–খেলাটি কোথায় হয়েছিল?
ঘুঁটেপাড়ায়। কী পেলে, ইউসেবিয়ো, মুলার নিয়ে লাফালাফি করিস! জীবনে একটা ম্যাচে কখনও বত্রিশটা গোল দিয়েছে তোদের রিভেরা, জেয়ার জিনহো? ববি চার্লটন তো আমার কাছে বেবি রে!
একটা মোক্ষম চাল মারতাছে- বিড়বিড় করে আওড়াল হাবুল সেন।
হাবুলার কপাল ভালো যে টেনিদা সেটা ভালো করে শুনতে পেল না। বললে, কী বললি, মোক্ষদা মাসি? কী করে জানলি রে? ওই মোক্ষদা মাসির বাড়িতেই তো আমি গিয়েছিলুম ঘুঁটেপাড়ায়। সেইখানেই তো সেই দারুণ ম্যাচ। কিন্তু মোক্ষদা মাসির খবর তোকে বললে কে?
আমি জানি– হাবুল পণ্ডিতের মতো হাসল।
ওর ওস্তাদি দেখে আমার রাগ হয়ে গেল। বললুম, বল দেখি ঘুঁটেপাড়া কোথায়?
–ঘুইট্যাপাড়া আর কোথায় হইব? গোবরডাঙার কাছেই। গোবর দিয়াই তো ঘুইট্যা হয়।
ইয়াহ! টেনিদা এত জোরে হাবুলের পিঠ চাপড়ে দিলে যে হাবুল চ্যাঁ করে উঠল। নাকটাকে জিভেগজার মতো উঁচু করে টেনিদা বললে, প্রায় ধরেছিস। তবে ঠিক গোবরডাঙার কাছে নয়, ওখান থেকে দশ মাইল হেঁটে, দুই মাইল দৌড়ে
দৌড়তে হয় কেন?–ক্যাবলা জানতে চাইল।
–হয়, তাই নিয়ম। অত কৈফিয়ত চাসনি বলে দিচ্ছি। ওখানে সবাই দৌড়য়। হল?
ক্যাবলা বললে, হল। আর পথের বিবরণ দরকার নেই, গল্পটা বলল।
গল্প!–টেনিদা মুখটাকে গাজরের হালুয়ার মতো করে বললে, এমন একটা জলজ্যান্ত সত্যি ঘটনা, আর তুই বলছিস গল্প! শিগগির উইথড্র কর–নইলে এক চড়ে তোর নাক
আমি বললুম, নাগপুরে উড়ে যাবে।
ক্যাবলা বললে, বুঝেছি। আচ্ছা আমি উইথড্র করলুম। কিন্তু টেনিদা ইংরেজীতে উচ্চারণ উইথড্র নয়।
আবার পণ্ডিতী! টেনিদা গর্জন করল : টেক কেয়ার ক্যাবলা, ফের যদি বিচ্ছিরি একটা কুরুবকের মতো বকবক করবি তো এক্ষুনি একটা পুঁদিচ্চেরি হয়ে যাবে বলে দিচ্ছি তোকে। যা শিগগির আট আনার ঝাল-মুড়ি কিনে আন– তোর ফাইন!
আলুভাজা-আলুভাজা মুখ করে ক্যাবলা ফাইন আনতে গেল। ওর দুর্গতিতে আমরা কেউ দুঃখিত হলুম না বলাই বাহুল্য। সব কথাতেই ক্যাবলা ওরকম টিকটিকির মত টিকটিক করে।
বুঝলি ঝালমুড়ি চিবুতে চিবুতে টেনিদা বলতে লাগল : ছ দিনের জন্যে তো বেড়াতে গেছি মোক্ষদা মাসির বাড়িতে। মেসোমশাই ব্যবসা করেন আর মাসিমা যা রাঁধেন না, খেলে অজ্ঞান হয়ে যাবি। মাসির রান্না বাটি-চচ্চড়ি একবার খেয়েছিস তো ওখান থেকে নড়তেই চাইবি না–ঘুঁটেপাড়াতেই ঘুঁটের মতো লেপটে থাকবি।
আমার খুব মনের জোর, তাই বাটি-চচ্চড়ি আর ক্ষীরপুলির লোভ কাটিয়েও কলকাতায় ফিরে আসি। সেবারেও গেছি- দুটো দিন একটু ভালোমন্দ খেয়ে আসতে। ভরা শ্রাবণ, থেকে থেকেই ঝুপঝাপ বৃষ্টি। সেদিন সকালে মাসিমা তালের বড়া ভেজে ভেজে তুলছেন। আর আমি একটার-পর-একটা খেয়ে যাচ্ছি, এমন সময় কটা ছেলে এসে হাজির।
অনেকবার তো ঘুঁটেপাড়ায় যাচ্ছি, ওরা সবাই আমায় চেনে। বললে, টেনিবাবু, বড় বিপদে পড়ে আপনার কাছে ছুটে এলুম। আজ বিকেলে শিবতলার মাঠে বিচালিগ্রমের সঙ্গে আমাদের ফুটবল ম্যাচ। ওরা ছজন প্লেয়ার কলকাতা থেকে হায়ার করেছে, আমরাও ছজন এনেছি। কিন্তু মুশকিল হল, আমাদের এখানকার একজন জাঁদরেল খেলোয়াড় হঠাৎ অসুস্থ হয়ে পড়েছে। আপনাকেই আমাদের উদ্ধার করতে হচ্ছে দাদা।
জানিস তো, লোকের বিপদে আমার হৃদয় কেমন গলে যায়। তবু একটু কায়দা করে বললুম, সব হায়ার করা ভালোভালো প্লেয়ার, ওদের সঙ্গে কি আর আমি খেলতে পারব? তা ছাড়া এবছরে তেমন ফর্ম নেই আমার। ওরা তো শুনে হেসেই অস্থির।
কী যে বলেন স্যার, আপনি পটলডাঙার টেনিরাম শর্মা- আপনার ফর্ম তো সব কাজে সব সময়েই থাকে। প্রেমেন মিত্তিরের ঘনাদা, হেমেন্দ্রকুমারের জয়ন্ত, শিব্রামের হর্ষবর্ধন–এদের ফর্ম কখনও পড়তে দেখেছেন?
আমি হাতজোড় করে প্রণাম করে বললুম, ঘনাদা, জয়ন্ত, হর্ষবর্ধনের কথা বললেন–ওঁরা দেবতা– আমি তো স্রেফ নস্যি। ওঁরা যদি গরুড় পাখি হন, আমি স্রেফ চড়ুই।
ওরা বললে, অত বুঝিনে দাদা, আপনাকে ছাড়ছিনে। আমাদের ধারণা, মোহনবাগান ইস্টবেঙ্গল তো তুচ্ছ– আপনি ইচ্ছা করলে বিশ্ব একাদশে খেলতে পারেন। আর আপনি যদি চড়ুই পাখি হন, আমরা তো তা হলে–কী বলে, মশা।
আমি বললুম, ঘুঁটেপাড়ার মশাকে তুচ্ছ করবেন না মশাই, এক-একটা প্রায় এক ইঞ্চি লম্বা।
ওরা হেঁ-হেঁ করে চলে গেল, কিন্তু আমাকে রাজি করিয়েও গেল। আমার ভীষণ ভাবনা হল রে। থান্ডার ক্লাবে যা খেলি– তা খেলি, কিন্তু অতগুলো এ-ডিভিসন বি-ডিভিসন খেলোয়াড়ের সামনে! ওরা না হয় আপ করে গেল, কিন্তু আমি দাঁড়াব কী করে?
কিন্তু ফিরিয়েও তো দেওয়া যায় না। আমার নিজের প্রেস্টিজ-পটলডাঙার প্রেস্টিজ সব বিপন্ন! কোন্ দেবতাকে ডাকি ভাবতে-ভাবতে হঠাৎ মা নেংটীশ্বরীকে মনে পড়ে গেল। আরে সেই নেংটীশ্বরী- আরে সেই যে রে-কম্বল নিরুদ্দেশ-এর ব্যাপারে যে-দেবতাটির সঙ্গে আমাদের দেখা হয়ে গিয়েছিল। মনে-মনে বলতে লাগলুম, এ-বিপদে তুমিই দয়া করো মা–গোটা কয়েক নেংটি ইঁদুর পাঠিয়ে দাও তোমার–খেলার সময় ওদের পায়ে কুটুরকুটুর করে কামড়ে দিক। নিদেনপক্ষে পাঠাও সেই অবকাশরঞ্জিনী বাদুড়কে– সে ওদের সকলের চাঁদি ঠুকরে বেড়াক।
এসব প্রার্থনা-ট্রার্থনা করে শ-দেড়েক তালের বড়া খেয়ে আবার বেশ একটা তেজ এসে গেল। কেবল মনে হতে লাগল, আজ একটা এসপার-ওসপার হয়ে যাবে। তখন কি জানি, গুনে-গুনে বত্রিশটা গোল দিতে পারব, আমি একাই?