আমাকে দিয়েই শুরু। পেটের মধ্যে পালাজ্বরের পিলেটা ধপাৎ করে লাফিয়ে উঠল একবার।
টেনিদা বললে, ঘাবড়াচ্ছিস কেন? যেই বল আসবে ঠাঁই করে পিটিয়ে দিবি। অ্যায়সা হাঁকড়াবি যে এক বলেই ওভার বাউন্ডারি—পারবি না?
—পারা যাবে বোধহয় কান-টান চুলকে আমি জবাব দিলাম।
—বোধহয় নয়, পারতেই হবে। তাড়াতাড়ি যদি আউট হয়ে যাস, তোকে আর আমি আস্ত রাখব না। মনে থাকবে?
এর মধ্যে হাবুল সেন আমার পায়ে আবার প্যাড পরিয়ে দিয়েছে, সেইটে পরে, হাতে ব্যাট নিয়ে দেখি নড়াচড়া করাই শক্ত!.
কাতর স্বরে বললাম : হাঁটতেই পারছি না যে! খেলব কী করে?
—তুই হাঁটতে না পারলে আমার বয়েই গেল! টেনিদা বিচ্ছিরি রকম মুখ ভ্যাংচাল : বল মারতে পারলে আর রান নিতে পারলেই হল!
–বা রে, হাঁটতেই যদি না পারি, তবে রান নেব কেমন করে?
—মিথ্যে বকাসনি প্যালা—মাথা গরম হয়ে যাচ্ছে আমার। হাঁটতে না পারলে দৌড়নো। যায় না? কেন যায় না—শুনি? তাহলে মাথা না থাকলেও কী করে মাথাব্যথা হয়? নাক না ডাকলেও লোকে ঘুমোয় কী করে? যা—যা, বেশি ক্যাঁচম্যাচ করিসনি। মাঠে নেমে পড়!
একেবারে মোক্ষ যুক্তি।
নামতেই হল অগত্যা। খালি মনে মনে ভাবছি প্যাড-ফ্যাড সুষ্ঠু পড়ে না যাই! ব্যাটটাকে। মনে হচ্ছে ভীমের গদার মতো ভারি—আগে থেকেই তো কজি টনটন করছে। আমি ওটাকে হাঁকড়াব না ওটাই আমায় আগে হাঁকড়ে দেবে—সেইটেই ঠাহর করতে পারছি না।
তাকিয়ে দেখি, পিছনে আর দুপাশে খালি চোরবাগান টাইগার ক্লাব। ওদের সঙ্গেই ম্যাচ কিনা!
কিন্তু এ আবার কী রকম ঝিঁঝি খেলা? ফুটবল তো দেখেছি সমানে সমানে লড়াই—এ-ওর পায়ে ল্যাং মারছে—সে তার মাথায় ঢু মারছে—আর বল সিধে এসপার ওসপার করবার জন্যে দুই গোলকিপার দাঁড়িয়ে আছে ঘুঘুর মতো। এ-পক্ষের একটা চিত হলে প্রায় সঙ্গে সঙ্গে ও-পক্ষের আর-একটা কাত। সে একরকম মন্দ নয়।
কিন্তু এ কী কাপুরুষতা! আমাদের দুজনকে কায়দা করবার জন্যে ওরা এগারো জন। সেইসঙ্গে আবার দুটো আমপায়ার। তাদের পেটে-পেটে যে কী মতলব তা-ই বা কে জানে! আমপায়ারদের গোল-গোল চোখ দেখে আমার তো প্রায় ভ্যামপায়ার বলে সন্দেহ হল!
তারপরে লোকগুলোর দাঁড়িয়ে থাকার ধরন দ্যাখো একবার! কেমন নাড়গোপালের মতো নুলো বাড়িয়ে উবু হয়ে আছে—যেন হরির লুটের বাতাসা ধরবে। সব দেখে-শুনে আমার রীতিমতো বিচ্ছিরি লাগল।
এই রেবল ছোড়ে যে! ব্যাট নিয়ে হাঁকড়াতে যাব—প্যাড-ট্যাড নিয়ে উলটে পড়ি আর কি! বলটা কানের কাছ দিয়ে বেরিয়ে গেল দমদম বুলেটের মতো—একটু হলেই কানটা উড়িয়ে নিত। একটা ফাঁড়া তো কাটল! কিন্তু ও কী? আবার ছেড়ে যে।
জয় মা ফিরিঙ্গি পাড়ার ফিরিঙ্গি কালী! যা-হোক একটা-কিছু এবার হয়ে যাবে! বলি দেবার খাঁড়ার মতো ব্যাটটাকে মাথার ওপর তুলে হাঁকিয়ে দিলাম। বলে লাগল না..স্রেফ পড়ল আমার হাঁটুর ওপরে। নিজের ব্যাটাঘাতে বাপরে বলে বসে পড়তেই দেখি, বলের চোটে স্টাম্প-ফাম্পগুলো কোথায় উড়ে বেরিয়ে গেছে।
—আউট–আউট।
চারিদিকে বেদম চিৎকার। আমপায়ার আবার মাথার ওপরে একটা হাত তুলে জগাই-মাধাইয়ের মতো দাঁড়িয়ে।
কে আউট হল? ক্যাবলা বোধহয়? আমি তক্ষুনি জানতাম, আমাকে কাকতাড়ুয়া বলে গাল দিয়েছে—আউট না হয়ে যায় কোথায়!
হাঁটুর চোটটা সামলে নিয়ে ব্যাট দিয়ে স্টাম্পগুলো সব ঠিক করতে যাচ্ছি হঠাৎ হতচ্ছাড়া আমপায়ার বলে বসল—তুমি আউট, চলে যাও।
আউট? বললেই হল? আউট হবার জন্যেই এত কষ্ট করে প্যাড আর পেন্টলুন পরেছি। নাকি? আচ্ছা দ্যাখো একবার! বয়ে গেছে আমার আউট হতে!
বললাম, আমি আউট হব না। এখন আউট হবার কোনও দরকার দেখছি না আমি।
আমি ঠিক বুঝেছিলাম ওরা আমপায়ার নয়, ভ্যামপায়ার। কুইনিন চিবোনোর মতো যাচ্ছেতাই মুখ করে বললে : দরকার না থাকলেও তুমি আউট হয়ে গেছ। স্টাম্প পড়ে গেছে। তোমার।
—পড়ে গেছে তো কী হয়েছে—আমি রেগে বললাম, আবার দাঁড় করিয়ে দিতে কতক্ষণ? ও-সব চালাকি চলবে না স্যার—এখনও আমার ওভার বাউন্ডারি করা হয়নি!
কেন জানি না, চারিদিকে ভারি যাচ্ছেতাই একটা গোলমাল শুরু হয়ে গেল। চোরবাগান। ক্লাবের লোকগুলোই বা কেন যে এরকম দাপাদাপি করছে, আমি কিছু বুঝতে পারলুম না।
তার মধ্যে আবার চালকুমড়ো ক্যাবলাটা ছুটে এল ওদিক থেকে।
—চলে যা—চলে যা প্যালা! তুই আউট হয়ে গেছিস। আর কতক্ষণ ধৈর্য থাকে এ-অবস্থায়? আমি চেঁচিয়ে বললাম, তোর ইচ্ছে থাকে তুই আউট হ-গে! আমি এখন ওভার বাউন্ডারি করব।
আমার কানের কাছে সবাই মিলে তখন সমানে কিচির-মিচির করছে। আমি কান দিতাম না—যদি না কটাং করে আমার কানে টান পড়ত।
তাকিয়ে দেখি–টেনিদা।
ধাঁই করে আমার কাছ থেকে ব্যাট নিয়ে কানে একটা চিড়িং মেরে দিল—তিড়িং করে লাফিয়ে উঠলাম আমি।
——যা উল্লুক! বেরো মাঠ থেকে। খুব ওস্তাদি হয়েছে, আর নয়!
রামছাগলের মতো মুখ করে অগত্যা আমায় চলে যেতে হল। মনে-মনে বললাম, আমাকে আউট করা! আউট কাকে বলে সে আমি দেখিয়ে দেব!
গিয়ে তো বসলাম কিন্তু কী তাজ্জব কাণ্ড! আমাদের দেখিয়ে দেবার আগেই চোরাবাগানের টাইগার ক্লাব আউট দেখিয়ে দিচ্ছে। কাররও স্টাম্প উল্টে পড়েছে, পিছনে যে লোকটা কাঙালি-বিদায়ের মতো করে হাত বাড়িয়ে বসে আছে, সে আবার খুটুস করে স্টাম্প লাগিয়ে দিচ্ছে। কেউ বা মারবার সঙ্গে সঙ্গেই লাফিয়ে উঠে বল লুফে নিচ্ছে। খালি আউট –আউট–আউট! এ আবার কী কাণ্ড রে বাবা!