কিন্তু যা হল তা একটা দেখবার মতো ঘটনা। শাবাশ একখানা খেল, একেবারে ভানুমতীর খেল। এবার ফাতনা ড়ুবতেই আর হেঁইয়া শব্দে টান দিলে না টেনিদা। আস্তে আস্তে অতি সাবধানে বঁড়শিটাকে ঘাটের দিকে টানতে লাগল। তারপর বঁড়শিটা যখন একেবারে কাছে চলে এসেছে, তখন দেখা গেল মস্ত একটা লাল রঙের কাঁকড়া বঁড়শিটা প্রাণপণে আঁকড়ে আছে। টেনিদা বললে, বঁড়শি জলের ওপর তুললেই ও ব্যাটা ছেড়ে দেবে। বঁড়শি আমি তোলবার আগে ঠিক জলের তলায় ধামাটা পেতে ধরবি, বুঝলি জগা! তারপর দেখা যাবে কে বেশি চালাক—আমি, না ব্যাটাচ্ছেলে কাঁকড়া!
তারপর আরম্ভ হল সত্যিকারের শিকারপর্ব। টেনিদার বুদ্ধির কাছে এবারে কাঁকড়ার দল ঘায়েল। আধঘণ্টার মধ্যে ধামা বোঝাই।
দুটো প্রকাণ্ড প্রকাণ্ড হুইলের শিকার দু কুড়ি কাঁকড়া!
টেনিদা বললে, মন্দ কী! কাঁকড়ার ঝোলও খেতে খারাপ নয়। তোর খিচুড়ি কতদূর জগা?
কিন্তু ভদ্রলোকের এক কথা। আমি সেটা ভুলিনি।
বললাম, টেনিদা, মুড়োটা তোমার—আর ল্যাজা-পেটি আমার মনে আছে তো?
টেনিদা আঁতকে বললে, অ্যাাঁ।
আমি বললাম, হ্যাঁ।
টেনিদা এক মিনিটে কাঁচুমাচু হয়ে গেল, তা হলে?
–তা হলে মুড়ো, অর্থাৎ কাঁকড়ার দাঁড়া দুটো তোমার, আর বাকি কাঁকড়া আমার।
টেনিদা আর্তনাদ করে বললে, সে কী?
আমি বললাম, ভদ্দরলোকের এক কথা।
—তা হলে কাঁকড়ার কি মুড়ো নেই?
মুড়ো না থাকলেও মুখ আছে, কিন্তু আমি সে চেপে গেলাম। বললাম, ওই দাঁড়াই হল ওদের মুড়ো।
টেনিদা খানিকক্ষণ চুপ করে দাঁড়িয়ে রইল, তারপর আস্তে আস্তে বসে পড়ল। বললে, প্যালা, তোর মনে এই ছিল! ও হো-হো-হো-
তা যা খুশি বলল। বঙ্গেশ্বরী মিষ্টান্ন ভাণ্ডারে সাড়ে তিন টাকার শোক কি আমি এর মধ্যেই ভুলেছি!
আজ দুদিন বেশ আরামে কাঁকড়ার ঝোল খাচ্ছি। টেনিদা দাঁড়া কী রকম খাচ্ছে বলতে পারব না, কারণ রাস্তায় সেদিন আমাকে দেখেও ঘাড় গুঁজে গোঁ-গোঁ করে চলে গেল, যেন চিনতেই পারেনি।
সাংঘাতিক
সাত দিন পরেই পরীক্ষা। আর কী? সেই কালান্তক স্কুল-ফাইন্যাল।
পর পর দুবার শাদা কালিতে আমার নাম ছাপা হয়েছে, তিন বারের বার যদি তাই ঘটে–তাহলে বড়দা শাসিয়েছে আমাকে সোদপুরে রেখে আসবে।
–সোদপুরে তো গান্ধীজী থাকতেন। আমি গম্ভীর হয়ে বলেছিলাম।
–তুমিও থাকবে। বড়দা আরও গম্ভীর হয়ে বললে, তবে গান্ধীজী যেখানে থাকতেন সেখানে নয়। তিনি যাদের দুধ খেতেন–তাদের আস্তানায়।
–মানে?
–মানে পিঁজরাপোলে।
আমি ব্যাজার হয়ে বললাম, পিজরাপোলে কেন থাকতে যাব? ওখানে কি মানুষ থাকে?
মানুষ থাকে না, গোরু-ছাগল তো থাকে। সেজন্যেই তো তুই থাকবি। কচিকচি ঘাস খাবি আর ভ্যা-ভ্যা করে ডাকবি। শুনে মনটা এত খারাপ হল যে কী বলব। একদিন সন্ধেবেলা গড়ের মাঠে গিয়ে চুপি চুপি একমুঠো কাঁচা ঘাস খেয়ে দেখলাম–যাচ্ছেতাই লাগল! ছাদে গিয়ে একা-একা ব্যা ব্যা করেও ডাকলাম, কিন্তু ছাগলের মতো সেই মিঠে প্রাণান্তকর আওয়াজটা কিছুতেই বেরুল না।
তাই ভারি দুশ্চিন্তায় পড়লাম। গিয়ে বললাম লিডার টেনিদাকে।
টেনিদার অবস্থা আমার মতোই। এবার নিয়ে ওর চারবার হবে। হাবুল সেনের দ্বিতীয় বার। শুধু হতভাগা ক্যাবলাটাই লাফে লাফে ফার্স্ট হয়ে এগিয়ে আসছে–তিন ক্লাস নীচে ছিল, ঠিক ধরে ফেলেছে আমাকে। এর পরে যদি টপকে চলে যায় তাহলে সত্যিই পিঁজরাপোলে যেতে হবে!
চাটুজ্যেদের রোয়াকে বসে টেনিদা আতা খাচ্ছিল। গভীরভাবে চিন্তা করতে গিয়ে গোটাকয়েক বিচি খেয়ে ফেললে। তারপর অন্যমনস্কভাবে, খোসাটা যখন অর্ধেক খেয়ে ফেলেছে, তখন সেটাকে থুথু করে ফেলে দিয়ে বললে, ইউরেকা। হয়েছে।
–কী হয়েছে?
–প্ল্যানচেট।
–প্ল্যানচেট কাকে বলে?
টেনিদা বললে, তুই একটা গাধা। প্ল্যানচেট করে ভূত নামায়–জানিসনে?
এর মধ্যেই কোত্থেকে পাঁঠার ঘুগনি চাটতে চাটতে ক্যাবলা এসে পড়েছে। বললে, উঁহু, ভুল হল। ওর উচ্চারণ হবে প্লাসে।
–থাম-থাম–বেশি ওস্তাদি করিসনি! ভূতের কাছে আবার শুদ্ধ উচ্চারণ! তারা তো চন্দ্রবিন্দু ছাড়া কথাই কইতে পারে না–বলেই ছোঁ মেরে ক্যাবলার হাত থেকে ঘুগনির পাতাটা কেড়ে নিল টেনিদা।
ক্যাবলা হায় হায় করে উঠল। টেনিদা একটা বাঘাটে হুঙ্কার করে বললে, থাম, চিল্লাসনি। এ হল তোর ধৃষ্টতার শাস্তি। বলতে বলতে জিভের এক টানে ঘুগনির পাতা একদম সাফ।
ভেবেছিলাম আমাকেও একটু দেবে–কিন্তু পাতার দিকে তাকিয়ে বুকভরা আশা একেবারে ধুক করে নিবে গেল। বললাম, মরুক গে, প্ল্যানচেট আর প্লাসে কিন্তু ওসব ভুতুড়ে কাণ্ড আবার কেন? ভূত-টুত আমার একেবারেই পছন্দ হয় না।
টেনিদা হেঁ-হেঁ করে বললে, আছে রে গোমুখ–আছে। সবাই কি আর তালগাছের মতো হাত বাড়িয়ে ঘাড় মটকে দেয়? ওদের মধ্যেও দু-চারটে ভদ্র লোক আছে। তারা পরীক্ষার কোশ্চেন-টোশ্চেন বলে দেয়।
–অ্যাঁ?
–তবে আর বলছি কী! টেনিদা এবার শালপাতার উলটো দিকটা একবার চেটে দেখল। কিছু পেলে না–তালগোল পাকিয়ে ক্যাবলার মুখের ওপর পাতাটা ছুঁড়ে দিলে। বললে, আমার বিরিঞ্চি মামা কিছুতেই আর বি. এ পাশ করতে পারে না। গুনে গুনে আঠারো বার। গাঁজা খেলো। শেষকালে যখন আমার মামাতো ভাই গুবরে বি. এ ক্লাসে উঠল, তখন মামা কিছুতেই আর বি,এলার মুখের ওপর পাতা একবার চেটে বিরিঞ্চি মামার আর সইল না। প্ল্যানচেটে বসল। আর বললে পেত্যয় যাবি না প্যালাটপ টপ করে কোশ্চেন-পেপার এসে পড়তে লাগল টেবিলের ওপর।