নেচে নেচে আয় মা কালী
আমি যে তোর সঙ্গে যাব–
তুই খাবি মা পাঁঠার মুড়ো
আমি যে তোর প্রসাদ পাব।
জঙ্গলের ভেতর দিয়ে টুকরো-টুকরো জ্যোৎস্না ছড়িয়ে পড়েছিল। হঠাৎ মামার চোখে পড়ল, কালো কম্বল মুড়ি দিয়ে একটা লোক সেই বনের ভেতর বসে কোঁ-কোঁ করছে।
আর কে! ওটা নির্ঘাত রামভরসা।
রামভরসার ম্যালেরিয়া ছিল। যখন-তখন যেখানে-সেখানে জ্বর এসে পড়ল। কিন্তু ওষুধ খেত না–এমনকি এই কুইনিনের দেশে এসেও তার রোগ সারবার ইচ্ছে ছিল না। রামভরসা তার ম্যালেরিয়াকে বড্ড ভালোবাসত। বলত, উ আমার বাপ-দাদার ব্যারাম আছেন। উকে তাড়াইতে হামার মায়া লাগে!
কুট্টিমামার মেজাজ যদিও আফিং-এর নেশায় ঝুঁদ হয়ে ছিল, তবু রামভরসাকে দেখে চিনতে দেরি হল না। রেগে বললে, তোকে না আমি বাসস্ট্যান্ডে যেতে বলেছিলুম? আর তুই এই জঙ্গলের মধ্যে কোঁ-কো করছিস? নে–চল–
গোঁ-গোঁ আওয়াজ করে রামভরসা উঠে দাঁড়াল।
কুট্টিমামা নাক চুলকে বললে, ইঃ, গায়ের কম্বলটা দ্যাখো একবার! কী বদখৎ গন্ধ! কোনওদিন ধুসনি বুঝি? শেষে যে উকুন হবে ওতে! নে–চল ব্যাটা গাড়ল! আর এই শুঁটকী মাছের পুঁটলিটাও নে। তুই থাকতে ওটা আমি বয়ে বেড়াব নাকি?
এই বলে মামা পুঁটলিটা এগিয়ে দিলে রামভরসার দিকে।
–এঃ, হাত তো নয়, যেন নুলো বের করেছে! যাক, ওতেই হবে।
মামা রামভরসার হাতে পুঁটুলিটা গুঁজে দিলে জোর করে।
রামভরসা বললে, গোঁ-গোঁ–ঘোঁক!
–ইস! সায়েবদের সঙ্গে থেকে খুব যে সায়েবি বুলি শিখেছিস দেখছি! চল–এবার বাসামে ফিরে কুইনিন ইনজেকশন দিয়ে তোর ম্যালেরিয়া তাড়াব। দেখব কেমন সায়েব হয়েছিস তুই!
রামভরসা বললে, ঘুঁক-ঘুঁক!
–ঘুঁক–ঘুঁক? বাংলা-হিন্দী বলতে বুঝি আর ইচ্ছে করছে না? চল–পা চালা–কুট্টিমামা আগে-আগে, পিছে পিছে শুঁটকী মাছের পুঁটলি নিয়ে রামভরসা। মামা একবার পেছনে তাকিয়ে দেখলে, কেমন থপাস থপাস হাঁটছে রামভরসা।
–উঃ, খুব যে কায়দা করে হাঁটছিস! যেন বুট পড়ে বড় সায়েব হাঁটছেন।
রামভরসা বললে, ঘঁচাৎ!
–ঘঁচাৎ? চল বাড়িতে, তোর কান যদি কচাৎ করে কেটে না নিয়েছি, তবে আমার নাম গজগোবিন্দ হালদার নয়!
মাইল-খানেক হাঁটবার পর কুট্টিমামার কেমন সন্দেহ হতে লাগল।
পেছনে-পেছনে থপথপ করে রামভরসা ঠিকই আসছে, কিন্তু কেমন কচমচর করে আওয়াজ হচ্ছে যেন! মনে হচ্ছে, কেউ যেন বেশ দরদ দিয়ে তেলেভাজা আর পাঁপর চিবুচ্ছে। রামভরসা শুঁটকী মাছ খাচ্ছে নাকি? তা কী করে সম্ভব? রামভরসা রান্না করা শুঁটকীর গন্ধেই পালিয়ে যায়কাঁচা শুঁটকী সে খাবে কী করে!
মামা একবার পেছনে তাকিয়ে দেখল কিন্তু বিশেষ কিছু বোঝা গেল না। একে তো নেশায় চোখ বুজে এসেছে, তার ওপর এদিকে একেবারে চাঁদের আলো নেই, ঘুরঘুট্টি অন্ধকার। শুধু দেখা গেল, পেছনে-পেছনে সমানে থপথপিয়ে আসছে রামভরসা, ঠিক তেমনি গদাইলস্করি চালে।
পায়ের নীচে পাইনের অজস্র শুকনো কাঁটাওয়ালা পাতা ঝরে রয়েছে। মামা ভাবলে হয়তো তাই থেকেই আওয়াজ উঠেছে এইরকম।
তবু মামা জিজ্ঞেস করল, কী রে রামভরসা, শুঁটকী মাছগুলো ঠিক আছে তো?
রামভরসা জবাব দিলে, ঘু–ঘু।
–ঘু–ঘু? ইস, আজ যে খুব ডাঁটে রয়েছিস দেখছি–যেন আদত বাস্তুঘুঘু।
রামভরসা বললে,–হুঁ–হুঁ।
কুট্টিমামা বললে, সে তত বুঝতেই পারছি। আচ্ছা, চল তো বাড়িতে, তারপর তোরই একদিন কি আমারই একদিন।
আরও খানিকটা হাঁটবার পর মামার বড্ড তামাকের তেষ্টা পেল। সামনে একটা খাড়া চড়াই, তারপর প্রায় আধমাইল নামতে হবে। একটু তামাক না খেয়ে নিলে আর চলছে না।
মামার বাঁ কাঁধে একটা চৌকিদারি গোছের ঝোলা ঝুলত সব সময়ে; তাতে জুতোর কালি, দাঁতের মাজন থেকে শুরু করে টিকে-তামাক পর্যন্ত সব থাকত। মামা জুত করে একখানা পাথরের ওপর বসে পড়ল, তারপর কল্কে ধরাতে লেগে গেল। রামভরসাও একটু দূরে ওত পেতে বসে পড়ল–আর ফোঁসফোঁস করে নিঃশ্বাস ছাড়তে লাগল।
–কী রে, একটান দিবি নাকি?
–হুঁ–হুঁ।
–সে তো জানি, তামাকে আর তোমার অরুচি আছে কবে? আচ্ছা, দাঁড়া আমি একটু খেয়ে নিই, তারপর প্রসাদ দেব তোকে।
চোখ বুজে গোটা কয়েক সুখটান দিয়েছে কুট্টিমামা হঠাৎ আবার সেই কচর-মচর শব্দ। শুঁটকী মাছ চিবোবার আওয়াজ নির্ঘাত।
কুট্টিমামা একেবারে অবাক হয়ে চেয়ে রইল কিছুক্ষণ। তারপর রেগে ফেটে পড়ল :
–তবে রে বেল্লিক, এই তোর ভণ্ডামি?-শুঁটকী মাছ হাম হুঁতা নেই, রাম রাম।–দাঁড়া, দেখাচ্ছি তোকে।
বলেই হুঁকো-টুকো নিয়ে মামা তেড়ে গেল তার দিকে।
তখন হঠাৎ আকাশ থেকে মেঘ সরে গেল, জ্বলজ্বলে একটা চাঁদ দেখা গেল সেখানে। একরাশ ঝকঝকে দাঁত বের করে রামভরসা বললে, ঘোঁক-ঘরর–ঘরর—
আর যাবে কোথায়! হাতের আগুন-সুদ্ধ হুঁকোটা রামভরসার নাকের ওপর ছুঁড়ে দিয়ে ‘বাপ রে–গেছি রে’–বলে কুট্টিমামার চিৎকার। তারপরই ফ্ল্যাট, একদম অজ্ঞান।
রামভরসা নয়, ভালুক। আফিং-এর ঘোরে মামা কিচ্ছুটি বুঝতে পারেনি। ভালুকের জ্বর হয় জানিস তো? তাই দেখে মামা ওকে রামভরসা ভেবেছিল। গায়ের কালো রোঁয়াগুলোকে। ভেবেছিল কম্বল। আর শুঁটকী মাছের পুঁটলিটা পেয়ে ভালুক বোধহয় ভেবেছিল, এ-ও তো মজা মন্দ নয়। সঙ্গে সঙ্গে গেলে আরও বোধহয় পাওয়া যাবে। তাই খেতে-খেতে পেছনে আসছিল। খাওয়া শেষ হলেই মামার ঘাড় মটকাত।