–পরীক্ষার পরে না আগে? রোমাঞ্চিত হয়ে আমি জানতে চাইলাম।
দূর উল্লুক! পরে হবে কেন রে, একমাস আগে।
হঠাৎ ক্যাবলা একটা বেয়াড়া প্রশ্ন করে বসল।
–আচ্ছা টেনিদা সবসুদ্ধ তোমার ক’টা মামা?
–অত খবরে তোর দরকার কী রে গর্দভ? পুলিশ কমিশনার থেকে পকেটমার পর্যন্ত সারা বাংলাদেশে আমার যত মামা, তাদের লিসটি করতে গেলে একটা গুপ্ত প্রেসের পঞ্জিকা হয়ে যায়–তা জানিস?
–ছাড়ান দে–ছাড়ান দে। বললে হাবুল সেন।
আমি বললাম, আমাদের অঙ্কের কোশ্চেন যে করেছে সে কি তোমার মামা হয় নাকি?
–কে জানে, হতেও পারে! টেনিদা তাচ্ছিল্য করে জবাব দিলে।
–তা হলে তাকেই প্ল্যানচেটে ডাকো না!
–চুপ কর বেল্লিক! জ্যান্ত মানুষ কি কখনও প্লানচেটে আসে? ভূতকে ডাকতে হয়। ভূতের অসীম ক্ষমতা–যা ইচ্ছে তাই করতে পারে। তেমন-তেমন ভূত যদি আসে ব্যস্–মার দিয়া কেল্লা!
–বেশ তো-আনো না তবে ভূতকে? আমি অনুনয় করলাম।
–বললেই হল? টেনিদা প্রায় ভূতের মতো দাঁত খিচোল : ভূত কি চানাচুরওয়ালা যে ডাকলেই আসবে? তার জন্যে হ্যাঁপা আছে না? অন্ধকার ঘর চাই–টেবিল চাই–চারজন লোক চাই—
ক্যাবলার চোখ দুটো মিটমিট করছিল। বললে, ঠিক আছে। আমাদের গ্যারাজের পাশে একটা অন্ধকার ঘর আছে–একটা পা-ভাঙা টেবিল আমি দেব, আর চার মূর্তি আমরা তো আছিই।
টেনিদা বললে, বাঃ, গ্র্যান্ড! শুনে এত ভালো লাগছে যে তোর পিঠে আমার তিনটে চাঁটি মারতে ইচ্ছে করছে!
ক্যাবলা একলাফে রোয়াক থেকে নেমে পড়ল। বললে, তা হলে আজ রাত্রেই?
টেনিদা বললে, হ্যাঁ–আজ রাত্রেই।
আমার কেমন যেন সুবিধে মনে হচ্ছিল না। ভূত-টুত কেমন যেন গোলমেলে ব্যাপার! কিন্তু সাতদিন পরেই যে স্কুল ফাঁইন্যাল! আর তার দেড়মাস বাদেই পিঁজরাপোল!
অগত্যা নাক-টাক চুলকে আমায় রাজি হয়ে যেতে হল।
বাড়ির পেছনে গ্যারাজ–এমনি ঘুরঘুটটি অন্ধকার সেখানে, গ্যারাজের পাশের ছোট টিনের ঘরটা যেন ভুযো কালি মাখানো। গিয়ে দেখি ক্যাবলা সব বন্দোবস্ত করে রেখেছে। একটা পায়া-ভাঙা টেবিল। তার চারদিকে চারটে চেয়ার। একটু দূরে লম্বা দড়ির সঙ্গে ছোট একটা বস্তা ঝুলছে। টেবিলের ওপর ক্যাবলা একটা মোমবাতি জ্বেলে রেখেছিল–তার আলোতেই সব দেখতে পেলাম।
বস্তাটা দেখিয়ে হাবুল বললে, ওইটা কী ঝুল্যা আছে রে! খাওন-দাওনের কিছু আছে নাকি?
টেনিদা বললে, পেট-সর্বস্ব সব–খালি খাওয়াই চিনেছে! ওটা বকসিংয়ের বালির বস্তা।
–ভূত আইস্যা ওইটা লইয়া বকসিং কোরব নাকি? হাবুলের জিজ্ঞাসা।
ক্যাবলা হেসে বললে, ওটা ছোড়দার।
টেনিদা বললে, থাম–এখন বেশি বাজে বকিসনি। এবার কাজ শুরু করা যাক। হ্যাঁ রে ক্যাবলা–এদিকে কেউ কখনও আসবে না তো?.
–না, সে ভয় নেই।
–তবে দরজা বন্ধ করে দে।
ক্যাবলা দরজা বন্ধ করে দিলে। টেনিদা বললে, চারজনে চারটে চেয়ারে বসব আমরা। আলো নিবিয়ে দেব। তারপরে ধ্যান করতে থাকব।
–ধ্যান? কীসের ধ্যান?–আমি জানতে চাইলাম।
–ভূতের। মানে অঙ্কের কোশ্চেন বলে দিতে পারে–এমন ভূতের।
হাবুল বললে, সেইডা মন্দ কথা না। হারু পণ্ডিতের ডাকন যাউক।
হারু পণ্ডিত! শুনে আমার বুকের ভেতরে একেবারে ছাত করে উঠল। তিন বছর আগে মারা গেছেন হারু পণ্ডিত। দুর্দান্ত অঙ্ক জানতেন। তার চাইতেও জানতেন দুর্দান্তভাবে পিটতে। একটা চৌবাচ্চার নল দিয়ে জল-টল ঢোকার কী সব অঙ্ক দিতেন, আমরা হাঁ করে থাকতাম আর পটাৎ পটাৎ গাঁট্টা খেতাম। সেই হারু পণ্ডিতকে ডাকা।
আমি বললাম, বড় মারত যে!
-এখন আর মারবে না। ভূত হয়ে মোলায়েম হয়ে গেছে। তা ছাড়া কেউ তো ডাকে–আমরা ডাকলে কত খুশি হবে দেখিস। শুধু অঙ্ক কেন–চাই কি আদর করে সব কোশ্চেনই বলে দেবে! টেনিদা আমাকে উৎসাহিত করলে।
ক্যাবলা বললে, তবে ধ্যানে বসা যাক।
আমি বললাম, হ্যাঁ ভাই, একটু তাড়াতাড়ি। বেশি দেরি হয়ে গেলে বড়দা কান পেঁচিয়ে দেবে। আমি বলে এসেছি ক্যাবলার কাছে অঙ্ক কষতে যাচ্ছি।
টেনিদা বললে, আমি আলো নিবিয়ে দিচ্ছি। তার আগে শেষ কথাগুলো বলে নিই। সবাই হারু পণ্ডিতকে ধ্যান করবি। এক মনে, এক প্রাণে। সেই দাড়ি–সেই ডাঁটভাঙা চশমা, সেই টাক–সেই নস্যি নেওয়া–
ক্যাবলা বললে, সেই গাঁট্টা–
টেনিদা ধমক দিয়ে বললে, চুপ, বাজে কথা এখন বন্ধ। শুধু ধ্যান। এক মনে, এক প্রাণে। শুধু প্রার্থনা : “স্যার–দয়া করে একবার আসুন–আপনার অধম ছাত্রদের পরীক্ষার কোশ্চেনগুলো বলে দিয়ে যান।” আর কিছু না–আর কোনও কথা নয়। আচ্ছা আমি আলো নেবাচ্ছি। ওয়ান-টু-থ্রি—
টুক করে আলো নিবে গেল।
বাপস, কী অন্ধকার! দম যেন আটকে যায়। ভয়ে আমার গা শিরশির করতে লাগল। ধ্যান করব কী ছাই, এমনিতেই মনে হচ্ছিল, চারদিকে যেন সার বেঁধে ভূত দাঁড়িয়ে আছে।
তবু ধ্যানের চেষ্টা করা যাক। কিন্তু কী যাচ্ছেতাই মশা এ-ঘরে। পা দুটো একেবারে ফুটো করে দিচ্ছে। অনেকক্ষণ দাঁত-টীত খিঁচিয়ে থেকে আর পারা গেল না। চটাস করে একটা চাঁটি মারলাম।
কিন্তু একি! পায়ে চাঁটি মারলাম কিন্তু লাগল না তো? আমার পা কি একেবারে অসাড় হয়ে গেছে? আর আমার পাশ থেকে হাবুল তখুনি হাঁইমাই করে চেঁচিয়ে উঠল : অ টেনিদা, ভূতে আমার পায়ে ঠাঁই কইর্যা একটা চোপড় মারছে।
টেনিদা বললে, শাট আপ। ধ্যান করে যা।
–কিন্তু আমারে যে চোপড় মারল।