কিন্তু টেনিদার মেজাজ কী করে ঠাণ্ডা করতে হয় সে তো জানি। তক্ষুনি মোড় থেকে এক ঠোঙা তেলেভাজা কিনে আনলুম। আর গরম গরম আলুর চপে কামড় দিয়েই টেনিদা একেবারে জল হয়ে গেল।
-প্যালা, ইউ আর এ গুড বয়।
আমি বললুম, হুঁ।
–এই জন্যেই আমি তোকে এত ভালবাসি।
–সে তো দেখতেই পাচ্ছি।
–হাবুল সেন আর ক্যাবলাটার কিচ্ছু হবে না।
আমি বললুম, হবেই না তো। এই গরমের ছুটিতে আমাদের ফেলে–একটা গেল মামাবাড়িতে আম খেতে, আর একটা মা বাবার সঙ্গে বেড়াতে গেল শিলঙে। বিশ্বাসঘাতক।
টেনিদা বেগুনি চিবুতে চিবুতে বললে, বল–ট্রেটর। ওতে জোর বেশি হয়।
বললুম, মরুক গে, ওদের কথা ছাড়ো। কিন্তু তোমার সেই একাদশী পিসে
-ইয়েস-একাদশী পিসে। টেনিদা বললে, তাঁর কথাই বলতে যাচ্ছিলুম তোকে। আমার ঠিক রিয়েল পিসে নন–মার যেন কী রকম খুড়তুতো দাদামশাইয়ের মাসতুতো ভাইয়ের মামাতো শ্বশুরের
আমি ঘাবড়ে গিয়ে বললুম, থাক, এতেই হবে। মানে তিনি তোমার পিসেমশাই–এই তো?
হাঁ, পিসেমশাই। বাঁকুড়ায় উকিল। খুব পশার-বুঝলি? বাড়ি-গাড়ি, বিস্তর টাকা। এক ছেলে পঞ্জাবে ইঞ্জিনিয়ার, আর এক ছেলে যেন কোথায় প্রফেসারি করে। মানে এত পয়সাকড়ি যে এখন পিসে ইচ্ছা করলে সব ছেড়ে বসে বসে গড়গড়া টানতে পারেন। কিন্তু ওসবে একাদশী পিসের সুখ নেই। খালি টাকা টাকা–টাকা। কিন্তু তার একটা পয়সা খরচ করতে হলে তাঁর পাঁজরা ভেঙে যায়।
কী করেন তা হলে টাকা দিয়ে?
-কেন, ব্যাঙ্কে জমান। একটা কানাকড়িও তোলেন না তা থেকে। বলেন–গুরুর আদেশ। গুরু নাকি বলে দিয়েছেন ব্যাঙ্কের জমানো টাকা কখনও তুলতে নেই, তাতে পাপ হয়।
-সত্যিই ওঁর গুরু আছে নাকি?
-ঘোড়ার ডিম, সব বানানো। ওঁদের কে এক কুলগুরু নাকি একবার কিছু প্রণামীর আশায় ওঁর বাড়িতে এসেছিলেন–একাদশী পিসে মোটা একখানা আইনের বই নিয়ে তাঁকে এমন তাড়া লাগালেন যে গুরুদেব এক ছুটে বাঁকুড়ার বর্ডার পেরিয়ে একেবারে মানভূম–মানে পুরুলিয়া ডিসট্রিক্টে চলে গেলেন।
–ডেনজারাস!
-ডেনজারাস বলে ডেনজারাস! বাড়িতে লোকজন টেকে না–ঝি-চাকর আসে, কিন্তু মোটা মোটা চালের আধপেটা ভাত, আধপোড়া দু-একখানা রুটি, খোসাসুদ্ধ কড়াইয়ের দাল আর ডাঁটার চচ্চড়ি দিন তিনেক খেয়েই তারা বাপরে–মা-রে বলে ছুটে পালায়। যাওয়ার আগে যদি মাইনে চায়, একাদশী পিসে বলেন, মাইনে! চুক্তি ভঙ্গের দায়ে এক্ষুনি তোদের নামে এক নম্বর ঠুকে দেব।
পিসেমশাইয়ের বাড়িতে গোরু আছে, দুধও হয় কিন্তু দুধ পিসেমশাই কাউকে খেতে দেন না–বলেন, ও তো শিশুর খাদ্য। দুধ তিনি বিক্রি করেন। ঘি? আরে রামো–কোন ভদ্রলোকে ঘি খায়? এক সের তেলে তাঁর বাড়িতে ছমাস রান্না হয়। মাংস? পিসে বলেন, ছিঃ জীবহিংসা করতে নেই।
আমি জিজ্ঞেস করলুম, পরের বাড়িতে গিয়ে তিনি মাংস খান না?
–খাবেন না কেন? পেলেই খান। কিন্তু জীব-হিংসের পাপ তো অন্যের। পিসের কী দোষ?
-আর মাছ?
হুঁ, মাছ একটু অবিশ্যি না হলে তাঁর খাওয়া হয় না। দুটো ছোট-ছোট শিঙিমাছ আনলে তাঁর মাসখানেক চলে যায়।
–সে কী।
টেনিদা মিটমিট করে হাসল : বুঝতে পারছিস না? মাছ দুটোকে হাঁড়িতে জিইয়ে রাখা হয়। আর রোজ সকালে পিসেমশাই একখানা দাড়ি কামানোর ব্লেড দিয়ে সেই মাছদের ল্যাজ থেকে–এই মনে কর–আধ ইঞ্চির কুড়ি ভাগের এক ভাগ কেটে নেন।
আমি একটা বিষম খেলুম : কত বললে?
–আধ ইঞ্চির কুড়ি ভাগের এক ভাগ।
কাটতে পারে কেউ? ইমপসিবল!
–তুই ইমপসিবল বললেই হবে? যে-লোক ওভাবে পয়সা জমাতে পারে সে সব পারে। এমন ভাবে কাটেন যে মাছ দুটো টেরও পায় না–পরদিন সে ল্যাজ আবার গজিয়ে যায়। আর সেই ল্যাজের কাটা টুকরোটা দিয়ে এক বাটি ঝোল রান্না করে খান একাদশী পিসে–বলেন, শিঙিমাছের ঝোল খুব বলকারক।
আমি বললুম, তাতে আর সন্দেহ কী! কিন্তু মাছ দুটো মরে গেলে?
–বাড়িতে বিরাট ভোজ। সবাই সেদিন ঝোলে আঁশটে গন্ধ পায়। তারপর সাত দিন আর মাছ আসে না। পিসে বলেন–এত মাছ খাওয়া হয়েছে, এগুলো আগে হজম হোক!
–তা এখন পিসে হঠাৎ কাঁকে গেলেন কেন?
–আরে যেতে কি আর চেয়েছিলেন? তাঁকে যেতে হল। সেই কথাই বলি।
… এখন হয়েছে কী জানিস? সারা জীবন ওই কড়াইয়ের দাল আর ডাঁটা চচ্চড়ি খেতে-খেতে শেষকালে পিসিমা গেলেন দারুণ চটে।–ওদিকে টাকায় শেওলা জমে গেল, এদিকে আমরা না খেয়ে মরি! বিদ্রোহ করলেন পিসিমা।
বিদ্রোহ!
–তা ছাড়া আর কী! সামনা-সামনি কিছু বললেন না, কিন্তু চমৎকার প্ল্যান আঁটলেন একটা। পিসে তো কড়াইয়ের দাল, চচ্চড়ি আর তাঁর সেই মাছ খেয়ে নিয়মিত কোর্টে চলে যান। আর পিসিমা কী করেন? তক্ষুনি চাকরকে বাজারে পাঠান-গলদা চিংড়ি, ইলিশ, মাছ, পাকা পোনা, ভাল মাংস, ডিম এইসব আনান। সেগুলো তখন রান্না হয়, পিসিমা খান, ঝি-চাকর খায়–বাড়িতে যে-দুটো মড়াখেকো বেড়াল ছিল তারা দেখতে-দেখতে তেল-তাগড়া হয়ে যায়।
আমি বললুম, এ কিন্তু পিসিমার অন্যায়। পিসেকে ফাঁকি দিয়ে
টেনিদা রেগে বললে, কিসের অন্যায়? পিসে যদি কাঁড়ি কাঁড়ি টাকা রোজগার করেও না খেয়ে শিটকে হয়ে থাকেন–সে তাঁর খুশি। তাই বলে পিসিমা কষ্ট পেতে যাবেন কেন? আর অনেক দিনই ডাঁটা-চচ্চড়ি চিবিয়েছেন, চিবুতে চিবুতে দাঁতই পড়ে গেছে গোটাকয়েক, শেষ বয়সে ইচ্ছে হবে না একটু ভালোমন্দ খাবার?