গুলপট্টি তো নির্ঘাত। চাটুজ্যেদের রকে বসে তেলেভাজা খেতে খেতে সবাই। দুটো-চারটে গুল দেয়, আমিও ঝেড়েছিলুম একটা। কিন্তু টেনিদা দুবার ম্যাট্রিকে গাড্ডা খেয়েছে, তার মেমোরি এত ভাল কে জানত?
বাদামটা গিলে ফেলে আমি বললুম, না, না, গুলপট্টি হবে কেন? পালাজ্বরে কাহিল করে দিয়েছে নইলে এতদিনে আমি মোহনবাগানে খেলতুম, তা জানো? এখন দৌড়োতে গেলে পিলেটা একটু নড়ে—এই যা অসুবিধে।
—পিলেই তো নড়াবি। পিলে নড়লে তোর পালাজ্বরও সরে পড়বে—এই বলে দিলুম। নে—নেমে পড়—
ফুর্—র্—র্—র্–
রেফারির বাঁশির আওয়াজ। আমি কী বলতে যাচ্ছিলুম, তার আগেই এক ধাক্কায় টেনিদা আমাকে ছিটকে দিলে মাঠের ভেতরে। পড়তে-পড়তে সামলে নিলুম। ভেবে দেখলুম, গোলমাল বেশি বাড়ানোর চাইতে দু-একটা গোল দেওয়ার চেষ্টা করাই ভাল।
যা থাকে কপালে! আজ প্যালারামেরই একদিন কি পালাজ্বরেরই একদিন!
খেলা শুরু হল।
ব্যাকে দাঁড়িয়ে আছি। ভেবেছিলুম ভজুয়া একাই ম্যানেজ করবে কিন্তু দেখা গেল, মুখ ছাড়া আর কোনও পুঁজিই ওর নেই। একটা বল পায়ের কাছে আসতেই রাম শট হাঁকড়ে দিলে। কিন্তু বলে পা লাগল না—উলটে ধড়াস করে শুকনো মাঠে একটা আছাড় খেল ভজুয়া। ভাগ্যিস গোলকিপার গোবা তক্কেতক্কে ছিলঅইলে ঢুকেছিল আর-কি একখানা।
হাই কিক দিয়ে গোবরা বলটাকে মাঝখানে পাঠিয়ে দিলে। রাইট আউট হাবুল সেন বলটা নিয়ে পাঁই-পাঁই করে ছুটল-ফাঁড়া কাটল এ-যাত্রা।
কিন্তু ফুটবল মাঠে সুখ আর কতক্ষণ কপালে থাকে। পরক্ষণেই দেখি বল দ্বিগুণ বেগে ফিরে আসছে আমাদের দিকে—আর নিয়ে আসছে ট্যারা ন্যাড়া মিত্তির।
ভজুয়া বোঁ-বোঁ করে ছুটল—কিন্তু ন্যাড়া মিত্তিরকে ছুঁতেও পারল না। খুট করে ন্যাড়া কাটিয়ে নিলে, ভজুয়া একেবারে লাইন টপকে গিয়ে পড়ল লাইনসম্যান ক্যাবলার ঘাড়ে।
কিন্তু ভজুয়ার যা খুশি হোক—আমার তো শিরে সংক্রান্তি। এখন আমি ছাড়া ন্যাড়া মিত্তির আর গোলকিপার গোবরার ভেতরে আর কেউ নেই। আর গোরাকে তো জানি। ন্যাড়ার ট্যারা চোখের দিকে তাকিয়ে হাঁ করে দাঁড়িয়ে থাকবে—কোন্ দিক দিয়ে বল যে গোলে ঢুকছে টেরও পাবে না।
—চার্জ! চার্জ!—সেন্টারহাফ টেনিদার চিৎকার : প্যালা, চার্জ—
জয় মা কালী! এমনিও গেছি—অমনিও গেছি। দিলুম পা ছুড়ে! কিমাশ্চর্যম। ন্যাড়া মিত্তির বোকার মতো দাঁড়িয়ে বলটা সোজা ছুটে চলে গেছে হাবুল সেনের কাছে।
—ব্রেভো, ব্রেভো প্যালা!—চারদিক থেকে চিৎকার উঠল : ওয়েল সেভড। তাহলে সত্যিই আমি ক্লিয়ার করে দিয়েছি। আমি পটলডাঙার প্যালারাম, ছেলেবেলায় টেনিস বল ছাড়া যে কখনও পা দিয়ে ফুটবল ছোঁয়নি—সেই আমি ঠেকিয়েছি দুর্ধর্ষ ন্যাড়া মিত্তিরকে! আমার চব্বিশ ইঞ্চি বুক গর্বে ফুলে উঠল। মনে হল, ফুটবল খেলাটা কিছুই নয়। ইচ্ছে করে এতদিন খেলিনি বলেই মোহনবাগানে চান্স পাইনি।
কিন্তু আবার যে ন্যাড়া মিত্তির আসছে! ওর পায়ে কি চুম্বক আছে! সব বল কি ওর পায়ে গিয়ে লাগবে?
দুবার অপদস্থ হয়ে ভজুয়া খেপে গিয়েছিল। মরিয়া হয়ে চার্জ করল। কিন্তু রুখতে পারল না। তবু এবারেও গোল বাঁচল। তবে গোবরা নয়—একরাশ গোবর। ঠিক সময়মতো তাতে পা পিছলে পড়ে গেল ন্যাড়া মিত্তির, আর আমি ধাঁই করে শট মেরে ক্লিয়ার করে দিলুম। ওদের লেফট আউটের পায়ে লেগে থ্রো হয়ে গেল সেটা।
কিন্তু আত্মবিশ্বাস ক্রমেই বাড়ছে। পটলডাঙার থান্ডার ক্লাবের চিৎকার সমানে শুনছি। ব্রেভো প্যালা-শাবাশ! আরে, আবার যে বল আসে! আমাদের ফরোয়ার্ডগুলো কি ঘোড়ার ঘাস কাটছে নাকি? গেল-গেল করতে করতে ওদের বেঁটে রাইট ইনটা শট করলে আমার পায়ের তলা দিয়ে বল উড়ে গেল গোলের দিকে।
গো-ও-ও-
ভ্যাগাবন্ড ক্লাবের চিৎকার। কিন্তু ওল আর নয়, স্রেফ কচু। অর্থাৎ বল তখন পোস্ট ঘেঁষে কচুবনে অন্তর্ধান করেছে।
গোল কিক্।
কিন্তু এর মধ্যেই একটা কাণ্ড করেছে ভজুয়া। বলকে তাড়া করতে গিয়ে শট করে দিয়ে গোল-পোস্টের গায়ে। আর তার পরেই আঁই-আঁই করতে করতে বসে পড়েছে পা চেপে ধরে।
ভজুয়া ইনজিওর্ড! ধরাধরি করে দু-তিনজন তাকে বাইরে নিয়ে গেল।
আপদ গেল! যা খেলছিল—পারলে আমিই ওকে ল্যাং মেরে দিতুম। গোলপোস্টটাই। আমার হয়ে কাজ সেরে দিয়েছে। কিন্তু এখন যে আমি একেবারে একা একা কুম্ভ রক্ষা করে নকল কুঁদিগড়! এলোপাথাড়ি কাটল কিছুক্ষণ। ভগবান ভরসা—আমাকে আর বল ছুঁতে হল না। গোটা দুই শট গোবরা এগিয়ে এসে লুফে নিলে, গোটা তিনেক সামলে নিলে হাফ ব্যাকেরা। তারপর হাফ-টাইমের বাঁশি বাজল।
আঃ—কোনওমতে ফাঁড়া কাটল এ-পর্যন্ত। বাকি সময়টুকু সামলে নিতে পারলে হয়!
পেটের পিলেটা একটু টনটন করছে বুকের ভেতরও খানিকটা ধড়ফড়ানি টের পাচ্ছি। কিন্তু চারদিক থেকে তখন থাণ্ডার ক্লাবের অভ্যর্থনা : বেড়ে খেলছিস প্যালা, শাবাশ! এমনকি ক্যাপ্টেন টেনিদা পর্যন্ত আমার পিঠ থাবড়ে দিলে : তুই দেখছি রেগুলার ফার্স্ট ক্লাস প্লেয়ার! না—এবার থেকে তোকে চান্স দিতেই হবে দু-একবার
এতে আর কার পিলে-টিলের কথা মনে থাকে। বিজয়গর্বে দু-গ্লাস লেবুর শরবত খেয়ে নিলুম। শুধু ভজুয়া কিছু খেল না—পায়ে একটা ফেটি বেঁধে বসে রইল গোঁজ হয়ে। টেনিদা দাঁত খিচিয়ে বললে, শুধু একনম্বরের বাক্যি-নরেশ! এক লাথসে কুত্তাকো লরিমে চড়া দিয়া! তবু একটা বল ছুঁতে পারলে না—ছছঃ—ছো?