শুনে প্রথম লোকটা দ্বিতীয় লোকটার মুখের দিকে কিছুক্ষণ চেয়ে রইল। তারপরে তেমনি হাসি-হাসি মুখে বললে, তা তোমরা এসেছ–তাতেও হবে। এসো এসো
লোকটা উঠে দাঁড়াল।
ভেতরের ঘরে। সেখানেই বিরিয়ানি পোলাও আর মোগলাই কালিয়ার ব্যবস্থা হয়েছে কিনা। এসো–চলে এসো–নইলে ঠাণ্ডা হয়ে যাবে।
টেনিদা বললে, আয় প্যালা—
আসতে বলার দরকার ছিল না। তার অনেক আগেই এসে পড়েছি আমি। জিবের ডগাটা সুড়সুড় করে উঠছে! শরবত টরবতগুলো এতক্ষণ পেটের মধ্যেই ছিল হঠাৎ সেগুলো হজম হয়ে গিয়ে খিদেয় নাড়ি-ভুড়ি ছুঁই ছুঁই করতে লাগল।
সেই লোকটার পেছনে পেছনে আমরা এগিয়ে চললাম। একটা অন্ধকার বারান্দা–তারপরে আর-একটা ঘর। তার মধ্যেও আলো নেই। লোকটা বললে, ঢুকে পড়ো এখানে।
অন্ধকার যে–টেনিদার গলায় সন্দেহের সুর। আমারও কী রকম যেন বেয়াড়া লাগল। যে-ঘরে পোলাও কালিয়া থাকে সে-ঘর অন্ধকার থাকবে কেন? পোলাওয়ের জলুসেই আলো হয়ে থাকবার কথা।
লোকটা বললে, ঢোকো না–আলো জ্বেলে দিচ্ছি। টেনিদা ঢুকল, পেছন পেছন আমিও। আর যেই ঢুকেছি অমনি পটাং করে লোকটা দরজা বন্ধ করে দিলে।
একী একী–দোর বন্ধ করছেন কেন? দরজার ওপাশ থেকে সেই লোকটার পৈশাচিক অট্টহাসি শোনা গেল : পোলাও কালিয়া খাওয়াব বলে।
শেকল আটকে দিলেন কেন?–আমি চেঁচিয়ে উঠলাম : ঘরে তো পোলাওকালিয়া কিছু নেই। এ যে কয়লার ঘর মনে হচ্ছে! ঘুঁটের গন্ধ আসছে
লোকটা আবার বাজখাই গলায় বললে, ঘুঁটের গন্ধ! শুধু ঘুঁটের গন্ধেই পার পেয়ে যাবে ভেবেছ? এর পরে তিনটি বাছা বাছা গুণ্ডা আসবে–দেবে রাম ঠ্যাঙানি যাকে বলে আড়ং-ধোলাই। প্রাণ খুলে পোলাও-কালিয়া খাবে।
শুনে আমার হাত-পা সোজা পেটের মধ্যে সেঁধিয়ে গেল। আমি ধপাস করে সেই অন্ধকার কয়লার ঘরের মেজেতেই বসে পড়লাম। নাকমুখের ওপর দিয়ে ফুড়কফুড়ক করে গোটাচারেক আরশোলা উড়ে গেল।
টেনিদা কাঁপতে কাঁপতে বললে, আমাদের সঙ্গে এ রসিকতা কেন স্যার? আমরা কী করেছি?
কী করেছ?–লোকটা সিংহনাদ ছাড়ল : তোমরা–মানে, তোমার মামা গজগোবিন্দ আমাদের কোম্পানি থেকে তিনশো তিপান্ন টাকার নস্যি কিনেছ তিন বছর ধরে সব বাকিতে। একটা পয়সা ছোঁয়ায়নি। তারপর আর এ-পাড়া সে মাড়ায়নি।
–আর আমাদের কোম্পানি তারই জন্যে লাল বাতি জ্বেলেছে। আজ তাকে ঠ্যাঙাবার জন্যেই পোলাও-মাংসের টোপ ফেলেছিলাম। সে আসেনি–তোমরা এসেছ। টাকা তো পাবই না কিন্তু তোমাদের রাম ঠ্যাঙানি দিয়ে যতটা পারি–সুখ করে নেব। একটু দাঁড়াও–গুণ্ডারা এল বলে
টেনিদা হাঁউমাউ করে উঠল : দোহাই স্যার আমাদের ছেড়ে দিন স্যার। আমরা নেহাত নাবালক, নস্যি-টস্যির ধার ধারিনে–আমাদের ছেড়ে দিন
কিন্তু লোকটার আর সাড়া পাওয়া গেল না। দরজায় শেকল দিয়ে বেমালুম সরে পড়েছে। গুণ্ডা ডাকতেই গেছে খুব সম্ভব।
আমার পালা জ্বরের পিলেতে গুরগুর করে শব্দ হচ্ছে। বুকের ভেতর ঠাণ্ডা হিম! চোখের সামনে কেবল পটোল-ধুঁদুল কাঁচকলা এই সব দেখতে পাচ্ছি। হালখাতার পোলাও খেতে গিয়ে পটলডাঙার প্যালারামের এবার পটল তোলবার জো।
টেনিদা বললে, প্যালা রে মেরে ফেলবে যে! গলা দিয়ে কেবল কুঁই কুঁই করে খানিকটা আওয়াজ বেরুল।
–ওরে বাবা–পায়ের ওপর দিয়ে ছুঁচো দৌড়চ্ছে।
এর পরে লাঠি দৌড়বে–অনেক কষ্টে আমি বলতে পারলাম।
টেনিদা দরজাটার ওপর দুম দুম করে লাথি ছুড়তে লাগল : দোহাই স্যার–ছেড়ে দিন স্যার–আমরা কিছু জানিনে স্যার আমরা নেহাত নাবালক স্যার
কটাৎ। আমার কপালে কিসে ঠোকর মারল। তারপরেই কী একটা প্রাণী নাকের ওপর একটা নোংরা পাখার ঘা দিয়ে উড়ে গেল। নির্ঘাত চামচিকে।
বাপরে বলে আমি লাফ মারলাম। এক লাফে একটা জানালার কাছে! আর সঙ্গে সঙ্গেই আবিষ্কার করলাম, জানালার দুটো গরাদ ভাঙা। অর্থাৎ গলে বেরিয়ে যাওয়া যায়। টেনিদা তখনও প্রাণপণে ধাক্কাচ্ছে! বললাম, টেনিদা, এখানে একটা ভাঙা জানালা।
-কই কোথায়?
এই তো বলেই আমি জানালা দিয়ে দুনম্বর লাফ। আর সঙ্গে সঙ্গে–একেবারে ডাস্টবিনে রাজ্যের দুর্গন্ধ আবর্জনার ভেতর।
টেনিদাও আমার ঘাড়ের ওপরে এসে পড়ল পর মুহূর্তেই। আর তক্ষুনি উলটে গেল ডাস্টবিন! আমাদের গায়ে মাথায় পৃথিবীর সব রকম পচা আর নোংরা জিনিস একেবারে মাখামাখি। হালখাতার খাওয়া-দাওয়াই বটে। অন্নপ্রাশন থেকে শুরু করে যা কিছু খেয়েছিলাম–সব ঠেলে বেরিয়ে আসছে গলা দিয়ে।
কিন্তু বমি করারও সময় নেই আর। পেছনে একটা কুকুর তাড়া করেছে কারা যেন বললে, চোর–চোর। সর্বাঙ্গে সেই পচা আবর্জনা মেখে প্রাণপণে ছুটতে আরম্ভ করেছি আমরা। সোজা বড় রাস্তার দিকে। সেখান থেকে একেবারে গিয়ে গঙ্গায় নামতে হবে–পুরো দুঘণ্টা চান না করলে গায়ের গন্ধ যাওয়ার সম্ভাবনা নেই।