কিছু ঘাবড়াসনি-বুঝলি? আজ জামাইষষ্ঠী কিনা—মালী এ-বেলা শ্বশুরবাড়ি গেছে। ভালোমন্দ খেয়ে-দেয়ে সন্ধের পরে ফিরবে। আজকেই সুযোগ।

অমন জাঁদরেল মালীরও শ্বশুরবাড়ি থাকে—আমার বিশ্বাসই হল না। ঘটা বললে, সত্যি বলছি টেনি। চল না বাগানে—গেলেই বুঝতে পারবি!

গেলুম বাগানে। বেগতিক দেখলেই রামদৌড় লাগাব। লম্বা লম্বা ঠ্যাং দুটো তো আছেই!

গিয়ে দেখি, সত্যিই তাই। মালীর ঘরে মস্ত একটা তালা ঝুলছে। আর বাগানে?

গাছ ভর্তি আম আর আম! তাদের কী রঙ, আর ক্যায়সা খোশবু! মনে হল যেন স্বর্গের নন্দনবনে এসে ঢুকেছি আর চারদিকে অমৃত ফল ঝুলছে। কিন্তু হলে কী হবে! প্রায় সবগুলো গাছই বিচ্ছিরি রকমের জাল দিয়ে ঘেরাও করা। ঢিল মারলে পড়বে না—আঁকশিতে নামবে না।

শুধু একদিকে বেঁটে চেহারার একটা গাছে কোনও জালই নেই! আর কী আম হয়েছে সে-গাছে! মাটির হাতখানেক কাছাকাছি পর্যন্ত আম ঝুলে পড়েছে। পেকে টুকটুক করছে আমগুলো–লালে আর হলদেতে কী আশ্চর্য তাদের রঙ! দেখেই আনন্দে আমার মূছা যাবার জো হল।

ঘটা বললে, এ-আমের নাম হল পেশোয়ার কি আমীর। আমের সেরা। খেলে মনে হবে পেশোয়ারের আঙুর, ভীম নাগের সন্দেশ আর কাশীর চমচম একসঙ্গে খাচ্ছিস। লেগে য়া টেনি—

বলবার আগেই লেগে গেছি আমি। চক্ষের নিমেষে টেনে নামিয়েছি গোটা পনেরো পেশোয়ার কি আমীর। তারপর বেশ টুসটুসে একটা আমে যেই কামড় বসিয়েছি—

সঙ্গে সঙ্গে কী হল সে আমার মনে নেই প্যালা! আমি মাথা ঘুরে সেইখানেই বসে পড়লুম। ওরে বাকী টক! দশ মিনিট ধরে খালি মনে হতে লাগল, আমার দুপাটি দাঁতের ওপর কেউ দমাদম হাতুড়ি ঠুকছে আমার দু কানে তিরিশটা ঝিঝি পোকা কোরাস গাইছে, আমার নাকের ওপর তিন ডজন উচ্চিংড়ে লাফাচ্ছে, আমার মাথার ওপর সাতটা কাঠঠোকরা এক নাগাড়ে ঠুকে চলেছে।

যখন জ্ঞান হল—তখন দেখি দুডজন পেশোয়ার কি আমীর সামনে নিয়ে আমি বসে আছি ধুলোর ওপর। ঘটার চিহ্নমাত্র নেই। ঘটকৰ্পর কপূরের মতোই উবে গেছে।

কী শয়তান, কী বিশ্বাসঘাতক! একবার যদি ওকে সামনে পাই, তাহলে ওর নাক খিমচে দেব, কান কামড়ে দেব, পিঠে জলবিছুটি ঘষে দেব, ওর ছুটির টাস্কের সব অঙ্কগুলো এমন ভুল করে রেখে দেব যে ইস্কুলে গেলেই সপাসপ বেত। কিন্তু সে তো পরের কথা পরে। এখন কী করি!

আমের লোভেই কি না কে জানে, পাটকিলে রঙের মস্ত দাড়িওলা একটা রামছাগল গুটি গুটি পায়ে আমার দিকে এগোচ্ছে। আমার সমস্ত রাগ ছাগলটার ওপরে গিয়ে পড়ল। বটে—আম খাবে। দ্যাখো একবার পেশোয়ার কি আমীরকে পরখ করে!

ছাগলে সব খায়—জানিস তো প্যালা? ছাতা খায়, খাতা খায়, হকিস্টিক খায়, জুতো খায়জুতোবুরুশওয়ালাকেও যে বাগে পেলে খায় না একথা জোর করে বলা যায় না। আমার সেই কামড়ে-দেওয়া আমাকেই দিলুম ছুড়ে ওর দিকে।

মাটিতেও পড়তে পেল না ক্রিকেটের বলের মতোই আকাশে লাফিয়ে উঠে ছাগলটা আমটাকে লুফে নিলে! তারপর?

–ব্য-আ-আ-করে গগনভেদী আওয়াজ হল একটা। একটা নয়—যেন সমস্ত ছাগলজাতি একসঙ্গে আর্তনাদ করে উঠল। তারপরেই টেনে একখানা দৌড় মারল। সে কী দৌড় রে প্যালা! চক্ষের পলকে বাগান পেরুল, মাঠ পেরুল, লাফ মারতে মারতে খানা-খন্দল পেরুল। বোধহয় মেদিনীপুরে গিয়েই শেষতক সেটা থামল।

আমি জ্বলন্ত চোখে আমগুলোর দিকে তাকিয়ে রইলুম। ঘটাকে একটা খাওয়াতে পারলে বুকের জ্বালা নিবত। কিন্তু সেটাকে আর পাই কোথায়? তিন দিনের মধ্যেও টিকির ডগাটি পর্যন্ত দেখতে পাব না এটা নিশ্চিন্ত।

তা হলে কাকে খাওয়াই?

নির্ঘাত গাবলু মামাকে। দুদিন আমার কান দুটো বেহালার কানের মতো আচ্ছা করে মুচড়ে দিয়েছে। এ আম গাবলু মামারই খাওয়া দরকার। গোটা আষ্টেক আম কোঁচড়ে লুকিয়ে ফিরে এলুম।

ভগবান ভরসা থাকলে সবই সম্ভব হয় প্যালা বুঝলি? বাড়ি ফিরে দেখি ভীষণ হইচই। গাবলু মামা কোন্ সাহেবের সঙ্গে দেখা করতে যাচ্ছে চাকরির চেষ্টায়। দইয়ের ফোঁটা-টোটা পরানো হচ্ছে—দিদিমা–বড়মামি-দাদু—সবাই একসঙ্গে দুর্গা দুর্গা কালী কালী এই সব আওড়াচ্ছেন।

গাবলু মামার ঘরে উঁকি দিয়ে দেখি—কেউ নেই। শুধু টেবিলের ওপর রঙচঙে একটা বেতের ঝুড়ি। তাতে বাছা বাছা সব বোম্বাই আম। ভগবান বুদ্ধি দিলেন রে পালা। কেউ দেখবার আগেই আমি ঘরে ঢুকে গোটাকয়েক বোম্বাই সরিয়ে ফেললুমতার ওপর সাজিয়ে দিলুম সাতটা পেশোয়ার কি আমীর—মানে, সাতটা অ্যাঁটম বম্।

তারপরে গোয়ালঘরে লুকিয়ে বসে সেই বোম্বাই আমগুলো সাবাড় করছি—দেখি না, সেই ঝুড়িটা নিয়ে গাবলু মামা গটগটিয়ে বেরিয়ে গেলেন। আর দাদু দোরগোড়ায় দাঁড়িয়ে সমানে কালী কালী বলতে লাগলেন।

এইবার আমার চটকা ভাঙল। অ্যাঁ—ওই আম সাহেবের কাছে ভেট যাচ্ছে। গাবলু মামার অবস্থা কী হবে ভেবে আমারই তো গায়ের রক্ত জমে গেল। চাকরি তো দুরে থাকহাড়গোড় নিয়ে গাবলু মামা ফিরতে পারলে হয়। বেশ খানিকটা অনুতাপই হল এবার। ইস—এ যে লঘু পাপে গুরুদণ্ড হয়ে গেল রে।

বললে– বিশ্বাস করবিনি প্যালা—ওই আমের জোরেই শেষতক গাবলু মামার চাকরি হয়ে গেল। কী করে? সেইটেই আদত গল্প।

যে সাহেবটার সঙ্গে মামা দেখা করতে গেল, তার নাম ডার্কডেভিল। যতটা না বুড়ো হয়েছে তার চাইতে বেশি ধরেছে বাতে। প্রায় নড়তে-চড়তে পারে না, একটা চেয়ারে বসে রাত-দিন কোঁ কোঁ করছে। তার হাতেই গাবলু মামার চাকরি।

আমের ঝুড়ি নিয়ে গিয়ে গাবলু মামা সায়েবকে সেলাম দিলে। তারপর নাক-টাক কুঁচকে, মুখটাকে হালুয়ার মতো করে বললে, মাই গার্ডেনস্ ম্যাংগো স্যার। ভেরি গুড স্যার-ফর ইয়োর ইটিং স্যার

একদম চালিয়াতি-বুঝলি প্যালা। আমার মামার বাড়ির ধারে কাছেও আমের গাছ। নেই। তবু ওসব বলতে হয়—গাবলু মামাও চালিয়ে দিলে।

সায়েবটা বেজায় লোভী, তায় রাত-দিন রোগে ভুগে লোভ আরও বেড়ে গিয়েছিল। আমের ঝুড়ি দেখেই সায়েবের নোলা লকলকিয়ে উঠল। তার ওপরে আবার সেই পেশোয়র কি আমীর-তার যেমন গড়ন, তেমনি রঙ! তক্ষুনি সে ছুরি বের করলে টেবিলের টানা থেকে।

–কাম বাবু, হ্যাভ সাম (একটুখানি খাও)–বলেই এক টুকরা সে গাবলু মামার দিকে এগিয়ে দিলে।

—নো স্যার—আই ইট মেনি স্যার,—এইসব বলে গাবলু মামা হাত-টাত কচলাতে লাগল। কিন্তু সায়েবের গোঁজানিস তো? ধরেছে যখন-খাইয়ে ছাড়বেই।

অগত্যা গাবলু মামাকে নিতেই হল টুকরোটা। আর মুখে দিয়েই–

–দাদা গো! গেলুম–বলে গাবলু মামা চেয়ারসুদ্ধ উলটে পড়ে গেল। কষে একটা দাঁত নড়ছিল, সেটাও খসে গেল সঙ্গে সঙ্গেই।

আর সায়েব?

আমে কামড় দিয়েই বিটকেল আওয়াজ ছাড়লে : ও গশ্‌—ঘোঁয়াক। তারপরেই তোক করে এক লাফে টেবিলে উঠে পড়ল, দাঁড়িয়ে উঠে বললে, মাই গড—ঘ্যাচাৎ!

এই বলে আর-এক লাফ। মাথার ওপর ফ্যান ঘুরছিল, সায়েব তার একটা ব্লেডকে চেপে ধরলে। তারপর ঘুরন্ত ফ্যানের সঙ্গে শূন্যে ঘুরতে লাগল বাঁই বাঁই করে।

সে কী যাচ্ছেতাই কাণ্ড—তোকে কী বলব প্যালা। ঘরের ভেতর নানারকম আওয়াজ শুনে সায়েবের আদাঁলি ছুটে এসেছিল। সে সায়েবকে ফ্যানের সঙ্গে বনবনিয়ে ঘুরতে দেখে বললে, রামরাম—এ কেইসা কাম! বলে সে কাকের মতো হাঁ করে রইল।

আর সেই সময়েই ঘুরন্ত আর উড়ন্ত সায়েবের হাত থেকে পেশোয়ার কি আমীর টুপ করে খসে পড়ল। আর পড়বি তো পড় একেবারে আদালির হাঁকরা মুখে।—এ দেশোয়ালী ভাই জান গইরে বলে আদালি পাঁই-পাঁই করে একেবারে ইস্টিশানের প্ল্যাটফর্মে এসে পড়ল। তখন মাদ্রাজ মেল ইস্টিশান ছেড়ে চলে যাচ্ছে—এক লাফে তাতেই উঠে পড়ল আদালি, তারপর পতন ও মূছ। ওয়ালটেয়ারে গিয়ে নাকি তার জ্ঞান হয়েছিল।

ততক্ষণে গাবলু মামার চটকা ভেঙেছে। মাথার ওপরে সায়েবের বুটের ঠোক্কর কাঁধে এসে লাগতেই গাবলু মামা টেনে ছুট। একদৌড়ে বাড়িতে এসে আছাড় খেয়ে পড়ল—তারপরেই একশো চার জ্বর, আর তার সঙ্গে ভুল বকুনি : ওই—ওই আম আসছে। আমায় ধরলে!

বাড়িতে তো কান্নাকাটি। আমার মনের অবস্থা তো বুঝতেই পারছিস! কিন্তু পরের দিন তাজ্জব কাণ্ড! সকালেই সায়েবের দু নম্বর চাপরাশি গাবলু মামার নামে এক চিঠি নিয়ে এসে হাজির।

ব্যাপার কী?

না–গাবলু মামার চাকরি হয়েছে। আড়াইশো টাকা মাইনের চাকরি।

কেমন করে হল? রে, কেন হবে না? সায়েব তো ফ্যানের ব্লেড থেকে ছিটকে পড়ল। পড়তেই দেখে—আশ্চর্য ঘটনা। সায়েবের দশ বছরের বাত-হাত-পা ভালো করে নাড়তে পারত না-পেশোয়ার কি আমীরের এক ধাক্কাতেই সে-বাত বাপ-বাপ করে পালিয়েছে। কাল সারা বিকেল সায়েব মাঠে ফুটবল খেলেছে, আনন্দে সকলকে ভেংচি কেটেছে, বাড়ি ফিরে তার পেল্লায় মোটা মেমসায়েবের সঙ্গে মারামারি করেছে পর্যন্ত।

আর গাবলু মামার জ্বর? তক্ষুনি রেমিশন! দশ বালতি জলে চান করে, ভাত খেয়ে, কোট-পেন্টলুন পরে গাবলু মামা তক্ষুনি সায়েবকে সেলাম দিতে ছুটল।

বুঝলি প্যালা—তাই বলছিলুম, টক আমকে অচ্ছেদ্দা করতে নেই! জুতমতো কাউকে খাইয়ে দিতে পারলে বরাত খুলে যায়।

ডালমুটের ঠোঙাটা শেষ করে টেনিদা থামল।

—আহা, এমন বাতের ওষুধ! আমি বললুম, সে আমগাছটা—

দীর্ঘশ্বাস ফেলে টেনিদা বললে, ও-সব ভগবানের দান রে—বেশিদিন কি সংসারে থাকে? পরদিনই কালবৈশাখী ঝড়ে গাছটা ভেঙে পড়ে গিয়েছিল।

প্রভাতসঙ্গীত

টেনিদা অসম্ভব গম্ভীর। আমরা তিনজনও যতটা পারি গম্ভীর হওয়ার চেষ্টা করছি। ক্যাবলার মুখে একটা চুয়িং গাম ছিল, সেটা সে ঠেলে দিয়েছে গালের একপাশে–যেন একটা মার্বেল গালে পুরে রেখেছে এই রকম মনে হচ্ছে। পটলডাঙার মোড়ে তেলেভাজার দোকান থেকে আলুর চপ আর বেগুনী ভাজার গন্ধ আসছে, তাইতে মধ্যেমধ্যে উদাস হয়ে যাচ্ছে হাবুল সেন। কিন্তু আজকের আবহাওয়া অত্যন্ত সিরিয়াস–তেলেভাজার এমন প্রাণকাড়া গন্ধেও টেনিদা কিছুমাত্র বিচলিত হচ্ছে না।

খানিক পরে টেনিদা বলল, পাড়ার লোকগুলো কী বলদিকি?

আমি বললুম, অত্যন্ত বোগাস।

খাঁড়ার মতো নাকটাকে আরও খানিক খাড়া করে টেনিদা বললে, পয়সা তো অনেকেরই আছে। মোটরওলা বাবুও তো আছেন কজন। তবু আমাদের একসারসাইজ ক্লাবকে চাঁদা দেবে না?

না–দিব না।–হাবুল সেন মাথা নেড়ে বললে, কয়–একসারসাইজ কইর‍্যা কী হইব? গুণ্ডা হইব কেবল!

হ, গুণ্ডা হইব!–টেনিদা হাবুলকে ভেংচে বললে, শরীর ভালো করবার নাম হল গুণ্ডাবাজি! অথচ বিসর্জনের লরিতে যারা ভুতুড়ে নাচ নাচে, বাঁদরামো করে, তাদের চাঁদা দেবার বেলায় তো পয়সা সুড়সুড় করে বেরিয়ে আসে। প্যালার মতো রোগা টিকটিকি না হয়ে

বাধা দিয়ে বললুম, আবার আমাকে কেন?

ইউ শাটাপ।–টেনিদা বাঘাটে হুংকার ছাড়ল : আমার কথার ভেতরে কুরুবকের মতো-খুব বিচ্ছিরি একটা বকের মতো বকবক করবি না–সেকথা বলে দিচ্ছি তোকে। প্যালার মতো রোগা টিকটিকি না হয়ে পাড়ার ছেলেগুলো দুটো ডাম্বেল-মুগুর ভাঁজুক, ডন দিক–এই তো আমরা চেয়েছিলাম। শরীর ভালো হবে, মনে জোর আসবে, অন্যায়ের সামনে রুখে দাঁড়াবে, বড় কাজ করতে পারবে। তার নাম গুণ্ডাবাজি। অথচ দ্যাখ-দু-চারজন ছাড়া কেউ একটা পয়সা ঠেকাল না। আমরা নিজেরা চাঁদা-টাদা দিয়ে দু-একটা ডাম্বেল-টাম্বেল কিনেছি, কিন্তু চেস্ট একসপ্যান্ডার, বারবেল

ক্যাবলা আবার চুয়িং গামটা চিবোতে আরম্ভ করল। ভরাট মুখে বললে, কেউ পাত্তাই দিচ্ছে না।

হাবুল মাথা নাড়ল : দিব না। ক্লাব তুইল্যা দাও টেনিদা।

তুলে দেব? কভি নেহি টেনিদার সারা মুখে মোগলাই পরোটার মতো একটা কঠিন প্রতিজ্ঞা ফুটে বেরুল : চাঁদা তুলবই। ইউ প্যালা!

আঁতকে উঠে বললুম, অ্যাঁ?

আমাদের নিয়ে তো খুব উষ্টুম-ধুষ্টুম গপ্পো বানাতে পারিস, কাগজে ছাপাটাপাও হয়। একটা বুদ্ধি-টুদ্ধি বের করতে পারিস নে?

মাথা চুলকে বললুম, আমি–আমি

হাঁ-হাঁ, তুই-তুই।–টেনিদা কটাং করে আমার চাঁদিতে এমন গাঁট্টা মারল যে ঘিলুটিলু সব নড়ে উঠল এক সঙ্গে। আমি কেবল বললুম, ক্যাঁক।

ক্যাবলা বললে, ওরকম গাঁট্টা মারলে তো বুদ্ধি বেরুবে না, বরং তালগোল পাকিয়ে যাবে সমস্ত। এখন ক্যাঁক বলছে, এর পরে ঘ্যাঁক-ঘ্যাঁক বলতে থাকবে আর ফস করে কামড়ে দেবে কাউকে।

গাঁট্টার ব্যথা ভুলে আমি চটে গেলুম।

ঘ্যাঁক করে কামড়াব কেন? আমি কি কুকুর?

টেনিদা বললে, ইউ শাটাপ–অকর্মার ধাড়ি।

হাবুল বললে, চুপ কইর‍্যা থাক প্যালা–আর একখান গাট্টা খাইলে ম্যাও-ম্যাও কইর‍্যা বিলাইয়ের মতন ডাকতে আরম্ভ করবি। অরে ছাইড়া দাও টেনিদা। আমার মাথায় একখান বুদ্ধি আসছে।

টেনিদা ভীষণ উৎসাহ পেয়ে ঢাকাই ভাষা নকল করে ফেলল : কইয়্যা ফ্যালাও।

হাবুল বললে, আমরা গানের পার্টি বাইর করুম।

গানের পার্টি? মানে-সেই যে চাঁদা দাও গো পুরবাসী? আর শালু নিয়ে রাস্তায় রাস্তায় ঘুরে বেড়াব?–টেনিদা দাঁত খিঁচিয়ে বললে, আহা-হা, কী একখানা বুদ্ধিই বের করলেন। লোকে সেয়ানা হয়ে গেছে, ওতে আর চিঁড়ে ভেজে? সারা দিন ঘুরে হয়তো পাওয়া যাবে বত্রিশটা নয়া পয়সা আর দুখানা ছেঁড়া কাপড়। দুদ্দুর!

ক্যাবলা টকাৎ করে চুয়িং গামটাকে আবার গালের একপাশে ঠেলে দিলে।

টেনিদা–দি আইডিয়া!

আমরা সবাই একসঙ্গে ক্যাবলার দিকে তাকালুম। আমাদের দলে সেই-ই সব চেয়ে ছোট আর লেখাপড়ায় সবার সেরা–হায়ার সেকেন্ডারিতে ন্যাশনাল স্কলার। খবরের কাগজে কুশলকুমার মিত্রের ছবি বেরিয়েছিল স্ট্যান্ড করবার পরে, তোমরা তো সে-ছবি দেখেছ। সেই-ই ক্যাবলা।

ক্যাবলা ছোট হলেও আমাদের চার মূর্তির দলে সেই-ই সবচেয়ে জ্ঞানী, চশমা নেবার পরে তাকে আরও ভারিক্কি দেখায়। তাই ক্যাবলা কিছু বললে আমরা সবাই-ই মন দিয়ে তার কথা শুনি।

ক্যাবলা বললে, আমরা শেষ রাত্রে–মানে এই ভোরের আগে বেরুতে পারি সবাই।

শেষ রাত্তিরে-হাবুল হাঁ করে রইল :শেষ রাত্তিরে ক্যান? চুরি করুম নাকি আমরা?

চুপ কর না হাবলা– ক্যাবলা বিরক্ত হয়ে বললে, আগে ফিনিশ করতে দে আমাকে। আমি দেখেছি, ভোরবেলায় ছোট-ছোট দল কীর্তন গাইতে বেরোয়। লোকে রাগ করে না, সকালবেলায় ভগবানের নাম শুনে খুশি হয়। পয়সা-টয়সাও দেয় নিশ্চয়।

টেনিদা বললে, হু, রাত্তিরে ঘুমিয়ে-টুমিয়ে ভোরবেলায় লোকের মন খুশিই থাকে। তারপর যেই বাজারে কুমড়োকাঁচকলা আর চিংড়ি মাছ কিনতে গেল, অমনি মেজাজ খারাপ। আর অফিস থেকে ফেরবার পরে তো–ইরে ব্বাস।

আমি বললুম, মেজদা যেই হাসপাতাল থেকে আসে–অমনি সকলকে ধরে ইনজেকশন দিতে চায়।

হাবুল বললে, তর মেজদা যদি পাড়ার বড় লোকগুলারে ধইর‍্যা তাগো পুটুস-পুটুস কইর‍্যা ইনজেকশন দিতে পারত।

টেনিদা চেঁচিয়ে উঠল : অর্ডার-অর্ডার, ভীষণ গোলমাল হচ্ছে। কিন্তু ক্যাবলার আইডিয়াটা আমার বেশ মনে ধরেছে–মানে যাকে বলে সাইকোলজিক্যাল। সকালে লোকের মন খুশি থাকে–ইয়ে যাকে বলে বেশ পবিত্র থাকে, তখন এক-আধটা বেশ ভক্তিভরা গান-টান শুনলে কিছু-না-কিছু দেবেই। রাইট। লেগে পড়া যাক তা হলে।

আমি বললুম, কিন্তু জিমন্যাস্টিক ক্লাবের জন্যে আমরা হরিসংকীর্তন গাইব?

ক্যাবলা বললে, হরি-সংকীর্তন কেন? তুই তো একটু-আধটু লিখতে পারিস, একটা গান লিখে ফ্যাল। ভীম, হনুমান–এইসব বীরদের নিয়ে বেশ জোরালো গান।

আমি

হাঁ, তুই, তুই।–টেনিদা আবার গাঁট্টা তুলল : মাথার ঘিলুটা আর একবার নড়িয়ে দিই, তা হলেই একেবারে আকাশবাণীর মতো গান বেরুতে থাকবে।

আমি এক লাফে নেমে পড়লুম চাটুজ্যেদের রোয়াক থেকে।

বেশ, লিখব গান। কিন্তু সুর দেবে কে?

টেনিদা বললে, আরে সুরের ভাবনা কী–একটা কেত্তন-ফেত্তন লাগিয়ে দিলেই হল।

আর গাইব কেডা? হাবুলের প্রশ্ন শোনা গেল : আমাগো গলায় তো ভাউয়া ব্যাংয়ের মতন আওয়াজ বাইর অইব।

হ্যাং ইয়োর ভাউয়া ব্যাং।–টেনিদা বললে, এসব গান আবার জানতে হয় নাকি? গাইলেই হল। কেবল আমাদের থান্ডার ক্লাবের গোলকিপার পাঁচুগোপালকে একটু যোগাড় করতে হবে, ও হারমোনিয়াম বাজাতে পারে–গাইতেও পারে–মানে আমাদের লিড করবে।

হাবুল বললে, আমাগো বাড়িতে একটা কর্তাল আছে, লইয়া আসুম।

ক্যাবলা বললে, আমাদের ঠাকুর দেশে গেছে, তার একটা ঢোল আছে। সেটা আনতে পারি।

গ্র্যান্ড!-টেনিদা ভীষণ খুশি হল : ওটা আমিই বাজাব এখন। দেন এভরিথিং ইজ কমপ্লিট। শুধু গান বাকি। প্যালা-অফ অ্যান আওয়ার টাইম। দৌড়ে চলে যা–গান লিখে নিয়ে আয়। এর মধ্যে আমরা একটু তেলেভাজা খেয়েনি।

মাথা চুলকে আমি বললুম, আমিও দুটো তেলেভাজা খেয়ে গান লিখতে যাই না কেন? মানে–দু-একটা আলুর চপ-টপ খেলে বেশ ভাব আসত।

আর আলুর চপ খেয়ে কাজ নেই। যা বাড়ি যা–কুইক। আধ ঘণ্টার মধ্যে গান লিখে না আনলে ভাব কী করে বেরোয় আমি দেখব। কুইক–কুইক

টেনিদা রোয়াক থেকে নেমে পড়তে যাচ্ছিল। অগত্যা আমি ছুট লাগালুম। কুইক নয়–ক্যইকেস্ট যাকে বলে।

জাগো রে নগরবাসী, ভজো হনুমান
করিবেন তোমাদের তিনি বলবান।
ও গো–সকালে বিকালে যেবা করে ভীমনাম
সেই হয় মহাবীর নানা গুণধাম।
জাগো রে নগরবাসী–ডন দাও, ভাঁজো রে ডামবেল,
খাও রে পরান ভরি ছোলাকলা-আম-জাম-বেল
হও রে সকলে বীর, হও ভীম, হও হনুমান,
জাগিবে ভারত এতে করি অনুমান।

ক্যাবলা গান শুনে বললে, আবার অনুমান করতে গেলি কেন? লেখ–জাগিবে ভারত এতে পাইবে প্রমাণ।

টেনিদা বললে, রাইট। কারেকট সাজেসশন।

হাবুল বললে, কিন্তু মানুষরে হনুমান হইতে কইবা? চেইত্যা যাইব না?

টেনিদা বললে, চটবে কেন? পশ্চিমে হনুমানজীর কত কদর। জয় হনুমান বলেই তো কুস্তি করতে নামে। হনুমান সিং–হনুমানপ্রসাদ, এরকম কত নাম হয় ওদের। হনুমান কি চাড্ডিখানা কথা রে। এক লাফে সাগর পেরুলেন, লঙ্কা পোড়ালেন, গন্ধমাদন টেনে আনলেন, রাবণের রথের চুড়োটা কড়মড়িয়ে চিবিয়ে দিলেন এক দাঁতের জোরটাই ভেবে দ্যাখ একবার।

তবে কিনা-খাও রে পরান ভরি ছোলাকলা-আম-জাম-বেল চুয়িং গাম খেতে খেতে ক্যাবলা বললে, এই লাইনটা ঠিক

আমি বললুম, বারে, গানে রস থাকবে না? কলা-আম-জামে কত রস বল দিকি? আর দুটো-চারটে ভালো জিনিস খাওয়ার আশা না থাকলে লোকে খামকা ডামবেল বারবেল ভাঁজতেই বা যাবে কেন? লোভও তো দেখাতে হয় একটু।

ইয়া।-টেনিদা ভীষণ খুশি হল : এতক্ষণে প্যালার মাথা খুলেছে। এই গান গেয়েই আমরা কাল ভোররাত্তিরে পাড়ায় কীর্তন গাইতে বেরুব। ডি-লা-গ্র্যান্ডি মেফিস্টোফিলিস

আমরা তিনজন চেঁচিয়ে উঠলুম : ইয়াক ইয়াক।

এবং পরদিন ভোরে–

শ্ৰদ্ধানন্দ পার্কের কাছে কাক ডাকবার আগে, ঝাড়ুদার বেরুনোর আগে প্রথম ট্রাম দেখা না দিতেই

জাগো রে নগরবাসী, ভজো হনুমান—

আগে-আগে গলায় হারমোনিয়াম নিয়ে পাঁচুগোপাল। তার পেছনে ঢোল নিয়ে টেনিদা, টেনিদার পাশে কর্তাল হাতে ক্যাবলা। থার্ড লাইনে আমি আর হাবুল সেন। টেনিদা বলে দিয়েছে, তোদের দুজনের গলা একেবারে দাঁড়কাকের মতো বিচ্ছিরি, কোনও সুর নেই, তোরা থাক ব্যাকলাইনে।

আহা–টেনিদা যেন গানের গন্ধর্ব। একদিন কী মনে করে যেন সন্ধ্যাবেলায় গড়ের মাঠে সুর ধরেছিল–আজি দখিন দুয়ার খোলা এসো হে, এসো হে, এসো হে। কিন্তু আসবে কে? জন তিনেক লোক অন্ধকারে ঘাসের ওপর শুয়েছিল, দু লাইন শুনেই তারা তড়াক তড়াক করে উঠে বসল, তারপর তৃতীয় লাইন ধরতেই দুড়দুড় করে টেনে দৌড় এসপ্ল্যানেডের দিকে–যেন ভূতে তাড়া করেছে।

আমি বলতে যাচ্ছিলুম, তোমার গলায় তো মা সরস্বতীর রাজহাঁস ডাকে কিন্তু হাবুল আমায় থামিয়ে দিলে। বললে, চুপ মাইর‍্যা থাক। ভালোই হইল, তর আমার গাইতে হইব না। অরা তিনটায় গাঁ-গাঁ কইর‍্যা চ্যাঁচাইব, তুই আর আমি পিছন থিক্যা অ্যাঁ-অ্যাঁ করুম।

সুতরাং রাস্তায় বেরিয়েই পাঁচুর হারমোনিয়ামের প্যাঁ-প্যাঁ আওয়াজ, টেনিদার দুমদাম ঢোল আর ক্যাবলার ঝমাঝম কতাল। তারপরেই বেরুল সেই বাঘা কীর্তন :

ওগো সকালে বিকালে যেবা করে ভীমনাম

পাঁচুর পিনপিনে গলা, টেনিদার গগনভেদী চিৎকার, ক্যাবলার ক্যাঁক্যাঁ আওয়াজ, হাবুলের সর্দি বসা স্বর আর সেই সঙ্গে আমার কোকিল-খাওয়া রব। কোরাস তো দূরে থাক পাঁচটা গলা পাঁচটা গোলার মতো দিগ্বিদিকে ছুটল :

জাগো রে নগরবাসী, ডন দাও–ভাঁজো রে ডামবেল-

ঘোঁয়াক ঘোঁয়াক করে আওয়াজ হল, দুটো কুকুর সারা রাত চেঁচিয়ে কেবল একটু ঘুমিয়েছে-তারা বাঁইবাঁই করে ছুটল। গড়ের মাঠের লোকগুলো তো তবু এসপ্ল্যানেড পর্যন্ত দৌড়েছিল, এরা ডায়মন্ড হারবারের আগে গিয়ে থামবে বলে মনে হল না।

এবং তৎক্ষণাৎ

দড়াম করে খুলে গেল ঘোষেদের বাড়ির দরজা। বেরুলেন সেই মোটা গিন্নী–যাঁর চিৎকারে পাড়ায় কাক-চিল পড়তে পায় না।

আমাদের কোরাস থেমে গেল তাঁর একটি সিংহগর্জনে।

কী হচ্ছে অ্যাঁ। এই লক্ষ্মীছাড়া হতভাগা টেনি-কী আরম্ভ করেছিস এই মাঝরাত্তিরে?

অত বড় লিডার টেনিদাও পিছিয়ে গেল তিন পা।

মানে মাসিমা–মানে ইয়ে এই ইয়ে–একসারসাইজ ক্লাবের জন্য চাঁদা

চাঁদা! অমন মড়া-পোড়ানো গান গেয়ে–পাড়াসুদ্ধ লোকের পিলে কাঁপিয়ে মাঝরাত্তিরে চাঁদা? দূর হ এখেন থেকে ভূতের দল, নইলে পুলিশ ডাকব এক্ষুনি।

দড়াম করে দরজা বন্ধ হল পরক্ষণেই।

কীর্তন পার্টি শোকসভার মতো স্তব্ধ একেবারে।

হাবুল করুণ স্বরে বলল, হইব না টেনিদা। এই গানে কারও হৃদয় গলব না মনে হইতাছে।

হবে না মানে?–টেনিদা পান্তুয়ার মতো মুখ করে বললে, হতেই হবে। লোকের মন নরম করে তবে ছাড়ব।

কিন্তু ঘোষমাসিমা তো আরও শক্ত হয়ে গেলেন–আমাকে জানাতে হল।

উনি তো কেবল চেঁচিয়ে ঝগড়া করতে পারেন, জিমন্যাস্টিকের কী বুঝবেন! অলরাইট–নেকসট হাউস। গজকেষ্টবাবুর বাড়ি। আবার পদযাত্রা। আর সম্মিলিত রাগিণী :

খাও রে পরান ভরি ছোলা-কলা-আম-জাম-বেল–
হও রে সকলে বীর, হও ভীম, হও হনুমান

পাঁচু, টেনিদা, ক্যাবলা তেড়ে কেবল হও হনুমান পর্যন্ত গেয়েছে, আমি আর হাবলা আম পর্যন্ত বলে সুর মিলিয়েছি, অমনি গজকেষ্ট হালদারের দোতলার ঝুলবারান্দা থেকে

না, চাঁদা নয়। প্রথমে একটা ফুলের টব, তার পরেই একটা কুঁজো। মেঘনাদকে দেখা গেল না, কিন্তু টবটা আর একটু হলেই আমার মাথায় পড়ত, আর কুঁজোটা একেবারে টেনিদার মৈনাকের মতো নাকের পাশ দিয়ে ধাঁ করে বেরিয়ে গেল।

আমি চেঁচিয়ে বললুম, টেনিদা–গাইডেড মিশাইল।

বলতে বলতেই আকাশ থেকে নেমে এল প্রকাণ্ড এক হুলো বেড়াল-পড়ল পাঁচুর হারমোনিয়ামের ওপর। খ্যাঁচ-ম্যাচ করে এক বিকট আওয়াজ হারমোনিয়ামসুদ্ধু পাঁচু একেবারে চিত–আর ক্যাঁচক্যাঁচাঙ বলে বেড়ালটা পাশের গলিতে উধাও!

ততক্ষণে আমরা ঊর্ধ্বশ্বাসে ছুটেছি। প্রায় হ্যারিসন রোড পর্যন্ত দৌড়ে থামতে হল আমাদের। পাঁচু কাঁদো কাঁদো গলায় বললে, টেনিদা, এনাফ। এবার আমি বাড়ি যাব।

হাবুল বললে, হ, নাইলে মারা পোড়বা সক্কলে। অখন কুজা ফ্যালাইছে, এইবারে সিন্দুক ফ্যালাইব। অখন বিলাই ছুঁইর‍্যা মারছে, এরপর ছাত থিক্যা গোরু ফ্যালাইব।

টেনিদা বললে, শাট আপ–ছাতে কখনও গোরু থাকে না।

না থাকুক গোরু-ফিক্যা মারতে দোষ কী। আমি অখন যাই গিয়া। হিষ্ট্রি পড়তে হইব।

এঃ–হিষ্ট্রি পড়বেন!–টেনিদা বিকট ভেংচি কাটল : ইদিকে তো আটটার আগে কোনওদিন ঘুম ভাঙে না। খবর্দার হাবলা–পালানো চলবে না। আর একটা চানস নেব। এত ভালো গান লিখেছে প্যালা, এত দরদ দিয়ে গাইছি আমরাজয় হনুমান আর বীর ভীমসেন মুখ তুলে চাইবেন না? এবং মহৎ কাজ করতে যাচ্ছি আমরা কিছু চাঁদা জুটিয়ে দেবেন না তাঁরা? ট্রাই ট্রাই এগেন। মন্ত্রের সাধন কিংবা–ধর, পাঁচু

পাঁচুগোপাল কাঁউমাউ করতে লাগল : একসকিউজ মি টেনিদা। পেল্লায় হুলো বেড়াল, আর একটু হলেই নাকফাঁক আঁচড়ে নিত আমার। আমি বাড়ি যাব।

বাড়ি যাবেন!–টেনিদা আবার একটা যাচ্ছেতাই ভেংচি কাটল : মামাবাড়ির আবদার পেয়েছিস, না? টেক কেয়ার পেঁচো–ঠিক এক মিনিট সময় দিচ্ছি। যদি গান না ধরিস, এক থাপ্পড়ে তোর কান

ক্যাবলা বললে, কানপুরে চলে যাবে।

আমি হাবুলের কানে কানে বললুম, লোকে আমাদের এর পরে ঠেঙিয়ে মারবে, হাবলা। কী করা যায় বল তো?

তুই গান লেইখ্যা ওস্তাদি করতে গেলি ক্যান?

সংকীর্তন গাইবার বুদ্ধি তো তুই-ই দিয়েছিলি।

হাবুল কী বলতে যাচ্ছিল, আবার প্যাঁ-প্যাঁ করে হারমোনিয়াম বেজে উঠল পাঁচুর। এবং :

জাগো রে নগরবাসী–ভজো হনুমান

ঢোলক-করতালের আওয়াজে আবার চারদিকে ভূমিকম্প শুরু হল। আর পাঁচটি গলার স্বরে সেই অনবদ্য সংগীতচর্চা :

করিবেন তোমাদের তিনি বলবান–

কোনও সাড়াশব্দ নেই কোথাও। কুঁজো নয়, বেড়াল নয়, গাল নয়, কিচ্ছু নয়। সামনে কন্ট্রাকটার বিধুবাবুর নতুন তেতলা বাড়ি নিথর!

আমাদের গান চলতে লাগল :

ওগো-সকালে বিকালে যেবা করে ভীমনাম-

ডামবেল পর্যন্ত যেই এসেছে, দড়াম করে দরজা খুলে গেল আবার। গায়ে একটা কোট চড়িয়ে, একটা সুটকেস হাতে প্রায় নাচতে নাচতে বেরুলেন বাড়ির মালিক বিধুবাবু।

আমি আর হাবলা টেনে দৌড় লাগাবার তালে আছি, আঁক করে পাঁচুর গান থেমে গেছে, টেনিদার হাত থমকে গেছে ঢোলের ওপর। বিধুবাবু আমাদের মাথায় সুটকেস ছুঁড়ে মারবেন কিনা বোঝবার আগেই

ভদ্রলোক টেনিদাকে এসে জাপটে ধরলেন সুটকেসসুদ্ধ। নাচতে লাগলেন তারপর।

বাঁচালে টেনিরাম, আমায় বাঁচালে। অ্যালার্ম ঘড়িটা খারাপ হয়ে গেছে, তোমাদের ডাকাত-পড়া গান কানে না এলে ঘুম ভাঙত না; পাঁচটা সাতের গাড়ি ধরতে পারতুম না–দেড় লাখ টাকার কন্ট্রাকটই হাতছাড়া হয়ে যেত। কী চাই তোমাদের বলো। শেষ রাতে তিনশো শেয়ালের কান্না কেন জুড়ে দিয়েছ বলো–আমি তোমাদের খুশি করে দেব।

শেয়ালের কান্না না স্যার–শেয়ালের কান্না না!–বিধুবাবুর সঙ্গে নাচতে নাচতে তালে-তালে টেনিদা বলে যেতে লাগল : একসারসাইজ ক্লাব-ডামবেল বারবেল কিনব–অন্তত পঞ্চাশটা টাকা দরকার—

.

বেলা নটা। রবিবারের ছুটির দিন। চাটুজ্যেদের রোয়াকে বসে আছি আমরা। পাঁচুগোপালও গেস্ট হিসেবে হাজির আছে আজকে।

মেজাজ আমাদের ভীষণ ভালো। পঞ্চাশ টাকা দিয়ে গেছেন বিধুবাবু। সামনের মাসে আরও পঞ্চাশ টাকা দেবেন কথা দিয়েছেন।

নিজের পয়সা খরচ করে টেনিদা আমাদের আইসক্রিম খাওয়াচ্ছিল। আইসক্রিম শেষ করে, কাগজের গেলাসটাকে চাটতে-চাটতে বলল, তবে যে বলেছিলি হনুমান আর ভীমের নামে কাজ হয় না? হুঁ হুঁ–কলিকাল হলে কী হয়, দেবতার একটা মহিমে আছে না?

পাঁচু বললে, আর হুলো বেড়ালটা যদি আমার ঘাড়ে পড়ত

আমি বললুম, আর ফুলের টব যদি আমার মাথায় পড়ত।

হাবুল বললে, কুঁজাখান যদি দমাস কইর‍্যা তোমার নাকে লাগত

টেনিদা বললে, হ্যাং ইয়োর হুলো বেড়াল, ফুলের টব, কুঁজো। ডি-লা-গ্র্যান্ডি মেফিস্টোফিলিস।

আমরা চেঁচিয়ে বললুম, ইয়াক ইয়াক।

বনভোজনের ব্যাপার

হাবুল সেন বলে যাচ্ছিল–পোলাও, ডিমের ডালনা, রুই মাছের কালিয়া, মাংসের কোর্মা

উস-উস শব্দে নোলার জল টানল টেনিদা : বলে যা–থামলি কেন? মুর্গ মুসল্লম, বিরিয়ানি পোলাও, মশলদা দোসে, চাউ-চাউ, সামি কাবাব–

এবার আমাকে কিছু বলতে হয়। আমি জুড়ে দিলাম : আলু ভাজা, শুক্তো, বাটিচচ্চড়ি, কুমড়োর ছোকা–

টেনিদা আর বলতে দিলে না! গাঁক-গাঁক করে চেঁচিয়ে উঠল : থাম প্যালা, থাম বলছি। শুক্তো বাটি–চচ্চড়ি।–দাঁত খিঁচিয়ে বললে, তার চেয়ে বল না হিঞ্চে সেদ্ধ, গাঁদাল আর শিঙিমাছের ঝোল! পালা-জ্বরে ভুগিস আর বাসক-পাতার রস খাস, এর চাইতে বেশি বুদ্ধি আর কী হবে তোর! দিব্যি অ্যায়সা অ্যায়সা মোগলাই খানার কথা হচ্ছিল, তার মধ্যে ধাঁ করে নিয়ে এল বাটি-চচ্চড়ি আর বিউলির ডাল! ধ্যাত্তোর।

ক্যাবলা বললে, পশ্চিমে কুঁদরুর তরকারি দিয়ে ঠেকুয়া খায়। বেশ লাগে।

–বেশ লাগে?–টেনিদা তিড়িং করে লাফিয়ে উঠল : কাঁচা লঙ্কা আর ছোলার ছাতু আরও ভালো লাগে না? তবে তাই খা-গে যা। তোদের মতো উল্লুকের সঙ্গে পিকনিকের আলোচনাও ঝকমারি।

হাবুল সেন বললে, আহা-হা চৈইত্যা যাইত্যাছ কেন? পোলাপানে কয়–

–পোলাপান! এই গাড়লগুলোকে জলপান করলে তবে রাগ যায়। তাও কি খাওয়া যাবে এগুলোকে? নিম-নিসিলের চেয়েও অখাদ্য। এই রইল তোদের পিকনিক–আমি চললাম! তোরা ছোলার ছাতু আর কাঁচা লঙ্কার পিণ্ডি গেল গে–আমি ওসবের মধ্যে নেই!

সত্যিই চলে যায় দেখছি। আর দলপতি চলে যাওয়া মানেই আমরা একেবারে অনাথ। আমি টেনিদার হাত চেপে ধরলাম : আহ, বোসো না। একটা প্ল্যান-ট্যান হোক। ঠাট্টাও বোঝ না।

টেনিদা গজগজ করতে লাগল : ঠাট্টা। কুমডোর ছোকা আর কুঁদরুর তরকারি নিয়ে ওসব বিচ্ছিরি ঠাট্টা আমার ভালো লাগে না।

-না-না, ওসব কথার কথা।হাবুল সেন ঢাকাই ভাষায় বোঝাতে লাগল : মোগলাই খানা না হইলে আর পিকনিক হইল কী?

–তবে লিস্টি কর–টেনিদা নড়ে-চড়ে বসল।

প্রথমে যে লিস্টটা হল তা এইরকম :

বিরিয়ানি পোলাও

কোর্মা।

কোপ্তা কাবার দুরকম।

মাছের চপ–

মাঝখানে রেসিকের মতো বাধা দিলে ক্যাবলা : তা হলে বাবুর্চি চাই, একটা চাকর, একটা মোটর লরি, দুশো টাকা–

–দ্যাখ ক্যাবলা–টেনিদা ঘুষি বাগাতে চাইল।

আমি বললাম, চটলে কী হবে? চারজনে মিলে চাঁদা উঠেছে দশ টাকা ছ-আনা।

টেনিদা নাক চুলকে বললে, তাহলে একটু কম-সম করেই করা যাক। ট্যাক-খালির জমিদার সব-তোদের নিয়ে ভদ্দরলোকে পিকনিক করে!

আমি বলতে যাচ্ছিলাম, তুমি দিয়েছ ছ-আনা, বাকি দশ টাকা গেছে আমাদের তিনজনের পকেট থেকে। কিন্তু বললেই গাঁট্টা। আর সে গাঁট্টা ঠাট্টার জিনিস নয়-জুতসই লাগলে স্রেফ গালপাট্টা উড়ে যাবে।

রফা করতে করতে শেষ পর্যন্ত লিস্টটা যা দাঁড়াল তা এই :

খিচুড়ি (প্যালা রাজহাঁসের ডিম আনিবে বলিয়াছে)

আলু ভাজা (ক্যাবলা ভাজিবে)

পোনা মাছের কালিয়া (প্যালা রাঁধিবে)

আমের আচার (হাবুল দিদিমার ঘর হইতে হাত-সাফাই করিবে)

রসগোল্লা, লেডিকেনি (ধারে ম্যানেজ করিতে হইবে)

লিস্টি শুনে আমি হাঁড়িমুখ করে বললাম, ওর সঙ্গে আর-একটা আইটেম জুড়ে দে হাবুল। টেনিদা খাবে।

–হেঁ–হেঁ–প্যালার মগজে শুধু গোবর নেই, ছটাকখানেক ঘিলুও আছে দেখছি। বলেই টেনিদা আদর করে আমার পিঠ চাপড়ে দিলে। গেছি গেছি বলে লাফিয়ে উঠলাম  আমি।

আমরা পটলডাঙার ছেলে কিছুতেই ঘাবড়াই না। চাটুজ্জেদের রোয়াকে বসে রোজ দু-বেলা আমরা গণ্ডায় গণ্ডায় হাতি-গণ্ডার সাবাড় করে থাকি। তাই বেশ ডাঁটের মাথায় বলেছিলাম, দূর-দূর। হাঁসের ডিম খায় ভদ্দরলোক। খেতে হলে রাজহাঁসের ডিম। রীতিমতো রাজকীয় খাওয়া!

–কিন্তু কোথায় পাওয়া যাবে শুনি? খুব যে চালিয়াতি করছিস, তুই ডিম পাড়বি নাকি?–টেনিদা জানতে চেয়েছিল।

–আমি পাড়তে যাব কোন দুঃখে? কী দায় আমার?–আমি মুখ ব্যাজার করে বলেছিলাম : হাঁসে পাড়বে।

–তা হলে সেই হাঁসের কাছ থেকে ডিম তোকেই আনতে হবে। যদি না আনিস, তা হলে–

তা হলে কী হবে বলবার দরকার ছিল না। কিন্তু কী গেরো বলল দেখি। কাল রবিবার–ভোরের গাড়িতেই আমরা বেরুব পিকনিকে। আজকের মধ্যেই রাজহাঁসের ডিম যোগাড় করতে না পারলে তো গেছি। পাড়ায় ভন্টাদের বাড়ি রাজহাঁস আছে গোটাকয়েক। ডিম-টিমও তারা নিশ্চয় পাড়ে। আমি ভন্টাকেই পাকড়ালাম। কিন্তু কী খলিফা ছেলে ভন্টা! দু-আনার পাঁঠার ঘুগনি আর ডজনখানেক ফুলুরি সাবড়ে তবে মুখ খুলল।

–ডিম দিতে পারি, তবে, নিজের হাতে বার করে নিতে হবে বাক্স থেকে।

–তুই দে না ভাই এনে। একটা আইসক্রিম খাওয়াব। ভন্টা ঠোঁট বেঁকিয়ে বললে, নিজেরা পোলাও-মাংস সাঁটবেন আর আমার বেলায় আইসক্রিম। ওতে চলবে না। ইচ্ছে হয় নিজে বের করে নাও–আমি বাবা ময়লা ঘাঁটতে পারব না। কী করি, রাজি হতে হল।

ভন্টা বললে, দুপুরবেলা আসিস। বাবা মেজদা অফিসে যাওয়ার পরে। মা তখন ভোঁস-ভোঁস করে ঘুমোয়। সেই সময় ডিম বের করে দেব।

গেলাম দুপুরে। উঠোনের একপাশে কাঠের বাক্স–তার ভেতরে সার সার খুপরি। গোটা-দুই হাঁস ভেতরে বসে ডিমে তা দিচ্ছে। ভন্টা বললে, যা–নিয়ে আয়।

কিন্তু কাছে যেতেই বিতিকিচ্ছিরিভাবে ফাঁস-ফাস করে উঠল হাঁস দুটো।

ফোঁসফোঁস করছে যে!

ভন্টা উৎসাহ দিলে : ডিম নিতে এসেছিস–একটু আপত্তি করবে না? তোর কোন ভয় নেই প্যালাদে হাত ঢুকিয়ে।

হাত ঢুকিয়ে দেব? কিন্তু কী বিচ্ছিরি ময়লা!–ময়লা আর কী বদখত গন্ধ! একেবারে নাড়ি উলটে আসে। তার ওপরে যেরকম ঠোঁট ফাঁক করে ভয় দেখাচ্ছে–

ভন্টা বললে, চিয়ার আপ প্যালা। লেগে যা!

যা থাকে কপালে বলে যেই হাত ঢুকিয়েছি–সঙ্গে সঙ্গে–ওরে বাপরে! খটাং করে হাঁসটা হাত কামড়ে ধরল। সে কী কামড়! হাঁই-মাই করে চেঁচিয়ে উঠলাম আমি।

–কী হয়েছে রে ভন্টা, নীচে এত গোলমাল কিসের?-ভস্টার মার গলার আওয়াজ পাওয়া গেল।

আমি আর নেই। তাঁচকা টানে হাঁসের ঠোঁট থেকে হাত ছাড়িয়ে চোঁচা দৌড় লাগালাম। দরদর করে রক্ত পড়ছে তখন।

রাজহাঁস এমন রাজকীয় কামড় বসাতে পারে কে জানত। কিন্তু কী ফেরোজ ভস্টাটা। জেনে-শুনে ব্রাহ্মণের রক্তপাত ঘটাল। আচ্ছা পিকনিকটা চুকে যাক–দেখে নেব তারপর। ওই পাঁঠার ঘুগনি আর ফুলুরির শোধ তুলে ছাড়ব।

কী করা যায়–গাঁটের পয়সা দিয়ে মাদ্রাজী ডিমই কিনতে হল গোটাকয়েক।

পরদিন সকালে শ্যামবাজার ইস্টিশানে পৌঁছে দেখি, টেনিদা, ক্যাবলা আর হাবুল এর মধ্যেই মার্টিনের রেলগাড়িতে চেপে বসে আছে। সঙ্গে একরাশ হঁড়ি কলসি, চালের পুঁটলি, তেলের ভাঁড়। গাড়িতে গিয়ে উঠতে টেনিদা হাঁক ছাড়ল : এনেছিস রাজহাঁসের ডিম?

দুর্গা নাম করতে করতে পুঁটলি খুলে দেখালাম।

–এর নাম রাজহাঁসের ডিম। ইয়ার্কি পেয়েছিস?–টেনিদা গাঁট্টা বাগাল।

আমি গাড়ির খোলা দরজার দিকে সরে গেলাম : মানে–ইয়ে, ছোট রাজহাঁস কিনা–

-ঘোট রাজহাঁস! কী পেয়েছিস আমাকে শুনি? পাগল না পেটখারাপ?

হাবুল সেন বললে, ছাড়ান দাও–ছাড়ান দাও। ডিম তো আনছে!

টেনিদা গর্জন করে বললে, ডিম এনেছে না কচু। এই তোকে বলে রাখছি প্যালাডিমের ডালনা থেকে তোর নাম কেটে দিলাম। এক টুকরো আলু পর্যন্ত নয়, একটু ঝোলও নয়! ..

মন খারাপ করে আমি বসে রইলাম। ডিমের ডালনা আমি ভীষণ ভালোবাসি, তাই থেকেই আমাকে বাদ দেওয়া! আচ্ছা বেশ, খেয়ো তোমমরা। এমন নজর দেব পেট ফুলে ঢোল হয়ে যাবে তোমাদের।

পিঁ করে বাঁশি বাজল–নড়ে উঠল মার্টিনের রেল। তারপর ধ্বস-ধ্বস ভোঁস ভোঁস করে এর রান্নাঘর, ওর ভাঁড়ার-ঘরের পাশ দিয়ে গাড়ি চলল।

টেনিদা বললে, বাগুইআটি ছাড়িয়ে আরও চারটে ইস্টিশান। তার মানে প্রায় এক ঘন্টার মামলা। লেডিকেনির হাঁড়িটা বের কর, ক্যাবলা।

ক্যাবলা বললে, এখুনি। তাহলে পৌঁছবার আগেই সে সাফ হয়ে যাবে?

টেনিদা বললে, সাফ হবে কেন, দুটো-একটা চেখে দেখব শুধু। আমার বাবা ট্রেনে চাপলেই খিদে পায়। এই একঘন্টা ধরে শুধু-শুধু বসে থাকতে পারব না। বের কর হাঁড়ি–চটপট–

হাঁড়ি চটপটই বেরুল–মানে, বেরুতেই হল তাকে। তারপর মার্টিনের রেলের চলার তালে তালে ঝটপট করে সাবাড় হয়ে চলল। আমি ক্যাবলা আর হাবুল সেন জুল-জুল করে শুধু তাকিয়েই রইলাম। একটা লেডিকেনি চেখে দেখতে আমরাও যে ভালোবাসি, সেকথা আর মুখ ফুটে বলাই গেল না।

ইস্টিশান থেকে নেমে প্রায় মাইলখানেক হাঁটবার পরে ক্যাবলার মামার বাড়ি। কাঁচা রাস্তা, এঁটেল মাটি, তার ওপর কাল রাতে একপশলা বৃষ্টি হয়ে গেছে আবার। আগে থেকেই রসগোল্লার হাঁড়িটা বাগিয়ে নিলে টেনিদা।

–এটা আমি নিচ্ছি। বাকি মোটঘাটগুলো তোরা নে।

–রসগোল্লা বরং আমি নিচ্ছি, তুমি চালের পোঁটলাটা নাও টেনিদা।–লেডিকেনির পরিণামটা ভেবে আমি বলতে চেষ্টা করলাম।

টেনিদা চোখ পাকাল : খবরদার প্যালা, ওসব মতলব ছেড়ে দে। টুপটাপ করে দু-চারটে গালে ফেলবার বুদ্ধি, তাই নয়?– বাবা–চালাকি ন চলিষ্যতি।

দীর্ঘশ্বাস ফেলে গাঁটরি বোঁচকা কাঁধে ফেলে আমরা তিনজনেই এগোলাম।

কিন্তু তিন পাও যেতে হল না। তার আগেই ধাঁইধপাস্! টেনে একখানা রাম-আছাড় খেল হাবুল।

–এই খেয়েছে কচুপোড়া!–টেনিদা চেঁচিয়ে উঠল।

সারা গায়ে কাদা মেখে হাবুল উঠে দাঁড়াল। হাতের ডিমের পুঁটলিটা তখন কুঁকড়ে এতটুকু–হলদে রস গড়াচ্ছে তা থেকে।

ক্যাবলা বললে, ডিমের ডালনার বারোটা বেজে গেল।

তা গেল। করুণ চোখে আমরা তাকিয়ে রইলাম সেইদিকে। ইস–এত কষ্টের ডিম। ওরই জন্যে রাজহাঁসের কামড় পর্যন্ত খেতে হয়েছে।

টেনিদা হুঙ্কার দিয়ে উঠল : দিলে সব পণ্ড করে। এই ঢাকাই বাঙালটাকে সঙ্গে এনেই ভুল হয়েছে। পিটিয়ে ঢাকাই পরোটা করলে তবে রাগ যায়।

আমি বলতে যাচ্ছিলাম, হাবুল চার টাকা চাঁদা দিয়েছে–তার আগেই কী যেন একটা হয়ে গেল! হঠাৎ মনে হল আমার পা দুটো মাটি ছেড়ে শোঁ করে শূন্যে উড়ে গেল, আর তারপরেই–

কাদা থেকে যখন উঠে দাঁড়ালাম, তখন আমার মাথা-মুখ বেয়ে আচারের তেল গড়াচ্ছে। ওই অবস্থাতেই চেটে দেখলাম একটুখানি। বেশ ঝাল ঝাল টক-টক–বেড়ে আচারটা করেছিল হাবুলের দিদিমা!

ক্যাবলা আবার ঘোষণা করলে, আমের আচারের একটা বেজে গেল!

টেনিদা খেপে বললে, চুপ কর বলছি ক্যাবলা–এক চড়ে গালের বোম্বা উড়িয়ে দেব।

কিন্তু তার আগেই টেনিদার বোম্বা উড়ল–মানে স্রেফ লম্বা হল কাদায়। সাত হাত দূরে ছিটকে গেল রসগোল্লার হাঁড়ি–ধবধবে শাদা রসগোল্লাগুলো পাশের কাদাভরা খানায় গিয়ে পড়ে একেবারে নেবুর আচার।

ক্যাবলা বললে, রসগোল্লার দুটো বেজে গেল!

এবার আর টেনিদা একটা কথাও বললে না। বলবার ছিলই বা কী! রসগোল্লার শোকে বুকভাঙা দীর্ঘশ্বাস ফেলতে ফেলতে চারজনে পথ চলতে লাগলাম আমরা। টেনিদা তবু লেডিকেনিগুলো সাবাড় করেছে, কিন্তু আমাদের সান্ত্বনা কোথায়! অমন স্পঞ্জ রসগোল্লাগুলো।

পাঁচ মিনিট পরে টেনিদাই কথা কইল।

–তবু পোনা মাছগুলো আছে–কী বলিস! খিচুড়ির সঙ্গে মাছের কালিয়া আর আলুভাজা-নেহাত মন্দ হবে না–অ্যাঁ?

হাবুল বললে, হ-হ, সেই ভালো। বেশি খাইলে প্যাট গরম হইব। গুরুপাক না খাওয়াই ভালো।

ক্যাবলা মিটমিট করে হাসল : শেয়াল বলছিল, দ্রাক্ষাফল অতিশয় খাট্টা!ক্যাবলা ছেলেবেলায় পশ্চিমে ছিল, তাই দুই-একটা হিন্দী শব্দ বেরিয়ে পড়ে মুখ দিয়ে।

টেনিদা বললে, খাট্টা! বেশি পাঁঠঠামি করবি তো চাঁট্টা বসিয়ে দেব।

ক্যাবলা ভয়ে স্পিকটি নট! আমি তখনও নাকের পাশ দিয়ে ঝাল ঝাল টক-টক তেল চাটছি। হঠাৎ বুক-পকেটটা কেমন ভিজে ভিজে মনে হল। হাত দিয়ে দেখি, বেশ বড়োসড়ো এক-টুকরো আমের আচার তার ভেতরে কায়েমি হয়ে আছে।

–জয়গুরু! এদিক-ওদিক তাকিয়ে টপ করে সেটা তুলে নিয়ে মুখে পুরে দিলাম। সত্যিহাবুলের দিদিমা বেড়ে আচার করেছিল। আরও গোটাকয়েক যদি ঢুকত।

বাগানবাড়িতে পৌঁছুলাম আরও পনেরো মিনিট পরে।

চারিদিকে সুপুরি আর নারকেলের বাগান–একটা পানা-ভর্তি পুকুর, মাঝখানে, একতলা বাড়িটা। কিন্তু ঘরে চাবিবন্ধ। মালীটা কোথায় কেটে পড়েছে, কে জানে!

টেনিদা বললে, কুছ পরোয়া নেই। চুলোয় যাক মালী। বলং বলং বাহ্বলং নিজেরা উনুন খুঁড়বখড়ি কুড়ব, রান্না করব–মালী ব্যাটা থাকলেই তো ভাগ দিতে হত। যা হাবুল ইট কুড়িয়ে আনউনুন করতে হবে। প্যালা, কাঠ কুড়িয়ে নিয়ে আয়,ক্যাবলাকেও সঙ্গে করে নিয়ে যা।

–আর তুমি?–আমি ফস করে জিজ্ঞেস করে ফেললাম।

–আমি?–একটা নারকেল গাছে হেলান দিয়ে টেনিদা হাই তুলল : আমি এগুলো সব পাহারা দিচ্ছি। সবচাইতে কঠিন কাজটাই নিলাম আমি। শেয়াল কুকুর এলে তাড়াতে হবে তো।–যা তোরাহাতে-হাতে বাকি কাজগুলো চটপট সেরে আয়।

কঠিন কাজই বটে! ইস্কুলের পরীক্ষার গার্ডদেরও অমনি কঠিন কাজ করতে হয়। ত্রৈরাশিকের অঙ্ক কষতে গিয়ে যখন ‘ঘোড়া-ঘোড়া ঘাস-ঘাস’ নিয়ে আমাদের দম আটকাবার জো, তখন গার্ড মোহিনীবাবুকে টেবিলে পা তুলে দিয়ে ফোঁরর্‌-ফৌ শব্দে নাক ডাকাতে দেখেছি।

টেনিদা বললে, যা–যা সব-দাঁত বের করে দাঁড়িয়ে আছিস কেন? ঝাঁ করে রান্নাটা করে ফ্যাল বড় খিদে পেয়েছে।

তা পেয়েছে বইকি। পুরো এক হাঁড়ি লেডিকেনি এখনও গজগজ করছে পেটের ভেতর। আমাদের বরাতেই শুধু অষ্টরম্ভা। প্যাচার মতো মুখ করে আমরা কাঠখড়ি সব কুড়িয়ে আনলাম।

টেনিদা লিস্টি বার করে বললে, মাছের কালিয়া–প্যালা রাঁধিবে।

আমাকে দিয়েই শুরু। আমি মাথা চুলকে বললাম, খিচুড়ি-টিচুড়ি আগে হয়ে যাক–তবে তো?

–খিচুড়ি লাস্ট আইটেম–গরম গরম খেতে হবে। কালিয়া সকলের আগে। নে প্যালা-লেগে যা–

ক্যাবলার মা মাছ কেটে নুন-টুন মাখিয়ে দিয়েছিলেন, তাই রক্ষা। কড়াইতে তেল চাপিয়ে আমি মাছ ঢেলে দিলাম তাতে।

আরে–এ কী কাণ্ড! মাছ দেবার সঙ্গে সঙ্গেই কড়াই-ভর্তি ফেনা। তারপরেই আর কথা নেই–অতগুলো মাছ তালগোল পাকিয়ে গেল একসঙ্গে। মাছের কালিয়া নয়–মাছের হালুয়া।

ক্যাবলা আদালতের পেয়াদার মতো ঘোষণা করল : মাছের কালিয়ার তিনটে বেজে গেল।

–তবে রে ইস্টুপিড–। টেনিদা তড়াক করে লাফিয়ে উঠল : কাঁচা তেলে মাছ দিয়ে। তুই কালিয়া রাঁধছিস? এবার তোর পালাজ্বরের পিলেরই একদিন কি আমারই একদিন।

এ তো মার্টিনের রেল নয়–সোজা মাঠের রাস্তা। আমার কান পাকড়াবার জন্যে টেনিদার হাতটা এগিয়ে আসার আগেই আমি হাওয়া। একেবারে পঞ্জাব মেলের স্পিডে।

টেনিদা চেঁচিয়ে বললে, খিচুড়ির লিস্ট থেকে প্যালার নাম কাটা গেল।

তা যাক। কপালে আজ হরি-মটর আছে সে তো গোড়াতেই বুঝতে পেরেছি। গোমড়া মুখে একটা আমড়া-গাছতলায় এসে ঘাপটি মেরে বসে রইলাম।

বসে বসে কাঠ-পিঁপড়ে দেখছি, হঠাৎ গুটি গুটি হাবুল আর ক্যাবলা এসে হাজির।

–কী রে, তোরাও?

ক্যাবলা ব্যাজার মুখে বললে, খিচুড়ি টেনিদা নিজেই রাঁধবে। আমাদের আরও খড়ি আনতে পাঠাল।

সেই মুহূর্তেই হাবুল সেনের আবিষ্কার! একেবারে কলম্বাসের আবিষ্কার যাকে বলে?

–এই প্যালা–দ্যাখছস? ওই গাছটায় কীরকম জলপাই পাকছে!

আর বলতে হল না। আমাদের তিনজনের পেটেই তখন খিদেয় ইঁদুর লাফাচ্ছে। জলপাই-জলপাই-ই সই! সঙ্গে সঙ্গে আমরা গাছে উঠে পড়লাম–আহাটক-টক-মিঠে-মিঠে জলপাই–যেন অমৃত।

হাবুলের খেয়াল হল প্রায় ঘন্টাখানেক পরে।

–এই, টেনিদার খিচুড়ি কী হইল?

ঠিক কথা খিচুড়ি তো এতক্ষণে হয়ে যাওয়া উচিত। তড়াক করে গাছ থেকে নেমে পড়ল ওরা। হাতের কাছে পাতা-টাতা যা পেলে, তাই নিয়ে ছুটল উধ্বশ্বাসে। আমিও গেলাম পেছনে পেছনে, আশায় আশায়। মুখে যাই বলুক–এক হাতা খিচুড়িও কি আমায় দেবে না? প্রাণ কি এত পাষাণ হবে টেনিদার?

কিন্তু খানিক দূর এগিয়ে আমরা তিনজনেই থমকে দাঁড়ালাম। একেবারে মন্ত্রমুগ্ধ!

টেনিদা সেই নারকেল গাছটায় হেলান দিয়ে ঘুমুচ্ছে। আর মাঝে মাঝে বলছে, দেদে ক্যাবলা, পিঠটা আর একটু ভাল করে চুলকে দে।

পিঠ চুলকে দিচ্ছে সন্দেহ কী। কিন্তু সে ক্যাবলা নয়-একটা গোদা বানর। আর চার-পাঁচটা গোল হয়ে বসেছে টেনিদার চারিদিকে। কয়েকটা তো মুঠো মুঠো চাল-ডাল মুখে পুরছে, একটা আলুগুলো সাবাড় করছে আর আস্তে আস্তে টেনিদার পিঠ চুলকে দিচ্ছে। আরামে হাঁ করে ঘুমুচ্ছে টেনিদা, থেকে থেকে বলছে, দে ক্যাবলা, আর একটু ভালো করে চুলকে দে!

এবার আমরা তিনজনে গলা ফাটিয়ে চেঁচিয়ে উঠলাম : টেনিদা বাঁদর বাঁদর।

–কী! আমি বাঁদর!বলেই টেনিদা হাঁ করে সোজা হয়ে বসলসঙ্গে সঙ্গেই বাপ বাপ বলে চিৎকার!

–ইঁ-ইঁ-ক্লিচ-ক্লি্চ! কিচ-কিচ!

চোখের পলকে বানরগুলো কাঁঠাল গাছের মাথায়। চাল-ডাল আলুর পুটলিও সেই সঙ্গে। আমাদের দেখিয়ে দেখিয়ে তরিবত করে খেতে লাগল–সেই সঙ্গে কী বিচ্ছিরি ভেংচি! ওই ভেংচি দেখেই না লঙ্কার রাক্ষসগুলো ভয় পেয়ে যুদ্ধে হেরে গিয়েছিল!

পুকুরের ঘাটলায় চারজনে আমরা পাশাপাশি চুপ করে বসে রইলাম। যেন শোকসভা! খানিক পরে ক্যাবলাই স্তব্ধতা ভাঙল।

–বন-ভোজনের চারটে বাজল।

–তা বাজল।–টেনিদা দীর্ঘশ্বাস ফেলল : কিন্তু কী করা যায় বল তো প্যালা? সেই লেডিকেনিগুলো কখন হজম হয়ে গেছে–পেট চুঁই-চুঁই করছে খিদেয়!

অগত্যা আমি বললাম, বাগানে একটা গাছে জলপাই পেকেছে, টেনিদা

জলপাই! ইউরেকা! বনে ফল-ভোজন–সেইটেই তো আসল বন-ভোজন! চল চল, শিগগির চল!

লাফিয়ে উঠে টেনিদা বাগানের দিকে ছুটল।

 বেয়ারিং ছাঁট

পটলডাঙার টেনিদা, আমি আর হাবুল সেন চাটুজ্যেদের রকে বসে মন দিয়ে পেয়ারা খাচ্ছি। হঠাৎ দেখি, ক্যাবলা বেশ কায়দা করে–নাকটাকে উচ্চিংড়ের মতো আকাশে তুলে সামনে দিয়ে চলে যাচ্ছে। কেমন একটা আলেকজাণ্ডারের মতো ভঙ্গি যেন দিগ্বিজয় করতে বেরিয়েছে।

টেনিদা খপ করে একটা লম্বা হাত বাড়িয়ে ক্যাবলাকে ধরে ফেলল।

বলি, অমন তালেবরের মতো যাওয়া হচ্ছে কোথায়? নাকের ডগায় একটা চশমা চড়িয়েছিস বলে বুঝি আমাদের দেখতেই পাসনি।

ক্যাবলা বললেন, দেখতে পাব না কেন? একটু কাজে যাচ্ছি

–এই রোববার সকালে কী এমন রাজকার্যে যাচ্ছিস র‍্যা! নেমন্তন্ন খেতে নাকি? তা হলে আমরাও সঙ্গে যাই।

ক্যাবলা গম্ভীর হয়ে বললে, না–নেমন্তন্ন না। আমি চুল ছাঁটতে যাচ্ছি।

চুল ছাঁটতে?–টেনিদা শুনে দারুণ খুশি হল : ডিলা গ্র্যান্ডি মেফিস্টোফিলিস। চল- আমিও যাচ্ছি।

এইবার আমার পালা। আমি চেঁচিয়ে বললুম, খবরদার ক্যাবলা, টেনিদাকে সঙ্গে নিয়েছিস কি মরেছিস! গত বছর টেনিদা আমাকে এমন একখানা গ্রেট-ছাঁটাই লাগিয়েছিল যে আমার বউভাতের নেমন্তন্ন খাওয়া একদম বরবাদ।

টেনিদা বটে বললে, তুই একটা পয়লা নম্বরের পেঁয়াজ-চচ্চড়ি। বেশ ডিরেকশন দিয়ে দিয়ে চুল ছাঁটাচ্ছিলুম- চেঁচিয়ে-মেচিয়ে ভণ্ডুল করে দিলি। না রে ক্যাবলা, তোর কোনও ভয় নেই। আমি অ্যায়সা কায়দা করে তোর চুল ছাঁটিয়ে আনব যে, কী বলে- তোর মাথা দিয়ে কী বলে–একেবারে শিখা বেরুতে থাকবে।

হাবুল বললে, হ, শিখাই বাইর হইব। শিখার মানে হইল গিয়া টিকি।

আমি বললুম, তা বেশ তো তুই টিকিই রাখ ক্যাবলা। আমরা সবাই বেশ করে টানতে পারব!

টেনিদা দাঁত খিঁচিয়ে বললে, টেক কেয়ার! টিকি নিয়ে টিকটিকির মতো টিকটিক করবিনে– বলে দিচ্ছি? শিখা মানে বুঝি আর কিছু হয় না? তা হলে আলোর শিখা মানে কী? আলোর টিকি? আলোর কখনও টিকি হয়? কোন্ দিন বলবি, অন্ধকারের টিকি চাঁদের টিকি–

হাবুল খুব জ্ঞানীর মতো বললে, চাঁদের টিকি ধইর‍্যা রাশিয়ানরা তো টান মারছে।

আমি বাধা দিয়ে বললুম, কক্ষনো না। চাঁদের মাথা ন্যাড়া আমাদের পাড়ার নকুলবাবুর মতো। চাঁদের টিকি নেই।

ক্যাবলা বললে, উঃ–এরা তো মাথা ধরিয়ে দিলে দেখছি। ঘাট হয়েছে, আমি আর চুল ছাঁটতে চাই না। এই বসছি।

টেনিদা হতাশ হয়ে বলল,বসলি?

হ্যাঁ, বসলুম।

–আমাকে নিয়ে চুল ছাঁটতে যাবিনে?

না। ক্যাবলার মুখে একটা কঠিন প্রতিজ্ঞা দেখা দিলে : তোমাকে নিয়ে তো নয়ই। প্যালার সেই গ্রেট ছাঁটাই আমি দেখেছি, ও যে গল্পটা লিখেছিল মনের দুঃখে, সেটাও পড়েছি।

টেনিদা মন খারাপ করে বললে, তোর ভালোর জন্যেই বলেছিলুম। মানে আমার ভুলোদার মতো সস্তায় কিস্তিমাত করতে গিয়ে না পস্তাস, সেইজন্যেই বলছিলুম।

আমি বললুম, ব্যাপারটা খুলে বলো তা হলে। কী হয়েছিল তোমার ভুলোদার?

-কী হয়েছিল ভুলোদার? টেনিদা টকাং করে আমার চাঁদিতে ছোট্ট একটা গাঁট্টা মারলে : ফাঁকি দিয়ে গপ্পোটা বাগাবার চেষ্টা আর সেইটে পত্রিকায় লিখে দেবার মতলব? ও-সব চালাকি চলবে না। ভুলোদার সেই প্যাথেটিক কাহিনী শুনতে হলে চার আনার তেলেভাজা আগে আনো-কুইক।

আমার পকেটে দুআনা ছিল, আরও দুআনা হাবুলের কাছ থেকে আমায় ধার করতে হল।

.

দুখানা বেগুনি একসঙ্গে মুখে পুরে দিয়ে টেনিদা বললে, আমার ভুলোদা– মানে আমাদের দূর সম্পর্কের জ্যাঠামশাইয়ের এক ছেলে পয়সাকড়ির ব্যাপারে ছিল বেজায় টাইট। জ্যাঠামশাইয়ের টাকার অভাব ছিল না, ভুলোদাও কী সব ধানপাটের ব্যবসা করত কিন্তু একটা পয়সা খরচ করতে হলে ভুলোদার চোখ কপালে উঠে যেত।

বললে বিশ্বাস করবিনে, একদিন বাজারে গিয়ে টুক করে একটা নয়া পয়সা পড়ে গেল নালার ভেতরে। বাজারের নালা- বুঝতেই পারছিস! যেমন নোংরা– তেমনি বদখত গন্ধ তার ওপরে এক হাত পাঁক। দেখলেই নাড়ি উলটে আসে। কিন্তু ভুলোদা ছাড়বার পাত্তর নয়। এক ঘণ্টা ধরে দুহাতে সেই নালা ঘাঁটলে। আর একটার বদলে চার-চারটে নয়া পয়সা মিলল তার ভেতর থেকে, একটা অচল সিকি পেলে দুটো মরা শিঙিমাছ আর জ্যান্ত একটা খলসে মাছও পেয়ে গেল! তিনটে নয়া পয়সা নগদ লাভ হল, সেদিন আর মাছও কিনতে হল না।

হাবুল বললে, এ রাম?-থু-থু

টেনিদা বললে, থু-থু? জানিস, ভুলোদা এখন কত বড়লোক? বাড়িতে গামছা পরে বসে থাকে, কিন্তু ব্যাঙ্কে তার কত টাকা!

ক্যাবলা বললে, আমাদের বড়লোক হয়ে কাজ নেই, বেশ আছি। পচা ড্রেন থেকে মরা শিঙিমাছ খেতে পারব না– গামছা পরেও বসে থাকতে পারব না।

টেনিদা বললে না, না পারবি তো যা–কচুপোড়া খে গে।

আমি ব্যস্ত হয়ে বললুম, আঃ-ঝগড়া করছ কেন? গল্পটা বলতে দাও না।

টেনিদা গজগজ করতে লাগল; ই– বড়লোক হবেন না। না হলি তো না হলি– অত তড়পানি কিসের জন্যে র‍্যা? মরা শিঙিমাছ খেতে না চাস, জ্যান্ত তিমি মাছ খা গামছা পরতে না চাস আলোয়ান পরে বসে থাক। ওসব ধ্যাষ্টামো আমার ভালো লাগে না—হুঁ!

আমি বললুম, গপ্পোটা–

গপ্পোটা! টেনিদা মুখটাকে ডিম-ভাজার মতো করে বললে, ধ্যৎ। খালি কুরুবকের মতো বকবক করলে গপ্পো হয়?

ক্যাবলা বললে, কুরুবক এক রকমের ফুল। ফুল কখনও বকবক করে না।

টেনিদা চেঁচিয়ে বললে, শাট আপ? আমি বলছি কুরুবক এক রকমের বক– খুব বিচ্ছিরি বক। ফের যদি আমার সঙ্গে তক্কো করবি, তা হলে আমি এক্ষুনি কাঁচি এনে তোকে একটা গ্রেট ছাঁটাই লাগিয়ে দেব।

শুনে ক্যাবলার মুখ টুখ একবারে শুঁটকী মাছের মতো হয়ে গেল। বললে, নানা, তুমি বলে যাও। আমি আর তক্কো করব না।

করিসনি। বেঘোরে মারা যাবি তা হলে। বলে কুরুবক একরকমের ফুল। তা হলে। গোরুও একরকমের ফল, রসগোল্লা একরকমের পাখি, বানরগুলোও একরকমের পাকা তাল! যা–যা–চালাকি করিসনি।

আমি বললুম, কিন্তু ভুলোদা

–আরে গেল যা! এটা যে ভুলোদা-ভুলোদা করে খেপে যাবে দেখছি!–টেনিদা আমার চাঁদিতে আর একটা গাঁট্টা মারলে; শিঙিমাছ দিয়ে নিজেও পটোলের ঝোল খায় কিনা– তাই এত ফুর্তি হয়েছে। বলে তেলেভাজার ঠোঙা থেকে শেষ আলুর চপটা মুখে পুরে দিয়ে বললে, একদম সাইলেন্স! নইলে গল্প আমি আর বলব না।

আমরা বললুম, আচ্ছা–আচ্ছা!

টেনিদা শুরু করল :

ভুলোদা পশ্চিমে কোথায় ব্যবসা করত। ওদেশে থাকবার জন্যে আর পয়সা বাঁচাবার জন্যে তো বটেই, একেবারে পুরোপুরি দেশোয়ালি বনে গিয়েছিল। মোটা কুর্তা পরত, পায়ে দিত কাঁচা চামড়ার নাগরা গড়গড়িয়ে দেহাতী তালুতে সব সময় খইনি ডলত। পানকে বলতে পানোয়া–সাপকে বলত সাঁপোয়া। আমরা কিছু জিগ্যেস করলে অন্যমনস্কভাবে জবাব দিত–কুছ, কহলি হো?

কামাতে খরচ হবে বলে দাড়ি রেখেছিল। তাতে বেশ সাধু সাধু দেখাত আর গাঁয়ের সাদাসিধে মানুষ কিছু ভক্তি-ছেদ্দাও করত। কিন্তু চুলটা মাঝে-মাঝে না কাটলে মাথা কুটকুট করে। তা ছাড়া কী বলে- রাত-দিন টাকার ধান্দায় ঘুরে ভুলোদা খুব সাফসুফ থাকতেও পারে না। জামা কাচে মাসে একবার, চান করে বছরে চারবার। তাই চুল একটু বেশি বড় হলেই উকুন এসে বাসা বাঁধে। কিন্তু চুল ছাঁটাইয়েও ভুলোদার খরচ ছিল না। বেশ একটা কায়দা করে নিয়েছিল। কী কায়দা বল দিকি?

আমি বললুম, বোধ হয় নিজেই কাঁচি দিয়ে ছাঁটাই করত।

টেনিদা সুকুমার রায়ের হযবরলর কাকটার মতো দুলে-দুলে বললে, হয় নি হয় নি–ফেল!

হাবুল বললে, হ, বুঝছি। নিজের মাথার চুল খামচা খামচা কইরা টাইন্যা তুলত।

–ইঃ–কী বুদ্ধি! মগজ তো নয়–যেন নিরেট একটা খাজা কাঁঠাল বসে আছে। আয় ইদিক–খিমচে খিমচে তোর খানিক চুল তুলে দি। কেমন লাগে, টের পাবি।

টেনিদা হাত বাড়াতেই হাবুল সড়াৎ করে এক লাফে রক থেকে নেমে পড়ল।

ক্যাবলা বললে, আমরা ও-সব কায়দা-ফায়দার খবর জানব কোত্থেকে। তুমিই বলো।

টেনিদা তেলেভাজার ফাঁকা ঠোঙাটা খুঁজে একটা কিসের ভাঙা টুকরো পেলে। অগত্যা সেইটেই মুখে পুরে দিয়ে বললে, কায়দাটা বেশ মজার। ভুলোদা নজর করে দেখেছিল দেহাতী নাপিতদের মধ্যে বেশ সুন্দর একটা নিয়ম আছে। চুল-দাড়ি ছাঁটতে স্বজাতির কাছ থেকে ওরা কখনও পয়সা নেয় না। গিয়ে নমস্কার করে সামনে বসলেই বুঝে নেবে– এ আমার সমাজের লোক। তখন দিব্যি একখানা ফ্রি হেয়ার কাট! আসবার সময় আর-একটা নমস্কার করে উঠে এলেই হল– একটা পয়সা খরচ নেই।

ভুলোদাও শিখে গিয়েছিল। ব্যবসার কাজে এ-গাঁয়ে ঘুরে বেড়াতে, আসতে-যেতে দুটি নমস্কার ঠুকলেই ব্যস, কাজ হাসিল।

সেদিনও তাই করেছে। রাম রাম ভেইয়া বলে তো বসে পড়েছে এক নাপিতের সামনে, চুল ছাঁটাইয়ের সঙ্গে সঙ্গে দেহাতী ভাষায় নানান গপ্পো চলছে। চাষের অবস্থা কেমন, কোথায় ভাণ্ডা কে ভর্তা মানে বেগুনের ঘণ্ট দিয়ে আচ্ছা পুরী খাওয়া যায়, কোন গাছে তিনোয়া চুড়ৈল- মানে তিনটে পেত্নী রহতী বা। এই সব সদালাপের ভেতর দিয়ে ভুলোদার চুল কাটা তো শেষ হল।

চলে ভেইয়া–রাম রাম– বলে ভুলোদা পা বাড়াতে যাবে, তক্ষুনি একটা কাণ্ড হল।

সামনেই গঙ্গা। একটা খেয়া নৌকো ওপার থেকে এপারে লাগল। আর দেখা গেল, সেই নৌকো থেকে জনা পনেরো লোক এদিক পানেই আসছে। বুড়ো থেকে ছোকরা পর্যন্ত সব বয়সের লোক আছে তাদের ভেতর।

দেখেই নাপিতের চোখ কপালে উঠল। হায় রাম বলে খাবি খেল একটা। ভুলোদা গুটি-গুটি চলে যাচ্ছিল, হঠাৎ নাপিত খপ করে হাত চেপে ধরলে তার।

–এই ভাগতা কেঁও? বৈঠো।

ভুলোদা অবাক। পয়সা চায় নাকি? দেহাতী ভাষায় বললে, আমি পয়সা দেব কেন? আমি তো তোমার স্বজাত।

নাপিত বললে, সে বলতে হবে না আমি জানি। ওই যে পনেরোজন লোক আসছে, দেখছ না? ওদের কামাতে হবে এখন। আমি একা পারব কেন? তুমিও আমাদের স্বজাত-হাত লাগাও।

অ্যাঁ!

নাপিত টেনে ভুলোদাকে পাশে বসিয়ে দিলে। বললে, কী করবে ভেইয়া-দেশ গাঁয়ের নিয়ম তো মানতে হয়। ওরাও আমাদের জাত-কুটুম। গাঁয়ের লোক মরছে- তাই সবাই কামাতে আসছে এপারে।

নাপিত একটা খাবি খেয়েছিল, ভুলোদা চারটে বিষম খেল।

তা-তা–ওরা এপারে কেন? ওপারে কামালেই তো পারত।

নাপিত রেগে বললে, বুদ্ধ! স্বজাত হয়েও যেন কিছু জানো না। কামাবে কে–সবারই তো অশৌচ।

ভুলোদা ততক্ষণে হাঁ করে বসে পড়েছে। মুখের ভেতর টপাং করে একটা পাকা বটের ফল পড়ল, টেরও পেলে না। ব্যাপারটা এতক্ষণে বুঝতে পেরেছে। আর বুঝেই হাত-পা ঠাণ্ডা হয়ে গেছে তার।

বুঝলি! আরও সব মজার নিয়ম রয়েছে ওদের দেশে। গাঁয়ে কেউ মরলেই সমস্ত পুরুষমানুষকে মাথা কামাতে হবে- দাড়ি চাঁছতে হবে। তাই সবসুদ্ধু এপারে এসে পৌঁছেছে।

ভুলোদা তবু একবার শেষ চেষ্টা করলে। আমার বহু কাজ আছে পেটমে দরদ হচ্ছে–

এর মধ্যে পনেরোজন লোক এসে পড়েছে। নাপিত ধমক দিয়ে বললে আভি চুপ করো–ক্ষুর লে লেও। বলেই ভুলোদার হাতে ক্ষুর ধরিয়ে দিলে একখানা।

পনেরোজন এসে তো রাম রাম বলে নমস্কার করে গোল হয়ে বসে পড়ল। ভুলোদার তখন মাথা বোঁ বোঁ করে ঘুরছে-হাত-পা একেবারে হিম। ম্যালেরিয়ায় ভোগ্য রোগাপটকা লোক তো নয়–ইয়া ইয়া সব জোয়ান। সঙ্গে পাকা পাকা বাঁশের লাঠি। এমন করে ঘিরে বসেছে যে, পালানোর রাস্তাঘাট সব বন্ধ।

পয়সা দিয়ে দাড়ি কামাবার ভয়ে কোনওদিন ক্ষুর ধরেনি– চুলছাঁটা তো বেয়ারিং পোস্টেই চালিয়েছে এতকাল। মাথা-মুখ কামাবে কী– কিছুই জানে না। কিন্তু সে কথা বলবারও জো নেই। এক্ষুনি দিব্যি বিনি-পয়সায় চুল কেটে নিয়েছে। যদি বলতে যায়, আমি তোমাদের সমাজের লোক নই- তা হলে কেবল নাপিতই নয়, সবসুদ্ধ ষোলোজন লোক তাকে অ্যায়সা ঠ্যাভানি দেবে যে, ভুলোদা কেবল তক্তা নয়–একেবারে তক্তাপোশ হয়ে যাবে। চেয়ার টেবিল হয়ে যাওয়াও অসম্ভব নয়।

নাপিত ততক্ষণে একজনের মাথা জলে ভিজিয়েছে একটুখানি, তারপর ঘচাঘচ ক্ষুর চালাতে শুরু করেছে। আর একজন দিব্যি উবু হয়ে ভুলোদার দিকে মাথা বাড়িয়ে দিয়ে ঘুঘুর মতো বসে আছে।

ওদিকে ভুলোদা চোখ বুজে বলছে : হে মা কালী, এ যাত্রা আমায় বাঁচাও। তোমায় আমি সোয়া পাঁচ আনার নানাবড্ড বেশি হয়ে গেল সোয়া পাঁচ পয়সার পুজো দেব।

হাবুল চুকচুক করে বললে, ইস ইস! আইচ্ছা ফ্যাচাঙে তো পইড়া গেছে তোমার ভুলোদা।

আমি বললুম, কিন্তু কী কিপটে দেখেছিস! তখনও পয়সার দিকে নজরটা ঠিক আছে।

টেনিদা বললে, তা আছে! ওই জন্যেই তো মা কালী ওকে দয়া করলেন না। সাদাসিধে মানুষগুলোর হকের পয়সা এইভাবে ঠকানো! এখন বোঝ মজাটা।

ভুলোদা তো সমানে জপ করছে : মা–মা–সোয়া পাঁচ আনা না–না-সোয়া পাঁচ পয়সার পুজো দেব–আর এদিকে যে-লোকটা মাথা পেতে ঠায় বসেই ছিল, তার ঘাড়ে ব্যথা হয়ে গেছে। সে রেগে ভুলোদার পেটে একটা খোঁচা দিয়ে বললে, আরে হাঁ করকে কাহে বৈঠা হায়।হাত লাগাও–

ভুলোদা দেখল, আর উপায় নেই। তক্ষুনি লোকটার মাথায় ক্ষুর বসিয়ে দে এক টান।

জল-টল কিছু দেয়নি- চুল ভেজেনি ওভাবে ক্ষুর লাগালে কী হয়, বুঝতেই পারিস।

আরে হাঁ-হাঁ-ক্যা করতা–বলে লোকটা চেঁচিয়ে উঠল, আর ভুলোদা গি-গি-গি–বলে আওয়াজ তুলেই ঠায় অজ্ঞান।

সত্যি সত্যিই কি অজ্ঞান। আরে, না না। প্রাণটা তো বাঁচাতে হবে। তাই অজ্ঞান হওয়া ছাড়া ভুলোদা আর কোনও রাস্তা খুঁজে পেলে না।

তখন চারিদিকে ভারি গোলমাল শুরু হল।

–আরে, ক্যা ভৈল? ক্যা ভৈল? মর গেইল বা?– ক্ষুরের ঘায়ে যে-লোকটার চাঁদি ছুলে দিয়েছে সে পর্যন্ত তার পেল্লায় চাঁদিটা সামলে নিলে।

–এ জী, তুমারা ক্যা ভৈল? মানে– ওহে, তোমার কী হল?

ভুলোদা বলে চলল : গি-গি গি

তখন একজন বললে, ভূত পাকড়লি, কা?–মানে ভূতে ধরল।

সকলে একবাক্যে বললে, তাই হবে।

ব্যস আর কথা নেই। ষোলোজন লোক তক্ষুনি ভুলোদাকে চ্যাংদোলা করে নিয়ে চলল, যেভাবে শুয়োর নিয়ে যায় আর কি। ভুলোদার হাত-পা যেন ছিঁড়ে যেতে লাগল–একটুখানি নধর হুঁড়ি হয়েছিল, সেটা নাচতে লাগল ফুটবলের মতো কিন্তু ষোলোজনের কাছ থেকে বাঁচতে হলে চুপ করে থাকা ছাড়া উপায় নেই। তখন গলা দিয়ে গি গি নয়–সত্যিকারের গোঁ গোঁ বেরুচ্ছে।

নিয়ে ফেললে এক রোজার বাড়িতে। সবাই মিলে চেঁচিয়ে বললে, ভূত পাকড়লি।

রোজা বললে, ঠিক হ্যায়–আচ্ছাসে পাকড়ো।

অমনি সবাই মিলে ভুলোদার হাত-পা ঠেসে ধরলে। ভুলোদা তেমনি গোঁ-গোঁ করতে লাগল।

এদিকে রোজা কতকগুলো শুকনো লঙ্কার মতো কী পুড়িয়ে ভুলোদার নাকে ধোঁয়া দিতে শুরু করলে। ফ্যাঁচচো ফ্যাচচো করে হাঁচতে-হাঁচতে ভুলোদার তো নাড়ি ছিঁড়ে যাবার দাখিল।

তারপরেই রোজা করেছে কি কোত্থেকে একটা খ্যাংড়াঝাঁটা এনে– কীসব বিড়বিড় করে বকতে বকতে ভুলোদাকে ঝপাং ঝপাং করে পিটতে আরম্ভ করেছে।

ভুলোদার অবস্থা তখন বুঝতেই পারছিস! গলা ফাটিয়ে চেঁচাতে লাগল : বাবা-রে–মা-রে-ঠনঠনের কালী-রে– আমার দফা সারলে রে–আমি গেলুম রে!

নাপিতরা চোখ বড় বড় করে বললে, বাংলা বোল রহা।

তখন সবাই বললে, আঁ–বাঙালি ভূত পাকড়ালি। রাম রাম রাম।

রোজা মাথা নাড়লে। বললে, বাঙালির ভূত বহুৎ জব্বর ভূত। আরও জোরে ঝাঁটা চালাতে হবে।

ঝপাং ঝপাং ঝপাং! তার ওপরে নাকে সেই লঙ্কাপোড়ার গন্ধ। ভুলোদা আর কিছু টের পেল না।

উঠে বসল তিনঘণ্টা পরে। একটু একটু করে ব্যাপারটা খেয়াল হচ্ছে তখন। দেখলে, দুশো গাঁয়ের লোক তাকে ঘিরে দাঁড়িয়ে। তার মাথা পরিষ্কার করে কামানো–একেবারে ন্যাড়া মুখে একটি দাড়ির চিহ্ন নেই, এমন কি ভুরু পর্যন্ত নিটোলভাবে চাঁছা। চাঁদির ওপরে দুর্গন্ধ কী একটা প্রলেপ মাখানো-গা-ভর্তি জল আর কাদা।

হেসে রোজা বললে, হাঁ, অব ঠিক হেই। ভূত ভাগ গইল বা।

হাঁ সেই থেকে ভূত সত্যিই পালিয়েছে ভুলোদার। এখন আর সস্তায় কিস্তিমাত করতে চায় না। নিয়মিত সেলুনে গিয়ে নগদ আটগণ্ডা পয়সা খরচ করে চুল ছেঁটে আসে।

তাই বলছিলুম, ওরে ক্যাবলা–

রেগে ক্যাবলা উঠে দাঁড়াল : আমি তোমার ভুলোদার মতো বিনি পয়সায় চুল ছাঁটতে চাইছিলুম–এ কথা তোমায় কে বলে?

তারপর তেমনি কায়দা করে নাকের ওপর চশমাটাকে আরও উঁচুতে তুলে, আলেকজাণ্ডারের ভঙ্গিতে গটমটিয়ে চলে গেল সে।

ব্রহ্মবিকাশের দন্তবিকাশ

হাবলু আর ক্যাবলা কলকাতায় নেই। গরমের ছুটিতে একজন গেছে বহরমপুরে পিসিমার বাড়িতে আম খেতে, আর একজন মা বাবার সঙ্গে উধাও হয়েছে শিলঙে। এখন পটলডাঙা আলো করে আছি আমরা দুই মূর্তি আমি আর টেনিদা। টেনিদাকেও দিন তিনেক দেখা যাচ্ছে না–কোন তালে যে ঘুরছে কে জানে।

ভাবছি বলটুদার কাছেই যাই, বেশ সময় কাটবে। বলটুদা আবার টেনিদার নাম শুনতে পারে না বলে, টেনিদা আবার মানুষ নাকি? এক নম্বরের চালিয়াত, কেবল উষ্টুম-ধুষ্টুম গল্প বানাতে পারে- আর সকলের সঙ্গে মারামারি করতে পারে– ছোঃ ছোঃ! আর টেনিদা বলে, বল্টে? ওটা একটা গোভূত। ফুটবল-মাঠে একবার পেলে এমন একখানা ল্যাং মেরে দেব না যে, একমাস চিতপটাং হয়ে থাকবে।

বলটুদার কাছেই বেরুচ্ছি, হঠাৎ টেনিদার সঙ্গে দেখা।

কী রে, মুখখানা যে ভারি খুশি-খুশি দেখছি- একেবারে ছানার পোলাওয়ের মতো! বলি, যাওয়া হচ্ছে কোথায়?

প্রায় বলেই ফেলেছিলুম বলটুদার বাড়ি; কিন্তু সঙ্গে সঙ্গে সামলে নিলুম। তা হলেই আর দেখতে হত না– ফটাং করে একটা রামগাঁট্টা পড়ত মাথার ওপর। বললুম, এই ইয়ে–মানে–একটু হাওয়া খেতে যাচ্ছিলুম।

দুদ্দুর–হাওয়া আবার খায় কে? হাওয়া খাওয়ার কোনও মানে হয় নাকি? হাওয়া খেয়ে পেট ভরে? চপ, কাটলেট, পুডিং–এইসব খাবি?

শুনে, আমার রোমাঞ্চ হল।

বললুম, কেন খাব না আলবাত খাব। পেলেই খেতে থাকব! কে খাওয়াবে–তুমি?

টেনিদা আমার পিঠে ধাঁই করে চড় মারল একটা।

বদনাম দিসনি প্যালা বলে দিচ্ছি সেকথা।

বদনাম মানে?

আমি– এই টেনিরাম শর্মা কাউকে, কক্ষনো খাওয়াই না–নিজেই খেয়ে থাকি বরাবর। এ হচ্ছে আমার নীতি–মানে প্রিনসিপল। তোকে খাওয়াতে গিয়ে প্রিনসিপল নষ্ট করব? তুই তো দেখছি একটা নিরেট কুরুবক।

আমার বুকভরা আশা ধুক করে নিবে গেল। শুকনো মুখে বললুম, তবে কে খাওয়াবে? কার গরজ পড়ছে আমাকে চপ কাটলেট-পুডিং খাওয়াবে?

আছে-আছে–লোক আছে। সব খাবার সাজিয়ে বসে আছে। কেবল খেতে পারলে হয়।

অ–দোকানে।–আমি ব্যাজার হয়ে বললুম, খাওয়া-দাওয়ার কথা নিয়ে ঠাট্টা কোরো না টেনিদা, এসব খুব সিরিয়াস ব্যাপার। মনে ভীষণ ব্যথা লাগে।

তোর মগজে কিচ্ছু নেই, স্রেফ ঝিঙে-চচ্চড়িতে ভরতি। দোকান-টোকান নয়- একদম ফ্রি। তুই গেলেই টেবিল সাজিয়ে খেতে দেবে। কিন্তু খেতে পারবি না।

শুনে কেমন তালগোল পাকিয়ে গেল–টেবিল সাজিয়ে খেতে দেবে, অথচ খেতে পারব না? পচা-টচা বুঝি? নাকি কেষ্টনগরের মাটির তৈরি?

উঁহু আসল–ওরিজিন্যাল। একদম ফ্রেশ। খেতে দেবে, অথচ খেতে পারবি না। উলটে, চোখ কপালে তুলে মরতে মরতে ফিরে আসবি।

এ যে দেখছি রহস্যের খাসমহল তৈরি করছে। চপ কাটলেট-পুডিং নিয়ে এসব ধাষ্টামো আমার ভালো লাগে না। আমি রেগে বললুম, সব বানিয়ে বানিয়ে যা তা বলছ। আমি চললুম।

আহা-হা-চটে যাচ্ছিস কেন?–টেনিদা বললে, আমি তো তোকে নেমন্তন্ন করতেই আসছিলুম। সেইসঙ্গে বলতে আসছিলুম, খেতে দেবে অথচ খেতে পারবি নে, মাঝখান থেকে প্রাণ নিয়ে টানাটানি।

খেতে দিয়ে বুঝি লাঠিপেটা করে?

দ্যুৎ! খুব মিষ্টি মিষ্টি হেসে হাসির গল্প করে। আর সেই গল্পই মারাত্মক।

কিচ্ছু বুঝতে পারছি না।

মিটমিট করে হেসে টেনিদা বললে, তা হলে সবটা খুলে বলি তোকে। আয় বসা যাক একটু।

দুজনে মিলে বসে পড়লুম চাটুজ্যেদের বোয়াকে। টেনিদা বললে, ব্রহ্মবিকাশবাবুকে জানিস?

বললুম, না। অমন বিটকেল নামের কাউকে আমি চিনি না। চিনতে চাই না।

তিনিই খাওয়াতে চান।

খাওয়াতে চান তো খেতে দেন না কেন? তার মানে কী?

মানে–ওইটেই ওঁর রসিকতা।

অ্যাঁ!

বলছি, বলছি, বেশ মন দিয়ে শুনে যা। বুঝলি, ব্রহ্মবিকাশবাবুকে আমিও চিনতুম না। একদিন শ্ৰদ্ধানন্দ পার্কের সামনে নিজেই যেচে আলাপ করলেন আমার সঙ্গে। বললেন, তুমিই বুঝি পটলডাঙার টেনিরাম? বেশ বেশ! বড় আনন্দ হল। অনেক নাম শুনেছি তোমার তোমার বন্ধু প্যালারামের লেখা দু-একটা গল্পও পড়ে ফেলেছি। তা এসো না আজ বিকেলে অখিল মিস্তিরি লেনে আমার বাড়িতে। একসঙ্গে চা-টা খাওয়া যাবে।

বুঝলি, সে হল গত বছর পুজোর সময়, তোরা কেউ কলকাতায় নেই তখন। থাকলে তো দলবলসুদ্ধই নিয়ে যেতুম। কিন্তু গিয়ে বুঝলুম তোদের নিয়ে গেলে একটা কেলেঙ্কারি হয়ে যেত।

অখিল মিস্তিরি লেনে বেশ বড় বাড়ি পাট না ঝোলা গুড় কিসের যেন ব্যবসা করে অনেক টাকা জমিয়েছেন ব্রহ্মবিকাশবাবু। বিয়ে-থা করেননিঃ একা থাকেন, খুব ছিমছাম দারুণ পরিপাটি। বাড়িতে থাকবার মধ্যে একজন আধবুড়ো চাকর।

দরজার বেল টিপতেই সে এসে খুব খাতির করে নিয়ে গেল। একেবারে ডাইনিং হলে। সে একেবারে এলাহি কাণ্ড- বুঝলি! পট ভরতি চপ কাটলেট-সিঙাড়া, প্লেটে বোমার তালের মতো ইয়া এক পুডিং। কী সব দামী দামী কাপ-প্লেট, সে আর কী বলব তোকে। একটা চেয়ারে জাঁকিয়েই বসেছিলেন ব্রহ্মবিকাশবাবু, আমাকে দেখেই চিনিমাখা হাসি হেসে বললেন, এসো হে, তোমার জন্যেই বসে আছি।

খাবারের আয়োজন দেখেই তো আমার এক বচ্ছরের খিদে একসঙ্গে পেয়ে গেল। বললুম,হেঁ-হেঁ, কী সৌভাগ্য। বলেই, প্লেটে গোটা দুই কাটলেট একসঙ্গে তুলে নিলুম।

ব্ৰহ্মবিকাশ আড়চোখে একবার চেয়ে দেখলেন। তারপর মুচকি হেসে বললেন, এসো হে টেনিরাম, একটু মজা করে খাওয়া যাক। শুনেছি তুমি খুব খেতে পারো; আমিও খাইয়ে লোক। কম্পিটিশন হোক, দেখা যাক কে কত তাড়াতাড়ি খেতে পারে।

জানিস তো, এরকম কম্পিটিশনে আমি সর্বদাই রেডি। নিজের খাবার চক্ষের নিমেষে ফিনিশ করে কিভাবে তোদের প্লেটগুলি টেনে নিই–সে তো হাড়ে হাড়ে টের পাস তোরা।…বললুম, হেঁ-হেঁ, সে তো খুব আনন্দের কথা। মনেমনে ভাবলুম, দাঁড়ান মশাই, আজ ব্ৰহ্ম খাওয়া দেখিয়ে দেব আপনাকে।

কিন্তু

টেনিদা থামল। আমি আকুল হয়ে বললুম, কিন্তু কী?

দাঁড়া না ঘোড়াড্ডিম।–

মুখটাকে আলুভাজার মতো করে টেনিদা বললে, মনের দুঃখুটা একটু সামলে নিতে দে। বুঝলি, কিচ্ছু খেতে পারলুম না–একখানা মোশ্চম বিষম খাওয়া ছাড়া। আর আমি যখন কপালে চোখ তুলে ত্রিভুবন দেখছি, তখন সব খাবারগুলো ব্ৰহ্মবিকাশবাবু পরিপাটি করে খেয়ে ফেলেন।

কী রকম?

আরে সেইটেই তো প্যাঁচ। এক কামড়ে যেই আধখানা কাটলেট মুখে পুরেছি, ব্রহ্মবিকাশ বললেন, ওহে টেনিরাম, একটা মজার ব্যাপার শোনো। এক ভদ্দরলোক না– পকেটে একটা মস্ত ছুঁচো নিয়ে বাসে উঠেছেন। যেই পকেটমার সে-পকেটে হাত ঢুকিয়েছে, অমনি ছুঁচোটা ই-ক্রিচ বলে দিয়েছে তার আঙুলে কামড়ে

বুঝলি, সেরেফ একটা বাজে মিথ্যে কথা। কেউ কি ছুঁচো পকেটে নিয়ে বাসে ওঠে? ছুঁচো কি মানিব্যাগ না রুমাল? কিংবা চাবির রিং? কিন্তু এমন বিটকেল ভঙ্গিতে কথাটা বললেন যে শুনে আমার বেদম হাসি পেয়ে গেল। সেই হাসির চোখে আধখানা কাটলেট গলায় গিয়ে আটকাল- দম আটকে যাই আর কি! চাকরটা বোধহয় জল হাতে রেডিই ছিল; মাথায় থাবড়ে-থাবড়ে জল দিতে যখন আমি খানিকটা সুস্থ হলুম–তখন বুঝলি, প্রায় সব ফিনিশ–কেবল আমার পাতের সেই আধখানা কাটলেট পড়ে আছে। গোটাটা উনিই তুলে মেরে দিয়েছেন।

চুকচুক করে বললেন, আহা-হা টেনিরাম, বিষম খেয়ে কম্পিটিশনে হেরে গেলে? খাবার তো আর নেই– একটু চা খাবে নাকি?

চা খেতে গিয়ে আবার একখানা বিষম খাই আর কি! আমি ঘোঁত ঘোঁত করে বেরিয়ে এলুম।

টেনিদার কথা শুনে আমি বললুম, ওটা অ্যাকসিডেন্ট। হঠাৎ বিষম খেয়েই তুমি খেতে পেলে না।

মোটেই না। ওই হচ্ছে ওঁর কায়দা। রাস্তায় বেরিয়ে চার-পাঁচটা ছেলের সঙ্গে দেখা। দুজন আমাকে চেনে। একজন ওই বিশু–সুরেন্দ্রনাথ কলেজে ব্যাক খেলে। বিশু বললে, ব্যাপার কী টেনিদা? ব্রহ্মবিকাশ চোংদারের বাড়ি বুঝি খেতে গিয়েছিলে? প্রাণ নিয়ে ফিরেছ তো?

আমি তো থ।

তাদের কাছেই শুনলাম। এ হল ব্ৰহ্মবিকাশবাবুর খুব মজার খেলা। লোককে খেতে বলেন, তারা খাওয়া শুরু করলেই বিচ্ছিরি ভঙ্গিতে একটা উদ্ভট কথা বলে দেন। সে তক্ষুনি বিষম খায় : প্রাণ নিয়ে টানাটানি পড়ে আর সেই ফাঁকে ব্রহ্মবিকাশ সব সাফ করে দেন। এই সেই কথামালার শেয়াল আর সারসের গপ্পোর মতো-বুঝেছিস?

আমি শুনে বললাম, কেউ যদি না হাসে, রামগরুড় হয়?

রামগরুড়কেও হাসিয়ে দেবেন : এমনি ওঁর বলার কায়দা। তুই আমি কী রে- একবার এক জাঁদরেল কাবুলিওয়ালাকে পর্যন্ত।

কাবুলিওয়ালা! তাকে পেলেন কোথায়?

কী করবেন! কেউ তো আর আসে না- সবাই চিনে ফেলেছে কিনা। শেষে রাস্তা থেকে এক কাবুলিওয়ালাকে অনেক ভুজুং ভাজুং দিয়ে ডেকে আনলেন। তারপর খেতে দিয়েই শুরু করলেন- সমঝা হ্যায় আগা সাহেব, এক আদমিকো বহুৎ লম্বে দাড়ি থা। ওহি দাড়িমে এক জিন তো ঘুস গিয়া। যব উয়ো আদমি কু খানেকো নিয়ে মুখে হাত লে যাতা, তব ওহি জিন সেই সব লাড্ডু-মণ্ডা ঝাঁ করে কেড়ে লেতা, আর দাড়িমে ছিপায়কে আপনি খা লেতা।

মানে, বুঝলি না, একটা লোকের লম্বা দাড়ির ভেতরে জিন–মানে একটা দৈত্য ঢুকে গিয়েছিল। লোকটা লাড্ডু-মণ্ডা কিছু খাবার জন্যে মুখ তুললেই ঝাঁ করে কেড়ে নিয়ে দাড়িতে লুকোনো দৈত্যটা সেগুলো খেয়ে ফেলত।…যেই বলা–কাবুলিওয়ালা অ্যায়সা বিষম খেল যে তিন দিন হাসপাতালে। তারপর সেই-যে দেশে চলে গেল, আর তার পাত্তা নেই।

আমি বললুম, কী ডেনজারাস!

শুধু ডেনজারাস? যাকে বলে পুঁদিচ্চেরি। কিন্তু এখন হয়েছে কী, আজ সকালে ওঁর সঙ্গে আমার দেখা হয়েছিল। বললেন, টেনিরাম, অনেকদিন তো তোমার সঙ্গে চা খাওয়া হয়নি, এসো না আজ বিকেলে। বেশ মজার গপ্পো-টগ্লো করা যাবে। আমি বললাম, আমার বন্ধু প্যালাকেও সঙ্গে আনব নাকি? উনি বললেন, সে তো খুব ভালো কথা নিশ্চয় নিয়ে আসবে। কী রে যাবি?

আঁতকে বললুম, উঁহু, নেভার। আমি চপ কাটলেট খেতে চাই, বিষম খেতে চাই না।

খুব গম্ভীর হয়ে টেনিদা একটু ভাবল। তারপর বললে, লুক হিয়ার, প্যালা।

ইয়েস স্যার।

ইয়ার্কি দিসনি ব্যাপারটা খুব পুঁদিচ্চেরি–একেবারে মেফিস্টোফিলিস যাকে বলে। আমি একটা প্ল্যান ঠাউরেছি।

কোনও প্ল্যানের ভেতরে আমি নেই। আমার আবার একটুতেই দারুণ হাসি পায়। মারা যাব নাকি শেষ পর্যন্ত?

দাঁড়া না কাঁচকলা। শোন। যেই উনি বেয়াড়া একটা হাসির গল্প আরম্ভ করবেন না–তুই কটাস করে আমাকে একটা চিমটি লাগাবি; আমিও একটা লাগিয়ে দেব তোকে। ব্যস আর হাসাতেই পারবেন না। তারপর–ডিলা–গ্র্যান্ডি—হুঁ, মাথায় একটা মতলব এসেছে। দিচ্ছি আজকে ব্রহ্মবিকাশ চোংদারকে ম্যানেজ করে। এখন উঠে পড়ছটা বাজে, কুইক।

আমি যাব না।

তোকে যেতেই হবে। নইলে এক থাপ্পড়ে তোর কান

কানপুরে পাঠিয়ে দেব।

ইয়া! একদম কারেক্ট! ওঠ–কুইক-কুইক

.

কী করা যায়, যেতেই হল ব্রহ্মবিকাশের বাড়িতে। টেনিদা যা বলেছিল ঠিক তাই। সেই বাড়ি, সেই আধবুড়ো চাকর, সেই ডাইনিং হল। চেয়ারে ব্রহ্মবিকাশ চোংদার। আর টেবিলে–

সে আর কী বলব। দেখলেই মনে হয় ঝাঁপিয়ে পড়ি। কিন্তু হাসি হাসি মুখে ব্রহ্মবিকাশ তাকিয়ে আছেন তিনি সবাইকে খেতে ডাকবেন, অথচ কাউকে খেতে দেবেন না। এরকম যাচ্ছেতাই লোক যে সংসারে থাকতে পারে আমি জানতুম না।

ব্ৰহ্মবিকাশ মুচকে মুচকে হাসছিলেন আর রাগে আমার গা জ্বলে যাচ্ছিল। বললেন, তুমিই বুঝি প্যালারাম? শিঙিমাছ দিয়ে পটোলের ঝোল খেতে বুঝি খুব ভালোবাস?

বললুম, সে আগে খেতুম–ছেলেবেলায়। এখন কালিয়া কাবাব কোর্মা খেয়ে থাকি।

ভালো–ভালো। আরে মানুষ তো খাওয়ার জন্যেই বেঁচে থাকে। এসো, লেগে যাও। কম্পিটিশন হোক। দেখা যাক, কে আগে খেতে পারে।

টেনিদা আমার গা টিপল।

তারপর যা হল, সংক্ষেপে বলি।

একটা গরম-গরম ফুলকপির সিঙাড়ায় সবে কামড় বসিয়েছি হঠাৎ ব্রহ্মবিকাশ বললেন, একটা কাণ্ড হয়েছে শোনো। এক লোকের খুব নাক ডাকত। তার ঘরে চোর ঢুকেছে। আর তক্ষুনি একটা গুবরে পোকা বোঁ করে উড়ে বসেছে লোকটার নাকে। তার নাক ডাকার ধাক্কায় গুবরে পোকাটা বুলেটের মতো ঠিকরে গিয়ে ঠাস করে চোরটার কপালে

বলার কায়দাই এমনি যে তক্ষুনি স্রেফ আমার অপঘাত ঘটে যেত। কিন্তু সঙ্গে সঙ্গে আমার হাঁটুতে টেনিদার এক রামচিমটি আর আমিও টেনিদার পিঠে আর এক মোক্ষম চিমটি। দুজনেই এক সঙ্গে চ্যাঁ করে উঠলুম।

ব্ৰহ্মবিকাশ কেমন বোকা বনে গেলেন; তক্ষুনি থেমে গেল গল্পটা।

অ্যা–কী হল তোমাদের?

আমার হাঁটু জ্বালা করছিল, টেনিদারও যে খুব আরাম লাগছিল তা নয়। উচ্ছে খাওয়া-মুখে টেনিদা বললে, আজ্ঞে–ইয়ে–হয়েছে কী, হাসির গল্প শুনলেই আমাদের কেমন কান্না পায়।

কান্না পায়!

পায় বইকি। শিব্রামের গপ্পো পড়তে গেলেই তো প্যালার দাঁতকপাটি লাগে। আমি তো সুকুমার রায়ের পাগলা দাশু পড়ে এত কেঁদেছিলুম যে বাড়িময় জল থইথই।

অ্যাঁ!

ব্ৰহ্মবিকাশ সামলে নিতে চেষ্টা করলেন, সেই ফাঁকে আমাদের হাত চলতে লাগল। তারপরেই এহে–ভারি দুঃখের কথা বলে, ভীষণ ব্যাজার হয়ে দুটো চিংড়ির কাটলেটে টান দিলেন, টেনিদা আবার একটা তাঁর হাত থেকে প্রায় কেড়ে আনল।

ব্রহ্মবিকাশ বোধহয় আর-একটা কিছু ঠাওরাতে যাচ্ছিলেন, হঠাৎ টেনিদা বললে, ব্রহ্মবিকাশবাবু

প্রাণপণে কাটলেট চিবুতে চিবুতে ব্রহ্মবিকাশ বললেন, অ্যাঁ?

আপনি তো হাসির গপ্পো জানেন, আমি খুব ভালো ম্যাজিক জানি।

অ্যাঁ!

এই যে দুটো জলের গেলাস দেখছেন, দূর থেকে এই গেলাসের জল আমি বদলে দেব। কখনও লাল হয়ে যাবে, কখনও নীল, কখনও হলদে, কখনও বেগুনী, কখনও সবুজ। শুধু মন্তর পড়ে।

শুনে ব্রহ্মবিকাশের চিবুনি থেমে গেল।

অ্যাঁ! তাও কি হয় নাকি? পিসি সরকার হলে নাকি হে?

পি-সি সরকার! তিনি তো আমার কাছে এটা শেখবার জন্যে ঝুলোঝুলি, আমিই শেখাইনি। দেখতে চান ম্যাজিকটা? নিন হাত পাতুন, নানা উলটো করে দুহাতের পাতা মেলে দিন টেবিলের ওপর। ইয়া–কারেক্ট।

ব্রহ্মবিকাশ কিছু না বুঝেই হাতের পাতা উবুড় করে টেবিলে মেলে দিয়েছিলেন। তিনি জানলেন না যে কী হারাইতেছেন? এবং পত্রপাঠ টেনিদা দুটো জলভরতি গ্লাস তাঁর দুহাতের চেটোয় বসিয়ে দিলে।

ধরে থাকুন– ধরে থাকুন। ধৈর্য ধরে বসে থাকুন; আস্তে আস্তে জল নীল হবে– লাল হবে হলদে হবে–বেগুনী হবে–প্যালা, কুইক কুইক।

আর বলবার অপেক্ষা রাখে? আমি তখন কুইক নই–কুইকেস্ট! আর টেনিদা চালাচ্ছিল একেবারে জেট-প্লেনের স্পিডে।

ব্ৰহ্মবিকাশ হাহাকার করে উঠলেন।

আরে–আরে—

আরে–আরে নয়, চুপ করে বসে থাকুন। এসব ম্যাজিকে একটু সময় লাগেই স্যার। অনেক হাসির গপ্পো শুনিয়েছেন; আজ একটু ম্যাজিক দেখুন। হাত নাড়তে চেষ্টা করলে আপনার দামী গেলাসেরই বারোটা বাজবে, আমার কী! হবে–হবে– নীল হবে, লাল হবে– সবুজ হবে–সব হবে! একটু ধৈর্য ধরুন; হাসি হাসি মুখে বসে থাকুন, ভাবতে চেষ্টা করুন হোকাস-পোকাস-গিলি-গিলি। প্যালা–কুইক–কুইক—

গেলাসের মায়ার ব্রহ্মবিকাশ হাঁ করে বেকুবের মতো বসে রইলেন, চাকরটাকে ডাকবার কথা পর্যন্ত তাঁর মনে এল না। আর সেই ফাঁকে আমরা

না–না, আমরা একেবারে ছোটলোক নই। উনি চিংড়ির যে কাটলেটটা আধখানা খেয়েছিলেন, সেটা ওঁর জন্যেই রেখে এসেছিলুম।

ভজগৌরাঙ্গ কথা

হাবুল সেন বর্ধমানে মামার বাড়ি বেড়াতে গেছে। ক্যাবলা গেছে বাবা-মার সঙ্গে নাইনিতালে। তাই পুজোর ছুটিতে পটলডাঙা আলো করে আছি চার মূর্তির দুজন–আমি আর টেনিদা।

বিকেলবেলা ভাবছি, ধাঁ করে লিলুয়ায় ছোট পিসিমার বাড়ি থেকে একটু বেড়িয়ে আসি–হঠাৎ বাইরে থেকে টেনিদার গাঁকগাঁক করে চিৎকার!

–প্যালা, কাম–কুইক!

নতুন ডাক্তার মেজদা হসপিটালে গোটাকতক রুগী-টুগী মেরে ফিরে আসছিল। নিজের ঘরে ঢুকতে ঢুকতে দাঁত খিঁচিয়ে আমায় বলে গেল : যাও জাম্বুবান–তোমার দাদা হনুমান তোমায় ডাকছে। দুজনে মিলে এখন লঙ্কা পোড়াওগে।

জাম্বুবান কখনও লঙ্কা পোড়ায়নি–মেজদাকে এই কথাটা বলতে গিয়েও আমি বললুম না। ওকে চটিয়ে দিলে মুশকিল। একটু পেটের গণ্ডগোল হয়েছে কি, সঙ্গে সঙ্গে সাতদিন হয়তো সাগু বার্লি কিংবা স্রেফ কাঁচকলার ঝোল খাইয়ে রাখবে, নইলে পটাং করে পেটেই একটা ইনজেকশান দিয়ে দেবে। তাই মিথ্যে অপবাদটা হজম করে যেতে হল।

আবার টেনিদার সেই পাড়া কাঁপানো বাজখাঁই হাঁক প্যালা, আর ইউ ডেড?

টেনিদার চিৎকার শুনলে মড়া অবধি লাফিয়ে ওঠে, আর আমি তো এখনও মারাই যাইনি। হুড়মুড় করে দোতলা থেকে নেমে এসে বললুম কী হয়েছে, চ্যাঁচাচ্ছ কেন অত?

টেনিদা আমার চাঁদির ওপর কড়াং করে একটা গাট্টা মারল। বললে : তুই একটা নিরেট ভেটকি মাছ। আমি তো শুধু চ্যাঁচাচ্ছি ব্যাপারটা শুনলে তুই একেবারে ভজ গৌরাঙ্গ ভজ গৌরাঙ্গ বলে দু-হাত তুলে নাচতে থাকবি। যাকে বলে, নরীনৃত্যতি।

কাণ্ডটা দ্যাখো একবার–টেনিদা সংস্কৃত আওড়াচ্ছে। পণ্ডিতমশাই একবার ওকে গো শব্দরূপ জিজ্ঞেস করায় বলেছিল, গৌ–গৌবৌ-গৌবরঃ। শুনে পণ্ডিতমশাই চেয়ার থেকে উলটে পড়ে যেতে যেতে সামলে গিয়েছিলেন। আর ওকে বলেছিলেন– কী বলেছিলেন, সেটা নাইবা শুনলে!

কিন্তু সংস্কৃত যখন বলছে, তখন ব্যাপারটা নিশ্চয় সাংঘাতিক। বললুম : খামকা আমি নাচব কেন? আর যদিই বা নাচি, ভজ গৌরাঙ্গ বলব কেন? তোমার নাম ধরে ভজহরি ভজহরি বলেও তো নাচতে পারি! (তোমরা তো জানোই, টেনিদার পোশাকী নাম ভজহরি মুখুজ্যে।)

টেনিদা আমার নাকের সামনে বুড়ো আঙুল নাচিয়ে বললে : ভজহরি বলে নাচলে কচুপোড়া পাবি। আরে, আজ সন্ধের পর ভজগৌরাঙ্গবাবু যে পোলাও-মাংস খাওয়াচ্ছেন। তোকে আর আমাকে।

শুনে খানিকক্ষণ আমি হাঁ করে থাকলুম।

-কে খাওয়াচ্ছে বললে?

–ভজগৌরাঙ্গবাবু।

আমার হাঁ-টা আরও বড় হল : ভালো করে বলো, বুঝতে পারছি না।

বলেই বুঝতে পারলুম, কী ভুলটাই করেছি। টেনিদা সঙ্গে সঙ্গে আমার কানের কাছে মুখ এনে ভজগৌরাঙ্গ বলে এমন একখানা হাঁক ছাড়ল যে আমি আঁতকে তিন হাত লাফিয়ে উঠলুম। কান কনকন করতে লাগল, মাথা বনবন করে উঠল!

টেনিদা হিড়হিড় করে টানতে টানতে আমাকে চাটুজ্যেদের বোয়াকে নিয়ে এল। বললে : শুনে যে তোর মুচ্ছো যাওয়ার জো হল দেখছি। বিশ্বেস হচ্ছে না বুঝি?

বাঁ-দিকের কানটা চেপে ধরে আমি বললুম : ভজগৌরাঙ্গ আমাদের মাংসপোলাও খাওয়াবে?

–আলবত। তোকে আর আমাকে।

–ভজগৌরাঙ্গ সমাদ্দার?

নির্ঘাত!

বলে কী টেনিদা? পাগল হয়ে গেছে না পেট খারাপ হয়েছে? ভজগৌরাঙ্গবাবুর মতো কৃপণ সারা কলকাতায় আর দুজন নেই। একাই থাকেন। ওঁর ছেলে রামগোবিন্দ চাকরি পেয়েই নিজের মাকে নিয়ে কেষ্টনগরে চলে গেছে–মানে পালিয়ে বেঁচেছে। ভজগৌরাঙ্গ পাটের দালালি করছেন, আর টাকা জমাচ্ছেন। বাড়ির সামনে ভিক্ষুক এলে লাঠি নিয়ে তাড়া করেন। একবার গোটাকয়েক ডেয়ো পিঁপড়ে ওঁর একটুখানি চিনি খেয়ে ফেলেছিল, ভদ্রলোক পিঁপড়েগুলোকে ধরে একটা শিশিতে পুরে রাখলেন আর পর পর তিনদিন সেই পিঁপড়ে দিয়ে চা করে খেলেন। সেই ভজগৌরাঙ্গ পোলাও-মাংস খাওয়াবেন আমাকে আর টেনিদাকে? উঁহু, মাথা খারাপ হলেও একথা লোকে ভাবতে পারে না। টেনিদারই পেট খারাপ হয়েছে!

টেনিদা বললে : অমন শিঙাড়ার মতো মুখ করে, ছাগলের মতো তাকিয়ে আছিস যে? তা হলে সব খুলে বলি, শোন!

কাল শেষরাত্তিরে ছোট কাকা সরকারি কাজে এরোপ্লেনে চেপে সিঙ্গাপুরে গেছে। আমি দমদমে ছোট কাকাকে তুলে দিয়ে যখন ট্যাক্সি করে বাড়ি ফিরেছি, তখন রাত চারটে। গলির মধ্যে ঢুকেই দেখি যে এক যাচ্ছেতাই ব্যাপার! একটা লোক ল্যাম্পপোস্টের ওপর ঝুলছে; আর নীচ থেকে একজন পাহারাওলা উতারো-উতারো বলে তার ঠ্যাং ধরে টানছে।

এগিয়ে এসে দেখি ল্যাম্পপোস্ট ধরে যে-লোকটা ঝুলছে, সে আর কেউ নয়–ভজগৌরাঙ্গবাবু!

বলল কী–ভজগৌরাঙ্গবাবু? তা শেষরাত্তিরে ল্যাম্পপোস্ট ধরে ঝুলতে গেল কেন?

–আরে, সেইটেই তো গণ্ডগোল! পাহারাওলা তো এক হ্যাঁচকা টানে ভজগৌরাঙ্গকে চালকুমড়োর মতো ধপাত করে নামিয়ে নিলে। তারপর বলে, তো ইলেকট্রিকের তার চুরি করতা হ্যায়–চলো থানামে! আর ভজগৌরাঙ্গ হাঁউমাউ করতে থাকে, আমি শেষ রাত্রে বৈঠকে বৈঠকে হিসাব লিখতা থা, একঠো কাগজ উড়কে ল্যাম্পপোস্টকে উপরে গিয়ে লটকে গিয়া, সেইঠো পাড়তে গিয়া। পাহারাওলা তা বিশ্বেস করবে কেন? খালি বলে, তোম চোর হ্যায়–চলো থানামে।

আমাকে দেখেই ভজগৌরাঙ্গবাবুর সেকি কান্না! বলে, বাবা টেনি, আমায় বাঁচাও। এই বুড়ো বয়েসে চোর বলে ধরে নিয়ে গেলে আমি আর বাঁচব না।

যাই হোক, আমি পাহারাওলাকে অনেক বোঝালুম। বললুম, এ দারোগা সাব–এ লোক আচ্ছা আদমি, চুরি নেহি করতা। ছোড় দিজিয়ে দারোগা সাহেব।–দারোগা সাহেব বলাতে লোকটা একটু ভিজল। খানিকটা খইনিটইনি খেয়ে, ভজগৌরাঙ্গবাবুর টিকিতে একটা টান দিয়ে বলল, আচ্ছা, আজ ছোড় দেতা। ফের যদি তুম্ ল্যাম্পপোস্টে উঠে গা, তো তুমকো ফাঁসি দে দেগা।–বলে চলে গেল।

তখন ভজগৌরাঙ্গ আমার হাত জড়িয়ে ধরলেন। বললে, বাবা টেনি, তুমি আমায় ধনে-প্রাণে বাঁচিয়েছ। একথা কাউকে বোলো না–তা হলে পাড়ায় মুখ দেখাতে পারব না। তোমাকে আমি চারটে পয়সা দিচ্ছি, ডালমুট খেয়ো। আমি বললুম, অত সস্তায় হবে না স্যার! যদি আমাকে আর প্যালাকে কাল সন্ধেয় পোলাও-মাংস খাওয়াতে পারেন, তবেই ব্যাপারটা চেপে যাব।

শুনে বুড়োর চোখ কপালে চড়ে গেল। বলে, এই গরমে পোলাও-মাংস খেতে নেই বাবা-শেষে অসুখ করে পড়বে। তার চে বরং দুই আনা পয়সা দিচ্ছি-তুমি আর প্যালারাম বোঁদে কিংবা গুজিয়া কিনে খেয়ো। পাকৌড়াও খেতে পারো।

আমি বললুম, এই আশ্বিন মাসে মোটেই গরম নেই–ওসব বাজে কথা চলবে না। জেলের হাত থেকে বাঁচালুম, একশো-দুশো টাকা ফাইনও হতে পারত, তার বদলে কিনা বোঁদে আর পাকৌড়া। বেশ, কিছু খাওয়াতে হবে না আপনাকে। সকাল হলেই আমি আর প্যালা দুটো চোঙা মুখে নিয়ে রাস্তায় বেরুব। আমি বলব–পটলডাঙার ভজগৌরাঙ্গ, প্যালা বলবে–তার-চোর। আমি বলব–পুলিশ ধরে কাকে? প্যালা বলবে–ভজগৌরাঙ্গকে। ব্যাস–বুড়ো একদম ঠাণ্ডা। সুড়সুড় করে রাজি হয়ে গেল। বুঝলি প্যালা–একেই বলে পলিটিকস্।

তা হলে আজ সন্ধেয় আমরা পোলাও কালিয়া খাচ্ছি? ভজগৌরাঙ্গের বাড়িতে?

–নিশ্চয়। ঠেকাচ্ছে কে?

এবারে সত্যি সত্যিই আমি নেচে উঠলুম! চেঁচিয়ে বললুম : ডি-লা গ্র্যান্ডি মেফিস্টোফিলিস–

টেনিদা বলল :ইয়াক–ইয়াক!

.

সন্ধের পরে ভজগৌরাঙ্গের বাড়ি গিয়ে তো সমানে কড়া নাড়ছি দুজনে। পুরো পনেরো মিনিট কড়া নাড়বার পরেও কোনও সাড়াশব্দ নেই। বুড়ো চুপ করে ঘাপটি মেরে বসে আছে ভেতরে। সারা রাত কড়া নাড়লেও দরজা খুলবে বলে মনে হল না।

আমি বললুম : হল তো? খাও এখন পোলাও-কালিয়া। পিঁপড়ে দিয়ে ও চা খায়–ওর কথায় তুমি বিশ্বাস করলে?

টেনিদা খেপে গেল। খাড়া নাকটাকে গণ্ডারের মতো উঁচু করে বললে : দরজা খুলবে না। দাঁড়া–খোলাচ্ছি। আমি বলছি–ভজগৌরাঙ্গ–তুই সঙ্গে সঙ্গে বলবি–

মনে আছে। হাঁক পাড়ো

টেনিদা যেই আকাশফাটা চিৎকার তুলেছে–ভজগৌরাঙ্গ, আর আমি কাঁসরের মতো ক্যানকেনে গলায় জবাব দিয়েছি–তার-চোর,–অমনি চিচিং ফাঁক! ক্যাঁচ দরজা খুলে গেল। একমুখ কাঁচা-পাকা দাড়ি নিয়ে ভজগৌরাঙ্গ বেরিয়ে এলেন সুট করে।

–আহা-হা, করছ কী! চুপচুপ!

–চুপচুপ মানে? আধ ঘণ্টা ধরে কড়া নাড়ছি–কোনও সাড়াই নেই? ভেবেছেন কি আপনি? প্যালা–এগেইন।–

ভজগৌরাঙ্গ তাড়াতাড়ি বললেন : না-না–এগেইন নয়! আহা-হা, বড় কষ্ট হয়েছে তো তোমাদের। আমি কড়ার আওয়াজ শুনতেই পাইনি। মানে–এই–পেট ব্যথা করছিল কিনা, তাই একটু ঘুমিয়ে পড়েছিলুম। এসো–এসো–ভেতরে এসো

বারান্দায় একটা ছেঁড়া মাদুর পাতা, তার একপাশে কতকগুলো হিসেবের কাগজপত্র। একটা লণ্ঠন মিটমিট করে জ্বলছে। বাড়িতে ইলেকট্রিকের লাইন নিয়ে পয়সা খরচ করবেন, এমন পাত্রই নন ভজগৌরাঙ্গ। কাগজপত্রগুলো সরিয়ে দিয়ে বললেন : বোসো বাবা বোসো, একটু জিরোও আগে।

টেনিদা বলল : জিরোবার দরকার নেই, দোরগোড়ায় আধ ঘণ্টা জিরিয়েছি আমরা। পোলাও-কালিয়া কোথায় তাই বলুন!

–পোলাওকালিয়া?–ভজগৌরাঙ্গ খাবি খেলেন।

হুঁ, পোলাওকালিয়া!–টেনিদা বাঘাটে গলায় বললে; সেই রকমই কথা ছিল। কোথায় সে?

ভজগৌরাঙ্গ বললেন : এঃ, তাই তো একেবারে মনেই ছিল না। মানে সারা দিন খুব পেটের ব্যথায় কষ্ট পাচ্ছিলুম কিনা, সেইজন্যেই তা ইয়ে, তোমাদের বরং চার আনা পয়সা দিচ্ছি, শেয়ালদায় পাঞ্জাবিদের দোকানে গিয়ে দুআনার মাংস আর দুআনার পুরি

আমি বললুম : দু আনায় মাংস দেয় না, চিবুনো-হাড় দিতে পারে একটুকরো।

টেনিদা গর্জন করে বললে : চালাকি? ফাঁকি দেবার মতলব করেছেন? জেল থেকে বাঁচিয়ে দিলুম–তার এই প্রতিদান? যাক, আমরা কিছু খেতে চাই না। চল প্যালা–এখুনি বেরিয়ে পড়ি চোঙা নিয়ে।

–আহা-হা, চোঙা আবার কেন?–ভজগৌরাঙ্গ ব্যস্ত হয়ে উঠলেন : চোঙা-টোঙা খুব খারাপ জিনিস। ছিঃ বাবা টেনি, চোঙা নিয়ে চেঁচাতে নেই–ওতে লোকের শান্তি ভঙ্গ হয়।

–সে আমরা বুঝব। আমরা চোঙা ফুঁকে আপনাকে শিঙে ফুঁকিয়ে ছাড়ব। প্যালা–চলে আয়–

–আহা, থামো—থামো–ভজগৌরাঙ্গ টেনিদার হাত চেপে ধরলেন। তারপর ডিম ভাজার মতো করুণ মুখ করে মিহিদানার মতো মিহি গলায় বললেন : নিতান্তই যদি খাবে, তা হলে আমার খাবারটাই খেয়ে যাও। আমি নয় আজ রাতে এক গ্লাস জল খেয়েই শুয়ে থাকব।–বলেই ভজগৌরাঙ্গের দীর্ঘশ্বাস পড়ল।

–আপনার খাবারটা কী?–আমার সন্দেহ হল।

–ভালো মাছ আছে আজকে–পুঁটি মাছ ভাজা। সেই সঙ্গে পান্তা ভাত। দশ দিন পরে দুগণ্ডা পয়সা দিয়ে একটুখানি মাছ এনেছিলুম আশা করে, কিন্তু কপালে না থাকলে। আবার বুকভাঙা দীর্ঘশ্বাস ভজগৌরাঙ্গের।

বটে, পুঁটি মাছ ভাজা আর পান্তো ভাত। ও রাজভোগ আপনিই খান মশাই। পালা, চোঙা দুটো রেডি আছে তো? চল–বেরিয়ে পড়ি

ভজগৌরাঙ্গ কাঁউকাঁউ করে কী বলতে যাচ্ছিলেন, হঠাৎ খটখট করে বাজের মতো বেজে উঠল দরজার কড়া। সঙ্গে সঙ্গে বিদঘুটে মোটা গলায় কে বললে : ভাজগুড়ুংবাবু হ্যায়–ভাজগুড়ুং বাবু?

ভজগৌরাঙ্গ থমকে থেমে গেলেন। টেনিদা জিজ্ঞেস করলে : কোন্ হ্যায়?

আবার সেই মোটা গলা শোনা গেল : হামি লালবাজার থানা থেকে আসছে।

ভজগৌরাঙ্গ ঠকঠক করে কেঁপে উঠলেন।

–এই সেরেছে! টিকিটা টেনে দিয়েও পাহারাওয়ালা রাগ যায়নি নির্ঘাত লালবাজারের গিয়ে নালিশ করেছে–আর পুলিশে আমায় ধরতে এসেছে। বাবা টেনি, কাল মাংস পোলাও-চপ-কাটলেট সব খাওয়াব, আমাকে আজ যেমন করে হোক বাঁচাও।

বাইরে থেকে আবার আওয়াজ এল : জলদি দরজা খুলিয়ে দেন হামি লালবাজারসে আসছে!

–ওকে বলো–ইয়ে, তোমরা আমার ভাইপো, আর আমি তিন মাসের জন্যে দিল্লি গেছি বলেই ভজগৌরাঙ্গ চট করে অন্ধকার ঘরে ঢুকে পড়লেন, তারপরই একেবারে তক্তপোশের তলায়। সেখান থেকে কুকুরের বাচ্চার ডাকের মতো কুঁকুঁ করে আওয়াজ উঠতে লাগল। বোঝা গেল, ভজগৌরাঙ্গ প্রাণপণে কান্না চাপবার চেষ্টা করছেন।

–এ ভাজগুড়ুং বাবু–দরজা খোলিয়ে

টেনিদা ফিসফিস করে বললে : ব্যাপার সুবিধে নয় রে প্যালা, লালবাজারের পুলিশ কেন আবার? বুড়োর জন্যে আমরাও ফেঁসে যাব নাকি?

আমি বললুম : আমরা তো কখনও ল্যাম্পপোস্টে উঠিনি, আমাদের ভয় কিসের? দরজা খুলে দেখাই যাক।

তক্তপোশের তলায় আবার কুঁকুঁ করে আওয়াজ উঠতে লাগল।

টেনিদা দরজা খুলল ভয়ে ভয়ে। বাইরে খাকী জামাপরা এক পুলিশের লোক দাঁড়িয়ে তার হাতে একটা মস্ত বড় হাঁড়ি। আমাদের দেখেই এক প্রকাণ্ড স্যালুট ঠুকল। তারপর একটা চিঠি দিয়ে বললে : চটর্জি সাহেব দিয়া। হামি সাহাবকো আরদালী আছে।

রাস্তার আলোয় চিঠিটা পড়ে দেখলুম আমরা। কেষ্টনগর থেকে লিখেছে রামগোবিন্দ :

বাবা, পুলিশ অফিসার মিস্টার চাটার্জি আমার বন্ধু। কেষ্টনগরে বেড়াতে এসেছিলেন। ওঁর সঙ্গে তোমার জন্যে এক হাঁড়ি ভালো সরপুরিয়া আর সরভাজা পাঠালুম। ঘরে রেখে পচিয়ো না–খেয়ো। আমি আর মা ভালো আছি। প্রণাম নিয়ো।
রামগোবিন্দ।

টেনিদা একবার আমার দিকে তাকাল, আমি তাকালুম টেনিদার দিকে। আমি বললুম : আচ্ছা আরদালী সাহেব, সব ঠিক হ্যায়।

আরদালী সাহেব আবার স্যালুট করে, জুতো মচমচিয়ে চলে গেল।

আমি কী বলতে যাচ্ছিলুম, টেনিদা ঝট করে আমাকে দরজার বাইরে টেনে নিয়ে এল।

–চুপ, স্পিকটি নট! এক হাঁড়ি সরভাজা আর সরপুরিয়া–খাঁটি কেষ্টনগরের জিনিস। পোলাও-কালিয়া কোথায় লাগে এর কাছে।

দরজাটা টেনে দিতে দিতে টেনিদা হাঁক পাড়ল : ভজগৌরাঙ্গবাবু, লাইন ক্লিয়ার! পুলিশ তাড়িয়েছে। কাল আর ঘর থেকে বেরুবেন না। পরশু সন্ধ্যায় আমরা পোলাও কালিয়া খেতে আবার আসব। এখন দরজাটা বন্ধ করে দিন।

তারপর?

তারপর সেই সরভাজা আর সরপুরিয়ার হাঁড়ি নিয়ে আমরা দুজন সোজা টেনিদাদের তে-তলার ছাদে। টেনিদা একখানা গোটা সরভাজা মুখে দিয়ে বললে; ডি-লা-গ্র্যান্ডি মেফিস্টোফিলিস–

আমি সরপুরিয়ায় কামড় দিয়ে বললুম : ইয়াক–ইয়াক!

ভজহরি ফিল্ম কর্পোরেশন

বউবাজার দিয়ে আসতে আসতে ভীমনাগের দোকানের সামনে ঠায় দাঁড়িয়ে গেল টেনিদা। আর নড়তে চায় না। আমি বললুম, রাস্তার মাঝখানে অমন করে দাঁড়ালে কেন? চলো।

–যেতে হবে? নিতান্তই যেতে হবে?–কাতর দৃষ্টিতে টেনিদা তাকাল আমার দিকে; প্যালা, তোর প্রাণ কি পাষাণে গড়া? ওই দ্যাখ, থরে থরে সন্দেশ সাজানো রয়েছে, থালার ওপর সোনালি রঙের রাজভোগ হাতছানি দিয়ে ডাকছে, রসের মধ্যে ডুব-সাঁতার কাটছে রসগোল্লা, পানতো। প্যালা রে–

আমি মাথা নেড়ে বললুম, চালাকি চলবে না। আমার পকেটে তিনটে টাকা আছে, ছোটমামার জন্যে মকরধ্বজ কিনতে হবে। অনেক দেরি হয়ে যাচ্ছে, চলো এখন

টেনিদা শাঁ করে জিভে খানিকটা লাল টেনে নিয়ে বললে, সত্যি বলছি, বড্ড খিদে পেয়েছে রে! আচ্ছা, দুটো টাকা আমায় ধার দে, বিকেলে না হয় ছোটমামার জন্যে মকরধ্বজ

কিন্তু ও সব কথায় ভোলবার বান্দা প্যালারাম বাঁড়ুজ্যে নয়। টেনিদাকে টাকা ধার দিলে সে-টাকাটা আদায় করতে পারে এমন খলিফা লোক দুনিয়ায় জন্মায়নি। পকেটটা শক্ত করে ঢেকে ধরে আমি বললুম, খাবারের দোকান চোখে পড়লেই তোমার পেট চাঁই-চাঁই করে ওঠে– ওতে আমার সিমপ্যাথি নেই। তা ছাড়া, এ-বেলা মকরধ্বজ না নিয়ে গেলে আমার ছেঁড়া কানটা সেলাই করে দেবে কে? তুমি?

রেলগাড়ির ইঞ্জিনের মতো একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল টেনিদা।

ব্রাহ্মণকে সক্কালবেলা দাগা দিলি প্যালা–মরে তুই নরকে যাবি।

-যাই তো যাব। কিন্তু ছোটমামার কানমলা যে নরকের চাইতে ঢের মারাত্মক সেটা জানা আছে আমার। আর, কী আমার ব্রাহ্মণ রে! দেলখোস রেস্তোরাঁয় বসে আস্ত-আস্ত মুরগির ঠ্যাং চিবুতে তোমায় যেন দেখিনি আমি!

উঃ! সংসারটাই মরীচিকা–ভীমনাগের দোকানের দিকে তাকিয়ে শেষবার দৃষ্টিভোজন করে নিলে টেনিদা; নাঃ, বড়লোক না হলে আর সুখ নেই।

বিকেলে চাটুজ্যেদের রোয়াকে বসে সেই কথাই হচ্ছিল। ক্যাবলা গেছে কাকার সঙ্গে চিড়িয়াখানায় বেড়াতে, হাবুল সেন গেছে দাঁত তুলতে। কাজেই আছি আমরা দুজন। মনের দুঃখে দুঠোঙা তেলেভাজা খেয়ে ফেলেছে টেনিদা। অবশ্য পয়সাটা আমিই দিয়েছি এবং আধখানা আলুর চপ ছাড়া আর কিছুই আমার বরাতে জোটেনি।

আমার পাঞ্জাবির আস্তিনটা টেনে নিয়ে টেনিদা মুখটা মুছে ফেলল। তারপর বললে, বুঝলি প্যালা, বড়লোক না হলে সত্যিই আর চলছে না।

–বেশ তো হয়ে যাও-না বড়লোক– আমি উৎসাহ দিলুম।

হয়ে যাও-না! বড়লোক হওয়াটা একেবারে মুখের কথা কিনা! টাকা দেবে কে, শুনি? তুই দিবি?– টেনিদা ভেংচি কাটল। আমি মাথা নেড়ে জানালুম, না আমি দেব না।

–তবে?

লটারির টিকিট কেনো।– আমি উপদেশ দিলুম।

ধ্যাত্তোর লটারির টিকিট! কিনে কিনে হয়রান হয়ে গেলুম, একটা ফুটো পয়সাও যদি জুটত কোনও বার! লাভের মধ্যে টিকিটের জন্যে বাজারের পয়সা চুরি করতে গিয়ে ধরা পড়লুম, বড়দা দুটো অ্যায়সা থাপ্পড় কষিয়ে দিলে। ওতে হবে না বুঝলি? বিজনেস করতে হবে!

–বিজনেস!

–আলবাত বিজনেস। টেনিদার মুখ সংকল্পে কঠোর হয়ে উঠল; ওই যে কী বলে, হিতোপদেশে লেখা আছে না, বাণিজ্যে বসতে ইয়ে মানে লক্ষ্মী! ব্যবসা ছাড়া পথ নেই বুঝেছিস?

–তা তো বুঝেছি। কিন্তু তাতেও তো টাকা চাই।

–এমন বিজনেস করবে যে নিজের একটা পয়সাও খরচ হবে না। সব পরস্মৈপদী– মানে পরের মাথায় কাঁঠাল ভেঙে।

-সে আবার কী বিজনেস?–আমি বিস্মিত হয়ে জানতে চাইলুম।

–হুঁ হুঁ, আন্দাজ কর দেখি?–চোখ কুঁচকে মিটিমিটি হাসতে লাগল টেনিদা; বলতে পারলি না তো? ওসব কি তোর মতো নিরেট মগজের কাজ? এমনি একটা মাথা চাই, বুঝলি?

সগৌরবে টেনিদা নিজের ব্রহ্মতালুতে দুটো টোকা দিলে।

–কেন অযথা ছলনা করছ? বলেই ফেলো না– আমি কাতর হয়ে জানতে চাইলুম।

টেনিদা একবার চারদিকে তাকিয়ে ভালো করে দেখে নিলে, তারপর আমার কানের কাছে মুখ এনে ফিসফিস করে বললে, ফিলিম কোম্পানি!

অ্যাঁ! আমি লাফিয়ে উঠলাম।

–গাধার মতো চ্যাঁচাসনি টেনিদা ষাঁড়ের মতো চেঁচিয়ে উঠল; সব প্ল্যান ঠিক করে ফেলেছি। তুই গল্প লিখবি– আমি ডাইরেকট–মানে পরিচালনা করব। দেখবি, চারিদিকে হইহই পড়ে যাবে।

–ফিলিমের কী জানো তুমি? আমি জানতে চাইলুম।

–কে-ইবা জানে?–টেনিদা তাচ্ছিল্যভরা একটা মুখ ভঙ্গি করলে; সবাই সমান সকলের মগজেই গোবর। তিনটে মারামারি, আটটা গান আর গোটা কতক ঘরবাড়ি দেখালেই ফিলিম হয়ে যায়। টালিগঞ্জে গিয়ে আমি শুটিং দেখে এসেছি তো।

কিন্তু তবুও–

ধ্যাৎ, তুই একটা গাড়ল। টেনিদা বিরক্ত হয়ে বললে, সত্যি সত্যিই কি আর ছবি তুলব আমরা! ওসব ঝামেলার মধ্যে কে যাবে!

— তা হলে?

–শেয়ার বিক্রি করব। বেশ কিছু শেয়ার বিক্রি করতে পারলে বুঝলি তো?–টেনিদা চোখ টিপল; দ্বারিক, ভীমনাগ, দেলখোস, কে. সি. দাস

এইবার আমার নোয় জল এসে গেল। চুক চুক করে বললুম- থাক, থাক আর বলতে হবে না।

পরদিন গোটা পাড়াটাই পোস্টারে পোস্টারে ছেয়ে গেল।

দি ভজহরি ফিলিম কর্পোরেশন
আসিতেছে–আসিতেছে
রোমাঞ্চকর বাণীচিত্র
বিভীষিকা।
পরিচালনা : ভজহরি মুখোপাধ্যায় (টেনিদা)
কাহিনী : প্যালারাম বন্দ্যোপাধ্যায়।

তার নীচে ছোট ছোট হরফে লেখা : সর্বসাধারণকে কোম্পানির শেয়ার কিনিবার জন্য অনুরোধ জানানো হইতেছে। প্রতিটি শেয়ারের মূল্য মাত্র আট আনা। একত্রে তিনটি শেয়ার কিনিলে মাত্র এক টাকা।

এর পরে একটা হাত এঁকে লিখে দেওয়া হয়েছে : বিশেষ দ্রষ্টব্য শেয়ার কিনিলে প্রত্যেককেই বইতে অভিনয়ের চান্স দেওয়া হইবে। এমন সুযোগ হেলায় হারাইবেন না। মাত্র অল্প শেয়ার আছে, এখন না কিনিলে পরে পস্তাইতে হইবে। সন্ধান করুন- ১৮নং পটলডাঙা স্ট্রিট, কলিকাতা।

আর, বিজ্ঞাপনের ফল যে কত প্রত্যক্ষ হতে পারে, কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই হাতেনাতে তার প্রমাণ মিলে গেল। এমন প্রমাণ মিলল যে প্রাণ নিয়ে টানাটানি। অত তাড়াতাড়ি ব্যাপারটা আমরা আশা করিনি। টেনিদাদের এত বড় বাড়িটা একেবারে খালি, বাড়িসুষ্ঠু সবাই গেছে দেওঘরে, হাওয়া বদলাতে। টেনিদার ম্যাট্রিক পরীক্ষা সামনে, তাই একা রয়ে গেছে বাড়িতে, আর আছে চাকর বিষ্ণু। তাই দিব্যি আরাম করে বসে আমরা তেতলার ঘরে রেডিয়ো শুনছি আর পাঁঠার ঘুগনি খাচ্ছি। এমন সময় বিষ্টু খবর নিয়ে এল মূর্তিমান একটি ভগ্নদূতের মতো।

বিষ্টুর বাড়ি চাটগাঁয়। হাঁইমাই করে নাকি সুরে কী যে বলে ভালো বোঝা যায় না। তবু যেটুকু বোঝা গেল, শুনে আমরা আঁতকে উঠলুম। গলায় পাঁঠার ঘুগনি বেঁধে গিয়ে মস্ত একটা বিষম খেল টেনিদা।

বিষ্টু জানাল : আঁড়িত ডাঁহাইত হইড়ছে (বাড়িতে ডাকাত পড়েছে)।

বলে কী ব্যাটা! পাগল না পেট খারাপ! ম্যাড়া না মিরগেল! এই ভর দুপুর বেলায় একেবারে কলকাতার বুকের ভেতরে ডাকাত পড়বে কী রকম!

বিষ্টু বিবর্ণ মুখে জানাল :নীচে হাঁসি দেইক্যা যান (নীচে এসে দেখে যান)।

আমি ভেবেছিলাম খাটের তলাটা নিরাপদ কিনা, কিন্তু টেনিদা এমন এক বাঘা হাঁকার ছাড়লে যে আমার পালাজ্বরের পিলেটা দস্তুরমতো হকচকিয়ে উঠল।

কাপুরুষ! চলে আয় দেখি একটা বোম্বাই ঘুষি হাঁকিয়ে ডাকাতের নাক ন্যাবড়া করে দি। আমি নিতান্ত গোবেচারা প্যালারাম বাঁড়ুজ্যে, শিংমাছের ঝোল খেয়ে প্রাণটাকে কোনওমতে ধরে রেখেছি, ওসব ডাকাত-ফাকাতের ঝামেলা আমার ভালো লাগে না। বেশ তো ছিলাম, এ-সব ভজঘট ব্যাপার কেন রে বাবা। আমি বলতে চেষ্টা করলুম, এই–এই মানে, আমার কেমন পেট কামড়াচ্ছে–

–পেট কামড়াচ্ছে! টেনিদা গর্জন করে উঠল : পাঁঠার ঘুগনি সাবাড় করার সময় তো সে কথা মনে ছিল না দেখছি। চলে আয় প্যালা, নইলে তোকেই আগে

কথাটা টেনিদা শেষ করল না, কিন্তু তার বক্তব্য বুঝতে বেশি দেরি হল না আমার। জয় মা দুর্গা– কাঁপতে কাঁপতে আমি টেনিদাকে অনুসরণ করলুম।

কিন্তু না– ডাকাত পড়েনি। পটলডাঙার মুখ থেকে কলেজ স্ট্রিটের মোড় পর্যন্ত কিউ!

কে নেই সেই কিউতে? স্কুলের ছেলে, মোড়ের বিড়িওয়ালা, পাড়ার ঠিকে ঝি, উড়ে ঠাকুর, এমন কি যমদূতের মতো দেখতে এক জোড়া ভীম-দর্শন কাবুলিওয়ালা।

আমরা সামনে এসে দাঁড়াতেই গগনভেদী কোলাহল উঠল।

–আমি শেয়ার কিনব—

–এই নিন মশাই আট আনা পয়সা—

ঝি বলল, ওগো বাছারা, আমি এক টাকা এনেছি। আমাদের তিনখানা শেয়ার দাও আর একটা হিরোইনের চান্স দিয়ো

পাশের বোর্ডিংটার উড়ে ঠাকুর বললে, আমিও আষ্টো গণ্ডা পয়সা আনুচি–

সকলের গলা ছাপিয়ে কাবুলিওয়ালা রুদ্র কণ্ঠে হুঙ্কার ছাড়ল : এঃ বাব্বু, এক এক রূপায়া, লায়া, হামকো ভি চান্স চাহিয়ে

তারপরেই সমস্বরে চিৎকার উঠল : চান্স–চান্স! চিৎকারের চোখে আমার মাথা ঘুরে গেল- দুহাতে কান চেপে আমি বসে পড়লুম।

আশ্চর্য, টেনিদা দাঁড়িয়ে রইল। দাঁড়িয়ে রইল একেবারে শান্ত, স্তব্ধ বুদ্ধদেবের মতো। শুধু তাই নয়, এ কান থেকে ওকান পর্যন্ত একটা দাঁতের ঝলক বয়ে গেল তার মানে হাসল।

তারপর বললে, হবে, হবে, সকলেরই হবে, বরাভয়ের মতো একখানা হাত সামনের দিকে বাড়িয়ে দিয়ে বললে, প্রত্যেককেই চান্স দেওয়া হবে। এখন চাঁদেরা আগে সুড়সুড় করে পয়সা বের করে দেখি। খবরদার, অচল আধুলি চালিয়ো না, তা হলে কিন্তু

জয় হিন্দ–জয় হিন্দ

ভিড়টা কেটে গেলে টেনিদা দু হাত তুলে নাচতে শুরু করে দিলে। তারপর ধপ করে একটা চেয়ারে বসতে গিয়ে চেয়ারসুদ্ধই চিতপাত হয়ে পড়ে গেল।

আমি বললুম, আহা-হা

কিন্তু টেনিদা উঠে পড়েছে ততক্ষণে। আমার কাঁধের ওপর এমন একটা অতিকায় থাবড়া বসিয়ে দিলে যে, আমি আর্তনাদ করে উঠলাম।

–ওরে প্যালা, আজ দুঃখের দিন নয় রে, বড় আনন্দের দিন। মার দিয়া কেল্লা! ভীমনাগ, দ্বারিক ঘোষ, চাচার হোটেল, দেলখোস-আঃ!

যন্ত্রণা ভুলে গিয়ে আমিও বললুম, আঃ!

–আয় গুনে দেখি– এ কান থেকে ওকান পর্যন্ত আবার হাসির ঝলক উলসে উঠল।

রোজগার নেহাত মন্দ হয়নি। গুনে দেখি, ছাব্বিশ টাকা বারো আনা।

বারো আনা?–টেনিদা ভ্রূকুটি করলে, বারো আনা কী করে হয়? আট আনা এক টাকা করে হলে– উঁহু! নিশ্চয় ডামাডোলের মধ্যে কোনও ব্যাটা চার গণ্ডা পয়সা ফাঁকি দিয়েছে– কী বলিস?

আমি মাথা নেড়ে জানালুম, আমারও তাই মনে হয়।

উঃ–দুনিয়ায় সবই জোচ্চোর। একটাও কি ভালো লোক থাকতে নেইরে? দিলে সক্কালবেলাটায় বামুনের চার চার আনা পয়সা ঠকিয়ে। টেনিদা দীর্ঘশ্বাস ফেলল : যাক, এতেও নেহাত মন্দ হবে না। দেলখোস, ভীমনাগ, দ্বারিক ঘোষ

আমি তার সঙ্গে জুড়ে দিলুম, চাচার হোটেল, কে সি দাস

টেনিদা বললে, ইত্যাদি ইত্যাদি। কিন্তু শোন প্যালা, একটা কথা আগেই বলে রাখি। প্ল্যানটা আগাগোড়াই আমার। অতএব বাবা সোজা হিসেব- চৌদ্দ আনা–দু আনা।

আমি আপত্তি করে বললুম, অ্যাঁ, তা কী করে হয়?

টেনিদা সজোরে টেবিলে একটা কিল মেরে গর্জন করে উঠল, হুঁ, তাই হয়। আর তা যদি না হয়, তাহলে তোকে সোজা দোতালার জানালা গলিয়ে নীচে ফেলে দেওয়া হয়, সেটাই কি তবে ভালো হয়?

আমি কান চুলকে জানালুম, না সেটা ভালো হয় না!

তবে চল গোটা কয়েক মোগলাই পরোটা আর কয়েক ডিশ ফাউল কারি খেয়ে ভজহরি ফিলম কর্পোরেশনের মহরত করে আসি

টেনিদা ঘর-ফাটানো একটা পৈশাচিক অট্টহাসি করে উঠল। হাসির শব্দে ভেতর থেকে ছুটে এল বিষ্টু। খানিকক্ষণ হাঁ করে তাকিয়ে থেকে বললে, ছটো বাবুর মাথা হাঁড়াপ (খারাপ) অইচে!

কিন্তু দিন কয়েক বেশ কেটে গেল। দ্বারিকের রাজভোগ আর চাচার কাটলেট খেয়ে শরীরটাকে দস্তুরমতো ভালো করে ফেলেছি দুজনে। কে. সি. দাসের রসমালাই খেতে খেতে দুজনে ভাবছি- আবার নতুন কোনও একটা প্ল্যান করা যায় কি না, এমন সময়

দোরগোড়ায় যেন বাজ ডেকে উঠল। সেই যমদূতের মতো একজোড়া কাবলিওয়ালা। অতিকায় জাব্বা-জোব্বা আর কালো চাপদাড়ির ভেতর দিয়ে যেন জিঘাংসা ফুটে বেরোচ্ছে।

আমরা ফিরে তাকাতেই লাঠি ঠুকল : এ বাব্বু– রূপেয়া কাঁহা হামলোগ গা চান্স কিধর?

–অ্যাঃ! টেনিদার হাত থেকে রসমালাইটা বুক-পকেটের ভেতর পড়ে গেল : প্যালা রে, সেরেছে!

–সারবেই তো! আমি বললুম, তবে আমার সুবিধে আছে। চৌদ্দ আনা দু আনা। চৌদ্দ আনা ঠ্যাঙানি তোমার, মানে স্রেফ ছাতু করে দেবে। দু আনা খেয়ে আমি বাঁচলেও বেঁচে যেতে পারি।

কাবুলিওয়ালা আবার হাঁকল :–এঃ ভজহরি বাব্বু–বাহার তো আও—

বাহার আও–মানেই নিমতলা যাও! টেনিদা এক লাফে উঠে দাঁড়াল, তারপর সোজা আমাকে বগলদাবা করে পাশের দরজা দিয়ে অন্যদিকে।

–ওগো ভালো মানুষের বাছারা, আমার ট্যাকা কই, চান্স কই? ঝি হাতে আঁশবটি নিয়ে দাঁড়িয়ে।

–আমারো চান্সো মিলিবো কি না?–উড়ে ঠাকুর ভাত রাঁধবার খুন্তিটাকে হিংস্রভাবে আন্দোলিত করল।

–জোচ্চুরি পেয়েছেন স্যার–আমরা শ্যামবাজারের ছেলে আস্তিন গুটিয়ে একদল ছেলে তাড়া করে এল।

এক মুহূর্তে আমাদের চোখের সামনে পৃথিবীটা যেন ঘুরতে লাগল। তারপরেই–করেঙ্গে ইয়া মারেঙ্গে! আমাকে কাঁধে তুলে টেনিদা একটা লাফ মারল। তারপর আমার আর ভালো করে জ্ঞান রইল না। শুধু টের পেলুম, চারিদিকে একটা পৈশাচিক কোলাহল; চোট্টা–চোট্টা-ভাগ যাতা–আর বুঝতে পারলুম যেন পঞ্জাব মেলে চড়ে উড়ে চলেছি।

ধপাৎ করে মাটিতে পড়তেই আমি হাঁউমাউ করে উঠলুম। চোখ মেলে তাকিয়ে দেখি, হাওড়া স্টেশন। রেলের একটা ইঞ্জিনের মতোই হাঁপাচ্ছে টেনিদা।

বললে, হুঁ হুঁ বাবা, পাঁচশো মিটার দৌড়ে চ্যাম্পিয়ন– আমাকে ধরবে ওই ব্যাটারা! যা প্যালা– পকেটে এখনও বারো টাকা চার আনা রয়েছে, ঝট করে দুখানা দেওঘরের টিকিট কিনে আন। দিল্লি এক্সপ্রেস এখুনি ছেড়ে দেবে।

ভুতুড়ে কামরা

ওদের বাড়ির নিমগাছটার তলায় বসে কান চুলকোতে চুলকোতে বলটুদা আমায় জিজ্ঞেস করলে, আচ্ছা প্যালা, ভূত সম্বন্ধে তোর আইডিয়া কী?

আমি বললুম, কোনও আইডিয়া নেই।

শুনে বলটুদা ভীষণ ব্যাজার হল। এত ব্যাজার হল যে খচ করে কানে একটা খোঁচাই খেয়ে গেল। শেষে মুখটাকে এক ভাঁড় রাবড়ির মতো করে বললে, কেন? আইডিয়া নেই কেন?

আমি বললুম, কী করে থাকবে? কখনও দেখিনি তো।

–শুনে-টুনেও কিছু মনে হয় না?

–একদম না। লোকে নানা রকম ডেসক্রিপশন দেয়। কেউ বলে, খামকা একটা কাটামুণ্ডু ঘ্যাঁচাৎ করে কামড়াতে এল, কেউ বলে সাদা কাপড় পরে রাত দুপুরে হাতের ওপর হেঁটে যাচ্ছে, কেউ বলে আমগাছে এক পা আর জামগাছে আর এক পা দিয়ে–

বলটুদা বললে, বাজে বকিসনি। ধর, এই নিমগাছটায় একটা ভূত আছে–

এই দিন-দুপুরেই দারুণ চমকে আমি একবার নিমগাছটার দিকে চেয়ে দেখলুম। না, ভূত-টুত কিছু নেই, কেবল ঠিক আমার মাথার ওপরেই একটা কাক বসে রয়েছে। কাককে আদৌ বিশ্বাস নেই, একটু সরে বসলুম তক্ষুনি।

বলটুদাকে বললুম, তোমার নিমগাছের ভূতকে খামকা আমি ধরতে যাব কেন? কী দরকার আমার? ভূত ধরা-টা আমি আদৌ পছন্দ করি না–তোমাকে সাফ বলে দিচ্ছি।

কিন্তু মনে কর, ভূত যদি তোকেই ধরে? মানে, তোকেই ধরতে পছন্দ করে যদি?

আমি দস্তুরমতো ঘাবড়ে গিয়ে বললুম, বলটুদা, এবার আমি বাড়ি চলে যাব। বলটুদা খপ করে আমার হাত চেপে ধরে টেনে বসালে। বললে, আহা, যাচ্ছিস কেন? বললুম বলেই কি সত্যি সত্যিই ভূতে ধরছে নাকি তোকে? মানে, আমি সেদিন ভূতের পাল্লায় পড়েছিলুম কিনা–সেই ব্যাপারটাই তোকে বলব।

আমি বললুম, তুমি আবার কবে থেকে আমাদের টেনিদার মতো গল্পবাগীশ হলে বলটুদা?

টেনিদার নাম শুনেই বলটুদা জ্বলে গেল। বললে, টেনি। তার কথা আর বলিসনি। তোদের দলের ওই সদারটা এক নম্বরের গুলবাজ–খালি বানিয়ে বানিয়ে যা তা গল্প বলে। সেদিন আবার আমাকে দিব্যি ভুজুং-ভাজুং দিয়ে দি গ্রেট আবার খাবো রেস্তোরাঁয় আড়াই টাকা খেয়ে গেল।-নাকটাকে কী রকম যেন তেলে ভাজা সিঙাড়ার মতো করে বলটুদা বললে, ছোঃ ছোঃ! যাবার আগে আমার পিঠ চাপড়ে কী সব মেফিস্টোফিলিস-টিসিস বলেও গেল–কিছু বুঝতে পারলুম না। রামো—রামো–টেনি আবার একটা মানুষ।

বুঝতে পারলুম, টেনিদা বলটুদার প্রাণে দারুণ দাগা দিয়ে গেছে, আড়াই টাকার শোক আর বলটুদা ভুলতে পারছে না। আমি সান্ত্বনা দিয়ে বললুম, টেনিদার কথা ছেড়ে দাও, ও ওই রকম। তোমার ভূতের গল্পটাই বলল।

–গল্প? আমি বানিয়ে বলার মধ্যে নেই। যা বলব, একদম সত্য ঘটনা।

–আচ্ছা, বলতে থাকো।

তখন বলটুদা আর একবার বেশ করে কান চুলকে নিলে, তারপর বলতে থাকল।–

আমার বড়দির বড় মেয়ে–দিল্লিতে জমেছে বলে যার নাম রাজধানী, ছোটবেলায় যাকে আমি ভুল করে ‘দাদখানি’ বলে ডাকতুম, আর বড়দি যাকে বলত ‘ধানী লঙ্কা’, তার বিয়ে হয়েছে এক কোলিয়ারির ইঞ্জিনিয়ারের সঙ্গে। এবার পুজোর ছুটিতে আমি দেখানে বেড়াতে গিয়েছিলুম।

দিন দশেক বেশ আরামে থেকে, খুব খেয়ে দেয়ে, ওদের মটর গাড়িতে অনেক বেড়িয়ে-টেড়িয়ে কলকাতায় ফিরে আসছিলুম। সন্ধের পরে গাড়ি বদলাতে হল ছোট একটা জংশন স্টেশনে। ট্রেনে বেজায় ভিড়, শেষে দেখি, পেছন দিকের একটা ছোট সেকেন্ড ক্লাস কামরা থেকে সব যাত্রী হুড়মুড় করে নেমে যাচ্ছে। দেখে খুব মজা লাগল, আমি ফাঁকা গাড়িটায় টুপ করে উঠে বসলুম। সতরঞ্চি-জড়ানো ছোট বিছানাটা পেতে, মাথার কাছে সুটকেসটা রেখে বেশ নিশ্চিন্ত হয়ে বসে পড়া গেল।

ট্রেন আরও প্রায় কুড়ি মিনিট এখানে থাকবে, আমি বসে বসে দেখতে লাগলুম। অন্য সব গাড়িতে লোক উঠছে-নামছে, এদিকে কেউ আর আসছে না। বোধহয় পেছন দিকের গাড়ি বলেই এটার ওপর কারও নজর নেই। আমার ভীষণ ভালো লাগছিল। একটা রেলের কামরায় একলা যেতে ভারি মজা লাগে নিজেকে বেশ লাট-বেলাটের মতো মনে হয়।

এর মধ্যে জন দুই মাড়োয়ারী যাত্রী অনেক লাটবহর নিয়ে আমার গাড়ির দিকেই তাক করে আসছে বলে বোধ হল। ভাবলুম–এই রে, এসে ঢুকল বুঝি! হঠাৎ একজন লোক তাদের কী যেন বললে, অমনি তারা সঙ্গে সঙ্গে উলটো দিকে ছুটল। আমার স্বস্তির নিঃশ্বাস পড়ল বটে, কিন্তু ব্যাপারটা ঠিক বুঝতে পারলুম না। তারপরেই মনে হল, ওদের বোধ হয় থার্ড ক্লাসের টিকিট ছিল, ওই লোকটা বলে দিয়েছে এটা সেকেন্ড ক্লাস, সেই জন্যেই সরে পড়ল।

যাই হোক, বেশি ভেবেচিন্তে লাভ নেই। গাড়ি ছাড়তে আরও কিছু দেরি আছে, কিন্তু আমি আর বসতে পারছিলুম না। একে তো আসবার আগে রাজধানী বিস্তর খাইয়েছে, বলেছে, ‘ছোট মামা, রেলে খালি পেটে যেতে নেই, শরীর খারাপ করে।’ আমিও তাই শুনে লচিমাংস-মিষ্টিতে গলা পর্যন্ত ঠেসে নিয়েছি, তিন ঘণ্টা পেরিয়ে গেল, পেটে এখনও দেড় মন ভার। তায় রাত প্রায় সাড়ে দশটা বাজে, দারুণ ঘুম পাচ্ছিল। গাড়িতে যে ওঠে উঠুক, আমি তো আপাতত লম্বা হই।

যা ভাবা তাই করা। আমি শুয়ে পড়লুম। গাড়ি ছাড়তে বোধহয় মিনিট দশেক দেরি ছিল তখনও, কিন্তু আমার ঘুমিয়ে পড়তে তিন মিনিটও লাগল না। আর সেই ঘুমের ভেতরেই টের পেলুম ট্রেনের হুইসেল বাজছে, কামরাটা নড়তে আরম্ভ করেছে। প্রাণপণে চেষ্টায় আধখানা চোখ খুলে দেখলুম অন্য যাত্রী আর কেউ ওঠেনি। নিশ্চিন্তে ঘুমানো যাক তবে।

নিশ্চিন্তেই আমি ঘুমোলুম।

রাত তখন কত হয়েছে জানি না, হঠাৎ আমার চটকা ভাঙল। ভীষণ মশা কামড়াচ্ছে আর কী রকম একটা অদ্ভুত গন্ধ নাকে লাগছে। চমকে চেয়ে দেখি, গাড়িটা দাঁড়িয়ে রয়েছে। কামরায় নিতল অন্ধকার–গোটা চারেক আলো জ্বলছিল, পাখা ঘুরছিল, কিন্তু এখন আলো নেই, পাখাও চলছে না।

ব্যাপারটা কী? বাইরে তাকালুম-কিচ্ছু দেখা যাচ্ছে না, শুধু কালো পাঁচিলের মতো থমথমে অন্ধকার। সে-অন্ধকারে একটাও তারা নেই, জোনাকি নেই, কিছু নেই। জানলার অন্য দিকে তাকালুম, ঠিক এক দৃশ্য। যেন রাতারাতি গাড়িটাকে কেউ একটা আলকাতরার সমুদ্রের ভেতর তলিয়ে দিয়েছে। তারপর মনে হল, কেবল আলকাতরা নয়, ধোঁয়ার মতো কী যেন কুণ্ডলী পাকিয়ে উঠছে তার ভেতর–নিশ্চয় কুয়াশা।

ব্যাপারটা কী?

রাত যে কখনও এত অন্ধকার হয়, সে আমি স্বপ্নেও জানতুম না। আকাশে যদি ঘন কালো মেঘ দেখা দেয়, তার ভেতরেও অন্তত আবছা একটা আলোর আভাস থাকে, মাঝে মাঝে বিদ্যুৎ চমকায়। তাও যদি না হয়, লাইনের ধারে ঝোপে-জঙ্গলে অন্তত দুটো একটা জোনাকির ফুলকি জ্বলে। এমন কাণ্ড তো কখনও দেখিনি।

ট্রেন কি কোনও স্টেশনে থেমে আছে? তা হলে আলো কই? স্টেশনের বাইরে লাইন-ক্লিয়ার না পেয়ে দাঁড়িয়ে রয়েছে? তা হলে সিগন্যালের বাতিও তো দেখা যাবে। কোথায় সেসব?

এদিকে একটা অদ্ভুত গন্ধ পাক খাচ্ছে আমাকে ঘিরে ঘিরে। আর কী নিদারুণভাবে যে মশা কামড়াচ্ছে–সে আর তোকে কী বলব প্যালা! তার ওপর দুর্দান্ত গরম! আমি বসে বসে ঘামতে লাগলুম।

বেঞ্চির ওপর পা ছড়িয়ে বসেছিলুম, মশাদের যত নজর দেখছি পায়ের ওপরেই। শেষে জেরবার হয়ে যেই একটা চাঁটি হাঁকড়েছি-তোকে কী বলব প্যালা–সেটা আমার পায়ে লাগল না!

খরখরে লোমওলা নরম কী একটা জিনিসের ওপর ঘপাৎ করে গিয়ে চড়টা পড়ল। ঘুৎ করে কী একটা বিটকেল আওয়াজ হল, কালো মতন কে যেন শুন্যে লাফিয়ে উঠল, আমার চোখের সামনে দুটো সবুজ আগুন দপদপ করে উঠল, তারপরেই কী যেন ধপাৎ করে বাইরে পড়ে গেল।

আমি বুঝতে পারলুম, কামরার দরজাটা খোলা!

উঠে বন্ধ করব কি, হাত-পা আমার আতঙ্কে ঠাণ্ডা হয়ে এল! কে এই কালো জীব–কী সে? ট্রেনের ভেতরে সে আমার পায়ের কাছে কোত্থেকে এল, কেনই বা চড় খেয়ে খুঁৎ করে লাফিয়ে উঠল, আর লাফিয়েই বা গেল কোথায়? অমন অস্বাভাবিক দুটো সবুজ চোখই বা কেন–আর সে চোখে কোন্ হিংস্র প্রতিহিংসা লুকিয়ে ছিল?

তবে কি এ সব ভৌতিক ব্যাপার?

ব্যস, মনে করতেই আমার মাথার চুল খাড়া হয়ে গেল। এইবার বুঝতে পারলুম, গাড়ির এই কামরটা নিশ্চয় ভুতুড়ে। তাই জংশন স্টেশনে লোকগুলো সব হুড়মুড়িয়ে এই গাড়ি থেকে নেমে পালিয়েছে, তাই মাড়োয়ারী দুজন এ-গাড়িতে উঠতে এসেও অমন ঊর্ধ্বশ্বাসে উলটো দিকে দৌড় দিয়েছে।

আর আমি এমন নিরেট গর্দভ যে এসব দেখেও কিছু বুঝতে পারিনি! এই মারাত্মক ভুতুড়ে কম্পার্টমেন্টে উঠে নিশ্চিন্তে ঘুম লাগিয়েছি!

কী করব এখন? নেমে পড়ব গাড়ি থেকে? তারপর যেদিকে চোখ যায়, টেনে দৌড় লাগাব?

কিন্তু এই অন্ধকারে চোখ আর কোন্ দিকে যাবে? দিগবিদিক দূরে যাক, নিজের হাত-পা পর্যন্ত দেখতে পাচ্ছি না যে। আর পালাব? চোর-ডাকাতের হাত থেকে পালানো যায়, পুলিশের হাত থেকেও হয়তো যায়, কিন্তু ভূতের পাল্লা থেকে? খপ করে ত্রিশ গজ লম্বা একখানা হাত বাড়িয়ে ঘাড়টি টেনে ধরবে।

হঠাৎ টপ-টপ-টপাৎ। মাথার ওপর কয়েক ফোঁটা ঠাণ্ডা জল পড়ল। তারপরেই বাইরে বিটকেল ছারাৎ ছারাৎ আওয়াজ। ঠিক মনে হল, কে যেন একটা লম্বা পাইপ দিয়ে জল ছুঁড়ছে।

শুধু মনে হওয়া নয়-ঘারাৎ করে কোত্থেকে একরাশ বিচ্ছিরি জল আমার নাকে মুখে এসে আছড়ে পড়ল।

–বাপরে, গেছি গেছি বলে আমি জানলা বন্ধ করে ফেললুম। সমানে সেই আওয়াজটা চলতে লাগল-মনে হল, সেই অথই অন্ধকারে পেত্নীর বাচ্চা আলকা গোলা নিয়ে গেলি খেলছে।

আমি বসে বসে রঘুপতি রাঘব-টাঘব গাইতে চেষ্টা করলুম। গলা দিয়ে গান বেরুল না, খালি বঁ-বুঁ করে এমন যাচ্ছেতাই আওয়াজ বেরুতে লাগল যে আঁতকে উঠে চুপ করে গেলুম।

ভয়ে কাঠ হয়ে কতক্ষণ বসে আছি জানি না, জলের সেই ছারছ্যারানি কখন থেমে গেছে তা-ও টের পাইনি। আচমকা–সেই কালিঢালা অন্ধকার আর সাদা কুয়াশার ভেতরে একা লাল আলো। বিশ্বাস করবিনি প্যালা, শুধুই একটা লাল আলো। ঠিক গাড়িটার দিকে এগিয়ে আসছে–জানলার কাঁচের মধ্য দিয়ে আমি স্পষ্ট দেখলাম। আমার মনে হল, একচোখা যেন একটা দৈত্য হাঁ করে চলে আসছে আমার দিকে।

এতক্ষণ চুপ করেই দিলুম, এইবার আমি বাপ্ রে মা-রে করে একটা আকাশফাটানো চিৎকার ছাড়লুম। আর লাল আলোটা যেন শূন্যের ভেতরে থমকে দাঁড়াল-তারপরেই ধাঁ করে কোন দিকে যেন মিলিয়ে গেল।

আমার আর চোখ মেলে চেয়ে থাকবার সাহস ছিল না। বেশ বুঝতে পারছিলুম, আজ এই ভুতুড়ে রেলগাড়ির কামরাতেই অপঘাতে আমার প্রাণটা যাবে। একবার গলায় হাত দিয়ে পৈতেটা খুঁজে দেখলুম–কিন্তু তাকে তো সেই সাত বছর আগে জামার সঙ্গে ধোপাবাড়িতে চালান করে দিয়েছি, এখন আর কোথায় পাওয়া যাবে।

বেশ বুঝতে পারলুম, আজ আমার বারোটা বেজে গেল। আমাকে নিয়ে এই ভুতুড়ে কামরাটা যে কোন নরকে গিয়ে হাজির হয়েছে জানি না, কিন্তু এরপর একটার পর একটা বিভীষিকা আসতে থাকবে, আমার রক্ত একদম জমাট বেঁধে যাবে, তারপরেই সোজা হার্টফেল। বাড়িতে মা বাবার কাছে আর পৌঁছুতে পারব না–এখন থেকেই সোজা ভূতের। দলে ভর্তি হয়ে যাব।

চোখ বুজে মনে মনে রাম রাম জপ করছি, এমন সময়—

বাজখাই গলায় কে বললে, ইউ রোগ!

আঁতকে লাফিয়ে উঠলুম। অন্ধকার জায়গায় কোত্থেকে ঝলমলে আলো। আর সেই আলোয় ইয়া ঢ্যাঙা এক সাহেব দাঁড়িয়ে। আবার বাজখাই স্বরে বললে, ইউ রোগ! তুম্ কোন্ হ্যাঁয়?

ওরে বাপরে সাহেব ভূত! আমার রাম নাম গিয়ে ব্রহ্মরঞ্জে পৌঁছুল। আবার একখানা মোক্ষম চিৎকার ছেড়ে আমি গাড়ির মেঝেতে চিৎপাত হয়ে পড়লুম। বিশ্বসংসার মুছে গেল!

এই পর্যন্ত বলে বলটুদা থামল। আমি আকুল হয়ে বললুম, তারপর?

–তারপর আর কী? ভীষণ যা-তা ব্যাপার।

—মানে?

–মানে আবার কী? কামরাটা খারাপ, জংশন স্টেশনেই সেই জন্যে ট্রেন থেকে কেটে নিয়ে শেডের মধ্যে ঢুকিয়েছিল আমাকে সুষ্ঠু। ঘুমের ঘোরে কিচ্ছু টের পাইনি আমি। জুত পেয়ে একটা কালো কুকুর আমার বিছানায় এসে উঠেছিল, গাড়ি ধোয়ার জল ছরছর করে আমার মুখে এসে পড়েছিল, লাল লণ্ঠন হাতে একটা কুলি এদিকে আসছিল, আমার চিৎকারে ভয় পেয়ে ডেকে এনেছিল ওদের ইন্সপেক্টারকে। আর তাকে দেখেই আমার দাঁতকপাটি লেগে গিয়েছিল।

আমি বললুম, অ্যাাঁ!

বলটুদা বললে, হ্যাঁ-হ্যাঁ। আমি তোদের টেনিদার মতো বানিয়ে বানিয়ে গল্প বলি না, এ হল রিয়্যাল ভূতের ব্যাপার। আচ্ছা, এবারে বাড়ি যেতে পারিস।

এই বলে বলটুদা উঠে পড়ল। হনহন করে নিজেই হেঁটে চলে গেল আলেকজান্ডারের ভঙ্গিতে।

মৎস্যপুরাণ

বঙ্গে আর যাব কোথায়, বঙ্গেই তো আছি—একেবারে ভেজালহীন খাঁটি বঙ্গসন্তান। আসলে গিয়েছিলাম বঙ্গেশ্বরী মিষ্টান্ন ভাণ্ডারে।

সবে দিন সাতেক ম্যালেরিয়ায় ভুগে উঠেছি। এমনিতেই বরাবর আমার খাইখাইটা একটু বেশি, তার ওপর ম্যালেরিয়া থেকে উঠে খাওয়ার জন্যে প্রাণটা একেবারে ত্রাহি ত্রাহি করে। দিনরাত্তির শুধু মনে হয় আকাশ খাই, পাতাল খাই, খিদেতে আমার পেটের বত্রিশটা নাড়ি একেবারে গোখরো সাপের মতো পাক খাচ্ছে। শুধু তো পেটের খিদে নয়, একটা ধামার মতো পিলেও জুটেছে সেখানে—আস্ত হিমালয় পাহাড়টাকে আহার করেও বোধহয় সেটার আশ মিটবে না।

সুতরাং বঙ্গেশ্বরী মিষ্টান্ন ভাণ্ডারে বসে গোটা তিনেক ইয়া ইয়া রাজভোগকে কায়দা করবার চেষ্টায় আছি।

কিন্তু তুমি যাও বঙ্গে—

হঠাৎ কানের কাছে সিংহনাদ শোনা গেল : এই যে প্যালা, বেড়ে আছিস–অ্যাঁ?

আমার পিলেটা ঘোঁৎ করে নেচে উঠেই কোঁৎ করে বসে পড়ল। রাজভোগটায় বেশ জুতসই একটা কামড় বসিয়েছিলাম, সেটা ঠিক তেমনি করে হাত আর দাঁতের মাঝখানে লেগে রইল ত্রিশঙ্কুর মতো। শুধু খানিকটা রস গড়িয়ে আদ্দির পাঞ্জাবিটাকে ভিজিয়ে দিলে।

চেয়ে দেখি—আর কে? পৃথিবীর প্রচণ্ডতম বিভীষিকা—আমাদের পটলডাঙার টেনিদা। পুরো পাঁচ হাত লম্বা খটে জোয়ান। গড়ের মাঠে গোরা ঠেঙিয়ে এবং খেলায় মোহনবাগান হারলে রেফারি-পিটিয়ে স্বনামধন্য। আমার মুখে অমন সরস রাজভোগটা কুইনাইনের মতো তেতো লাগল।

টেনিদা বললে, এই সেদিন জ্বর থেকে উঠলি নি? এর ভেতরেই আবার ওসব যা তা খাচ্ছিস? এবারে তুই নির্ঘাত মারা পড়বি।

—মারা পড়ব?—আমি সভয়ে বললাম।

—আলবাত! কোনও সন্দেহ নেই।—টেনিদা শব্দসাড়া করে আমার পাশের চেয়ারটায় বসে পড়ল : তবে আমি তোকে বাঁচাবার একটা চেষ্টা করে দেখতে পারি।

এই বলে, বোধহয় আমাকে বাঁচাবার মহৎ উদ্দেশ্যেই নাকি দুটো রাজভোগ তুলে টেনিদা কপ কপ করে মুখে পুরে দিলে। তারপর তেমনি সিংহনাদ করে বললে, আরও চারটে রাজভোগ।

আমার খাওয়া যা হওয়ার সে তো হল, আমারই পকেটের নগদ সাড়ে তিনটি টাকা খসিয়ে এ-যাত্ৰা আমার প্রাণটা বাঁচিয়ে দিলে টেনিদা। মনে মনে চোখের জল ফেলতে ফেলতে বেরুলাম দোকান থেকে। ভাবছি এবার হেদোর কোনা দিয়ে সই করে ডাফ স্ট্রিটের দিকে সটকে পড়ব, কিন্তু টেনিদা ক্যাঁক করে আমার কাঁধটা চেপে ধরল। সে তো ধরা নয়, যেন ধারণ। মনে হল কাঁধের ওপর কেউ একটা দেড়মনী বস্তা ধপাস করে ফেলে দিয়েছে। যন্ত্রণায় শরীরটা কুঁকড়ে গেল।

—অ্যাই প্যালা, পালাচ্ছিস কোথায়? ভয়ে আমার ব্রহ্মতালু অবধি কাঠ। বললাম, না, না, পা-পা পালাচ্ছি না তো!

—তবে যে মানিক দিব্যি কাঠবেড়ালির মতো গুটিগুটি পায়ে বেমালুম হাওয়া হয়ে যাচ্ছিলে? চালাকি না চলিষ্যতি। তোকে আমার সঙ্গে যেতে হবে এখন।

-কোথায়?

–দমদমায়।

আমি অবাক হয়ে বললাম, দমদমায় কেন?

টেনিদা চটে উঠল : তুই একটা গাধা।

আমি বললাম, গাধা হবার মতো কী করলাম?

টেনিদা বাঘা গলায় বললে, আর কী করবি? ধোপার মোট বইবি, ধাপার মাঠে কচি কচি ঘাস খাবি, না প্যাঁ-হোঁ প্যাঁ-হোঁ করে চিৎকার করবি? আজ রবিবার, দমদমায় মাছ ধরতে যাব—এটা কেন বুঝিস নে উজবুক কোথাকার?

—মাছ ধরতে যাবে তো যাও—আমাকে নিয়ে টানাটানি করছ কেন?

–তুই না গেলে আমার বঁড়শিতে টোপ গেঁথে দেবে কে, শুনি? কেঁচো-টেচো বাবা আমি হাত দিয়ে ঘাঁটতে পারব না—সে বলে দিচ্ছি।

–বাঃ, তুমি মাছ মারবে আর কেঁচোর বেলায় আমি?

–নে, রাস্তায় দাঁড়িয়ে এখন আর ফ্যাঁচক্যাঁচ করতে হবে না। চটপট চল শেয়ালদায়। পনেরো মিনিটের ভেতরেই একটা ট্রেন আছে।

আমি দাঁড়িয়ে ইতস্তত করছি, টেনিদা একটা হ্যাঁচকা মারলে। টানের চোটে হাতটা আমার কাঁধ থেকে উপড়েই এল বোধ হল। গেছি গেছি বলে আমি আর্তনাদ করে উঠলাম।

–যাবি কোথায়? আমার সঙ্গে দমদমায় না গেলে তোকে আর কোথাও যেতে দিচ্ছে কে! চল চল। রেডি—ওয়ান, টু–

কিন্তু থ্রি বলবার আগেই আমি যেন হঠাৎ দুটো পাখনা মেলে হাওয়ায় উড়ে গেলাম। মাথা ঝিমঝিম করতে লাগল, কানে শব্দ বাজতে লাগল ভোঁ-ভোঁ। খেয়াল হতে দেখি, টেনিদা একটা সেকেন্ড ক্লাস ট্রামে আমাকে তুলে ফেলেছে।

আমাকে বাজখাঁই গলায় আশ্বাস দিয়ে বললে, যদি মাছ পাই তবে ল্যাজ থেকে কেটে তোকে একটু ভাগ দেব।

কী ছোটলোক! যেন মুড়ো-পেটি আমি আর খেতে জানি না। কিন্তু তর্ক করতে সাহস হল না। একটা চাঁটি হাঁকড়ালেই তো মাটি নিতে হবে, তারপরে খাটিয়া চড়ে খাঁটি নিমতলাযাত্রা! মুখ বুজে বসে রইলাম। মুখ বুজেই শিয়ালদা পৌঁছুলাম। তারপর সেখান থেকে তেমনি মুখ বুজে গিয়ে নামলাম দমদমায় গোরাবাজারে।

রেললাইনের ধার দিয়ে বনগাঁর মুখে খানিকটা এগোতেই একটা পুরনো বাগানবাড়ি। টেনিদা বললে, চল, ওর ভেতরেই মাছ ধরবার বন্দোবস্ত আছে।

আমি তিন পা পিছিয়ে গেলাম। বললাম, খেপেছ? এর ভেতরে মাছ ধরতে যাবে কী রকম। ওটা নির্ঘাত ভুতুড়ে বাড়ি।

টেনিদা হনুমানের মতো দাঁত খিচিয়ে বললে, তোর মুণ্ড! ওটা আমাদের নিজেদের বাগানবাড়ি, ওর ভেতরে ভূত আসবে কোখেকে? আর যদি আসেই তো এক ঘুষিতে ভূতের বত্রিশটা দাঁত উড়িয়ে দোব–হুঁ হুঁ! আয়-আয়—

মনে মনে রামনাম জপতে জপতে আমি টেনিদার পিছনে পিছনে পা বাড়ালাম।

বাগানবাড়িটা বাইরে থেকে যতটা জংলা মনে হচ্ছিল, ভেতরে তা নয়। একটা মস্ত ফুলের বাগান। এখন অবশ্য ফুলটুল বিশেষ কিছু নেই, কিন্তু পাথরের কতকগুলো মূর্তি এদিকে ওদিকে ছড়ানো রয়েছে। কিছু কিছু ফলের গাছ—আম, লিচু, নারকেল—এইসব। মাঝখানে পুরনো ধরনের একখানা ছোট বাড়ি। দেওয়ালের চুন খসে গেছে, ইট ঝরে পড়েছে। এদিকে ওদিকে, তবু বেশ সুন্দর বাড়ি। মস্ত বারান্দা, তাতে খান কয়েক বেতের চেয়ার পাতা।

বারান্দায় উঠেই টেনিদা একখানা বোম্বাই হাঁক ছাড়লে, ওরে জগা—

দূর থেকে সাড়া এল, আসুচি।…তারপরেই দ্রুতবেগে এক উড়ে মালীর প্রবেশ। বললে, দাদাবাবু আসিলা?

টেনিদা বললে, ই আসিলাম। এতক্ষণ কোথায় ছিলি ব্যাটা গোভূত? শিগগির যা, ভালো দেখে গোটা কয়েক ডাব নিয়ে আয়।

—আনুচি—

বলেই জগা বিদ্যুৎবেগে বানরের মতো সামনের নারকেল গাছটায় চড়ে বসল, তারপর মিনিটখানেকের মধ্যেই নেমে এল ডাব নিয়ে। পর পর চারটে ডাব খেয়ে টেনিদা বললে, সব ঠিক আছে জগা?

জগা বললে, হুঁ।

বঁড়শি, টোপ, চার—সব?

জগা বললে, হুঁ।

–চল প্যালা, তাহলে পুকুরঘাটে যাই।

পুকুরঘাটে এলাম। সত্যিই খাসা পুকুরঘাট। শাদা পাথরে খাসা বাঁধানো। পুকুরে অল্প অল্প শ্যাওলা থাকলেও দিব্যি টলটলে জল। ঘাটটার ওপরে নারকেলপাতার ছায়া ঝিরঝিরে বাতাসে কাঁপছে। পাখি ডাকছে এদিকে ওদিকে। মাছ ধরবার পক্ষে চমৎকার জায়গা। ঘাটটার ওপরে দুটো বড় বড় হুইল বঁড়শিবঁড়শি দুটোর চেহারা দেখলে মনে হয় হাঙর কুমির ধরবার মতলব আছে।

টেনিদা আবার বললে, চার করেছিস জগা?

—হুঁ।

—কেঁচো তুলেছিস?

—হুঁ।

—তবে যা তুই, আমাদের জন্যে খিচুড়ির ব্যবস্থা করগে। আয় প্যালা, এবার আমরা কাজে লেগে যাই। নে বঁড়শিতে কেঁচো গাঁথ।

আমি কাঁদো কাঁদো মুখে বললাম, কেঁচো গাঁথব?

টেনিদা হুঙ্কার ছাড়ল : নইলে কি তোর মুখ দেখতে এখানে এনেছি নাকি? ওই তো বাংলা পাঁচের মতো তোর মুখ, ও-মুখে দেখবার মতো কী আছে র‍্যা? মাইরি প্যালা, এখন বেশি বকাসনি আমাকে–মাথায় খুন চেপে যাবে। ধর, কেঁচো নে।

কী কুক্ষণেই আজ বাড়ি থেকে বাইরে পা বাড়িয়েছিলাম রে। এখন প্রাণটা নিয়ে ঘরের ছেলে মানে মানে ঘরে ফিরতে পারলে হয়। আমার মুখের দিকে তাকিয়ে টেনিদার বোধহয় দয়া হল। বললে, নে নে, মন খারাপ করিসনি। আচ্ছা, আচ্ছা—মাছ পেলে আমি মুছোটা নেব আর সব তোর। ভদ্দর লোকের এক কথা। নে, এখন কেঁচো গাঁথ।

মাছ টেনিদা যা পাবে সে তো জানাই আছে আমার। লাভের মধ্যে আমার খানিক কেঁচো-ঘাঁটাই সার। এরই নাম পোড়া কপাল।

কিন্তু ভদ্দরলোকের এক কথা। সে যে কী সাংঘাতিক কথা সেটা টেনিদা টের পেল একটু পরে।

ছিপ ফেলে দিব্যি বসে আছি।

বসে আছি তো আছিই। জলের দিকে তাকিয়ে তাকিয়ে চোখ ব্যথা করতে লাগল। কিন্তু কা কস্য। জলের ওপর ফাতনাটি একেবারে গড়ের মাঠের মনুমেন্টের মতো খাড়া হয়ে আছে। একেবারে নট নড়ন-চড়ন–কিচ্ছু না।

আমি বললাম, টেনিদা, মাছ কই?

টেনিদা বললে, চুপ, কথা বলিসনি। মাছে ভয় পাবে।

আবার আধঘণ্টা কেটে গেল। বুড়ো আঙুলে কাঁচকলা দেখাবার মতো ফাতনাটি তেমনি মাথা তুলে দাঁড়িয়ে আছে। জলের অল্প অল্প ঢেউয়ে একটু একটু দুলছে, আর কিছু নেই।

আমি বললাম, ও টেনিদা, মাছ কোথায়?

টেনিদা বিরক্ত হয়ে বললে, থাম না। কেন বকরবকর করছিস র‍্যা? এসব বাবা দশ-বিশ সেরী কাতলার ব্যাপার—এ কী সহজে আসে? এ তো একেবারে পেল্লায় কাণ্ড। নে, এখন মুখে ইস্কুপ এঁটে বসে থাক।

ফের চুপচাপ। খানিক পরে আমি আবার কী একটা বলতে যাচ্ছি, কিন্তু টেনিদার দিকে তাকিয়েই থমকে গেলাম। ছিপের ওপরে একেবারে হুমড়ি খেয়ে পড়েছে, চোখ দুটো যেন ঠিকরে বেরিয়ে আসছে তার।

সত্যিই তো—এ যে দস্তুর মতন অঘটন। চোখকে আর বিশ্বাস করা যায় না; ফাতনা টিপটিপ করে নাচছে মাছের ঠোকরে।

আমাদের দু জোড়া চোখ যেন গিলে খাচ্ছে ফাতনাটাকে। দুহাতে ছিপটাকে আঁকড়ে ধরেছে টেনিদা—আর একটু গেলেই হয়! টিপটিপ—আমাদের বুক ঢিপঢিপ করছে সঙ্গে সঙ্গে। আমি চাপা গলায় চেঁচিয়ে উঠলাম, টেনিদা—

–জয় বাবা মেছো পেত্নী, হেঁইয়ো—

ছিপে একটা জগঝম্প টান লাগাল টেনিদা। সপাংসাঁই করে একটা বেখাপ্পা আওয়াজে বঁড়শি আকাশে উড়ে গেল, মাথার ওপর থেকে ছিড়ে পড়ল নারকেলপাতার টুকরো। কিন্তু বঁড়শি! একদম ফাঁকা মাছ তো দূরে থাক, মাছের একটি আঁশ পর্যন্ত নেই।

টেনিদা বললে, অ্যাঁ, ব্যাটা বেমালুম ফাঁকি দিলে! আচ্ছা, আচ্ছা যাবে কোথায়! আজ ওরই একদিন কি আমারই একদিন। নে প্যালা, আবার কেঁচো গাঁথ—

টান দেখেই বুঝতে পারছি কী রকম মাছ উঠবে! মাছ তো উঠবে না, উঠবে জলহস্তী। কিন্তু বলে আর চাঁটি খেয়ে লাভ কী, কেঁচো গাঁথা কপালে আছে, তাই গেঁথে যাই।

কিন্তু টেনিদার চারে আজ বোধ হয় গণ্ডা গণ্ডা রুই কাতলা কিলবিল করছে। তাই দু মিনিট না যেতেই এ কী! দু নম্বর ফাতনাতেও এবার টিপটিপ শুরু হয়েছে।

বললাম, টেনিদা, এবারে সামাল।

টেনিদা বললে, আর ফসকায়? বারে বারে ঘুঘু তুমি—হুঁ হুঁ! কিন্তু কথা বলিসনি প্যালা—চুপ। টিপটিপটিপ। টপ!

সাঁ করে আবার বঁড়শি আকাশে উঠল, আবার ছিড়ে পড়ল নারকেলপাতা। কিন্তু মাছ? হায়, মাছই নেই।।

টেনিদা বলেন, এবারেও পালাল? উঃ—জোর বরাত ব্যাটার। আচ্ছা, দেখে নিচ্ছি। কেঁচো গাঁথ প্যালা! আজ এসপার কি ওসপার।

তাজ্জব লাগিয়ে দিল বটে। বঁড়শি ফেলবামাত্র ফাতনা ড়ুবিয়ে নিচ্ছে, অথচ টানলেই ফাঁকা। এ কী ব্যাপার! এমন তো হয় না হওয়ার কথাও নয়।

টেনিদা মাথা চুলকোতে লাগল। পর পর গোটা আষ্টেক টানের চোটে মাথার ওপরে নারকেলগাছটাই ন্যাড়ামুড়ো হয়ে গেল, কিন্তু মাছের একটুকরো আঁশও দেখা গেল না।

টেনিদা বললে, এ কীরে, ভুতুড়ে কাণ্ড নাকি?

পিছনে কখন জগা এসে দাঁড়িয়েছে আমরা টেরও পাইনি। হঠাৎ পানে রাঙা একমুখ হেসে জগা বললে, আইজ্ঞা ভুতো নয়, কাঁকোড়া অছি।

–কাঁকোড়া? মানে কাঁকড়া?

জগা বললে, হুঁ।

–তবে আজ কাঁকড়ার বাপের শ্রাদ্ধ করে আমার শান্তি!… আকাশ কাঁপিয়ে হুঙ্কার ছাড়লে টেনিদা : বসে বসে নিশ্চিন্তে আমার চার আর টোপ খাচ্ছে? খাওয়া বের করে দিচ্ছি। একটা বড় দেখে ডালা কিংবা ধামা নিয়ে আয় তো জগা!

—ডালা! ধামা!—আমি অবাক হয়ে বললাম, তাতে কী হবে?

—তুই চুপ কর প্যালাবকালেই চাঁটি লাগাব। দৌড়ে যা জগাধামা নিয়ে আয়।

আমি সভয়ে ভাবলাম টেনিদার কি মাথা খারাপ হয়ে গেল নাকি? ধামা হাতে করে পুকুরে মাছ ধরতে নামবে এবারে?… কিন্তু–

কিন্তু যা হল তা একটা দেখবার মতো ঘটনা। শাবাশ একখানা খেল, একেবারে ভানুমতীর খেল। এবার ফাতনা ড়ুবতেই আর হেঁইয়া শব্দে টান দিলে না টেনিদা। আস্তে আস্তে অতি সাবধানে বঁড়শিটাকে ঘাটের দিকে টানতে লাগল। তারপর বঁড়শিটা যখন একেবারে কাছে চলে এসেছে, তখন দেখা গেল মস্ত একটা লাল রঙের কাঁকড়া বঁড়শিটা প্রাণপণে আঁকড়ে আছে। টেনিদা বললে, বঁড়শি জলের ওপর তুললেই ও ব্যাটা ছেড়ে দেবে। বঁড়শি আমি তোলবার আগে ঠিক জলের তলায় ধামাটা পেতে ধরবি, বুঝলি জগা! তারপর দেখা যাবে কে বেশি চালাক—আমি, না ব্যাটাচ্ছেলে কাঁকড়া!

তারপর আরম্ভ হল সত্যিকারের শিকারপর্ব। টেনিদার বুদ্ধির কাছে এবারে কাঁকড়ার দল ঘায়েল। আধঘণ্টার মধ্যে ধামা বোঝাই।

দুটো প্রকাণ্ড প্রকাণ্ড হুইলের শিকার দু কুড়ি কাঁকড়া!

টেনিদা বললে, মন্দ কী! কাঁকড়ার ঝোলও খেতে খারাপ নয়। তোর খিচুড়ি কতদূর জগা?

কিন্তু ভদ্রলোকের এক কথা। আমি সেটা ভুলিনি।

বললাম, টেনিদা, মুড়োটা তোমার—আর ল্যাজা-পেটি আমার মনে আছে তো?

টেনিদা আঁতকে বললে, অ্যাাঁ।

আমি বললাম, হ্যাঁ।

টেনিদা এক মিনিটে কাঁচুমাচু হয়ে গেল, তা হলে?

–তা হলে মুড়ো, অর্থাৎ কাঁকড়ার দাঁড়া দুটো তোমার, আর বাকি কাঁকড়া আমার।

টেনিদা আর্তনাদ করে বললে, সে কী?

আমি বললাম, ভদ্দরলোকের এক কথা।

—তা হলে কাঁকড়ার কি মুড়ো নেই?

মুড়ো না থাকলেও মুখ আছে, কিন্তু আমি সে চেপে গেলাম। বললাম, ওই দাঁড়াই হল ওদের মুড়ো।

টেনিদা খানিকক্ষণ চুপ করে দাঁড়িয়ে রইল, তারপর আস্তে আস্তে বসে পড়ল। বললে, প্যালা, তোর মনে এই ছিল! ও হো-হো-হো-

তা যা খুশি বলল। বঙ্গেশ্বরী মিষ্টান্ন ভাণ্ডারে সাড়ে তিন টাকার শোক কি আমি এর মধ্যেই ভুলেছি!

আজ দুদিন বেশ আরামে কাঁকড়ার ঝোল খাচ্ছি। টেনিদা দাঁড়া কী রকম খাচ্ছে বলতে পারব না, কারণ রাস্তায় সেদিন আমাকে দেখেও ঘাড় গুঁজে গোঁ-গোঁ করে চলে গেল, যেন চিনতেই পারেনি।

 সাংঘাতিক

সাত দিন পরেই পরীক্ষা। আর কী? সেই কালান্তক স্কুল-ফাইন্যাল।

পর পর দুবার শাদা কালিতে আমার নাম ছাপা হয়েছে, তিন বারের বার যদি তাই ঘটে–তাহলে বড়দা শাসিয়েছে আমাকে সোদপুরে রেখে আসবে।

–সোদপুরে তো গান্ধীজী থাকতেন। আমি গম্ভীর হয়ে বলেছিলাম।

–তুমিও থাকবে। বড়দা আরও গম্ভীর হয়ে বললে, তবে গান্ধীজী যেখানে থাকতেন সেখানে নয়। তিনি যাদের দুধ খেতেন–তাদের আস্তানায়।

–মানে?

–মানে পিঁজরাপোলে।

আমি ব্যাজার হয়ে বললাম, পিজরাপোলে কেন থাকতে যাব? ওখানে কি মানুষ থাকে?

মানুষ থাকে না, গোরু-ছাগল তো থাকে। সেজন্যেই তো তুই থাকবি। কচিকচি ঘাস খাবি আর ভ্যা-ভ্যা করে ডাকবি। শুনে মনটা এত খারাপ হল যে কী বলব। একদিন সন্ধেবেলা গড়ের মাঠে গিয়ে চুপি চুপি একমুঠো কাঁচা ঘাস খেয়ে দেখলাম–যাচ্ছেতাই লাগল! ছাদে গিয়ে একা-একা ব্যা ব্যা করেও ডাকলাম, কিন্তু ছাগলের মতো সেই মিঠে প্রাণান্তকর আওয়াজটা কিছুতেই বেরুল না।

তাই ভারি দুশ্চিন্তায় পড়লাম। গিয়ে বললাম লিডার টেনিদাকে।

টেনিদার অবস্থা আমার মতোই। এবার নিয়ে ওর চারবার হবে। হাবুল সেনের দ্বিতীয় বার। শুধু হতভাগা ক্যাবলাটাই লাফে লাফে ফার্স্ট হয়ে এগিয়ে আসছে–তিন ক্লাস নীচে ছিল, ঠিক ধরে ফেলেছে আমাকে। এর পরে যদি টপকে চলে যায় তাহলে সত্যিই পিঁজরাপোলে যেতে হবে!

চাটুজ্যেদের রোয়াকে বসে টেনিদা আতা খাচ্ছিল। গভীরভাবে চিন্তা করতে গিয়ে গোটাকয়েক বিচি খেয়ে ফেললে। তারপর অন্যমনস্কভাবে, খোসাটা যখন অর্ধেক খেয়ে ফেলেছে, তখন সেটাকে থুথু করে ফেলে দিয়ে বললে, ইউরেকা। হয়েছে।

–কী হয়েছে?

–প্ল্যানচেট।

–প্ল্যানচেট কাকে বলে?

টেনিদা বললে, তুই একটা গাধা। প্ল্যানচেট করে ভূত নামায়–জানিসনে?

এর মধ্যেই কোত্থেকে পাঁঠার ঘুগনি চাটতে চাটতে ক্যাবলা এসে পড়েছে। বললে, উঁহু, ভুল হল। ওর উচ্চারণ হবে প্লাসে।

–থাম-থাম–বেশি ওস্তাদি করিসনি! ভূতের কাছে আবার শুদ্ধ উচ্চারণ! তারা তো চন্দ্রবিন্দু ছাড়া কথাই কইতে পারে না–বলেই ছোঁ মেরে ক্যাবলার হাত থেকে ঘুগনির পাতাটা কেড়ে নিল টেনিদা।

ক্যাবলা হায় হায় করে উঠল। টেনিদা একটা বাঘাটে হুঙ্কার করে বললে, থাম, চিল্লাসনি। এ হল তোর ধৃষ্টতার শাস্তি। বলতে বলতে জিভের এক টানে ঘুগনির পাতা একদম সাফ।

ভেবেছিলাম আমাকেও একটু দেবে–কিন্তু পাতার দিকে তাকিয়ে বুকভরা আশা একেবারে ধুক করে নিবে গেল। বললাম, মরুক গে, প্ল্যানচেট আর প্লাসে কিন্তু ওসব ভুতুড়ে কাণ্ড আবার কেন? ভূত-টুত আমার একেবারেই পছন্দ হয় না।

টেনিদা হেঁ-হেঁ করে বললে, আছে রে গোমুখ–আছে। সবাই কি আর তালগাছের মতো হাত বাড়িয়ে ঘাড় মটকে দেয়? ওদের মধ্যেও দু-চারটে ভদ্র লোক আছে। তারা পরীক্ষার কোশ্চেন-টোশ্চেন বলে দেয়।

–অ্যাঁ?

–তবে আর বলছি কী! টেনিদা এবার শালপাতার উলটো দিকটা একবার চেটে দেখল। কিছু পেলে না–তালগোল পাকিয়ে ক্যাবলার মুখের ওপর পাতাটা ছুঁড়ে দিলে। বললে, আমার বিরিঞ্চি মামা কিছুতেই আর বি. এ পাশ করতে পারে না। গুনে গুনে আঠারো বার। গাঁজা খেলো। শেষকালে যখন আমার মামাতো ভাই গুবরে বি. এ ক্লাসে উঠল, তখন মামা কিছুতেই আর বি,এলার মুখের ওপর পাতা একবার চেটে বিরিঞ্চি মামার আর সইল না। প্ল্যানচেটে বসল। আর বললে পেত্যয় যাবি না প্যালাটপ টপ করে কোশ্চেন-পেপার এসে পড়তে লাগল টেবিলের ওপর।

–পরীক্ষার পরে না আগে? রোমাঞ্চিত হয়ে আমি জানতে চাইলাম।

দূর উল্লুক! পরে হবে কেন রে, একমাস আগে।

হঠাৎ ক্যাবলা একটা বেয়াড়া প্রশ্ন করে বসল।

–আচ্ছা টেনিদা সবসুদ্ধ তোমার ক’টা মামা?

–অত খবরে তোর দরকার কী রে গর্দভ? পুলিশ কমিশনার থেকে পকেটমার পর্যন্ত সারা বাংলাদেশে আমার যত মামা, তাদের লিসটি করতে গেলে একটা গুপ্ত প্রেসের পঞ্জিকা হয়ে যায়–তা জানিস?

–ছাড়ান দে–ছাড়ান দে। বললে হাবুল সেন।

আমি বললাম, আমাদের অঙ্কের কোশ্চেন যে করেছে সে কি তোমার মামা হয় নাকি?

–কে জানে, হতেও পারে! টেনিদা তাচ্ছিল্য করে জবাব দিলে।

–তা হলে তাকেই প্ল্যানচেটে ডাকো না!

–চুপ কর বেল্লিক! জ্যান্ত মানুষ কি কখনও প্লানচেটে আসে? ভূতকে ডাকতে হয়। ভূতের অসীম ক্ষমতা–যা ইচ্ছে তাই করতে পারে। তেমন-তেমন ভূত যদি আসে ব্যস্–মার দিয়া কেল্লা!

–বেশ তো-আনো না তবে ভূতকে? আমি অনুনয় করলাম।

–বললেই হল? টেনিদা প্রায় ভূতের মতো দাঁত খিচোল : ভূত কি চানাচুরওয়ালা যে ডাকলেই আসবে? তার জন্যে হ্যাঁপা আছে না? অন্ধকার ঘর চাই–টেবিল চাই–চারজন লোক চাই—

ক্যাবলার চোখ দুটো মিটমিট করছিল। বললে, ঠিক আছে। আমাদের গ্যারাজের পাশে একটা অন্ধকার ঘর আছে–একটা পা-ভাঙা টেবিল আমি দেব, আর চার মূর্তি আমরা তো আছিই।

টেনিদা বললে, বাঃ, গ্র্যান্ড! শুনে এত ভালো লাগছে যে তোর পিঠে আমার তিনটে চাঁটি মারতে ইচ্ছে করছে!

ক্যাবলা একলাফে রোয়াক থেকে নেমে পড়ল। বললে, তা হলে আজ রাত্রেই?

টেনিদা বললে, হ্যাঁ–আজ রাত্রেই।

আমার কেমন যেন সুবিধে মনে হচ্ছিল না। ভূত-টুত কেমন যেন গোলমেলে ব্যাপার! কিন্তু সাতদিন পরেই যে স্কুল ফাঁইন্যাল! আর তার দেড়মাস বাদেই পিঁজরাপোল!

অগত্যা নাক-টাক চুলকে আমায় রাজি হয়ে যেতে হল।

বাড়ির পেছনে গ্যারাজ–এমনি ঘুরঘুটটি অন্ধকার সেখানে, গ্যারাজের পাশের ছোট টিনের ঘরটা যেন ভুযো কালি মাখানো। গিয়ে দেখি ক্যাবলা সব বন্দোবস্ত করে রেখেছে। একটা পায়া-ভাঙা টেবিল। তার চারদিকে চারটে চেয়ার। একটু দূরে লম্বা দড়ির সঙ্গে ছোট একটা বস্তা ঝুলছে। টেবিলের ওপর ক্যাবলা একটা মোমবাতি জ্বেলে রেখেছিল–তার আলোতেই সব দেখতে পেলাম।

বস্তাটা দেখিয়ে হাবুল বললে, ওইটা কী ঝুল্যা আছে রে! খাওন-দাওনের কিছু আছে নাকি?

টেনিদা বললে, পেট-সর্বস্ব সব–খালি খাওয়াই চিনেছে! ওটা বকসিংয়ের বালির বস্তা।

–ভূত আইস্যা ওইটা লইয়া বকসিং কোরব নাকি? হাবুলের জিজ্ঞাসা।

ক্যাবলা হেসে বললে, ওটা ছোড়দার।

টেনিদা বললে, থাম–এখন বেশি বাজে বকিসনি। এবার কাজ শুরু করা যাক। হ্যাঁ রে ক্যাবলা–এদিকে কেউ কখনও আসবে না তো?.

–না, সে ভয় নেই।

–তবে দরজা বন্ধ করে দে।

ক্যাবলা দরজা বন্ধ করে দিলে। টেনিদা বললে, চারজনে চারটে চেয়ারে বসব আমরা। আলো নিবিয়ে দেব। তারপরে ধ্যান করতে থাকব।

–ধ্যান? কীসের ধ্যান?–আমি জানতে চাইলাম।

–ভূতের। মানে অঙ্কের কোশ্চেন বলে দিতে পারে–এমন ভূতের।

হাবুল বললে, সেইডা মন্দ কথা না। হারু পণ্ডিতের ডাকন যাউক।

হারু পণ্ডিত! শুনে আমার বুকের ভেতরে একেবারে ছাত করে উঠল। তিন বছর আগে মারা গেছেন হারু পণ্ডিত। দুর্দান্ত অঙ্ক জানতেন। তার চাইতেও জানতেন দুর্দান্তভাবে পিটতে। একটা চৌবাচ্চার নল দিয়ে জল-টল ঢোকার কী সব অঙ্ক দিতেন, আমরা হাঁ করে থাকতাম আর পটাৎ পটাৎ গাঁট্টা খেতাম। সেই হারু পণ্ডিতকে ডাকা।

আমি বললাম, বড় মারত যে!

-এখন আর মারবে না। ভূত হয়ে মোলায়েম হয়ে গেছে। তা ছাড়া কেউ তো ডাকে–আমরা ডাকলে কত খুশি হবে দেখিস। শুধু অঙ্ক কেন–চাই কি আদর করে সব কোশ্চেনই বলে দেবে! টেনিদা আমাকে উৎসাহিত করলে।

ক্যাবলা বললে, তবে ধ্যানে বসা যাক।

আমি বললাম, হ্যাঁ ভাই, একটু তাড়াতাড়ি। বেশি দেরি হয়ে গেলে বড়দা কান পেঁচিয়ে দেবে। আমি বলে এসেছি ক্যাবলার কাছে অঙ্ক কষতে যাচ্ছি।

টেনিদা বললে, আমি আলো নিবিয়ে দিচ্ছি। তার আগে শেষ কথাগুলো বলে নিই। সবাই হারু পণ্ডিতকে ধ্যান করবি। এক মনে, এক প্রাণে। সেই দাড়ি–সেই ডাঁটভাঙা চশমা, সেই টাক–সেই নস্যি নেওয়া–

ক্যাবলা বললে, সেই গাঁট্টা–

টেনিদা ধমক দিয়ে বললে, চুপ, বাজে কথা এখন বন্ধ। শুধু ধ্যান। এক মনে, এক প্রাণে। শুধু প্রার্থনা : “স্যার–দয়া করে একবার আসুন–আপনার অধম ছাত্রদের পরীক্ষার কোশ্চেনগুলো বলে দিয়ে যান।” আর কিছু না–আর কোনও কথা নয়। আচ্ছা আমি আলো নেবাচ্ছি। ওয়ান-টু-থ্রি—

টুক করে আলো নিবে গেল।

বাপস, কী অন্ধকার! দম যেন আটকে যায়। ভয়ে আমার গা শিরশির করতে লাগল। ধ্যান করব কী ছাই, এমনিতেই মনে হচ্ছিল, চারদিকে যেন সার বেঁধে ভূত দাঁড়িয়ে আছে।

তবু ধ্যানের চেষ্টা করা যাক। কিন্তু কী যাচ্ছেতাই মশা এ-ঘরে। পা দুটো একেবারে ফুটো করে দিচ্ছে। অনেকক্ষণ দাঁত-টীত খিঁচিয়ে থেকে আর পারা গেল না। চটাস করে একটা চাঁটি মারলাম।

কিন্তু একি! পায়ে চাঁটি মারলাম কিন্তু লাগল না তো? আমার পা কি একেবারে অসাড় হয়ে গেছে? আর আমার পাশ থেকে হাবুল তখুনি হাঁইমাই করে চেঁচিয়ে উঠল : অ টেনিদা, ভূতে আমার পায়ে ঠাঁই কইর‍্যা একটা চোপড় মারছে।

টেনিদা বললে, শাট আপ। ধ্যান করে যা।

–কিন্তু আমারে যে চোপড় মারল।

–ধ্যান না করলে আরও মারবে। চোখ বুজে বসে থাক।

আমি একদম চুপ। এঃ হে-হে–ভারি ভুল হয়ে গেছে। অন্ধকারে নিজের ঠ্যাং ভেবে হাবুলের পায়েই চড় মেরে দিয়েছি।

আরও কিছুক্ষণ কাটল। ধ্যান করবার চেষ্টা করছি কিন্তু কিছুতেই কিছু হচ্ছে না। হারু পণ্ডিতের টাক আর দাড়িটা বেশ ভাবতে পারছি, কিন্তু সঙ্গে সঙ্গেই গাঁট্টটাও বিচ্ছিরিভাবে মনে পড়ে যাচ্ছে। তক্ষুনি ধ্যান বন্ধ করে দিচ্ছি। ওদিকে আবার দারুণ খিদে পাচ্ছে। আসবার সময় দেখেছি রান্নাঘরে মাংস চেপেছে। এতক্ষণে হয়েও গেছে বোধহয়। বাড়িতে থাকলে ঠাকুরের কাছে গিয়ে এক-আধটু চাখতে-টাখতেও পারতাম। যতই ভাবি, খিদেটা ততই যেন নাড়ির ভেতরে পাক খেতে থাকে।

হঠাৎ অন্ধকার ভেদ করে রব উঠল : ব্যা-ব্যা-ব্যা–অ্যা-অ্যা–

কী সর্বনাশ! ধ্যান করতে করতে শেষকালে পাঁঠার আত্মা ডেকে আনলাম নাকি! এতক্ষণ যে মাংসের কথাই ভাবছিলাম।

আমার পাশ থেকে হাবুল কাঁপা গলায় বললে, অ টেনিদা–পাঁঠা ভূত!

অন্ধকারে টেনিদা গর্জন করলে : যেমন তোরা পাঁঠা-পাঁঠা ভূত ছাড়া আর কী আসবে তোদের কাছে।

ক্যাবলা খিকখিক করে হেসে উঠল। সঙ্গে সঙ্গেই আবার শোনা গেল : ভ্যা–অ্যা–অ্যা–অ্যা–

টেনিদা বললে, অমন কত আসবে। ধ্যানে বসলে সবাই আসতে চায় কিনা। এখন কেবল একমনে জপ করে যা–পাঁঠা ভূত, তুমি চলে যাও, স্বর্গে গিয়ে ঘাস খাও। আমরা শুধু হারু পণ্ডিতকে চাই। সেই টাক, সেই দাড়ি–সেই নস্যির ডিবে–আমাদের সেই স্যারকেই চাই। আর কাউকে না–কাউকেই না–

পাঁঠা ভূতকে যে আমিই ডেকে ফেলেছি সেটা চেপে গেলাম। কিন্তু আমার পায়ে ওটা কী সুড়সুড়ি দিয়ে গেল? প্রায় চেঁচিয়ে বলতে যাচ্ছি হঠাৎ টের পেলাম–আরোশোলা।

খিদেটা ভুলে গিয়ে প্রাণপণে স্যারকে ডাকতে চেষ্টা করতে লাগলাম। কিন্তু বেশিক্ষণ ধ্যানের জো আছে? ঘটাং করে কে যেন আমার পায়ে ল্যাং মারল।

–টেনিদা। ভূতে ল্যাং মারছে আমাকে–আমি আর্তনাদ করলাম।

হাবুল বলে উঠল : আঃ–খামখা গাধার মতন চাঁচাস ক্যান? আমার পা-টা হঠাৎ লাইগ্যা গেছে।

টেনিদা দাঁত কিড়মিড় করে উঠল : উঃ–এই গাড়লগুলোকে নিয়ে কি ধ্যান হয়? তখন থেকে সমানে ডিসটার্ব করছে। এবার যে একটা কথা বলবে, তার কান ধরে সোজা বাইরে ফেলে দেব।

আবার ধ্যান শুরু হল।

প্রায় হারু পণ্ডিতকে ধ্যানের মধ্যে এনে ফেলেছি। এল, এল–এসেই পড়েছে বলতে গেলে। টাকটা প্রায় আমার চোখের সামনে-মনে হচ্ছে যেন দাড়ির সুড়সুড়ি আমার মুখে এসে লাগছে। একমনে বলছি : দোহাই স্যার, স্কুল ফাঁইন্যাল স্যার–অঙ্কের কোশ্চেন স্যার।–আর ঠিক তক্ষুনি–

কেমন একটা বিটকেল শব্দ হল মাথার ওপর।

চমকে তাকাতে দেখি টিনের চালের গায়ে দুটো জ্বলজ্বলে চোখ। ঠিক যেন মোটা মোটা চশমার আড়াল থেকে হারু পণ্ডিত আমার দিকে চেয়ে রয়েছেন। আমার পালাজ্বরের পিলেটা সঙ্গে সঙ্গে তড়াং করে লাফিয়ে উঠল।

–ওকি–ওকি টেনিদা।–আমি আবার আর্তনাদ করে উঠলাম। সঙ্গে সঙ্গে সেই জ্বলন্ত চোখ দুটো যেন শূন্য থেকে ঝাঁপিয়ে পড়ল–আর আমার মাথায় এসে লাগল এক রামচাঁটি। ভূত হয়ে সে চাঁটি মোলায়েম হওয়া তো দূরে থাক–আরও মোক্ষম হয়ে উঠেছে।

বাপ্ রে গেছি বলে আমি এক প্রচণ্ড লাফ মারলাম। সঙ্গে সঙ্গে টেবিল উলটে পড়ল।

–খাইছে–খাইছে–ভূতে খাইছে রে-হাবুল কেঁদে উঠল।

–টেবিল চাপা দিয়ে আমায় মেরে ফেলে দিলে রে–টেনিদার চিৎকার শোনা গেল।

অন্ধকারে আমি দরজার দিকে ছুটে পালাতে চাইলাম। সঙ্গে সঙ্গেই কে যেন আমার ঘাড়ে লাফ দিয়ে পড়ল। আমার গলা দিয়ে–গ্যাঁ- ঘোঁক–বলে একটা আওয়াজ বেরুলো-আর তার পরেই–সর্ষে ফুল। ঝিঁঝির ডাক। পটলডাঙার প্যালারাম একেবারে ঠায় অজ্ঞান।

চোখ মেলে দেখি, মেঝেয় পড়ে আছি। ঘরে মোমবাতি জ্বলছে, আর ক্যাবলা আমার মাথায় জল দিচ্ছে। চেয়ার টেবিলগুলো ছত্রাকার হয়ে আছে ঘরময়।

আমি বললাম, ভু–ভু–ভূত।

ক্যাবলা বললে, না–ভূত নয়। টেনিদা আর হাবুল তক্ষুনি পালিয়েছে বটে, কিন্তু তোকে চুপি চুপি সত্যি কথা বলি। ঘরটার পেছনেই একটা ছাগল বাঁধা আছে। দাদুর হাঁপানি রোগ আছে কিনা, ছাগলের দুধ খায়। সেই ছাগলটাই ডাকছিল।

–আর সেই জ্বলজলে চোখ? সেই চাঁটি?

–হুলোর।

–হুলো কে?

–আমাদের বেড়াল। এ-ঘরে প্রায়ই ইঁদুর ধরতে আসে।

–কিন্তু হুলো কি অমন চাঁটি মারতে পারে?

–চাঁটি মারবে কেন রে বোকা? তুই চ্যাঁচালি–ভয় পেয়ে হুলোও চাল থেকে লাফ দিলে। পড়বি তো পর ছোড়দার স্যান্ডব্যাগের ওপরে। আর সঙ্গে সঙ্গে ব্যাগ দোল খেয়ে

এসে তোর মাথায় লাগল–তুই ভাবলি হারু পণ্ডিতের গাঁট্টা।ক্যাবলা হেসে উঠল।

–আর আমার ঘাড়ে অমন করে লাফিয়ে পড়ল কে?

–হাবলা। ভয় পেয়ে বেরুতে গিয়ে তোকে বিধ্বস্ত করে চলে গেছে।ক্যাবলা হেসে উঠল আবার।

আমি আবার চোখ বুজলাম। ক্যাবলার কথাই হয়তো ঠিক। কিন্তু আমার মন বলছে–ওই হুলো আর বালির বস্তার মধ্য দিয়ে সত্যি সত্যিই হারু পণ্ডিতের মোম চাঁটি আমার মাথায় এসে লেগেছে।

কারণ, পৃথিবীতে অমন দুর্মদ চাঁটি আর কেউ হাঁকড়াতে পারে না। আর কিছুতেই না।

হনোলুলুর মাকুদা

শ্রদ্ধানন্দ পার্কে আমি বেশ নরম গলায় গান গাইতে চেষ্টা করেছিলুম, এমন দেশটি কোথাও খুঁজে পাবে নাকো তুমি–আর টেনিদা বেশ উদাস হয়ে একটার পর একটা চীনেবাদাম চিবিয়ে খাচ্ছিল। ঠিক সেই সময় পাশ থেকে কে যেন গলা খাঁকারি দিয়ে বললে, হু-হুম্।

চেয়ে দেখি লম্বা চেহারার একটি লোক, গায়ে রংচটা হলদে মতন একটা পুরনো ওভারকোট, পরনে তালিমারা ট্রাউজার আর গালভর্তি এলোপাথাড়ি দাড়ির সঙ্গে একমুখ হাসি। দাঁতগুলো আবার পানের ছোপধরা–ঠিক একরাশ কুমড়োর বিচির মতো মনে হল।

লোটা আবার বললে, আমি প্রতিবাদ করছি। এর চাইতে ভালো দেশ পৃথিবীতে অনেক আছে।

টেনিদার চীনেবাদাম চিবানো বন্ধ হয়ে গেল।

–আচ্ছা লোক তো মশাই। আপনি বাঙালী হয়ে বাংলা দেশের নিন্দে করছেন?

–আমি বাঙালী নই। আমি ভারতবর্ষের লোকই নই।

–তবে কি বাঙাল? না পাকিস্তানি?

–না–আমি হনোলুলুর লোক।

–হনোলুলু?–টেনিদার গলায় চীনেবাদাম আটকে গেল। আর আমি কাকের মতো হাঁ করে চেয়ে রইলুম লোকটার মুখের দিকে।

বার কয়েক কেশে-টেশে টেনিদা সামলে নিলে। তারপর বললে, চালিয়াতির আর জায়গা পাননি স্যার? দিব্যি বাঙালী চেহারা আপনার–চমৎকার বাংলায় কথা বলছেন, আপনি হনোলুলুর লোক? তা হলে আমি তো ম্যাডাগাস্কারের লোক আর এই প্যালাটা হচ্ছে আফ্রিকার গরিলা।

আমি দারুণ প্রতিবাদ করে বললুম, কক্ষনো না, আমি মোটেই আফ্রিকার গরিলা নই। বরং তোমাকে অস্ট্রেলিয়ার ক্যাঙারু বলা যেতে পারে।

গালভর্তি এলোমেলো দাড়ি আর কুমড়োর বিচির মতো দাঁত নিয়ে আবার হেসে উঠল লোকটা। বললে, ছিঃ খোকারা, নিজেদের মধ্যে ঝগড়া করতে নেই। আমি হনোলুলুর লোক কি না জানতে চাও? তোমরা অ্যানথ্রপোলজি পড়েছ?

আমরা বললুম, না, পড়িনি।

–পিথেকানথ্রোপাস ইরেকটাসের কথা কিছু জানো?

আমরা আঁতকে উঠে বললুম, না–জানি না।

–সেই জন্যেই বুঝতে পারছ না। এসব পড়লে-টড়লে জানতে, বাঙালী আর হনোলুলুর লোকের চেহারা একই রকম।

গোটা দুতিন কটকটে নামের ধাক্কাতেই আমরা কাত হয়ে গিয়েছিলুম, তেমনি বোকার মতো চেয়ে রইলুম লোকটার দিকে।

লোকটা তেমনি বলে যেতে লাগল : আর বাংলা শিখলুম কী করে? আমি হচ্ছি ওয়ার্ল্ড-ট্যুরিস্ট–অর্থাৎ ভূ-পর্যটক। আর জানোই তো, টুরিস্টদের দুনিয়ার তামাম ভাষা শিখতে হয়।

–আপনি সব ভাষা জানেন?–টেনিদা এবার নড়েচড়ে সোজা হয়ে বসল।

–আলবাত।

জাপানী বলুন তো?

কাই-দু চি নাগাসাকি হিরোহিতো-উচিমিরো-কিচিকিদা বুঝতে পারছ?

আমি বললুম, পরিষ্কার বুঝতে পারছি। আচ্ছা, একটু জার্মান বলুন!

–ভোলতেনজেন-কুলতুরক্যাম্প-ব্লিৎক্রিগ-গট ইন্ হিম্মেল!

টেনিদা বললে, খুব ইন্টারেস্টিং তো? ফরাসীও নিশ্চয় জানেন?

লোকটা মিটমিট করে হেসে বললে, আঁফাঁ তেরিব্বল–বঁজুর মঁসিয়ো–সিল ভূ প্লে-ক্যাস্ কে সে।

টেনিদা বললে, দারুণ।

আমি চোখ কপালে তুলে বললুম, নিদারুণ।

–আর শুনতে চাও?

না স্যার, এতেই দম আটকে আসছে। আপনার নামটা জানতে পারি?

আমার নাম ম্যাকাদিনি বেনিহিত অ্যাসপারাগাস ডি প্রোফান্ডিস।

কী সর্বনাশ!

লোকটা তালিমারা ট্রাউজারের পকেটে হাত পুরে বেশ কায়দা করে শিস দিলে একটা। বললে, আমাদের হনোলুলুর নাম একটু লম্বাই হয়। তোমাদের বাঙালী নামই বা কিসে কম? এই তো একটু আগেই এক ভদ্রলোকের সঙ্গে আলাপ হল–তাঁর নাম নিত্যরঞ্জন দত্ত রায়চৌধুরী।

টেনিদা মাথা চুলকে বলল, যেতে দিন স্যার, কাটাকাটি হয়ে গেল। কিন্তু অত বড় নামে তো আপনাকে ডাকা যাবে না, একটু শর্টকাট করতে পারলে

-আচ্ছা, আচ্ছা, ম্যাকাদিনি বোলো। তোমাদের বাংলা মতে ম্যাকুবাবুও বলতে পারো।

আমি বললুম, মাকু বললে হয় না?

–তাও হয়।-লোকটা একগাল হাসল : মাকুদাই বরং বোলো আমাকে। বেশ একটা ভাই ভাই সম্পর্ক হয়ে যাবে। আর জানোই তো–এটা বিশ্বপ্রেমের যুগ।

টেনিদা বললে, নিশ্চয়। এখন চারিদিকেই তো বিশ্বপ্রেম। তা মাকুদা–আপনি কিন্তু  আমাদের প্রাণে বড় ব্যথা দিয়েছেন।

মাকুদা বললে, দিয়েছি নাকি? গট ইন হিম্মেল। কখন দিলুম?

-একটু আগেই। প্যালা গান গাইছিল, এমন দেশটি কোথাও খুঁজে পাবে নাকো তুমি-আপনি ফস করে বলে বসলেন যে, আপনি তার প্রতিবাদ করছেন।

মাকুদা আমাদের পাশে বসে পড়ল এতক্ষণে। তালিমারা ট্রাউজারের পকেট থেকে একটা বিড়ি বের করে সেটা ধরিয়ে নিলে। তারপর বললে, আঁফাঁ তেরিবল। মানে আমি খুব দুঃখিত। মাত্র তিন দিন আগেই আমি জাপান থেকে এসেছি কিনা। সেখানে যে আদর যত্ন পেয়েছি, তার কথা যখনই মনে পড়ছে–তখনই ভাবছি হিরিসুমা কুচিকিদো–অর্থাৎ কিনা,–আহা সে স্বর্গ।

তাই নাকি।

-কী আর বলব তোমাদের। এলোমেলো দাড়িতে-ভর্তি গালটাকে ছুঁলো করে নিয়ে মাকুদা চোঁ করে বিড়িতে একটা টান দিলে : প্রথম যেদিন জাপানে পা দিলুম কাউকে চিনিটিনি না, সবে দুপা পথে বেরিয়েছি, হঠাৎ দুজন লোক আমাকে স্যালুট করে বললে, ইসিকিমা কিচিকিচি?–মানে, তুমি কি বিদেশী? আমি বললুম, উচি উচি–মানে হ্যা হ্যা। লোক দুটো বললে, ওকাকুরা আসাবুরো–মানে আমাদের সঙ্গে এসো।

টেনিদা জানতে চাইল : তারপর?

-তারপর? নিয়ে গেল একটা ফার্স্ট ক্লাস হোটেলে। কত যে কী খাওয়াল সে আর কী বলব। চাউচাউ, ব্যাঙের রোস্ট–আহা, মনে পড়লে এখনও পেটের ভেতর চনচন করে ওঠে। পেট ভরে খাইয়ে-দাইয়ে হাতে দুশো ইয়েন-মানে জাপানী টাকা দিয়ে বললে, দোজিমুরা কাঁচুমাচু–অর্থাৎ কিনা, তোমায় সামান্য কিছু হাত খরচ দিলুম।

টেনিদা বললে, ইস–একবার তো জাপান যেতে হচ্ছে। ওখাবারগুলো এখানকার চীনে হোটেলে পাওয়া যায়-ই-ই-স্!

–যেয়ো। শুধু জাপান? যেই ফ্রান্সে গেছি, অমনি এক ভদ্রলোক বোঁ করে তাঁর মস্ত মোটরটা আমার পাশে থামালেন। বললেন, মঁসিয়ো, ভেনেজাভেক মোয়া।–মানে আমার সঙ্গে আসুন। গাড়িতে তুলে নিয়ে গেলেন তাঁর মস্ত বাড়িতে। তারপর কী যত্ন কী খাওয়া-দাওয়া। বললেন, আ তু দো লাং? মানে-ফরাসী দেশ দেখবেন? ক্রজ্যাত ত্র্যা মেশা–মানে আমার গাড়ি করে যত ইচ্ছে ঘুরুন।

আমি বললুম, টেনিদা, ফ্রান্সেও একবার যাওয়া দরকার।

টেনিদা বললে, হুঁ, কাল-পরশুর মধ্যেই বেরিয়ে পড়লেই হয়। সে পরে ভাবা যাবে। কিন্তু মাকুদা, বাংলা দেশে এসে

মাকুন্দা শেষ টান মেরে বিড়িটা সামনের একটা ঝোপের মধ্যে ফেলে দিলে! উদাস হয়ে বললে, বাংলা দেশ হচ্ছে এক নম্বরের গেফানজেন–মানে অতিশয় বাজে জায়গা। এক কাপ চা তো দূরের কথা–কেউ একটা বিড়ি পর্যন্ত অফার করে না হে। বিদেশী টুরিস্ট–হনোলুলু থেকে আসছি–আমার দিকে একবার কেউ তাকায় না পর্যন্ত। কাল এক ভদ্রলোককে জিজ্ঞেস করতে যাচ্ছিলুম-ট্রামটা কোন্ দিকে যাবে। যেই বলেছি স্যার–তিনি এক লাফে সাত হাত সরে গিয়ে বললেন, হবে না বাবা-মাপ করো। কেন, আমি ভিখিরি নাকি?–মাকুদার চোখ জ্বলতে লাগল : শেম।

আমি আর টেনিদা একসঙ্গে বললুম, শেম–শেম!

মাকুদা তেমনি জ্বলন্ত চোখে বললে, আমি দেশে গিয়ে একটা ভ্রমণকাহিনী লিখব। পৃথিবীর সব ভাষায় সে বইয়ের অনুবাদ হবে, লাখ লাখ কপি বিক্রি হবে তার। তাতে লেখা থাকবে, বাঙালী অতি নচ্ছার–মানে গেফানজেন, বাংলাদেশ অতি খারাপ–মানে ল্য শা বোতে–মানে ইতিপুরো তাকাহাঁচি মানে

এই পর্যন্ত শুনেই আমাদের বাঙালী রক্তে আগুন ধরে গেল। দেশকে অপমান–জাতির নামে অপবাদ। টেনিদা হঠাৎ গর্জন করে বললে, থামুন দাদা, আর বলতে হবে না। বাঙালীর পরিচয় এখনও পাননি।–প্যালা!

ইয়েস টেনিদা?

পকেটে হাউ মাচ?

–ছটা টাকা আছে। একটা পড়ার বই কিনব ভেবেছিলুম।

–পড়া? পড়া এখন চুলোয় যাক। জাতির সম্মান বিপন্ন দেখতে পাচ্ছিস না? আমার কাছেও একটা পাঁচ টাকার নোট রয়েছে, কাকিমা তেল-সাবান কিনতে দিয়েছিল। কিন্তু ন্যাশনাল প্রেস্টিজই যদি যায় কী হবে তেল-সাবান দিয়ে? চল–মাকুদাকে আমরা এনটারটেন করি। সমস্ত বাঙালী জাতির পক্ষ থেকেই।

বইয়ের টাকা দিয়ে মাকুদাকে এনটারটেন করা! বড়দার মুখটা মনে পড়তেই বুকের ভেতরে একবার আঁকুপাঁকু করে উঠল। কিন্তু দেশ এবং জাতির এই দারুণ দুর্দিনে কিসের দুঃখ, কিসের দৈন্য, কিসের লজ্জা–মানে–আমরা ঘুচাব মা তোর কালিমা, মানুষ আমরা, নহি তো মেষ।

টেনিদা বললে, চলুন মাকুদা–বাঙালীকেও একবার দেখে যান।

কুমড়োর বিচির মতো দাঁত বের করে মাদা বললেন, কোথায় দেখব?

-দি গ্রেট আবার-খাবো রেস্টুরেন্টে।

মাকুদা দেখলেন, ভালোই দেখলেন। চারটে কাটলেট, দু প্লেট মাংস, এক প্লেট পোলাও, এক প্লেট পুডিং। তারপর দু প্যাকেট ভালো সিগারেট আর তিনটাকা ট্যাক্সি খরচ আমরা ওঁর হাতে তুলে দিলাম। মানে আরও দিতুম, কিন্তু পকেট ততক্ষণে গড়ের মাঠ হয়ে গিয়েছিল।

–এইবার খুশি হয়েছেন মাকুদা?

ট্যাক্সিতে পা দিয়ে মাকুদা বললেন, বিলক্ষণ।

বাঙালীর কথা লিখবেন তো ভালো করে? আমার আর প্যালারামের কথা?

-সব লিখব, যদি আমার বই কেউ ছাপে।-বলে মাকুন্দা ট্যাক্সিওয়ালাকে বললে, বাগবাজার-জলদি।

আমি ব্যস্ত হয়ে বললুম, আপনার বই ছাপবে না মানে? আপনি একজন ওয়ার্ল্ড ট্যুরিস্ট

–জীবনে আমি দমদমের ওপারে যাইনি। আমার নাম বেচারাম গড়গড়ি–বাগবাজারে থাকি। বড্ড খিদে পেয়েছিল–তাই–তা, বেড়ে খাইয়েছ ভাই, থ্যাঙ্ক ইউ, টা টা– আমাদের নাকের ওপর একরাশ ধোঁয়া ছেড়ে দিয়ে বোঁ করে বেরিয়ে গেল ট্যাক্সিটা।

 হালখাতার খাওয়াদাওয়া

টেনিদা বললে, মেরে দিয়েছি কেল্লা। চল একটু মিষ্টিমুখ করে আসা যাক।

মিষ্টিমুখ করতে আপত্তি আছে–এমন অপবাদ প্যালারামের শত্রুরাও দিতে পারবে না। তবে টেনিদার সঙ্গে যেতেই আপত্তি আছে একটু। ওর মিষ্টিমুখ মানেই আমার পকেট ফাঁক। টেনিদা যখনই বলেছে, চল প্যালা বঙ্গেশ্বরী মিষ্টান্ন ভাণ্ডার থেকে তোকে জলযোগ করিয়ে আনি–তখনই আমার কমসেকম পাঁচটি করে টাকা স্রেফ বরবাদ। মানে রাজভোগগুলো ও-ই খেয়েছে আর আমি বসে বসে দুএকটা যা খেতে চেষ্টা করেছি, থাবা দিয়ে সেগুলো কেড়ে নিয়ে বলেছে, এসব ছেলেপুলের খেতে নেই–পেট খারাপ করে।

অতএব গেলাস দুই জল খেয়েই আমায় উঠে আসতে হয়েছে। একেবারে খাঁটি জলযোগ যাকে বলে। তাই টেনিদার প্রস্তাব কানে যেতেই আমি তিন পা পেছিয়ে গেলাম।

বললাম, আমার শরীর ভালো নেই–আমি এখন মামাবাড়ি যাচ্ছি।

টেনিদা খাঁড়ার মতো নাকটাকে খাড়া করে বললে, শরীর ভালো নেই তো মামাবাড়ি যাচ্ছিস কেন? তোর মামা কি ভেটিরিনারি সার্জন যে তোর মতো ছাগলকে পটাৎ পটাৎ করে ইনজেকসন দেবে? বেশি পাকামি করিসনি প্যালাচল আমার সঙ্গে।

-সত্যি বলছি টেনিদা—

কিন্তু সত্যি-মিথ্যে কিছুই টেনিদা আমায় বলতে দিলে না। আমার পিঠে পনেরো সের ওজনের একটা চাঁটি বসিয়ে বললে, কেন বচ্ছরকার প্রথম দিনটাতে একরাশ মিথ্যে বলছিস প্যালা? কোনও ভাবনা নেই বুঝলি? তোর এক পয়সাও খরচ নেই সব পরম্মৈপদী।

পরস্মৈপদী? কে খাওয়াবে? আমাদের মতো অপোগন্ডকে খাওয়াবার জন্য কার মাথা ব্যথা পড়েছে?

টেনিদা বললে, তোর মগজে আগে গোবর ছিল, এখন একেবারে নিটোল খুঁটে। ওরে গর্দভ, আজযে হালখাতা। দোকানে গেলেই খাওয়াবে।

কিন্তু আমাদের খাওয়াবে কেন? নেমন্তন্ন করেনি তো?

–সেই ব্যবস্থাই তো করেছি। টেনিদা হেঁ-হেঁ করে হেসে বললে, এই দ্যাখ বলেই পকেট থেকে বের করলে একগাদা লাল-নীল হালখাতার চিঠি।

–এসব তুমি পেলে কোথায়?

আরে আমার চিঠি নাকি? সব কুট্টিমামার।

কুট্টিমামা।

–হ্যাঁ-হ্যাঁ–সেই-যে গজগোবিন্দ হালদার? তোকে বলিনি? সেই-যে ভালুকের নাকে টিকের আগুন দিয়ে পুড়িয়ে দিয়েছিল। সেই কুট্টিমামার অনেক এসেছে। তাই থেকেই কয়েকটা হাতসাফাই করেছি আমি। বিশেষ করে এইটে–

বলে একটা লাল রঙের চিঠি এগিয়ে দিলে। তাতে নতুন খাতা মহরত-হরত এইসব বাঁধা গতের তলায় কালি দিয়ে লেখা আছে : প্রিয় গজগবিন্দবাবু, অবশ্য আসিবেন। মাংস, পোলাও, দই, রসগোল্লার বিশেষ ব্যবস্থা হইয়াছে। ইতি আপনাদের চন্দ্রকান্ত  চাকলাদার-প্রোপাইটার, নাসিকামোহন নস্য কোম্পানি।

টেনিদার চোখ চকচক করে উঠল : দেখছিস তো খ্যাঁটের ব্যবস্থাখানা? এমন সুযোগ ছাড়তে নেই। তবে একা খেয়ে সুবিধে হবে না, তাই তোকেও সঙ্গে করে নিয়ে যেতে চাইছি।

–কিন্তু টেনিদা—

টেনিদা মুখটাকে গণ্ডারের মতো করে বললে, আবার কিন্তু কী রে? পটোল দিয়ে শিঙিমাছের ঝোল খেয়ে খেয়ে তুই দেখছি একটা পটোলের দোলমা হয়ে গেছিস। মাংস-পোলাও খেতে পাবি তাতে অত ঘাবড়ে যাচ্ছিস কেন?

-আমি বলছিলাম হালখাতায় গেলে নাকি টাকা-ফাকা দিতে হয়

-না দিলেই হল। দোকানদারেরা এসময় ভারি জব্দ থাকে জানিস তো? যত টাকাই পাওনা থাক না কেন–মুখ ফুটে চাইতে পারে না। যত খুশি খেয়ে আয়, হাসিমুখে বলবে, আর দুটো মিহিদানা দেব স্যার? চল প্যালা–এমন মওকা ছাড়তে নেই।

ভেবে দেখলাম, ছাড়া উচিতও নয়। আমি টেনিদার সঙ্গই নিলাম।

প্রথম দু-একটা জায়গায় খুচরো খাওয়া-দাওয়া হল।

এক গ্লাস ঘোলের শরবত-দুটো-একটা মিষ্টি–এই সব। দোকানদারেরা অবশ্য আড় চোখে টাকার থালার দিকে তাকিয়ে দেখছিল আমরা কী দিই। আমরা ও-সবে ভ্রুক্ষেপ না করে নিজেদের কাজ ম্যানেজ করে গেলাম, অর্থাৎ যতটা পারা যায় রসগোল্লা, ঘোলের শরবত, ডাবের জল এসব সেঁটে নিলাম। এক-আধজন বেশ ব্যাজার হল, একজনের গলা তো স্পষ্টই শোনা গেল : দুশো সাতাশ টাকা বাকি–গজগোবিন্দবাবু একটা পয়সা ছোঁয়ালেন না–আবার দুটো ছোকরা এসে তিন টাকার খাবার সাবড়ে গেল!–ওসব তুচ্ছ কথায় আমরা কান দিলাম না–দেওয়ার দরকারই বোধ হল না। উপরন্তু দুজনে চারটে করে পান নিয়ে নেমে এলাম রাস্তায়।

আমি টেনিদাকে বললাম, এসব ঘোল-ফোল খেয়ে পেট ভরিয়ে লাভ কী? তোমার সেই নাসিকামোহন নস্য কোম্পানিতেই চলো না!–বলতে বলতে আমার নোলায় প্রায় আধ সের জল এসে গেল : পোলাওটা যদি ঠাণ্ডা হয়ে যায়, তা হলে খেতে জুত লাগবে না। তা ছাড়া বেশি দেরি হলে মাংসও আর থাকবে না–কেবল খানকয়েক পাঁঠার হাড় পড়ে থাকবে।

টেনিদা বললে, আঃ–এই পেটুকটা দেখছি জ্বালিয়ে খেল! এইসব টুকটাক খেয়ে খিদেটা একটু জমিয়ে নিচ্ছি, তা এটার কিছুতেই আর তর সইছে না।

-মানে আমি বলছিলাম, যদি ফুরিয়ে-টুরিয়ে যায়–

–হুঁ, সেও একটা কথা বটে!–টেনিদা নাক চুলকে বললে, আচ্ছা চল-যাওয়া যাক—

ঠিকানা বাগবাজারের। তাও কি এক গলির মধ্যে। অনেক খুঁজে খুঁজে বের করতে হল।

এই নাকি নাসিকামোহন নস্য কোম্পানি! দেখে কেমন যেন খটকা লেগে গেল। একটু পুরনো একতলা ঘর। ভেতরে মিটিমিট করে আলো জ্বলছে। বাইরে একটা সাইনবোর্ড–তাতে প্রকাণ্ড নাকওলা লোক এক জালা নস্যি টানছে এমনি একটা ছবি। সাইনবোর্ডটা কেমন কাত হয়ে ঝুলছে। এরাই খাওয়াবে মাংসপোলাও!

বললাম, টেনিদা-পোলাও-টোলাওয়ের গন্ধ তো পাচ্ছি না!

টেনিদা বললে, আছে–সব আছে। চল–ভেতরে যাই।

ঘুরে ঢুকে দেখি একটা ময়লা চাদর পাতা তক্তপোশে দুটো ষণ্ডামতন লোক কেলে হাঁড়ির মতোমুখ করে বসে আছে। পাশে একটা কাঁচ ভাঙা আলমারি–তাতে গোটা কয়েক শিশি-বোতল। আর কিছু নেই।

আমরা কী রকম ঘাবড়ে গেলাম। জায়গা ভুল করিনি তো। কিন্তু তাই বা কী করে। বাইরে স্পষ্টই সাইনবোর্ড ঝুলছে। ওই তো আলমারির গায়ে সাঁটা এক টুকরো কাগজে লেখা রয়েছে : নাসিকামোহন নস্য কোম্পানি–প্রোঃ চন্দ্রকান্ত চাকলাদার।

আমাদের দেখেই একটা লোক বাঘাটে গলায় বললে, কী চাই?

সঙ্গে সঙ্গে আমি প্রায় দরজার বাইরে। টেনিদা ঢোক গিলে বললে, আমরা হালখাতার নেমন্তন্ন পেয়ে আসছি।

–হালখাতার নেমন্তন্ন!–লোকটা তেমনি বাঘা গলায় কী বলতে যাচ্ছিল, দুনম্বর তাকে থামিয়ে দিলে।

বললে, কে পাঠিয়েছে তোমাদের?

ব্যাপারটা কী রকম গোলমেলে মনে হল। আমি ভাবছিলাম কেটে পড়া উচিত, কিন্তু টেনিদা হাল ছাড়ল না। পকেট থেকে সেই চিঠিটা বের করে বলল, এই তো-মামা আমাদের পাঠিয়েছেন। মামা-মানে গজগোগাবিন্দ হালদার

–গজগোবিন্দ হালদার?–প্রথম লোকটা এবারে ঝাঁটা গোঁফের পাশ দিয়ে মিটিমিটি হাসল : ওহো–তাই বলো! আগে বললেই বুঝতে পারতাম। আমাদের এখানে আজ স্পেশ্যাল ব্যবস্থা কিনা–তাই বেছে বেছে মাত্র জন জনকয়েককে নেমন্তন্ন করা হয়েছে। তা গজগোবিন্দবাবু কোথায়? তিনি যে বড় এলেন না?

–তিনি একটু জরুরি কাজে আসানসোলে গেছেন–টেনিদা পটাং করে মিথ্যে কথা বলে দিলে : তাই আমাদের এখানে আসতে বিশেষ করে বলে দিয়েছেন।

শুনে প্রথম লোকটা দ্বিতীয় লোকটার মুখের দিকে কিছুক্ষণ চেয়ে রইল। তারপরে তেমনি হাসি-হাসি মুখে বললে, তা তোমরা এসেছ–তাতেও হবে। এসো এসো

লোকটা উঠে দাঁড়াল।

ভেতরের ঘরে। সেখানেই বিরিয়ানি পোলাও আর মোগলাই কালিয়ার ব্যবস্থা হয়েছে কিনা। এসো–চলে এসো–নইলে ঠাণ্ডা হয়ে যাবে।

টেনিদা বললে, আয় প্যালা—

আসতে বলার দরকার ছিল না। তার অনেক আগেই এসে পড়েছি আমি। জিবের ডগাটা সুড়সুড় করে উঠছে! শরবত টরবতগুলো এতক্ষণ পেটের মধ্যেই ছিল হঠাৎ সেগুলো হজম হয়ে গিয়ে খিদেয় নাড়ি-ভুড়ি ছুঁই ছুঁই করতে লাগল।

সেই লোকটার পেছনে পেছনে আমরা এগিয়ে চললাম। একটা অন্ধকার বারান্দা–তারপরে আর-একটা ঘর। তার মধ্যেও আলো নেই। লোকটা বললে, ঢুকে পড়ো এখানে।

অন্ধকার যে–টেনিদার গলায় সন্দেহের সুর। আমারও কী রকম যেন বেয়াড়া লাগল। যে-ঘরে পোলাও কালিয়া থাকে সে-ঘর অন্ধকার থাকবে কেন? পোলাওয়ের জলুসেই আলো হয়ে থাকবার কথা।

লোকটা বললে, ঢোকো না–আলো জ্বেলে দিচ্ছি। টেনিদা ঢুকল, পেছন পেছন আমিও। আর যেই ঢুকেছি অমনি পটাং করে লোকটা দরজা বন্ধ করে দিলে।

একী একী–দোর বন্ধ করছেন কেন? দরজার ওপাশ থেকে সেই লোকটার পৈশাচিক অট্টহাসি শোনা গেল : পোলাও কালিয়া খাওয়াব বলে।

শেকল আটকে দিলেন কেন?–আমি চেঁচিয়ে উঠলাম : ঘরে তো পোলাওকালিয়া কিছু নেই। এ যে কয়লার ঘর মনে হচ্ছে! ঘুঁটের গন্ধ আসছে

লোকটা আবার বাজখাই গলায় বললে, ঘুঁটের গন্ধ! শুধু ঘুঁটের গন্ধেই পার পেয়ে যাবে ভেবেছ? এর পরে তিনটি বাছা বাছা গুণ্ডা আসবে–দেবে রাম ঠ্যাঙানি যাকে বলে আড়ং-ধোলাই। প্রাণ খুলে পোলাও-কালিয়া খাবে।

শুনে আমার হাত-পা সোজা পেটের মধ্যে সেঁধিয়ে গেল। আমি ধপাস করে সেই অন্ধকার কয়লার ঘরের মেজেতেই বসে পড়লাম। নাকমুখের ওপর দিয়ে ফুড়কফুড়ক করে গোটাচারেক আরশোলা উড়ে গেল।

টেনিদা কাঁপতে কাঁপতে বললে, আমাদের সঙ্গে এ রসিকতা কেন স্যার? আমরা কী করেছি?

কী করেছ?–লোকটা সিংহনাদ ছাড়ল : তোমরা–মানে, তোমার মামা গজগোবিন্দ আমাদের কোম্পানি থেকে তিনশো তিপান্ন টাকার নস্যি কিনেছ তিন বছর ধরে সব বাকিতে। একটা পয়সা ছোঁয়ায়নি। তারপর আর এ-পাড়া সে মাড়ায়নি।

–আর আমাদের কোম্পানি তারই জন্যে লাল বাতি জ্বেলেছে। আজ তাকে ঠ্যাঙাবার জন্যেই পোলাও-মাংসের টোপ ফেলেছিলাম। সে আসেনি–তোমরা এসেছ। টাকা তো পাবই না কিন্তু তোমাদের রাম ঠ্যাঙানি দিয়ে যতটা পারি–সুখ করে নেব। একটু দাঁড়াও–গুণ্ডারা এল বলে

টেনিদা হাঁউমাউ করে উঠল : দোহাই স্যার আমাদের ছেড়ে দিন স্যার। আমরা নেহাত নাবালক, নস্যি-টস্যির ধার ধারিনে–আমাদের ছেড়ে দিন

কিন্তু লোকটার আর সাড়া পাওয়া গেল না। দরজায় শেকল দিয়ে বেমালুম সরে পড়েছে। গুণ্ডা ডাকতেই গেছে খুব সম্ভব।

আমার পালা জ্বরের পিলেতে গুরগুর করে শব্দ হচ্ছে। বুকের ভেতর ঠাণ্ডা হিম! চোখের সামনে কেবল পটোল-ধুঁদুল কাঁচকলা এই সব দেখতে পাচ্ছি। হালখাতার পোলাও খেতে গিয়ে পটলডাঙার প্যালারামের এবার পটল তোলবার জো।

টেনিদা বললে, প্যালা রে মেরে ফেলবে যে! গলা দিয়ে কেবল কুঁই কুঁই করে খানিকটা আওয়াজ বেরুল।

–ওরে বাবা–পায়ের ওপর দিয়ে ছুঁচো দৌড়চ্ছে।

এর পরে লাঠি দৌড়বে–অনেক কষ্টে আমি বলতে পারলাম।

টেনিদা দরজাটার ওপর দুম দুম করে লাথি ছুড়তে লাগল : দোহাই স্যার–ছেড়ে দিন স্যার–আমরা কিছু জানিনে স্যার আমরা নেহাত নাবালক স্যার

কটাৎ। আমার কপালে কিসে ঠোকর মারল। তারপরেই কী একটা প্রাণী নাকের ওপর একটা নোংরা পাখার ঘা দিয়ে উড়ে গেল। নির্ঘাত চামচিকে।

বাপরে বলে আমি লাফ মারলাম। এক লাফে একটা জানালার কাছে! আর সঙ্গে সঙ্গেই আবিষ্কার করলাম, জানালার দুটো গরাদ ভাঙা। অর্থাৎ গলে বেরিয়ে যাওয়া যায়। টেনিদা তখনও প্রাণপণে ধাক্কাচ্ছে! বললাম, টেনিদা, এখানে একটা ভাঙা জানালা।

-কই কোথায়?

এই তো বলেই আমি জানালা দিয়ে দুনম্বর লাফ। আর সঙ্গে সঙ্গে–একেবারে ডাস্টবিনে রাজ্যের দুর্গন্ধ আবর্জনার ভেতর।

টেনিদাও আমার ঘাড়ের ওপরে এসে পড়ল পর মুহূর্তেই। আর তক্ষুনি উলটে গেল ডাস্টবিন! আমাদের গায়ে মাথায় পৃথিবীর সব রকম পচা আর নোংরা জিনিস একেবারে মাখামাখি। হালখাতার খাওয়া-দাওয়াই বটে। অন্নপ্রাশন থেকে শুরু করে যা কিছু খেয়েছিলাম–সব ঠেলে বেরিয়ে আসছে গলা দিয়ে।

কিন্তু বমি করারও সময় নেই আর। পেছনে একটা কুকুর তাড়া করেছে কারা যেন বললে, চোর–চোর। সর্বাঙ্গে সেই পচা আবর্জনা মেখে প্রাণপণে ছুটতে আরম্ভ করেছি আমরা। সোজা বড় রাস্তার দিকে। সেখান থেকে একেবারে গিয়ে গঙ্গায় নামতে হবে–পুরো দুঘণ্টা চান না করলে গায়ের গন্ধ যাওয়ার সম্ভাবনা নেই।

Exit mobile version