–যেয়ো। শুধু জাপান? যেই ফ্রান্সে গেছি, অমনি এক ভদ্রলোক বোঁ করে তাঁর মস্ত মোটরটা আমার পাশে থামালেন। বললেন, মঁসিয়ো, ভেনেজাভেক মোয়া।–মানে আমার সঙ্গে আসুন। গাড়িতে তুলে নিয়ে গেলেন তাঁর মস্ত বাড়িতে। তারপর কী যত্ন কী খাওয়া-দাওয়া। বললেন, আ তু দো লাং? মানে-ফরাসী দেশ দেখবেন? ক্রজ্যাত ত্র্যা মেশা–মানে আমার গাড়ি করে যত ইচ্ছে ঘুরুন।
আমি বললুম, টেনিদা, ফ্রান্সেও একবার যাওয়া দরকার।
টেনিদা বললে, হুঁ, কাল-পরশুর মধ্যেই বেরিয়ে পড়লেই হয়। সে পরে ভাবা যাবে। কিন্তু মাকুদা, বাংলা দেশে এসে
মাকুন্দা শেষ টান মেরে বিড়িটা সামনের একটা ঝোপের মধ্যে ফেলে দিলে! উদাস হয়ে বললে, বাংলা দেশ হচ্ছে এক নম্বরের গেফানজেন–মানে অতিশয় বাজে জায়গা। এক কাপ চা তো দূরের কথা–কেউ একটা বিড়ি পর্যন্ত অফার করে না হে। বিদেশী টুরিস্ট–হনোলুলু থেকে আসছি–আমার দিকে একবার কেউ তাকায় না পর্যন্ত। কাল এক ভদ্রলোককে জিজ্ঞেস করতে যাচ্ছিলুম-ট্রামটা কোন্ দিকে যাবে। যেই বলেছি স্যার–তিনি এক লাফে সাত হাত সরে গিয়ে বললেন, হবে না বাবা-মাপ করো। কেন, আমি ভিখিরি নাকি?–মাকুদার চোখ জ্বলতে লাগল : শেম।
আমি আর টেনিদা একসঙ্গে বললুম, শেম–শেম!
মাকুদা তেমনি জ্বলন্ত চোখে বললে, আমি দেশে গিয়ে একটা ভ্রমণকাহিনী লিখব। পৃথিবীর সব ভাষায় সে বইয়ের অনুবাদ হবে, লাখ লাখ কপি বিক্রি হবে তার। তাতে লেখা থাকবে, বাঙালী অতি নচ্ছার–মানে গেফানজেন, বাংলাদেশ অতি খারাপ–মানে ল্য শা বোতে–মানে ইতিপুরো তাকাহাঁচি মানে
এই পর্যন্ত শুনেই আমাদের বাঙালী রক্তে আগুন ধরে গেল। দেশকে অপমান–জাতির নামে অপবাদ। টেনিদা হঠাৎ গর্জন করে বললে, থামুন দাদা, আর বলতে হবে না। বাঙালীর পরিচয় এখনও পাননি।–প্যালা!
ইয়েস টেনিদা?
পকেটে হাউ মাচ?
–ছটা টাকা আছে। একটা পড়ার বই কিনব ভেবেছিলুম।
–পড়া? পড়া এখন চুলোয় যাক। জাতির সম্মান বিপন্ন দেখতে পাচ্ছিস না? আমার কাছেও একটা পাঁচ টাকার নোট রয়েছে, কাকিমা তেল-সাবান কিনতে দিয়েছিল। কিন্তু ন্যাশনাল প্রেস্টিজই যদি যায় কী হবে তেল-সাবান দিয়ে? চল–মাকুদাকে আমরা এনটারটেন করি। সমস্ত বাঙালী জাতির পক্ষ থেকেই।
বইয়ের টাকা দিয়ে মাকুদাকে এনটারটেন করা! বড়দার মুখটা মনে পড়তেই বুকের ভেতরে একবার আঁকুপাঁকু করে উঠল। কিন্তু দেশ এবং জাতির এই দারুণ দুর্দিনে কিসের দুঃখ, কিসের দৈন্য, কিসের লজ্জা–মানে–আমরা ঘুচাব মা তোর কালিমা, মানুষ আমরা, নহি তো মেষ।
টেনিদা বললে, চলুন মাকুদা–বাঙালীকেও একবার দেখে যান।
কুমড়োর বিচির মতো দাঁত বের করে মাদা বললেন, কোথায় দেখব?
-দি গ্রেট আবার-খাবো রেস্টুরেন্টে।
মাকুদা দেখলেন, ভালোই দেখলেন। চারটে কাটলেট, দু প্লেট মাংস, এক প্লেট পোলাও, এক প্লেট পুডিং। তারপর দু প্যাকেট ভালো সিগারেট আর তিনটাকা ট্যাক্সি খরচ আমরা ওঁর হাতে তুলে দিলাম। মানে আরও দিতুম, কিন্তু পকেট ততক্ষণে গড়ের মাঠ হয়ে গিয়েছিল।
–এইবার খুশি হয়েছেন মাকুদা?
ট্যাক্সিতে পা দিয়ে মাকুদা বললেন, বিলক্ষণ।
বাঙালীর কথা লিখবেন তো ভালো করে? আমার আর প্যালারামের কথা?
-সব লিখব, যদি আমার বই কেউ ছাপে।-বলে মাকুন্দা ট্যাক্সিওয়ালাকে বললে, বাগবাজার-জলদি।
আমি ব্যস্ত হয়ে বললুম, আপনার বই ছাপবে না মানে? আপনি একজন ওয়ার্ল্ড ট্যুরিস্ট
–জীবনে আমি দমদমের ওপারে যাইনি। আমার নাম বেচারাম গড়গড়ি–বাগবাজারে থাকি। বড্ড খিদে পেয়েছিল–তাই–তা, বেড়ে খাইয়েছ ভাই, থ্যাঙ্ক ইউ, টা টা– আমাদের নাকের ওপর একরাশ ধোঁয়া ছেড়ে দিয়ে বোঁ করে বেরিয়ে গেল ট্যাক্সিটা।
হালখাতার খাওয়াদাওয়া
টেনিদা বললে, মেরে দিয়েছি কেল্লা। চল একটু মিষ্টিমুখ করে আসা যাক।
মিষ্টিমুখ করতে আপত্তি আছে–এমন অপবাদ প্যালারামের শত্রুরাও দিতে পারবে না। তবে টেনিদার সঙ্গে যেতেই আপত্তি আছে একটু। ওর মিষ্টিমুখ মানেই আমার পকেট ফাঁক। টেনিদা যখনই বলেছে, চল প্যালা বঙ্গেশ্বরী মিষ্টান্ন ভাণ্ডার থেকে তোকে জলযোগ করিয়ে আনি–তখনই আমার কমসেকম পাঁচটি করে টাকা স্রেফ বরবাদ। মানে রাজভোগগুলো ও-ই খেয়েছে আর আমি বসে বসে দুএকটা যা খেতে চেষ্টা করেছি, থাবা দিয়ে সেগুলো কেড়ে নিয়ে বলেছে, এসব ছেলেপুলের খেতে নেই–পেট খারাপ করে।
অতএব গেলাস দুই জল খেয়েই আমায় উঠে আসতে হয়েছে। একেবারে খাঁটি জলযোগ যাকে বলে। তাই টেনিদার প্রস্তাব কানে যেতেই আমি তিন পা পেছিয়ে গেলাম।
বললাম, আমার শরীর ভালো নেই–আমি এখন মামাবাড়ি যাচ্ছি।
টেনিদা খাঁড়ার মতো নাকটাকে খাড়া করে বললে, শরীর ভালো নেই তো মামাবাড়ি যাচ্ছিস কেন? তোর মামা কি ভেটিরিনারি সার্জন যে তোর মতো ছাগলকে পটাৎ পটাৎ করে ইনজেকসন দেবে? বেশি পাকামি করিসনি প্যালাচল আমার সঙ্গে।
-সত্যি বলছি টেনিদা—
কিন্তু সত্যি-মিথ্যে কিছুই টেনিদা আমায় বলতে দিলে না। আমার পিঠে পনেরো সের ওজনের একটা চাঁটি বসিয়ে বললে, কেন বচ্ছরকার প্রথম দিনটাতে একরাশ মিথ্যে বলছিস প্যালা? কোনও ভাবনা নেই বুঝলি? তোর এক পয়সাও খরচ নেই সব পরম্মৈপদী।
পরস্মৈপদী? কে খাওয়াবে? আমাদের মতো অপোগন্ডকে খাওয়াবার জন্য কার মাথা ব্যথা পড়েছে?