টেনিদা বললে, তোর মগজে আগে গোবর ছিল, এখন একেবারে নিটোল খুঁটে। ওরে গর্দভ, আজযে হালখাতা। দোকানে গেলেই খাওয়াবে।
কিন্তু আমাদের খাওয়াবে কেন? নেমন্তন্ন করেনি তো?
–সেই ব্যবস্থাই তো করেছি। টেনিদা হেঁ-হেঁ করে হেসে বললে, এই দ্যাখ বলেই পকেট থেকে বের করলে একগাদা লাল-নীল হালখাতার চিঠি।
–এসব তুমি পেলে কোথায়?
আরে আমার চিঠি নাকি? সব কুট্টিমামার।
কুট্টিমামা।
–হ্যাঁ-হ্যাঁ–সেই-যে গজগোবিন্দ হালদার? তোকে বলিনি? সেই-যে ভালুকের নাকে টিকের আগুন দিয়ে পুড়িয়ে দিয়েছিল। সেই কুট্টিমামার অনেক এসেছে। তাই থেকেই কয়েকটা হাতসাফাই করেছি আমি। বিশেষ করে এইটে–
বলে একটা লাল রঙের চিঠি এগিয়ে দিলে। তাতে নতুন খাতা মহরত-হরত এইসব বাঁধা গতের তলায় কালি দিয়ে লেখা আছে : প্রিয় গজগবিন্দবাবু, অবশ্য আসিবেন। মাংস, পোলাও, দই, রসগোল্লার বিশেষ ব্যবস্থা হইয়াছে। ইতি আপনাদের চন্দ্রকান্ত চাকলাদার-প্রোপাইটার, নাসিকামোহন নস্য কোম্পানি।
টেনিদার চোখ চকচক করে উঠল : দেখছিস তো খ্যাঁটের ব্যবস্থাখানা? এমন সুযোগ ছাড়তে নেই। তবে একা খেয়ে সুবিধে হবে না, তাই তোকেও সঙ্গে করে নিয়ে যেতে চাইছি।
–কিন্তু টেনিদা—
টেনিদা মুখটাকে গণ্ডারের মতো করে বললে, আবার কিন্তু কী রে? পটোল দিয়ে শিঙিমাছের ঝোল খেয়ে খেয়ে তুই দেখছি একটা পটোলের দোলমা হয়ে গেছিস। মাংস-পোলাও খেতে পাবি তাতে অত ঘাবড়ে যাচ্ছিস কেন?
-আমি বলছিলাম হালখাতায় গেলে নাকি টাকা-ফাকা দিতে হয়
-না দিলেই হল। দোকানদারেরা এসময় ভারি জব্দ থাকে জানিস তো? যত টাকাই পাওনা থাক না কেন–মুখ ফুটে চাইতে পারে না। যত খুশি খেয়ে আয়, হাসিমুখে বলবে, আর দুটো মিহিদানা দেব স্যার? চল প্যালা–এমন মওকা ছাড়তে নেই।
ভেবে দেখলাম, ছাড়া উচিতও নয়। আমি টেনিদার সঙ্গই নিলাম।
প্রথম দু-একটা জায়গায় খুচরো খাওয়া-দাওয়া হল।
এক গ্লাস ঘোলের শরবত-দুটো-একটা মিষ্টি–এই সব। দোকানদারেরা অবশ্য আড় চোখে টাকার থালার দিকে তাকিয়ে দেখছিল আমরা কী দিই। আমরা ও-সবে ভ্রুক্ষেপ না করে নিজেদের কাজ ম্যানেজ করে গেলাম, অর্থাৎ যতটা পারা যায় রসগোল্লা, ঘোলের শরবত, ডাবের জল এসব সেঁটে নিলাম। এক-আধজন বেশ ব্যাজার হল, একজনের গলা তো স্পষ্টই শোনা গেল : দুশো সাতাশ টাকা বাকি–গজগোবিন্দবাবু একটা পয়সা ছোঁয়ালেন না–আবার দুটো ছোকরা এসে তিন টাকার খাবার সাবড়ে গেল!–ওসব তুচ্ছ কথায় আমরা কান দিলাম না–দেওয়ার দরকারই বোধ হল না। উপরন্তু দুজনে চারটে করে পান নিয়ে নেমে এলাম রাস্তায়।
আমি টেনিদাকে বললাম, এসব ঘোল-ফোল খেয়ে পেট ভরিয়ে লাভ কী? তোমার সেই নাসিকামোহন নস্য কোম্পানিতেই চলো না!–বলতে বলতে আমার নোলায় প্রায় আধ সের জল এসে গেল : পোলাওটা যদি ঠাণ্ডা হয়ে যায়, তা হলে খেতে জুত লাগবে না। তা ছাড়া বেশি দেরি হলে মাংসও আর থাকবে না–কেবল খানকয়েক পাঁঠার হাড় পড়ে থাকবে।
টেনিদা বললে, আঃ–এই পেটুকটা দেখছি জ্বালিয়ে খেল! এইসব টুকটাক খেয়ে খিদেটা একটু জমিয়ে নিচ্ছি, তা এটার কিছুতেই আর তর সইছে না।
-মানে আমি বলছিলাম, যদি ফুরিয়ে-টুরিয়ে যায়–
–হুঁ, সেও একটা কথা বটে!–টেনিদা নাক চুলকে বললে, আচ্ছা চল-যাওয়া যাক—
ঠিকানা বাগবাজারের। তাও কি এক গলির মধ্যে। অনেক খুঁজে খুঁজে বের করতে হল।
এই নাকি নাসিকামোহন নস্য কোম্পানি! দেখে কেমন যেন খটকা লেগে গেল। একটু পুরনো একতলা ঘর। ভেতরে মিটিমিট করে আলো জ্বলছে। বাইরে একটা সাইনবোর্ড–তাতে প্রকাণ্ড নাকওলা লোক এক জালা নস্যি টানছে এমনি একটা ছবি। সাইনবোর্ডটা কেমন কাত হয়ে ঝুলছে। এরাই খাওয়াবে মাংসপোলাও!
বললাম, টেনিদা-পোলাও-টোলাওয়ের গন্ধ তো পাচ্ছি না!
টেনিদা বললে, আছে–সব আছে। চল–ভেতরে যাই।
ঘুরে ঢুকে দেখি একটা ময়লা চাদর পাতা তক্তপোশে দুটো ষণ্ডামতন লোক কেলে হাঁড়ির মতোমুখ করে বসে আছে। পাশে একটা কাঁচ ভাঙা আলমারি–তাতে গোটা কয়েক শিশি-বোতল। আর কিছু নেই।
আমরা কী রকম ঘাবড়ে গেলাম। জায়গা ভুল করিনি তো। কিন্তু তাই বা কী করে। বাইরে স্পষ্টই সাইনবোর্ড ঝুলছে। ওই তো আলমারির গায়ে সাঁটা এক টুকরো কাগজে লেখা রয়েছে : নাসিকামোহন নস্য কোম্পানি–প্রোঃ চন্দ্রকান্ত চাকলাদার।
আমাদের দেখেই একটা লোক বাঘাটে গলায় বললে, কী চাই?
সঙ্গে সঙ্গে আমি প্রায় দরজার বাইরে। টেনিদা ঢোক গিলে বললে, আমরা হালখাতার নেমন্তন্ন পেয়ে আসছি।
–হালখাতার নেমন্তন্ন!–লোকটা তেমনি বাঘা গলায় কী বলতে যাচ্ছিল, দুনম্বর তাকে থামিয়ে দিলে।
বললে, কে পাঠিয়েছে তোমাদের?
ব্যাপারটা কী রকম গোলমেলে মনে হল। আমি ভাবছিলাম কেটে পড়া উচিত, কিন্তু টেনিদা হাল ছাড়ল না। পকেট থেকে সেই চিঠিটা বের করে বলল, এই তো-মামা আমাদের পাঠিয়েছেন। মামা-মানে গজগোগাবিন্দ হালদার
–গজগোবিন্দ হালদার?–প্রথম লোকটা এবারে ঝাঁটা গোঁফের পাশ দিয়ে মিটিমিটি হাসল : ওহো–তাই বলো! আগে বললেই বুঝতে পারতাম। আমাদের এখানে আজ স্পেশ্যাল ব্যবস্থা কিনা–তাই বেছে বেছে মাত্র জন জনকয়েককে নেমন্তন্ন করা হয়েছে। তা গজগোবিন্দবাবু কোথায়? তিনি যে বড় এলেন না?
–তিনি একটু জরুরি কাজে আসানসোলে গেছেন–টেনিদা পটাং করে মিথ্যে কথা বলে দিলে : তাই আমাদের এখানে আসতে বিশেষ করে বলে দিয়েছেন।