–তা বটে।
-এইভাবেই বেশ চলে যাচ্ছিল। পিসেমশাই কিছুই টের পেতেন না। কেবল মধ্যে-মধ্যে বেড়াল দুটোর দিকে তাকিয়ে তাঁর মনে একটা কুটিল সন্দেহ দেখা দিত। পিসিমাকে জিজ্ঞেস করতেন, বেড়াল দুটো কী খাচ্ছে-টাচ্ছে বলো তো? এত মোটা হচ্ছে কেন? পিসিমা ভালোমানুষের মতো মুখ করে বলতেন, ওরা আজকাল খুব ইঁদুর মারছে–তাই। ও–ইঁদুর মারছে। শুনে পিসেমশাই খুব খুশি হতেন, বলতেন, ইঁদুর মারা খুব ভালো, ও ব্যাটারা ধান-চাল, কলাইটলাই খেয়ে ভারি লোকসান করে।
সবই তো ভালো চলছিল, কিন্তু সেদিন হঠাৎ
আমি জিজ্ঞেস করলুম, হঠাৎ?
–পিসেমশাই কোর্টে গিয়ে দেখলেন–কে মারা গেছেন, কোর্ট বন্ধ। একটু গল্প-গুজব করে, পরের পয়সায় দু-একটা পান-টান খেয়ে বেলা বারোটা নাগাদ হঠাৎ বাড়ি ফিরলেন তিনি। ফিরেই তিনি স্তম্ভিত! এ কী! সারা বাড়ি যে মাছের কালিয়ার গন্ধে ম-ম করছে। মাছের মুড়ো দিয়ে সোনামুগের ডালের সুবাসে বাতাস ভরে গেছে যে! এ তিনি কোথায় এলেন কার বাড়িতে এলেন! জেগে আছেন, না স্বপ্ন দেখছেন।
দরজায় গাড়ি থামার শব্দে ওদিকে তো পিসিমার হাত-পা পেটের ভেতর ঢুকে গিয়েছিল। কিন্তু পিসিমা দারুণ চালাক আর মাথাও খুব ঠাণ্ডা। তিনি এক গাল হেসে বললেন, এসো এসো। তুমি যাওয়ার পরেই তোমার এক মক্কেল-কী নাম ভুলে গেছি প্রকাণ্ড একটা রুইমাছ, ভালো সোনামুগের ডাল আর ফুলকপি পাঠিয়ে দিয়েছে। তাই রান্না করছিলুম।
অ–মক্কেল। পিসেমশাই একটু আশ্বস্ত হলেন কিন্তু তারপরেই আঁতকে উঠে বললেন, কিন্তু তেল, ঘি? মশলা-পাতি?
সব সে পাঠিয়ে দিয়েছিল।
তাই নাকি? তাই নাকি? তা হলে খুব ভালো–পিসেমশাইয়ের বোঁচা গোঁফের ফাঁকে একটু হাসি দেখা দিল : আমি ভাবতুম, মক্কেলগুলো সব বে-আক্কেলে–এর দেখছি একটু বুদ্ধি-বিবেচনা আছে। তা কোথাকার মক্কেল বললে? কী নাম?
নাম তো ভুলে গেছি।–পিসিমা বুদ্ধি খাটিয়ে বললেন, বোধহয় সোনামুখীর কোনও লোক। তিনি জানতেন সোনামুখীতে পিসের কিছু মক্কেল আছে।
সোনামুখী?–ভুরু কুঁচকে ভাবতে লাগলেন পিসে।
পিসি বললেন, হয়েছে হয়েছে, এখন তোমায় আর অত আকাশ-পাতাল ভাবতে হবে না। কত লোকের মামলা জিতিয়ে দিয়েছ, কে খুশি হয়ে দিয়ে গেছে, ও নিয়ে মাথা ঘামালে চলে? এখন এসো–মুড়িঘণ্টের ডাল আর মাছের কালিয়া দিয়ে দুটো ভাত খাও।
বাড়ি গন্ধে ভরাট–তাতে মাথা খারাপ হয়ে যায় পিসেমশাইয়ের পেটও চুঁই চুঁই করছিল। তবু একটু মাথাটা চুলকে বললেন, বামুনের ছেলে, এক সূর্যিতে দুবার ভাত খাব?
ভাত না খেলে। মাছই খাও একটু।
তা হলে ভাতও দাও দুটো। শুধু মাছে কি আর– পিসে ভেবে-টেবে বললেন, আর মক্কেলই তো খাওয়াচ্ছে–ওতে দোষ হবে না বোধহয়।
পিসিমা বললেন, না-কোনও দোষ হবে না।
অগত্যা পিসে বসে গেলেন। কিন্তু ডাল থেকে মুড়ো তুলে মুখে দিয়েই হঠাৎ একটা আর্তনাদ করলেন তিনি।
এ যে যজ্ঞির রামা।
পিসিমা বললেন, পরের পয়সায় তো।
কিন্তু কয়লা পুড়ল যে।
পিসিমা বললেন, কয়লা তো পোড়াইনি। চাকর দিয়ে শুকনো ডাল-পালা কুড়িয়ে আনিয়েছি।
কিন্তু কিন্তু-হাঁড়ি-ডেকচিগুলো?–বুকফাটা চিৎকার করলেন পিসেমশাই।
সেগুলো আগুনে পুড়ল না এতক্ষণ? ক্ষতি হল না তাতে? তারপর মাজতে হবে না? আরও ক্ষয়ে যাবে না সেজন্যে?–বলতে বলতে পিসেমশাই ডুকরে ডুকরে কেঁদে উঠলেন : গেল–আমার এত টাকার হাঁড়ি-ডেকচি ক্ষয়ে গেল আর কাঁদতে কাঁদতে ঠাস করে পড়ে গেলেন। পড়েই অজ্ঞান।
জ্ঞান হল বারো ঘণ্টা পরে। চোখ লাল–খালি ভুল বকছেন। থেকে-থেকে কঁকিয়ে কেঁদে উঠছেন :গেল–গেল–আমার হাঁড়ি-ডেকচি গেল।
ডাক্তার এসে বললেন, দারুণ শক পেয়ে পাগল হয়ে গেছে। রাঁচি পাঠিয়ে দেখুন–ওরা যদি কিছু করতে পারে।
তাই একাদশী পিসে কাঁকে চলে গেলেন। হয়তো ছমাস পরে ফিরবেন। এক বছর পরেও ফিরতে পারেন। আর নইলে পাকাপাকিভাবে থেকেও যেতে পারেন ওখানে। রাঁচির জল হাওয়ায় ভালোই থাকবেন আর মধ্যে মধ্যে হাঁড়ি-ডেকচির জন্যে কান্নাকাটি করবেন।
আমি বললুম, আচ্ছা টেনিদা, এখন একাদশী পিসি কী করবেন? বেশ নিশ্চিন্তে রোজ রোজ মাছ-মাংস-পোলাও-পায়েস খাবেন তো?
টেনিদা বললে, ছি প্যালা–তুই ভীষণ হার্টলেস।
আমি চুপ করে রইলুম। তেলেভাজার ঠোঙা শেষ হয়ে গিয়েছিল, একটা ল্যাজ-ন্যাড়া নেড়ী কুত্তার গায়ে সেটা ছুঁড়ে দিয়ে টেনিদা আমার কানে কানে বললে, এখন মানে যদ্দিন পিসে কাঁকেতে থাকে এই সময় বাঁকুড়ায় বেড়াতে যাওয়া যায়, না রে? যাবি তুই আমার সঙ্গে?
পরমানন্দে মাথা নেড়ে আমি বললুম, নিশ্চয়–নিশ্চয়।
কাঁকড়াবিছে
চাটুজ্জেদের রকে আমি, টেনিদা আর হাবুল সেন বসে মোড়ের বুড়ো হিন্দুস্থানীর কাছ থেকে কিনে-আনা তিনটে ভুট্টাপোড়া খুব তরিবত করে খাচ্ছিলুম। হঠাৎ কোত্থেকে লাফাতে লাফাতে ক্যাবলা এসে হাজির।
–ডি লা গ্র্যান্ডি মেফিস্টোফিলিস। মেরেছি একটাকে।
কচরকচর করে ভুট্টার দানা চিবুতে চিবুতে টেনিদা বললে, হঠাৎ এত লম্ফঝম্ফ যে? কী মেরেছিস? মাছি, না ছারপোকা?
একটা মস্ত কাঁকড়াবিছে। দেওয়ালের ফুটো থেকে বেরিয়ে দিব্যি ল্যাজ তুলে আমাদের ছেদিলালকে কামড়াতে যাচ্ছিল। ছেদিলাল আপন মনে গান গাইতে গাইতে গোরু দোয়াচ্ছে, কিচ্ছু টের পায়নি। আমি দেখেই একটা ইট তুলে ঝাঁ করে মেরে দিলুম-ব্যস-ঠাণ্ডা।