–ধ্যান না করলে আরও মারবে। চোখ বুজে বসে থাক।
আমি একদম চুপ। এঃ হে-হে–ভারি ভুল হয়ে গেছে। অন্ধকারে নিজের ঠ্যাং ভেবে হাবুলের পায়েই চড় মেরে দিয়েছি।
আরও কিছুক্ষণ কাটল। ধ্যান করবার চেষ্টা করছি কিন্তু কিছুতেই কিছু হচ্ছে না। হারু পণ্ডিতের টাক আর দাড়িটা বেশ ভাবতে পারছি, কিন্তু সঙ্গে সঙ্গেই গাঁট্টটাও বিচ্ছিরিভাবে মনে পড়ে যাচ্ছে। তক্ষুনি ধ্যান বন্ধ করে দিচ্ছি। ওদিকে আবার দারুণ খিদে পাচ্ছে। আসবার সময় দেখেছি রান্নাঘরে মাংস চেপেছে। এতক্ষণে হয়েও গেছে বোধহয়। বাড়িতে থাকলে ঠাকুরের কাছে গিয়ে এক-আধটু চাখতে-টাখতেও পারতাম। যতই ভাবি, খিদেটা ততই যেন নাড়ির ভেতরে পাক খেতে থাকে।
হঠাৎ অন্ধকার ভেদ করে রব উঠল : ব্যা-ব্যা-ব্যা–অ্যা-অ্যা–
কী সর্বনাশ! ধ্যান করতে করতে শেষকালে পাঁঠার আত্মা ডেকে আনলাম নাকি! এতক্ষণ যে মাংসের কথাই ভাবছিলাম।
আমার পাশ থেকে হাবুল কাঁপা গলায় বললে, অ টেনিদা–পাঁঠা ভূত!
অন্ধকারে টেনিদা গর্জন করলে : যেমন তোরা পাঁঠা-পাঁঠা ভূত ছাড়া আর কী আসবে তোদের কাছে।
ক্যাবলা খিকখিক করে হেসে উঠল। সঙ্গে সঙ্গেই আবার শোনা গেল : ভ্যা–অ্যা–অ্যা–অ্যা–
টেনিদা বললে, অমন কত আসবে। ধ্যানে বসলে সবাই আসতে চায় কিনা। এখন কেবল একমনে জপ করে যা–পাঁঠা ভূত, তুমি চলে যাও, স্বর্গে গিয়ে ঘাস খাও। আমরা শুধু হারু পণ্ডিতকে চাই। সেই টাক, সেই দাড়ি–সেই নস্যির ডিবে–আমাদের সেই স্যারকেই চাই। আর কাউকে না–কাউকেই না–
পাঁঠা ভূতকে যে আমিই ডেকে ফেলেছি সেটা চেপে গেলাম। কিন্তু আমার পায়ে ওটা কী সুড়সুড়ি দিয়ে গেল? প্রায় চেঁচিয়ে বলতে যাচ্ছি হঠাৎ টের পেলাম–আরোশোলা।
খিদেটা ভুলে গিয়ে প্রাণপণে স্যারকে ডাকতে চেষ্টা করতে লাগলাম। কিন্তু বেশিক্ষণ ধ্যানের জো আছে? ঘটাং করে কে যেন আমার পায়ে ল্যাং মারল।
–টেনিদা। ভূতে ল্যাং মারছে আমাকে–আমি আর্তনাদ করলাম।
হাবুল বলে উঠল : আঃ–খামখা গাধার মতন চাঁচাস ক্যান? আমার পা-টা হঠাৎ লাইগ্যা গেছে।
টেনিদা দাঁত কিড়মিড় করে উঠল : উঃ–এই গাড়লগুলোকে নিয়ে কি ধ্যান হয়? তখন থেকে সমানে ডিসটার্ব করছে। এবার যে একটা কথা বলবে, তার কান ধরে সোজা বাইরে ফেলে দেব।
আবার ধ্যান শুরু হল।
প্রায় হারু পণ্ডিতকে ধ্যানের মধ্যে এনে ফেলেছি। এল, এল–এসেই পড়েছে বলতে গেলে। টাকটা প্রায় আমার চোখের সামনে-মনে হচ্ছে যেন দাড়ির সুড়সুড়ি আমার মুখে এসে লাগছে। একমনে বলছি : দোহাই স্যার, স্কুল ফাঁইন্যাল স্যার–অঙ্কের কোশ্চেন স্যার।–আর ঠিক তক্ষুনি–
কেমন একটা বিটকেল শব্দ হল মাথার ওপর।
চমকে তাকাতে দেখি টিনের চালের গায়ে দুটো জ্বলজ্বলে চোখ। ঠিক যেন মোটা মোটা চশমার আড়াল থেকে হারু পণ্ডিত আমার দিকে চেয়ে রয়েছেন। আমার পালাজ্বরের পিলেটা সঙ্গে সঙ্গে তড়াং করে লাফিয়ে উঠল।
–ওকি–ওকি টেনিদা।–আমি আবার আর্তনাদ করে উঠলাম। সঙ্গে সঙ্গে সেই জ্বলন্ত চোখ দুটো যেন শূন্য থেকে ঝাঁপিয়ে পড়ল–আর আমার মাথায় এসে লাগল এক রামচাঁটি। ভূত হয়ে সে চাঁটি মোলায়েম হওয়া তো দূরে থাক–আরও মোক্ষম হয়ে উঠেছে।
বাপ্ রে গেছি বলে আমি এক প্রচণ্ড লাফ মারলাম। সঙ্গে সঙ্গে টেবিল উলটে পড়ল।
–খাইছে–খাইছে–ভূতে খাইছে রে-হাবুল কেঁদে উঠল।
–টেবিল চাপা দিয়ে আমায় মেরে ফেলে দিলে রে–টেনিদার চিৎকার শোনা গেল।
অন্ধকারে আমি দরজার দিকে ছুটে পালাতে চাইলাম। সঙ্গে সঙ্গেই কে যেন আমার ঘাড়ে লাফ দিয়ে পড়ল। আমার গলা দিয়ে–গ্যাঁ- ঘোঁক–বলে একটা আওয়াজ বেরুলো-আর তার পরেই–সর্ষে ফুল। ঝিঁঝির ডাক। পটলডাঙার প্যালারাম একেবারে ঠায় অজ্ঞান।
চোখ মেলে দেখি, মেঝেয় পড়ে আছি। ঘরে মোমবাতি জ্বলছে, আর ক্যাবলা আমার মাথায় জল দিচ্ছে। চেয়ার টেবিলগুলো ছত্রাকার হয়ে আছে ঘরময়।
আমি বললাম, ভু–ভু–ভূত।
ক্যাবলা বললে, না–ভূত নয়। টেনিদা আর হাবুল তক্ষুনি পালিয়েছে বটে, কিন্তু তোকে চুপি চুপি সত্যি কথা বলি। ঘরটার পেছনেই একটা ছাগল বাঁধা আছে। দাদুর হাঁপানি রোগ আছে কিনা, ছাগলের দুধ খায়। সেই ছাগলটাই ডাকছিল।
–আর সেই জ্বলজলে চোখ? সেই চাঁটি?
–হুলোর।
–হুলো কে?
–আমাদের বেড়াল। এ-ঘরে প্রায়ই ইঁদুর ধরতে আসে।
–কিন্তু হুলো কি অমন চাঁটি মারতে পারে?
–চাঁটি মারবে কেন রে বোকা? তুই চ্যাঁচালি–ভয় পেয়ে হুলোও চাল থেকে লাফ দিলে। পড়বি তো পর ছোড়দার স্যান্ডব্যাগের ওপরে। আর সঙ্গে সঙ্গে ব্যাগ দোল খেয়ে
এসে তোর মাথায় লাগল–তুই ভাবলি হারু পণ্ডিতের গাঁট্টা।ক্যাবলা হেসে উঠল।
–আর আমার ঘাড়ে অমন করে লাফিয়ে পড়ল কে?
–হাবলা। ভয় পেয়ে বেরুতে গিয়ে তোকে বিধ্বস্ত করে চলে গেছে।ক্যাবলা হেসে উঠল আবার।
আমি আবার চোখ বুজলাম। ক্যাবলার কথাই হয়তো ঠিক। কিন্তু আমার মন বলছে–ওই হুলো আর বালির বস্তার মধ্য দিয়ে সত্যি সত্যিই হারু পণ্ডিতের মোম চাঁটি আমার মাথায় এসে লেগেছে।
কারণ, পৃথিবীতে অমন দুর্মদ চাঁটি আর কেউ হাঁকড়াতে পারে না। আর কিছুতেই না।
হনোলুলুর মাকুদা
শ্রদ্ধানন্দ পার্কে আমি বেশ নরম গলায় গান গাইতে চেষ্টা করেছিলুম, এমন দেশটি কোথাও খুঁজে পাবে নাকো তুমি–আর টেনিদা বেশ উদাস হয়ে একটার পর একটা চীনেবাদাম চিবিয়ে খাচ্ছিল। ঠিক সেই সময় পাশ থেকে কে যেন গলা খাঁকারি দিয়ে বললে, হু-হুম্।