–ঘেঁয়াও–ঘুঁঙ
কুট্টিমামা আঁতকে উঠলেন। বাংলোর সামনে তারের বেড়া–তার ওপারে সেই বাঘ। কেমন যেন জোড়হাত করে বসেছে। কুট্টিমামার মুখের দিকে তাকিয়ে করুণ স্বরে বললে, ঘেঁয়াং কুঁই!
আর হাঁ করে মুখটা দেখাল!
ঠিক সেই রকম। দাঁতগুলো তোলবার পরে কুট্টিমামার মুখের যে-চেহারা হয়েছিল, অবিকল তা-ই! একেবারে পরিষ্কার–একটা দাঁত নাই! নির্ঘাত রামধনিয়ার মুখ।
বাঘটা হুবহু কান্নার সুরে বললে—ঘ্যাঁ–ঘ্যাঁ–ভ্যাঁও! ভাবটা এই, দাঁতগুলো তো সব গেল দাদা! আমার খাওয়া-দাওয়া সব বন্ধ! এখন কী করি?
কিন্তু তার আগেই এক লাফে কুট্টিমামা ঘরে ঢুকে দরজা বন্ধ করেছেন। বাঘটা আরও কিছুক্ষণ ঘাং-এ্যাং—ভ্যা–ভ্যা করে কেঁদে বনের মধ্যে চলে গেল।
পরদিন সকালে কুট্টিমামা জানালার পাশে দাঁড়িয়ে, বাঁধানো দাঁতের পাটি দুটো খুলে নিয়ে, বেশ করে মাজছিলেন। দিব্যি সকালের রোদ উঠেছে সায়েবগুলো ভোঁস ভোঁস করে ঘুমুচ্ছে তখনও, আর কুট্টিমামা দাঁড়িয়ে দাঁত মাজতে মাজতে ফ্যাকফ্যাক গলায় গান গাইছিলেন :এমন চাঁদের আলো, মরি যদি সে-ও ভালো
সকাল বেলায় চাঁদের আলোয় গান গাইতে গাইতে কুট্টিমামার বোধহয় আর কোনও দিকে খেয়ালই ছিল না। ওদিকে সেই ফোকলা বাঘ এসে জানলার বাইরে বসে রয়েছে ঝোপের ভেতরে। কুট্টিমামার দাঁত খোলা বুরুশ দিয়ে মাজাসব দেখছে এক মনে। মাজা-টাজা শেষ করে যেই কুট্টিমামা দাঁত দুপাটি মুখে পুরতে যাবেন–অমনিঃ ঘোঁয়াৎ ঘালুম।
অর্থাৎ তোফা–এই তো পেলুম।
জানলা দিয়ে এক লাফে বাঘ ঘরের মধ্যে।
টা-টাইগার–পর্যন্ত বলেই কুট্টিমামা ফ্ল্যাট।
বাঘ কিন্তু কিছুই করল না। টপাৎ করে কুট্টিমামার দাঁত দু-পাটি নিজের মুখে পুরে নিল কুট্টিমামা তখনও অজ্ঞান হননি–জ্বলজ্বল করে দেখতে লাগলেন, সেই দাঁত বাঘের মুখে বেশ ফিট করেছে। দাঁত পরে বাঘা আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে বেশ খানিকক্ষণ নিঃশব্দে বাঘা হাসি হাসল, তারপর টপ করে টেবিল থেকে টুথব্রাশ আর টুথপেস্টের টিউব মুখে তুলে নিয়ে জানলা গলিয়ে আবার
কুট্টিমামার ভাষায়–একেবারে উইন্ড! মানে হাওয়া হয়ে গেল।
টেনিদা থামল। আমাদের দিকে তাকিয়ে গর্বিতভাবে বললে, তাই বলছিলুম, দাঁত বাঁধানোর গল্প আমার কাছে করিসনি! হুঃ!
কুট্টিমামার হাতের কাজ
চিড়িয়াখানার কালো ভালুকটার নাকের একদিক থেকে খানিকটা রোঁয়া উঠে গেছে। সেদিকে আঙুল বাড়িয়ে আমাদের পটলডাঙার টেনিদা বললে, বল তো প্যালা–ভালুকটার নাকের ও-দশা কী করে হল?
আমি বললাম, বোধহয় নিজেদের মধ্যে মারামারি করেছে, তাই—
টেনিদা বললে, তোর মুণ্ডু!
–তা হলে বোধহয় চিড়িয়াখানার লোকেরা নাপিত ডেকে কামিয়ে দিয়েছে। মানুষ যদি গোঁফ কামায়, তাহলে ভালুকের আর দোষ কী?
–থাম থাম–বাজে ফ্যাক-ফ্যাক করিসনি। টেনিদা চটে গিয়ে বললে : যদি এখন এখানে কুট্টিমামা থাকত, তাহলে বুঝতিস সব জিনিস নিয়েই ইয়ার্কি চলে না।
–কে কুট্টিমামা?
–কে কুট্টিমামা?
–টেনিদা চোখ দুটোকে পাটনাই পেঁয়াজের মতো বড় বড় করে বললে : তুই গজগোবিন্দ হালদারের নাম শুনিসনি?
–কখনও না–আমি জোরে মাথা নাড়লাম : কোনওদিনই না! গজগোবিন্দ। অমন বিচ্ছিরি নাম শুনতে বয়ে গেছে আমার।
–বটে! খুব তত তড়পাচ্ছিস দেখছি। জানিস আমার কুট্টিমামা আস্ত একটা পাঁঠা খায়! তিন সের রসগোল্লা ঠুকে দেয় তিন মিনিটে?
–তাতে আমার কী? আমি তো তোমার কুট্টিমামাকে কোনওদিন নেমন্তন্ন করতে যাচ্ছি। প্রাণ গেলেও না।
–তা করবি কেন? অমন একটা জাঁদরেল লোকের পায়ের ধুলো পড়বে তোর বাড়িতে–অমন কপাল করেছিস নাকি তুই? পালাজ্বরে ভুগিস আর শিঙিমাছের ঝোল খাস–কুট্টিমামার মর্ম তুই কী বুঝবি র্যা? জানিস, কুট্টিমামার জন্যেই ভালুকার ওই অবস্থা।
এবারে চিন্তিত হলাম।
–তা তোমার কুট্টিমামার এসব বদ-খেয়াল হল কেন? কেন ভালুকের নাক কামিয়ে দিতে গেল খামকা তার চাইতে নিজের মুখ কামালেই তো ঢের বেশি কাজ দিত।
–চুপ কর প্যালা, আর বাজে বকালে রদ্দা খাবি–টেনিদা সিংহনাদ করল। আর তাই শুনে ভালুকটা বিচ্ছিরি রকম মুখ করে আমাদের ভেংচে দিলে।
টেনিদা বললে, দেখলি তো? কুট্টিমামার নিন্দে শুনে ভালুকটা পর্যন্ত কেমন চটে গেল।
এবার আমার কৌতূহল ঘন হতে লাগল।
–তা ভালুকটার সঙ্গে তোমার কুট্টিমামার আলাপ হল কী করে?
–আরে সেইটেই তো গল্প। দারুণ ইন্টারেস্টিং! হুঁ হুঁ বাবা, এ-সব গল্প এমনি শোনা যায় কিছু রেস্ত খরচ করতে হয়। গল্প শুনতে চাস–আইসক্রিম খাওয়া।
অগত্যা কিনতেই হল আইসক্রিম।
চিড়িয়াখানার যেদিকটায় অ্যাটলাসের মূর্তিটা রয়েছে, সেদিকে বেশ একটা ফাঁকা জায়গা দেখে আমরা এসে বসলাম। তারপর সারসগুলোর দিকে তাকিয়ে আইসক্রিম খেতে-খেতে শুরু করলাম টেনিদা :
আমার মামার নাম গজগোবিন্দ হালদার। শুনেই তো বুঝতে পারছিস ক্যায়সা লোক একখানা। খুব তাগড়া জোয়ান ভেবেছিস বুঝি? ইয়া ইয়া ছাতি–অ্যায়সা হাতের গুলি? উঁহু, মোটেই নয়। মামা একেবারে প্যাঁকাটির মতো রোগা–দেখলে মনে হয় হাওয়ায় উল্টে পড়ে যাবে। তার ওপর প্রায় ছ’হাত লম্বা মাথায় কোঁকড়া কোঁকড়া চুল দূর থেকে ভুল হয় বুঝি একটা তালগাছ হেঁটে আসছে। আর রং! তিন পোঁচ আলকাতরা মাখলেও অমন খোলতাই হয় না। আর গলার আওয়াজ শুনলে মনে করবি-ডজনখানেক নেংটি ইঁদুর ফাঁদে পড়ে চি-চি করছে সেখানে।