জগা বললে, হুঁ।
বঁড়শি, টোপ, চার—সব?
জগা বললে, হুঁ।
–চল প্যালা, তাহলে পুকুরঘাটে যাই।
পুকুরঘাটে এলাম। সত্যিই খাসা পুকুরঘাট। শাদা পাথরে খাসা বাঁধানো। পুকুরে অল্প অল্প শ্যাওলা থাকলেও দিব্যি টলটলে জল। ঘাটটার ওপরে নারকেলপাতার ছায়া ঝিরঝিরে বাতাসে কাঁপছে। পাখি ডাকছে এদিকে ওদিকে। মাছ ধরবার পক্ষে চমৎকার জায়গা। ঘাটটার ওপরে দুটো বড় বড় হুইল বঁড়শিবঁড়শি দুটোর চেহারা দেখলে মনে হয় হাঙর কুমির ধরবার মতলব আছে।
টেনিদা আবার বললে, চার করেছিস জগা?
—হুঁ।
—কেঁচো তুলেছিস?
—হুঁ।
—তবে যা তুই, আমাদের জন্যে খিচুড়ির ব্যবস্থা করগে। আয় প্যালা, এবার আমরা কাজে লেগে যাই। নে বঁড়শিতে কেঁচো গাঁথ।
আমি কাঁদো কাঁদো মুখে বললাম, কেঁচো গাঁথব?
টেনিদা হুঙ্কার ছাড়ল : নইলে কি তোর মুখ দেখতে এখানে এনেছি নাকি? ওই তো বাংলা পাঁচের মতো তোর মুখ, ও-মুখে দেখবার মতো কী আছে র্যা? মাইরি প্যালা, এখন বেশি বকাসনি আমাকে–মাথায় খুন চেপে যাবে। ধর, কেঁচো নে।
কী কুক্ষণেই আজ বাড়ি থেকে বাইরে পা বাড়িয়েছিলাম রে। এখন প্রাণটা নিয়ে ঘরের ছেলে মানে মানে ঘরে ফিরতে পারলে হয়। আমার মুখের দিকে তাকিয়ে টেনিদার বোধহয় দয়া হল। বললে, নে নে, মন খারাপ করিসনি। আচ্ছা, আচ্ছা—মাছ পেলে আমি মুছোটা নেব আর সব তোর। ভদ্দর লোকের এক কথা। নে, এখন কেঁচো গাঁথ।
মাছ টেনিদা যা পাবে সে তো জানাই আছে আমার। লাভের মধ্যে আমার খানিক কেঁচো-ঘাঁটাই সার। এরই নাম পোড়া কপাল।
কিন্তু ভদ্দরলোকের এক কথা। সে যে কী সাংঘাতিক কথা সেটা টেনিদা টের পেল একটু পরে।
ছিপ ফেলে দিব্যি বসে আছি।
বসে আছি তো আছিই। জলের দিকে তাকিয়ে তাকিয়ে চোখ ব্যথা করতে লাগল। কিন্তু কা কস্য। জলের ওপর ফাতনাটি একেবারে গড়ের মাঠের মনুমেন্টের মতো খাড়া হয়ে আছে। একেবারে নট নড়ন-চড়ন–কিচ্ছু না।
আমি বললাম, টেনিদা, মাছ কই?
টেনিদা বললে, চুপ, কথা বলিসনি। মাছে ভয় পাবে।
আবার আধঘণ্টা কেটে গেল। বুড়ো আঙুলে কাঁচকলা দেখাবার মতো ফাতনাটি তেমনি মাথা তুলে দাঁড়িয়ে আছে। জলের অল্প অল্প ঢেউয়ে একটু একটু দুলছে, আর কিছু নেই।
আমি বললাম, ও টেনিদা, মাছ কোথায়?
টেনিদা বিরক্ত হয়ে বললে, থাম না। কেন বকরবকর করছিস র্যা? এসব বাবা দশ-বিশ সেরী কাতলার ব্যাপার—এ কী সহজে আসে? এ তো একেবারে পেল্লায় কাণ্ড। নে, এখন মুখে ইস্কুপ এঁটে বসে থাক।
ফের চুপচাপ। খানিক পরে আমি আবার কী একটা বলতে যাচ্ছি, কিন্তু টেনিদার দিকে তাকিয়েই থমকে গেলাম। ছিপের ওপরে একেবারে হুমড়ি খেয়ে পড়েছে, চোখ দুটো যেন ঠিকরে বেরিয়ে আসছে তার।
সত্যিই তো—এ যে দস্তুর মতন অঘটন। চোখকে আর বিশ্বাস করা যায় না; ফাতনা টিপটিপ করে নাচছে মাছের ঠোকরে।
আমাদের দু জোড়া চোখ যেন গিলে খাচ্ছে ফাতনাটাকে। দুহাতে ছিপটাকে আঁকড়ে ধরেছে টেনিদা—আর একটু গেলেই হয়! টিপটিপ—আমাদের বুক ঢিপঢিপ করছে সঙ্গে সঙ্গে। আমি চাপা গলায় চেঁচিয়ে উঠলাম, টেনিদা—
–জয় বাবা মেছো পেত্নী, হেঁইয়ো—
ছিপে একটা জগঝম্প টান লাগাল টেনিদা। সপাংসাঁই করে একটা বেখাপ্পা আওয়াজে বঁড়শি আকাশে উড়ে গেল, মাথার ওপর থেকে ছিড়ে পড়ল নারকেলপাতার টুকরো। কিন্তু বঁড়শি! একদম ফাঁকা মাছ তো দূরে থাক, মাছের একটি আঁশ পর্যন্ত নেই।
টেনিদা বললে, অ্যাঁ, ব্যাটা বেমালুম ফাঁকি দিলে! আচ্ছা, আচ্ছা যাবে কোথায়! আজ ওরই একদিন কি আমারই একদিন। নে প্যালা, আবার কেঁচো গাঁথ—
টান দেখেই বুঝতে পারছি কী রকম মাছ উঠবে! মাছ তো উঠবে না, উঠবে জলহস্তী। কিন্তু বলে আর চাঁটি খেয়ে লাভ কী, কেঁচো গাঁথা কপালে আছে, তাই গেঁথে যাই।
কিন্তু টেনিদার চারে আজ বোধ হয় গণ্ডা গণ্ডা রুই কাতলা কিলবিল করছে। তাই দু মিনিট না যেতেই এ কী! দু নম্বর ফাতনাতেও এবার টিপটিপ শুরু হয়েছে।
বললাম, টেনিদা, এবারে সামাল।
টেনিদা বললে, আর ফসকায়? বারে বারে ঘুঘু তুমি—হুঁ হুঁ! কিন্তু কথা বলিসনি প্যালা—চুপ। টিপটিপটিপ। টপ!
সাঁ করে আবার বঁড়শি আকাশে উঠল, আবার ছিড়ে পড়ল নারকেলপাতা। কিন্তু মাছ? হায়, মাছই নেই।।
টেনিদা বলেন, এবারেও পালাল? উঃ—জোর বরাত ব্যাটার। আচ্ছা, দেখে নিচ্ছি। কেঁচো গাঁথ প্যালা! আজ এসপার কি ওসপার।
তাজ্জব লাগিয়ে দিল বটে। বঁড়শি ফেলবামাত্র ফাতনা ড়ুবিয়ে নিচ্ছে, অথচ টানলেই ফাঁকা। এ কী ব্যাপার! এমন তো হয় না হওয়ার কথাও নয়।
টেনিদা মাথা চুলকোতে লাগল। পর পর গোটা আষ্টেক টানের চোটে মাথার ওপরে নারকেলগাছটাই ন্যাড়ামুড়ো হয়ে গেল, কিন্তু মাছের একটুকরো আঁশও দেখা গেল না।
টেনিদা বললে, এ কীরে, ভুতুড়ে কাণ্ড নাকি?
পিছনে কখন জগা এসে দাঁড়িয়েছে আমরা টেরও পাইনি। হঠাৎ পানে রাঙা একমুখ হেসে জগা বললে, আইজ্ঞা ভুতো নয়, কাঁকোড়া অছি।
–কাঁকোড়া? মানে কাঁকড়া?
জগা বললে, হুঁ।
–তবে আজ কাঁকড়ার বাপের শ্রাদ্ধ করে আমার শান্তি!… আকাশ কাঁপিয়ে হুঙ্কার ছাড়লে টেনিদা : বসে বসে নিশ্চিন্তে আমার চার আর টোপ খাচ্ছে? খাওয়া বের করে দিচ্ছি। একটা বড় দেখে ডালা কিংবা ধামা নিয়ে আয় তো জগা!
—ডালা! ধামা!—আমি অবাক হয়ে বললাম, তাতে কী হবে?
—তুই চুপ কর প্যালাবকালেই চাঁটি লাগাব। দৌড়ে যা জগাধামা নিয়ে আয়।
আমি সভয়ে ভাবলাম টেনিদার কি মাথা খারাপ হয়ে গেল নাকি? ধামা হাতে করে পুকুরে মাছ ধরতে নামবে এবারে?… কিন্তু–