টেনিদা মুখটাকে কুচোচিংড়ির মত সরু আর বিচ্ছিরি করে বললে, ফুঃ।
ফুঃ মানে? ক্যাবলা চটে গেল; কাঁকড়াবিছের সঙ্গে চালাকি নাকি? একবার কামড়ালেই বুঝতে পারবে।
কাঁকড়াবিছের সঙ্গে চালাকি কে করতে যাচ্ছে? কিন্তু কলকাতায় কাঁকড়াবিছে? রাম রাম! ওরা তো ডেয়ো পিঁপড়ের বড়দা ছাড়া কিছু নয়। আসল কাঁকড়াবিছের কথা জানতে চাস তো আমার পচামামার গল্প শুনতে হবে।
গল্পের আরম্ভে ক্যাবলা তড়াক করে রকে উঠে বসল।
হাবুল বললে, পচামামা? এই নামটা এইবারে য্যান নূতন শুনত্যা আছি।
কাল শুনবি আরও, এখুনি হয়েছে কী!–ভুট্টার দানাগুলো শেষ করে টেনিদা এবার সবটা বেশ করে চেটে নিলে : আর যত শুনবি ততই চমকে যাবি।
আমি একবার মাথাটা চুলকে নিয়ে বললুম, একটা কথা জিজ্ঞেস করব টেনিদা?
ভুট্টার গোঁজটা ছুঁড়ে ফেলে দিয়ে টেনিদা মোটা গলায় বললে, ইয়েস, পারমিশন দিচ্ছি।
–তোমার কটি মামা আছে সবসুদ্ধ?
টেনিদা বললে, ফাইভ ফিফটিফাইভ। মানে পাঁচশো পঞ্চান্ন জন।
আমি কাকের মতো হাঁ করে বসে রইলুম, ক্যাবলা একটা খাবি খেল, আর হাবুল সেন ডুকরে উঠল : খাইছে!
ইউ শাট আপ হাবলা, চিল্লাসনি। মামা কী রকম জানিস? ঠিক রেকারিং ডেসিমেলের মতো-মানে, শেষ নেই। মনে কর মার পিসতুতো ভাইয়ের বড় শালার মেজ ভায়রা-তাকে কী বলে ডাকব?
আমরা একবাক্যে বললুম, মামা।
কিংবা মনে কর, আমার কাকিমার মাসতুতো বোনের খুড়তুতো ভাইয়ের
ক্যাবলা বললে, থাক, আর বলতে হবে না। মানে, মামা। বিশ্বময় মামা।
রাইট। পচামামা সেই বিশ্বময় মামার একজন।
আমি অধৈর্য হয়ে বললাম, সে তো হল। কিন্তু কাঁকড়াবিছে
টেনিদা দাঁত খিঁচিয়ে বললে, দাঁড়া না ঘোড়াড্ডিম। আগে সব জিনিসটা ক্লিয়ার করে নিতে হবে না? কুরুবকের মতো বেশি বকবক করবি তো তোর কানের ওপর এখুনি একটা কাঁকড়াবিছে ছেড়ে দেব।
হাবুল বললে, ছাইড়া দাও–প্যালার কথা ছাইড়া দাও! ওইটা একটা দুগ্ধপোইষ্য শিশু।
কী আমার ঠাকুর্দা এলেন রে–আমি হাবুলকে ভেংচি কাটলুম।
টেনিদা আমার মাথায় টাং করে একটা টোকা মেরে বললে, ইউ স্টপ! নাউ নো ঝগড়া। তাহলে দুই থাপ্পড় দিয়ে দুটোকেই তাড়িয়ে দেব এখান থেকে। এখন পচামামার গল্প শুনে যা। খবরদার, ডিসটার্ব করবিনে।
আমরা একবাক্যে বললুম, না–না।
–পচামামা, বুঝলি–একটা গলাখাঁকারি দিয়ে টেনিদা শুরু করলে : স্কুলে সাতবার ম্যাট্রিক পরীক্ষায় ফেল করেছিল। আটবারের বার টেস্টেও যখন অ্যালাও হতে পারল না, তখন দাদু-মানে পচামামার বাবা তাকে পেল্লায় একটা চড় মেরে বলল, নিকালে আমার বাড়ি থেকে হতভাগা মুখ, কুপুত্তুর, বোম্বেটে, অকালকুষ্মাণ্ড কোথাকার।
একসঙ্গে চার-চারটে ওইরকম জবরদস্ত গাল, আর গালের ওপর অমনি একখানা, কী বলে–জাড্যাপহ চাঁটি–
আমি জিজ্ঞাসা করলুম : জাড্যাপহ মানে কী?
–আমি কোত্থেকে জানব? শুনতে বেশ জাঁদরেল লাগে, তাই বললুম।
ক্যাবলা বলতে গেল : জাড্যাপহ, অর্থাৎ কিনা, যা জড়তা অপহরণ
-চুপ কর ক্যাবল-টেনিদা খেঁকিয়ে উঠল : তুই আর পণ্ডিতের মতো টিকটিক করিসনি! ফের যদি বিদ্যে ফলাবি–আমি আর গল্প বলবই না। মুখে বল্টু এঁটে বসে থাকব।
আমি ব্যস্ত হয়ে বললাম, না–না, আমরা আর কথা বলব না। গল্পটাই চলুক।
টেনিদা আবার শুরু করল : সেই জাড্যাপহ চাঁটি খেয়ে পচামামার মন উদাস হল। ম্যাট্রিক পরীক্ষার নিকুচি করেছে–এমন অপমান সহ্য করা যায়। পচামামা সেই রাতেই দেশান্তরী হল।
মানে বিদেশে আর যাবে কোথায়, তখনও পাকিস্তান হয়নি-সোজা দার্জিলিং মেলে উঠে পড়ল। নামল গিয়ে শিলিগুড়িতে। সেখান থেকে হাঁটতে হাঁটতে পাহাড় জঙ্গল ভেঙে, বাঙলা দেশের চৌহদ্দি পেরিয়ে একেবারে চলে গেল ভুটানে।
ইচ্ছে ছিল তিব্বতে গিয়ে অতীশ দীপঙ্কর-টর হবে, কিন্তু একে বেজায় শীত, তায় ভুটান তখন লালে লাল।
লালে লাল?-ক্যাবলা জিজ্ঞেস করলে; ভূটানীরা খুব দোল খেলে বুঝি?
–তোর মুণ্ডু! লেবু–লেবু, কমলালেবু। ভূটানী কমলা বিখ্যাত, জানিস তো? আর পাহাড় আলো করে সব বাগান, তাতে হাজারে হাজারে ফল পেকে টুক-টুক করছে ঝরে পড়ছে গাছতলায়। যত খুশি কুড়িয়ে খাও, কেউ কিচ্ছুটি বলবে না। এমনকি এদিক-ওদিক তাকিয়ে দুটো-চারটে ছিঁড়ে নিতে পারো–কে আর অত লক্ষ করতে যাচ্ছে!
মোদ্দা, ওই কমলালেবুর টানেই পচামামা ভূটানে আটকে গেল। যেখানে-সেখানে পড়ে থাকে আর পেটভরতি লেবু খায়। দেখতে দেখতে পচামামার ছিবড়ে বাদুড়চোষা চেহারাই পালটে গেল একদম। দাদু কিপটে লোক, তাঁর বাড়িতে পুঁইডাঁটা চচ্চড়ি, কড়াইয়ের ডাল আর খলসে মাছের ঝাল খেয়ে পচামামার বুদ্ধিটুদ্ধিগুলোতে মরচে পড়ে গিয়েছিল, কিন্তু কমলালেবুর রসে হঠাৎ সেগুলো চাঙা হয়ে উঠল।
ওদিকে সবচাইতে বড় বাগানের মালিক হল পেম্বাদোরজী শিরিং। নামটা, কী বলে-একটু ইয়ে হলেও লোকটি বেশ ভালোমানুষ। গোলগাল চেহারা, গায়ে ওদের সেই কালো আলখাল্লা, মাথায় কাঁচাপাকা চুলের লম্বা বিনুনি। মুখে পাঁচ-সাত গাছা দাড়ি, সব সময় মিঠে-মিঠে হাসি, আর রাতদিন চমরী গাইয়ের জমাট দুধের টুকরো চুষছে। পচামামা তাকে গিয়ে মস্ত একটা সেলাম ঠুকে বললে, শিরিং সাহেব, আমি একজন বিদেশী।
শিরিং হেসে বললে, সে জানি। আজ পনেরো দিন ধরে তুমি আমার বাগানের লেবু খেয়ে আধাসাট করছ। কিন্তু আমরা অতিথিবৎসল বলে তোমায় কিছু বলিনি। ভুটিয়া হলে আমার এই কুকরি দিয়ে মুণ্ডটি কচাৎ করে কেটে নিতুম।